চিকিৎসা কি শুধুই একটি পেশা, নাকি মহান ব্রত?



খাদ্যে ভেজাল, নগর জীবনের শত দূষণ ও শত অনিয়ম প্রতিকূলতা থেকেই হয়তো ইদানিং মানুষের শরীরে নানান রকম সব নতুন নতুন রোগশোকের উদ্ভব হচ্ছে এবং শারীরিক মানসিক অসুবিধা শতগুণ বেড়ে যাচ্ছে; শরীরে অস্বাভাবিক গ্যাস আটকে অনেকের জীবনে মারাত্মক বিপদ নেমে আসছে। ভেজাল খাদ্যের বিষ পাকস্থলিতে জমে তা গ্যাস উৎপন্ন করছে, পরবর্তিতে সেসবে হৃদপিন্ড চেপে ধরছে এবং হটাৎ ষ্টোক করে কেউ না কেউ মারাও যাচ্ছে; কয়দিন ধরে এমন সব মৃত্যুর দুঃসংবাদই বেশি পাচ্ছি। আমার পেটেও এই একই রকম ভয়ানক ভয়াবহ এক ধরনের পাজি গ্যাস উৎপন্ন হয়েছিল, যা কয়দিন আগে বেশ ভাল করেই টের পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, পুরো শরীরটা একটা গ্যাস চ্যাম্বারে পরিণত হয়েছে, যে কোন সযয় ফেটে যাবে; না পারতাম শুইতে, না পারতাম বইতে। অগত্যা ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হলো। 

এক ছোটভাই ডায়াগনস্টিক ও ডক্টরস্ চেম্বারের ব্যবসা করে, তার কাছে বলতেই সে আমাকে একটা ট্যাবলেট খেতে বললো; তৎক্ষনাত তা খেয়ে বেশ আরামও পেলাম। কিছুটা সুস্থ্য হতেই বিকেলে তার কাছে তার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ছুটলাম। নামিদামি সব বড় বড় ডাক্তার বসেন তার সেন্টারে। সব শুনে ভেবেচিন্তে ছোটভাই যে ডাক্তারের কাছে পাঠালো তিনি এদেশের একটি বিখ্যাত মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের স্বনামধন্য একজন প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান। 
তাঁকে সব খুলে বললাম, আমার পেটে প্রচুর গ্যাস, মাঝেমধ্যেই মনে হয় তা যেন সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পরছে; বিশেষকরে পায়ে ও পিঠে। যখন গ্যাস শরীরে ছড়ায় তখন কোমড়ের পিছন সাইট ও রান প্রচন্ড ব্যথা করতে থাকে। 

কিছুটা শুনে, পেটেপিঠে দু-একটা টিপটাপ দিয়ে ডাক্তার সাহেব প্রেসকিপশনে লম্বা একগাদা টেস্ট লিখে দিয়ে বললেল, 'এইসব করিয়ে আসুন।' তখন খেয়াল করিনি - প্রেসকিপশনে তিনি কোন ঔষধের নামই লেখেননি। সারা পৃষ্টা জুড়ে শুধু টেস্ট আর টেস্টের নাম তুলে দিয়েছেন। সেসবের মাঝে এমন একটা টেস্ট দিলেন যা তাঁর মনোনীত জায়গা থেকেই করাতে হবে; কোলনোস্কপি করতে বললেন তাঁর নিজেস্ব ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে - যা আমা হতে বেশ দূরে এবং তাঁর মেনশন করা নির্দিষ্ট ডাক্তার দিয়েই করাতে বললেন।

যাই হউক, ডক্টরস ভিজিট দিয়ে ভাইয়ের ক্লিনিকে অন্যসব টেস্টগুলো করতে দিলাম এবং দূরে হলেও গাড়ি টান দিয়ে কোলনোস্কপি করতে ডাক্তার মনোনীত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গেলাম। গিয়ে দেখি তা অতোটা উন্নত নয়; সেখানকার পরিবেশ দেখে আমার মোটেও পছন্দ হলো না। তাও, যেয়ে যা দেখলাম জানলাম শুনলাম তাতে ঐ প্রফেসরের প্রতি আমার শ্রদ্ধাভক্তির পুরোটাই উবে গেল। শালার নটি প্রফেসর! মনে হলো, ঐ বেটা অযথা সব টেস্টফেস্ট দিয়ে শুধু শুধুই রোগিদের হয়রানি করেন। এত বড় শিক্ষিত ও বয়স্ক মানুষ(!) হয়েও কেন যে তাঁরা এইসব করেন, কিছুতেই বোধগম্য হলো না।

অবশ্য এরই মাঝে স্ত্রী-কে নিয়ে অন্য একজন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। স্ত্রী-র ডাক্তার তাঁর ডক্টরস ডাইগনসিস ও প্রেসকিপশন শেষে আমার শারীরিক সাময়িক অসুবিধার কথা শুনে একই প্রেসকিপশনের উল্টো পৃষ্টায় দু'টো ঔষধের নাম লিখে পনেরদিন নিয়মিত খেতে বললেন (ডাক্তার সাহেব দীর্ঘ দশ বছর ধরে আমার স্ত্রী-র নিয়মিত চিকিৎসা করছেন)। ঐ ডাক্তারের দেয়া ঐসব টেস্টফেস্টের কথা আমি আর তাঁর কাছে তুলিওনি, তিনিও কিছু করাতে বলেননি। তাঁর সাজেশন মতো ঐ দু'টো ঔষধ খেতে শুরু করলাম। আল্লাহর অশেষ রহমত ও মেহেরবাণী - এখন অনেকটা সুস্থ্যবোধ করছি; সেই সমস্যা আর আপাততঃ নেই। ঐ নটি প্রফেসরের কাছেও আর যাওয়া হয়নি।

খুব বেশি দুঃখ লেগেছিল তখন, যখন দেখেছিলাম নটি প্রফেসর আমার প্রেসকিপশনে একটা ঔষধের নামও লেখননি! কমপক্ষে একটা এন্টাসিড প্লাস তো তিনি তৎক্ষনাত আমাকে দিতে পারতেন? তাও শান্তনা থাকতো - প্রফেসর সাব তার অতসব বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে অন্ততঃ রোগির ব্যথার মুখে একটা ঔষধ দিয়েছেন। তাছাড়া আমার কাছ থেকে নেয়া তার নেয়া ফি-টার দাবিও নিঃশর্ত ছেড়ে দিতাম; তাতে তার জন্য ফি-এর টাকাটাও নিদেন পক্ষে হালাল হয়ে যেতো। ভাবি - এইভাবে অনাচার করে এতোসব সম্পদ কামিয়ে জমিয়ে কবরে গিয়ে কি লাভ হবে? না কি, এরা সারাজীবন বেঁচে থাকবেন, কখনো কবরে যাবেন না? এমন সম্পদ দুনিয়াতে ছেলেমেয়ের জন্য রেখে গেলেই-বা লাভ কি? তাছাড়া, টেষ্ট করে যান্ত্রিক ডায়াগনসিস হলে ডাক্তারের এতসব পড়ালেখারই-বা কৃতিত্ব কি, মূল্যটাই-বা কি?  

প্রিয় চিকিৎসক ভাই-বোনেরা, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের সাথে তুলনা করে আপনারা হয়তো ধারণা করতে পারেন আপনারা খুব অল্প খরচেই একটা ডিগ্রি পেয়েছেন, সেটি কিন্তু সত্যি নয়। আপনাদের লেখাপড়ার জন্যে অনেক টাকা খরচ হয়েছে, আপনারা সেটি টের পাননি; কারণ আপনাদের পেছনে এই খরচটুকু করেছে সরকার। সরকার এই অর্থটুকো পেয়েছে এই দেশের চাষিদের কাছ থেকে, শ্রমিকদের কাছ থেকে, কামার, কুমার, দর্জি সকল শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষদের কাছ থেকে। আমি আজ আপনাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এই দেশের অনেক দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ হয়তো তার নিজের সন্তানকে স্কুল কলেজ শেষ করে মেডিকেল কলেজে পাঠাতে পারেনি, কিন্তু তার হাড়ভাঙা খাটুনির অর্থ দিয়ে দেশের ২৯টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আপনাদের লেখাপড়া করিয়েছে। এখন আপনারাই  ঠিক করুন এই শিক্ষা দিয়ে আপনি কার জন্যে কী করবেন। অবশ্যই আপনি আপনার স্বাচ্ছন্দ্য কর্মজীবন গড়ে তুলেছেন, কিন্তু তার পাশাপাশি যাদের অর্থে আপনি লেখাপড়া শিখেছেন, সেই দরিদ্র মানুষের ঋণ আপনাদের কি শোধ করতে হবে না?

তবে, ডাক্তার মানেই ডাকাত নয় - সব ডাক্তারও খারাপ নয়। এদেশের অতি সাধারণ মানুষের মাঝে জনশ্রুত কিছু বাজে উদাহরন অবশ্য থাকতেই পারে। সব জায়গায় সব পেশায়ই এমন ভাল মন্দ আছে থাকবেও, আর থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই বলে ঢালাওভাবে সকল ডাক্তারকে দোষারোপ করা মোটেও ঠিক নয়। এদেশে এখনো এমন অনেক সৎ ও ভাল ডাক্তারও আছেন; এইসব সৎ, বুদ্ধিমান ও নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তাররাই আমাদের এই ছোট্ট ভূখন্ডের বিশাল জনগোষ্টির  চিকিৎসা সেবা সূচারুভাবে এবং অনায়াসে সম্পন্ন করে যাচ্ছেন। পৃথিবীতে এখনো এমন অনেক দেশ আছে যেসব দেশে অন্য দেশ থেকে ডাক্তার আমদানি করতে হয় এবং তা করেই সেদেশের সরকারকে চিকিৎসা সেবা সামলাতে হয়। 

মহৎ এই সেবামূলক পেশাটার বদনাম হয়তো ঐ রকম নটি প্রফেসররাই করছেন। তাদের মতো অতি অর্থলোভি লোকগুলোই আজ এদেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রের উচ্চ পদে অসীন হয়ে বসে আছেন, এবং তারাই সেবাকে ব্যবসা বানিয়েছেন। অসহায় যেসব রোগি চিকিৎসার জন্য তাদের কাছে আসেন তারা সবাই এইসব বাজে ডাক্তারের লালসার শিকার হন; টেস্টের নামে অযথা হয়রানি এবং প্রতারিত হন। আমার বিশ্বাস, অসহায় কাতর রোগিদের অভিশাপ এইসব রোগিখেঁকো ধোঁকাবাজ ডাক্তারদের গায়ে লাগবেই লাগবে। সত্যমিথ্যা ডিগ্রীর পান্ডুলিপি সাজিয়ে টোপ ফেলে এদেশের অতি সাধারণ অসহায় গরিব মানুষকে যারা জিম্মি করে ঠকাচ্ছেন, টেস্টের নামে হয়রানি ও নানাবিধ প্রতারণা করে টাকা কামাচ্ছেন, নিশ্চয় তারা কোন দিনও কোনখানে ভাল থাকতে পারবেন না, পারেন না; এবং ব্যক্তিজীবনেও কখনো তারা সুখি হতে পারেন না। এমন অনেক মানুষকেই আমি চিনি ও জানি যারা পারিবারিক জীবনে খুবই অসুখি এবং বার্ধক্যে এসে সাহায্যহীন ও প্রচন্ড অসহায় হয়ে পরেছেন।

অবশ্য, সব পেশায়ই আজকাল বানিজ্যিকিকরণের হাওয়া লেগেছে এবং সমাজে অতি মুনাফাখোরের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে; সেবা বা পূণ্য মানসিকতায় এখন আর এদেশে অনেকেই কিছু করতে চায় না বা করেন না। কি চিকিৎসা, কি অন্য কোন সেবা বা ব্যবসা বানিজ্য; সবখানেই আজ অনিয়ম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, উকিল, ব্যরিস্টার, জজসাব, শিক্ষক, শ্রমজীবী, পেশাজীবী, দোকনদার, হকার, ভিক্ষুক সবার মাঝেই দেখা যায় কিছু লোক এখন প্রচন্ড এগ্রেসিভ বানিজ্যিক মানসিকতা সম্পন্ন, যারা শুধু টাকা কামানোর ধান্ধা করে; যা আমাদের কৃষ্টি কালচারের সাথে মোটেও যায় না। আমি মনে করি - কর্মের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রতিটা মানুষ আন্তরিকতার সাথে সাধ্যমত প্রচেষ্টা করলে তার শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন সে পাবেই পাবে; জীবনে চলার পথও মসৃণ হবে। শুধুমাত্র অর্থপ্রাচুর্য দিয়ে কখনো সুখ কেনা যায় না।

এমন দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? এমন কেন হলো? দেশসেবকরা এখন দেশ সেবার নামে নেমেছে ভন্ডমিতে, জণগন সব সেজেছে নির্বোধ! রক্ষক এখন ভক্ষক হয়েছে; রাজনীতিবীদরা রাজনীতির নামে করছেন ঠকবাজী, বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধিবৃত্তির নামে করছেন দলবাজী, পেশাজীবীরা ঐক্কের নামে দেশবাসিকে করছেন জিম্মি, শ্রমজীবীরা দাবী-দাওয়ার নামে করছেন তাল-বাহানা, আইনজীবীরা স্বার্থের জন্য করছেন মারামারি, শিক্ষকরা হচ্ছেন অনৈতিকতার দর্পণ, ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন অতিব মুনাফাখোর, ভিক্ষুকরাও ধরেছেন ছদ্দবেশ, মিডিয়া করছে স্টান্টবাজি! কোথায় যাবো? কার সাথে কি করবো? কার কাছে কি বলবো? 

ভিক্ষুকরাও আজকাল বানিজ্যিক হিসাব মিলিয়ে চলে; দু টাকা দিলে আড়চোখে তাকায়! কেউ দশজন মিসকিন খাওয়াতে ইচ্ছে করলে তা সম্ভব হয় না; তাদের পাওয়া গেলেও শুধুমাত্র খাওয়ার জন্য তারা আসে না, সাথে টাকা দিতে হবে। শহরাঞ্চলে দিনমজুর কিছুটা মিললেও গ্রামে ক্ষেতে কাজ করানোর জন্য কোন লোকই পাওয়া যায় না। আপনি স্বীকার করুন আর নাই-বা করুন, দেশ কিন্তু অনেক এগিয়েছে। কিছু রাজনৈতিক জটিলতা, কিছু তথাকথিত সুশীলের হীনমন্যতা-কূটচাল, বিচ্ছিন্ন কিছু সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নানাবিধ প্রতিকূলতা সত্তেও আমাদের জীবনযাত্রার মান কিন্তু ঠিকই বেড়েছে এবং দেশের উন্নতির ধাপ তরতর করে এগিয়েই যাচ্ছে। 

শত প্রতিকূলতা প্রতিবন্ধকতা সত্তেও দেশে উন্নয়ন অগ্রগতি কিন্তু থেমে নেই, ঠিকই চলছে; উত্তরোত্তর দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদেশের খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষ উন্নয়ণের চাকা ঠিকই ঘুরাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে - রাতারাতি সব কিছু পাল্টে যায় না যাবেও না, ইচ্ছে করলেও এমন কিছু হয় না হবেও না। এতো বিশাল জনগোষ্টির এই ছোট্ট ভূখন্ডটির কথা আমাদের সবারই প্রথমে ভাবতে হবে; এতো এতো মানুষের ভার বহন করা তার পক্ষে কতটা কঠিন?

চিকিৎসা কি শুধুই একটি পেশা, নাকি এটি একটি মহান ব্রত? দেশের স্বাস্থ্যখাত, বিশেষ করে বেসরকারি খাতে চিকিৎসা ব্যবস্থায় শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের এ সংক্রান্ত নতুন আইন - 'চিকিৎসা সেবা আইন-২০১৬' কেমন করে যেন ঝুলে গেল! এই আইনটির একটি খসড়া প্রকাশ করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কিন্তু সে পর্যন্তই। আইনটিতে বেশ কিছু ভালো দিকও ছিল, তবে কিছু বিষয়ে এখনো রয়ে গেছে অস্পষ্টতা। যাই হউক না কেন, চিকিৎসা ব্যবস্থায় পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবী।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন