প্রাণীকুলে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের বিবেক ও বিবেচনা, মানবতা ও মনুষ্যত্ব জ্ঞান বলে কিছু থাকে; তবে এই সব বিষয় সম্পূর্ণরূপে যার যার নিজস্ব চিন্তা চেতনা ধ্যান ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ; অন্তরমুলে যার রয়েছে মানবতা। পৃথিবীর শুরু থেকে সকল মহামানবগণ মানবতা বিকাশেই সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে গেছেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহাম্মদ মুস্তবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য বিশ্ব মানবতার চেতনায় সকল কল্পকথা, কুসংস্কার, সব ধরনের মিথ্যা, অপপ্রচার ও প্রতারণার সামনে শির না নোয়ানোর শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন। অজকের পৃথিবীতে আমরা কি করছি, কাকেই-বা অনুসরণ করছি?
মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দন্ড কার্যকর হয়ে যাওয়া এক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর সাথে ৯০-এর দশকে মসজিদে পাশাপাশি নামাজ আদায় করতে গিয়ে আমার পরিচয় ও সখ্যতা। কেউ যদি তখন আমাকে বলতেন, তিনি একজন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত অপরাধী বা কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী আমি হয়তো তা মোটেও বিশ্বাস করতে পারতাম না; ঘূণাক্ষরেও ভাবতে পারতাম না তিনি এমন জঘণ্য কিছু করতে পারেন। খুবই নম্র ভদ্র অমায়িক একজন ভাল মানুষ। যে মসজিদে তখন আমি নিয়মিত নামাজ আদায় করতাম সেটি তাঁরই দানে গড়া; নিচ তলায় সমাজকল্যাণ অফিস ও লাইব্রেরি, দোতলা তিনতলায় নামাজঘর।
লক্ষ্য করতাম আযানের অনেক আগেই তিনি এসে কোর'আন নিয়ে মসজিদে বসে থাকতেন। রমজান এলে তো কোন কথাই ছিল না, দীর্ঘ দিনের জন্য এতেকাফে বসে যেতেন। তাঁর জন্য ইমাম সাহেবের পিছনে একটা জায়নামাজ পাতাই থাকত। তখন আমি সাধারণতঃ প্রতিদিন ফজর ও এ'শায় বা ছুটির দিনে সব ওয়াক্তে সেই মসজিদে জামাতে শরীক হতাম; বেশিরভাগ সময় ফরজ শুরু হওয়ার আগে আগে মসজিদে ডুকতাম। তিনি হয়তো আমাকে লক্ষ্য রাখতেন, চোখে পড়লেই পিছন থেকে ডেকে পাশে নিয়ে যেতেন। পাশাপাশি এক সাথে নামাজ আদায় করতে করতে এক সময় তাঁর জন্য আমার হৃদয়ে একটা ভীষণ রকমের ভক্তিশ্রদ্ধার জায়গা হয়ে উঠে। অবশ্য সেসময় এত কিছু চিন্তা করার মতো আমার সময় ও সুযোগ ছিল না, নামাজ আদায় করেই দুনিয়া চষে বেড়াতে হতো। মসজিদে আলাপচারিতার খুব একটা সময় বা সুযোগ করে উঠতে পারতাম না। তাছাড়া মসজিদে ডুকলে নামাজ ছাড়া ব্যক্তিগত কথাবার্তায় আমি কোন দিনই অভ্যস্ত ছিলাম না, এখনো নই।
যখন তারাবি আদায় করতাম তখন তারাবি শেষে আমাদের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা হতো, তাও কোর'আন হাদিস নিয়ে; ব্যক্তিগত কিছু তিনিও আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করতেন না, আমিও কখনো কিছু তাঁকে বলেছি বলে মনে পরে না। এতেকাফের সময় খেয়াল করলাম তিনি জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর কোর'আন তাফসির পড়ছেন বা জামাতে ইসলামী-র বই নিয়ে বসে আছেন। সেই থেকেই কেন যেন আমার মস্তিস্কে খটকা লাগে; কারণ মওদুদী সাবের তাফসির 'তাফহীমুল কুরআন' (ইসলামী স্কলারদের মতে একটি বিকৃত তাফসির) আমি পড়েছি; যা আমার কাছে মোটেও ভাল ঠেকে নি। পরে যখন পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছিলাম দীর্ঘ দিন ধরে যার সাথে আমি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ আদায় করেছি তিনি একজন কুখ্যাত মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী; কি কষ্টটাই যে সেদিন আমি পেয়েছিলাম তা আজ আর ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
৮০-র দশকে শীতকালে গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের এলাকায় প্রচুর ওয়াজ মাহফিল হতো; বিশেষ করে কালিগঞ্জের অনতিদূরে শীতলক্ষ্যার ওপাড়ে ডাঙ্গা'র সেই বিখ্যাত তাফসিরুল কোর'আন মাহফিলের কথা মনে হয় অত্রদা অঞ্চলের মানুষ এখনও ভুলতে পারেন নি। প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হওয়া ডাঙ্গা'র সেই বিখ্যাত ইসলামিক জলসায় তাফসিরুল কোর'আন মাহফিলের প্রধান বক্তা থাকতেন মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। দু দিন বা তিন দিন চলতো সেই তাফসির মাহফিল। আমাদের অঞ্চলের এমন কেউ তখন ছিলেন না যিনি সাঈদী সাবের ওয়াজ একবার হলেও শোনেন নি।
আমার এক মামা সাঈদী সাবের প্রচন্ড ভক্ত ছিলেন, এবং সেসময়ে তাঁর খুব কাছের মানুষও ছিলেন। সাঈদী সাব যেদিন তাফসিরে থাকতেন মামা সেদিন আমাদেরকেও উদ্ভূদ্ধ করে মাহফিলে নিয়ে যেতে চাইতেন। তার কাছে তখন সাঈদী সাবের অনেক গল্প শুনতাম; ১০টা মটর সাইকেল সামনে ১০টা মটর সাইকেল পিছনে সাঈদী সাবের গাড়ি মাঝখানে রেখে গার্ড দিয়ে তাঁকে কোন ইসলামিক জলসায় আনানেয়া করা হতো। আমিও তখন লাল রঙের একটা এইচ১০০এস চালাতাম। তাই সাঈদী সাব'কে ঢাকা থেকে ডাঙ্গা নিয়ে যেতে এসে মামা আমাকেও অনুরোধ করতেন, যেন গার্ড রেজিমেন্টের সাথে যাই। কিন্তু কেন যেন কিছুতেই মন সায় দিত না, তাই তেমন ভাবে যাইও নি কোন দিন। তাছাড়া ঐসব আমি মন থেকে কখনো মেনে নিতে পারতাম না। ভাবতাম, একজন ধার্মিক আলেমের এতো গার্ডফার্ট পাইকপেয়াদা লাগবে কেন?
কেন যেন সেই সময়ই সাঈদী সাব নামের লোকটাকে আমার তেমন সুবিধের মনে হতো না। তারপরও মামার অনুরোধে দু চার বার মাঠে বসে সাঈদী সাবের কোর'আন তাফসির শুনেছি, মঞ্চে উঠে তাঁর সাথে হ্যান্ডশেক কোলাকুলি করারও সুযোগ পেয়েছি।
সাঈদী সাব যখন ওয়াজ করতে মঞ্চে উঠতেন দেখতাম একদল তরুণ যুবক পাইকপেয়াদা সবসময় তাঁর সাথে থাকছে; তারাই - 'নারায়ে তাকবির - আল্লাহ্ হু আকবার!' বলে তাঁকে মঞ্চে নিয়ে আসছে এবং পেন্ডেলে তাদের সে কি তর্জন গর্জন! আমার স্পষ্ট মনে আছে, শীতের সেইসব রাতে পাতলা একটা চাদর মুড়ি দিয়ে খোলা মাঠে গভীর রাত পর্যন্ত আমরা তাঁর ওয়াজ শুনতাম, ফজরের নামাজ আদায় করে খুব ভোরে আবার দলবলে বাড়ির দিকে রওনা দিতাম।
সেসব সময়ে মামার সাথে বসে সাঈদী সাবের অনেক ওয়াজের ক্যাসেটও শুনেছি; আস্তে আস্তে এক সময় তাঁর শ্রুতিমধুর কোর'আন তেলওয়াত ও সুর করা ওয়াজের একজন ভক্ত হতে শুরু করলাম। কিন্তু হটাৎ একদিন কেন যেন মনে হতে লাগল দেশের যুবক শ্রেণীকে উদ্ভুদ্ধ করে খেপানোর জন্যই হয়তো প্রায় প্রতিটি ওয়াজে তিনি জিহাদ নিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন। পরে আস্তে আস্তে যখন জানতে পারি তিনি একজন স্বাধীনতা বিরোধী ও জামাতে ইসলামীর প্রচারক, সবসময় তাঁর সাথে থাকা ছেলেপেলে শিবিরের কর্মী, তখন থেকেই তাঁকে আর ভালভাবে নিতে পারি নি।
৯০ দশকের মাঝামাঝি বনানীতে এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে একদিন দেখি ছেলেসহ সাঈদী সাব বন্ধুর ওখানে ওর সাথে বসে কথা বলছেন। আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যানুযায়ী সম্মানপূর্বক সালাম দিয়ে রুম থেকে তখনই বের হয়ে আসতে চাইতে বন্ধু বলল, "অসুবিধা নেই, তুই বয়, সাঈদী সাব এখনই চলে যাবেন।" বসলাম সত্য, কিন্তু সাঈদী সাবের উঠার কোন লক্ষণই দেখতে পেলাম না। বন্ধু জানতো আমি সাঈদী সাব'কে মোটেও ভাল চোখে দেখি না; ওদের সামনে চুপচাপ বসে থেকে কেমন যেন ইতস্তত করছিলাম। বন্ধু বুঝতে পেরে এরই মাঝে বলে উঠল, "প্লিজ! আপনারা আসতে পারেন, আমি আপনাদের জন্য কোন উপকারই করতে পারবো না।" ছেলে তৎক্ষণাৎ রুম থেকে বের হয়ে গেলেন, কিন্তু সাইদী সাব বসেই আছেন, তাঁর নিজের কথা বলেই যাচ্ছেন। লোকটা যে আসলেই একজন বেহায়া লাজলজ্জাহীন সেদিনের কিছুক্ষণের ঘটনাপ্রবাহ দেখেই তা বেশ ভাল করে বুঝে গিয়েছিলাম। পরে বন্ধুর কাছে জানতে পারি তিনি এসেছিলেন তাঁর লেখা বই'য়ের ইংরেজী অনুবাদ করাতে, কিন্তু বন্ধু কিছুতেই রাজি হয় নি।
সাঈদী সাবের মামলার রিভিউ শুনানির বাকী আর মাত্র এক মাস। হটাৎ আজ কেন যেন অতীতের সেইসব ঘটনাগুলো মানসপটে ভেসে উঠেছে। তাছাড়া কয়দিন ধরে লক্ষ্য করছি সাঈদী সাবের 'বাপ কা বেটা' তৃতীয় পুত্রধন মাসুদ সাঈদী তার ফেসবুক স্টেটাসে ও কথাবার্তায় একটু অন্য রকম প্রচারণা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে আবার তাকে চাঁন্দে পাঠানোর সেই দল সেই একই কূচক্রীমহল আস্তে আস্তে দেশবিদেশে সোচ্চার হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তারা হয়তো এখনও মোটেও বুঝতে পারছে না - পাপ বাপ-কেও ছাড়ে না, সাঈদী সাব তো নস্যি!
এখনো সময় আছে, আল্লাহ সুবানাহু তা'আলাকে আপনারা ভয় করুন। মিথ্যে বুঝিয়ে আজকের প্রজন্মকে আর বিভ্রান্ত করবেন না; ইসলামের দোহাই দিয়ে বেবুঝ ছেলেপেলেকে আর জঙ্গি বানাবেন না। সাঈদী সাব বা আপনারা যে কত ধূর্ত কূটকৌশলী তা হয়তো আজকের এই প্রজন্ম জানে না বুঝতে পারে না, কিন্তু আমরা যারা কালের স্বাক্ষী হয়ে এখনো বেঁচে আছি তারা আপনাদের ঠিকই চিনি ও জানি এবং বুঝি আপনারা কি চিজ?
আরেক গ্রুপ দেখছি এরই মাঝে আবারও নতুনভাবে প্রচারপ্রচাণা চালাতে শুরু করেছে ৭১-এ দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বয়স কম ছিল; আমি তো বলি তিনি তখন নাবালক ছিলেন, বিশ্বাস হয় না?
যারা এসব কথা বলেন বা বিশ্বাস করেন এবং মিডিয়ায় এসব এখনো প্রচার করেন তারা হয়তো আহাম্মক, নয়তো জামাতে ইসলামীর কর্মী বা সুবিধাভোগি; সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে এসব এক ধরনের কূটচাল কূটকৌশল।
তাঁর বড় ছেলের বয়স এখন কত? - বড় ছেলে রাফীর বিন সাঈদী ৪৭ বছর বয়সে ২০১২ সালে মারা গেছেন। তাছাড়া ১৯৬০ সালে সাঈদী সাব আলিম পাশ করেছেন। আলিম পাশের বয়স বা বড় ছেলের বয়স বিবেচনা করলেই তো সব কিছু মিলে যায়; এর জন্য তো আর কাউকে আকাশ বিজ্ঞানী হতে হয় না।
তারপরও রিভিউ শুনানির আগে আগে সাঈদী সাবের আসল চেহারাটা আজও আরেকবার আপনাদের সামনে তুলে ধরে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই; বিবেক বিবেচনা যার যার।
দেলোয়ার হোসেন সাঈদী হিসেবে আজ আমরা যাকে চিনি তাঁর দাখিল ও আলিম পরীক্ষার সার্টিফিকেটে নাম ছিল আবু নাঈম মোহাম্মদ দেলাওয়ার হুসাইন। সাঈদী খ্যাত এই নাঈম দাখিল পাশ করেন ১৯৫৭ সালে দারুল সুন্নাহ শর্ষীণা মাদ্রাসা থেকে এবং আলিম পাশ করেন ১৯৬০ সালে বরুইপাড়া মাদ্রাসা থেকে। ঐ সময় সাঈদী সাব তার জন্মতারিখ ব্যাবহার করেন ০১-০১-১৯৪৫; যার মানে - ১২ বছর বয়সে তিনি দাখিল পাশ করেন।
সাঈদী সাব দাখিল ও আলিম সার্টিফিকেটে উল্লেখিত নামটি পরিবর্তন করতে উদ্যোগী হন ২০০৮ সালের ৫ নভেম্বর; ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক দিন আগে। যা তিনি করান দাখিল পাশ করার প্রায় ৫১ বছর ও আলিম পাশ করার ৪৮ বছর পর। এফিডেভিট করিয়ে তাঁর নাম রাখেন 'দেলোয়ার হোসেইন সাঈদী'।
বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন সংক্রান্ত আইনে আছে - সার্টিফিকেটে নামে ভুল থাকলে সেই ভুল সংশোধন করতে হয় পাশ করার ২ বছরের মধ্যে, কিন্তু সাঈদী সাব কিভাবে ৫১ বছর পর তাঁর নাম পরিবর্তন করালেন এবং কি ভাবে? এইসব প্রশ্নের উত্তর কোনোভাবেই দিতে পারেন নি তৎকালীন নাম ও বয়স সংশোধন সংক্রান্ত কমিটির সদস্য সাবেক মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ (অবসরপ্রাপ্ত), মাদ্রাসা বোর্ডের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক হাফিজুর রহমান (অবসরপ্রাপ্ত), সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও তৎকালীন চেয়ারম্যান মোঃ আবদুর নূর এবং মাদ্রাসা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবু ছালেহ আহমেদ। তবে জানা গিয়েছিল মোহাম্মদ আব্দুর নূর ২০০৩ সালে সাঈদী সাবের সুপারিশেই পদোন্নতি পেয়েছিলেন।
সাঈদী সাব যখন তাঁর নাম পরিবর্তন করান তখন দৈনিক সংগ্রামে যে এফিডেভিট বিজ্ঞাপনটি দিয়েছিলেন সেটি লক্ষ্য করলেই আসল ঘটনা সবাই বুঝে যাবেন। তাই সেই এফিডেভিট'টিই হুবুহুব তুলে ধরছি -
"আমি দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদী জন্ম তাং ০১-০১-১৯৪৫ ইং পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী বাড়ি নং ৯১৪ শহীদবাগ ঢাকা। আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দা। আমি পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বর্তমানে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডর অধীনে আলিম ও দাখিল পাস করি, দাখিল পাসের সন ১৯৫৭ ১ম বিভাগ রোল নং ৩৯২০ কেন্দ্র সারসিন । দাখিল পরীক্ষায় ভুলবশত: আমার নাম দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদীর পরিবর্তে আবু নাঈম মোহাম্মদ দেলাওয়ার হুসাইন লিপিবদ্ধ হয়েছে। আলিম পাসের সন ১৯৬০ সাল রোল নং ১৭৬০ কেন্দ্র খুলনা বিভাগ ৩য়। আলিম পরীক্ষায় ভুলবশত: আমার নাম দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদীর পরিবর্তে আবু নাঈম মোহাম্মদ দেলাওয়ার হুসাইন লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আমার শুদ্ধ ও সঠিক নাম হবে দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদী। এ ব্যাপারে আমি অদ্য ৫/১১/২০০৮ ইং নোটারী পাবলিক ঢাকা এর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে আমার নাম সংশোধনের বিষয়ে হলফ করলাম। দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদী, পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী, বাড়ি নং ৯১৪ শহীদবাগ, ঢাকা। - সংগ্রাম পি-৭২১২/০৮.
এই এফিডেভিট'টি সাঈদী সাব ২০০৮ সালের ৫ নভেম্বর করান এবং এর তিন দিন পর ৮ নভেম্বর ২০০৮ সালে তার বয়স পুনরায় পরিবর্তন করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগে আরো একটি এফিডেভিট জমা দেন।
সাঈদী সাবের সার্টিফিকেটে এতদিন লেখা ছিল, জন্ম ১৯৪৫ সাল এবং দাখিল পাশ করেন ১৯৫৭ সালে। কিন্তু তিনি হয়তো পরে বুঝতে পারেন এত অল্প বয়সে দাখিল পাশ করা যায় না, তাই তিনি তখন আবার তার বয়স পরিবর্তন করান। কিন্তু এখানেও তিনি দেশের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করেন।
বয়স সংক্রান্ত এফিডেভিটের ক্ষেত্রে আইন হলো - এফিডেভিট করতে হয় ব্যাক্তির মাকে কিংবা বাবাকে দিয়ে (যদি জীবিত থাকেন)। ২০০৮ সালে সাঈদী সাবের মা জীবিত থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজে স্বাক্ষর দিয়েই বয়স এফিডেভিট করিয়েছিলেন। তাছাড়া, ওখানে সাক্ষরের স্থানে তিনি লিখেছিলেন "দেলোয়ার হোসেন সাঈদী"।
মাত্র ২২ দিনের ব্যবধানে নির্বাচনী প্রত্যয়ন পত্রে স্বাক্ষর পরিবর্তন করে লিখেন "আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী"।
অর্থাৎ মাত্র ২২ দিনে তিনি 'দেলোয়ার হোসেন সাঈদী' থেকে 'আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী" হয়ে যেতে পেরেছিলেন। সার্টিফিকেটে জন্ম সাল ১৯৪৫ থাকলেও নির্বাচনের সময় তা করে দিতে পেরেছিলেন ১৯৪০ সাল! সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা আলিম (সমমান ইন্টারমিডিয়েট) হলেও নামের আগে নির্দ্বিধায় বসিয়ে দিতে পেরেছিলেন 'আল্লামা'!
এইসব কি সাঈদী সাবের জন্য নতুন কিছু ছিল?
পিরোজপুর জিলার ইন্দুরকানী থানা, তথা বর্তমান জিয়ানগর উপজিলার বর্তমান 'সাঈদখালি' গ্রাম আগে পরিচিত ছিল 'সাউদখালি' নামে; অবশ্য এখনো অনেকেই এই গ্রামকে সেই আগের নামেই চেনেন ও জানেন। তবে কগজপত্রে সাউদখালি হয়ে গিয়েছিল 'সাঈদখালি'। আর নামের এই পরিবর্তন নিয়ে এলাকায় স্থানীয় মানুষের মাঝে বেশ মজার মজার গল্পও প্রচলিত আছে। গ্রামের নামে এই পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন সেই গ্রামেরই বিতর্কিত মানুষ(!) দেলোয়ার হোসেন সাঈদী! ক্ষমতার দাপটে 'সাউদখালি' গ্রামকে 'সাঈদী' নামের সাথে মিলিয়ে বানিয়ে দিয়েছিলেন 'সাঈদখালি'; যেমন করে ৭১-এর দেইল্যা রাজাকার বা দেলওয়ার শিকদার বা নাঈম মোহাম্মদ দেলাওয়ার হুসাইন থেকে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন 'আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী'।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পিরোজপুর জেলা ইউনিট কমান্ড ঐ জেলার রাজাকার বা স্বাধীনতা বিরোধীদের যে তালিকা আদালতে জমা দিয়েছেন তাতে মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর নাম ছিল না। ঐ তালিকার ৪৬ নং ক্রমিকে পরিষ্কার উল্লেখ আছে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারের নাম 'দেলোয়ার সিকদার'। এই দেলোয়ার সিকদার স্বাধীনতার পর গণরোষে গণপিটুনিতে মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু তার লাশ কখনো কোথাও পাওয়া যায় নি।
দেলোয়ার সিকদার আর দেলোয়ার হোসেন সাঈদী এক ব্যক্তি নয় (!), রাজাকার দেলোয়ার সিকদারের কৃত অপরাধের দন্ড ভোগ করছেন বিশ্ববিখ্যাত এক আলেম(!), ইত্যাদি ইত্যাদি কতসব যুক্তিতর্ক আমাদের সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কিছুটা বিবেক খাটালেই-তো বুঝা যায় প্রকৃত ঘটনা কি?
বালিয়াপাড়া ইউনিয়নের সাউদখালি গ্রামে অতি সাধারণ এক কৃষক পরিবারে ৪০-এর দশকে অনেক ভাইবোনের মাঝে জন্ম নেন এই দেলোয়ার শিকদার। ৭১-এ অত্রদা অঞ্চলের সবাই যাকে কুখ্যাত দেইল্যা রাজাকার হিসেবে চিনত ও জানত, কালের বিবর্তনে ঘটনার পরিক্রমায় লুটপাটের সম্পদে সেই তিনিই সব ভোল পাল্টিয়ে এক সময় সেজে যান আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী; বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী আমির, জাতীয় সংসদ সদস্য আরো কত কি!
দেইল্যা রাজাকারের পরিচয় ও ফিরিস্তি তো এখন পুরানো খবর, পুরো দেশবাসীই এসবের কিছু না কিছু জানেন; কোর্ট থেকে অলরেডি প্রমাণ হয়ে গেছে যে, তিনি একজন কুখ্যাত মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি; হেন কোন অপকর্ম নেই যা তিনি তার এই ক্ষুদ্র জীবনে করে নি। শুধুমাত্র দেইল্যা রাজাকারের ৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের ফিরিস্তি লেখতে বাংলাদেশ নামের এই গরিব রাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে ৪০৭৪ পৃষ্ঠা। যে বিশটি অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল সেসবের মধ্যে আটটি অভিযোগে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং এর মধ্যে দুটি অপরাধে তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে আপিল শুনানিতে আমৃত্যু দন্ডাদেশ দেয়া হয়; এতে রাষ্ট্রপক্ষ খুশি হতে না পেরে রিভিউ চায়; সাঈদী সাবের সেই রিভিউ শুনানির তারিখ আগামী ১৪ মে, ২০১৭।
দেইল্যা রাজাকার আর দেলোয়ার হোসেন সাঈদী একজন হউক বা ভিন্ন হউক, দেইল্যা রাজাকারের ফাঁসি হউক বা যাবজ্জীবন হউক, দেইল্যা রাজাকারের পুরো সাজা মওকুফ হউক বা ফাঁসি পুনঃবহাল হউক, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তবে, জানা কোন সত্য নিয়ে কেউ মিথ্যাচার করলে তা দেখে ও জেনে নিরবে বসে থাকার মানুষ আমি নই; এমনটা আমার ধাচে একেবারেই যায় না।
নিজেকে আড়াল করতে সাইদী সাবের এতসব কুকর্ম কুকৃত্তি জানার পরও এখনো যারা সুবক্তা নূরানী চেহারার অধিকারী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে একজন আলেমে দ্বীন ও মোফাসসিরে কুরআন হিসেবেই চিন্তা করছেন, অন্য কিছু ভাবতেও পারছেন না; তাঁদের জন্য বলছি - ইবলিস শয়তানও কিন্তু মস্ত বড় এক বুজুর্গ ।
মুখোসের অন্তরালে এইসব লোকগুলো একেকটা আস্ত জাহান্নামের কীট। এদের আসল চরিত্র কতটা জঘণ্য ও ভয়ঙ্কর, তাদের অপকর্মের পান্ডুলিপি কতটা বিশাল, তা আমাদের মত সাধারণ লোকদের কল্পনাকেও হার মানায়।
বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আমার আগের কিছু লেখা ও বর্তমান সমাজের খুটিনাটি বিষয় নিয়ে লেখা ধারাবাহিক ভাবে ফেসবুক বন্ধুদের জন্য প্রকাশ করবো বলে ভেবেছি। সাথে থাকুন, প্রকৃত সত্যকে জানুন; সাপোর্ট করুন এবং সত, সুন্দর, সুস্থ জীবন গঠন করুন।
সাইদী সাবের জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত:
১৯৭১-এ পিরোজপুরের পাড়েরহাট এলাকায় দেইল্যা রাজাকার হিসেবে পরিচিত দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী ১৯৪০ সালে ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুরের ইন্দুরকানী থানার বালিয়াপাড়া ইউনিয়নের সাউদখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি শর্ষিণা দারুল সুন্নাহ মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেন। আলিম পড়ার সময় তিনি জামায়াতে ইসলামী-র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন, এতে সেই মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে বারুইপাড়া সিদ্দিকীয়া সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৯৬০ সালে তিনি আলিম পাস করেন। এর পর তাঁর লেখাপড়া আর আগায় নি; বিশিষ্ট কোর'আন তাফসিরকারী বা আল্লামা হয়ে উঠার সঠিক কোন সনদপত্র আজও মেলেনি। অবশ্য, জামাতে ইসলামী-র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এমন অনেককে আমরা চিনি ও জানি, যারা বয়ানে পেঁয়াজডি (পিএইচডি), বাস্তবে ব-কলম। আসলে এসব হচ্ছে জামাতে ইসলামী-র রাজনীতির একটি বশীকরণ ট্রেনিং-এর ফল, যা আমরা এই দল করা একজন অতি সাধারণ মুদি দোকানী'র মাঝেও দেখতে পাই।
মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে সাঈদী সাব পিরোজপুরের পাড়েরহাট বন্দরের পাশে তার শ্বশুর বাড়িতে থাকতেন এবং পাড়েরহাট বাজারের রাস্তায় বসে লবণ, মরিচ ও অন্যান্য মুদি সদাই বিক্রি করতেন। ৭১-এর এপ্রিলে জামায়াতে ইসলামী-র আমির গোলাম আযম, মন্ত্রী এ কে এম ইউসুফ ও পিরোজপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ আফজালের নির্দেশনায় জামায়াত নেতা সেকান্দার শিকদার, দানেশ মোল্লা ও সাঈদী সাবসহ আরো কয়েকজনের সমন্বয়ে পাড়েরহাট শান্তি কমিটি গঠিত হয়। মে মাসের শুরুতে সাঈদী সাবের নেতৃত্বে স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী, মাদ্রাসা ছাত্র ও স্বাধীনতাবিরোধী অন্যান্য সংগঠনের সমন্বয়ে পাড়েরহাট রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এরপরই শুরু হয় তাদের তান্ডব।
৪ মে পিরোজপুরের মাছিমপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় ২০ জন এবং মাছিমপুর হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় ১৩ জনকে তারা হত্যা করে এবং সে সময় সেখানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
৫ মে সাঈদী সাব ও তার লোকজন কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ ও বিশিষ্ট পদার্থ বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের পিতা তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ, পিরোজপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাইদ মিজানুর রহমান ও আরেক সরকারি কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাককে হত্যা করে এবং তাঁদের লাশ বলেশ্বর নদীতে ফেলে দেয়।
৭ মে সাঈদী সাবের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ইন্দুরকানী থানার পাড়েরহাট বন্দর বাজারে ৩০ থেকে ৪০টি দোকান ও বাড়িতে লুটপাট করে; এর মধ্যে একটি দোকান থেকে সাঈদী সাব ২২ সের সোনা রূপা লুট করে নিয়ে আসে। আরো কত কি!
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতেই তিনি আত্মগোপনে চলে যান (প্রায় ১০ বছর তিনি আত্নগোপনে ছিলেন। সম্ভবতঃ সেই দশ বছর তিনি চাঁন্দে ছিলেন, তাঁর জীবনের ঐ ১০ বছরের কোন নির্ভরযোগ্য ইতিহাস কোথাও পাওয়া যায় নি) এবং দেইল্যা রাজাকার থেকে ভোল পাল্টিয়ে ৮০-র দশকে হটাৎ তিনি চাঁন্দ থেকে টাইটেল নিয়ে মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা মানুষের দেশ বাংলাদেশে আবির্ভূত হন।
আমাদের সমাজের অনেকে এখনো দেখি প্রশ্ন করেন - স্বাধীনতার এত বছর পর মানবতা বিরোধী অপরাধের এইসব বিচার করার কি আছে? - কেউ বলেন, এইসব বিচারের নামে ক্ষমতাসীন দল এক ধরনের প্রহসন করছে; আবার কেউ-বা বলেন, এসব তাদের রাজনৈতিক ষ্টান্ডবাজি। আমার তা মোটেও মনে হয় না। সময় যতই গড়াক না কেন, বেঁচে থাকা ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধীদের খুজে বের করে তাদের বিচারের সন্মুখীন করতে পারলে বা চিহ্নিত করে যেতে পারলে আমাদের ভবিষ্যত বংশধররাই এর উপকার পাবে এবং লাভবান হবে; এদেশে আর কেউ কোন দিনও জঘণ্য কোন অপকর্ম করার সাহস পাবে না এবং দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা সব সময় চেপে থাকবে। এইসব বিচারের সুফল শুধুমাত্র এককভাবে কোন দল পাবে না; এটা একটা জাতির আদর্শিক ভিত্তি, এক দিন পুরো জাতিই এর সুফল ভোগ করবে।
তাছাড়া, প্রকৃত মুসলিম হলে একজন মুসলমানকে মুসলিম হিসেবে অবশ্যই অন্তরে বিশ্বাস রাখতে হবে, আল্লাহ্ সুবানাহু তা'আলার হুকুম ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না এবং প্রত্যেক মানুষের কৃতকর্মের প্রতিফল তিনি যথাসময়েই দেন।
দীর্ঘ লেখা পড়তে পড়তে হয়তো এরই মাঝে বেশ বিরক্ত হয়ে উঠেছেন, কিন্তু কি যেন এক অদৃশ্য কারণে আজ আমার কলম থামতেই চাইছে না, আমি নিজেও তা বুঝতে পারছি না। হয়তো বিশ্বাসও করতে পারবেন না, এই সব স্বাধীনতা বিরোধীরা কতটা ভয়ঙ্কর ও কতটা সাংঘাতিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় হেন কোন অপকর্ম নেই যা তারা করেন নি এবং স্বাধীনতার পরেও তারা ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটিয়েছেন; সেইসব অপকর্ম ঢাকতে গিয়ে কত কুৎসিত পথেই-না তারা হেঁটেছেন; ঐসব মনে পড়লে আজও গা শিউরে উঠে।
বানিয়ে বানিয়ে রঙচঙ মেখে আমি কোন কিছু লেখতে পারি না। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে মুখোসের আড়ালে ঢেকে থাকা অমানুষগুলোর কুৎসিত চরিত্র নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে আমি চেষ্টা করি তাদের মস্তিষ্কের সুপ্ত বিবেক বিবেচনার কোষগুলো জাগ্রত করতে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লুটপাট করা সম্পদে সম্পদের পাহাড় গড়া অনেক মানুষই আজ আমাদের সমাজে বেশ পাকাপোক্ত আসন গেড়ে বসে আছেন; সমাজে তাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তিও কিন্তু কম না। দেশের অর্থনীতির অনেকটা জায়গা জুড়েই এখন তাদের অবস্থান। এমন কি তারা দখল করে নিয়েছেন এদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ; ভোগ করছেন অনেক অনেক সুবিধা। তারাই এখন এদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অপশক্তিতে পরিণত হয়েছেন। প্রকৃতভাবে তারা কিন্তু কোন দিনই এই দেশটাকে ভালোবাসতে পারে নি, মেনেও নিতে পারছে না এদেশের অগ্রগতি উন্নতি। ভোল পাল্টালেও সেইসব লুটেরা'রা এখনো এদেশের তরুণদের ধর্মের নামে বিপদগামী করেই যাচ্ছে, জঙ্গি বানাচ্ছে। আমি মনে করি দেশে আজকের যে জঙ্গি সন্ত্রাস তা তাদেরই ছকে গড়া।
এদেশের স্বঘোষিত 'প্রিন্স মুসা বিন শমসের'কে নাকি তাঁর এলাকার বর্তমান মানুষ চেনেন-ই না। তাই বলে কি সব কিছু থেমে থাকবে?
আমরা যাকে চমক সৃষ্টিকারী প্রিন্স মুসা হিসেবে চিনি ও জানি তার সার্টিফিকেটে নাম নাকি এডিএম মুসা; ফরিদপুর শহরের এক সাধারণ পরিবারে যার জন্ম। মুসা-বিন-শমসের কিংবা এডিএম মুসা, কোনো নামেই তার জন্মস্থান ফরিদপুরের মানুষ তাকে চেনে না। হটাৎ কেঁচো খুড়তে খুড়তে সাপ বেড়িয়ে এসেছে। ফরিদপুর শহরের সেই সাধারণ পরিবার থেকে আসা রহস্যময়ভাবে ধনকুবের হয়ে ওঠা লোকটি নাকি যুদ্ধাপরাধী; এলাকার মানুষ তাঁকে নাকি ‘নুলা মুসা’ নামে চিনে ও জানে। অবশ্য ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পরই বিভিন্ন মহল থেকে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় বিচারের দাবি উঠেছিল।
মুসার নেতৃত্বে নাকি ফরিদপুর সদর উপজেলার শিবরামপুরের বাবু বাড়ির ১৪-১৫ জনকে হত্যা এবং নগরকান্দা উপজেলার তালমা বাজারের রবী ত্রিবেদীর বাড়ির পেছনে কুণ্ডুবাড়ি থেকে ৮ মন স্বর্ণালঙ্কার লুট সহ আরো কত কি অপরাধের অভিযোগ উঠেছে।
কয়দিন আগে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে ২৮ পৃষ্ঠা অভিযোগের নথি তুলে দিয়েছে বাংলার দুই সাহসী সাংবাদিক।
একবার ভেবে দেখুন - আল্লাহ্ সুবাহানু তা'আলা কি না করতে পারেন?
আমি বিশ্বাস করি - প্রত্যেক মানুষ তার পাপপুণ্যের ফল দুনিয়াতেও ভোগ করেন, আখেরাতের অনন্ত হিসাব তো পরে-ই থাকে।
তাই বলছি, না জেনে না বুঝে নূরানী চেহারা লাল দাড়ি লম্বা টুপি বিশাল জুব্বা বা সোনার জুতা পা'য় সোনার থালে খায় দেখেই অতি আবেগে তৎক্ষণাৎ কাউকে সার্টিফাই বা সহযোগিতা করে বসবেন না; মুখোশের আড়ালে এসব তাদের ভন্ডামিও হতে পারে। মনে রাখবেন - মিথ্যার দশ পা - খরগোশগতিতে চলেও হেরে যায়, সত্যের এক পা - কচ্ছপগতিতে চললেও বিজয়ী হয়।
আল্লাহ্ সুবানাহু তা'আলাই মহাবিচারক, তিনিই সব কিছু দেখেন, জানেন এবং সবচেয়ে ভাল বুঝেন। তিনিই যাকে ইচ্ছা সম্মান দেন, যাকে যখন ইচ্ছা পদদুলিত করেন।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১৪ এপ্রিল, ২০১৭.
wfaroque@gmail.com
অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম। ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনOnek totho jante perechi
উত্তরমুছুন