বুধবার, ২৪ জুন, ২০২০

আকাশ ও মহাকাশ নিয়ে বিজ্ঞান ও পবিত্র কোর'আন:

আকাশ ও মহাকাশ নিয়ে পৃথিবীর মানুষের আগ্রহ  আর  উৎকন্ঠার কোন অন্ত নেই। আর সেই  আগ্রহ ও উৎকন্ঠা থেকেই যুগে যুগে এই দুনিয়ার মানুষ অনবরত গবেষণা করে গেছেন এবং  যাচ্ছেন;  সেইসব  গবেষণালব্ধ ফলের নির্যাসকে বলি বিজ্ঞান,  আর  যারা গবেষণা করেছেন বা করছেন তাদেরকে বলি বিজ্ঞানী। আমরা  একটু  গভীরভাবে   খেয়াল   করলেই বুঝতে  পারবো,  বিজ্ঞানীরা  প্রতিটি   জটিল জিনিসের  জাল  উন্মুক্ত করেছেন বা করছেন পবিত্র   কোল'আন   ও   হাদিস-এর  মৌলিক উৎস থেকেই।  জ্ঞান  আহরণে  প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তি মাত্রই প্রকৃতি নির্ভর,  আর এই প্রকৃতির স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তা কে? এমন কেউ কি আছেন, যিনি প্রকৃতি ছাড়া  সম্পূর্ণ শূন্য থেকে বা অন্য কোন   উৎস  থেকে   কোন   কিছু   আবিষ্কার করতে  পারেন   বা   পেরেছেন  বা  পারবেন?

অনেকেই  ভেবে  থাকেন  আকাশ ও মহাকাশ এক   ও   অভিন্ন;    প্রকৃতপক্ষে   আকাশ  ও মহাকাশ  দুটো  সম্পূর্ণ  ভিন্ন জিনিস। মহাশূণ্য অথবা  মহাকাশ  বলতে  সাধারণভাবে মাথার উপরকার   অনন্ত   আকাশ বুঝানো   হলেও বস্তুত   পৃথিবীর   বায়ুমণ্ডলসমৃদ্ধ আকাশকে পৃথিবীর   আকাশ   বলা   হয়।  তাই  পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে  মহাকাশ   হলো  পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের  বাইরের  অনন্ত    স্থান।   এ আকাশসীমায় অতি অল্প   ঘনত্বের   বস্তু বিদ্যমান;  অর্থাৎ  শূন্য   মহাশূন্য পুরোপুরি ফাঁকা   নয়।   প্রধানতঃ   অতি   অল্প পরিমাণ হাইড্রোজেন  প্লাজমা, তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ, চৌম্বক   ক্ষেত্র এবং নিউট্রিনো   এই   শূন্যে অবস্থান  করে।  তাত্ত্বিকভাবে, এতে  কৃষ্ণবস্তু এবং  কৃষ্ণশক্তি   বিদ্যমান।   মহাশূন্যে   এমন অনেক কিছু আছে যা মানুষ এখনও কল্পনাও করতে   পারেনি;   আর  কোন দিন পারবে কি না, তাও বলা অসম্ভব।

বিজ্ঞানের   একজন   শিক্ষক   হিসেবে  আমি অনেক  গভীরভাবে   চিন্তা   করে     দেখেছি, আজকের  আধুনিক বিজ্ঞানের  সকল আবিষ্কারই পবিত্র  কোর'আন  ও হাদিস-এর গবেষণালব্ধ ফল; বিজ্ঞানীরা  তাদের আবিষ্কারের মৌলিক প্রেরণা পেয়েছেন পবিত্র কোর'আন বা হাদিস থেকেই। বিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা ও অনেক সাধ্য-সাধনা করে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যামে আমাদের চাতুর্দিকের অদৃশ্য বায়ু স্তরকে সনাক্ত করেছেন এবং ধারণা দিয়েছেন, এই বায়ুমণ্ডলের বায়ুস্তর বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন রকম। আমাদের ভূ-পৃষ্ঠকে আবৃত করা এই বায়ুমণ্ডলকে বিজ্ঞান সাতটি স্তরে বিভক্ত করেছে; প্রতিটি স্তরেরই রয়েছে আলাদা নিজস্ব কিছু স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য। ফলে প্রতিটি স্তর সম্পূর্ণভাবে একেকটি আলাদা স্তরের মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের চারপার্শ্বের এই বায়ুমণ্ডলই পৃথিবীর বুকে জীবনকে সম্ভব সকল সুরক্ষার প্রাচীর গড়ে তুলেছে। এই বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরের যে কোন একটির অনুপস্থিতি পৃথিবীর বুকে থাকা জীবনকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে — আজকের বিজ্ঞান এমনটাই মন্তব্য করেছে। এখন ভেবে দেখুন, মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার কেমন ত্রুটিহীন সৃষ্টিশৈলী সকল ক্ষেত্রে দৃশ্যমান?

ভূপৃষ্ঠ থেকে ঊর্ধ্বে যে অদৃশ্য গ্যাসের আবরণ পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে তাকে বায়ুমণ্ডল বা Atmosphere বলে। বায়ুমণ্ডল বলতে পৃথিবীকে চারপাশে ঘিরে থাকা বিভিন্ন গ্যাস মিশ্রিত স্তরকে বুঝায়; যা পৃথিবী তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা ধরে রাখে। একে অবার আবহমণ্ডলও বলা হয়। বায়ুমণ্ডল চোখে দেখা যায় না,শুধু এর অস্তিত্ব আমরা অনুভব করতে পারি। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে এই বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর আবর্তনের সঙ্গে আবর্তিত হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে মোটামুটিভাবে প্রায় ১০,০০০ কিমি পর্যন্ত বায়ুমন্ডলের অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা হয়। মোটামুটিভাবে প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত অবস্থিত এই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে উপাদান ও রাসায়নিক গঠন অনুসারে মূলতঃ ২ টি স্তরে ভাগ করা যায়; যথা — (১) Homosphere বা সমমন্ডল, এবং (২) Heterosphere বা বিষমমন্ডল।

সমমন্ডল ও বিষমমন্ডলকে সর্বসাকুল্যে বিজ্ঞানীরা ৭ টি ভাগে বিভক্ত করেছেন; অর্থাৎ - উচ্চতা, উষ্ণতা ও বায়ুমন্ডলের উপাদানের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর উপরের চতুর্দিকের বায়ুমণ্ডলকে ভাগ করা স্তরের এই বিভক্তিগুলো মোটামুটিভাবে ৭ প্রকার — (১) ট্রোপোস্ফিয়ার, (২) স্ট্রাটোস্ফিয়ার, (৩) মেসোস্ফিয়ার, (৪) ওজোনোস্ফিয়ার, (৫) থার্মোস্ফিয়ার, (৬) আয়নোস্ফিয়ার, ও (৭) এক্সোস্ফিয়ার।

এখন দেখা যাক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই স্তরগুলো অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য —
১) ট্রপোস্ফিয়ার (Troposphere) বা আবহাওয়া স্তর :- ভু-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত হোমোস্ফিয়ারের প্রথম স্তরকে ট্রপোস্ফিয়ার (Troposphere) বলে; এটি সর্বনিম্ন বায়ুস্তর। বলতে গেলে এটি ভূপৃষ্টের লাগোয়া স্তর; যা আমরা অনুভব করি। এই স্তরের সাধারন উচ্চতা ৬ কিমি; বিষুব রেখার দিকে ১২ কিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারনতঃ বায়ুমণ্ডলীয় ব্যবস্থাদী তিন থেকে চার কিমি পর্যন্ত বিরাজমান থাকে; প্রায় ৭৫% বায়ুমণ্ডলীয় গ্যাস এই স্তরেই থাকে। 

২) স্ট্রাটোস্ফিয়ার [Stratosphere] বা শান্তমণ্ডল :- ট্রপোস্ফিয়ার-এর উপরের ১৮ থেকে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুস্তরকে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডল বলে। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে ধূলিকণা, মেঘ প্রভৃতি না থাকায় এখানে ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে না। স্ত্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে বায়ুপ্রবাহ, মেঘ, ঝড়, বৃষ্টি ও বজ্রপাত দেখা যায় না বলে দ্রুতগতিসম্পন্ন জেটবিমানগুলো ঝড়-বৃষ্টি এড়িয়ে চলার জন্য স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের মধ্য দিয়ে চলাচল করে। জেটবিমানগুলি সাধারণত এই স্তরের মধ্যে দিয়ে চলার সময়ে আকাশে সাদা দাগ রেখে যায়।

৩) মেসোস্ফিয়ার (Mesosphere) :- স্ট্রাটোস্ফিয়ারের উপরে ৫০ কিমি থেকে ৮০ কিমি পর্যন্ত হোমোস্ফিয়ারের তৃতীয় স্তরকে মেসোস্ফিয়ার (Mesosphere) বলে।

৪) ওজোনোস্ফিয়ার (Ozonosphere) :- মেসোস্ফিয়ারের উপরে ওজন গ্যাসের স্তরটিকে ওজোনোস্ফিয়ার বলা হয়। মেসোস্ফিয়ার থেকে ২০-৫০ কি.মি. উচ্চতার মধ্যে এ স্তরটি; এটি সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষাকারী স্তর। 

৫) থার্মোস্ফিয়ার (Thermosphere) :- মেসোপজের পর থেকে প্রায় ৫০০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত অবস্থিত হালকা বায়ূস্তরকে থার্মোস্ফিয়ার (Thermosphere) বলা হয়। থার্মোস্ফিয়ারের বিস্তার প্রায় ৯০-৫০০ কিমি। এর বৈশিষ্ট্যগুলি হলো - উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই স্তরের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকে। হালকা বায়ু দিয়ে গঠিত এই স্তরের ভর বায়ুমণ্ডলের মোট ভরের মাত্র ০.৫%। এই স্তরের নিম্নভাগে তড়িৎযুক্ত কণা বা আয়নের উপস্থিতি দেখা যায়। এখানে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, ওজোন প্রভৃতি গ্যাস আয়নিত অবস্থায় থাকে।

৬) আয়নোস্ফিয়ার(Ionosphere) :- এই স্তরের শেষ সীমানা প্রায় ৫০০ কিমি। 
এই স্তরের বায়ু আয়নিত অবস্থায় রয়েছে (এই বিরাট অঞ্চলটি বিদ্যুতযুক্ত অসংখ্য কণা অর্থাৎ, আয়ন ও ইলেকট্রনে পূর্ণ হয়ে আছে)। তড়িতযুক্ত কণা বা আয়নের উপস্থিতির জন্য এই স্তরকে আয়নোস্ফিয়ারও বলা হয় । অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের এই স্তরের দুটি নাম রয়েছে, যেমন- থার্মোস্ফিয়ার ও আয়নোস্ফিয়ার। তবে এই স্তরটি আয়োনোস্ফিয়ার নামেই বেশি পরিচিত। এখানে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, ওজোন প্রভৃতি গ্যাস আয়নিত অবস্থায় থাকে। তড়িতাহত অণুর চৌম্বক বিক্ষেপের ফলে সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলে এক রকম উজ্জ্বল আলোক বিচ্ছুরণ দেখা যায়, একে মেরুজ্যোতি বা মেরুপ্রভা বলে। ভূপৃষ্ঠের বেতার তরঙ্গগুলি আয়নোস্ফিয়ার ভেদ করে আর উপরে যেতে পারে না বলে এই স্তর থেকে বেতার তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে । তাই বিভিন্ন রেডিও স্টেশন থেকে প্রচারিত গান, বাজনা, নাটক, কবিতা, সংবাদ প্রভৃতি আমরা রেডিও মারফত বাড়ি বসে শুনতে পাই। এই স্তর থেকে রেডিও তরঙ্গ প্রতিফলিত হয় বলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নিতকরন সম্ভব হয়েছে; এটিকে ঝালর স্তরও বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এটি বায়ুস্তরের অলঙ্কার স্বরূপ। 

৭) এক্সোস্ফিয়ার (Exosphere) :- থার্মোস্ফিয়ারের উর্দ্ধে প্রায় ১৫০০ কিমি পর্যন্ত বায়ূস্তরকে এক্সোস্ফিয়ার (Exosphere) বলা হয়। এক্সোস্ফিয়ারের বিস্তার প্রায় ৫০০-১৫০০ কিমি। এর বৈশিষ্ট্যগুলো হলো - এই স্তরের বায়ু এত হালকা যে, এর অস্তিত্ব প্রায় বোঝাই যায় না। এই স্তরে হিলিয়াম ও হাইড্রোজেন গ্যাসের প্রাধান্য দেখা যায়। কৃত্রিম উপগ্রহ, স্পেস স্টেশন প্রভৃতি এই স্তরে অবস্থান করে। এই স্তরে উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়, তবে তা দ্রুত নয়। এই স্তরে গ্যাসের ঘণত্ব অত্যান্ত কম এবং আয়নিত অবস্থায় আছে। 

এই ভাবেই বিজ্ঞানীরা বায়ুমন্ডলের বায়ুস্তরকে সাতটি ভাগে বিভক্ত করেছেন, যার প্রতিটি স্তর অত্যান্ত সঠিকতার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে; মিলিত সমন্বয়তার মাধ্যমে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার কাজটি সার্বক্ষানিক অত্যান্ত সুনিপুন ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করে যাচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে বায়ুমণ্ডলে প্রাণহীন পরমানুগুলো নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে প্রাণময় পৃথিবীর জন্ গড়ে তুলছে সচেতন অস্তিত্ব; যা করছে মহান স্রষ্টার নির্দেশে।

বিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে বায়ুমণ্ডলের স্তরকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে সকলেই একমত হয়েছেন যে, এর স্তরভেদ প্রধানতঃ দুটি হলেও মূল স্তর সাতটি। আর এই তথ্যটির ধারণা আশ্চর্যজনকভাবে পবিত্র কোর'আন ও হাদিসের সাথে মিলেও যায়। সহীহ মুসলিম শরীফ-এর কিতাবুল ঈমান অধ্যায়ের মি'রাজ এবং নামায ফরয হবার বর্ণনায়, ৩০৮ নং হাদীসে উল্লেখ আছে — হযরত আনাস ইব্নে মালিক ইবনে সা’সাআ’হ (রাঃ) হতে বর্ণিত - রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে যেই রাতে আল্লাহ তা'আলা পরিভ্রমণে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই রাতের ঘটনা বর্ণনায় সাহাবীগণের সম্মুখে তিনি বলেছেন - যখন আমি কা’বা গৃহে উন্মুক্ত অংশ হাতিমে (উপনীত হলাম এবং তখনও আমি ভাঙ্গা ঘুমে ভারাক্রান্ত) ঊর্ধ্বমুখী শায়িত ছিলাম, হঠাৎ এক আগন্তুক ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ) আমার নিকট আসিলেন এবং আমাকে নিকটবর্তী/ জমজম কূপের সন্নিকটে নিয়ে আসলেন। 

অতঃপর আমার বক্ষে ঊধর্ব র্সীমা হইতে পেটের নিম্ন সীমা পর্যন্ত চিরিয়া ফেলিলেন এবং আমার হৃৎপিণ্ড বা কল্বটাকে বাহির করিলেন। অতঃপর একটি স্বর্ণপাত্র উপস্থিত করা হইল, যাহা ইমান (পরিপক্ব সত্যিকার জ্ঞানবর্ধক) বস্তুতে পরিপূর্ণ ছিল। আমার কল্বটাকে (জমজমের পানিতে) ধৌত করিয়া তাহার ভিতরে ঐ বস্তু ভরিয়া দেওয়া হইল এবং কল্বটাকে নির্ধারিত স্থানে রাখিয়া আমার বক্ষকে ঠিকঠাক করিয়া দেওয়া হইল। অতঃপর আমার জন্য খচ্চর হইতে একটু ছোট, গাধা হইতে একটু বড় শ্বেত বর্ণের একটি বাহন উপস্থিত করা হইল, তাহার নাম “বোরাক”; যাহার প্রতি পদক্ষেপ দৃষ্টির শেষ সীমায়। সেই বাহনের উপর আমাকে সওয়ার করা হইল। 

ঘটনা প্রবাহের ভিতর দিয়ে জিবরাইল (আঃ) আমাকে লইয়া নিকটবর্তী, তথা প্রথম আসমানের দ্বারে পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। ভিতর হইতে পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হইল, জিবরাইল স্বীয় পরিচয় প্রদান করিলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হইল, আপনার সঙ্গে কে আছেন? জিবরাইল বলিলেন, মুহাম্মদ (সাঃ) আছেন। বলা হইল, তাঁহাকে নিয়া আসিবার জন্যই তো আপনাকে তাঁহার নিকট পাঠান হইয়াছিল? জিবরাইল বলিলেন, হাঁ। তারঃপর আমাদের প্রতি মোবারকবাদ জানাইয়া দরজা খোলা হইল। গেটের ভিতরে প্রবেশ করিয়া তথায় আদম (আঃ)-কে দেখিতে পাইলাম। জিবরাইল আমাকে তাঁহার পরিচয় করাইয়া বলিলেন, তিনি আপনার আদি পিতা আদম (আঃ), তাঁহাকে সালাম করুন। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। আমার সলামের উত্তরদানে আমাকে “সুযোগ্য পুত্র ও সুযোগ্য নবী” আখ্যায়িত করিলেন এবং খোশ আমদেদ জানাইলেন।

অতঃপর জিবরাইল আমাকে লইয়া দ্বিতীয় আসমানের দ্বারে পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। এখানেও পূর্বের ন্যায় কথোপকথন হইল এবং শুভেচ্ছা মোবারকবাদ জানাইয়া দরজা খোলা হইল। ভিতরে প্রবেশ করিয়া তথায় ইয়াহইয়া (আঃ) ও ঈসা (আঃ)-এর সাক্ষাৎ পাইলাম; তাঁহাদের উভয়ের নানী পরস্পর ভগ্নী ছিলেন। জিবরাইল আমাকে তাঁহাদের পরিচয় দানে সালাম করিতে বলিলেন, আমি তাঁহাদিগকে সালাম করিলাম। তাঁহারা আমার সালামের উত্তর প্রদান করতঃ “সুযোগ্য ভ্রাতা সুযোগ্য নবী” বলিয়া আমাকে খোশ আমদেদ জানাইলেন।

অতঃপর জিবরাইল (আঃ) আমাকে লইয়া তৃতীয় আসমানের দ্বারে পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। তথায়ও পূর্বের ন্যায় কথোপকথনের পর শুভেচ্ছা স্বাগত জানাইয়া দরজা খোলা হইল। ভিতরে প্রবেশ করিয়া ইউসুফ (আঃ)-এর সাক্ষাৎ পাইলাম। জিবরাইল (আঃ) আমাকে তাঁহার সহিত পরিচয় করাইয়া সালাম করিতে বলিলেন; আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি সালামের উত্তর দান করতঃ আমাকে “সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী” বলিয়া মোবারকবাদ জানাইলেন। 

অতঃপর আমাকে লইয়া জিবরাইল চতুর্থ আসমানের নিকটে পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। সেখানেও পূর্বের ন্যায় প্রশ্নোত্তরের পর শুভেচ্ছা স্বাগত জানাইয়া দরজা খোলা হইল। ভিতরে প্রবেশ করিয়া আমরা তথায় ইদ্রিস (আঃ)-এর সাক্ষাৎ পাইলাম। জিবরাইল (আঃ) আমাকে তাঁহার পরিচয় করাইয়া সালাম করিতে বলিলেন। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি সালামের উত্তর দিলেন এবং “সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী” বলিয়া আমাকে মারহাবা জানাইলেন।
 
অতঃপর জিবরাইল আমাকে লইয়া পঞ্চম আসমানে পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। এই স্থানেও পূর্বের ন্যায় প্রশ্নোত্তর চলার পর শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ দানের সহিত দরজা খোলা হইল। আমি ভিতরে পৌঁছিয়া হারুন (আঃ)-এর সাক্ষাৎ পাইলাম, জিবরাইল আমাকে তাঁহার পরিচয় দানে সালাম করিতে বলিলেন। আমি সালাম করিলাম। তিনি আমার সালামের উত্তর দিলেন এবং “সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী” বলিয়া আমাকে খোশ আমদেদ জানাইলেন।

তারঃপর জিবরাইল আমাকে লইয়া ষষ্ঠ আসমানের দরজায় পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। এস্থানেও পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হইলে জিবরাইল স্বীয় পরিচয় দান করিলেন, অতঃপর সঙ্গে কে আছে জিজ্ঞাস করা হইল; তিনি বলিলেন, মুহাম্মদ (সাঃ)। বলা হইল, তাঁহাকে তো নিয়া আসিবার জন্য অপনাকে পাঠান হইয়াছিল? জিব্রাঈল বলিলেন, হাঁ। তৎক্ষণাত শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানাইয়া দরজা খোলা হইল। তথায় প্রবেশ করিয়া মুসা (আঃ)-এর সাক্ষাৎ পাইলাম । জিবরাইল (আঃ) আমাকে তাঁহার পরিচয় জ্ঞাত করিয়া সালাম করিতে বলিলেন। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি সালামের উত্তর প্রদান করিলেন এবং “সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী” বলিয়া আমাকে মোবারকবাদ জানাইলেন। যখন আমি এই এলাকা ত্যাগ করিয়া যাইতে লাগিলাম তখন মুসা (আঃ) কাঁদিতেছিলেন। তাঁহাকে কাঁদিবার কারণ জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেন, আমি কাঁদিতেছি এই কারণে যে, আমার উম্মতে বেহেশত লাভকারীর সংখ্যা এই নবীর উম্মতের বেহেশত লাভকারীর সংখ্যা অপেক্ষা কম হইবে, অথচ তিনি বয়সের দিক দিয়া যুবক এবং দুনিয়াতে প্রেরিত হইয়াছেন আমার পরে। 

তারঃপর জিবরাইল (আঃ) আমাকে লইয়া সপ্তম আসমানের প্রতি আরোহণ করিলেন, এবং তাহার দ্বারে পৌঁছিয়া দরজা খুলিতে বলিলেন। এস্থানেও পূর্বের ন্যায় সকল প্রশ্নোত্তরই হইল এবং দরজা খুলিয়া শুভেচ্ছা ও স্বাগত জনান হইল। আমি ভিতরে প্রবেশ করিলাম। তথায় ইবরাহিম (আঃ)-এর সাক্ষাৎ লাভ হইল। জিবরাইল আমাকে বলিলেন, তিনি আপনার (বংশের আদি) পিতা, তাঁহাকে সালাম করুন। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি আমার সালামের উত্তর দিলেন এবং “সুযোগ্য পুত্র, সুযোগ্য নবী” বলিয়া মারহাবা ও মোবারকবাদ জানাইলেন। (সংক্ষিপ্ত করলাম হাদীস)   

আমরা পৃথিবীবাসিরা আমাদের পরিচিত আকাশ বলতে যদি আমাদের ভূপৃষ্ঠের চতুর্দিকের খোলা শূণ্যতাকে ধরে নেই, তবে তার একটি নির্দিষ্ট সীমানাও ধরে নেওয়া যায়; আর সেই চিন্তায় আমরা যদি আমাদের বায়ুমণ্ডলকে ধরে নেই, তবে তার একটি সুনির্দিষ্ট সীমানা পাওয়া যায় এবং এই অঞ্চলটিও সাতটি অংশেই বিভক্ত। কিন্তু পবিত্র কোর'আনের সূরা আল মুলক-এর ৩ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন —
الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا مَّا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِن تَفَاوُتٍ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَى مِن فُطُورٍ 
অর্থাৎ - 'তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টিতে কোন তফাত দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফেরাও; কোন ফাটল দেখতে পাও কি?'

পবিত্র কোর'আনুল কারীমে এই সাত স্তরের আকাশ বলতে মহাবিশ্বের সাতটি আলাদা স্তরকেই বুঝিয়েছেন, মাথার উপর দেখতে পাওয়া খোলা আকাশটি নয়; যা হতে পারে সাতটি আলাদা মাত্রায় বা সাতটি আলাদা আকর্ষণ ক্ষেত্র। অনেকে এ বিষয়টিকে আমাদের ভূপৃষ্টের সাত স্তরের বায়ু মণ্ডলকে বুঝানো হয়েছে বলে মনে করেন। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে বর্তমানে অনেকের কাছেই এই কথাটি পরিস্কার হয়ে গেছে যে, এই সাত স্তরের আকাশ বলতে আসলে আমাদের এই বায়ু মণ্ডলকে বুঝানো হয়নি; বুঝানো হয়েছে কোর'আনুল কারীমের ভিন্ন আয়াতে ভিন্ন আঙ্গিকে; আমরা তা পরে দেখবো। তবে এখানে এই স্তরভেদ বলতে একের অধিক বিশ্বকেই বুঝানো হয়েছে এবং তার সংখ্যা সাতটি বলেও পরিস্কার ধারনা দেওয়া হয়েছে। যার ধারে কাছেও বিজ্ঞান এখনো পৌঁছতে পারে নি।

মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা সূরা আম্বিয়ার ৩২ নং আয়াতে বলেন — 
وَجَعَلْنَا السَّمَاء سَقْفًا مَّحْفُوظًا وَهُمْ عَنْ آيَاتِهَا مُعْرِضُونَ
অর্থাৎ - 'আমি আকাশকে সুরক্ষিত ছাদ করেছি; অথচ তারা আমার আকাশস্থ নিদর্শনাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।'

বলা চলে আমাদের উপরস্থিত বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর চার দিকের এক গ্যাসীয় আবরণ; যার গড় উচ্চতা প্রায় দশ হাজার কিমি। হয়তো বলতে পারেন এতো উচু গ্যাসের স্তরের কি প্রয়োজন ছিল? এই উঁচু গ্যাসের স্তরই আমাদের পৃথিবীকে আবাসযোগ্য করে তুলেছে; এর সামান্য ব্যতিক্রমই এই আবাসযোগ্যতা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞান বলছে - মহাকাশের শেষ প্রান্তে থাকা লক্ষ লক্ষ বিভিন্ন আকৃতির মিটিওরাইট বা উল্কাপিণ্ড প্রতি নিয়ত আমাদের পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। বায়ু স্তরের ঘর্ষনে এই পাথরখণ্ডের উল্কাপিণ্ডগুলো ভষ্মে পরিণত হয়ে যাচ্ছে; রক্ষা পাচ্ছে আমাদের মাটির পৃথিবী। 

দিনে অন্ততঃ দু’চারটি উল্কাপিণ্ডও যদি আমাদের পৃথিবীতে চলে আসতো, তাতে পৃথিবীতে নির্বিগ্নে জীবনধারন অসম্ভব হয়ে পড়তো। তাছাড়া, সূর্য থেকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর হাজারো রকমের অতিবেগুণী রশ্মি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে; বায়ুস্তর এগুলোকে বাঁধা দিচ্ছে। এই কাজে এইসব বায়ুস্তরগুলো এমনই সিদ্ধহস্ত যে, ভাবলে মনে হয় যেন কোন অশরীরী মহাশক্তি দূরে বসে অনায়াসে এইসব ক্রিয়াগুলো সুনিপুনভাবে পরিচালনা করছেন। অবশ্য, ধর্মবিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেন, মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার নির্দেশে আসমানের ফেরেশতাগণ এসব কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করছেন।

বিজ্ঞানের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, আমাদের আজকের পৃথিবী আর জন্মলগ্নের পৃথিবী এক রকম নয়; অতিনবতারা বা সুপারনোভা (এটি হলো এক ধরনের নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ যার ফলশ্রুতিতে নক্ষত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং অবশেষরূপে থাকে নিউট্রন তারা কিংবা কৃষ্ণবিবর) বিস্ফোরণ থেকে ছায়পথের উৎপত্তি। সেই ছায়াপথের বিবর্তনের ধারায় তার অসংখ্য নক্ষত্রের একটি নগণ্য সদস্য সূর্যের দেহাংশ থেকে আমাদের পৃথিবীর জন্ম হয়েছে বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা। এই জন্ম ইতিহাস থেকেই বুঝা যায় যে, আদি পৃথিবী আজকের মত এতোটা সুরম্য ছিল না, ছিল এক জ্বলন্ত অগ্নিগোলক; যা ধীরে ধীরে বহু বছরের বিবর্তনে সৌন্দর্যের রাণী হয়ে উঠেছে, গড়ে উঠেছে প্রাণের আবাসভুমি। আজকের দিনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় মানুষ বুঝতে পারছে যে, কত কঠিন পরিস্থিতির ও সুক্ষ্ম জটিলতার মধ্য দিয়ে কত আশ্চর্যজনক ভাবে গড়ে উঠেছে আমাদের এই পৃথিবী।

এইসব ভাবতে গিয়ে মানুষ বিষ্ময়ে অবিভূত হয়ে পড়ছে এই ভেবে যে, কি করে এই অভাবিত সমন্বয় সাধিত হলো, যেখানে রয়েছে অসামান্য এক পারস্পারিক ভারসাম্যতার নিঁখুত সমন্বয়; যার যৎসামান্য পরিবর্তনে বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে পৃথিবী ও সমগ্র প্রাণী জগৎ। অথচ সৃষ্টিতে কত নিগূঢ় ভারসাম্যতা বিরাজিত, নেই কোন অপ্রতুলতা; চারিদিকেই আছে শুধু বিপুল প্রাচুর্যতা। অনেকেই সীমিত জ্ঞানের পরিসীমায় আবদ্ধ হয়ে এই প্রাচুর্যতার ব্যাখ্যা খুঁজে না পেয়ে সহজ করে বলে ফেলেন,‘বিশাল এই বস্তু সকল অনাদিকাল ধরে অবাদ বিচরণের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে প্রাণ; প্রাণ সৃষ্টির জন্য কোন স্রষ্টার প্রয়োজন হয়নি; প্রাণ বিশৃঙ্খল প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত দান।’

প্রাণ সৃষ্টির মহিমায় আমরা গর্বিত; আর সম্ভবতঃ এ কারণেই ইংরেজ দার্শনিক স্যার ফ্রন্সিস বেকন বলেছিলেন, 'সামান্য দর্শন জ্ঞান মানুষকে নাস্তিকতার দিকে টেনে নিয়ে যায়, আবার গভীর দর্শন জ্ঞান মানুষকে ধর্মের দিকে টেনে নিয়ে আসে।' সময়ের বিবর্তনে আজকের পরিপক্ক বিজ্ঞান সঠিক তথ্যের সন্ধান দিয়ে সৃষ্টিকর্তাকেই প্রতিষ্ঠিত করে যাচ্ছে। তাইতো বিজ্ঞানী ফ্রেড ওয়েল তার বৈজ্ঞানিক হিসেব-নিকেশ কষে বলেছিলেন, 'স্রষ্টাহীন, পরিকল্পনাহীন এবং অবাদ বিস্তৃতির ফলে যে ভাবনার ভূবন সৃষ্টি হতে পারে তাতে জীবন সৃষ্টির একান্ত পূর্বশর্ত প্রাণরস বা এনজাইম একটি কার্যক্ষম দল সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা যদি হয় একভাগ, তবে সম্ভবনাহীনতা হবে ১০৪০০০০ ভাগ।' অথচ অসীম সংখ্যক প্রাণ পৃথিবীর মুক্ত হাওয়ায় অবাদে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে; এত প্রাণের আবাসস্থল এই পৃথিবীকে কে দিল এমন আবাসযোগ্যতা? 

তাইতো মহান দয়াময় আল্লাহ সূরা ক্কাফের ৫ নং আয়াতে বলেন —
مَّا لَهُم بِهِ مِنْ عِلْمٍ وَلَا لِآبَائِهِمْ كَبُرَتْ كَلِمَةً تَخْرُجُ مِنْ أَفْوَهِهِمْ إِن يَقُولُونَ إِلَّا كَذِبًا
অর্থাৎ - 'এ সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও নেই। কত কঠিন তাদের মুখের কথা। তারা যা বলে তা তো সবই মিথ্যা।'

আমার এই প্রশ্নে আরও অনেক জবাব রয়েছে বিজ্ঞানের হাতে। তবে জীবনের এই আবাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে কত হাজার হাজার সমন্বয় করতে হয়েছে তাঁকে তা একমাত্র তিঁনিই জানেন, যিঁনি এইসব সমন্বয় সুচারুভাবে সাধন করেছেন। তবে কিছু কিছু বিষয় আজকের বিজ্ঞানীরা তাদের অক্লান্ত চেষ্টায় জানতে পেরেছেন।

'আপনা আপনি গজিয়ে উঠেছে এই বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড' - এমন একটি ধারনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কানাডার রয়েল সোসাইটির জীব ও পদার্থ বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক এ্যালন ‘The Evidence of God in expanding Universe' গ্রন্থে বলেছেন, 'এ পৃথিবীকে এত নিপুন সমন্বয়ের মাধ্যমে এমনি করে প্রাণীদের বসবাসের উপযোগী করে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, সেগুলোকে বিবেচনা করলে কোন ভাবেই বলা যায় না যে, এই পৃথিবী আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে।’ এই কথার উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা নিজে, সূরা আল মুরসালাত-এর ২৫ নং আয়াতে; তিনি বলেন —
أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ كِفَاتًا
অর্থাৎ - 'আমি কি পৃথিবীকে সৃষ্টি করিনি ধারণকারিনী রূপে?' 
এবং ২৬ নং আয়াতে বলেন — أَحْيَاء وَأَمْوَاتًا অর্থাৎ - 'জীবিত ও মৃতকে।' 

উপরোক্ত আয়াতে কাজী জাহান মিয়া (আল-কোরআন দ্য চ্যালেঞ্জ মহাকাশ পর্ব) ‘ধারনকারিনী' শব্দের জায়গায় ‘উপযুক্ত আবাস স্থল’ ব্যবহার করেছেন। ২৫ নং আয়াতে كِفَاتًا শব্দটির সঠিক অর্থ কি? মিসরের কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড. রাশেদ আল খলিফা তার ইংরেজী তরজমায় এই শব্দটিকে তরজমা করেছেন abode; যার অর্থ গৃহ, বাসস্থান,আবাসস্থল ইত্যাদি। আয়াত ২৫-এ বলা হয়েছে ‘ধারণকারিনী রূপে’; কাকে ধারণকারিনী বলা হয়েছে? আবার আয়াত ২৬ এ বলা হয়েছে ‘জীবিত বা মৃতকে’; তাহলে একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যাওয়া যায় যে, এখানে প্রাণীর কথা বলা হয়েছে এবং আমরা জানি জীবিত প্রাণীরা তাদের আবাস গৃহে বসবাস করে; সেই সূত্রে পৃথিবীকে প্রাণীর আবাস গৃহ বলাটাই বাঞ্চণীয়। 

সূরা আল আম্বিয়ার ১৬ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন —
وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاء وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَاعِبِينَ
অর্থাৎ - ‘আমি আকাশ ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী বস্তুপুঞ্জকে খেলার ছলে সৃষ্টি করি নাই।'

এবং সুরা বাকারা-র ১৬৩ নম্বর আয়াতে তিনি বলেন —
وَإِلَـهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ
অর্থাৎ - 'আর তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি অতি দয়াময়, পরম দয়ালু।'

এবং ১৬৪ নম্বর আয়াতে বলেন —
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاخْتِلاَفِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنزَلَ اللّهُ مِنَ السَّمَاء مِن مَّاء فَأَحْيَا بِهِ الأرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَآبَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخِّرِ بَيْنَ السَّمَاء وَالأَرْضِ لآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
অর্থাৎ - 'নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে, সে নৌকায় যা সমুদ্রে মানুষের জন্য কল্যাণকর বস্তু নিয়ে চলে এবং আসমান থেকে আল্লাহ যে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন অতঃপর তার মাধ্যমে মরে যাওয়ার পর যমীনকে জীবিত করেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সকল প্রকার বিচরণশীল প্রাণী ও বাতাসের পরিবর্তনে এবং আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী স্থানে নিয়োজিত মেঘমালায় রয়েছে নিদর্শনসমূহ এমন কওমের জন্য, যারা বিবেকবান।'

তাই বলা যায়, এমনোতর হাজার হাজার সমন্বয়ের মধ্যে একটি বিশেষ সমন্বয় হলো - পৃথিবীর অক্ষ তির্যকতা। আমরা জানি পৃথিবী তার কক্ষতলে নিজ অক্ষের সাথে ২৩.৫০ ডিগ্রী কৌণিক অবস্থানে অবস্থিত। এই অবস্থান যে কত সুক্ষ্ম হিসেব ব্যবস্থা, তা বিজ্ঞানী মাত্রই জানেন। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, এই অবস্থান সকল গ্রহ বা নক্ষত্রের জন্য এক রকম নয়। আর এ থেকেই পরিস্কার বুঝা যায় যে, এ ব্যবস্থা আপনা আপনি হতে পারে না। হয়তো বলতে পারেন, প্রকৃতির নিয়মে ব্যবস্থাটি আগে থেকেই হয়েছিল; সেই হয়ে থাকার সুবাদে পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ আপনা আপনি হয়েছে। 

অনুভবশক্তির পরিসর অনুযায়ী আমার জ্ঞানের সীমা অতি ক্ষুদ্র; তারপরও মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা সুযোগ করে দিলে, প্রাণ সৃষ্টি যে কত জটিল ও সুক্ষ্ম সমন্বয়তার মধ্যে ঘটেছে, তার আলোচনা অন্য পরিসরে অন্য সময় আরেকদিন করবো; তখন দেখবেন, তা এই সব মহাজাগতিক সমন্বয়ের চেয়েও বহুগুন জটিল। ফলে এসব কথা কোন উপায়েই বলা চলে না যে, এ সব আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে। 

আমি আলোচনা করছিলাম পৃথিবীর তীর্যকতা নিয়ে, আসুন সেখানেই থাকি। আজকের বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা- নিরীক্ষায় এ বিষয়টি স্বতসিদ্ধ যে, এই তীর্যকতার জন্যেই পৃথিবীতে ঋতুচক্রের সূচনা হয়; শীত গ্রীষ্মে তাপমাত্রার তারতম্যের মাধ্যমে দেখা দেয় ঋতু বৈচিত্র। আমরা জানি পৃথিবী তার কক্ষপথে নিজ অক্ষের সাথে ২৩.৫০ ডিগ্রী কৌণিক অবস্থানে অবস্থিত। এই তীর্যকতা সঠিক মাত্রায় না হলে পৃথিবী হতো আবাসের অনুপোযুক্ত; যার প্রকৃত উদাহরণ হলো - ইউরেনাস। ইউরেনাসের এই তীর্যকতা ৯০ ডিগ্রী বা তারও বেশী; যার ফলে গ্রহটিতে বিরাজ করছে উদ্ভট এক চরম ভাবাপন্নতা। এই গ্রহের মেরু অঞ্চলে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কাল পৃথিবীর হিসেবে প্রায় বিশ বছর। বিজ্ঞানীরা সুক্ষ্ম হিসেব করে দেখেছেন যে, এই তীর্যকতাও একেবারে স্থির নয়; খুব ধীর গতিতে এর পরিবর্তন ঘটে। কমতে কমতে একসময় বিপরীত মুখী হয়ে আবারও তা পূর্বাবস্থানে ফিরে আসে; এই পর্যায় কালটি প্রায় ২৬,০০০ বছর; একে বলা হয় পৃথিবীর অক্ষঘূর্ণির অগ্রগমন চক্র। 

এই তীর্যকতা পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তীত হয় পৃথিবীর আবহাওয়া। এই পরিবর্তন এতোটাই ধীরলয়ে ঘটে যে, প্রাণীকুল বেঁচে থাকার তাগিদে নিজেদেরকে অনায়াসে খাপ খাইয়ে নেয়; ২৬ ,০০০ বছর পরে আবার ফিরে আসে সেই আদি অবস্থানে। এই ফিরে আসার চক্রটি যদি সুনিশ্চিত করা না হত তাহলে পৃথিবী আটকে যেতো কোন এক নির্দষ্ট ভাবাপন্ন অবস্থায়; যার প্রভাব পড়তো প্রাণীকুলের জীবনচক্রে। হয়ত পৃথিবীর পরিবেশ একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় স্থির হয়ে যেতো কিছুসংখ্যক প্রাণীর চারণ ভূমি হিসেবে। পৃথিবীতে আবহাওয়ার এই পরিবর্তন আছে বলেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতি, আবার দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন প্রাণ। সম্ভবতঃ দয়াময় এই চক্রটি বিধিত করেছেন পৃথিবীর রূপ বৈচিত্রকে বিভিন্ন প্রাণীর জন্যে উপযোগী করে তোলার প্রয়োজনেই।

নিশ্চয়ই এই বিবর্তন প্রকৃতি জগতে এক মহা সুসংবাদ; হয়তো তা পৃথিবীতে দয়াময়ের সৃষ্টি বৈচিত্রের এক মহা নিয়ামক। হয়তো এই ব্যবস্থাই প্রাণ সৃষ্টির এই উদ্দীপনাকে ক্ষুদ্রত্বের সীমাবদ্ধতা থেকে বৃহৎ পরিসরে মুক্তি দিয়েছে। আর সৃষ্ট প্রাণগুলো আবাস যোগ্যতা পেয়েছে নিজ নিজ সময় সীমা পর্যন্ত। তাইতো হাজার হাজার বছরের নিরলস পরিশ্রমের ফলে প্রাপ্ত ধারনার সারমর্ম দয়াময়ের কাছ থেকে নেমে এসেছে চিন্তাশীল মানুষের জন্যে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। জানলো না কেউ, বুঝলো না কেউ, শুধু গুমরে কাঁদলো কোর'আনের বাণী; আজো থামলো না সে কান্না। রয়ে গেল আরো কত না জানা রহস্য তারই পাতায়।

তাই, সূরা আল মুমিনুন-এর ১৭ নং আয়াত দিয়ে আজকের মতো সমাপ্ত করছি; আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন —
وَلَقَدْ خَلَقْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعَ طَرَائِقَ وَمَا كُنَّا عَنِ الْخَلْقِ غَافِلِينَ
অর্থাৎ- 'আমি তোমাদের উপর স্তরে স্তরে সাত মহাকাশ সৃষ্টি করিয়াছি, আমি সৃষ্টি বিষয়ে অসতর্ক নহি।’

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
০৩ জানুয়ারি, ২০১৮.

৪টি মন্তব্য:

  1. আগে তো বইয়ের মধ্যেই জ্ঞান আবদ্ধ ছিল।বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখেছি সব। কিন্তু এখন ইসলামিক
    দৃষ্টিতে মহাকশ সম্পর্কে জানতে পেরে ভালই লাগছে🙂

    উত্তরমুছুন
  2. বিজ্ঞানের এই অনন্ত রহস্য আবিস্কারের ক্ষুধা একেবারে শেষ পর্যন্ত চলতেই থাকবে।চমৎকার লিখাটির জন্য ধন্যবাদ ওয়ালী ভাই।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক অনেক শুভকামনা সাথে থাকার জন্য; ধন্যবাদ দাদা!

      মুছুন