ডা. মরিস বুকাইলি; যার জন্ম: ১৯২০ সালে এবং মৃত্যু ১৯৯৮ সালে। ক্যাথলিক বা অর্থোডক্স বা গোঁড়াবাদী এই খ্রিস্টান ডা. মরিস বুকাইলি বিখ্যাত হয়ে যান ১৯৭৬ সালে একটি বই লিখে, যে বইটির নাম - 'The Bible, the Quran and Science' বা 'বাইবেল, কুরআন এবং বিজ্ঞান'। মুসলমানদের বক্তব্য হলো বইটি নাকি পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিল! এ'টি অবশ্য বেস্ট সেলার, এবং প্রায় ৫০ টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল শুধুমাত্র মুসলমানদের অন্ধত্বের কারণে!
একজন মুসলমানের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো সত্য উন্মোচন ও সততা; হুজুরপাক (সাঃ) ইসলাম প্রচার শুরুর আগেই ছিলেন সর্বস্বীকৃত 'আল-আমীন'। কিন্তু আফসোস! মুসলমানরা আজ তাদের অমূল্য সম্পদ - সততা, সত্যবাদীতা পদদুলিত করে মিথ্যার উপর ভর করে চলছে বা চলতে চাইছে। যে সততা, সত্যবাদীতা ছিল মুসলমানের সবচেয়ে বড় গৌরব ও বড় অহংকার, আজ সেই তাদেরই বংশধররা পদদুলিত করছে এসব প্রতি পদেপদে! কিন্তু কেন? আপনারা কি ভুলে গেছেন হুজুরপাক (সাঃ)-এর সেই অমর আমিয় বাণী— 'মিথ্যা সকল পাপের মা'।
পবিত্র কুর'আনুল কারীম-এর সূরা হা-মীম সেজদাহ-র ৪২ নম্বর আয়াত—
لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِن بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنزِيلٌ مِّنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ অর্থাৎ - "এতে মিথ্যার প্রভাব নেই, সামনের দিক থেকেও নেই এবং পেছন দিক থেকেও নেই; এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।" অথচ, চিরন্তন সত্য কুর'আনুল কারীম ছেড়ে আজ আমরা যতসব মিথ্যা প্রচার ও প্রপাগান্ডা নিয়ে ব্যস্ত, এবং চরমভাবে মেতে আছি! কয়দিন আগে আমি রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর একটি মু'জেযা সম্পর্কিত সহীহ হাদীস বর্ণনা করেছিলাম; এক বন্ধু সেখানে মরিস বুকিইলি কোড করেছিল। আমার প্রশ্ন তার কাছে, মুসলমানের কাছে কি কুর'আন সুন্নাহ্-র চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টানের বই?
একটি সর্বস্বীকৃত মত হলো— হুজুরপাক (সাঃ) হলেন সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী মহামানব, আর তাঁর প্রচারিত ধর্ম ইসলাম হলো আল্লাহ্ প্রদত্ত একটি সত্য ধর্ম; পবিত্র কুর'আনুল কারীম চীরসত্য এবং রাসুলুল্লাহও (সাঃ)-এর জীবন ও কর্ম চীরসত্য। এ'সব ছেড়ে একজন অর্থলোভী মরিস বুকাইলি বা অন্য করো বা দুনিয়াবী অন্য কোন স্বার্থবাজের বই আমরা পড়বো কেন?
হ্যাঁ, পড়তে পারি বা আমিও পড়ি; তবে তা জানার জন্য, জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য। আমি মনে করি, একজন মুসলমানের মৌলিক জ্ঞানের সকল উৎস হওয়া উচিত পবিত্র কুর'আনুল কারীম ও হাদীসগ্রন্থগুলো। এখন প্রশ্ন আসতে পারে— সঠিক হাদীস আমাদের কাছে কি পৌঁছেছে? মরিস বুকাইলি তার গ্রন্থ -'বাইবেল, কুরআন এবং বিজ্ঞান'-এ সকল হাদীসকে এমন একটি প্রশ্নেরই সন্মুক্ষীন করেছেন! এ সব যে একটি ওহাবী চক্রান্ত তা সরল মুসলমান মোটেও বিশ্বাস করে না বা বুঝে উঠতে পারে না! তাই আজ আমি তার আদি-অন্তের কিছুটা তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।
মরিস এবং মারি জেমস বুকাইলির পুত্র মরিস বুকাইলি একজন ফরাসি চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ডাক্তার, মিশরতত্ত্ব এর ফরাসি সোসাইটির সদস্য, এবং একজন লেখক। মরিস বুকাইলি ১৯৪৫ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত মেডিসিনের উপর চর্চা করেন এবং গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির উপর একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ১৯৭৩ সালে মরিস বুকাইলি সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহ ফয়সালের পরিবারের চিকিৎসক নিযুক্ত হন এবং একই সাথে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের পরিবারের ডাক্তার ছিলেন। সেই সুবাদে কেমন করে যেন তিনি ইসলামের একজন একনিষ্ঠ গবেষক হয়ে উঠেন! শত প্রচার-প্রপাগান্ডা থাকলেও তিনি কখনো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি বা করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত কোন তথ্য আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি!
'বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান' বইটি মরিস বুকাইলি ১৯৭৬ সালে প্রকাশ করেন। "The Bible the Quran and Science-এ তিনি বলেন, কুর'আনের কোন বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের সাথে বিরোধবাচক নয়; জ্যোতির্বিদ্যা, ভ্রূণতত্ত্বসহ আরো অনেক বিষয় থেকে উদাহরণ দিয়ে তা তিনি ব্যাখ্যাও করেন। আর এতেই মুসলমান সব হুমরি খেয়ে পড়লো! কিন্তু, হাদীসের কথা বলতে গিয়ে সহীহ বোখারী-কেও তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করে বসেছেন! যাক, সেদিকে যাবো না, গেলে লেখা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। তবে, তার মুসলমান হওয়ার কিছু প্রপাগান্ডা তুলে ধরে আপনাদের নিজেদের বিবেকের কাছেই প্রশ্ন রাখছি?
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, মৃত ফ্রাঁসোয়া মিত্রা প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকেন ১৯৮১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। তিনি তার পদে থাকাকালীন সময়ে আশির দশকের শেষের দিকে নাকি ফিরাউনের মমিকে আতিথেয়তার জন্য মিসরের কাছে অনুরোধ জানান; ফ্রান্স নাকি কিছু প্রত্নতাত্তিক গবেষণা করতে চায়। মিসরের সরকারও তাতে রাজি হয়। কাজেই কায়রো থেকে ফিরাউনের যাত্রা শুরু হলো প্যারিসে! প্লেনের সিড়ি থেকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, তার মন্ত্রীবর্গ ও ফ্রান্সের সিনিয়র অফিসারগণ লাইন ধরে দাড়ালেন এবং মাথা নিচু করে ফিরাউনকে স্বাগত জানালেন!
মমির উপর গবেষণার জন্য সেখানে প্রধান সার্জন ছিলেন মরিস বুকাইলি। ফিরাউনের শরীরে লবণ দেখে নাকি সবচেয়ে বড় প্রমাণ পেয়ে গিয়েছিলেন বুকাইলি;..... সে (ফিরাউন) ডুবে মারা গিয়েছিল এবং তার শরীর ডোবার পরপরই সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র [লোহিত সাগর] থেকে তুলে আনা হয়েছিল! তারপর লাশটা সংরক্ষণ করার জন্য দ্রুত মমি করা হয়! .............. এ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরিস বুকাইলি নাকি পবিত্র কুর'আন শিখেন, সৌদি আরব যান.... ইসলাম গ্রহণ করেন.... আরও কত কি!
যদি তাই সত্য হয়, তবে এই ঘটনা ৮১-৯৫ এর মধ্যের, অথচ 'বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান' বইটি প্রকাশিত হয়েছিল '৭৬-এ। এখন আপনিই বলুন, কেমনে কি? অনেক সময় অনেক সত্য জেনেও চুপ করে থাকি, থাকতে হয়; কিন্তু অসত্যকে সত্য মনে করে এবং প্রকাশ করে কেউ যদি গর্ববোধ করে, তখন তো আর চুপ থাকা যায় না। মনে রাখবেন - জ্ঞান হলো আল্লাহ্ প্রদত্ত জিনিস; এর জন্য অনেক ধ্যান করতে হয়॥
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
০১ মে, ২০১৯.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন