মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০২০

জ্ঞান বনাম অজ্ঞানের ফেতনা ফ্যাসাদ:

'Islam' is derived from the Arabic root 'Salema'; peace, purity, submission and obedience. In the religious sense 'Islam' means submission to the will of God and obedience to His law. তাই ইসলামকে এক কথায় সজ্ঞায়িত করতে গেলে বলা যায়—  'ইসলাম' হলো 'শান্তি'; আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা-র নিকট আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যা ঘটে থাকে। এ নিয়ে দ্বিমত করার কোন অবকাশ বা সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। 

শুধুমাত্র বিতর্ক করার অভিপ্রায়ে বা অযথা অন্যকে দোষারোপ করার বদইচ্ছায় যারা ইসলাম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, তাদের জ্ঞানের পরিধী নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। মহান রাব্বুল আ'লামিন কোনদিনও তাদেরকে জ্ঞান দান করেন না; যা পবিত্র কালাম পাকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। তাই, জ্ঞানের প্রকৃত সংজ্ঞা জানতে হলে বা বুঝতে হলে অবশ্যই রাব্বুল আ'লামিনের দিদার পেতে হবে, তপস্যা করতে হবে, একাগ্র চিত্তে চর্চা করতে হবে। 

হযরত যায়িদ বিন সাবিত (রা:) বলেন -  একদিন আবু হুরাইরা, আমাদের এক বন্ধু ও আমি মসজিদে আল্লাহ্‌-র কাছে দু'আ করছিলাম। এমন সময় রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামকে আমরা দেখতে পেলাম। তিনি এগিয়ে এসে আমাদের মাঝখানে বসলেন, আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, "তোমরা তোমাদের কাজ আবার শুরু করো।" আমি ও আমার বন্ধুটি আবু হুরাইরার আগেই আল্লাহ্‌-র কাছে দু'আ করলাম। রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম আমাদের দু'আর সাথে সাথে 'আমীন' বললেন। তারপর আবু হুরাইরা দু'আ করলেন - "হে আল্লাহ্‌! আমি আপনার কাছে চাই যা কিছু আমার দু'বন্ধু চেয়েছেন, আর সেইসাথে এমন জ্ঞান চাই যা কখনো ভুলে না যাই।" এবারও রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম 'আমীন' বললেন। আমরা দু'জনও বললাম - " আমরাও চাই যেন ভুলে না যাই এমন জ্ঞান। " রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বললেন "আওস গোত্রের এ লোকটি ( আবু হুরাইরা (রা:) ) এক্ষেত্রে তোমাদের দু'জনকে হারিয়ে দিয়েছে।"  

ছহীহ বুখারী শরীফে আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস - " রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে একমাত্র আবদুল্লাহ ইবনে উমর ব্যতীত আর কেউ আমার চেয়ে বেশি বর্ণনাকারী নেই; তাও এজন্য যে, তিনি হাদিস লিখতেন, আমি লিখতাম না।"  

একজন মানুষের পক্ষে কেমন করে তা সম্ভব? এতো হাদিস শুধুমাত্র স্মৃতি আওড়িয়ে বলে যাওয়া! - আসুন তাঁর নিজ জবানী থেকেই শুনে নেই; "তোমরা হয়তো মনে করছো আমি খুব বেশি হাদিস বর্ণনা করি। আমি ছিলাম রিক্তহস্ত, হতদরিদ্র; পেটে পাথর বাঁধা একজন। সর্বদা রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের সাহচার্য পেতে চাইতাম। তাই তাঁর আশপাশেই থাকতাম, সময় কাটাতাম। মুহাজিররা ব্যস্ত থাকতো তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে এবং আনসাররা তাঁদের ধন-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে সদা তৎপর থাকতো। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াস সাল্লামের সান্নিধ্যে একদিন আমি বললাম - 'ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি আপনার অনেক কথাই শুনি, কিন্তু তার অনেক কিছুই ভুলে যাই।' একথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বলেন - 'তোমার চাদরটি মেলে ধর।' আমি মেলে ধরলাম। তারপর তিনি বললেন - 'তোমার বুকের সাথে লেপ্টে ধর।' আমি লেপ্টে ধরলাম। এরপর থেকে আর কখনো কোন কথাই আমি ভুলিনি।" 

১০ম হিজরীতে ইয়ামেনে ইসলাম প্রচারের জন্য খালিদ সাইফুল্লাহ (রা:)কে পাঠানো হলো। ছ'মাস অক্লান্ত চেষ্টার পরও তিনি সফলকাম হতে পারলেন না, বিফল মনোরথে সদলবলে মদিনায় ফিরে এলেন। সাথে সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়েমেন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং তদানুসারে ঘোষণাও দিয়ে দেন। হযরত আলী (রা:) তখন সবে যৌবনে পা দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের এই ঘোষণা শুনে তিনি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন। খালিদ সাইফুল্লাহ (রা:)-র মত বীর যেখানে গিয়ে ব্যার্থ হয়েছেন, সেখানে তিনি গিয়ে কি করবেন? কিছুটা ভয়, কিছুটা সংশয় নিয়ে স্পন্দিত হৃদয়ে রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন - "আপনি আমাকে এমন লোকদের কাছে পাঠাচ্ছেন যেখানে নতুন নতুন সব ঘটনা ঘটবে, অথচ বিচার ক্ষেত্রে আমার কোন অভিজ্ঞতাই নেই।" উত্তরে রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বললেন - "আল্লাহ্‌ তোমাকে সঠিক রায় প্রদানের শক্তি দান করবেন।"  তিনি হযরত আলী (রা:)-র মুখে হাত রাখলেন এবং দু'আ করলেন। হযরত আলী (রা:) বলেন - "অতপর আমি আর কখনো কোন বিচারে দ্বিধাগ্রস্ত হইনি।"
 
ইয়েমেন যাওয়ার আগে রাসুল পাক সাল্লাল্লাহহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম নিজ হাতে হযরত  আলী (রা:)-র  মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দেন এবং বুকে বুক মিলিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন - "আলী!  মুখের কথা শব্দ হিসেবে কর্ণে যায়, অন্তরের কথা অন্তর বুঝে।"  হযরত আলী রাদি'আল্লাহু আনহু যথাসময়ে ইয়ামেন পোঁছলেন, প্রচার কাজ শুরু করলেন। খুব অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইয়ামেনবাসী একের পর এক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে, এমনকি হামাদান গোত্রের সবাইও মুসলমান হয়ে যায়। ইসলামের বিশ্ব ইতিহাস থেকে স্পষ্ট অনুধাবন করা যায়, আজও ইয়ামেনবাসীরাই পৃথিবীর সবচেয়ে সাচ্চা মুসলমান।  

পবিত্র কোর'আনুল কারিমে আল্লাহ‌ রাব্বুল আ'লামিন স্বয়ং ঘোষণা করেন, "অ তিলকাল আমছালু নাদ্বরিবুহা  লিন্নাসি অমা ইয়া'ক্বিলুহা ইল্লাল আলিমুন!" ; অর্থাৎ -' আমি এ সকল উপমা মানুষের জন্য পেশ করে থাকি, এগুলো তারাই বুঝে, যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে।'  
আল্লাহ্‌ রাব্বুল আ'লামিন আরও ঘোষণা করেন - "অলাক্বাদ জি'নাহুম বিকিতাবিন  ফাদ্বালনাহু আলা ইলমিন।" অর্থাৎ - 'আমি তাদের নিকট এমন কিতাব পাঠিয়েছি যা জ্ঞানের সঙ্গে পুঙ্খানুপঙ্খরুপে বর্ণনা করেছি।' 

এবং জ্ঞান সম্পর্কে সুরা 'আন নূর' এর ৩৫ নাম্বার আয়াতে তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেন - "আল্লা-হু নূরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্ব; মাছালু নূরিহী কামিশকা-তিন ফীহা মিম্বাবা-হু; আল্ মিস্বাবাহু ফী যুজ্বা-জ্বাহ; অাযযুজ্বা-জ্বাতু কাআন্নাহা কাওকাবুন দুররিয়্যুইঁ ইউক্বাদু মিন শাজ্বারাতিম মুবা-রাকাতিন যাইতূনাতিল লা শারকিয়্যাতিওঁ ওয়ালা গারবিয়্যাতি, ইঁ ইয়াকা-দু যাইতূহা ইউদ্বি--উ ওয়া লাও লাম তামসাসহু না-র; নুরুন আ'লা নূর; ইয়াহদিল্লাহু লিনূরহী মাইঁ ইয়াশ--উ; ওয়া ইয়াদ্বরিবুল্লা-হুল্ অামছা-লা লিন্না-স; ওয়াল্লা-হু বিকুল্লি শাইয়িন 'আলীম।"  অর্থাৎ - 'আল্লাহ-ই আকাশ ও পৃথিবীর জ্যোতি; তাঁর জ্যোতির উপমা প্রদীপ দানের মত, যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের পাত্রে স্থাপিত, কাঁচের পাত্রটি একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত; পবিত্র জয়তুন বৃক্ষের তৈল দ্বারা যা প্রজ্জোলিত করা হয়, যা পূর্ব মুখিও নয় এবং পশ্চিম মুখিও নয়। তাতে অগ্নিসংযোগ না করলেও মনে হয় তার তৈল যেন উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে; জ্যোতির উপর জ্যোতি! আল্লাহ‌ যাকে ইচ্ছা তাকে তাঁর জ্যোতির দিকে পথ প্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা দিয়ে থাকেন এবং আল্লাহ সর্ববিষয়ে জানেন।'

উক্ত আয়াতের শানে নুযূলে সঠিক তাফসীরে দেখা যায় -- জাহেলিয়াতের যুগে বিভিন্ন লোক নিজের দাসীদের দিয়ে অর্থ আয় করত। মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই-র কাছেও তেমন কিছু দাসী ছিল, যাদের দিয়ে সে অশ্লীল কাজ করিয়ে অর্থ আয় করত। তাদের মধ্য থেকে অনেকেই মুসলমান হয়েছিল; তারা এ ধরনের অসৎ কাজ করতে অস্বীকার করলে আব্দুল্লাহ বিন উবাই তাদের উপর অশ্লীল কাজ করতে জবরদস্তি করত। এর পরিপ্রেক্ষিতেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। (তাফসীরে ওসমানী) 

জ্ঞানের সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেক রকম, প্রকৃত জ্ঞান সম্পূর্ণরুপে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। বর্তমান  পৃথিবীর জীবন্ত বিস্ময় নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ অথর্ব একজন মানুষ হয়েও বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় একের পর এক তিনি অবদান রেখেই চলছেন। আস্তিকতা বা নাস্তিকতার প্রশ্নে না গিয়ে যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করা যায়, তবে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে যায় - তিনি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে যতই সংশয় প্রকাশ করুক, সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করুক বা না করুক, তাতে কারোই কিছু আসে যায় না; সৃষ্টিকর্তা তাঁর মত একজন অথর্বের মাধ্যমেই বিশ্বভ্রম্মান্ডের সকল জটিল বিষয়গুলোর সমাধান দিয়ে যাচ্ছেন। 

বিগ ব্যাং থেকে ব্লাক হোল, বস্তুর অবিনাশীতাবাদ থেকে দি গ্রান্ড ডিজাইন পর্যন্ত - ভৌত বিজ্ঞানের এমন কোন জটিল বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দাঁড় করাননি। গত কয়দিন আগে 'ঈশ্বরকণা' নিয়ে যে কঠিন বাস্তবতার কথা তিনি পৃথিবীবাসীকে স্মরণ করিয়ে  দিয়েছেন তা জেনে আমি মোটেও আশ্চর্যান্বিত হই নি। বরং আমি বিশ্বাস করি - ঈশ্বর কণা নয় ইস্রাফিলের শিংগার এক ফুতকারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবী নামের এই গ্রহটি। আল্লাহ্‌ বা ঈশ্বর প্রশ্নে যে যত কিছুই বলুক না কেন পবিত্র কোর'আনে এ সবের ব্যাখ্যা আরো অনেক বেশি অনেক সুন্দর ও সুচারুভাবে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও সল্পতায় খুব অল্পই আমরা বুঝতে ও জানতে পারি। 

প্রকৃত জ্ঞান অবশ্যই সুরা নূর এর ৩৫ নং আয়াতে স্পষ্ট উল্লেখিত আছে। "নুরুন আ'লা নূর " অর্থাৎ - 'জ্যোতির উপর জ্যোতি' বলতে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আ'লামিন এই ঈশ্বর কণা তথা জ্ঞানের নূরের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফের ছহীহ তাফসীর ঘাটলে এই কথাটির সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এই 'নূর' বা জ্ঞান অর্জন করতে হলে, এই নূরের স্পর্শ পেতে হলে অবশ্যই আগে আত্নশুদ্ধির মাধ্যমে নিজের  দোষত্রুটি শুধরিয়ে নিতে হবে, নিজকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গঠন করতে হবে। 

নামজও আদায় করবো, আবার ঘুষও খাবো; রোজাও রাখবো, আবার সুদও খাবো; লম্বা লম্বা জুব্বা পাগড়ী দাড়ি রেখে তসবিহ তাহলীল করে লোকচোখে পরহেজগার সাজবো, আবার মিথ্যাও বলবো, দুনিয়ার সব আকাম কুকাম করবো! এ সব করে কখনো প্রকৃত জ্ঞানের ছোঁয়া পাওয়া যাবে না, নিজেকে মুসলিম হিসেবেও দাবী করা যাবে না; পরকালে নবীর সাফায়াত প্রত্যাশা করা যাবে না। ইসলাম ইসলাম বলে মুখে যতই ফেনা তুলি না কেন, কোন লাভ হবে না, যদি অন্তর পরিশুদ্ধ না হয়। আত্নশুদ্ধি, আত্নসমালোচনা ও আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমেই আল্লাহ্‌ ও আল্লাহ্‌-র রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামকে বুঝতে হবে, পায়বন্দী করতে হবে, তবেই মিলবে শান্তি ও স্বস্তি। 

প্রচলিত আছে রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম যদি জ্ঞানের ঘর হয়ে থাকেন হযরত আলী রাদি'আল্লাহু আনহু হলেন সেই ঘরের দরজা। সেই দরজায় পৌঁছানো মোটেই অত সহজ কোন কাজ নয়। বিংশশতাব্দীর মুসলিমের আলো আধারীর এই জামানায় অনেক উদ্ভট ভ্রান্তির উদ্ভব ঘটেছে, ঘটছে। সাহাবী রাদি'আল্লাহু আনহুদের অনুসরণ করার মত দু:সাহসও আজকের জামানার কেউ কেউ দেখাচ্ছে। এমন কি আল্লাহ্‌-র হাবিবের নক্ষত্রসম সাহাবী রাদি'আল্লাহু আনহুদের নিয়ে কুটুক্তি কটাক্ষ করতে দেখা যাচ্ছে অনেক ভ্রান্তমতবালম্বী ভন্ডদের। তারা আবার নিজেদের মুসলিম হিসেবে দাবীও করে!

অনেক ধরনের ভ্রান্ত মতবাদ বর্তমানের মুসলিমের মাঝে প্রচলিত। এক শ্রেণী ছয় উশুলের নামে গাঁট্টিবোস্কা নিয়ে পিকনিক স্টাইলে দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে, মসজিদকে ঘুমের ঘর বানিয়েছে; অথচ নিজের ইমানেরই খবর নেই। অন্যকে হেদায়েতের বাণী শুনিয়ে বেড়াচ্ছে, ঘরে বউ ছেলেমেয়ে কি করে বেড়াচ্ছে সেই খবর নেয়ার সময় পাচ্ছে না; এ কোন ধরনের ইসলাম? - এক দল পীরের পিছু ঘুরতে ঘুরতে নিজেরাই ফানাফিল্লাহ বাকাবিল্লাহ হয়ে যাচ্ছে,  অথচ আসল পীর মা-বাবার খোঁজখবর নেয়ারও ফুসরত পাচ্ছে না। মা-বাবার মুখপানে সদয় দৃষ্টিতে তাকানো যে সবচেয়ে বড় ইবাদত, তা না করে ভন্ড পীরের পানে চেয়ে থেকে রুহানি শক্তি তালাশে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরছে। 

বর্তমান জামানার পীরদের বড় বুজুর্গি পরিমাপ করা হয় কার উরসে কত বেশি উট দুম্বা গরু ছাগল এসেছে, কার কত বস্তা টাকা উঠেছে,  এসব দিয়ে; অথচ মুরিদ পীরের পাশের রুমে বসে বাজে কাজ করছে সেই খবরই রাখতে পারে না, অথচ নিজকে জাহির করতে চায় রুহানির সংবাদদাতা হিসেবে! আসলে, আধুনিক বিজ্ঞানের সুবিধা নিয়ে এই সব ভন্ডরা সাধারণ জ্ঞানহীন মুসলিমকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টায় ব্যস্ত। অন্য আরেক দল তো ইসলামকে রাষ্ট্রিয় বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অকাতরে রাষ্ট্রিয় সম্পদ বিনষ্ট করে চলছে। শত মত ও শত পথের  বিভ্রান্তিতে পরে অল্পজ্ঞানী মুসলিমদের মাঝে ইসলাম নিয়ে হতাশার উদ্বেগ হয়েছে। মুত্তাকীন ইমানদার মুসলিমরা সমাজ থেকে নিজেদের আড়াল করে নিয়েছে। প্রকৃত মুসলিম সেই, যে আল্লাহ্‌ ও আল্লাহ্‌-র রাসুলের প্রতি পুরোপুরি পায়বন্দ, নিজের ও পরিবার পরিজনের প্রতি সৎ ভাবাপন্ন।
 
ছহীহ বোখারী শরীফের ২য় খন্ডের ১৭ নং অধ্যায়ের ২৭৪৩ নং হাদিসে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে— হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা:) হতে বর্ণিত; নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বলেন- পূর্ব এলাকা হতে একদল লোক আত্নপ্রকাশ করবে, তারা কোর'আন পড়বে, কিন্তু কোর'আন তাদের গলার নীচে নামবে না ( অর্থাৎ, তারা অন্তর থেকে কোর'আন পাঠ করবে না)।  তারা তাদের দ্বীন এমনভাবে উপেক্ষা করবে, যেভাবে তীর শিকার অতিক্রম করে যায়। তারা পুনর্বার তাদের দ্বীনের দিকে ফিরে আসবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তীর তার নিজ স্থানে ফিরে না আসবে ( অর্থাৎ, তারা কোন দিনও ইসলামে ফিরে আসবে না)। 


ব্রিটিশ মদদে মদিনার পূর্বাঞ্চল নাজাত থেকে সেই ফিতনারই উৎপত্তি ঘটিয়েছিল আবদুল ওহাব নাজদী। আবদুল ওহাব নাজদীর মতবাদ বর্তমান মুসলিম বিশ্বে এক শ্রেণীর কাছে অহীতুল্য ( নাউজুবিল্লাহ)। আবদুল ওহাব নাজদী তার ওহাবী মতবাদে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে - হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামও আমাদের মতই একজন মানুষ! আমার মত একটি সাধারণ বিবেকের কাছেও এই মতবাদটি ভ্রান্ত ও অযৌক্তিক বলে প্রমাণিত হয়। কেন না - যে নবীর সৃষ্টি না হলে আসমান-জমিন, আরশ-কুরসী কিছুই সৃষ্টি হতো না, তিনি আবার নদু যদু মদু কদুর মতো মানুষ হন কি করে? - এই ভ্রান্ত মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আবদুল ওহাব নাজদী এমন সব কূটকৌশল অবলম্বন করেছিল যা ভাষায় বর্ণনা করার মত নয়। বর্তমানে আমাদের দেশে এই ভ্রান্ত মতবাদ মহামারীর আকার ধারণ করেছে। মুসলিমের সামাজিক অস্থিরতার কারনও নাজদীর ভ্রান্ত কিতাব। 

অনেকে হাজার বছর আগের হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহর চেয়েও বিজ্ঞ আলেম মনে করে উনবিংশ শতাব্দীর এই ভ্রান্তমতবালম্বীকে। যারা এমন মনে করে তাদের উদ্দ্যেশে বলছি - অন্ধত্ব দুর করার জন্য হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহর লিখা 'এহইয়াউল উলুমিদ্দীন' ও ওহাবীদের লিখা কিতাব পাশাপাশি রেখে পড়ে নিজের বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা খাটান, দেখবেন - সকল ভ্রান্তি কেঁটে গেছে। তাছাড়া - আপনি মারা গেলে কবরে আপনাকে কেউ কিন্তু জিজ্ঞেস করবে না - নবী নূরের তৈরী না মাটির তৈরী? - বরং যাঁকে সাধারণ বানাবার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছেন তাঁর পবিত্র চেহারা মোবারক কবরে দেখিয়েই আপনাকে প্রশ্ন করবে আন্ধা ফেরেস্তা। সেই কবরে, তাঁকে  না চিনতে পারলে কিন্তু খবর আছে! তাছাড়া রোজ-হাশরের ময়দানে কিন্তু অন্য কেউও সাফায়াত করতে আসবে না;  আপনার আমার আমাদের, তথা ইসলামের আলোক বর্তিকা, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আ'লামিনের প্রিয় হাবিব, দো-জাহানের বাদশাহ্ই এগিয়ে আসবেন। 

ওহাবী মতাদর্শের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো পরশ্রীকাতরতা। কেউ তাদের মতের বাইরে গেলেই বেদাত বেদাত বলে চিল্লিয়ে উঠে, মুর্তাদ বা নাস্তিক ফতোয়া দিয়ে সেই ব্যক্তিকে প্রাণে মেরে ফেলে। এসব কি ইসলাম সম্মত? বেদাত এর প্রকৃত সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ কি আপনারা জানেন?? কাউকে হত্যা করার আপনারা কে? নাকি আবদুল ওহাব নাজদী,  ওসামা-বিন-লাদেন, মওদুদীর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে মুসলিম বিশ্বকে অস্থির করে মার্কিনী চাল বাস্তবায়নের মরনপন চেষ্টা করছেন? মরার পর কোথায় যাবেন? - পত্রিকায় গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানলাম - ড. হুমায়ুন আজাদ, ব্লগার রাজিব, ভ্রান্ত পীর (গুপিবাগে জবাই হওয়া) সহ ছয় জন, বুয়েট ছাত্র ও সর্বশেষ মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে নির্মমভাবে জবাই করেছে এই ওহাবী ভ্রান্ত মতবালম্বীরাই। তারা অন্যের ভীন্ন মত মোটেও সহ্য করতে পারে না, এটি ওহাবীদের এক ধরনের হীনমন্যতা। প্রকৃতপক্ষে সত্যকে তারা ভয় পায়; তাই নিঃসংশয়তার আশ্রয় নেয়। সত্যই যদি আপনাদের কোর'আন হাদিসের উপর এতোটুকো বিশ্বাস থেকে থাকে - আল্লাহ্‌-র আজাব গজব ও রোষানলকে ভয় করুন।

কোন মানুষকে জবাই করে হত্যা করা কি ইসলাম সমর্থন করে? যে নবীর সৃষ্টি না হলে  কোন কিছুরই সৃষ্টি হতো না, সেই নবীর উম্মত দাবী করা বর্তমান এক দল ছলেবলে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামকে সাধারণ মানুষের কাতারে নামিয়ে আনার যে হীন চক্রান্ত বিগত এক শতাব্দী ধরে করে আসছে তা এক জঘন্য বিকৃত মানসিকতার পরিচায়ক, যা ভাবতেও খুব কষ্ট লাগে। স্টিফেন হকিংকে আপনারা নাস্তিক বলে গালাগালি করেন, বলেন তো আপনাদের কি বলে তিরস্কার করা উচিত? - ইহুদী খৃষ্টানদের পরকাল হিসাবনিকাশ নিয়ে তো আপনার আমার ভাবার কিছু নেই? - যে স্রষ্টা তাদের সৃষ্টি করেছেন তাঁর উপর ছেড়ে দেন না। নিজে মুসলিমের ঘরে জন্ম নিয়ে মুসলমান নিধনের যে মিশনে নেমেছেন, তা কতটা যৌক্তিক? - মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম এর প্রেমে দেওয়ানা ছিলেন, এটাই কি তাঁর অপরাধ? 

ছহীহ বোখারী শরীফ এর ইমান পর্বের ৩ নং অধ্যায়ের ৯ নং হাদিস - "প্রকৃত মুসলিম সে যে কথা ও কাজে অপর মুসলিমকে কষ্ট দেয় না।" 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১২-০৯-২০১৪.

৭টি মন্তব্য:

  1. এই রকম লেখা আরও পড়তে চাই।
    ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে আপনি এমন আরও লেখা লিখবেন।

    উত্তরমুছুন
  2. The Quran and Islam allows for much interpretation when it comes to science. ... However, much of science in Islam relies on the Quran as a basis of evidence and Islamic scientists often use one another as sources. Early Muslims pursued science with an underlying assumption of confirming the Quran. Excellent writings. May Allah bless you.

    উত্তরমুছুন