আমি বলি কি - ইচ্ছে করেই এক শয়তান ড্রাইভার দু'জন নিস্পাপ শিশু-কিশোর ছাত্র-ছাত্রীকে তার বাসের চাকায় পিষ্ঠ করে খুন করেছে, ছেঁচড়িয়ে আহত করেছে আরো অনেককে! বাচ্চাদের সব বন্ধুরা গর্জে উঠলো, দেশের সকল ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় নেমে পরলো - নিরাপদ সড়ক ও বাস ড্রাইভারের বিচারের দাবীতে। শুরু হলো পৃথিবীর ইতিহাসের সর্ব বৃহৎ সর্ব কনিষ্ঠ নাগরিক আন্দোলন এ'দেশে। এদিকে মোবাইল, ইমো ও ফেইজবুক মেসেঞ্জারে দেশ-বিদেশ থেকে কত শত মেসেজ যে এই কয়দিনে পেলাম তার কোন ইয়ত্তাই নেই! কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক বুঝতে যাচাই করতে গিয়ে পড়লাম এক মহা বিপদে! গতকাল উত্তরা থেকে এক বোনের অনুরোধে একটি মেসেজ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে যা আবিষ্কার করলাম তা এই মুহূর্তে এ জাতীর জন্য সত্যিই খুব ভয়াবহ ও ভয়ংঙ্কর এবং অত্যন্ত ভীতিকর একটি ব্যাপার।
ছোটবেলায় আমরা সবাই ইংরেজীতে হয়তো একটি গল্প পড়েছি - দ্য ফক্স উইদাউট এ টেইল বা লেজ কাটা শিয়াল; যা অত্যন্ত মজার ও প্রতি শিক্ষার্থীর জীবনে বাস্তবতা শিক্ষায় একটি অত্যন্ত মূল্যবান ও অতি গুরুত্বপূর্ণ গল্প। যদিও সবার জানা তারপরও গল্পের সারাংশ মোটামুটিভাবে না বললেই নয়— একদিন এক শিয়াল জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটছিল, হঠাৎ সে একটি ফাঁদে পড়ে যায়। অনেক কষ্টে সে ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসে, কিন্তু সে তার লেজটি হারায়। লেজবিহীন তাকে দেখতে খুবই অদ্ভুত লাগছিলো! লেজ হারানোর জন্য তার মনে ছিল প্রচণ্ড রকমের দুঃখ। শিয়ালটি ছিল অত্যন্ত রকমের চালাক বা ধূর্ত। সে মনে মনে একটি ফন্দি এঁটে সব শিয়ালকে একটি সভায় আমন্ত্রণ জানালো; যথা সময়ে শিয়ালরাসব সেই সভায় উপস্থিত হলো।
লেজবিহীন ধূর্ত সেই শিয়ালটি অন্যসব শিয়ালকে বললো, ‘আমার প্রিয় বন্ধুগণ! আমি যা বলি তা আপনারা শুনুন। আমি একটি নতুন ও অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করেছি - এই যে আমাদের লেজগুলো, সে সবের তো মোটেও কোন প্রয়োজনীয় জিনিস নয়, তাই দরকার নেই। একদিকে এটা দেখতে কদাকার এবং সবসময় নোংরা হয়ে থাকে, তাছাড়া বিপদে পড়লে ওটা নিয়ে দৌঁড়াতে ভীষণ সমস্যায় পরতে হয়; তাই আমি আমার লেজটি কেটে ফেলেছি। আপনারাও সবাই আপনাদের লেজ কেটে ফেলেন।'
সেই দলে ছিল এক বৃদ্ধ ও জ্ঞানী শিয়াল। সে ধূর্ত শিয়ালের সব কথা অতি মনোযোগ সহকারে শুনে পরিশেষে বললো, ‘আমার প্রিয় বন্ধু! তোমার পরিকল্পনা খুবই মজার, তবে বোকামিপূর্ণ! তোমার লেজ নেই, আমি জানি তা ফাঁদে পরে কাটা গেছে। তাই তুমি কূট-বুদ্ধি করে চাইছো আমাদের সবার লেজটাও কাটতে!'
আমাদের বর্তমান সমাজে এমন শিয়ালের সংখ্যা এতো বেশি বেড়েছে এতো বেশি হয়েছে, তারা নিজেরাই জানে না আসলে তারা কি করতে চাইছে? ছোটকালের এ গল্পের শিক্ষা আমরা কে কতটা গ্রহণ করেছি বা কতটা নিয়েছি তা আমার জানা নেই। আসলে কি— জানতে হবে বুঝতে হবে আমাদের মানব সমাজের অতি ধূর্ত লোকগুলো সৃষ্টির সেই শুরু থেকেই সব সময় নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করতে বা তাদের মতো সবাইকে বানাতে হরেক রকম ছলা-কলার আশ্রয় নেয় এবং নিতে পারে; তাই হুট করে ইমোশনাল হয়ে কোন কিছু করা কারো জন্যই মঙ্গল হবে বলে আমার মনে হয় না। বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে দেখতে হবে, ভাল মন্দ উভয় যাচাই করতে হবে। কারো বক্তব্য বা কোন কিছু সামনে আসলে আগে সে'সবের উদ্দেশ্য জানার বা বুঝার চেষ্টা করতে হবে; তারপর সমর্থন বা অসমর্থন।
এ'দেশে নীতিকথা আমরা সবায় বলি, কিন্তু কেউ নিজের বাস্তবিক জীবনে সে'সব প্রয়োগ করি না; নিজে চুরি করি, আবার অন্যকে বলি চোর! আর কেউ যদি হটাৎ করে আমাদের সামনে বলে উঠে - চিলে কান নিয়ে গেছে; আমরা বেশিরভাগ লোক চিলের পিছে দৌঁড়াই, মাথার সাথের ছোট্ট এই কানটিতে হাত দিয়ে দেখি না! তাই তো সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে এ'দেশে রিউমার ছড়ানো সহজ হয়েছিল, ছাব্বিশ ট্রাক হেফাজতিদের লাশ শাপলা চত্তর থেকে গায়েব করে দিয়েছিল সরকার(!), এ'সব বলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা সহজ হয়েছিল। ঠিক তেমন করেই গতকাল ধানমন্ডিতে চার জন ছাত্র মারা গেছে, দু'জন ছাত্রী ধর্ষিতা হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো সহজ হয়েছে এবং হচ্ছে!
আসলে অতিরিক্ত মিডিয়া হয়ে এবং বিশেষ করে ফেইজবুক ইমো এসে মানুষকে এখন এক মহা যন্ত্রণাই ফেলে দিয়েছে! বিশেষ করে ফেইজবুক এখন এমন একটি মিডিয়া যেখানে টিকে থাকতে চাইলে যে কারো বিবেক লাগবে, বুদ্ধি লাগবে এবং সর্বপরি ভাল একজোড়া চোখ থাকতে হবে। অবশ্য এ ব্যাপারে শুধু ফেইজবুকের দোষ দেয়া যায় না। ওখান থেকেও শিখার আছে অনেক কিছু। কিন্তু আমরা অনেকেই সে'সবের ধারেকাছেও যাই না। বেশিরভাগ লোকই এখানে ব্যস্ত থাকে যতসব ধার্মিক প্রপাগান্ডা আর যতসব অসত্য রিউমার নিয়ে! যখনই কেউ কোন কিছু এখানে বলে বা লিখে বা উপদেশ দেয়, তখন তা কি সঠিক না বেঠিক তা অবশ্যই আমাদের বিবেকের তুলাদণ্ড দিয়ে আগে যাচাই করা উচিত; তারপর বিশ্বাস।
এই তো সে'দিন এক অমানুষ বাস ড্রাইভার দু'জন কিশোর ছাত্র-ছাত্রীকে প্রত্যক্ষ খুন করে ফেললো; তাতে তাদের বন্ধুরা সব জেগে উঠলো। দেশের সকল ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় নেমে গেলো, নিরাপদ সড়ক চাই ও বাস ড্রাইভারের বিচারের দাবীতে আন্দোলন শুরু করে দিল, পরদিন এলো ৯ দফা; সরকার সব মেনেও নিলো। ড্রাইভাররা খুন তো করছে সব সময়ই, বছর ধরেই; আমরা বড়রা পেরেছি কি দীর্ঘদিন লেখালেখি বা রাস্তায় প্যাঁকপ্যাঁক করে বা টকশোতে ঠকঠক করে সরকারকে এ'সব দাবীর একটিও মানাতে? পারিনি!
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে, এ'সব ছোট্ট শিশু-কিশোরদের থেকে আমরা বড়রা এখন এ শিক্ষাটা গ্রহণ করলেই হয়। এই যে আমাদের শিশু-কিশোর সন্তানরা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার বিপর্যয়, ত্রুটিগুলো পুরো জাতির চোখে আঙ্গুল দিয়ে আজ দেখিয়ে দিলো - দেশের জজসাব থেকে শুরু করে সিধেল চোরসাব পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের প্রতিটি ছোট বড় পদের লোকজনই আমরা অবৈধ অনৈতিকতায় আবদ্ধ, তা প্রত্যক্ষ করে কি আমরা কিছুই শিক্ষা নিতে পারিনি, পারবো না?
বিগত কয়দিন ধরে যে ছাত্র আন্দোলন চলেছে তা ছিল অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ ও সার্বজনীন সমর্থনযোগ্য; আমিও ব্যক্তিগতভাবে কয়দিন রাস্তায় গিয়েছি, ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে থেকেছি, তাদের সাথে কথা বলেছি, ওদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছি। এক সময় বুঝতে পারলাম এই যৌক্তিক দাবীর আন্দোলনটিও সাবোটাজ হয়ে যাচ্ছে এবং অলরেডি গেছে। কিন্তু কেন? এ'দেশে চলে ক্ষমতা আর ভোটের রাজনীতি! তবে, তোমরা দেশকে যে মেসেজ দিয়েছো, তাই যথেষ্ট। দিনে দিনে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে করে যে কোন সময় যে কোন স্থানে বড় ধরণের কোন অঘটন বা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কে নিবে এর দায়?
সে আশঙ্কা থেকেই আমি বার বার অনেককে সতর্ক করেছিলাম। ছোট্ট ছোট্ট হাটুর বয়সি বাচ্চাদের সাথে কথা বলে যতটা বুঝতে পেরেছি তা হলো - বড়দের সবার উপর তাদের প্রচণ্ড ক্ষোভ থেকেই তাদের এই রাস্তায় নামা। কেউ যদি মনে করে থেকে থাকে কোন দলকে প্রাধান্য দিতে তারা আন্দোলন শুরু করেছিল, তা হলে সেটি হবে চরম বোকামি এবং পরম ভুল। কিন্তু সময়ের দীর্ঘ সূত্রতায় যখনই এ'দেশের লেজকাটা শিয়ালরা আন্দোলনে ঢুকে পরলো, তখনই লক্ষ্য করেছি বিষয়টি অন্যদিকে টার্ন নিয়েছে। তাই বলছি—
প্রিয় বাচ্চারা, তোমরা হয়তো ভাববে স্যার তোমাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে; মোটেও তা নয়। তোমরা এখনো দেশ চালনোর মতো উপযুক্ত হওনি। ইমোশন আর ক্ষোভ দিয়ে একটি রাষ্ট্র চালানো যায় না। একটু লক্ষ্য করো- তোমাদের দাবী সরকার মেনে নেয়ার পরও তোমরা রাস্তায় বসে নিরাপদ সড়ক চাচ্ছো! অথচ, সারা দেশ এরই মাঝে প্রায় অচল হয়ে গেছে, জনজীবনে দূর্যোগ নেমে এসেছে। সরকারি কাজ বাদই দিলাম, ব্যক্তিগত অতি জরুরি কাজটিও অনেকে করতে পারছেন না, যানবাহন না চলায়।
এ'দেশে কয় জনের প্রাইভেট কার আছে? আর কত? শুধুমাত্র সড়ক নিয়েই কি একটি দেশ একটি সরকার? দেশের প্রতিটি কাজ এরই মাঝে প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। অতএব সরকারের তো যে কোন প্রদক্ষেপ নিতেই হবে, তাই না? তোমরা তো দেখলে এবং বুঝতে পারলে দেশের বেশিরভাগ লোকই করাপটেড! তাই তোমরা সঠিক পথে গড়ে উঠতে চেষ্টা করো; দূর্নীতি ও অনিয়মকে ঘৃন্না করো।
প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা, যার যে কাজ তাদেরকে সে কাজ করতে দাও, তোমরা ঘরে ফিরে যাও; লেখাপড়ায় মনযোগ দাও। এবং নিজ নিজ ঘর থেকেই এখন তোমরা নতুন এক আন্দোলন শুরু করো- যার বাবা ড্রাইভার সে তার বাবাকে বলো সঠিক ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে রাস্তায় সাবধানে গাড়ি চালাতে, যার বাবা পুলিশ সে তার বাবাকে বলো সৎ ও সঠিক পথে তাঁকে চলতে, যার বাবা সরকারি চাকুরে সে তার বাবাকে বলো ঘুষ না খেতে, যার বাবা ব্যবসায়ি সে তার বাবাকে বলো খাদ্যে বা পণ্যে বেজাল না দিতে, অতি মুনাফা না করতে, সব্বাই নিজ নিজ বাবাকে বলো ঘুষ দিয়ে তোমাকে স্কুলে ভর্তি না করতে, ক্লাস টিচারকে ক্লাসে পড়াতে বলো - প্রাইভেট পড়ানো বাদ দিতে বলো, সবাই সবার বাবা-মা ও শিক্ষকসহ আসপাশের সবাইকে বলো অনৈতিকতা অনিয়ম সব পরিহার করতে। শিক্ষককে সব সময় চোখে চোখে রাখো; দেখবে, সব কিছু সুন্দর হয়ে যাবে এবং অত্যন্ত ভাল ভাবে চলবে আমাদের গোটা দেশ। তোমরাই এ দেশ ও জাতীর আসল চাকা; তোমরা ঘুরলেই দেশ ঘুরবে॥
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৫ আগস্ট, ২০১৮.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন