শনিবার, ২০ জুন, ২০২০

পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?

গভীর রাত। এক আজানা আশংকায় বুকটা ভার হয়ে আছে। কিছুতেই চোখে ঘুম আসছে না, ঘুমাতে পারছি না। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে কতগুলো নিস্পাপ মুখ। কি দেখলাম সারাটা দিন, সারাটা বিকাল, সন্ধ্যা থেকে রাত? দলে দলে তারা পতঙ্গের মতো ছুটে আসছে ঢাকার দিকে! ওরা গার্মেন্ট কর্মী। সরকার করোনাভাইরাসের পাদুর্ভাবে সারা দেশকে লকডাউন করতে ছুটি দিয়েছে। সাধারণ ছুটি মনে করে তারা যে যেভাবে পেরেছে ছুটে চলে গেছে বাড়িতে। ছুটি শেষ, যানবাহন বন্ধ তাতে কি? ট্রাকে চড়ে বা পায়ে হেঁটে আবার দলবেঁধে চলে এসেছে ঢাকায়! করোনা নামক যে প্রাণঘাতি ভাইরাসটি সারা দুনিয়াকে তটস্থ করে চলছে, তার কোন তোয়াক্কাই তাদের নেই! 

মিডিয়াতে চিল্লাচিল্লির পর দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখার জন্য মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন বিজিএমইএ-এর সভাপতি ড. রুবানা হক। গার্মেন্টস মালিকরা হয়তো এই অনুরোধ মেনে নিয়ে ছুটি ঘোষণা করবেন। কিন্তু এই কাজটা ওরা আসার আগে গতকাল করলেন না কেন? এই ভাসমান মানুষগুলো এখন কোথায় যাবে? ঢাকা সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর শহর। ওরা যদি আক্রান্ত হয়, তাদের দায়দায়িত্ব কে নেবে? 

এক শ্রেণীর লোকজন মানুষকে বিপদে ফেলে মজা পায়, দেশের আইনকে তারা মোটেও তোয়াক্কা করে না; তাদের ভাব— কিসের সরকার কিসের কি? গার্মেন্টস মালিকরা তাই করে দেখালো দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে। সর্বোপরি, বারংবার ঘুরেফিরে আমার মাথায় একটি প্রশ্নই আসছে— এই কঠিন লকডাউনের মধ্যে আর্মির চোখ ফাঁকি দিয়ে এতো এতো লোকজন ঢাকায় আসলো কি করে? আর্মিরাই-বা তাদের আটকায় নি কেন??
   
ল্যাটিন অ্যামেরিকার একটি দেশ যার নাম ইকুয়েডর। ইকুয়েডরের সবচেয়ে জনবহুল শহর গুয়াইয়াকিল। ওখানে করোনাভাইরাস মহামারিতে শুধু হাসপাতালে মানুষ মারা যাচ্ছে না, মানুষকে রাস্তায় মরে পড়ে থাকতেও দেখা যাচ্ছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মরদেহগুলো সরিয়ে নিতে সে দেশের আর্মিকে নিয়োজিত করা হয়েছে। তা সরাতেও কয়েকদিন সময় লেগে যাচ্ছে। 

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইকুয়েডরের গুয়াইয়াস প্রদেশে করোনাভাইরাসের কারণে ১ এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত যত জনের মৃত্যু হয়েছে, তা ল্যাটিন অ্যামেরিকার সবগুলো দেশ মিলিয়ে মারা যাওয়া মানুষের চেয়েও বেশি। পুরো প্রদেশে মোট ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৯৩৭ জনের; মোট আক্রান্তের ৭০ শতাংশ রোগীর বসবাস এই শহরেই। এটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শহরগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে মাথাপিছু করোনাভাইরাস আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। তার ওপর ভাইরাস পরীক্ষার আগেই যারা মারা গেছে, তাদের কোন পরিসংখ্যানই  রাখা হয়নি। 

ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, চীনে ৫০ হাজার মানুষ করোনায় মারা গেছে; যদিও চীন তা অস্বীকার করছে। ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের পরিণতি কি ভয়ঙ্কর ভয়াবহ সারা পৃথিবী তা দেখছে। শুরুতে তারা বেশ উদাসীন ছিল; কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলেনি। এখন তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা শুধু ভেঙেই পড়েনি, কঠিন যুদ্ধ করেও লাশ ও আক্রান্তের মিছিল  কিছুতেই থামাতে পারছে না। লাশের প্যাকেট খুঁজতে হচ্ছে আমেরিকাকে। কি ভয়ানক ভয়াবহ অবস্থা! মিলানের কবরস্থানে লাশ রাখার  জায়গা নেই। 

ইউরোপ আমেরিকায় মিনিটের হিসাবে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। চিকিৎসকরা ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছেন; আরও চিকিৎসক দরকার নিউ ইয়র্কে। দুনিয়া কাঁপানো হোয়াইট হাউস অসহায় পর্যদুস্ত। অত উন্নত দুনিয়া উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার দেশের যদি এই দশা হয়, আমাদের মতো দুর্দশাগ্রস্ত  চিকিৎসা নির্ভর দেশে একবার মহামারী দেখা দিলে কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হবে তা ভেবে দেখেছেন কি? 

ইতালিতে মহামারি দেখা দিয়েছে আক্রান্তের ৪৫ দিন পর, স্পেনে ৫০ দিন পর, যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫ দিন পর, আমরা আক্রান্ত হয়েছি ৮ মার্চ, এখনো ৩০ দিন পাড় হয়নি। এরই মধ্যে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি? ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ছি? আমরা এতোটা নিশ্চিন্ত হই কি করে যে আমাদের দেশে করোনাভাইরাস তেমন একটা সুবিধা করতে পারবে না? ওহ! কাঠমোল্লা আর ইমোশনাল মুসলিমের চিন্তা মাথায় ঢুকেছে? আল্লাহ আমাদের হেফাজত করবেন? —অবশ্যই। কিন্তু আপনাকে সতর্কতা অবলম্বন করার কথা তো এই আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলাই বলেছেন।  

দেখেন ভাই, না কাজ করে যদি আপনি ঘরে বসে খাবার আল্লাহ দিবে বলে বসে বসে জপ করেন, খাবার কিন্তু আল্লাহ এসে আপনার মুখে তুলে দিয়ে যাবেন না। আগুন ধেয়ে আসতে দেখে যদি না দৌঁড়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলেন- আল্লাহ বাঁচাবে, আপনি পুড়বেন না কি, মরবেন না কি? মসজিদে আপনি যেমন যান, আমিও যাই; মসজিদ আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। ফজর থেকে এশা নিয়মিতই আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা আমাকে মসজিদে যেয়ে নামাজ আদায় করান। কিন্তু, বিগত কয়েকদিন আগে করোনাভাইরাস দেশে প্রবেশ করার পর আর যাওয়া হয়নি। 

একদিন হটাৎ আমার মনটা খচ্ করে উঠলো, মনে হলো— মসজিদে মুসুল্লির সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে, কিন্তু নিয়মিত মুসুল্লি যারা ছিলেন তাদের কাউকেই আশেপাশে দেখছি না; বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুললো। একটু পর্যবেক্ষণ করতেই বুঝে গেলাম ওরা কেউ আগের মুসুল্লি নন, নতুন মুসুল্লি নতুন নামাজী। তবে আলহামদুলিল্লাহ! ওদের আল্লাহ অন্ততঃ এক উছিলায় হেদায়েত করেছেন। গবেষণা করে দেখলাম, ওরা আসলে বেশিরভাগই ইমোশনাল মুসলিম, প্রাকটিসিং মুসলিম তারা নন। 

জীবন থেকে নেয়া কিছু অভিজ্ঞতা— যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে খারাপ কাজ করে সে-ই আবার কথায় কথায় আল্লাহর উপর কসম খান, সমাজের সবচেয়ে দূর্নীতিবাজ ঘুষখোর ব্যক্তিটিকে দেখেছি বার বার ওমরাহ/হজ্জ করতে মক্কা মদিনা যেতে! মিথ্যার সাথে যার বসবাস তাকেই দেখেছি মসজিদে প্রথম কাতারে বসতে, মদখোরকে দেখেছি মসজিদের সেক্রেটারী/সভাপতি হতে, তাছাড়া সমাজে একশ্রেণীর লোক আছে যারা বিপদ-আপদ দেখলে মসজিদে দৌঁড়ান; আমি তাদেরকেই বলি ইমোশনাল মুসলিম। 

করোনাভাইরাস লকডাউনে দেখলাম ইমোশনাল মুসলিমের আনাগোনা মসজিদে বেড়ে গেছে। ওরা তো প্রকৃত দ্বীনে সত্যবাদী নয়। আল্লাহর হাবীব বলেছেন, 'আক্রান্ত ব্যক্তি মসজিদে আসবে না।' ওরা হয়তো এই মরণ ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মসজিদে এসে পড়বে। হয়তো মনে করবে মসজিদ নিরাপদ জায়গা, ওখানে আসলে আল্লাহ ভালো করে দেবেন। এ দিকে সে যে কতজনকে এই ভাইরাসে আক্রান্ত করে দিয়ে গেল, তার হিসাব কে রাখবে? এই ভেবে মসজিদের জামাত পরিত্যাগ করলাম। না যেয়ে যদি ভুল করে থাকি ছওয়াব দেয়া না দেয়ার মালিক যিনি তিনিই হিসাব নিবেন পাপ-পূণ্যের।

প্রায় সকল দেশেই মসজিদগুলো বন্ধ হয়ে গেছে; আল্লাহর ঘর বন্ধ করার যোগ্যতা রাখে কে? হেরেম শরীফ, মসজিদে নববী বন্ধ করার অধিকার কার আছে? —নিশ্চয়  স্বয়ং আল্লাহর। আমাদের পাপে দুনিয়া ভরে গেছে। তাই তিনি আমাদের জন্য তাঁর ঘরে প্রবেশ বন্ধ করে দিচ্ছেন।

আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের সরকার আমাদের মসজিদগুলো আবাদের নির্দেশ দিয়েছেন। ইমামসাব মুয়াজ্জিনসাব খাদেমসাব আরও দু/চারজন নির্দিষ্ট নিশ্চিত পরিচিত মুসুল্লি নিয়ে মসজিদ আবাদ করার জন্য। চার জন হলেই মসজিদে জামাত করা যায়; ইফা-র ঘোষণাও তাই। কিন্তু দেশের এই ক্রান্তিকালেও দেখা যাচ্ছে অতি আবেগি বা ইমোশনাল মুসলিমরা জামাতে শরিক হতে দলে দলে মসজিদে চলে যাচ্ছেন। আপনি কি নিশ্চিত, মসজিদে করোনাভাইরাস আক্রান্ত কোন ব্যক্তি যায়নি বা যেখানে সেজদা করছেন সেখানে ভাইরাসটি লেগে নেই? 

এই ভাইরাসটি খুবই ছোঁয়াচে; লোক থেকে লোকে বা বাহক থেকে বাহকে অনুপ্রবেশ করে। দেশে দেশে সরকার ছুটি ঘোষণা করে বারবার ঘোষণা দিচ্ছে— ঘরে থাকো, পৃথিবীর দেশে দেশে বিজ্ঞ আলেম-ওলামাগণ কিয়াস করে বলে দিয়েছেন, হোম কোয়ারেন্টাইনে যাও এবং ঘরে নামাজ আদায় করে নাও। অতএব, এতো রিক্সে না যেয়ে ঘরে নামাজ আদায় করলে যদি আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা নামাজ কবুল করে নেন, ক্ষতি কি?? 

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা  সবায় বেশ অস্থির এবং মনস্তাপ নিয়ে কোয়ারেন্টাইনে আছি, প্রতিটি মূহুর্ত যাচ্ছে আমাদের চরম উৎকণ্ঠায়। ফোনটা বেজে উঠলে মনে হয়— কোন খারাপ খবর এলো না তো? আজ যা ঘটলো তার জন্য না জানি জাতিকে আবার কোন মাশুল গুনতে হয়? আমাদের কারো অসততায় বা অসতর্কতায় যদি ভাইরাসটি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং মহামারীতে রূপ নেয়, এই জনবহুল ঘনবসতিপূর্ণ দেশটার কোথায় পালিয়ে আপনি আপনাকে রক্ষা করবেন?? অতএব, সাবধান।।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন