মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-এর একটি রেওয়ায়েত- 'উমর বিন মায়মূন (রঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, রোগীর জন্য বসে নামায জায়েয হওয়ার আলামত কি? তিনি বললেন, যখন সে তার দুনিয়াবী কাজের জন্য দাঁড়াতে পারেনা, তখন বসে নামায পড়বে।’
যে ব্যক্তি জমিনে সিজদা করতে সক্ষম নয় তার ব্যাপারে হানাফী ফকীহগণের প্রসিদ্ধ মত- 'এমন ব্যক্তির উপর দাড়িয়ে নামায আদায় করা জরুরী নয়, বরং সে বসে ইশারায় নামায আদায় করবে।'
এ বক্তব্যটি যদিও একেবারে দলীলবিহীন নয়, কিন্তু অনেক মুহাক্কিক ফকীহের দৃষ্টিতে এই মাসআলায় দলীলের বিচারে ফিকহে হানাফীর এই বক্তব্য বেশি শক্তিশালী, যা ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-র শাগরিদ ইমাম যুফার ইবনে হুযাইল (রঃ)-এর মতামত; আর এটাই বাকী তিন ইমামের {ইমাম মালেক (রঃ), ইমাম শাফেয়ী (রঃ) এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ)} মত। আর তা হলো- এমন ব্যক্তি (যে ব্যক্তি জমিনের উপর সিজদা করতে অক্ষম) যদি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে সক্ষম হয়, তাহলে তাকে দাঁড়িয়েই নামায আদায় করতে হবে। আর যেহেতু সে সিজদা করতে অক্ষম তাই সে ইশারায় সিজদা করবে (যদি রুকু করতেও অক্ষম হয়, তাহলে রুকুও ইশারায় আদায় করবে)। জমিনে সিজদা করতে অক্ষম হওয়ার কারণে কোন অবস্থায়ই দাঁড়ানোর ফরয ছাড়া যাবে না।
বর্তমান বিশ্বের খ্যাতনামা মুফতী জাস্টিস মুহাম্মাদ তকী উসমানী নতুন ফতওয়ায় এ মাসআলাটির উপর বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, কিয়ামের ফরয আদায় থেকে শুধু ঐ ব্যক্তি ছাড় পাবে, যে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম। সিজদা করতে অক্ষম হওয়ার কারণে কিয়াম-এর ছাড় পাবে না। তিনি সেখানে বিশদভাবে এ কথারও খন্ডন করেছেন যে, শুধু সিজদার জন্য কিয়াম ফরয করা হয়েছে। তাই সিজদা করতে অক্ষম হলেই তার জন্য কিয়াম জরুরী থাকে না। একাধিক দলীল দ্বারা তিনি এ কথাটি প্রমাণ করেছেন যে, কিয়াম নামাযের একটি স্বতন্ত্র ফরয, যা শুধু সিজদার জন্য নয়।
এমন কি মুফতি তকী উসমানী এই ফতওয়ায় এ কথাটিও লিখেছেন যে, যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামায শুরু করতে পারে, কিন্তু সিজদার জন্য জমিনে বসার পর আবার দাঁড়াতে তার অনেক কষ্ট হয়, এমন ব্যক্তিও কিয়াম (দাঁড়িয়ে নামায পড়া) একেবারে ছাড়বে না। বরং প্রথম রাকাত দাঁড়িয়ে আদায় করবে। এরপর দাঁড়াতে কষ্ট হওয়ার কারণে বাকী নামায বসে আদায় করবে।
এর সাথে তিনি এ বিষয়টিও অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, জমিনের উপর সিজদা করতে অক্ষম কোন মুসল্লী যদি ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী আমল করে এবং পুরা নামায বসে আদায় করে এবং ইশারায় রুকু সিজদা করে তাহলে তার নামায ফাসেদ হয়েছে বলব না; কারণ, গায়রে মুজতাহিদের (মুজতাহিদ নয় এমন) জন্য মুজাতাহিদের ‘কওল'ও (বক্তব্য) দলীলে শরয়ী। সুতরাং যে ব্যক্তি সে অনুযায়ী আমল করেছে আমরা বলবো না তার নামাজ ফাসেদ হয়েছে।
যে ব্যক্তি শুধু আরামের জন্য অথবা মামুলি কষ্টের বাহানায় চেয়ারে নামায আদায় করছেন তিনি মস্ত বড় ভুল কাজ করছেন; এভাবে নামায আদায় করার দ্বারা তার নামাযই হবে না। তার উপর ফরয দাঁড়িয়ে নামায আদায় করা এবং যথা নিয়মে রুকু সিজদা আদায় করা।
আর যে ব্যক্তি জমিনের উপর বসে নামায আদায় করতে সক্ষম তার জন্য শুধু এই বাহানায় চেয়ারে বসে নামায আদায় করা ঠিক নয় যে, সে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে বা রুকু সিজদা করতে অক্ষম। বরং এ ধরণের লোকেরা জমিনে বসে নামায আদায় করবে। চেয়ারে বসে নামায আদায় করবেন শুধু ঐ লোকেরা যারা জমিনে বসে নামায আদায় করতে অক্ষম।
মুফতি তকী উসমানী তাঁর সদ্য লেখা এ ফতওয়ায় চেয়ারে বসে নামায আদায় করার ক্ষতির দিকগুলো আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘জমিনে বসে নামায আদায় করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও ইদানীং চেয়ারে বসার যে প্রচলন দেখা যায় তাতে বিভিন্ন দিক থেকে আপত্তি রয়েছে।
১). মাযুর ব্যক্তিদের জন্য জমিনে বসে নামায আদায় করাই উত্তম ও মাসনূন তরীকা। এর উপরই সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম এবং পরবর্তীদের আমল চলে আসছে। চেয়ারে বসে নামায আদায় করার রেওয়াজ কেবল শুরু হয়েছে! খায়রুল কুরূনে এর নযীর নেই; অথচ সে যুগে মাযুরও ছিল, চেয়ারও ছিল।
২). যে ব্যক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে মাযুর নয়, অর্থাৎ কিয়াম, রুকু সিজদা করতে সক্ষম, তার জন্য জমিনে বা চেয়ারে বসে ফরয এবং ওয়াজিব নামায আদায় করাই জায়েয নয়; অথচ কখনো কখনো দেখা যায় এ ধরণের সুস্থ ব্যক্তিও সামনে চেয়ার পেয়ে চেয়ারে বসে নামায আদায় করে নেয়। ফলে, তার নামাযই হয় না।
৩). চেয়ারের ব্যবহারের কারণে কাতার সোজা করা ও সোজা রাখার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অথচ মিলে মিলে দাঁড়ানো ও কাতার সোজা করার বিষয়ে হাদীস শরীফে জোর তাকীদ এসেছে।
৪). বিনা প্রয়োজনে মসজিদে চেয়ারের অধিক্যের কারণে তা নাসারাদের গির্জা ও ইহুদীদের উপাসনালয়ের সাদৃশ দেখা যায়; তারা গির্জায় চেয়ার ও বেঞ্চে বসে উপাসনা করে। আর দ্বীনী বিষয়ে ইহুদী নাসারা ও অন্যান্য জাতির সাদৃশ্য থেকেই নিষেধ করা হয়েছে।
৫). নামায তো এমন ইবাদত যা আদায় করতে হয় বিনয়াবনত হয়ে বিগলিতচিত্তে। আর চেয়ারে বসে নামায আদায় করার চেয়ে জমিনে বসে নামায আদায়ের মাঝে তা পূর্ণমাত্রায় পাওয়া যায়।
৬). কোন কোন যুবক ও সুস্থ ব্যক্তি নামাযের পর মসজিদে রাখা চেয়ারে বসে আরাম করে। কখনো কখনো চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসে আলাপচারিতায় লিপ্ত হয়। এটা মসজিদের পবিত্রতা, মার্যাদা ও আদবের খেলাফ।
৭). মসজিদে চেয়ারের ব্যবহারের কারণে কোন কোন ছুরতে কুরআনে কারীম এবং মুরববী নামাযীদের আদব ও এহতেরামের ব্যত্যয় ঘটে।'
এমন স্পষ্ট বক্তব্য দেয়ার পর তিনি আবার এটাও লিখেছেন যে, রুকু সিজদা করতে অক্ষম ব্যক্তিগণ জমিনের উপর বসে ইশারায় নামায আদায় করতে সক্ষম হওয়ার পরও যদি চেয়ারে বসে নামায আদায় করে থাকেন, তাহলে সেটাও জায়েয, কিন্তু অনুত্তম কাজ। আর দারুল উলূম দেওবন্দের ফতওয়ায় এটাকে শুধু অনুত্তমই বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে, তা বিভিন্ন কারণে কারাহাত মুক্ত নয়।
আমার যতদূর জানা আছে তা হলো- আমাদের দেশের বিভিন্ন দারুল ইফতার ফতওয়াও এটাই; মারকাযুদ দাওয়ার দারুল ইফতার ফতওয়াও এটাই যে, রুকু সিজদায় অক্ষম ব্যক্তিগণ জমিনে বসতে সক্ষম হলে তাদের জন্য চেয়ারে বসে নামায আদায় করা মাকরূহ; যা পরিহার করা জরুরী। আর রুকু সিজদায় সক্ষম ব্যক্তি যদি এমনটি করে তাহলে তো তার নামাযই শুদ্ধ হবে না।
মোদ্দাকথা, যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পদ্ধতি হলো- জমিনে বসে তা আদায় করা। আর যে রুকু সিজদা করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পন্থা হলো- ইশারায় তা আদায় করা। আর যে ব্যক্তি যমিনে বসে নামায আদায় করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প হলো- চেয়ারে বসে নামায আদায় করা। কেবলমাত্র প্রথম ও দ্বিতীয় ওযরের কারণে চেয়ারে বসে নামায আদায় জায়েয নয়।
যদি কেউ দাঁড়াতে সক্ষম না হয় তাহলে সে বসে নামাজ আদায় করবে। বসতে সক্ষম না হলে শুয়ে নামাজ আদায় করতে হবে। বসে নামাজ আদায় করা মানেই জমিনে বা ফ্লোরে বসে আদায় করা। সহীহ বুখারি শরিফসহ হাদিসের বিভিন্ন কিতাবে এসেছে- সওয়ারি থেকে পড়ে একবার হুজুরপাক (সাঃ) আহত হয়েছিলেন, তখন তিনি জমিনে বসে নামাজ আদায় করেছেন। নবী কারীম (সাঃ)-এর যুগেও কিন্তু চেয়ার বা চেয়ার সদৃশ বস্তু ছিল। তাছাড়া মাজুর অবস্থায়ও হুজুরপাক (সাঃ) চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করেননি।
হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) বলেন, আমি হুজুরপাক (সাঃ)-কে অসুস্থ ব্যক্তির নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে; তা সম্ভব না হলে বসে। তাও সম্ভব না হলে শুয়ে নামাজ আদায় করবে। (বুখারি ১/১৫০ তিরমিজি ১/৮৫) এ হাদিস দ্বারা স্পষ্ট এ'টাই বুঝা যায় যে, দাঁড়াতে সক্ষম না হলে (জমিনে) বসে, তাও সম্ভব না হলে শুয়ে নামাজ আদায় করতে হবে। সুতরাং হাদিস থেকে এ কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, চেয়ারে বসে নামাজ কোনো অবস্থাতেই সহি নয়।
সুতরাং যিনি দাঁড়াতে সক্ষম কিন্তু নিয়ম মতো রুকু সিজদা করতে অক্ষম তিনি দাঁড়িয়ে-ইশারা করে নামাজ আদায় করবেন। চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করলে সহি হবে না। -(বাদায়ে ১/২৮৬)
যারা দাঁড়াতে ও রুকু সিজদা করতে অক্ষম তারা জমিনে বসে ইশারায় নামাজ আদায় করবেন। তাশাহুদের নিয়মে বসতে না পারলে যেভাবে বসতে পারেন সেভাবেই বসবেন। চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করলে নামাজ সহি হবে না।
কোনোভাবে বসতে না পারলে শুয়ে নামাজ আদায় করতে হবে; তা-ও চেয়ারে বসে নয়।
মো:আবু বকর ছিদ্দীক নামের একজন আললামা শামী (রঃ)-কে প্রশ্ন করেছিলেন, 'আস্সালামু আলাইকুম। হযরত, আমার নানীর কোমরের সমস্যা। এখন দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে সমস্যা হয় এবং রুকু করতে এবং সেজদা করতে খুব বেশি ব্যাথা করে এখন উনি কি চেয়ারে নামাজ পড়তে পারবে?'
তাঁর জবাব - ওয়ালাইকুম সালাম! আপনার নানী যদি জমিনে বসে নামায পড়তে পারেন, তাহলে জমিনে বসে নামায পড়বেন। এক্ষেত্রে তাশাহুদ অবস্থার মতো বসা আবশ্যক নয়; বরং যে আসনে বসলে আরাম হয়, সেভাবেই মাটিতে বসে ইশারা করে নামাজ আদায় করবেন। চেয়ারে বসা উচিত নয়। কারণ, শরিয়ত এমন অপারগদের মাটিতে বসার ব্যাপারে পূর্ণ ছাড় দিয়েছে। যে আসনে সম্ভব হয়, সেভাবেই বসে নামাজ আদায় করবে। (দুররে মুখতার মাআ শামী- ২/৫৬৬)
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৫ মে, ২০১৯.
👍👍👍👍👍
উত্তরমুছুনধন্যবাদ!
মুছুনরেগুলার লিখা চাই।
উত্তরমুছুনপাবেন ইনশাআল্লা!
মুছুনআসসালামু'আলাইকুম,
উত্তরমুছুনঅত্যন্ত জরুরী বিষয়টি নিয়ে তথ্যবহুল আলোচনার জন্য ধন্যবাদ।
ওয়ালাইকুম সালাম! অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই।
মুছুন