অতি ক্ষুদ্র একটি অনুজীব মানুষকে একেবারে ঘরবন্দী করে ফেলেছে। এই বন্দিত্বের স্থায়িত্ব কত, কে জানে? -দীর্ঘও হতে পারে। সারা বিশ্বের সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয়, আভ্যন্তরীণ-আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বানিজ্য, এমনকি নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্কের মাঝেও স্থিতি এসেছে। আগামী দিন কেমন হবে, সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। অতো কিছু ভেবে এখন মন খারাপ করা যাবে না। বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে, করোনা থেকে আগে বাঁচতে হবে, এবং অন্যকে বাঁচাতে হবে; বুঝতে হবে সার্বিক পরিস্থিতি, অন্যকেও বুঝাতে হবে। অভাব অভিযোগ জয় করার ব্রত নিতে হবে।
হু হু করে বাড়ছে সংক্রমিতের সংখ্যা এবং এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা; ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী বিশ্বে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা আজ তেইশ লাখ ছেড়ে গেছে এবং মৃতের সংখ্যা দের লাখ। এ থেকে কি সংক্রমণের প্রকৃত পরিসংখ্যান জানা বা বুঝার কোন উপায় আছে?
আসল চিত্রটা মনে হয় মোটেও জানা বা বুঝা যাচ্ছে না। কারণ, বিশ্বে যত মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে এ দ্বারা তার মাত্র ছোট একটা অংশ শনাক্তের মাধ্যমে সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে। কারো কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়লেই শুধু সে সংক্রমিত হিসাবে নথিভুক্ত হচ্ছে; অন্যথায় নয়। শনাক্তকরণ পরীক্ষা কখন করা হয়? যখন আক্রান্ত ব্যক্তি নিরুপায় হয়ে চিকিৎসা চায়। যাদের হালকা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে বা যাদের ভেতরে জীবাণু আছে, কিন্তু কোন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে না, তারা সংক্রমিতের তালিকায় উঠছে না। প্রতিদিন খবরের কাগজে এমন অনেক মৃত্যুর খবর উঠে আসে, যারা কোভিড-১৯ সিম্পটম নিয়ে মৃত্যুবরণ করে, করছে; তাদের হিসাব এখানে উঠছে কি?
আমাদের দেশের বাস্তবিক চিত্র কি তা আমরা কেউই জানিনা। তারপরও অতি ধার্মীক, অতি যুক্তিবাদী ও কিছু বেকুব টাইপ লোক লকডাউন মানছে না! করোনাকে তারা অতি সাধারণ রোগ হিসাবে তুচ্ছজ্ঞান করছে। এখনো অনেকেই বিনা প্রটেকশনে বিনা প্রয়োজনে বাহিরে বাতাস খেতে বের হচ্ছে, আড্ডাবাজী করছে! ডাব্লিউএইচও বারবার হুশিয়ারি দিচ্ছে সামাজিক দূরত্ব কড়াকড়ি করার জন্য; নয়তো করোনার ভয়াবহ বিস্তার ঘটতে পারে। সে হিসেবে সরকারও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ মানুষের মোটেও বোধদয় হচ্ছে না!
করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এমন ভয়ানক হয়ে যাচ্ছে, কয়দিন পর হয়তো তা সরকারের আয়ত্তের একেবারে বাইরে চলে যাবে। প্রাথমিক অবস্থায় বিদেশফেরতরা যখন দেশে ঢুকতে শুরু করেছিল তখন যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার, সচেতনও হয়নি কেউ; সেটা ছিল প্রথম ভুল। দ্বিতীয় ভুল ছিল— লকডাউনের ছুটিকে ঈদের ছুটি মনে করা। তৃতীয় ভুল— গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারিদের ঢাকায় ফেরানো এবং পুনরায় গ্রামে পাঠানো। এতে করে করোনাভাইরাস প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ, ফরজে আইন যেখানে শিথিল সেখানে ফরজে কিফায়া নিয়ে গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যা হয়েছে, তাতে করে সামনে আমাদের কপালে কি অপেক্ষা করছে তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন!
এক সপ্তাহ পর বুঝা যাবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। গতকাল আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়েছে; তা হতে সময় নিয়েছে ৪০ দিন। ৮ মার্চ থেকে এক হাজার হতে সময় নিয়েছে ৩৬ দিন, আর পরের এক হাজার আক্রান্ত হয়েছে মাত্র চার দিনে। অন্যদিকে ১৮ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, আর আজ নতুন ৭ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে ৯১ জনের। আজ ১৯ এপ্রিল ৩১২ জন নতুন সংক্রমিত নিয়ে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ালো ২৪৫৬ জনে।
ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী ২ হাজার রোগী হতে ইতালিতে সময় লেগেছিলো ৩২ দিন; এটাই সবচেয়ে কম সময়। অপর দিকে একই পরিমাণ রোগী আক্রান্ত হতে স্পেনে সময় লেগেছিলো ৪১ দিন; যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে লেগেছিলো ৪৮ দিন। অন্যদিক দিয়ে বর্তমানে ভয়াবহ আকারে করোনা মহামারির সম্মুখীন যুক্তরাষ্ট্রের ২ হাজার রোগী হতে সময় লেগেছে ৫৩ দিন। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পৃথিবীর উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পন্ন দেশগুলো যেভাবে হিমশিম খাচ্ছে, আমাদের অবস্থা কেমন হতে পারে তা চিন্তারও অতীত।
করোনা মেসাকারে মৃতের সংখ্যা কেবল ইউরোপেই এক লক্ষ ছাড়লো; ইউরোপ মহাদেশই এখন পর্যন্ত এই মেসাকারে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মহাদেশ। ইতালিতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে, এর পরেই রয়েছে স্পেন। ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১,৭৮,৯৭২ জন এবং মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ২৩,৬৬০ জন; এছাড়া স্পেনে মারা গেছে ২০ হাজারের বেশি মানুষ, ফ্রান্সে মারা গেছে ১৯ হাজারের বেশি এবং ব্রিটেনে ১৬ হাজারে উপরে। এ অবস্থায় স্পেনের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন— দেশে লকডাউনের মেয়াদ আরো বাড়াবেন। ওদিকে ফ্রান্সে করোনা সংক্রমণ আগের দিনের চেয়ে অনেক বেশি; ব্রিটেনে ২৪ ঘন্টায় নতুন সংক্রমণ ৫,৮৫০ এবং এ দেশটি এখন বিশ্বের পঞ্চম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ।
ভয়ংকর সংক্রামক এই ভাইরাসে এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ২৩,৯৫,৬৩৬ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে ১,৬৪,৫৬৫ জন; প্রতি মুহূর্তে হু হু করে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এএফপির হিসাব অনুযায়ী মোট মৃত্যুর এক তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে; মৃত্যুর সংখ্যা ৪০,২৬৫।
মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে যে দেশের নাম সেটি হলো তুরস্ক। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮৬,৩০৬ জন, আর মৃত্যু হয়েছে ২,০১৭ জনের; যা মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে। গত ২৪ ঘণ্টায় তুরস্কে আরো ৩,৯৭৭ জন নতুন আক্রান্ত হয়েছে; মৃত্যু হয়েছে ১২৭ জনের।
ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী করোনাভাইরাসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান— তুরস্ক করোনা আক্রান্ত শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় অষ্টম; তুরস্কের পরেই আছে ইরান। ইরানে এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৮২,২১১ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৫,১১৮ জনের। তুরস্কে গত ১০ মার্চ প্রথম একজন করোনা রোগী শনাক্ত হন। এর প্রায় এক মাস পর অর্থাৎ ৮ এপ্রিল আক্রান্ত হয় ৪,১১৭ জন।
আফ্রিকায় ৬ মাসে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের ধারণা, করোনা প্রাদুর্ভাবের পরবর্তী ভরকেন্দ্র হবে ওই অঞ্চলটি। এরই মধ্যে সেখানে ১৯ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, আর প্রাণ হারিয়েছে ১ হাজার। প্রাণঘাতী এ ভাইরাস আফ্রিকায় অন্তত তিন লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে এবং প্রায় তিন কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিবে বলে আশঙ্কা করছেন জাতিসংঘের কর্মকর্তারা।
বিশ্বব্যাপী করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, এর সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুও। গত এক সপ্তাহে বিশ্ব থেকে নাই হয়ে গেছে ৫০ হাজার মানুষ। তথ্য মতে— প্রথম মৃত্যুর পর ৫০ হাজার ছাড়তে সময় লেগেছে ৮২ দিন, আর এর পরের ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে সময় লেগেছে মাত্র ৮ দিন, এবং এর পরবর্তী ৫০ হাজার মারা গেছে মাত্র সাত দিনে! এখনো ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে করোনা ভাইরাস বিভীষিকা ছড়িয়েই যাচ্ছে; এশিয়ায় তো সবে শুরু।
দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা আঘাত হানে ২৩ জানুয়ারি; প্রথম আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় নেপালে, ২৬ জানুয়ারি শনাক্ত হয় শ্রীলঙ্কায়, ২৯ জানুয়ারি ভারতে, ২৩ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তানে, ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে, ৫ মার্চ ভুটানে, ৬ মার্চ মালদ্বীপে এবং সর্বশেষ ৮ মার্চ বাংলাদেশে। এরই মধ্যে অন্যান্য দেশকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশ স্থান করে নিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয়তে; আক্রন্তের ক্রমানুসারে। আগে আছে শুধু ভারত ও পাকিস্তান।
ইউরোপ আমেরিকার চেয়েও কত বেশি ধ্বংসাত্মক হতে যাচ্ছে করোনা আমাদের এ অঞ্চলে, তা এখন আর বুঝতে কারো বাকী নেই; একদিকে ঘনবসতি, অন্যদিকে অসচেতনতা। ভয় হচ্ছে, আমাদের দেশের দূর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ভঙ্গুর চিকিৎসা ব্যবস্থার জাঁতাকলে পড়ে না জানি রাস্তায় লাশের স্তুপ পড়ে। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোর যে করুণ পরিস্থিতি এবং আইসিইউ সুযোগ সুবিধার যে বেহাল অবস্থা, ভাবতেই ভয় হয়! এ দেশে করোনা চিকিৎসার আশা করা দুরাশা। ইউরোপে যেখানে প্রতি ১০ লক্ষ রোগীর জন্য রয়েছে ৪ হাজার আইসিইউ, সেখানে আমাদের কি আছে??
ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় যা ঘটেছে এমতাবস্থায় দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি যে দিনদিন খারাপের দিকে যাবে তাতে আর কারো কোন সন্দেহ নেই। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকবে অভাব অভিযোগ। আমাদের মাঝে আছে একদিকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়, অন্যদিকে জীবন ধারণের উপকরণের অপর্যাপ্ততার দুশ্চিন্তা; মানসিক অস্থিরতা চরম হওয়টাই স্বাভাবিক। তারপরও যে কোন পরিস্থিতি অবশ্যই সাহসিকতার সাথে মোকাবেলার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে।
ঘরে চাল কম? ডাল নেই? এক দিনের খাবার তিন দিন খেতে হবে। শরীরে জ্বর? ভয় না পেয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। করোনা পজেটিভ? আল্লাহকে স্মরণে রেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ অনুযায়ী নির্ভয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। জীবন তো একটাই; যদি বাঁচি— যুদ্ধ করেই বাঁচবো।।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২০ এপ্রিল, ২০২০.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন