বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০২০

একবিংশ শতাব্দীর ওহাবীজম:

বিখ্যাত তাবেঈ ইবনে শিরিন (রঃ) বলেছেন, 'নিশ্চয় এই ইলম দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং লক্ষ্য রেখো! কার নিকট থেকে তুমি তোমার দ্বীন গ্রহণ করছো।' লা-মাজহাবী আধুনিক ওহাবী দল সালাফি তথা আহলে হাদীস নামধারি দলের অন্যতম একজন নেতা হলেন নাসিরুদ্দিন আলবানী; তার অনেকগুলো বদ আকিদার মধ্যে অল্প কয়েকটি প্রথমেই তুলে ধরে আজকের লিখার সূচনা করছি।

*** নাসিরউদ্দিন আলবানী হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর, রওজা মুবারক হতে সবুজ গম্ভুজ ভেংগে ফেলা এবং হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওজা শরীফকে মসজিদে নববী হতে বের করে দেয়ার আবেদন করেছিলেন। –(সূত্রঃ তাহযিরুজ সাজিদ মিন ইত্তিখাযিল কুবুরি মাসাজিদ, শায়েক আলবানী, পৃষ্ঠা নং - ৯৮)
*** সালাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হলেন আল্লাহ তা'আলা (নাউজুবিল্লাহ!)। –(সূত্রঃ ফাতাওয়াল আলবানী ফিল মদীনাতি ওয়াল ইমারত, পৃষ্ঠা নং - ১৮)
*** আশ্চর্য হওয়া আল্লাহর একটি সিফত (নাউজুবিল্লাহ!)। –(কিতাবুশ শায়েখ আলবানী)
*** এটা ঈমান রাখো যে আল্লাহ তা'আলা (শুধু) আসমানে রয়েছে (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আল হাবী মিন ফাতাওয়াশ শায়েখ আলবানী,১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং - ৪৩)
*** নবীগণ যে নিষ্পাপ এটা সাধারণ বা ব্যাপক নয় (নাউজুবিল্লাহ!)। –(ফাতাওয়াল আলবানী ফিল মাদীনাতি ওয়াল ইমারত,পৃষ্ঠা নং - ১৮)
*** নবী-রাসূলগণ বিভিন্ন ধরনের সগীরা গুনাহ ও আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে থাকেন (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আল ফাতাওয়াল কুয়্যেতিয়্যা লিল আলবানী,পৃষ্ঠা নং - ২৯)
*** আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে যে সমস্ত আয়াত শিখিয়েছেন তা তিনি ভুলে যেতে পারেন (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আল ফাতাওয়াল কুয়্যেতিয়্যা লিল আলবানী,পৃষ্ঠা নং - ৩০)
*** নবী করীম সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উসিলা করে দোয়া করা হারাম (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আহকামুল যানায়েজ ওয়া বিদাউহা, পৃষ্ঠা নং - ২৬৪)
*** রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নন (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আত তাওয়াসসুল আনওয়াউহু ওয়া আহকামুহু, পৃষ্ঠা নং - ১৪৯)
*** নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওজা জিয়ারতের উদ্দশ্যে সফর করা হারাম (নাউজুবিল্লাহ!)।  –(ফাতাওয়াল আলবানী ফিল মদীনাতি ওয়াল ইমারত, পৃষ্ঠা নং - ১২)
*** নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্য কোন মৃত্যুদের উদ্দেশ্যে কোন আমলের সোওয়াব প্রেরণ করা জায়েজ নয় (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আহাকমুল জানায়েয ওয়া বিদাউহা, শায়েখ আলবানী, পৃষ্ঠা নং : ২৬০-২৬১)
*** জুম্মার দিনে 'ইন্নাল্লাহা ওয়ামালাইকাতাহু' এই আয়াত শরীফ পাঠ করা জায়েজ নয় এবং এটি একটি বেদাত (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আল আজউইবাতুন নাফেয়া, শায়েক আলবানী,পৃষ্ঠা নং - ৬৭)

বিগত অর্ধশতক ধরে 'সালাফি' পরিভাষাটি সারা বিশ্বে একটি ইসলামিক মেথডলজি হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার চেষ্টা  করছে। বর্তমান সালাফিরা  মুখে বলে তাদের লক্ষ্য হলো ইসলামের প্রথম প্রজন্মের মুসলমানদের ঈমান ও আমলের যে নবুয়তী মানদণ্ড ছিলো তার সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করা। আসলে কি তাই? আমরা প্রতিটি মুসলমান মাত্রই অবগত আছি যে নবুয়তী যুগ হলো রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সুন্নাহর সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তারপরের প্রথম তিন প্রজন্মের যুগ— সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর যুগের সবচেয়ে কাছাকাছি; তাই এই তিন প্রজন্মের সময়কালকে ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ  বিংশ শতাব্দীতে জন্ম নিয়ে পেশাগতভাবে একজন ঘড়ি মেরামতকারী নাসিরুদ্দিন আলবানী  প্রথম সালাফি শব্দটিকে একটি শ্রেণীগত প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন, তারপর ডাঃ জাকির নায়েক এ দলটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন।     

সালাফিরা হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী হলেও তাদের অনেকে আবার নির্দিষ্ট কোন মাজহাব অনুসরণ করেন না। শারয়ী অনেক বিষয়েই সালাফিদের সাথে অন্যান্য মতালম্বি মুসলিমদের যথেষ্ট  মতপার্থক্য রয়েছে। তারা কবর জিয়ারতকে কবর পূজা বলে, শবে বরাত, ঈদে মিলাদুনন্নবী ইত্যাদিকে ইসলামে যোগ হওয়া নতুন জিনিস হিসেবে বিশ্বাস করে এবং এগুলো উৎযাপন করে না। ২০১৫ সালে মিশরে মিশরীয় সরকার সালাফিদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

বর্তমানের এই ওহাবী দল তথা সৌদির সালাফিরা এই উপমহাদেশে আহলে হাদীস নাম নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ দলের অন্যতম বক্তা হলেন ডাঃ জাকির নায়েক; এবং মতিউর রহমান মাদানী হলেন তাদের অন্যতম দীক্ষাগুরু; আর তাদের নেতা হলেন  শায়েখ নাসিরুদ্দিন আলবানী। ডাঃ জাকির নায়েকের আকিদা ও রিসার্চ মুলতঃ আলবানীর আকিদা ও বই পুস্তক নিয়ে; যেমন - আলবানী যে হাদিস দুর্বল কিংবা জাল বলেছেন সেটি অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ সহিহ বললেও ডাঃ জাকির নায়েক আলবানীকেই সমর্থন দিয়ে থাকেন। আহলে হাদীসকে সালাফী নামে পরিচয়দানকারী ব্যক্তিটিও হলেন নাসির উদ্দিন আলবানী; যার ডাক নাম আবু আবদুর রহমান। 

ইউরোপের মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আলবেনীয়ায় জন্ম নেয়ায় তাকে আলবানী বলা হয়। তিনি ১৩৩৩ হিজরী মোতাবেক ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে আলবেনীয়ার রাজধানী স্কোডার (Shkoder), বর্তমান 'তিরানা'-য় জন্ম গ্রহন করেন। আলবানী লিখিত 'সিফাতুস সালাত' কিতাবের ভূমিকাতে উল্লেখ্য করা হয়েছে, নাসির উদ্দিন আলবানী ব্যক্তিগত জীবনে প্রথম অবস্থায় কাঠ মিস্ত্রির কাজ করতেন; এবং পরবর্তীতে পিতার ঘড়ি মেরামতের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
 
তার পিতা ছিলেন হানাফী মাজহাব-এর একজন অনুসরণকারী। আলবেনিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমদ জাগু নারীদের পর্দা নিষিদ্ধ করলে শিশু আলবানীকে নিয়ে তার পিতা সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে চলে আসেন। আলবানী নিজেও প্রথম জীবনে হানাফী মাজহাবের একজন অনুসারী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কেমন করে যেন তিনি মাজহাব থেকে ছিটকে পড়েন। হানাফী ফিকাহর কিতাব পাঠ করলেও একসময় তিনি হানাফী মাজহাবসহ সমস্ত মাজহাবকেই অস্বীকার করে বসেন, ঠিক মোহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী যেমন করে মাজহাব অস্বীকার করেছিলেন; এবং কোরআন হাদীস ও সলফে সালেহীনদের বিরুদ্ধেও তিনি অযথাই বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকেন। 

১৯৬০ সালের শুরুর দিকে প্রথম তিনি সকলের নজরে আসেন যখন ভিন্ন মতাবল্বনের জন্য পরপর দু'বার গ্রেপ্তার হন। প্রথম বার ১৯৬৮ সালের আগে দামেস্কের কেল্লা কারাগারে এক মাসের জন্য বন্দী ছিলেন; এটা সেই কারাগার, যেখানে ইবনে তাইমিয়াও বন্দী ছিলেন। ১৯৬৮ সালের যুদ্ধের সময় সিরিয়ান সরকার যখন সকল কারাবন্দীদের মুক্ত করে দেয় তখন তিনিও মুক্ত হন। কিন্তু আবারও তিনি তার ভ্রান্ত মত প্রচার করতে থাকেন। ফলে তাকে পুনরায় দামেস্কের পূর্ব-উত্তরাঞ্চলের আল হাসাকা কারাগারে বন্দী করা হয়; ওখানে তিনি আট মাস কারারুদ্ধ অবস্থায় অতিবাহিত করেন। কারগার হতে মুক্তি পেয়ে তিনি পরবর্তীতে সিরিয়া ত্যাগ করে জর্ডানে আশ্রয় নেন; এবং জর্ডানের রাজধানী আম্মানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। পরিশেষে সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ওহাবী কার্যাবলীর কারণে সৌদি রাজতন্ত্র তাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে; তাদের আর্থিক সহায়তায়ই তিনি ওহাবী মতবাদ প্রচার করার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেন। বর্তমান মুসলিম বিশ্বে আহলে হাদীস তথা সালাফী ওহাবীদের কেন্দ্রস্থল হলো সৌদিআরব। মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব নাজদী ও আল-সাউদের সেই ওহাবী মতবাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার হীন প্রচেষ্টায় তারা মক্কা-মদিনার বাহানা তুলে এবং সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সুবিধা গ্রহণ করে ব্যাপকভাবে তিনি প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে গেছেন, যা বর্তমানেও অব্যাহত আছে। ভারতের ঐতিহ্যবাহী আহলে হাদীস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া বেনারসে হাদীসের শিক্ষক হিসেবেও এক সময় আলবানীকে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল; কিন্তু তৎকালীন সময়ে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ চলছিল, সেই জন্য তিনি সেখানে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। 

সৌদি সরকার ওহাবী মতবাদকে শক্তিশালী করার জন্য আলবানীকে ১৩৯৫ হিজরী থেকে ১৩৯৮ হিজরী পর্যন্ত মদীনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট সদস্য হিসাবে মনোনীত করেন। পরে ১৪২০ হিজরী, ২ জুমাদাল আখেরা, শনিবার মোতাবেক ২ অক্টোবর, ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান।

নাসির উদ্দিন আলবানী ছিলেন কট্টর একজন ওহাবী ও একই সাথে সালাফী; সুন্নী চার মাজহাবকেই তিনি ভীষণভাবে কটাক্ষ করতেন করেছেন। তিনি তার কিতাবে লিখেছেন - 'মুসলিম ইমামগণের (মাজহাবের ইমামগণ) উমুক ইমাম কোন মাসয়ালার ইজতিহাদে বা তার রায়ে ভুল করেছেন, তা আমরা কেন বলতে পিছপা হবো?' তাই তো তার অনুসারী ও তার সাগরেদদেরও আজকাল দেখা যায় - মাজহাবের কথা শুনলেই ক্ষেপে যেতে, গায়ে আগুন ধরতে!

অথচ সারে চৌদ্দশ বছর আগেই হুজুর পাক (সাঃ) বলে গেছেন, 'আলোর উৎস থেকে যত দূরে যাবে তার দ্যোতি যেমন কমতে থাকবে, তদ্রুপ আমা হতে যত দূরে যাবে ঈমানের জ্যোতিও ততো কমতে থাকবে।' 
আমার কিছুতেই বুঝে আসে না আহলে হাদীস বা তথাকথিত সালাফি দলের লোকজন কি করে ভাবেন, একজন তাবেঈ বা তাবে-তাবেঈর চেয়েও উত্তম হাদীস ও ফিকাহ বুঝবেন ১৪শ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করা একজন তথাকথিত শায়েখ নাসিরুদ্দিন আলবানী বা অন্য কেউ?
 
হানাফী মাজহাবকে আলবানী খ্রিস্টধর্মের সাথে তুলনা করেছেন এবং লিখেছেন -
هذا صريح في أن عيسى عليه السلام يحكم بشرعنا ويقضي بالكتاب والسنة لا بغيرهما من الانجيل أو الفقه الحنفي و نحوه অর্থাৎ - 'এ থেকে স্পষ্ট যে, হযরত ঈসা (আঃ) আমাদের শরীয়ত অনুযায়ী ফয়সালা দিবেন এবং কিতাব ও সুন্নাহের মাধ্যমে বিচার করবেন। তিনি ইঞ্জিল, হানাফী ফিকহ কিংবা এজাতীয় অন্য কিছু দ্বারা বিচার করবেন না।' - (আল্লামা মুনযীরি (রহঃ) কৃত 'মুখতাসারু সহিহীল মুসলিম'-এর উপর শায়েখ নাসীরুদ্দিন আলবানীর টিকা সংযোজন, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৭৭, আল-মাকতাবুল ইসলামি, পৃষ্ঠা-৫৪৮)

অথচ তার পিতা নুহ নাতাজীও ছিলেন একজন হানাফী। তাছাড়া, তিনিও জীবনের দীর্ঘ একটি সময় হানাফী ছিলেন। তাঁর জীবনীতেই লিখা আছে -
الحنفي (قديماً) ، ثم الإمام المجتهد بعد  অর্থাৎ - 'প্রথম জীবনে হানাফী, পরবর্তী জীবনে নিজেই মুজতাহিদ ইমাম।' –(সাবাতু মুয়াল্লাফাতিল আলবানী, আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ আশ-শামরানী, পৃষ্ঠা-২, ১৬)

বর্তমান বিশ্বের ৯২.৫% মুসলমান চার মাজহাব-এর কোন না কোন একটির অনুসরণ করে থাকে, এবং অবশিষ্ট ৭.৫% লোক শিয়া ও অন্য সব মতাবলম্বী। দীর্ঘ সারে তেরশ বছর যাবৎ মুসলিম উম্মাহ মাজহাবের অনুসরণ করে আসছে। তবে কি তিনি সব মুসলমানকেই খ্রিস্টানদের মত পথভ্রষ্ট মনে করছেন?

জাল আর জয়ীফ বলে বলে আসলে তথাকথিত আহলে হাদীসরা হাজার হাজার হাদীসের অস্বীকারকারী;  অতএব তারা হলো 'মুনকারে হাদীস'। ওরা হাদীস মানার নামে বরং হাদীসকে সবসময় অস্বীকারই করে যাচ্ছে। আর যারা হাদীসকে অস্বীকার করবে, তারা মুরতাদের কাছাকাছি। তথাকথিত আহলে হাদীস দল যে মতের অনুসারী সে মতের বিরুদ্ধে কেউ কোন হাদিস বলতে গেলেই তা তারা বাতিল মনে করে, তাদের মতের বাইরের সব হাদীসকেই তারা জাল বা জয়ীফ বলে মুছকি হাসে! বড় বড় মুহাদ্দেসিন, সলফে সালেহিনগণ যেসব হাদীসকে আমলে এনেছেন, যেসব হাদীস গ্রহণ করেছেন, সেরূপ হাজার হাজার হাদীসকেও লা-মাযহাবী তথাকথিত আহলে হাদীস দল অনুসারীরা জাল বা জয়ীফ বলে এনকার করে; এটি আসলে হাদীস অস্বীকারের ভিন্ন একটি রূপ। 

লা-মাজহাবী তথাকথিত আহলে হাদীসরা আসলে মানুষের মগজে এই কথাটি ঢুকিয়ে দিতে চায় যে, জয়ীফ হাদীস কোন হাদীসই নয়, জয়ীফ হাদীস জাল হাদীসের মতই। তারা জয়ীফ হাদীসগুলোকে জাল হাদীস বলে অসংখ্য হাদীসকে অস্বীকার করছে। অথচ জাল আর জয়ীফ হাদীসের মধ্যে যে বিশাল পার্থক্য ব্যবধান রয়েছে তা তারা বুঝতেই চায় না বা বুঝার চেষ্টাও করে না।

হাদীস সহীহ হয়, জয়ীফ হয়, হাসান হয় সনদের উপর ভিত্তি করে। মুহাদ্দিসগণ যখন কোন হাদীসের রাবী (হাদীসের বর্নণাকারী)-র নাম পরিচয়, আমল, আখলাক ইত্যাদি যাচাই- বাছাই করেন, এর উপর ভিত্তি করেই তখন তাঁরা হাদীসের মান নির্ণয় করেন। এমন অনেক হাদীস আছে যেই হাদীসগুলো ইসলামের প্রাথমিক জামানাতে সহীহ শুদ্ধ ছিলো, কিন্তু পরবর্তীতে সনদের কারণে সেই একই হাদীসের মান দুর্বল হয়ে যায়। তাই বলে জয়ীফ দুর্বল হাদীসকে জাল হাদীস বলার কোন সুযোগ নেই। সমস্ত মুহাদ্দিসগণ একমত, যখন কোন বিষয়ে একাধিক জয়ীফ হাদীস থাকে তখন ঐ হাদীস সহীহ হাদীসের পর্যায়ে চলে যায়; এবং তখন ফাযায়েলের বিষয়ে জয়ীফ হাদীসের উপরও আমল করা যায়।

আর জাল হাদীস তো কোন হাদীসই নয়; বানানো বলে-ই তো ওটা জাল! মুহাদ্দিসগণ যখন কোন হাদীস গ্রহন করেন, অনেক সময় এমনও হয় যার কাছ থেকে হাদীসটি শুনছেন তার স্মরণ-শক্তি হয় তো কম, তাই হাদীসটি সম্পূর্ণভাবে পৌঁছাইতে পারেননি; তাই এখানে সতর্কতা স্বরূপ হাদীসের মান দুর্বল রাখা হয়েছে। এ কারণেই দেখবেন একই রকমের হাদীস এক রেওয়ায়েতে এসেছে একভাবে এবং অন্য আরেক রেওয়ায়েতে কিছু কম বেশি হয়ে এসেছে।

জাল আর জয়ীফের পার্থক্য একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বুঝার চেষ্টা করা যাক— 
 ধরা যাক, দু'জন লোক অসুস্থ হয়ে পাশাপাশি বেডে (খাটে) শোওয়া। একজন মারা গেলেন, আর আরেকজন মারা যাননি। যে মারা গেছেন তাকে সবায় কি বলবে? –লাশ। আর যে লোক অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন তাকে সবাই মানুষই বলবে; কারণ, তার ভিতর এখনও জান বা প্রাণ আছে।
জাল আর জয়ীফের ব্যাপারটি অনেকটা ঠিক এমনই। যে হাদীসটি জাল, সেটা লাশের মতো; ওটা কোন অবস্থায়ই হাদীস নয়। কিন্তু যে হাদীসটি জয়ীফ, সেটা অবশ্যই হাদীস। 

বিখ্যাত সব মুহাদ্দিসগণও তাঁদের কিতাবে প্রচুর জয়ীফ হাদীস উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দু:খের বিষয় হলো - তথাকথিত আহলে হাদীস শায়খ মিস্টার নাসিরউদ্দিন আলবানী তিরমিযী শরীফ ও আবু দাউদ শরীফের জয়ীফ হাদীসগুলোও আলাদা করে দু'টো কিতাব বের করেছেন! তাই আজকাল অনেকের কাছে সহীহ আবু দাউদও জয়ীফ আবু দাউদ এবং সহীহ তিরমিযীও জয়ীফ তিরমিযী! বিষয়টি ভাবতেই অবাক লাগে।

আলবানী কেমন করে যেন বুঝাতে চেয়েছেন - জয়ীফ হাদীস কোন হাদীসই নয়! হাদীস সহীহ না হওয়াকে বাতিল বলে গণ্য করা হচ্ছে; এবং আমলের অনুপযোগী মনে করা হচ্ছে। মূলতঃ এভাবে অনেক হাদীসকেই পুরোপুরি অস্বীকার করা হচ্ছে। একদিকে শুধু সহীহ হাদীস মানার কথা বলে তারা ইসলামকে অপরিপূর্ণ ও সংকীর্ণ করছে, অন্যদিকে অসংখ্য হাদীসকে এনকার (অস্বীকার) করছে।
আরেকটি কষ্টের বিষয় হলো  তারা তাদের সুবিধামত হাদীস নিচ্ছে, অন্যের বিরুদ্ধে বলার জন্য একটি সহীহ হাদীসকে জয়ীফ বলছে আবার তাদের পক্ষে সুবিধার জন্য অনেক জয়ীফ হাদীসকেও সহীহ বলে চালিয়ে দিচ্ছে! এসবের পিছনে কোন কূটিল চাল নেই তো?

ওলামায়েকেরামগণ অনেক আগ থেকেই মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে আসছেন যে, লা-মাযহাবী তথাকথিত আহলে হাদীস নামের দলটি আসলে একটি বাতিল ফের্কা ও গোমরাহি দল। তাঁরা বেশ ভাল করেই জানতেন তাদের জন্মের কাহিনী, ওদের হাদীস অস্বীকার করার বাস্তব অবস্থা, ওদের সাহাবা বিদ্বেষের নমুনা, ওদের নবী রাসূল বিদ্বেষের বাস্তব ঘটনা, সলফে সালেহীনদের প্রতি মুসলমানদের আস্তা ও ভক্তি নষ্ট করার প্রয়াস, মুসলমানদের মাঝে বিভ্রান্তি  ছড়িয়ে শতধা বিভক্ত করার ওদের বদ পরিকল্পনা, ইসলামের বেশকিছু হুকুম বাদ করে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্ত এবং জঘন্য সব অপপ্রয়াস। একটি কথা অনেক আগে থেকেই অনেকে জানেন, আসলে ওদের জন্মদাতা হলো ব্রিটিশ সরকার। তাই কখনো দেখবেন না তাদের পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধাচরণ করতে। 

ইংরেজ সরকার তো কখনো  ইসলামের এতো ভক্ত ছিল না যে ইসলামের প্রচারপ্রচারণায় ও বিকাশে তারা কোন দলকে টাকা পয়সা খরচ করে মার্কেটে নামাবে? বরং ইংরেজ সরকার ইসলামকে ধ্বংস করার জন্যই বিভিন্ন দল ও উপদল বানিয়েছিল; তার মধ্য থেকে কাদিয়ানীকে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে। লা-মাজহাবী তথাকথিত আহলে হাদীস দলও সেই ইংরেজ বাপের জন্ম দেয়া অন্যতম আরেকটি দল। সুতরাং তখন থেকেই এই উপমহাদেশের আলেম সমাজ বলে আসছেন - এই দলটিকে ইসলাম ধ্বংস করার জন্যই জন্ম দিয়েছে ব্রিটিশরা। সম্প্রতি তাদের মুখোশ অনেকটাই উন্মোচিত হয়েছে; এরই মধ্যে খাঁটি  মুসলমানদের কাছে সব কিছু অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে; যতই দিন যাচ্ছে এবং যাবে সারা বিশ্বের সামনে  তাদের মুখোশ আরো বেশি উন্মুচিত হবে। 

'মুযাহেরে হক্ব' কিতাবের স্বনামধন্য লেখক মাওলানা কুতুব উদ্দীন তার 'তুহফাতুল আরব ওয়াল আযম' গ্রন্থে লা-মাযহাবী গাইরে মুক্বাল্লিদ-এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন ঠিক এই ভাবে, 'সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ, মাওলানা ইসমাইল শহীদ ও মাওলানা আব্দুল হাই (রঃ) পাঞ্জাবে আগমন করার পরপরই কতিপয় বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীর সমন্বয়ে চার মাজহাবের ইমামগণের তাক্কলীদ অস্বীকারকারী নতুন ফের্কাটির সূত্রপাত লক্ষ্য করা যায়। যারা হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (রঃ)-র মুজাহিদ বাহিনীর বিদ্রোহী গ্রুপের সদস্য ছিল; ওদের মূখপাত্র ছিল মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী (মৃত- ১২৭৫ হি:)। তার এ ধরনের অসংখ্য ভ্রান্ত কর্মকান্ডের কারণে, সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (রঃ) ১২৪৬ হিজরীতে তাকে মুজাহিদ বাহিনী থেকে বহিষ্কার করেন। তখনই গোটা ভারতবর্ষের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগণ, বিশেষ করে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (রঃ)-এর খলীফা ও মুরীদগণ হারামাইন শরীফাইনের তদানীন্তন উলামায়ে কিরাম ও মুফতীগণের নিকট এ ব্যাপারে ফতওয়া তলব করেন। ফলে সেখানকার তৎকালীন চার মাযহাবের সম্মানীত মুফতীগণ ও অন্যান্য উলামায়ে কেরামগণ সর্বসম্মতিক্রমে মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী ও তার অনুসারীদেরকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ফির্কা বলে অভিহিত করেন; এবং মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসীকে কতল (হত্যা) করার নির্দেশ প্রদান করেন (এ ফতওয়া ১২৫৪ হিজরীতে তান্বীহুদ্দাল্লীন নামে প্রকাশ করা হয়, এখনো দেশের বিশিষ্ট লাইব্রেরীতে এর কপি সংরক্ষিত রয়েছে।)। মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী পলায়ন করতঃ কোনভাবে আত্মরক্ষা পায়। সেখানে গিয়ে তার নবআবিষ্কৃত দলের প্রধান হয়ে সরলমনা মুসলমানের মধ্যে তার বিষাক্ত মতবাদ ছড়াতে থাকে।' –(তুহফাতুল আরব ওয়াল আজম, পৃষ্ঠা নং - ১৬, খণ্ড - ২, আল-নাজাতুল কামেলা, পৃষ্ঠা নং - ২১৪, তন্বীহুদ্দাল্লীন, পৃষ্ঠা নং - ৩১)

লা-মাযহাবী গাইরে মুক্বাল্লিদ আলিম মৌলভী আসলাম জিরাজপুরী তার বিশিষ্ট রচনা 'নাওয়াদিরো'তে লিখেন, 'প্রথমতঃ এ জামাত নিজেদের বিশেষ কোন নাম রাখেনি। মাওঃ ইসমাইল শহীদ (রঃ)-এর শাহাদাতের পর প্রতিপক্ষের লোকেরা যখন দুর্নাম করার জন্য তাদেরকে ওহবী বলতে শুরু করে, তখন তারা নিজেরদেকে 'মুহাম্মাদী' বলতে থাকে; অতঃপর এ নামটি পরিহার করে 'আহলে হাদীস' উপাধি চয়ন করে; যা আজ পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে।' –(নাওয়াদিরাত, পৃষ্ঠা নং - ৩৪২)

উপরোক্ত দু'টি বিররণ থেকে এ'কথাটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী কর্তৃক ১২৪৬ হিজরীতে ভারতবর্ষে বর্তমান গাইরে মুক্বাল্লিদ তথা লা-মাযহাবী নামক নতুন ফের্কাটির জন্ম ও সূত্রপাত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তা 'ওয়াহাবী' হিসেবে পরিচিত ছিল; কিন্তু সে তখন নিজেকে 'মুহাম্মাদী' বলে প্রচার করতো। পরবর্তীতে 'ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম' এ মর্মে ফতওয়া দিয়ে ইংরেজের দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়; এবং এ সুযোগে সে সরকারী কাগজ-পত্র থেকে 'ওয়াহাবী' নাম রহিত করে আহলে হাদীস নাম বরাদ্দ করতে সক্ষম হয়।

ভারতবর্ষে ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসণ ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং ইংরেজ বিতাড়নে জিহাদী মুসলমানদের ব্রিটিশরা খুব বাজে ভাবে 'ওহাবী' উপাধিতে ভূষিত করতো; যদিও আরবের ব্রিটিশ স্পাই মিস্টার হামফ্রে-র হাতের তৈরী সেই মোহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নাজদী। ব্রিটিশ ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশনের প্রধান স্যার ডবলিও. ডবলিও. হান্টার-এর 'দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস' গ্রন্থ থেকেও বুঝতে পারা যায় যে, যেসব আলেম-ওলামা তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তাদেরকে তারা যতসব বাজে উপাধিতে ভূষিত করতেন। কিন্তু, তাদের 'ডিভাইড এন্ড রুল'-এর আওতাভূক্ত মুসলমান নামধারী মোনাফেকদের তারা তেমন মন্দ কোন উপধিতে ভূষিত করতেন না। কিন্তু, সত্য ইতিহাস কোন দিনও কোন ভাবেই চেপে রাখা যায় না, যায়ওনি; সে সময়ের পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে সব কিছু ঠিকই প্রকাশিত হয়েছে এবং হক প্রন্থিদের আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা ঠিকই ইতিহাসে অমর করে রেখেছেন।

সে সময় ইংরেজদের বিপক্ষে যাওয়া  মুসলমানদের ইংরেজ সরকার অতি সহজেই একটি 'ওহাবী' তকমা লাগিয়ে দিতো। গাইরে মুক্বাল্লিদরা এই ওহহাবী নামের তকমা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তাই তারা তখন নিজেদের 'মুহাম্মদী' এবং পরবর্তীতে 'আহলে হাদীস' নাম বরাদ্দ করার জন্য সম্ভাব্য সকল অপতৎপরতা চালিয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে গাইরে মুক্বাল্লিদদের তৎকালীন মুখমাত্র মৌলভী মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভী লাহোরী বৃটিশ সরকারের প্রধান কার্যালয় এবং পাঞ্জাব, সি-পি, ইউ-পি, বোম্বাই, মাদ্রাজ ও বাঙ্গালসহ বিভিন্ন শাখা অফিসে ইংরেজ প্রশাসনের আনুগত্যতা ও বশ্যতা স্বীকার করে তাদের জন্য 'আহলে হাদীস' নামটি বরাদ্দ দেয়ার জন্য দরখাস্ত করে। এ দরখাস্তগুলোর প্রতি-উত্তরসহ তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত তৎকালীন 'এশায়াতুস সুন্নাহ' পত্রিকায় (পৃষ্ঠা : ২৪-২৬, সংখ্যা: ২, খণ্ড : ১১) প্রকাশ করা হয়। যা পরে সাময়ীক নিবন্ধ আকারেও প্রকাশ পায় ও বাজারজাত করা হয়। তাদের মানসিকতা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কিছুটা আঁচ করার জন্য এখানে একটি উর্দু দরখাস্তের বাংলা অনুবাদ তুলে ধরছি।

'খেদমতে জনাব গভর্মেন্ট সেক্রেটারী,

আমি আপনার খেদমতে লাইন কয়েক লেখার অনুমতি এবং এর জন্য ক্ষমাও প্রার্থনা  করছি। আমার সম্পাদিত মাসিক 'এশায়াতুস সুন্নাহ' পত্রিকায় ১৮৮৬ ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলাম যে, ওহাবী শব্দটি ইংরেজ সরকারের নিমক হারাম ও রাষ্ট্রদ্রোহীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ শব্দটি হিন্দুস্তানের মুসলমানদের ঐ অংশের জন্য ব্যবহার সমীচিন হবে না, যাদেরকে 'আহলে হাদীস' বলা হয় এবং সর্বদা ইংরেজ সরকারের নিমক হালালী, আনুগত্যতা ও কল্যাণই প্রত্যাশা করে, যা বার বার প্রমাণও হয়েছে এবং সরকারী চিঠি প্রত্রে এর স্বীকৃতিও রয়েছে।
অতএব, এ দলের প্রতি ওহাবী শব্দ ব্যবহারের জোর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে এবং সাথে সাথে গভর্মেন্টের বরাবর অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে আবেদন করা যাচ্ছে যে, সরকারীভাবে এ ওহাবী শব্দ রহতি করে আমাদের উপর এর ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক এবং এ শব্দের পরিবর্তে 'আহলে হাদীস' সম্বোধন করা হোক।

আপনার একান্ত অনুগত খাদেম

আবু সাঈদ মুহাম্মদ হুসাইন

সম্পাদক : এশায়াতুস সুন্নাহ'

দরখাস্ত অনুযায়ী ইংরেজ সরকার তাদের জন্য 'ওহাবী' শব্দের পরিবর্তে 'আহলে হাদীস' নাম বরাদ্দ করেছে; এবং সরকারী কাগজপত্র, চিঠি ও সকল পর্যায়ে তাদের 'আহলে হাদীস' সম্বোধনের নোটিশ জারি করে নিয়মতান্তিকভাবে দরখাস্তকারীকেও লিখিতভাবে মঞ্জুরী নোটিশ দ্বারা অবহিত করেছে।

সর্বপ্রথম পাঞ্জাব গভার্মেন্ট সেক্রেটারী মি: ডব্লউ, এম, এন (W.M.N) বাহাদুর চিঠি নং-১৭৫৮ এর মাধ্যমে ৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৬ ইংরেজিতে অনুমোদনপত্র প্রেরণ করেন। অতঃপর ১৪ই জুলাই ১৮৮৮ইং সি.পি গভার্মেন্ট চিঠি নং-৪০৭ এর মাধ্যমে এবং ২০শে জুলাই ১৮৮৮ইং ইউ.পি গভার্মেন্ট চিঠি নং-৩৮৬ এর মাধমে এবং ১৪ই আগষ্ট ১৮৮৮ইং বোম্বাই গভার্মেন্ট চিঠি নং-৭৩২ এর মাধ্যমে এবং ১৫ই আগষ্ট ১৮৮৮মাদ্রাজ গভার্মেন্ট চিঠি নং ১২৭ এর মাধ্যমে এবং ৪ঠা মার্চ ১৮৯০ইং বাঙ্গাল গভার্মেন্ট চিঠি নং-১৫৫ এর মাধ্যমে দরখাস্তকারী মৌলভী আবু সাইদ মোহাম্মদ বাটালভীকে অবহিত করা হয়। –(এশায়াতুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা : ৩২-৩৯, সংখ্যা : ২, খণ্ড : ১১)

কোন মুসলিম দল বা জামাতের নাম অমুসলিম তথা মুসলামানদের চিরশত্রু খ্রিস্টান নাছারাদের মাধ্যমে বরাদ্দ করার ঘটনা সারে চৌদ্দশ বছরের ইসলামের ইতিহাসে এটিই প্রথম  এবং এটি একটি বিরল ঘটনা; যা কেবল এই উপমহাদেশের গাইরে মুক্বাল্লিদ আহলে হাদীসদেরই গৌরব ও সৌভাগ্যের ব্যাপার! তাই তারা এ ইতিহাসটি অত্যন্ত গৌরবের সাথে নিজেদের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করে সে'সময় বেশ তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিল!

সুরা মুহাম্মদ-এর ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন-  
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ  অর্থাৎ - হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রসূলের (সাঃ) আনুগত্য কর এবং নিজেদের কর্ম বিনষ্ট করো না।   
সুরা মুনাফিকুন-এর ১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন-
إِذَا جَاءكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ অর্থাৎ - মুনাফিকরা আপনার কাছে এসে বলেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। 

সুরা আল ইমরান-এর ৩১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন-
 قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ অর্থাৎ - বল, 'যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমার অনুসরণ করো। (তাহলে) আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।'

অনুসরণের নির্দেশবিষয়ক পবিত্র কুর'আনের বর্ণনা - 
১). ‘তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং অনুগত হও রাসূলের।' - (সূরা আল ইমরান : ৩২)
২). ‘ওহে যারা ঈমান এনেছো! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের।' (সূরা আননিসা : ৫৯) 
৩). ‘আর তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো আর রাসূলের আনুগত্য করো এবং সতর্ক হও।' - (সূরা আল মায়েদা : ৯২) 

অনুসরণকারীদের জন্য সুসংবাদ : রাসুল (সাঃ)-কে অনুসরণের নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকেও রাসূলুল্লাহর (সাঃ)-এর অনুসরণ-অনুকরণে বাধ্য করার জন্য, অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করার জন্য পুরস্কারস্বরূপ সুসংবাদও দিয়েছেন; পবিত্র কুর'আনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে - 
১). ‘আর যে কেউ আল্লাহর আনুগত্য করে এবং রাসূলের অনুসরণ করে, সে তো অবশ্যই মহাসাফল্য লাভ করবে।' - (সূরা আহযাব : ৭১) 
২). ‘আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত হয়, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে, এ হলো মহাসাফল্য।' - (সূরা নিসা : ১৩) 
৩). ‘আপনি বলে দিন, যদি তোমরা প্রকৃতই আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করো, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালো বাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন।' - (সূরা আল ইমরান : ৩১)

হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন, 'তোমরা আমার সুন্নাহকে অনুসরন কর।' 
এখন একটি বিষয় ভাল করে লক্ষ্য করুন - প্রত্যেক সুন্নাহই এক একটি হাদিস, কিন্তু প্রত্যেক হাদিসই সুন্নাহ নয়। দ্বীনের উপর চলার জন্য উম্মত সকল হাদীসকেই অনুসরন করতে পারবে কি? অবশ্যই না; যদি সেই হাদীসটি সহীহও হয়। কেননা অনেক সহীহ হাদীস আছে যা অন্য একটি বা একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা রহিত (বাতিল) হয়ে গেছে; বা যা পূর্বের বিধান ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হুকুম দ্বারা তা রহিত হয়ে গেছে। নিচে তেমনই  কয়েকটি হাদীস-এর উদাহরণ দেয়া হলো -

১). ইসলামের প্রথম যুগে নামাযরত অবস্থায় কথা বলা, সালাম দেওয়া , সালামের উত্তর দেওয়া সবই বৈধ ছিল। –(সহীহ্ বুখারী; হাদীস নং- ১১৯৯, ১২০০)
নামাজে কথা বলা যাবে এটা সহীহ হাদীসে আছে, কিন্তু আপনি কি এখন নামাজে কথা বলতে পারবেন? না পারবেন না; কারণ পরবর্তীতে এই বিধান রহিত হয়ে যায়।

২). হুজুর পাক (সাঃ)-সহ অন্যান্য মুসলিমগণ হিজরতের পর মদীনায় ১৬/১৭ মাস বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায আদায় করতেন। –)সহীহ্ বুখারী; হাদীস নং- ৭২৫২)
এখন কি আপনি পারবেন সহিহ হাদিসের ধোয়া তুলে মক্কার দিকে ফিরে নামাজ না আদায় করে বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতে?

৩). ইসলামের প্রথম যুগে বিধান ছিল যে, আগুনে রান্নাকৃত খাদ্য গ্রহণ করলে ওজু ভেঙ্গে যাবে। –(সহীহ্ বুখারী; হাদীস নং- ২০৮)
এটা তো সহীহ হাদীসেই আছে। আপনার জন্য কি এটা করা এখন বৈধ হবে? না, এটা হবে সুস্পষ্ট হারাম। কারণ, পরবর্তীতে এই বিধান বাতিল হয়ে গেছে।
এগুলো সবই সহীহ্ হাদীস, কিন্তু সুন্নাহ নয়; অর্থাৎ এই হাদীসগুলো উম্মতের জন্য এখন আর অনুসরণীয়  নয়।

৪). রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ১১টি বিয়ে করেছেন; এবং দেন মহর ছাড়াও তিনি বিয়ে করেছেন। –(সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ফী সীরাতি খাইরিল ইবাদ ১১/১৪৩-২১৭)
আপনি কি পারবেন ১১টি বিয়ে করতে? এগুলি তো সহীহ হাদিসেই আছে। তবে কেন পারবেন না? এমন অনেক হাদিস আছে যার বিধান নবী করীম (সাঃ)-এর সঙ্গে নির্দিষ্ট; উম্মতের জন্য সেসব আমল করা বৈধ নয়। এই বিষয়গুলো অবশ্যই বুঝতে হবে এবং বুঝা প্রয়োজনও।

৫). রাসুল পাক (সাঃ) দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছেন। –(সহীহ্ বুখারী; হাদীস নং- ১৯৩৮) কোমরে ব্যথা থাকার কারণে কিংবা এস্তেন্জা করার স্থানে বসার দ্বারা শরীরে বা কাপড়ে নাপাকি লাগার অশংঙ্কায় তিনি সারা জীবনে মাত্র ২বার দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেছেন; কিন্তু হাদীসের বর্ণনায় এসব কারণের কথা উল্লেখ নেই । শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার কথা আলোচিত হয়েছে। তো হাদীস সহীহ বলে এর উপর আমল করে কি দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করাকে সুন্নাহ বলা যাবে? এগুলো সবই সহীহ হাদীস, কিন্তু সুন্নাহ নয়; তাই, এই হাদীসগুলো উম্মতের জন্য অনুসরনীয় নয়।

যারা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে দাবী করছেন তাদের উচিৎ ১১টি বিয়ে করা, মহর ছাড়া বিয়ে করা, ইহরাম ও রোযা অবস্থায় শিঙ্গা লাগানো, দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা, বাইতুল মোকাদ্দেসের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করা, নামাজরত অবস্থায় কথা বলা; কারণ এর সবগুলোই সহিহ হাদীসে রয়েছে। কিন্তু  এসব এখন আর কোনভাবেই করতে পারবেন না। সুতরাং প্রকৃত সত্য হলো— কোন মুসলমানই কখনো আহলে হাদিস হতে পারে না পারবে না, প্রতিটি মুসলিমকে হতে হবে আহলে সুন্নাহ।

সহীহ হাদীসে মানবো ঠিক আছে, কিন্তু মাজহাব মানবো কেন? এই স্লোগানটি দিয়ে মুলতঃ ইসলাম না জানা অজ্ঞদেরই আই ওয়াশ করা হয়। আর যারা জেনে বুঝে এসব করে তাদের আসলে উদ্দেশ্য কি? এসব লিখতে গেলে লেখা আর কোনদিনই শেষ হবে না; এমন কি কাল কিয়ামত পর্যন্ত লিখলেও শেষ করা যাবে না। তবে যারা জেনে বুঝে এসব করে, তাদের উদ্দেশ্য কায়িক কিছু ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ। ওরা আসলে ব্রিটিশ-আমেরিকান মুসলিম বিরোধী মিশন বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে। আমেরিকা ও ইহুদীদের লক্ষ্য হচ্ছে, মুসলিমদের মধ্যে বিবাদ বাঁধিয়ে রেখে মুসলমানের উপর আধিপত্য বিস্তার করা।

এখন কথা হচ্ছে কোনটি সুন্নাহ আর কোনটি হাদীস? কোন হাদিসটি আমলযোগ্য নয়, কিংবা কোন হাদিসের চেয়ে কোন হাদিস অধিক আমলযোগ্য? এসব তো আমরা সবায়ই জানিনা, বুঝবো কি করে? এসব জানেন হাদীসবীদ ফকিহগণ। তাই, আমাদের উচিত তাঁদের অনুসরণ করা। আর তাদের অনুসরণ করাকেই বলে তাকলীদ করা; অন্য কথায় মাজহাব মানা। 

এ বিষয়ে রিয়াদুস সালেহিন রচনাকারী বিখ্যাত সালাফী ইমাম নববী বলেন, 'ব্যক্তি তাকলীদের অপরিহার্যতার কারণ এই যে, মুক্ত তাকলীদের অনুমতি দেয়া হলে প্রবৃত্তি তাড়িত মানুষ সকল মাজহাবের অনুকূল বিষয়গুলোই শুধু বেছে নিবে। ফলে হালাল-হারাম ও বৈধ-অবৈধ নির্ধারণের এখতিয়ার এসে যাবে তার হাতে। প্রথম যুগে অবশ্য ব্যক্তি তাকলীদ পুরাপুরি সম্ভব ছিলো না (তথাপিও ফকীহ সাহাবী (রাঃ)-গণের তাকলীদ করা হত )। কেননা, ফিকাহ বিষয়ক মাজহাবগুলো যেমন সুবিন্যস্ত ও পূর্নাঙ্গ ছিলো না, তেমনি সর্বত্র সেসব সহজলভ্যও ছিলো না। কিন্তু এখন তা সুবিন্যস্ত ও পূর্নাঙ্গ আকারে সর্বত্র সহজলভ্য। সুতরাং যে কোন একটি মাজহাব বেছে নিয়ে একনিষ্টভাবে তা অনুসরণ করাই এখন অপরিহার্য।'  –(আল মাজমু শরহুল মুহায্যাব; ১/১৯)

গাইরে মুকাল্লিদ আহলে হাদীসরা মানুষের আই ওয়াশ করার জন্য বলে থাকেন, মাজহাবের মধ্যে এতো মত পার্থক্য কেন? তারা দ্বীনের মধ্যে বিভাজন করছে। প্রথম কথা হচ্ছে, মাজহাবের ইমামদের মধ্যে যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে তা মুস্তাহাব। এগুলোর ভুল হলে কোন ক্ষতি নেই, সঠিকভাবে পালন করতে পারলে ভাল। যেমন– নামাজে কোথায় হাত বাধতে হবে এটা নিয়ে অনেক মতপার্থক্য। হাত যেখানেই বাধা হউক না কেন নামাজ আদায় হয়ে যাবে। এই মতপার্থক্যগুলো এতই সুক্ষ্ম যে, কাউকে ভুল বলা যায় না; প্রত্যেকের দলিল দেখলে মনে হয়, তারাই সঠিক।

মনে করুন, একটি অণুতে একটি পরমাণু কম হয়েছে; আরেকজন বলছেন, একটি বেশি হয়েছে। অণু-পরমাণু খুবই সুক্ষ্ম হওয়ায় আমরা জানি না আসলে কার কথাটি সঠিক। আমাদের পূর্ববর্তী মহান ইমামদের মাঝে মত পার্থক্যগুলোও ছিল ঠিক এতোটাই সুক্ষ্ম। সাহাবী (রাঃ)-গণের মধ্যেও এ'ধরনের মতপার্থক্য ছিল। অতএব, এসব বুঝতে হবে নিজের বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে।

হে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা! আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন॥

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২৩ মার্চ, ২০১৮.

1 টি মন্তব্য: