সোমবার, ২২ জুন, ২০২০

বিশ্বায়ন কি কেঁড়ে নিয়েছে আমাদের মমত্ববোধ মনুষ্যত্ব?

'আধুনিকতার বলি' বলি আর 'সভ্যতার বলি' বলি যা-ই বলি না কেন এ'সবের এক হৃদয়বিদারক অনাসৃষ্টি বিভিন্ন দিবসগুলি। বাবা দিবস নামের এই বিশেষ দিবসে আমার পরম পূজনীয় প্রাণপ্রিয় শিক্ষক সদ্যপ্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের মেয়ে কারিশমা ফারহীন চৌধুরীর একটি লেখা পড়ছিলাম প্রথম আলোতে, আর ভাবছিলাম কত কি? স্যারের মেয়ে থাকেন আমেরিকায়, সেখানকার কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি অধ্যাপিকা; স্যারের মৃত্যুর সময় তিনি কাছে আসতে পারেননি, কাছে আসতে পারেননি লাশ দাফনের সময়ও! আজ বাবা দিবসে তার বিশাল স্মৃতিচারণ সংবাদ মিডিয়ায়! এ'সব কি নিরর্থক অনর্থক নয়? মনুষ্য সম্পর্ক কি শুধুই স্মৃতিচারণের জন্যে?

কবে যেন পড়েছিলাম কোটি টাকার সম্পত্তি লিখে নিয়ে ৭০ বছর বয়সের এক বয়ঃবৃদ্ধা মায়ের ভরণপোষণ বন্ধ করে দেয় তাঁরই ঔরসজাত দুই সন্তান! শুধু কি তাই? সন্তানদের কাছে খাবার চাওয়ায় জন্মদাত্রী মা'য়ের মাথাও ফাটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয় সন্তান নামের ওসব অসভ্য বর্বর অমানুষরা! যত টুকো স্মরণে পড়ছে ঘটনাটি সম্ভবত নারায়ণগঞ্জের এবং দু'চার দিন আগের। অবশ্য এমনতর ঘটনা এদেশে হরহামেশাই ঘটছে, খুবই অল্প কিছু ঘটনা পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন মিডিয়ায় উঠে আসছে। এ দেশের সকল সন্তানদের কাছে আজ আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে, বাবা-মা কি শুধুই কোন বিশেষ দিবসে স্মরণীয় এবং বিশেষ সময়ে পূজনীয়? বা এমন নিগৃহীত হওয়ার মতো কোন কিছু?   

স্রষ্টার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব চিরস্থায়ী সৃষ্টি পৃথিবীতে আসে এক জটিল পরিক্রমায় মাতৃগর্ভ হয়ে। মাতৃগর্ভে প্রতিটি মানব শিশুই এককোষী ভ্রূণ থেকে হয় একখণ্ড মাংসপিণ্ড এবং অতঃপর মানবাকৃতির পরভুক প্রাণী হিসেবে একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত করে এবং বেড়ে উঠে মা'য়ের রক্ত-মাংসে নাড়ী পেচিয়ে; তাই তো প্রতিটি সন্তানকে বলা হয় তার জননীর নাড়ীছেড়া ধন। অতঃপর শিশুটি ভূমিষ্ট হয় পৃথিবীর জমিনে, দুই বছর পর্যন্ত মায়ের রক্তের নির্যাস নিয়েই বেড়ে উঠে। তা ছাড়া সেই ছোট্ট শিশুটির বেঁচে থাকার আর কোন অবলম্বন নেই, গত্যন্তর নেই। সেই শিশুটি বড় হয়ে যখন মা'কে অবহেলা করে বা নিগ্রহ করে, তখন মা'য়ের মনটা কেমন করে? আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলাই-বা তা সহ্য করবেন কি করে?? 

রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়ে নিজেরা কায়ক্লেশে চলেও সব সুখ সন্তানকে দিয়ে আদরে-সোহাগে বড় করে মা তার সেই সন্তানটিকে; বাবা যোগায় শক্তি-সাহস। বড় হতে থাকে ছোট্ট শিশুটি। শিশুটিকে বড় করতে বাবা-মা'কে কতটা পরিশ্রম আর কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তা প্রতিটি বাবা-মা মাত্রই অবগত। বড় হয়ে যদি দু'দিনের পরিচিত/পরিচিতা কারো মোহে সেই সন্তানটি তার ত্রিশ/বত্রিশ বছরের অতীতকে অস্বীকার করে বা অতীত ভুলে যায়, তখন আর কিই-বা করার থাকে বা বলার থাকে? কিন্তু প্রকৃতি তাকে কখনো ক্ষমা করে না, তার অন্যায়ের যথোপযুক্ত প্রতিফল ঠিকই একদিন দিয়ে দেয়। সন্তান টের পেলেও তখন আর আফসোস করে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে কোন লাভ হয় না, আর কিছুই করার থাকে না।

কিছু কিছু মৌলিক জিনিস এখন মানুষের মাঝ থেকে কেমন যেন উবে গেছে, বিশেষ করে আবেগ-অনুভূতির সম্পর্কগুলি। স্নেহ-মায়া-মমতা, প্রেম-প্রীতি-স্বাদ-আশা দিয়ে গড়া পারিবারিক সম্পর্কগুলি ও নির্মল ভালোবাসার বন্ধনগুলি একেবারে চ্ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে; অনেকের কাছে আবার এসব এখন একেবারে ঠুনকো জিনিস! একই পরিবারে মিলেমিশে থেকে, একই পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠেও হটাৎ পরিবার ত্যাগ করছে নতুন কারো প্রলুব্ধতায়, অন্যের প্ররোচনায়! এ কি বিশ্বায়নের ছোঁয়া, না কি অন্য কোন কিছু? অতি আধুনিকতার এই করাল গ্রাস শাশ্বত বাঙালির চিরাচরিত পারিবারিক জীবন ব্যবস্থাকে একেবারে তচনচ করে দিয়েছে! প্রায় প্রতিটি ঘরেই আজ এই একই সমস্যা। খণ্ডিত হচ্ছে পরিবার, বিচ্ছিন্ন হচ্ছে বাবা-মাও; কেউ-বা ঠাই পাচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে, কেউ-বা থাকছে রাস্তায়।  

ক্ষণস্থায়ী সৃষ্টি পশু-পাখির মাঝেও পারিবারিক বলয় ও মায়ার বন্ধন দেখা যায়, সহোদর-সহোদরা বা জন্মদাতা-জন্মদাত্রীর প্রতি আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ পরিলক্ষিত হয়; কিন্তু আজকের দুনিয়ায় কিছু অমানুষের মাঝে এইসবের কোন দাম নেই, আবেগ অনুভূতির লেশমাত্র বালাই নেই! বিশেষ করে কিছু তথাকথিত উচ্চ বিলাসী তরুণ-তরুণীর মাঝে এইসবের ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। পবিত্র কুর'আনুল কারীমে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ঘোষণা করেছেন— সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এর মিল কোথায়? তবে কি আমরা কেয়ামতের সম্মুখীন বা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে? 

মানুষ-মনুষ্যত্ববোধ, মায়া-মনতা, শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা এসব মানবীয় আচরণ গঠিত শব্দগুলি নিয়ে আজকাল আমার মাঝে বেশ খটকা লাগছে! তবে কি এইসব শব্দগুলি শুধুই আক্ষরিক? অনেক লোকের কাছে মনে হয় শব্দগুলি শুধুই মুখস্থ বিদ্যার পাঠ, বই পুস্তকের শ্রীবর্ধক বা শোভা বাড়ানোর উপকরণ; অর্থ আর প্রাচুর্যের মোহই তাদের কাছে সবকিছু! প্রকৃতির নির্মম পরিহাস করোনায় চতুর্দিকে মৃত্যুর যে বিভীষিকা চলছে, প্রকৃতিতে থাকা আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার দেয়া নিয়ামত অক্সিজেন স্বাভাবিকভাবে না নিতে পেরে শতশত ধনকুবের যে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করছে তা দেখেও কি তাদের মোটেও বোধের উদয় হয় না??  

মানুষের মধ্যে যখন মনুষ্যত্ববোধ মমত্ববোধ হারিয়ে যায় তখন সে আর মানুষ থাকে না, তাকে মানুষ বলা যায় না। মানুষ হতে হলে অবশ্যই তার ভেতর কিছু মানবীয় গুণাবলী থাকা চাই। আবার কারো মাঝে যদি মানবিক আচরণের অভাব পরিলক্ষিত হয়, তাকেও মানুষ বলা যায় না। বর্তমান দুনিয়ায় মানুষের নৈতিকতার কেন এতো অভাব? আসলে বর্তমান দুনিয়ায় নৈতিক শিক্ষারই বড় বেশি অভাব। নৈতিক শিক্ষা ছাড়া মানবীয় গুণাবলী বা আচরণ রপ্ত করা অন্য কোনভাবে সম্ভব নয় বা কখনো অর্জিত করা যায়ও না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পেড়িয়ে অনেকগুলি সার্টিফিকেট পেলেই যেমন শিক্ষিত হওয়া যায় না, ঠিক তদ্রূপ কেবলমাত্র মনুষ্যকুলে জন্ম নিলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হতে হলে বা মানুষ হিসাবে পরিচয় দিতে গেলে থাকতে হবে— চিন্তা-চেতনা, বিবেক-বিবেচনা, কাণ্ডজ্ঞান আর বিচার-বুদ্ধির ক্ষমতা। 

প্রাণিকুলে একমাত্র মানুষই মনুষ্যত্বের অধিকারী, মানবতা বা মনুষ্যত্ববোধ না থাকলে মানুষ কখনই মানুষ নয়। লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, উগ্রতা, যৌনতা, মোহ, স্বার্থপরতা, ক্রোধ প্রভৃতির কারণে মানুষের মনুষ্যত্ব হারিয়ে যায়। কোন লোকের মনুষ্যত্ব লোপ পেলে সে আর তখন মানুষ থাকে না, সে হয়ে যায় অমানুষ। গুম, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, চুরি, ডাকাতি, ইভটিজিং, প্রতারণা, চাঁদাবাজি, ঘুষ, অপহরণ, দুর্নীতি, অরাজকতা, মিথ্যা বলা, কারো ক্ষতি করা, কাউকে বিপদে ফেলা, অশান্তি করা, মা-বাবার অবাধ্য হওয়া ও পরিবার-পরিজনকে অপমান করা ইত্যাদি সব অনাসৃষ্টি অমানুষেরই কাজ। আর আজ আমাদের আজকের সমাজে এতো বেশি সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে কেন? এতো বেশি আধিপত্য বিস্তার ও অহংকারি লোকজনের উদ্ভব ঘটেছে কেন? মানুষের মনুষ্যত্ব লোপ পাওয়ার জন্যই এসব হয়েছে, ঘটেছে।
 
মানুষের ভেতর ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব থাকা খুবই স্বাভাবিক; কিন্তু মন্দকে পরিহার করে ভালোকে বেছে নেয়া এবং ভালো পথ অনুসরণ করাই মনুষ্যত্বের কাজ। আদর, স্নেহ, মায়া, মমতা, প্রেম, ভালবাসা, দয়া, উদারতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, সততা, ধৈর্য, ত্যাগ, ক্ষমা, সহানুভূতি, সৌজন্য, আদব, শৃঙ্খলা, বিনয়, কল্যাণ কামনা, ভালো ব্যবহার ইত্যাদি হচ্ছে মনুষ্যত্বের উপাদান; প্রতিটি মানুষের মাঝে এসব মনুষ্যত্বগুণ লুকিয়ে আছে। শুধু জাগাতে হবে। হিংস্র পশুত্ব স্বভাবটাকে দমিয়ে রাখতে পারলেই এবং ধৈর্য-সহিষ্ণুতার সঙ্গে একটু চর্চা করলেই মানুষের ভেতর থেকে মনুষ্যত্ব এমনিতেই জেগে ওঠে। মানুষকে শুধু মানুষ হলেই হবে না, ভেতরের মনুষ্যত্ববোধকে জাগাতে হবে; কেননা মনুষ্যত্ববোধ মানুষের জীবনকে আলোকিত করে। মনুষ্যত্বহীন মানবের জীবন কখনও আলোর মুখ দেখে না। তাই প্রতিটি মানুষের উচিত মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনা করা। 

অনন্ত সুন্দর ও কল্যাণের প্রত্যাশা নিয়ে মানুষের ভেতরে মনুষ্যত্ব জেগে ওঠুক, সমাজ থেকে দূর হউক সকল জঞ্জাল। পৃথিবীর প্রতিটি পরিবার আবার আগের মতো সুখী ও সুন্দর হউক, বাংলার প্রতিটি ঘরে বসবাস করুক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রতিটি  ঘর আলোকিত করুক বাবা-মা।। 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২১ জুন, ২০২০.

২টি মন্তব্য: