দুনিয়ার এই ক্রান্তিকালে যারা এখনো বেড়ানো নিয়ে মেতে আছেন তারা নিজেরাও হয়তো জানেন না আপনি কত বড় ক্ষতি করছেন বা করতে যাচ্ছেন দেশ ও জাতির, আপনার পরিবার পরিজনের। ছুটি পেয়ে আপনি হয়তো নিশ্চিন্তে এবাড়ি ওবাড়ি করছেন। কোন বাড়ি থেকে যে আপনি মরণব্যাধি করোনা জার্ম নিজ দেহে বহন করে নিয়ে আসবেন, তা বুঝতেই পারবেন না। সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্তে ভাইরাসটি আজ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ ছিল পাইয়োনিয়ার করোনা ভিকটিম এরিয়া। সারা দেশে এখন আর আপনি কোন এলাকাকে বাদ দিতে পারবেন না, যে এলাকায় করোনা আক্রান্ত রোগী নেই।
গত সপ্তাহে ফোনে মা'য়ের সাথে আমার রীতিমতো ঝগড়া হয়ে গেল! রাগ করে পুরো এক সপ্তাহ আমার ফোন ধরেনি, করেওনি! ঘটনা শুনলে হয়তো অপনি মনে করতে পারেন আমি একটা অমানবিক কাজ করেছি। একদিক দিয়ে চিন্তা করলে আমার নিজের কাছেও তাই মনে হয়। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় সঠিক সময়ে সঠিক কাজটিই আমি করেছিলাম বলে মনে হচ্ছে। নয়তো মা'য়ের অনেক বড় কোন ক্ষতি হয়তো হয়ে যেতে পারতো।
আমাদের ছোট খালা (বয়সে আমার অনেক ছোট) নারায়গঞ্জে বসবাস করে। আজ আম্মা আমাকে ফোন করে বললেন আমি যেন তার সাথে একটু যোগাযোগ করি, সে নাকি খুবই অসুস্থ। অথচ গত সপ্তাহে এই খালাকে নিয়েই মা'য়ের সাথে আমার তুমুল ঝগড়া! করোনার ছুটি(!) পেয়ে সে আমাদের আরেক খালার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। আম্মা ফোনে তাকে আমাদের বাড়িতে দাওয়াত করে। বোকা ছোট ভাই মেহমানদারির ব্যবস্থা করছিল! কথাটা শুনেই আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে! যথেষ্ট বয়স হয়েছে আম্মার, তাই তিনি হয়তো বে-বুঝ হয়ে পড়েছেন, ছোট ভাইয়ের তো ন্যুনতম জ্ঞান থাকার দরকার ছিল? এমনিতেই আম্মা একজন জন্মগত হাঁপানি রোগী। প্রতি শীতেই একবার তাঁকে হাসপাতালে নিতে হয়। এই শীতেও নিউমোনিয়া বাধিয়ে বসেছিলেন। ডিসেম্বর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি তিনমাস রীতিমতো মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছেন। তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমি ক্লান্ত।
যে পরিমাণ ঔষধ আর ইঞ্জেকশন আম্মা'কে পুশ করা হয়েছে নতুন করে আবার ইনফ্লুয়েঞ্জা বা করোনাভাইরাস কোনভাবে যদি তার শরীরে ডুকে যায়, কিছুতেই আর চিকিৎসা করানো সম্ভব হবে না; ডাক্তার এ কথা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন। এই কথা ভেবে আম্মা'কে অনুরোধ করি, এমন অবস্থায় খালাকে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতে নিষেধ করতে। তিনি বলতে পারেন নি, বলতে পারেনি ছোট ভাইও। অগত্যা আমিই ফোন করে তাকে নিষেধ করি। সে ক্ষেপে যায় এবং আমাকে একগাদা হাদিস শোনাতে থাকে! অগত্যা দিয়েছিলাম এক ঠাডা ধমক! আর এতেই আম্মা এক সপ্তাহ আমার সাথে কথা বলেননি।
আমাদের দেশের আথিতেয়তা দুনিয়া জোরা প্রসিদ্ধ। তাই বলে কি এমন সময়ে? চীন ইউরোপ আমেরিকায় মেসাকার চালিয়ে করোনা এখন এশিয়া চষে বেড়াচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বেশ আগে থেকেই আমাদের হুশিয়ার করে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় পাওয়ার পরও আমরা সে মতো কাজ করতে পারিনি। বরং অবহেলা করেছি, পূর্ব প্রস্তুতি নেইনি বা নিতে পারিনি। দেরিতে হলেও সরকার ঠিকই তা বুঝতে পেরেছে, কিন্তু আমরা কিছুতেই বুঝতে পারিনি পারছি না। ১৯২০ সালের স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাসের মেসাকার পৃথিবীর অসংখ্য মানুষকে মাটির নীচে পাঠিয়েছিল। ১৯১৮ সালের জানুয়ারী হতে ডিসেম্বর ১৯২০ অবধি এটি ৫০ কোটি মানুষের মাঝে ছড়িয়েছিল; যা সেই সময়ে বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ। আনুমানিক ১.৭ থেকে ৫ কোটি বা কোন কোন হিসাবে ১০ কোটির মত মানুষ এতে মারা গিয়েছিল। যা ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক একটি মহামারী। সেই ইতিহাস এ দেশের মানুষ জানে না বলেই হয়তো-বা এখনো তারা করোনাভাইরাস নিয়ে অতটা উদাসীন।
চীন থেকে শুরু, ইরান ইতালি হয়ে সারা পৃথিবীতে করোনা রীতিমতো মেসাকার চালিয়ে গেছে, যাচ্ছে। থেমে নেই তার করাল গ্রাস! প্রতিটি দেশের মেসাকারের দিকে লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝতে পারা যায়, চতুর্থ ধাপে করোনা ধ্বংসাত্মক রূপ নেয়। আমাদের দেশে এখনো করোনা চতুর্থ ধাপে পদার্পণ করেনি। ইতালিতে আক্রান্তের ইতিহাস লক্ষ্য করলে স্পষ্ট বুঝা যায় প্রথম আক্রান্তের ৪৫ দিন পর সেখানে চতুর্থ ধাপ অর্থাৎ মহামারি শুরু হয়; যা এখনো চলমান। স্পেনে মহামারি রূপ নেয় ৫০ দিন পর, যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫ দিন পর। আজ ১১ এপ্রিল, আমরা প্রথম আক্রান্ত হয়েছি ৮ মার্চ, ৩৩ দিন চলছে আমাদের দেশে করোনা অভিযাত্রার। আস্তে আস্তে প্রতিদিন এখনই যে হারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং সংখ্যা বাড়ছে, সামনের ১৫/১৭ দিন পর দেশের সার্বিক চিত্র কি হবে বা হতে পারে তা ভেবে এক অজানা আশংকায় আমার বুকটা কেপে উঠে।
কোনখানে কোন করোনা রোগী আবিষ্কৃত(!) হলে এখনো দেখতে পাচ্ছি- অদ্ভুত মানসিকতার কিছু লোক ছোট ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে ছুটে চলে সেই বাড়িটি দেখতে! প্রশাসনের অদ্ভুত আরেক চিন্তা, যেখানে করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায় সেখনটায়ই শুধু সাথে সাথে লকডাউন করা হয়! এটা কোন ধরনের উদ্ভট পরিকল্পনা তা আমার বুঝে আসে না। যার টেস্ট পজিটিভ হয়, সে তো আগেও সেই এলাকায়ই ছিল, ঘুরেও বেরিয়েছে, নয় কি? ধরা না পড়ার পূর্বে যদি সে অন্য পাঁচটি এলাকায় ভিজিট করে থেকে থাকে, তবে শুধুমাত্র আক্রান্তের বাড়িটি লক করে ফায়দাটা কি?? কে বা কারা এমন মোটা বুদ্ধি নিয়ে এই কাজ করে যাচ্ছেন তা আমি জানি না বুঝিও না! তবে এর ফল যে খারাপের দিকে যাচ্ছে তা খুব ভালো করেই টের পাওয়া যাচ্ছে। কেন জানি করোনা নিয়ে পুরো পরিকল্পনাটাই আমার কাছে কেমন ভুল ঠেকছে! এই ভুলের মাশুল না জানি জাতিকে চরমভাবে গুনতে হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অনুগ্রহপূর্বক এই মূহুর্তে এলাকাভিত্তিক লকডাউন না দিয়ে দেশে কারফিউ জারির আদেশ দিন। নয়তো কিছুতেই এই উন্নাসিক জাতিকে ঘরে পাঠানো সম্ভব হবে না, নিরাপদ দূরত্বেও রাখতে পারবেন না। কারণ আমরা শিক্ষিত হয়েছি সত্য, কিন্তু মানুষ হতে পারিনি।।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১১ এপ্রিল, ২০২০.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন