সোমবার, ২২ জুন, ২০২০

নাজি রে নাজি তোর লুডি ফকেজ!

'নাজি' আমার গ্রামের সহজসরল হাবাগোবা প্রকৃতির একজন ছেলে, আমাদের বাড়ির পাশেই তাদের বাড়ি। একসময় তাদের বাড়ির বেশিরভাগ লোকজনই অন্যের জমি চাষ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতো। গ্রামের পশ্চিম পাশে খাল পাড়ে কিছুটা নিচু জায়গায় তাদের বাড়ি হওয়াতে 'নাম বাড়ি' বা 'পশ্চিম বাড়ি' হিসেবে তাদের বাড়িটি এলাকায় পরিচিত। পশ্চিম বাড়ির নাজির উদ্দিন 'নাজি' ছোটবেলা থেকেই একটু অন্য রকম; তার আচার আচরণ অনেকটা প্রতিবন্ধির মতো ছিল। নাজির মা সেই হাবাগোবা নাজিরকে বিয়ে দেয় বেশ চালাকচতুর দুর গ্রামের একজন মেয়ের সাথে। ঘরে বাইরের সব কাজেই বউটি বেশ পটু। বিয়ের প্রথম থেকেই বউটিকে নিয়ে এলাকায় বেশ সরব আলোচনা হতো। কারন - সেই সময় আমাদের এলাকার কোন মেয়ে ক্ষেতে নেমে চাষাবাদের কাজ করতো না, মাঠে বের হতো না। নাজির বউই প্রথম মহিলা যে পুরুষদের মত মাঠে কাজ করতো, গরু ছাগল চড়াতো, গোসল করাতো; এক কথায় - ঘরে বাইরে সংসারের সকল কাজই সে একা সামলাতো। 

খাবারের ব্যাপারেও তার জুড়ি মেলা ভার ছিল; রান্না করে সব একাই সাবার করে ফেলতো, স্বামীর জন্য কিছুই অবশিষ্ট  রাখতো না। গোবেচারা নাজি সারাদিন বাড়ির বাইরেই এদিকওদিক ঘুড়ে বেড়াতো। দিন শেষে বাড়ি এলে বউ বলতো, " নাজি রে নাজি!  তোর লুডি ফকেজ! " অর্থাৎ - "নাজি রে নাজি!  তোর রুটি শেষ!"। এ সব নিয়ে একসময় গ্রামে বেশ মুখরোচক আলোচনা চলতো, তাদের সংসারে তখন খুব অভাব অনটন ছিল। কোন ব্যাপার নিয়েই নাজি কখনো বউকে কিছু বলতো না বা বলতে পারতো না। বলবে কি? -  বউ তাকে 'তুই' বলে সম্মোধন করতো। পাগলী টাইপ বউ কারো কোন কথায়ই কান দিত না। প্রায়ই নাজির কপালে খাবার জুটতো না; না খেয়েই রাত কাটাতো। আমাদের অঞ্চলে হতভাগা নাজি ও তার চালাক বউকে নিয়ে বেশ সরস  হাস্যরসাত্নক গল্প ও প্রবাদপ্রবচন এখনো সবার মুখে মুখে ভেসে বেড়ায়; যেমন- কারো ঘরের খাবার বা কোন কিছু শেষ হয়ে গেলেই "নাজির লুডি ফকেজ!" সর্বজন বিদিত। 

ঈদের ছুটিতে এবার এই নাজির বউয়ের সাথে আমার দেখা। পরন্ত বিকেলে নিবৃতে একা একা বাড়ি সংলগ্ন স্কুলমাঠে আনমনে পায়চারি করছিলাম। হটাৎ পুরুষালী ভরাকন্ঠে মহিলার আওয়াজ - "আব্বা! আসসালামু আলাইকুম" কানে আসতেই সামনে তাকিয়ে দেখি বেশ ভদ্রমার্জিত পোষাকে এক মহিলা আমাকে সালাম দিয়ে মাঠে আসছে। বেশ দুর থেকেই যথেষ্ট ভদ্রতা ও আন্তরিকতার সাথে আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করল। চিনতে না পারলেও গ্রামেরই কারো বউ ভেবে প্রতিউত্তর করেছি। মহিলা আমার পারিবারিক অনেক খোঁজখবর নিচ্ছিল, সাথে সাথে তার পরিবারের কথাও বলতে শুরু করেছিল; তার দুই মেয়ের বড়টি স্থানীয় কলেজে পড়ে, ছোটটি মাদ্রাসায় যায়, তারা এখন খুব ভাল আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মহিলাটি একমনে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তার সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি ও সুখের কথা বলে যাচ্ছিল (পরে বুঝেছি দ্রুত কথা বলা তার অভ্যাস)। 

আমি অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শুধু হা না বলে তার সাথে সায় দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাকে আমি মোটেও চিনতে পারিনি; ভেবেছি- নিজ গ্রামের পরিচিত কারো বউ হয়তো। আমি যে তাকে চিনতে পারিনি তা বুঝতে দেওয়াটা মোটেও সমোচিত হবে না, কষ্ট পেতে পারে - এই ভেবে শুধু প্রতিউত্তর করে যাচ্ছিলাম। সে আমাকে "আব্বা" সম্মোধন করে সহজসরল ও সাবলীলভাবে গ্রামের অনেক কিছুই বলছিল। ভেতরে ভেতরে আমি অদ্ভুত একটা মমতা অনুভব করছিলাম আর তার কথাগুলো একমনে শুনে যাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে জোড়ালো অনুরোধ করতে থাকে তাদের বাড়িতে বেড়াতে যেতে। অনেক চেষ্টা করেও স্মরণ করতে পারছিলাম না মহিলাটিকে; আগে কখনো দেখেছি বলেও মনে হচ্ছিল না। কিন্তু বার বার আব্বা আব্বা বলে এমন ভাবে মুখে চাপাচাপি করছিল তাতে মনে হলো সে যেন আমার খুব আপনজন, চিরচেনা। তার লাগাতার অনুরোধের মুখেই "আচ্ছা দেখি" বলে স্কুলমাঠ থেকে বাড়িতে প্রবেশ করলাম। ডুকতেই আম্মা জানতে চান মাঠে এতোক্ষন কার সাথে কথা বলছিলাম। মাঠে মহিলা তখনো আছে তাই চুপিচুপি আম্মাকে বললাম, "চিনতে পারিনি, কারো বউ হবে।" আমার কথা শুনেই আম্মা মহিলাকে ডাকতে থাকেন, "এই তুমি কেডা গো?" এতোক্ষন ধরে আমার সাথে তার কথোপকথনের স্পষ্ট আওয়াজ মনে হয় আম্মা ভালভাবে খেয়াল করেন নি। মহিলার কন্ঠের উচ্চ আওয়াজ শুনতে পেরেই  বললেন, " ওহ! এটা পশ্চিম বাড়ির নাজির বউ।"

এতদিন শুধু নাজির বউয়ের গল্পই শুনেছি, আজই প্রথমবার সাক্ষাত হলো। আমার মনে হতে লাগলো - মহিলাকে নিয়ে লোকমুখে যে সব প্রবাদপ্রবচন গ্রামে ছড়িয়ে আছে সেগুলো কি আদৌ সত্য? তার সমন্ধে বিস্তারিত জানার কৌতুহল আর দমিয়ে রাখতে পারলাম না। আম্মাকে বলতেই নাজির বউকে বাড়িতে ডেকে আনলেন, আমার কৌতুহলের অবসান হয়ে গেল। 

যা জেনেছি-

নাজি এখন আর আগের মত নেই; বেশ সুখি ও সচ্ছল, আগের সেই প্রতিবন্ধিকতাও নেই। ঘরদুয়ার সবই উন্নত হয়েছে, তবে সব কিছুই করেছে তার বউ। আগে নাজির বউ সারাদিন পায়ে ঢেঁকিতে ধান বানতো; অন্যের ধান বেনে চাল করে দিত, এখন বাড়িতে একটা ধান ভাঙার ইলেক্ট্রিক মেশিন বসিয়েছে, ওটা দিয়ে গ্রামের সবার চাল সে নিজে ভাঙিয়ে দেয়। সংসারে দুই মেয়ে নিয়ে বেশ সুখে আছে। আগের মত এখন আর তাদের কোন অভাব অনটন নেই, ঘরদুয়ার সবকিছুই সুন্দর করে সাঁজিয়েছে, রঙ্গিন টিভি হয়েছে। অভাবের দিনে নাজির বউ যে কয়টা রুটি বানাতো তার সব কয়টাই সে একা খেয়ে ফেলতো, বেচারা নাজির জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখতো না! এখন আর সেই অভাবের দিন নেই, তাদের অবস্থা পাল্টেছে। বউ নাজির ভাগ্যের চাকা সম্পূর্ণ ঘুড়িয়ে দিয়েছে। 'লুডি' আর ফকেজ হয় না, নাজিকেও আর না খেয়ে উপোষ থাকতে হয় না। মহিলার  পোষাকপরিচ্ছদ ও হাতে মোবাইল ফোন দেখে আগেই বুঝতে পেরেছিলাম তারা এখন বেশ সুখে আছে। নাজির বউয়ের দেখাদেখি পশ্চিম বাড়ির অন্য সবার ভাগ্যের চাকাও ঘুড়ে গেছে, বেশিরভাগ মেয়েরাই এখন গার্মেন্টস সহ বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করে, দু-চার জন বিদেশেও গেছে, অনেকের ভিটায় ইটের দালান উঠেছে।

বর্তমানে এদেশে পশ্চিম বাড়ির মত বাড়ি ও নাজির বউয়ের মত বউদের অভাব নেই। নাজির বউরা সারাদিন কঠোর পরিশ্রনের মাধ্যমে তাদের নিজেদের ভাগ্যের চাকা নিজেরাই ঘুড়িয়ে নিয়েছে। মাঠঘাট কলকারখানা সব জায়গাতেই তারা কঠোর পরিশ্রম করে কর্মের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখছে, সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করছে (এদেশের অপরাজনীতির নোংরা প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে কিছু নাজি কেমন করে যেন রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়ে যায়, জাতির নীতিনির্ধারক সেজে যায়)। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এই ধরনের কর্মঠ মানুষরাই দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতগুলোতে অংশগ্রহণ করে দেশকে সমৃদ্ধ করছে। 

বর্তমানে আমাদের দেশের জাতীয় অর্থনীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ তিনটি খাতের তিনটি চাকা - কৃষি,  গার্মেন্টস ও বৈদেশিক শ্রম সচল রেখেছে। বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায় এই তিন ধরনের পেশার বেশির ভাগ লোকজনই অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত। তারা নিজেদের জীবন ও জীবিকার জন্য সর্বক্ষণ কঠোর শ্রম দিয়ে যায়, তুলনামূলক ভাবে মজুরি বেশি পায় না; তাও তারা খুশি। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে তাদের অবদান অনেক, চাহিদা খুবই কম, প্রয়োজন মিটলেই তারা খুব খুশি। আয় ব্যয়ের সামাজস্য বজায় রেখে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে পারে বলেই তারা অল্পতেই সুখী হতে পারে। জীবন যাত্রার মান নিন্ম, তবু কারো বিরুদ্ধে তাদের কোন ধরনের অভিযোগ নেই। দেশের রাজনীতি বা অর্থনীতির জটিল বিষয়গুলো তাদের কাছে খুবই গৌণ; এ সব নিয়ে কখনো তারা মাথা ঘামায় না বা ঘামানোর প্রয়োজনও অনুভব করে না। সাদাসিধা জীবনে চারটা ডালভাত খেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকতে পারলেই মহাখুশি।  

এদেশে এই অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত মানুষরাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখার মুল চালিকাশক্তি। এ কথাটি আমি মোটেও মনগড়াভাবে বলছি না বা আমার ব্যক্তি মতের উপর নির্ভর করে লিখছি না; জাতীয় অর্থনীতির পরিসংখ্যান থেকে জেনে লিখেছি। সার্বিক দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করলে দেখা যায় এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষরা তুলনামূলক অনেক ভাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইচ্চ ডিগ্রীধারীদের চেয়ে তাদের অবদান কোন অংশেই কম নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে অনেক বেশি। কিন্তু তারা রাষ্ট্রিয় সুযোগসুবিধা ভোগ করছে অনেক কম। এইসব খেটেখাওয়া মানুষের টেক্সের টাকা দিয়ে গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এদেশের শিক্ষিতরা শিখছে, জ্ঞানার্জন করছে; সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচরণ করছে। কিন্তু দুক্ষজনক হলেও সত্য - এখনো পর্যন্ত এদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে শিক্ষিতদের অবদানই সবচেয়ে গৌণ! 

কেন? 

উচ্চ শিক্ষিত হয়ে এ দেশে কেউ কৃষি কাজ করে না বা করতে চায় না; গার্মেন্টস এর মেশিন চালায় না, বিদেশে শ্রম দিতেও যেতে চায় না, আবার কেউবা গেলেও দেশে ফিরে আসতে চায় না। আশেপাশে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় বেশিরভাগ শিক্ষিত প্রবাসিদের আয় এদেশে ফেরত আসে না, তারা বিদেশেই প্রতিষ্ঠা পেতে চায়, থেকে যেতে চায়। কেউ কেউ আবার খেটে খাওয়া মানুষের ঘামের টাকা ডলার করে বিদেশে নিয়ে যায়। লেখাপড়া শিখে আত্নসম্মান বা চুক্ষুলজ্জার হীনমন্যতায় ভোগা বাঙ্গালীর চিরাচরিত  চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া কায়িক পরিশ্রমের প্রতি এ দেশের অনেক শিক্ষিতের আগাগোড়াই বেশ অনিহা পরিলক্ষিত হয়। তাই মধ্যস্বত্বভোগী যত সব পেশা আছে, সবগুলোতেই শিক্ষিতের একচেটিয়া বিচরণ। অল্প পুঁজি স্বল্প শ্রম আর অধিক আয়ই এ দেশের শিক্ষিত মধ্যস্বত্বভোগীদের একমাত্র চিন্তা চেতনা। কৃষকের ফলানো ফসল বেচাকেনা থেকে শুরু করে রাজনীতির ময়দান পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষিতের অবাধ ও একচেটিয়া বিচরণ। পৃথিবীর যে কোন দেশের শিক্ষিত নাগরিক মানেই সেই দেশ ও জাতির মুল চালিকাশক্তি, মেরুদণ্ড। অথচ আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারীদের দিকে তাকালে শুধু নিরাশই হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ যখন অপকর্ম অপরাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে গন্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসায়, অন্যের হীনস্বার্থে ব্যবহৃত হয় তখন খুব কষ্ট লাগে। 

একজন শিক্ষক হবে জাতির আদর্শের প্রতীক, সততা ও নৈতিকতার ধারক ও বাহক। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে! এর পিছনে অবশ্য অনেক কারনও আছে। এদেশের বেশিরভাগ শিক্ষিতের জীবনযাত্রার আয় ও ব্যয় সম্পূর্ণ সামাজস্যহীন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে সম্মানী পান, তা দিয়ে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকাটা খুবই দুরহ হয়ে যায়। শিক্ষকদের বেতন অন্যান্য পেশার আয়ের তুলনায় অনেক কম; সমাজে যথাযোগ্য মান-সম্মান বজায় রেখে চলার জন্য নন্যুতম যে টুকু অর্থের দরকার তাও তাঁরা পান না। শিক্ষাখাত নিয়ে রাজনীতিকরা যত বড় বড় মৌখিক বক্তব্যই দেন না কেন, বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি নিশ্চিৎ বলতে পারি, সরকারের কাছে এদেশে শিক্ষকরাই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। ভাবসাব অনেকটা এমন - তাঁরা হাওয়া খেয়ে মানসম্মান বজায় রেখে দেশ জাতি গঠন করে যাবে! বেঁচে থাকার সংগ্রামে যেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে হয়, সেখানে স্কুল কলেজের শিক্ষকের কথা নাই বা বললাম। অবশ্য শত প্রতিকুলতা প্রতিবন্ধকতার মাঝেও আমাদের সমাজে এখনো অনেক আদর্শ শিক্ষক আছেন, যারা অল্প চাহিদা সল্প যোগান দিয়ে অনেক কষ্টে চলেও একটি সুন্দর দেশ ও জাতি গড়ার স্বপ্ন দেখেন।

অপরাজনীতির ছোঁয়ায় এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে সবচেয়ে বেশি; একেবারেই নাজুক হয়ে পরেছে। স্কুলে যাও, পরীক্ষায় অংশ নাও, পাশ কর - নীতির বর্তমান এই শিক্ষাব্যবস্থা কতটা যুগোপযোগী তা নিয়ে ভাবার কেউ নেই, ভাবার সুযোগও দেয়া হয় না। ভাল ও মেধাসম্পন্ন শিক্ষকগণ এদেশে এখন প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিকভাবে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পরেছেন, তাঁদের নীতিকথার মূল্য আর এই ঘুণেধরা বর্তমান সমাজের কারো কাছেই নেই; বরং তাঁরা সমালোচিত। বর্তমান সমাজে সবকিছুই ব্যক্তিগত অর্থপ্রাচূর্যের মাপকাঠিতে বিবেচনা করা হয়, এমন কি একজন শিক্ষককেও! তাই অনৈতিকতা ও লেজুড়বৃত্তিতার ধারক ও বাহকরাই শিক্ষার প্রতিটি স্তরে, প্রত্যেক জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল তবিয়তে অবস্থান করে আছে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, শিক্ষার মান দিন দিন নিন্মমূখী হয়ে শিক্ষার নামে অশিক্ষা সমাজে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করছে। 

দেশের নীতিনির্ধারকদের ভাবসাব দেখে মনে হয় শিক্ষাব্যবস্থা পিছিয়ে পরলেই তাদের লাভ! শাসন শোষণে কোন ধরনের বাধা আসবে না, ঝামেলার আশংকা থাকবে না। জ্ঞানের প্রদীপ্ত শিখা প্রজ্জোলনকারী স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন সম্পূর্ণরূপে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অবশ্য বিশ্বায়নের এই উচ্চবিলাশী উচ্চাকাঙ্খী যুগে মানুষের অর্থনৈতিক প্রয়োজন অনেক বেড়ে গেছে; বিশেষ করে শিক্ষিত শ্রেণীর। প্রয়োজনের তুলনায় তাদের চাহিদা অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বেশি আয়ের জন্য কেউ এখন আর ভাল-মন্ধ, বৈধ-অবৈধ, সঠিক-বেঠিক নৈতিক-অনৈতিকতার  বিষয়গুলো নিয়ে খুব একটা চিন্তা করছে না, এসব বিবেচনায়ও আনছে না। এদেশের নতুন নতুন যতসব উদ্ভট ও ফক্কিকার পেশা সৃষ্টি হয়েছে হচ্ছে সেগুলোর বেশিরভাগ শিক্ষিতরাই সৃষ্টি করছে এবং  প্রতিনিধিত্ব করছে। 

রিক্সাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, কামার-কুমার, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষরা এখনো অনেক সহজসরল ও নিরপেক্ষ নির্জীব জীবন যাপন করছে, তারা জটিল কিছু তেমন একটা বুঝে না, বুঝতে পারেও না। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল / ফরমালিন দেয়া থেকে শুরু করে অপরাজনীতির মাঠ গরম করা পর্যন্ত সব কিছুই কোন না কোন তথাকথিত শিক্ষিতই করছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক সব ধরনের বিশৃঙ্খলায় শিক্ষিতরাই অগ্রণী ভুমিকা পালন করছে। 
 
জাতিটাকে সম্পূর্ণরূপে দ্বিধাবিভক্ত করে দেয়ার পিছনে কোন সাধারণ মানুষের হাত আছে কি? - আমার মনে হয় খেটে খাওয়া রিক্সাওয়ালা, ক্ষেতের কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর বা বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারীর এতে কোন হাত নেই। নিরবচ্ছিন্নভাবে তারা তাদের শ্রম দিয়ে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করায় অবদান রেখেই চলছে। অথচ বেশিরভাগ তথাকথিত শিক্ষিতরা রাজনীতির নোংরা খেলায় জড়িয়ে দেশের বারোটা বাঁজাচ্ছে, উন্নতি অগ্রগতিকে সব সময় বাধাগ্রস্ত করেই চলছে; ধবংসের নতুন নতুন সব পদ্ধতি আবিষ্কার করছে। নিঃসন্দেহে শিক্ষিতেরাই একটি জাতির উন্নয়নের মুল চালিকাশক্তি, এতে কারো কোন সন্দেহ বা দ্বিমতের অবকাশ নেই, কিন্তু দুক্ষজনক হলেও সত্য - এদেশের  সকল প্রকার রাষ্ট্রিয় অপরাধ ও কন্সপিরেসিতে বেশিরভাগ তথাকথিত শিক্ষিতরাই জড়িত। জাতির বিভক্তিতে তারা অগ্রণী ভুমিকা পালন করছে। 

আমার কাছে খুবই আশ্চর্য লাগে যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক পর্যন্ত অনেকেই অপরাজনীতির নোংরা খেলায় জড়িয়ে রাজনৈতিক এই দ্বিধাবিভক্তিকে উস্কে দিচ্ছে। বর্তমানে এদেশের মানুষের মাঝে এমন এক ধরনের নিন্ম মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছে - যদি কেউ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, স্বাধীনতার কথা বলে, দেশ ও দেশের মানুষের কথা বলে, তবে সে হয়ে যায় ভারতের দালাল; অন্য কোন মত প্রকাশিত হলেই তাকে বলা হয় পাকিস্থানী! সেলুকাস! এ দেশে বাংলাদেশি আর কেউই রইলাম না!! তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত ও ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার এ কি দশা? - দুক্ষ! আমরা আজও কেউ বাঙ্গালী ও বাংলাদেশী হতে পারলাম না!
  
কাজী নজরুলের সেই মহান কবিতা কেন জানি আজ খুব বেশি মনে পরছে - 
   ঘুমিয়ে কা'যা করেছি ফজর,
  তখনো জাগিনী যখন যোহর।
  হেলায় খেলায় কেঁটেছে আসর, 
  মাগরিবের আজ শুনি আযান।
  জামাতে হাজির হই রে এশা'তে।

বিদ্রোহী কবির সুরে সুর মিলিয়ে আমারও আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে -
     পিতৃ হারিয়ে অনেক কেঁদেছি,
    বেহুশ হয়ে অনেক ঘুমিয়েছি।
    জাগো বাঙ্গালী জাগো -
    আরেক সুবহে সাদিক দাঁড়িয়ে দুয়ারে।

এই দেশ ও এই জাতি আমাদের সবার। বাংলা আমাদের রক্তস্নাত অহংকার। আমরা বাঙালী, বাঙালীয়ানা আমাদের সুখের স্পর্শ, অস্থিস্ত। নিজ দেশ ও জাতিকে ভালবাসা প্রতিটি মানুষের সবচেয়ে বড় আত্নতৃপ্তি, আত্নঅহংবোধ। একজন বাংলাদেশি হিসেবে গর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আবার সমবেতকণ্ঠে গাইতে চাই, "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।" অসচেতন হয়ে দেশ ও জাতির আর অকল্যাণ করতে চাই না; সচেতনতার এখনোই সময়। নয়তো আরো বেশি দেরি হয়ে গেলে হয়তো আমাদের মত নাজিদের কপালে অনেক বেশি দুক্ষ কষ্ট দুর্গতি অপেক্ষা করবে - সেদিন হয়তো আমাদের কপালেও 'লুডি' জুটবে না; সবকিছুই 'ফকেজ' হয়ে যাবে। কেউ হয়তো বলেই বসবে, "নাজি রে নাজি! তোর লুডি ফকেজ!"
 অতএব, সাধু সাবধান!

  মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
          ২০ আগষ্ট, '১৪।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন