রবিবার, ১২ জুলাই, ২০২০

হাইব্রিড প্রজন্ম!

বেশ কিছুদিন আগে ক্লাশ সিক্সের একটি ছোট্ট বাচ্চার কিছু অসংগতির কথা তুলে ধরেছিলাম রুদ্র নামের এক প্রতীকী চরিত্রের মাধ্যমে; প্রকৃতপক্ষে চরিত্রটি ছিল এদেশের বাচ্চাদের বেড়ে উঠার সময়কার সামগ্রিক চিত্রের একটি বাস্তব প্রতিচ্ছবি। রুদ্রর মায়ের ভাষ্য অনুুযায়ী সে  কথা শুনতো না, মিথ্যা বলতো, এমন কি মায়ের টাকাও চুুরি করত! লেখাটি যারা পড়েছেন তাঁদের মধ্য থেকে অনেকেই আমাকে বেশ কিছু জটিল এবং কঠিন  প্রশ্ন করেছেন। আমি সহজসরল একজন মানুষ, ভব সংসারের এসব জটিল সমীকরণ তেমন একটা ভালো বুঝি না, তাই ভালভাবে মিলাতেও পারিনি জীবনের অনেক হিসাবনিকাশ। কালক্ষেপণ না করে না ভেবে বুদ্ধির জোরে হটাৎ উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না, অর্থাৎ উপস্থিত বুদ্ধির জোর বেশিরভাগ সময়ই তেমন একটা ভালো দেখাতে পারি না; তাই আজকে এই বিলম্বিত উত্তর। অবশ্য অনেক বিষয়েই আমি তেমন একটা ভালো বুঝি না, অনেকের মতো অতটা গুছিয়ে কখনো লিখতেও পারি না। বাস্তবতার আলোকে দু'চোখে দৃষ্টিকটু কিছু পড়লে শুধু তা তুলে ধরতে চেষ্টা করি মাত্র। 

নিশ্চয় আপনারা ভুলে যাননি রুদ্র নামের সেই ছোট্ট ছেলেটির কথা? বাচ্চা ছেলেটি কি করে কেমন ভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল মিথ্যা বলা এবং হাত টানের মতো এমনতর জঘন্য সব বদঅভ্যাসে? অনেক দিন ধরেই ভাবছি রুদ্রকে নিয়ে বিস্তারিত কিছু লিখবো, কিন্তু কেন যেন হয়ে উঠেনি উঠছে না। কোন বাচ্চার নেতিবাচক দিক তুলে ধরে কিছু লিখতে গেলে অনেক কষ্ট হয়। আচ্ছা, ওরা কেন এমন হয়? নৈতিক অসংগতি নিয়ে কোন বাচ্চাই তো জন্মায় না; পরিবার পরিজন ও আশপাশ থেকেই তারা এসব শিখে শিখছে। রুদ্র'র মতো শত শত বাচ্চা আজ এদেশে প্রতিনিয়ত কেমন করে যেন অস্বাভাবিক আর অপ্রকৃতস্থ হয়ে যাচ্ছে! 

কিন্তু কেন? একটি শিশুরও-তো এমন হওয়ার কথা না? তারা জাতির আগামীর ভবিষ্যৎ। ওরা নষ্ট হয়ে গেলে দেশের ভবিষ্যৎ কি হবে? শিশুরা সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করে তার মা'কে। সত্য হলো, কোন মা বা বাবা যদি তার সন্তানের সামনে অনৈতিকতার আশ্রয় নেন, মিথ্যা বলেন, প্রতারণা করেন— বাচ্চাটি তৎক্ষণাৎ তা শিখে ফেলে এবং অনুসরণ, অনুকরণ ও বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করে। ভাল বা মন্দের পার্থক্য তারা মোটেও বুঝে না বা বুঝতে পারার কথাও নয়। তাই বাচ্চাদের সামনে কারো এমন কিছু করা উচিত নয় যা তাদের মনে খারাপ বা বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে। মনে রাখতে হবে, অনৈতিকতায় অভ্যস্ত কোন বাবা-মায়ের সন্তান কখনো নৈতিকতার উপাসক হতে পারে না। তাই, প্রত্যেক অভিভাকেরই উচিত এ ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকা, সচেতন হওয়া; নিজ সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনৈতিকতার সকল পাঠ ও বাস্তব অনুশীলন পরিহার করা।

একজন শিক্ষক হিসেবে সামাজের অনেক অসংগতিই চোখে পড়ে, সব কিছুতে সবসময় তেমন একটা নাক গলাই না বা গলানোও সম্ভব হয়ে উঠে না। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা মনের অজান্তেই কেমন করে যেন বিবেকে নাড়া দিয়ে উঠে, বিশেষ করে বাচ্চাদের ব্যাপার হলে আমি তা কখনোই এড়িয়ে যেতে পারি না। রুদ্রের কথায় আসা যাক; সেই রুদ্রের সাথে আমার এখন মাঝে মধ্যেই কথা হয়— ভাল-মন্দ সত্য-মিথ্যা নিয়ে তার সাথে বেশ হাসি-তামশাও হয়। মিথ্যা বলা তার রন্ধ্রে যেন মিশে গেছে! এতোটুকো ছোট্ট বাচ্চা, কেমন করে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলতে পারে, ছল করতে পারে, তা তাকে না দেখলে হয়তো আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না। বাচ্চারা হবে মাছুম, সৎ সুন্দর ও পবিত্রতার অমুর্ত প্রতীক; এমনই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সে মিথ্যা বলবে কেন?  প্রশ্নটি আমাকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। তাই জানার উৎগ্রীবতায় ওর সাথে মিশতে শুরু করি এবং অন্য বাচ্চাদের সাথেও ইদানীং অনেক বেশি মিশতে শুরু করেছি।

বাচ্চারা ভরসা পেলে, নির্ভয় ও ভালবাসার গন্ধ খুঁজে পেলে খুবই আন্তরিক অমায়িক ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠে, উচ্ছাসে মনের সব কথা গরগর করে বলতে থাকে। রুদ্র'র নানার সাথে আমার বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল, সেই সুবাদে সে আমাকে নানাভাই বলে ডাকে। প্রথম দেখায় তাকে সবারই  মনে হবে বেশ শান্তশিষ্ট গোবেচারা; কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে খবই চালাকচতুর। রুদ্রর বাবা বিদেশে থাকার সুবাদে তারা নানা বাড়িতেই বসবাস করে। ওরা দু ভাই-বোন; শুনেছি বোনটি নাকি ক্লাশ ফাইভে পড়ে। বাবার সংসার ও নিজের সংসারের মাতাব্বরি করতে করতে রুদ্র'র মা বাচ্চাদের প্রতি ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারছেন না হয়তো। তাছাড়া লক্ষ্য করেছি একদিন আমার সামনে বসে থেকেও তিনি ফোনে অন্য আরকজনকে বলছেন, আমি বাসায়! পরবর্তীতে আমি অনেকবার তার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবো বলে ভেবেছি, কিন্তু হয়ে উঠেনি। কি বলবো, কেমন করে তার নিজের দোষত্রুটি তাকেই শুধরানোর কথা বলবো? 

আমাদের সমাজের এ এক জটিল সমস্যা। অনেক বাবা-মা শত প্রতিকুলতার মাঝেও বাচ্চাদের সৎ ও সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন, অথচ রুদ্র'র মা'য়ের মতো মায়েরা সব থেকেও শুধুমাত্র কিছু বদঅভ্যাসের দোষে বাচ্চাদের নষ্ট করে ফেলছেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই ধরনের মায়েরা বাচ্চা সম্পর্কে একটু বেশিই আবেগপ্রবণ হন, মনে হয় কিছুটা বেশি দরদ দেখান; বাচ্চারাও এ সব বুঝতে পারে। মায়ের কিছু বদঅভ্যাস, অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ও বেখেয়ালিপনায় রুদ্র ছোট্টটি থেকেই সম্পূর্ণ অন্য রকম হয়ে যায়। অনেক কিছু জানতে পেরেছি রুদ্রর কাছ থেকেই। সময় ও সুযোগ পেলেই চুপিচুপি সে তার মামার ল্যাপটপে বসে পড়ে। তার মা হয়তো এসব খবর রাখেনই না বা জানেনও না। কয় দিনেই আমি তার সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব জমিয়ে তার কাছ থেকেই তার সম্বন্ধে অনেক অদ্ভুত কিছু খবর জেনেছি। 

এই বয়সেই রুদ্র অবলিলায় ফেসবুক চালায়, ফেসবুকের সব খবর  নিয়ে অকপটে কথা বলতে পারে; ষ্টেটাস করা, এসএমএস লেখা ও সেন্ড করা, ছবি আপলোড করা সব কিছুই সে জানে এবং অনায়াসে করতে পারে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ইন্টারনেট সম্পর্কিত অনেক কিছুতেই সে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। পড়ালেখায় তেমন একটা ভাল না হলেও, বিজ্ঞান সমন্ধে তেমন একটা ভাল জ্ঞান না থাকলেও প্রযুক্তির ব্যবহার সে যে খুব ভালভাবেই রপ্ত করেছে তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। ওর কথা শুনে প্রথম প্রথম কিছুটা চমকে গেলেও এখন আর চমকাই না। সমাজে এমন রুদ্রদের সংখ্যা এখন নেহায়েত কম নয়, বরং অনেক। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় মৌলিকত্ব বঞ্চিত এসব রুদ্রদের সংখ্যা আমাদের সমাজে  দিনদিন বেড়েই চলছে। বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে আমরাও না বুঝে তাদের সাময়িক ও সামগ্রিক সাপোর্টও দিয়ে যাচ্ছি; যা মোটেও উচিৎ নয়।
 
বেশ কিছু বাচ্চার সাথে ইদানীং আমি খুব আন্তরিকতার সাথে মিশেছি, তাদের জানার ও বুঝার চেষ্টা করেছি। তাতে করে একটি ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি— এখনকার বাচ্চারা আমাদের সময়ের বাচ্চাদের চেয়ে অনেক বেশি চালাকচতুর, অনেক বেশি অগ্রগামী। জন্মের পর থেকেই তারা বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রিক ও ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইস দেখছে, তাই ওসবের প্রতি তাদের আগ্রহ জন্মানো খুবই স্বাভাবিক এবং উৎগ্রীবতাও সহজাত; তবে অতিরিক্ত আসক্তি ভয়ানক খারাপ। বর্তমানে জন্ম থেকেই প্রতিটি বাচ্চা বিভিন্ন প্রকার ডিভাইসের সাথে পরিচিত হয় এবং হচ্ছে, সেগুলোর ব্যবহারও শিখে যাচ্ছে অনেকটা মাতৃভাষা শিক্ষা বা হাটাচলা শিক্ষার মতো করে; তাই এসব ব্যাপারে তাদের মাঝে এক ধরনের আসক্তি কাজ করছে। উৎগ্রীবতা ও সহজলভ্যতা থেকে এখনকার বাচ্চাদের মাঝে এ নিয়ে এ ধরনের আসক্তির উন্মেষ ঘটেছে এবং ঘটছে। এতে করে লেখাপড়ার প্রতি তাদের আকর্ষণ একেবারেই কমে গেছে বা যাচ্ছে; ডিভাইস ও সাইটগুলোর বাহ্যিক চাকচিক্যই তাদেরকে আকর্ষিত করছে বেশি। তাই, আমাদের উচিৎ বাচ্চাদের লেখাপড়ার প্রতি আকৃষ্ট করার মতো ওয়েবসাইট বেশি বেশি তৈরী করা এবং ওসব তাদের সামনে ব্যাপকভাবে তুলে ধরা।

তা না করে এক শ্রেণীর অভিভাবকদের দেখা যায় ইচ্ছা করেই তারা তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে ফেসবুকের মতো বড়দের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, আইডি খুলে দিচ্ছেন। এটি কতটুকো যুক্তিযুক্ত বা যুক্তিসংগত তা আমি মোটেও  বুঝে উঠতে পারি না, এসব চিন্তা করতেও কষ্ট হয়। তবে কোনভাবেই মনে হয় না কাজটি তারা ঠিক করছেন। ফেসবুক একটি বড়দের মাধ্যম এবং এমন একটি যোগাযোগ মাধ্যম যেখানে ভালর চেয়ে খারাপের আধিক্যই বেশি। তাছাড়া উন্মুক্ত চিন্তা ও স্বাধীন মতামতের নামে ওখানে বেশিরভাগ সময়ই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নোংরামির বহ্নিপ্রকাশ ঘটে। নিষিদ্ধ যে কোন জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত, তাই বাচ্চাদের তা আরো আনেক অনেক বেশি আকর্ষণ করে। আর এ কারণেই ফেসবুকে তারা বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং ওখানে সময়ও ব্যয় করছে অনেক বেশি। 

বাচ্চারা ফেসবুকে  আসলে কি করে? তাদের কাছ থেকেই জেনেছি— বিভিন্ন অশ্লীল উত্তেজক ছবি, নায়ক/নায়িকার ছবি ও বাজে নামসর্বস্ব পেইজগুলো তাদের কাছে খুব প্রিয়। তাছাড়া বন্ধুরা মিলে চ্যাট করে, ছেলে হলে মেয়েদের হাই লিখে এসএমএস করে - মেয়ে হলে ছেলেদের, সব ধরনের ছবিতেই  লাইক করে, ভালো লাগলে শেয়ার দেয়, স্টিকার কমেন্ট করে, লেখা কমেন্ট করে কম; এ'সবের আসক্তিতে ফেসবুক তাদের কাছে এখন এক ধরনের নিষিদ্ধ নেশার মতো। অবশ্য ফেসবুক একাউন্ট বন্ধুদের কাছে তাদের অহংকারের প্রতীক, যার নাই সে নাকি বলদা (তাদের ভাষা)! তাই, বাচ্চারা বায়না ধরলেও ওদের ভালভাবে বুঝিয়ে ইন্টারনেটের খারাপ দিকগুলোকে না বুঝতে দিয়ে কৌশলে এসব বিষয় এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করুন। 

তাছাড়া যে সময়টা একটি বাচ্চা ফেসবুক আসক্তিতে কাটাচ্ছে বা কাটাবে সে সময়টা সে যদি লেখাপড়া বা অন্য কোন ব্রেনগেইমে ব্যয় করে, তাতে ব্রেনের অনেক অনেক বেশি উৎকর্ষতা সাধিত হবে এবং লেখাপড়ায় অনেক ভাল করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। ব্যক্তিগতভাবে জানাশোনা কারো বাচ্চাকে আমি ইন্টার পাশ না করা পর্যন্ত তাদের হাতে মোবাইল এবং কম্পিউটার দিতে দেইনি। আমার হাতে গড়া অনেক ছেলেমেয়েই বর্তমানে সফল মানুষ। কেমন করে তারা তৈরি হলো? অনেক ছাত্রছাত্রীকে তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কিত জ্ঞান দান করা সত্ত্বেও তাদের বুঝিয়ে ইন্টারের আগে ব্যক্তিগত মোবাইল/কম্পিউটার সম্পৃক্ততা থেকে বিরত রেখে আমি দেখেছি তারা অনেক ভাল করেছে। তাই, আমার ব্যক্তিগত অভিমত— বাচ্চাদের আগে মৌলিক শিক্ষা দিন, বইপুস্তক থেকে পাঠের মাধ্যমে এ শিক্ষা ভালভাবে পেলে সে জীবনের সব ক্ষেত্রে সব কিছুতে অল্পতেই বিশেষত্ব অর্জন করতে পারবে, বিশেষজ্ঞ হতে পারবে। একটি কথা স্মরণ  রাখবেন— দেখে দেখে শিখা যায়, কিন্তু বিশেষজ্ঞ হওয়া যায় না।  

জানি, মৌলিক বিষয় নিয়ে এসব লেখা পড়ার মত লোকের বড় অভাব আজকালকার এই সমাজে; তবু লিখতে ইচ্ছে হয়, লিখি। সবার কথা সবার কাছে ভাল লাগে না লাগবে না, গ্রহণযোগ্যও হবে না; এটাই তো স্বাভাবিক। হয়তো আমার এ লেখাও অনেকের কাছে ভাল লাগছে না বা লাগবে না। তদুপরি সামাজিক সচেতনতার জন্য নিজের বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে বাচ্চাদের মঙ্গল কামনান্তে লিখেই যাবো। যদি নূন্যতম পক্ষে একজনও এই লেখাগুলো পড়ে এ থেকে কোন উপকার পান তাতেই এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সার্থক হবে বলে আমি মনে করি এবং বিশ্বাস রাখি এই ঘুণেধরা সমাজ একদিন পরিবর্তিত হবেই। তাই এই মুহুর্তে এদেশে অভিভাবক সচেতনতা ছাড়া অন্য আর কোন বিকল্প নেই, পথই দেখছি না।  

এ দেশের স্কুল-কলেজগুলোতে এখন কি শিক্ষা দেয়া হয় তা প্রতিটি অভিভাবক মাত্রই বেশ অবগত আছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধুই বাধ্যবাধকতা; ছাপানো রুটিন আর সিলেবাস ছাড়া অন্য কিছু নয়, আর কয়দিন পরপর শুধু পরীক্ষা! পড়ানোর নামে ঠনঠন ফাঁকাআওয়াজ, আর প্রয়োজন অপ্রয়োজনে উফরী নীতিবহির্ভূত বাড়তি ফি আদায়; এসব ছাড়া স্কুল-কলেজে আর কিছুই যেন হয় না, হচ্ছে না! এ দেশে এখন হয়তো এমন কোন বাচ্চা আর খুজে পাওয়া যাবে না যার দু/চার জন গৃহশিক্ষক নেই বা প্রাইভেট কোচিং-এ যেতে হয় না। যে বাচ্চাটি বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় জন্ম নিয়েছে, তার বেড়ে উঠাটিও বিজ্ঞান সম্মত ও বিজ্ঞান ভিত্তিক হওয়া উচিত ছিল, আর এটাই বাঞ্চনীয়। কিন্তু বাস্তবতায় ঘটছে ঠিক অন্য রকম কিছু— পারিবারিক বলয় এক রকম হলেও স্কুলের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা এখনো সম্পূর্ণ আগেরই মতন রয়ে গেছে। এখনো এ দেশের স্কুল-কলেজে শিক্ষায় সেই পুরোনো মানদাতার পদ্ধতিই প্রচলিত এবং প্রয়োগ ও অনুশিলন করানো হয়; বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবস্থার উন্নতির চেয়ে অবনতিই ঘটেছে বেশি। 

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে, সেই তুলনায় স্কুল-কলেজের অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা বেড়েছে অনেক কম। তাই সীমিত পরিসরে বেড়ে উঠা বাচ্চাদের অবস্থা এখন অনেকটা হাইবীড ফার্মের মুরগীর মতো; একটি ছোট্ট রুমে ৬০/৭০/৮০ জনের অমানবিক ক্লাশ। একদিকে ওদের মুল্যবোধ সৃষ্টি না করে, মেধার বিকাশ না ঘটিয়ে ক্লাশের পর ক্লাশ উত্তীর্ণ করা হচ্ছে বা এ প্লাসের নোট ধান্ধায় টাকার ছড়াছড়ি করা হচ্ছে মেধার বিকাশ না ঘটিয়েই, অন্যদিকে আধুনিক নতুন নতুন প্রযুক্তির সম্পৃক্ততা তাদের চোখের নেশা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাহ্যিক চাকচিক্য প্রকৃত সত্যটাকেই আড়াল করে দিচ্ছে তাদের কাছে। স্কুল, বাসা, কোচিং করতে করতে বাচ্চারা  হাঁপিয়ে উঠছে, তাই তারা অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। 

স্কুল-কলেজে নেই কোন খেলার মাঠ, নেই কারো কোন উৎসাহ উদ্দীপনা, নেই কোন শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ব্যবস্থা। তাই স্কুল-কলেজ থেকে ঘরে ফিরে বসে থাকা, টিভি দেখা বা ট্যাব/ল্যাপটপ/মোবাইল নিয়ে খেলা করা ছাড়া আজকের শহুরে বাচ্চাদের অন্য কোন গত্যন্তরই নেই। এ কেমন জীবন? প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে আশির্বাদ, কিন্তু তা হতে হবে বয়স ও সময়ের সাথে সংগতিপূর্ণ। অসংগতিপূর্ণ যে কোন বিষয় থেকে প্রতিটি  বাচ্চাকে দুরে রাখা উচিত এবং উত্তম। আর বেশি করে বাচ্চাদের উদ্ভুদ্ধ করা উচিত মৌলিক শিক্ষার দিকে। ঠিক মতো যদি একবার মৌলিক শিক্ষা দিয়ে একটি বাচ্চার বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা জাগ্রত করা যায়, মস্তিষ্কের নিউরনের বিকাশ ঘটানো যায়,  আমার বিশ্বাস সে বাচ্চা আর পিছু ফিরবে না, সে-ই হবে জাতির আগামীর কর্ণধার।

প্রযুক্তি নির্ভরতা বা নির্ভরশীলতা মানুষের চিন্তাশক্তিকে কুক্ষিগত করে দেয়, আর কায়িকশ্রম বা শারীরিক কসরত মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায় সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর এই পৃথিবীতে শিশুরা অনেকটা আর্টিফিশিয়াল প্লাস্টিক  ফাইবারের মত হয়ে গেছে। আমাদের দেশে বর্তমানে যে প্রজন্ম জাগরণ উঠেছে তা ভালর চেয়ে খারাপের দিকেই বেশি ধাবিত হচ্ছে। এক জেনারেশন সম্পূর্ণভাবে প্রাচীন ধ্যান ধারনা পোষণ করছে, আর অন্য আরেক জেনারেশন আধুনিকতার চরম উৎকর্ষতায় পৃথিবীর সমগ্র খোঁজখবর জেনেরেখে বেড়ে উঠছে। এতে করে সামাজিক সম্পর্ক ও আত্মিক বিশ্বাস বন্ধনে বিশাল দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। কিছুই না বুঝা যেমন এক ধরনের অভিশাপ, অনেক বেশি বুঝাও ঠিক তেমনই- এক ধরনের পাপ; দু'টোই খারাপ। অভিভাবক ও বাচ্চার মধ্যে তাই দূরত্ব দিনদিন বেড়েই চলছে; অনেক অভিভাবকই এখন বাচ্চাদের মানসিকতার সাথে তাল মিলাতে পারছেন না। তাই অযথা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি  হচ্ছে এবং বাচ্চারা পর্যায়ক্রমে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। আর সেসব বাচ্চাদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্যতার বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রযুক্তি নির্ভর বিনোদনের প্রতি আকর্ষিত হয়ে দিনদিন তারা তাদের সব প্রাণশক্তিই হারিয়ে ফেলছে।
 
উন্নত বিশ্বে বয়স ও ক্লাশ নির্ধারণ করে প্রযুক্তি ব্যবহারের নিয়ম নির্ধারিত থাকলেও আমাদের দেশে এ সবের কোন বাধ্য-বাধকতা নেই। একটি বাচ্চা জন্মেই মোবাইল, কম্পিউটার, ক্যালকুলেটর দেখে দেখে তা ব্যবহার করতে শিখে যাচ্ছে, চালাতেও পারছে। মৌলিক শিক্ষার প্রতি জোর না দিয়ে শুধু দেখে দেখে শিখায় মস্তিষ্কের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন হয় না, এতে স্নায়ুতন্ত্রে কোন ধরনের স্থায়ী ছাপ পারে না, যার ফলে বাচ্চাদের সৃজনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। একটু বড় হলেই দেখা যায় বাচ্চাদের লেখাপড়া মনে থাকছে না, ভালো লাগে না পড়াশোনা! অনেক বাচ্চাকেই লক্ষ্য করেছি তারা সাধারণ বিষয় সহজভাবে শিখতে পারলেও জটিল বিষয় বুঝার জন্য কোন ধরনের চেষ্টাই করে না। পড়ালেখার চেয়ে বরং মোবাইল গেম বা অন্যান্য ডিভাইসের প্রতিই তাদের আকর্ষণ বেশি বেড়ে যাচ্ছে। 

প্রতিদিন নতুন নতুন ডিভাইসের সাথে পরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতে মৌলিক পাঠের প্রতি তাদের খেয়াল একেবারেই কমে যাচ্ছে। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহের চেয়ে তারা বেশি আগ্রহান্বিত হয়ে পরছে ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইস ও অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি; অনেকটা মোহগ্রস্তও হয়ে পরছে। এই সব বিষয়গুলো নিয়ে আজকাল কেউই তেমন একটা ভাবছে না। স্যারেরা তো এ সব ব্যাপারে গুরুত্বই দেন না, অভিভাবকরাও এড়িয়ে চলেন। ফলোশ্রুতিতে সবকিছুতেই কেমন যেন হযবরল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে অভিভাবকদের আরো অধিক মনোযোগ ও  গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।  

আমি এমন অনেক বাচ্চাকে দেখেছি এবং চিনিজানি যাদের পারিবারিক বলয় বেশ সুসংহত; তাদের অভিভাবক শুধু তাদের লেখাপড়ার দিকেই খেয়াল রাখছেন না বরং চালচলন, পছন্দ অপছন্দ ও সামগ্রিক সব কিছুতেই দৃষ্টি দিচ্ছেন, বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করছেন। বাচ্চা বুঝের না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের প্রযুক্তি নির্ভর বিনোদনও বিসর্জন দিচ্ছেন অনেক পরিবার। আমার মনে হয় এসব পরিবারের সন্তানদের মেধার বিকাশ সুচারুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা অনেক ভাল করছে এবং করবে। প্রতিটি বিষয় সার্বিক  বিবেচনায় নিয়ে নিজ বাচ্চার জীবন গড়ার অভিপ্রায়ে প্রত্যেক অভিভাকেরই উচিত  পরিবেশ পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার সাথে সামাজস্য রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বাংলাদেশে বসবাস করে আমেরিকান মায়ের মত ছেলেকে পর্ণো শিক্ষায় সহযোগীতা করার উদ্ভট চিন্তা আদৌও আমাদের সমাজ ও সামাজিকতায় সম্ভব কিনা তা একবার গভীরভাবে চিন্তা করে দেখা উচিত; অন্যথায় পদে পদে সমূহ বিপদ। 

আমাদের দেশীয় কৃষ্টি-কালচার ও সামাজিক বলয়ে থেকেই আমাদেরকে আমাদের মতো করেই ভাবতে হবে বাঁচতে হবে; আমার বিশ্বাস তবেই প্রজন্ম উন্নত হবে, জাতি মুক্তি পাবে।।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
 ২২ জুলাই, ২০১৪. 

1 টি মন্তব্য: