ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারের লকডাউন গতকাল মঙ্গলবার চৌদ্দদিন পূর্ণ হলো, তা আরও সাত দিন বাড়িয়ে ২১ দিন করা হয়েছে; মানে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত ঘোষণা বহাল থাকবে। কিন্তু কাজের কাজ কি এবং কতটা হয়েছে বা হচ্ছে? গত ২৩ দিন আগে ১ জুন সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক সভায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকাকে লাল, হলুদ, সবুজ জোনে ভাগ করা হয়েছিল বলে জেনেছিলাম; 'অন্যরকম' এলাকা ভিত্তিক লকডাউন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতায় কি দেখা গেল? ঢাকার আর কোথাও লকডাউন নেই!
অবশ্য ঢাকার বাইরে ১৮টি জেলায় ছোট ছোট দেড় শ'রও বেশি এলাকা রেডজোন করে লকডাউন চলছে, ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছে; যদিও লকডাউন সেই আগের মতোই ঢিলেঢালাভাবেই পালিত হচ্ছে! অথচ সংক্রমণ অনেক বেশি থাকার পরও ঢাকায় লকডাউন নিয়ে হেলাফেলা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় কারিগরি দল প্রাথমিকভাবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অধীন মোট ৪৫টি এলাকাকে রেডজোন হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ কার্যকরী লকডাউনের ঘোষণা দিবে বলেছিল। কিন্তু বাস্তবতায় কিছুই করা হয়নি হচ্ছে না। সব কিছু কেমন যেন সেই আগের মতোই লেজেগোবরে অবস্থায় উপনীত হচ্ছে।
এদিকে দেশে হুহু করে বাড়ছে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা; গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৭ জন, এ নিয়ে মোট ১ হাজার ৫৮২ জনের মৃত্যু হলো। একই সময়ে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে আরও ৩ হাজার ৪৬২ জনের দেহে; ফলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১ লাখ ২২ হাজার ৬৬০ জনে। দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে ৮৪ হাজার হয়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়েই হয়তো বাড়ছে কোভিড-১৯-তে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা! পত্রপত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী মনে হচ্ছে না কোন কোটিপতি এই করোনার কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছেন বা পাবেন। দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে হয়তো কেউ-ই আর রক্ষা পাবেন না।
কোভিড-১৯ ভয়ঙ্কর থাবা সারা বিশ্বকে তচনচ করে দিয়েছে এবং মেসাকার চালিয়েই যাচ্ছে বিগত ছয়মাস ধরে; বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই এমন কোন জায়গা নেই যেখানে এই মরণ ভাইরাস মানুষকে সংক্রমিত করেনি। দিনদিন সংক্রমিতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে যে ভাবে বাড়ছে, তাতে আগামীতে এদেশে আমরা কেউ সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবো কিনা জানিনা। এমনভাবে চলতে থাকলে এ সন্দেহ হয়তো বাস্তব রূপ নিতে খুব একটা বেশি সময় নেবে না! আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন প্রথম বিশ্বের প্রথম সারির সব দেশগুলোই এই মহামারির কাছে অসহায়, বলা যায় কুপোকাত; এবং তা প্রমাণিত।
সারা পৃথিবীতে এরই মধ্যে (২৩ জুন পর্যন্ত) এই মরণ ভাইরাস ৯৩.৫৯ লক্ষ মানুষকে সংক্রমিত করেছে এবং ৪.৭৯ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এখনো সংক্রমণের উর্ধগতি চলমান; এখনো প্রায় প্রতিদিন বিশ্বে দেরলাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। ২৪ জুন ২০২০ ওয়ার্ল্ডোমিটারের সকালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারাবিশ্বে কোভিড-১৯ পজিটিভ মানুষের সংখ্যা ৯৩.৫৯ লক্ষ পেরিয়েছে; নতুন করে আর ৬.৪১ লক্ষ যোগ হলেই সংখ্যাটি পৌঁছে যাবে ১ কোটিতে৷ খেয়াল করেছিলাম ১৫ থেকে ২০ জুন— ওই পাঁচ দিনের মধ্যে ৯ লক্ষ নতুন সংক্রমণের খবর এসেছিল; এই গতিতে সংক্রমণ চলতে থাকলে আগামী ২৬ বা ২৭ জুনের মধ্যেই বিশ্বে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি।
আজকের হিসাব অনুযায়ী চীন, কাতার, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বাংলাদেশ ১৭ তম স্থান দখল করে নিয়েছে! বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিতের সংখ্যা ১,১৯,১৮৯ এবং মৃতের সংখ্যা ১,৫৪৫। এ পর্যন্ত সারাবিশ্বে সংক্রমিত হয়েছে ২১৫টি দেশ এবং এর মধ্যে ১৮৫ টি দেশে কোভিড-১৯তে মৃত্যু হয়েছে; তার মধ্যে ইউরোপ মহাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সেখানে প্রায় ১.৯০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে৷ ভুটান, ভিয়েতনামস উগান্ডা, মঙ্গোলিয়া, নামিবিয়া, লাওস, ফিজি, ম্যাকাও-সহ ২৭ টি দেশে আক্রান্ত ব্যক্তি থাকলেও আক্রান্ত হয়ে একজনেরও মৃত্যু খবর ওয়ার্ল্ডোমিটারে উঠেনি।
সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ টেস্ট হয়েছে আমেরিকায়; সেখানকার ৩৩ কোটির উপর জনগণের মধ্যে টেস্ট করেছে ২.৯৫ কোটির উপরে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণ সারে ১৬ কোটির মধ্যে অদ্যাবধি টেস্ট হয়েছে ৬.৪৭ লক্ষ। সারা বিশ্বে কোভিড-১৯তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার— ৬০ (প্রতি ১০ লক্ষ); ভারতে— ১০, বাংলাশে— ৯, এবং পাকিস্তানে— ১৬ ৷
ওয়ার্ল্ডোমিটারের কোভিট-১৯-র সার্বিক চিত্র পর্যালোচনায় একটি কথা আজ স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে— এশিয়ায় সংক্রমিতের সংখ্যা এখন তুলনামূলক বাড়ছে; বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে। সে সাথে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। বিগত কয়মাস ধরে চতুর্দিকে শুধু মন খারাপ হওয়ার মতো সংবাদই পেলাম এবং পাচ্ছি। আশেপাশের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন, কেউ কেউ আবার মৃত্যুবরণও করেছেন। কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করা মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, বরং টেস্টে ধরা পড়া আক্রান্তের মৃত্যুর সংখ্যার বেশ কয়েকগুণ বেশি। সংক্রমণের উর্ধগতি থাকা অবস্থায় 'সীমিত পরিসর' নামের গোল্লাছুট টাইপ দায়সারা লকডাউন দিয়ে সারাদেশে কোভিড-১৯-র বরং বিস্তার ঘটানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনের ব্রিফিং থেকে জানা যায়, পোনে দুই লক্ষ থেকে দুই লক্ষ মানুষ প্রায় প্রতিদিন ফোন করছেন তাদের কাছে! নিশ্চয় অসুবিধায় না পড়ে কেউ ওসব ফোন দেননি বা করেননি? যদি টেস্ট আরো বেশি করা তা হলে হয়তো বুঝা যেতো দেশের প্রকৃত অবস্থা আসলে কি? হয়তো আরও অনেক অনেক বেশি আক্রান্তের খবর জানা যেতো; সাবধান হওয়া যেতো।
যেহেতু সীমাবদ্ধতার দেয়াল অনেক উঁচু এবং অনেক বেশি তাই আভ্যন্তরীণ কোন বিষয়ই আমরা জানতে পারছি না; তাই বুঝাও যাচ্ছে না কোনকিছু। পথেঘাটে সবায় আমরা একসাথে চলছি কাজ করছি, বুঝতেও পারছি না কে আক্রান্ত আর কে আক্রান্ত নয়। প্রয়োজন/অপ্রয়োজনে আমাদের প্রত্যেককেই কমবেশি ঘরের বাইরে বের হতে হয় হচ্ছে। কিন্তু মনে সব সময় অযাচিত এক ভয় ও শঙ্কা কাজ করছে; না জানি কখন কে কোথা থেকে আক্রান্ত হই? কখন কে কোথা থেকে আক্রান্ত হয়ে ঘরে এই মরণ ভাইরাসকে নিয়ে আসবো তা কেউ জানি না।
এরই মাঝে বিবিসি গতকাল একটি ভয়ঙ্কর ভীতিকর সংবাদ প্রচার করেছে— ল্যাবরেটরি এবং টেস্টিং কিটের ঘাটতি দেখা দেয়ায় নাকি করোনাভাইরাস পরীক্ষা সংকটের মুখে পড়েছে বাংলাদেশে। নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষার সাথে জড়িতদের অনেকে নাকি জানিয়েছেন, এখন নমুনা সংগ্রহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে এবং একেবারে প্রয়োজন ছাড়া পরীক্ষা করা হচ্ছে না! দেশে সংক্রমণের এই উচ্চহারের মুখে ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষার টার্গেটের কথা বলা হলেও এখন তা সীমাবদ্ধ থাকছে ১৬ বা ১৭ হাজারের মধ্যে! স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, কিট নয়, ল্যবরেটরির অভাবে পরীক্ষার ক্ষেত্রে জট লেগে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন গা-ছাড়া দায়সারা কথাবার্তা আমরা লক্ষ্য করে আসছি সেই প্রথম থেকেই; রেড জোন, ইয়েলো জোন, গ্রীন জোন আরও কত কি করলো, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোনটাই! আর কত মরলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সজাগ হবে? দেশের সব মানুষ আক্রান্ত হলে কি?? আমরা সাধারণ জনগণ, এসব বগিজগি বুঝি কম। আমরা বেশি বেশি টেস্ট করাতে চাই, নিশ্চিত হতে চাই; কিন্তু কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছি না।
আবার কি আমরা আমাদের সেই আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো? কবে হবে এ'সব দুশ্চিন্তার অবসান? কবে আসবে সেই সুদিন??
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২৪ জুন, ২০২০.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন