"পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমন করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায়, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্যে; তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।" — সুরা বনী ইসরাঈল-এর প্রথম এই আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা মি'রাজ-এর কথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হলো এই মি'রাজ; যা স্মরণে আমরা প্রত্যেকেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারি ধ্যানে মগ্ন হওয়ার ও পূণ্য অর্জন করার। এবং এর ফলশ্রুতিতেই আমরা ভূমিকা রাখতে পারি মানবতার কল্যাণের। প্রকৃতপক্ষে এখান থেকে আমরা কে কি শিক্ষা নিলাম বা পেলাম তা তিনিই ভালো জানেন। তবে তিনি তাঁর মু'মিন, কাফির, বিশ্বাসকারী ও অস্বীকারকারী সমস্ত বান্দার অন্তরেরও কথা বুঝেন, শুনে থাকেন এবং দেখে থাকেন। আর প্রত্যেককে তিনি তাই দান করেন যে যে'টার হকদার— দুনিয়াতে এবং আখেরাতেও।
আমাদের প্রাণের প্রিয় নবী হুজুর পাক হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ঊর্ধ্বাকাশের উপরিভাগে পরিভ্রমণ বিষয়ক একটি ঘটনা মি'রাজ। হাদীসের মাধ্যমে ঘটনাপ্রবাহ বিস্তারিত তুলে ধরতে গেলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে, তাই ঐ দিকে না গিয়ে আজ আমি এখানে তুলে ধরতে চেষ্টা করবো বিজ্ঞান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মি'রাজ থেকে কি পেল?
আমাদের প্রাণের নবী দয়াল নবী হুজুর পাক হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে বাহনের মাধ্যমে ভ্রমণটি করে এসেছিলেন সেই বাহনটির নাম ছিল ‘বোরাক’, যার অর্থ - ‘বিদ্যুৎ’। গত শতকের বিজ্ঞানী আইনস্টাইন-এর Fourth Dimension Theory, E=mc2 নিয়ে একটু ভাবলেই হুজুর পাক (সাঃ)-এর মি'রাজের রাতের ভ্রমণ আমাদের ঈমানের জোরকে আরো বাড়িয়ে দেবে ইনশাআল্লাহ!
চতুর্মাত্রিক ধারণা আসলে কি? এই তত্ত্বটি হলো আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বা Theory of Relativity; তত্ত্বটি পদার্থবিজ্ঞানে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী তত্ত্ব। এটি পদার্থবিজ্ঞান জগতে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। আপেক্ষিক তত্ত্বের মতানুসারে— স্থান (space), কাল (time) ও জড় (matter) বা ভর পরম কিছু নয়, আপেক্ষিক। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এই তত্ত্বের সূচনা করেন ১৯০৫ সালে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব (special theory of relativity) প্রবর্তনের মাধ্যমে। আর হুজুর পাক (সাঃ)-কে সপ্তম আকাশ পেরিয়ে তাঁর দিদারে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই সারে চৌদ্দ'শ বছর আগে! কেমন করে?
পদার্থবিজ্ঞানে স্থান-কাল বলতে যেকোন গাণিতিক মডেলকে বোঝায়, যা সময় এবং স্থানকে মিলিয়ে স্থান-কাল সাংতত্যক (spacetime continuum) নামক একটি একক কাঠামো গঠন করে। স্থান-কাল মূলতঃ স্থানের তিনটি মাত্রার সাথে সময়কে যোগ করে একটি চতুর্মাত্রিক ধারণার জন্ম দেয়। ইউক্লিডীয় স্থান ধারণা অনুযায়ী— স্থানকে ত্রিমাত্রিক এবং সময়কে একটি আলাদা মাত্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই দু'য়ের মিলন ঘটানোর মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানীরা অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক জটিলতার ও সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন। এই চতুর্মাত্রিক নীতি দিয়ে বৃহৎ স্কেলে মহাবিশ্বের গঠন থেকে শুরু করে অনেক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু পর্যন্ত, প্রায় সব কিছুরই পরিচালনার নীতি ব্যাখ্যা করা যায়।
চিরায়ত বলবিদ্যা অনুসারে— ইউক্লিডীয় স্থানে স্থান-কালের ব্যবহার যথাযথভাবে করা যায়, কারণ সময় সেখানে ধ্রুবক এবং তা স্থানের ত্রিমাত্রিক গতি নিরপেক্ষ। এই তত্ত্ব কেবল নিম্ন গতির বস্তুর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আপেক্ষিকতাভিত্তিক তত্ত্বের কথা চিন্তা করলে, কালকে স্থানের থেকে আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। কারণ এক্ষেত্রে কাল আলোর বেগের সাপেক্ষে ত্রিমাত্রিক স্থানের গতির উপর নির্ভরশীল। এ'ছাড়া এ'টি তীব্র মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের উপরও নির্ভরশীল, কারণ, তীব্র মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র সময়ের গতিকে মন্থর করে দিতে পারে।
প্রকৃতিতে স্থান এবং সময় অবিচ্ছেদ্য ভাবে মিলে আছে। গাণিতিকভাবে এটা হলো প্রসঙ্গ কাঠামো দ্বারা বর্ণনাকৃত নানাবিধ ঘটনা। সাধারণতঃ তিনটি স্থানিক মাত্রা (দৈর্ঘ, প্রস্থ, ঊচ্চতা) ও একটি সময়গত মাত্রা (সময়) প্রয়োজনীয়। কোন সুনির্দিষ্ট স্থান-কালকে প্রকাশ করার জন্য মাত্রাগুলো প্রসঙ্গ কাঠামোর স্বাধীন উপাদান। যেমন পৃথিবীতে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা দুটি মৌলিক মাত্রা, যারা সম্মিলিত ভাবে একটি স্থান নির্দিষ্ট করে। অনেক সময় দেখা যায়, কোন পর্যবেক্ষক যা শুধু দৈর্ঘ্যর সাহায্যে পরিমাপ করছেন, অন্য পর্যবেক্ষক হয়তো দৈর্ঘ্য ও সময় উভয়ের সাহায্যে পরিমাপ করছেন। যে'কোন ঘটনাই স্থান-কাল নামক চতুর্মাত্রিক জগতে ঘটছে এটা ধরে নেয়াই হলো আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের ফলাফল প্রকাশ করার সবচেয়ে সহজ এবং ভাল পদ্ধতি, যেখানে তিনটি মাত্রা x, y, z স্থান নির্দেশ করে এবং চতুর্থ মাত্রা ict (i=(-1)1/2) সময় নির্দেশ করে। সময়ের মাত্রা t ব্যবহার না করে ict ব্যবহার করার কারণ হলো নীচের সমীকরনটি লরেঞ্জ রূপান্তরের ফলে অপরিবর্তনীয় থাকে।
s2=x2+y2+z2-(ct)2
অর্থাৎ যদি কোন ঘটনা S প্রস্ংগ কাঠামোর সাপেক্ষে x, y, z, t এবং S1 প্রসংগ কাঠামোর সাপেক্ষে x1, y1, z1, t1 এ ঘটে তাহলে,
s2=x2+y2+z2-(ct)2 =x12+y12+z12-(ct1)2
প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান দিয়ে কাউকে মি'রাজ বুঝানোর প্রয়োজন নেই, আমার ধারণা মি'রাজ থেকেই বিজ্ঞানীরা এ'সব অনেক কিছু আবিষ্কার করেছেন। এ বিশ্বব্রহ্মান্ডে স্রষ্টার ইশারায় ধর্মের সব অসাধারণ চিরসত্যগুলো অনেক আগেই ঘটে আছে, বিজ্ঞান তো সবে মাত্র কয়েক দিনের। মহান আল্লাহ যদি শুধু বলেন ‘কুন', আর তখনই সব কিছু হয়ে যায় 'ফা-ইয়া কুন’ অর্থাৎ ‘হও বললেই সব কিছু 'হয়ে যায়'; আর সব কিছুই ঘটে তৎক্ষণাৎ। তাই বিজ্ঞান দিয়ে ধর্ম না বুঝে ধর্ম দিয়ে বিজ্ঞান বুঝার চেষ্টা করেন, দেখবেন অনেক সহজেই সব কিছুর সমাধান পেয়ে যাবেন।
বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বের করেছেন - শূন্যস্থানে আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে যদি আলোর বেগে চলা যায় তবে পৃথিবী থেকে চাঁদে পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র এক সেকেন্ডের কিছু বেশি। কিছুদিন আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন 'আলোর গতির চেয়ে নিউট্রিনোর গতি বেশি'; শেষমেশ তা ভুল বলেও প্রমানিত হয়েছে। আসলেই কি তা সম্ভব? আলো আসলে কি? সত্যিকার আলো তো স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা; যা সুরা নূর-এর ৩৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আর সেই নূরের গতিবেগ কি মানুষের চিন্তায় ধরবে?
আরেকটি আলোর কথাও ‘সূরা ইব্রাহীমের’ প্রথম আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে এমন একটি আলোর কথা যা মানুষের জন্য ও এই পৃথিবীর জন্য একটি আলোকবর্তিকা, আর তা বর্ণনা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা; এবং এ ভাবে - 'আলিফ লাম- রা, এই কিতাব, এটা আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যাতে আপনি মানবজাতিকে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে বের করে আনতে পারেন অন্ধকার থেকে আলোকে, তাঁর পথে যিনি পরাক্রমশালী, প্রশংসার্হ।' এবং যার কাছে এ'টি নাজিল হয়েছে তিনি তাহলে কি? সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতে সে মানুষটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ হিসেবে; অর্থাৎ ‘মানবজাতির কল্যাণের জন্য রহমতস্বরুপ আগত এক মানব' হলেন পুরো জগতের আরেক আলো।
পবিত্র কুর'আনের নূরে আলোকিত 'নূর' মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে 'নূরুন আলা নূর' আল্লাহ তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের তিন বছর আগে ২৬ রজব দিবাগত রাতে সমস্ত পবিত্রতার ছোঁয়ায় (সিনা ছ্যাক বা হৃদয় ধৌতকরণ করতঃ) মহান আল্লাহ তা'আলা কিছু সময়ের জন্য উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন উর্ধ্বলোকে, মহান প্রতিপালকের একান্ত সান্নিধ্যে। এই ঘটনাটি ইসলামের দৃষ্টিতে মি'রাজুন্নবী (সাঃ) বা হুজুরপাক (সাঃ)-এর মিরাজ হিসেবে পরিচিত। মি'রাজ একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ উপরে উঠার সিঁড়ি বা সোপান; আরেক অর্থে উর্ধ্বগমন। সৃষ্টিকর্তার মহান আরশ পরিদর্শন করাবেন বলেই উপরোল্লিখিত সুরা বনি ইসরাইল-এর ঐ আয়াতে নিদর্শন দেখানোর কথা বলা হয়েছে। সূরা নাজ্বম-এর ৫৩ নং আয়াতটিও এখানে প্রণিধানযোগ্য; আর তা হলো- ‘তিনি তো তাঁর প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলী দেখেছিলেন।’
মি'রাজ নিয়ে অসংখ্য হাদিস আছে; সে সব মতে— কাবাঘরের হাতিম অংশে ফেরশতা জিবরাইল (আঃ) এসে তাঁর বক্ষবিদারণ বা সিনা ছ্যাক করেন। এরপর হুজুর পাক (সাঃ)-এর কলব ধৌত করেন। সত্যিই তো! যিনি এ পৃথিবী থেকে যাবেন মহান সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে সেই পবিত্র মানুষটিকে তো এভাবেই হতে হয়েছিল আরো পবিত্র। জমজমের পানি দিয়ে ধৌত হয়ে 'বোরাক' নামের সেই ত্বরিত-যানে আরোহন করানো হয় বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূতকে। এভাবে মসজিদুল আকসা হয়ে চলে যান সেই চরম পবিত্রতম গন্তব্যে।
যাওয়ার পথে পালাক্রমে তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল হজরত আদম (আঃ), হজরত ঈসা (আঃ), হজরত ইয়াহিয়া (আঃ), হজরত ইউসুফ (আঃ), হজরত ইদ্রিস (আঃ), হজরত হারুন (আঃ), হজরত মুসা (আঃ)-এর সাথে; এবং এরপর সপ্তম আসমানে তাঁর সাথে দেখা হয় হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এর। সব পবিত্র মানুষগুলোই এই নেককার নবী (সাঃ)-কে অভিনন্দন আর স্বাগত জানিয়েছিলেন প্রাণখুলে। এ পর্যন্ত ভ্রমণের সীমানাকে চিহ্নিত করা হয় সাত আসমান বলে।
এরপর হুজুর পাক (সাঃ)-কে নেয়া হয় সিদরাতুল মুনতাহায়; এর উপরে রয়েছে বায়তুল মা'মুর (পৃথিবীতে যার প্রতিচ্ছবি বায়তুল মুকাদ্দাস)। হুজুর পাক (সাঃ) ফেরশতাদের দেখলেন, আর দেখলেন জান্নাত-জাহান্নাম সহ আরো অনেক কিছু; এ পর্যন্তই যেতে পারেন জিবরাইল (আঃ)।
এর পরে হুজুর পাক (সাঃ) একা রফরফ-যানে আল্লাহর দরবারে যান, এবং একেবারে নিকট সান্নিধ্যে উপস্থিত হন; আশেক আর মাশুকের এ কাছাকাছি একান্ত আলাপে সৃষ্টি জগতের সব রহস্যই আল্লাহ তা'আলা তাঁর হাবীবকে বুঝিয়ে দেন।
মি'রাজ-এর রজনীতে হাবীব ও মাহবুবের একান্ত সাক্ষাতে মানুষের চলমান জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ ১৪ টি বিষয় ঘোষণা করা হয়েছে, যা সুরা বনি ইসরাঈল-এর ২২-৪৪ নম্বর আয়াতে সুস্পষ্ট প্রস্ফুটিত হয়েছে; যার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি—
১). আল্লাহকে ছাড়া কারও ইবাদত করবে না;
২). পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে;
৩). নিকট স্বজনদের তাদের অধিকার দাও;
৪). মিসকিনদের ও পথ সন্তানদের তাদের অধিকার দাও;
৫). অপচয় কোরো না;
৬). কৃপণতা কোরো না;
৭). সন্তানদের হত্যা করবে না (একসময় খাদ্যের অভাবে এ ঘৃণিত কাজ করা হতো);
৮). ব্যভিচারের নিকটেও যেও না;
৯). মানব হত্যা কোরো না;
১০). এতিমের সম্পদের কাছেও যেও না;
১১). প্রতিশ্রুতি পূর্ণ কোরো;
১২). মাপে পূর্ণ দাও;
১৩). অবস্থান কোরো না যাতে তোমার জ্ঞান নেই;
এবং
১৪). পৃথিবীতে গর্বভরে চলো না।
এ'সব মন্দ কাজ, এবং তোমার রবের কাছে যা অপছন্দ।
মি'রাজেই উপহার দেয়া হয় নামায; যা পরবর্তীতে হুজুর পাক (সাঃ) ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ ঘোষনা দিয়ে সর্বজনীন মি'রাজ বলেছিলেন; বলেছিলেন- 'নামায মুমিনদের জন্য মি'রাজস্বরুপ।' শ'বে মি'রাজের রাতে অর্জিত সেই অসাধারণ ব্যবস্থা নামাযকে ঘিরে আরো একটি ঘটনা বলেই এ লেখা শেষ করবো।
আমরা জানি আজানের সুরেলা ধ্বনিতে ভেসে আসে ইবাদতের সাথে ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ আহ্বান; যার অর্থই হচ্ছে 'এসো কল্যাণের জন্য।' আর নামাযের সমাপ্তিতে পাই একটি দো'য়া; যা এই মি'রাজের রাতেরই ঘটনা। সৃষ্টিকর্তার দিদার লাভের সুবর্ণ সুযোগ, অর্থাৎ মানুষের এই মি'রাজকে ঘিরেই চলে এসেছে এ দোয়া; দোয়াটি হলো ‘তাশাহুদ’ বা ‘আত্তাহিয়াতু’। এই দোয়াটি প্রতি নামাযেই আমাদের পাঠ করতে হয়। আসলে এটি একটি Conversation অর্থাৎ - কথোপকথন; যা মহান সৃস্টিকর্তার সাথে তাঁর প্রিয় হাবীব হুজুর পাক (সাঃ)-এর হয়েছিল। সকল মানবপ্রেমী (রহমাতুল্লিল আ'লামীন) হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সাথে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার যে কথাবার্তা হয়েছিল সেই মি'রাজের রাতে, এবং যার সাক্ষী হওয়ার গৌরব অর্জন করে চির ধন্য হয়েছিলেন ফেরেস্তারা।
মি'রাজের রাতে প্রাপ্ত এই দো'য়াটির মূল মর্মকথা আসুন আমরা সবাই এখন উপলব্ধি করতে চেষ্টা করি। আল্লাহ হলেন সব শান্তির কেন্দ্র, সকল শান্তির উৎস, সব শান্তির ঝরনাধারাও তাঁর থেকেই প্রবাহিত। হুজুর পাক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সেই শান্তির মহান শক্তির সাক্ষাতে সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বললেন—
‘আত্তাহিয়াতু লিল্লাহি ওয়াসসালাওয়াতু ওয়াত্তাইয়্যাবাতু’; অর্থাৎ- 'সব মৌখিক, আন্তরিক, শারীরিক, আর্থিক যাবতীয় প্রশংসা ও ইবাদত কেবল আল্লাহতায়ালার জন্য।'
এর উত্তরে মহান রাব্বুল আলামিন বললেন- ‘আসসালামু আলাইকা আইয়্যূহান্যাবিয়্যূ ওয়া রাহমাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু’; অর্থাৎ- 'হে নবী আপনার প্রতি সালাম, আপনার প্রতি আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ বর্ষিত হোক।' এ কথা শুনেই হুজুর পাক (সাঃ) আবেদন জানালেন- ‘আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস সোয়ালেহীন'; অর্থাৎ- 'আমাদের ও আল্লাহ'র নেক (সৎ) বান্দাদের উপর আল্লাহ'র রহমত ও অনুগ্রহ বর্ষিত হউক।'
এর মানে দাঁড়ালো অসাধারণ এই মহামানব আল্লাহ'র নূরের সম্মুখে দাঁড়িয়েও সব মানুষের কথা ভুলে জাননি। তিনি সকল শান্তির ঝর্নাধারা মহান আল্লাহ তা'আলাকে অনুরোধ করলেন এই বলে যে, আল্লাহ আপনার শান্তি শুধুমাত্র আমার উপর নয়, আমার উম্মতসহ সৃষ্টিকর্তার সমস্ত সৃষ্ট সৎ দাস ভালো মানুষগুলোর উপরও বর্ষিত হউক।
একবার ভাবুন তো দেখি কত সুন্দর চাওয়া এ'টি? যে'খানে আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী করিম (সাঃ) শুধু নিজের কথা ভাবেন নি, ভেবেছেন উম্মতের কথা, সকল মানুষের কথা। আমরা সাধারণ মানুষেরা এখান থেকে স্বার্থপরতার উর্দ্ধে উঠার ও সহমর্মিতা শিক্ষা অর্জন করার শিক্ষা নিশ্চয় পেতে পারি? প্রতি ওয়াক্তের প্রতি নামাযে আমরা নিজেরা নিজেদের মানবজাতি ও সৃষ্টিকর্তার সমস্ত সৃষ্টির জন্য এ'ভাবেই শান্তি কামনায় প্রস্তুত থাকতে পারি, এবং তা করতে পারি আমরা ‘তাশাহুদ’ অর্থাৎ ‘আত্তাহিয়াতুর’ এই শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেই।
দো'য়াটির শেষ অংশে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা ও তাঁর পিয়ারা হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কথোপকথন শোনার সৌভাগ্য অর্জন করে ফেরেস্তারা আনন্দে বলে উঠেছিলেন- ‘আশহাদুআল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশাহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু’; অর্থাৎ- 'আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর অন্য কোন মাবুদ নেই, এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহ'র বান্দা ও রসূল।'
আমাদের সৌরমন্ডলের সূর্যের চেয়ে কোটি কোটিগুণ জ্যোতিময় সেই নূরের আলো। অতএব, তাঁর গতিবেগ কি কল্পনা করা যায় বা যাবে? মি'রাজ নিয়ে কোনরুপ সন্দেহের অবকাশ নেই; এ ব্যাপারে একজন মুসলমানের ঈমান হতে হবে সিদ্দীকে আকবর হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর মতো। মনে রাখতে হবে, যুক্তিতে মুক্তি মেলে না, মুক্তি মেলে এবাদত ও আমলে।।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮.
বিজ্ঞান দিয়ে কাউকে মিরাজ বুঝানোর প্রয়োজন নেই বরং মিরাজ থেকেই বিজ্ঞনীরা অনেক কিছুই আবিস্কার করেছেন।একেবারে সঠিক এবং সুন্দর৷ বলেছেন।শুভকামনা সতত থাকলো।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ সহমত প্রকাশ করার জন্য। ইসলামকে আসলে মানুষ বুঝে না বা বুঝতে চায় না; বর্তমানে সবাই ব্যস্ত দুনিয়া নিয়ে। আসল সমস্যাটা এখানেই।
মুছুনকুর'আনুল কারীম এমন এক মহাগ্রন্থ, যাতে সব কিছুর সমাধান পাওয়া যায়; তবে খুঁজতে সেই চোখ থাকতে হবে।