পড়সি বড় ভাই, দেশের স্বনামধন্য এক পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির জিএম; খুবই ধার্মিক। মাসজিদে আমারা নিয়মিত জামাত পার্টনার। আমার কথায় এবং আমরা এক সাথেই মসজিদে যাওয়া বন্ধ করেছিলাম। করোনার আগমনে দীর্ঘ ১৭ দিন আর আমাদের কোন দেখা সাক্ষাৎ নেই। গতকাল হটাৎ তিনি ফোন করে জিজ্ঞেস করেন— 'দুই জুম্মা গেল, সামনে তৃতীয়— তিন জুম্মা উপস্থিত না হলে কি বউ অটো তালাক হয়ে যাবে?'
বর্তমানের এই মহা ফেতনার যুগে কোন আলেম কখন কোথায় যে কি বলে ফেলে, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই! মনে রাখবেন, ইসলাম মানে— আত্মসমর্পণ। কার কাছে? অবশ্যই মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে। এবাদত করতে হয় শুধুমাত্র এক আল্লাহর জন্য। নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, সবই একমাত্র আল্লাহর জন্য; মূল শর্ত 'ঈমান'। লোক দেখানো কোন এবাদত-আমলই আসমানে যায় না; অর্থাৎ আল্লাহ কবুল করেন না।
'জুম'আ' বা 'শুক্রবারের সালাত' ইসলামের অন্যতম একটি নামাজ। 'জুম'আ' আরবী শব্দ; এর অর্থ হলো— একত্রিত হওয়া, সম্মিলিত হওয়া, কাতারবদ্ধ হওয়া। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন শুক্রবারে প্রাপ্তবয়স্ক সকল মু'মিন-মুসলমান একটি নির্দিষ্ট সময়ে একই স্থানে একত্রিত হয়ে জামাতের সাথে যোহরের নামাজের পরিবর্তে এই নামাজ ফরযরূপে আদায় করে, সে জন্য এই নামাযকে জুমু'আর নামায বলা হয়। জুম’আর সালাত ফরজ; তবে ঐ সব পুরুষদের জন্য, যাদের উপর জামা’আতে সালাত আদায় করা ওয়াজিব।
এ নামাজ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ঘোষণা করেন—'হে মু'মিনগণ! জুম'আর দিনে যখন নামাজের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝ। অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।'—(জুম'আ: ৯-১০)
যেহেতু, পবিত্র কুর'আনুল কারীমে জুম'আর বিষয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, তাই এই বিষয়ে আর অন্য কোন দলীল খোজার প্রয়োজন নেই। অতএব, জুম'আর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
প্রত্যেক ঈমানদার মুসলমানের এ কথাটি অবশ্যই স্মরণে রাখা উচিত— প্রকৃত ওজরের কোন মাসালা লাগে না। দেশের বরেণ্য আলেমগণ ইফা-তে বসে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন— মসজিদে না যাওয়ার জন্য; এবং এই করোনা দূর্যোগে মসজিদে জামাত সীমিত রাখার জন্য। এর পরও দেশে এখন এমন কিছু ইমোশনাল মুসলমানের জন্ম হয়েছে যারা ভাব দেখাচ্ছে, মসজিদ সাধারণের জন্য বন্ধ হওয়াতে তারা যেন শোকে মরে পাথর হয়ে গেছে! কোর'আন হাদিসের জ্ঞান তাদের কতটুকু আছে আমি জানি না, তবে তারা যে মোটেও পরিবেশ, পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতা বোঝে না, তা নিশ্চিত। ওরা আসলে ফেতনাবাজ!
প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। পৃথিবীর পরিস্থিতি এতই নাজুক, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রেক্ষিতে মসজিদগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেল। এ অবস্থা কি মানব সৃষ্ট? আমি মনে করি আমাদেরই পাপের ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি। পৃথিবীতে আমরা এতো বেশি পাপ করে ফেলেছি, যার ভার আর বইতে পারছে না এই জমিন। তাই তো অতি ক্ষুদ্র এক অনুজীব পাঠানো হলো; যে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল— আমরা কত নিঃস্ব অসহায়!
ডব্লিউএইচও বলেছে— করোনাভাইরাস সোয়াইন ফ্লুর চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি ভয়াবহ। নিশ্চিত করে তারা বলেছে, এক দশক আগে বিশ্বজুড়ে সোয়াইন ফ্লুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল; পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, করোনাভাইরাস তার চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি ভয়াবহ। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সোয়াইন ফ্লুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তাতে আক্রান্ত হন কমপক্ষে ১৬ লক্ষ মানুষ; মারা যান ১৮ হাজার ৪৪৯ জন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা এ তিন মাসেই এর চেয়ে অনেক বেশি।
সোয়াইন ফ্লুর প্রতিষেধক ছিল, কিন্তু করোনা ভাইরাসের কোন প্রতিষেধক এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। বর্তমানে যা চিকিৎসা হচ্ছে তা সম্পূর্ণটাই আন্দাজের উপর। ডব্লিউএইচও তাই বারবার ঘোষণা করছে— মাস্ক পড়ো, ভীড় এড়িয়ে চলো, সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোও এবং সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকো।
ইসলাম মানুষের উপর কিছু চাপিয়ে দেয় না। কোন কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোন অবকাশ বা সুযোগও ইসলামে নেই। অবস্থা, অবস্থান ও পরিপ্রেক্ষিতের উপর নির্ভর করে ইসলাম চলে, শরিয়তের মাসালা বের করা হয়। পৃথিবীর সকল জ্ঞানীগুণী আলেমসমাজ মিলে এই অবস্থায় ঘরে নামাজ আদায়ের সীদ্ধান্ত দিয়েছেন। আর এতে করে এটাই বর্তমান অবস্থায় আমাদের ওপর শরীয়তের বিধান হয়ে গেছে। অতএব, জুম্মা বাদ দিয়ে এখন আমাদের ঘরে যোহর আদায় করতে হবে; জামাত ত্যাগ করাই উত্তম। কিন্তু, কি অদ্ভুত জাতি আমরা! মসজিদের জামাতে নির্দিষ্ট পাঁচ/দশ নিয়েও এখন দেশে মারামারি হচ্ছে! কেন রে ভাই— ঘরে নিবৃতে একাকী নামাজ আদায় করলে যদি আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা মসজিদের ছোয়াব দেন, আপনার সমস্যা কি?
তিন জুম্মা ত্যাগ সম্পর্কিত আমার চোখে পড়া কয়টি হাদিস আমি সংগ্রহ করে রেখেছি, সে'সব আপনাদের জন্য তুলে ধরছি। আপনারাই বিবেচনা করুন বউ তালাকের সাথে এসবের কোন সম্পর্ক আছে কি না? আর প্রতি মুসলিমেরই একটি বিষয় অবশ্যই স্মরণ রাখা উচিত—মিথ্যা দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে কোন মানুষকে আলোর পথের যাত্রী বানানো যায় না।
**রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি অবহেলা অলসতা করে পর পর তিন জুম্মা নামাজ ছেড়ে দিল, আল্লাহ তার অন্তরে মোহর মেরে দিবেন। —(আবু দাউদ)
**রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি পরপর তিনটি জুম্মা বিনা ওজরে ও ইচ্ছা করে ছেড়ে দেবে, আল্লাহ তা'আলা ঐ ব্যক্তির অন্তরে মোহর মেরে দেবেন। —(তিরমিযী,আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)
**হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি পর পর তিনটি জুম্মা পরিত্যাগ করবে, সে ইসলামকে পিছনের দিকে নিক্ষেপ করল। —(মুসলিম)
তথাকথিত কিছু আলেম কখন কি যে বলে, তারা তা নিজেরাও ভালো জানে না বা স্মরণ রাখতে পারে না; ওরা মাঘের গীত ফাগুনে গায়! আমার চোখে এখনও পর্যন্ত এমন কোন হাদিস বা ফিকার মাসালা পড়েনি, যা দিয়ে সাব্যস্ত করা যায় তিন জুম্মা তরক করলে অটো বউ তালাক! আপনারা পেলে আমাকে জানাবেন। পরিশেষে, মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়।
হে আল্লাহ! বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষকে এ বিশ্ব মহামারি থেকে রক্ষা করো।
আজ পহেলা বৈশাখ, ঘুচে যাক সব আঁধার; শুভ নববর্ষ—১৪২৭!!
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১৪ এপ্রিল, ২০২০.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন