সোমবার, ২০ জুলাই, ২০২০

স্বীকৃত মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও কিছু কথা:

'মুনাফিক' আরবিতে - منافق, বহুবচনে মুনাফিকুন একটি ইসলামিক পরিভাষা, যার অর্থ প্রতারক বা 'ভন্ড ধার্মিক'; যে প্রকাশ্যে ইসলাম চর্চা করে, কিন্তু গোপনে অন্তরে কুফরী বা ইসলামের প্রতি অবিশ্বাস লালন করে। আর এ ধরনের প্রতারনাকে বলা হয় 'নিফাক', আরবি - نفاق‎‎। প্রকৃতপক্ষে 'মুনাফিক' শব্দটি 'নফক' শব্দ থেকে গঠিত; নফকের অর্থ—গর্ত, ছিদ্র, সুড়ঙ্গ, বের হওয়া, খরচ করা, ব্যয় করা ইত্যাদি। কারো কারো মতে, ‘নাফেকুল ইয়ারবু’ (পাহাড়ি ইঁদুর) থেকে মুনাফিক শব্দটি গঠিত; পাহাড়ি ইঁদুরকে ‘নাফেকুল ইয়ারবু’ বলা হয়। কারণ পাহাড়ি ইঁদুর অত্যন্ত ধূর্ত, এরা পাহাড়ে অনেক গর্ত খনন করে বসবাস করে। এদের মারার জন্য এক গর্তে পানি বা অন্য কিছু দিলে অন্য গর্ত দিয়ে তারা বের হয়ে পালিয়ে যায়, ফলে ওদের সহজে মারা যায় না। মুনাফিকরাও অনুরূপ ধূর্ত; তাদের সহজে ধরা যায় না চেনা যায় না। 

পবিত্র কুর'আনুল কারীমের শতাধিক আয়াতে মুনাফিকদের বিষয়ে স্পষ্ট আলোচনা এসেছে এবং মুসলমানদের জন্য তাদের অমুসলিম শত্রুদের তুলনায় মুনাফিকদের অধিক বিপজ্জনক শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সহীহ বুখারী হতে উদ্ধৃত; আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত — রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, "একজন মুনাফিকের তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে — ১). যখন সে কোন কথা বলে, সে মিথ্যা বলে। ২). যখন সে কোন প্রতিশ্রুতি দেয়, সবসময় তা ভঙ্গ করে। ৩). যদি তুমি তাকে বিশ্বাস করো, সে অসৎ উপায় অবলম্বন করে। -(বুখারী -২৬৮২, মুসলিম -১/২৫)

আরেক বর্ণনায় এসেছে — আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত; নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে বিদ্যমান সে হচ্ছে খাঁটি মুনাফিক। যার মধ্যে এর কোনো একটি স্বভাব থাকবে তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থেকে যায়। এগুলো হচ্ছে; ১). আমানতের খেয়ানত করা। ২). কথা বললে মিথ্যা বলা। ৩). অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করা। এবং ৪). বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীলভাবে গালাগালি করা। -(বুখারী -২২৫৯, মুসলিম -১/২৫) 

হুজুরপাক (সাঃ)-এর সময়কার মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই সম্বন্ধে অনেকেই জানতে চেয়েছেন, এবং তার জানাজা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) পড়িয়েছেন কি-না, পড়িয়ে থাকলে কেন পড়িয়েছিলেন এ'সব জানতে চেয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মাতৃসূত্রে যিনি ছিলেন ইবনে সালুল নামে পরিচিত, তিনি  বনু খাজরাজ গোত্রের প্রধান ছিলেন এবং মদিনার একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিও ছিলেন। হুজুরপাক (সাঃ) মদিনায় আসার পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, যদিও তার ধর্মান্তরিত হওয়ার বিশ্বস্ততা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। হুজুরপাক (সাঃ)-এর সাথে তার বারংবার দ্বন্দ্বের কারণে ইসলামী ঐতিহ্য অণুসারে তাকে একজন মুনাফিক (ভণ্ড, প্রতারক) এবং মুনাফিকদের সর্দার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়; এর পিছনের কারণ অনেক।

ইবনে উবাই ছিলেন বনু খাজরাজ গোত্রের দলনেতাদের মধ্যে অন্যতম একজন। তৎকালীন সময়ে বনু খজরাজ গোত্র বনু আউস গোত্রের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। ফিজার যুদ্ধের সময় প্রথম দিনের যুদ্ধে ইবনে উবাই খাজরাজ গোত্রের একটি অংশের নেতৃত্ব দেন, কিন্তু দ্বিতীয় দিনে তিনি সরে আসেন। এরপর অন্য আরেক নেতার সাথে ইহুদি জিম্মিদের হত্যার বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হওয়ার কারণে বুয়াস যুদ্ধেও তিনি যোগ দেন নি। উক্ত দ্বন্দ্বের সময় বনু কায়নুকা গোত্রের কিছু ইহুদি বন্ধু তার জীবন রক্ষা করে, যা তিনি এভাবে বলতেন : "গাড়িবহরে সজ্জিত ৩০০ সেনা, সাথে আরও ৪০০ জন খালি হাতে, তারা হাদাইক এবং বোয়াসের ময়দানে আমাকে প্রকৃত শত্রু থেকে রক্ষা করেছে।"

ইবনে উবাই সেই সময় মদিনার সেই গোত্রীয় শত্রুতা মেটানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন এবং ঐ দুই গোত্রের শত্রুতার আংশিক মিটমাটও করতে সক্ষম হন। এ কারণে উভয় গোত্রই তার নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দেয়। তাই ইসলামের পূর্বে মদিনায় তিনি উচ্চ সামাজিক মর্যাদা অর্জন করেছিলেন, এবং তার সমর্থকরা তাকে রাজা বানানোরও পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় হুজুরপাক (সাঃ)-এর আগমনের ফলে তা বাস্তবায়িত হতে পারে নি। গোত্রে গোত্রে বিবাদ তখনো পরিপূর্ণভাবে মিটছিল না, এ কারণে কিছু মদিনাবাসী বিকল্প কোনো বিরোধ নিষ্পত্তিকারকের সন্ধান করছিল এবং সে কারণেই তারা হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে মদিনায় নিয়ে আসেন; যার ধর্মপ্রচারের কারণে ইতোমধ্যেই তিনি তাঁর বাসস্থান মক্কায় সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। আর আল্লাহ কর্তৃক প্রতিশ্রুত হিসেবে দাবিদার হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমনে তখন জণমনে ইবনে উবাইয়ের প্রভাব নিমিষেই মিলিয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনা ইবনে উবাইয়ের মনে ঈর্ষার জন্ম দেয়, কিন্তু সে তার শান্তিপূর্ণ আচার ব্যবহারের মাধ্যমে সকলের কাছে তা গোপন রাখে। সবকিছুর পরও ইবনে উবাইয়ের মর্যাদা আগের মতোই অক্ষুণ্ণ থাকে।

মদিনায় হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রবেশ করার পর স্থানীয় আরব জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ ইসলাম গ্রহণ করে। ইবনে উবাইও এর সাথে মানিয়ে নিল (ম্যাক্সিম রবিন্সনের মতে) এই ভেবে যে, এর বিরোধিতা করার চেয়ে এতে যোগদান করাই অধিক বুদ্ধিমানের কাজ হবে। অনেকের মতে ইবনে উবাই হুজুরপাক (সাঃ)-এর হিজরতের পরপর সা'দ ইবনে মুয়াজ (রাঃ)-এর সাথে একই সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলামের ঐতিহ্যগত ইতিহাসে ইবনে উবাইয়ের ধর্মান্তরিত হওয়াকে প্রতারণা বলে মনে করা হয় এবং তাকে মুনাফিকদের সর্দার হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। রবিন্সনের মতে, "ইহুদিদের সাথে যোগাযোগ থাকার ফলে ইবনে উবাইর মনে একেশ্বরবাদের প্রতি আগ্রহ জন্মে, এবং সম্ভবত এ কারণেই সে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।"

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার কারণে, ইবনে উবাই প্রকাশ্যে ও গোপনে হুজুরপাক (সাঃ)-এর উপহাসকারীদের নেতা হয়ে উঠে এবং মদিনায় মুসলিমদের আগমনের ফলে আগত বিপদ ও বিভ্রান্তি নিয়ে অনবরত অভিযোগ করতে লাগল। ইতিহাসবীদ ইবনে ইসহাক লিখেছেন, "কিছুসংখ্যক আনসার সাহাবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করতে রাজি ছিলেন না, তারা মুখে ইসলাম গ্রহণ করলেও অন্তরে বিশ্বাসঘাতকতা লুকিয়ে রেখেছিল, এবং এ কারণে সে সময়েই তারা প্রতারক বা মুনাফিক বলে পরিচিত ছিল। ইসলাম বিরোধী প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম মুরের মতে, ইবনে উবাই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর রোষানলে পতিত লোকজনের পক্ষে থাকার কারণে ইসলামের প্রথাগত ইতিহাসে তাকে নেতিবাচকরূপে প্রদর্শন করা হয়েছে।

ইহুদিদের বনু কাইনুকা গোত্র ছিল পেশায় কর্মকার, স্বর্ণকার ও তৈজসপত্র নির্মাতা। বদর যুদ্ধের কিছুদিন পর তাদের বাজারে এক মুসলিম মহিলা এক ইহুদি-র স্বর্ণের দোকানে কোন এক কাজে গিয়েছিল। ঐ মুসলিম মহিলা যখন ঐ দোকানে গিয়েছিলেন তখন ঐ ইহুদি কর্মচারী মুসলিম মহিলাটির মুখ খুলতে বলে। কিন্তু মহিলাটি তাঁর মুখ খুলতে রাজি না হওয়ায় মহিলাটি যখন স্বর্ণের দোকানের একটি চেয়ারে বসে তখন ইহুদি কর্মচারীটি ঐ মহিলার পোশাকে পেরেক মেরে চেয়ারের সাথে আটকে দেয়, ফলে উঠতে গিয়ে ঐ মহিলার জামা ছিঁড়ে সারা শরীর অনাবৃত হয়ে যায়। মুসলিম মহিলার আর্তনাদ শুনে এক মুসলিম পথচারী এটা দেখে খেপে গিয়ে ঐ ইহুদি কর্মচারীকে হত্যা করেন, এরপর ইহুদি কর্মচারীর পক্ষের লোকেরা সবাই মিলে ঐ মুসলমানকে হত্যা করে ফেলে।

উক্ত ঘটনার ফলে, ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে, মুসলিমরা ইহুদি গোত্র বনু কায়নুকার উপর আক্রমণ চালায়, এবং ১৫ দিন তাদেরকে অবরোধ করে রাখার পর অবশেষে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। মুসলিম ঐতিহাসিকদের মতে, ইবনে উবাই তখন বনু কায়নুকার সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্কে আবদ্ধ থাকায় হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে তাদের শাস্তি লঘু করার জন্য আবেদন করে। এতে হুজুরপাক (সাঃ) তার অনুরোধ গ্রহণ করেন, এবং বনু কায়নুকাকে শহর ছেড়ে চলে যাবার জন্য তিন দিনের সময় দিলেন। এমনতর অনেক ঘটনাতে ইবনে উবাই একজন মুনাফিক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। 

৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ তথা ৬ষ্ঠ হিজরির শা’বান মাসে খাজায়া গোত্রের বনু মুস্তালিক শাখার বিরুদ্ধে হুজুরপাক (সাঃ) অভিযান চালান; ইবনে উবাইও সেই অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এক সময় হুজুরপাক (সাঃ) জানতে পারলেন যে, বুন মুসতালিক গোত্রও তাদের সৈন্য সমাবেশ করছে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে হারেস ইবনে আবু দিরার, যিনি হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অন্যতম স্ত্রী হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ)-র পিতা। এ খবর পেয়েই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সৈন্য সামন্ত নিয়ে তাদের মুকাবিলায় বেরুলেন। মুরাইসি নামক ঝরনার কিনারে তাদের সাথে তুমুল যুদ্ধ হলো। আল্লাহ বনু মুস্তালিককে পরাজিত করলেন। তাদের বহু লোক নিহত হলো। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাদের সন্তান, নারী ও সম্পদ গণিমত হিসেবে গণ্য করলেন। 

বনু কালব ইবনে আউফ গোত্রের হিশাব ইবনে সুবাবা নামক জনৈক মুসলিম এতে নিহত হন; তাঁকে শত্রুপক্ষীয় মনে করে উবাদা ইবনে সমিতের দলভুক্ত জনৈক সাহাবী ভুলক্রমে হত্যা করেন। 

ঝরনার কিনারে অবস্থানকালেই মুসলমানদের মধ্যে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে; জাহজাহ ইবনে মাসউদ নামক বনু গিফারের এক বেদুঈন ক্রীতদাসকে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) তাঁর ঘোড়া রাখার জন্য মজুর হিসাবে নিয়োগ করেন। পানি নিয়ে খাজরাজ গোত্রের সিনান ইবনে আবার জুহানির সাথে তার ঝগড়া হয় এবং ক্রমে ঝগড়া মারামারিতে রূপান্তরিত হয়। তখন জুহানি চিৎকার করে ডাকলো “হে আনসারগণ, বাঁচাও।” জাহজাহও চিৎকার করে বললো, “হে মুহাজিরগণ, আমাকে বাঁচাও।” 

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল তখন তার গোত্রের একদল লোকের সাথে অবস্থান করছিল। কিশোর জায়িদ ইবনে আরকাম (রাঃ)-ও সেই দলের মধ্যে ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই চিৎকার শুনে উত্তেজিত হয়ে বলে, "তারা কি শেষ পর্যন্ত এমন কাণ্ড ঘটাল? ওরাতো আমাদের মাঝে থেকেই দল ভারী করে অহমিকায় মেতে উঠেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের ও মুহাজিরদের অবস্থা সেই প্রবাদ বাক্যের মতোই গড়াচ্ছে যে, ‘নিজের কুকুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটাসোটা বানাও, দেখবে একদিন সে তোমাকেই কেটে খাবে।’ আল্লাহর কসম, এবার যদি আমরা মদিনায় ফিরে যাই তাহলে সবলরা দুর্বলদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেবে।” তারপর তার স্বগোত্রীয়দের বলতে লাগল, “তোমার নিজেদের কী সর্বনাশ করেছ, এখন দেখ। ওদেরকে এ দেশে ঠাঁই দিয়েছ। তোমাদের সম্পদের ভাগ দিয়েছ। ওদের প্রতি অমন বদান্যতা যদি না দেখাতে তাহলে ওরা অন্যত্র যেতে বাধ্য হতো।” 

জায়িদ ইবনে আরকাম (রাঃ) এসব কথাবার্তা শুনে হুজুরপাক (সাঃ)-কে জানালেন। এ সময় তিনি সবেমাত্র শত্রুকে পরাস্ত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। তিনি যখন এই খবর শুনলেন তখন তাঁর কাছে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, “আব্বাদ ইবনে বিশরকে নির্দেশ দিন তাকে যমের ঘরে পাঠাক।” হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন, “ওমর আমি যদি তা করি তাহলে লোকেরা বলবে যে, মুহাম্মাদ নিজেই তার সহচরদের হত্যা করছে; তা করা যায় না। তবে তুমি এখনই এখান থেকে রওনা হবার নির্দেশ জানিয়ে দাও।” যে সময় এ নির্দেশ দেওয়া হলো সে সময় সাধারণত হুজুরপাক (সাঃ) কোথাও রওনা হতেন না, তথাপি সবাই রওনা হলো। এছাড়া ইবনে উবাইয়ের নিজ পুত্র আবদুল্লাহও হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে নিজের পিতাকে হত্যার আবেদন জানিয়ে অণুরোধ করেছিল।

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল যখন জানতে পারল যে জায়িদ ইবনে আরকাম (রাঃ) তার কথাগুলো হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে বলে দিয়েছেন, তখন সে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে ছুটে গিয়ে কসম খেয়ে বলতে লাগে, “জায়িদ যা বলেছে, আমি সে সব কথা বলি নি।” আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যেহেতু স্বগোত্রে খুবই সম্মানিত লোক বলে গণ্য হত তাই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট যেসব আনসারী সাহাবী ছিলেন তারা বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, জায়িদ হয়ত ভুল শুনেছে এবং সে যা বলেছে তা হয়ত পুরোপুরি মনে রাখতে পারে নি।” এভাবে তারা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের প্রতি একটু সৌজন্য দেখালেন এবং তাকে বাঁচিয়ে দিলেন। 

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সেই অবেলায়ই রওনা হলেন, তাঁর সাথে উসায়েদ ইবনে হুদাইস দেখা করলেন। তাঁকে সালাম ও অভিবাদন পূর্বক বললেন, "হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! আপনি বড়ই অসুবিধাজনক সময়ে যাত্রা করেছেন। সাধারণত এরকম সময়ে আপনি কোথাও যাত্রা করেন না।” হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তখন বললেন, “তোমাদের সঙ্গী লোকটি কি বলেছে তা শোন নি?” তিনি বললেন, “কোন্ সঙ্গী ?” হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন, “আবদুল্লাহ ইবনে উবাই।” উসায়েদ বললেন, “সে কী বলেছে?" হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন, “তার ধারণা, সে যদি মদিনায় ফিরে যেতে পারে তাহলে সবলরা দুর্বলদেরকে সেখান থেকে বের করে দেবে।” উসায়েদ বলল, “হে আল্লাহর রাসুল, আপনি ইচ্ছা করলে তাকে আমরা বের করে দিতে পারি। সত্যই সে অত্যন্ত হীন ও নীচ। আর আপনি পরাক্রান্ত।” তিনি আরো বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, তার প্রতি একটু নমনীয় হোন। আল্লাহর কসম, আপনাকে আল্লাহ আমাদের এমন সময় এনে দিয়েছেন যখন তার গোত্র তাকে মুকুট পরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাই সে মনে করে, আপনি তার থেকে একটা রাজ্য কেড়ে নিয়েছেন।” 

কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিবাদের ঝুঁকি এড়াতে সেই দিনই পুনরায় যাত্রা শুরু করেন। তিনি তাঁর সাহাবীদের সাথে নিয়ে একদিন একরাত ধরে পথ চললেন। পথে প্রচণ্ড রৌদ্রে তাদের অসহনীয় কষ্ট হতে লাগল। তাই এক জায়গায় যাত্রাবিরতি করলেন। লোকেরা মাটিতে নামতেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। আগের দিন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথায় লোকদের ভেতর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এভাবে অসময়ে যাত্রা করেছিলেন। বিশ্রাম শেষে হুজুরপাক (সাঃ) পুনরায় সদলবলে যাত্রা শুরু করলেন। হিজাজের মধ্য দিয়ে যাত্রাকালে তিনি একটি ঝরনার কাছে যাত্রাবিরতি করলেন; সে স্থানটির নাম বাক্কা। সেখান থেকে পুনরায় যখন যাত্রা শুরু হলো তখন মুসলমানদের উপর দিয়ে হঠাৎ একটা কষ্টদায়ক ভীতিপ্রদ বাতাস বয়ে গেল। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন, “এ বাতাসকে তোমরা ভয় পেয়ো না। একটা মস্তবড় কাফিরের মৃত্যু ঘটেছে। সে জন্যই এ বাতাস।” মদিনায় ফিরে তাঁরা দেখেন বনু কাইনুকা গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তি রিফায়া ইবনে জায়িদ ঐ দিনই মারা গেছে। সে ছিল মুনাফিকদের আশ্রয়স্থল তথা কুমন্ত্রণাদাতা।

পবিত্র কুর'আনে সুরা মুনাফিকুন-এ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার মতো লোকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, "তারাই বলেঃ আমরা যদি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করি তবে সেখান থেকে সবল অবশ্যই দুর্বলকে বহিস্কৃত করবে। শক্তি তো আল্লাহ তাঁর রসূল ও মুমিনদেরই কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না (63:8)।" 
আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পুত্র আবদুল্লাহ তার পিতার ব্যাপারটা জানতে পেরে হুজুরপাক (সাঃ)-কে বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি শুনেছি, আপনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে তার বৈরী কথাবার্তার জন্য হত্যা করতে ইচ্ছুক। যদি সত্যিই আপনি ইচ্ছুক হয়ে থাকেন তাহলে আমাকে নির্দেশ দিন আমি তার মাথা আপনার কাছে পৌঁছিয়ে দিই। আল্লাহর কসম! খাজরাজ গোত্র জানে যে, ঐ গোত্রে আমার চেয়ে পিতৃভক্ত লোক আর নেই। আমার আশঙ্কা হয় যে, আপনি আমার পিতাকে হত্যার জন্য কাউকে নির্দেশ দেবেন। আর সে তাকে হত্যা করবে, তখন আমার পিতৃহত্নাকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখে হয়তো আমার প্রবৃত্তি কুপ্ররোচনা দিয়ে আমাকে অসহিষ্ণু করে তুলবে। ফলে তাকে হত্যা করে আমি জাহান্নামে যেতে বাধ্য হব। কেননা সেক্ষেত্রে আমি একজন কাফিরের বদলায় একজন মু’মিনকে হত্যার দায়ে দোষী হব।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না সে যতদিন আমাদের সাথে থাকে ততদিন তার প্রতি আমরা নমনীয় থাকব এবং ভালো ব্যবহার করব।” 

এরপর থেকে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যখনই কোনো অঘটন ঘটাতো, তার গোত্রের লোকেরাই তাকে শায়েস্তা করতো। তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করতো এবং পাকড়াও করতো। এই অবস্থা জেনে একদিন হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে বললেন, “ওমর, পরিস্থির পরিবর্তনটা দেখছো তো? তুমি যেদিন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে হত্যার পরামর্শ দিয়েছিলে সেদিন যদি তাকে হত্যা করতাম তাহলে অনেকেই নাক সিটকাতো। কিন্তু আজ যদি তাকে হত্যার নির্দেশ দিই তাহলে সেদিন যারা নাক সিটকাতো, তারাই আজ তাকে হত্যা করবে।” হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি জানি আল্লাহর রাসুল (সাঃ)-এর সিদ্ধান্ত আমার সিদ্ধান্তের চাইতে অধিক কল্যাণকর।” 

এরপর একই বছর মার্চ মাসে মা আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ)-র বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়ে অভিযোগ আনা হল এবং তখন ইবনে উবাই ছিলেন তাদের মধ্যে একজন যারা এই গুজবটি রটিয়ে বেড়াচ্ছিল। আওস গোত্রের একজন নেতা অপবাদ রটনাকারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন, কিন্তু খাজরাজ গোত্র এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মা আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ)-র সতীত্ব সম্পর্কে ঐশী নিশ্চয়তা প্রদানকারী আয়াত নাজিল হওয়ার খবর সবাইকে জানানোর পর প্রত্যেক অপবাদকারীকে আশিটি বেত্রাঘাতের শাস্তি দিলেন, কিন্তু ইবনে উবাইকে কোনো শাস্তি দিলেন না।

৬৩০ সালে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলে ইবনে উবাই তাবুক যুদ্ধের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদানকারীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে। মুসলিম সেনাবাহিনী তাবুকের পথে যাত্রা শুরু করলে ইবনে উবাই গোপনে তাঁর লোকজন নিয়ে সেনাদল থেকে পালিয়ে গিয়ে মদিনায় ফিরে আসে। অনেকে বলেন, তার শারীরিক অসুস্থতার কারণে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অনুমতিতেই সে যুদ্ধ ছেড়ে চলে এসেছিল। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাবুক থেকে ফিরে আসার পর যারা যুদ্ধের সমালোচনা করেছিল এবং যুদ্ধে না গিয়ে মদিনায় থেকে গিয়েছিল তাদেরকে তিরস্কার করে সুরা তওবার ৮১ তম আয়াত অবতীর্ণ হয়।

তাবুক থেকে ফিরে আসার পর ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মারা যায়। তার ছেলে আবদুল্লাহ নবী করিম (সাঃ)-এর সেবায় হাজির হয়ে কাফনে ব্যবহারের জন্য তার কোর্তা চাইলে তিনি কোর্তা দিয়ে দিলেন। তারপর আবদুল্লাহ তাকেই জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন; তিনি এ জন্যও তৈরি হয়ে গেলেন। হযরত ওমর (রাঃ) বারবার এ মর্মে আবেদন জানাতে লাগলেন, "হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি এমন ব্যক্তির জানাজার নামাজ পড়াবেন যে অমুক অমুক কাজ করেছে?" কিন্তু তিনি তাঁর এ সমস্ত কথা শুনেও মুচকি হাসতে লাগলেন৷ এমনকি তার মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেও ইতস্তত করলেন না। এরপর হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তার জানাজার সালাত আদায় করেন (ভিন্ন মতও আছে এ নিয়ে) এবং ফিরে আসেন। এর কিছুক্ষণ পরেই সুরা বারাআতের (সুরা তওবার) এ দুটি আয়াত নাজিল হল : 

"তাদের কেউ মারা গেলে আপনি কখনো তার জানাজার সালাত আদায় করবেন না। এমতাবস্থায় যে তারা ফাসিক।"— (আয়াত : ৮৪)

এ আয়াতগুলো নাজিল হওয়ার পর নবী করিম (সাঃ) নিয়ম করে নিয়েছিলেন যে কোনো জানাজার শরিক হবার জন্য তাকে ডাকা হলে তিনি প্রথমে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। জিজ্ঞেস করতেন, সে কেমন ছিল৷ যদি জানতে পারতেন সে অসৎ চরিত্রের অধিকারী ছিল, তাহলে তার পরিবারের লোকদের বলে দিতেন, তোমরা যেভাবে চাও একে দাফন করে দিতে পারো। 

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই কয়েকজন কন্যা এবং আবদুল্লাহ নামের একটি পুত্রসন্তান রেখে যায়, যারা সকলেই সারাজীবন ধর্মপ্রাণ মুসলিম হয়ে ছিলেন।

সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও বলিষ্ঠ সনদ হাদিসসমূহ থেকে এ কথাই প্রতিপন্ন হয় যে, রসূলপাক (সাঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এর জানাযা পড়িয়েছিলেন। কিন্তু পরে তাঁকে সূরা তওবার ৮৪ নং আয়াতের মাধ্যমে মুনাফিকদের জানাযার নামায পড়াতে বারণ করা হয়। ফলে রসূলপাক (সাঃ) পরবর্তীকালে আর কখনো এমন কোনো লোকের জানাযা পড়াননি, যার মুনাফিক হওয়া একেবারেই স্পষ্ট ছিলো এবং তা রসূলপাক (সাঃ)-এর জানা ছিলো। 

কিন্তু কিছু কিছু হাদিস থেকে এ কথাও জানা যায় যে, তিনি আব্দুল্লাহ বিন উবাইর জানাযা পড়াননি। তিনি পড়াতে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু ওহী দ্বারা তাঁকে নিষেধ করা হয়। যেসব হাদিসে রসূলপাক (সাঃ) কর্তৃক জানাযা পড়ানোর উল্লেখ রয়েছে, সেগুলো বুখারি, মুসলিম ও অন্য ছয়টি সহীহ হাদিসগ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে। বুখারি ও মুসলিমের জানাযা অধ্যায়ে এ ধরণের একাধিক হাদিস রয়েছে। বুখারিতে 'জামা দ্বারা কাফন দেয়া।' শিরোনামে হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) বর্ণিত প্রথম হাদিসের বক্তব্য এই যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর ছেলে পিতা মারা যাওয়ার পর রসূল (সাঃ)-এর নিকট আবেদন জানালেন, "আপনার জামাটা দিন এবং জানাযা পড়িয়ে দিন।" তিনি রাজি হয়ে গেলে হযরত ওমর (রাঃ) বললেন : "আল্লাহ তায়ালা কি আপনাকে মুনাফিকদের জানাযা পড়াতে নিষেধ করেননি।" রসূল (সাঃ) বললেন : "আমাকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে, পড়াতেও পারি, নাও পড়াতে পারি।" অবশেষে তিনি জানাযা পড়ালেন। পড়ানোর পর এ আয়াত নাযিল হয়।

কিন্তু এ অধ্যায়ে হযরত জাবির বর্ণিত অপর হাদিসটি এরূপ : "আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে এলেন। তিনি তার লাশ উঠালেন, তার উপর নিজের পবিত্র লালা দিলেন এবং নিজের জামাটি তার কাফনে জড়িয়ে দিলেন।"

এ হাদিসে রসূলপাক (সাঃ) কর্তৃক জানাযা পড়ানোর উল্লেখ নেই। উল্লেখ না থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বিবেচনা সাপেক্ষ। প্রতীয়মান হয় যে, রসূলপাক (সাঃ)-এর পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ায় লাশ দাফন সম্পন্ন হয়, কিংবা কমেরপক্ষে তাকে কবরে নামানের পর তিনি পৌঁছেন। জানাযা দাফনের আগেই হয়তো পড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে রসূলপিক (সাঃ) তার পুত্র ও গোত্রের মনসন্তুষ্টির জন্য এবং ইসলামের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য নিজের মুখের লালা ও জামা দিয়ে কৃতার্থ করেন। এটা ছিলো রসূলপাক (সাঃ)-এর সর্বোচ্চ মানের মহানুভবতা ও ক্ষমার বহি:প্রকাশ। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য তাঁকে কখনো কোনো মুনাফিকের জানাযা পড়াতে এমনকি তার কবরের কাছে দাঁড়িয়ে দোয়া বা শোক প্রকাশ করতেও নিষেধ করে দেয়া হয়। 

হাদিস ব্যাখ্যাকারীগণ হযরত জাবিরের বর্ণিত এই হাদিস এবং অন্যান্য হাদিসের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। তারা বলেছেন, রসূলপাক (সাঃ) যখন লাশ বের করে এমন অসাধারণ অনুকম্পার মনোভাব অবলম্বন করেছেন, তখন নামাযও হয়তো পড়িয়েছেন। কিন্তু হযরত জাবির এ কথার উল্লেখ করেননি। বস্তুতঃ রসূলপাক (সাঃ)-এর আগমনের আগে যে দাফনক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল, সেটা জানাযা বাদ দিয়ে হওয়ার কথা নয়। কেননা জানাযা আগে হয় এবং দাফনের পালা পরে আসে।

দ্বিতীয় হাদিসটি হযরত আনাস থেকে বর্ণিত; এ হাদিস থেকে জানা যায়, সূরা তাওবার ৮৪ নং আয়াত জানাযা পড়ার আগেই নাযিল হয়ে গিয়েছিল এবং এর কারণে রসূলপাক (সাঃ) জানাযা পড়া থেকে বিরত থাকেন। 'মাজমায়ুয্‌ যাওয়াইদ' গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে ৪২ পৃষ্ঠায় 'মুনাফিকদের জানাযায় নিষেধাজ্ঞা' শিরোনামের অধীনে হাদিসটির বিবরণ এরূপ : "হযরত আনাস বিন মালিক জানান, রসূলপাক (সাঃ) আব্দুল্লাহ বিন উবাইর জানাযা পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জিবরীল তাঁকে থামালেন এবং এই ওহী শোনালেন 'ওদের কারো জানাযা পড়োনা এবং কবরেও দাঁড়িওনা।' মুসনদে আবু ইয়ালাতে এ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এর বর্ণনাকারীদের মধ্যে একজন রয়েছেন ইয়াযীদ রাক্কাশী। কোনো কোনো হাদিসশাস্ত্রবিদ তাঁর সম্পর্কে আপত্তি তুলেছেন। আবার কেউ কেউ তাঁকে নির্ভরযোগ্যও বলেছেন।"

হাদিসটির বর্ণনাকারীদের সকলের নামসহ পুরো সনদ ইমাম ইবনে জারীর স্বীয় সূরা তাওবার তফসীরে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন : হযরত জাবির থেকে বর্ণিত যে হাদিসটি ইতিপূর্বে বুখারি শরিফ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, সেটি অল্পবিস্তর শাব্দিক পার্থক্যসহ মুসনদে আহমদ এবং অন্যান্য হাদিসগ্রন্থেও লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং সে সব গ্রন্থেও হযরত জাবির বলেননি যে, রসূলপাক (সাঃ) জানাযা পড়িয়েছেন।

মুসনদে আহমদ তৃতীয় খণ্ড, ৩৭১৬ পৃষ্ঠায় একটি বর্ণনা এরূপ লিপিবদ্ধ রয়েছে :
 "আব্দুল্লাহ বিন উবাই মারা গেলে তার ছেলে রসূলপাক (সাঃ)-এর নিকট এসে বললেন : ইয়া রসূলুল্লাহ! আপনি যদি জানাযায় না আসেন, তবে সেটা আমাদের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর ব্যাপার হবে। তাই রসূলপাক (সাঃ) উপস্থিত হলেন, কিন্তু ততোক্ষণে লাশ কবরে নামানো হয়ে গেছে। রসূলপাক (সাঃ) বললেন : তোমরা দাফনের আগে আমাকে জানালে না কেন? অত:পর তিনি কবর থেকে লাশ বের করলেন, তার সমগ্র শরীরে নিজের লালা মাখিয়ে দিলেন এবং নিজের জামা পরিয়ে দিলেন।"

যাই হউক, রসূলপাক (সাঃ) জানাযা হয়তো পড়াননি, হয়তো তিনি শুধু লালা ও জামা দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন। এমনও হতে পারে যে, জানাযা পড়াবেন বলে মনস্থ করেছিলেন, কিন্তু পড়ানোর আগেই ওহী নাযিল হয়ে যায়। এ সম্ভাবনার কথা আমি আগেও বলেছি। তবে বিশুদ্ধতর হাদিসে জানাযা পড়ানোর উল্লেখ রয়েছে এবং তাতেও কোনো জটিলতা নেই। কেননা এ জানাযার আগে দোয়া করতে নিষেধ করা হয়েছিল শুধু কাফের ও মুশরিকের জন্য। মুনাফিকদের ব্যাপার একটু স্বতন্ত্র। বাহ্যত তারা মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিলো এবং সামাজিক সুযোগ সুবিধা মুসলমানদের মতোই ভোগ করতো। তাই রসূলপাক (সাঃ)-কে অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীনভাবে নিষেধ না করা পর্যন্ত মুনাফিকদের জানাযা পড়া না পড়ার ব্যাপারে তিনি স্বাধীন ছিলেন।

তবে আসল লক্ষণীয় ও শিক্ষণীয় বিষয়টি এখানে এই যে, মুনাফিকের জন্য আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর মাগফিরাতের দোয়াও গ্রহণগোয্য নয়, এবং মুনাফিকের কবরে যদি আল্লাহর নবী (সাঃ)-র মুখের লালা এবং গায়ের জামাও রেখে দেয়া হয়, তবু এই বরকতময় জিনিস মুনাফিককে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাতে পারবে না। হে আল্লাহ! প্রত্যেক কালেমা পড়া মুসলমানকে মুনাফিকি থেকে বিরত রাখুন॥
[তথ্যসূত্র উইকি]

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৩১ জুলাই, ২০১৮.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন