আজ মেসেঞ্জার কলে আমরা বেশ কয়েকজন কথা বলছিলাম। হঠাৎ এক ছোট ভাই আমাকে একটি প্রশ্ন করে বসলেন, কত রমজানে যেন একটা তারা উঠবে? ওটা উঠলেই নাকি করোনা চলে যাবে?? ছোট ভাইটিকে তখন এ নিয়ে বিস্তারিত বলতে পারিনি। যেহেতু সে আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডও, অতএব আজ এই বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার নিয়ে কিছু লিখতে চেষ্টা করবো, এমন ধারণা পোষণকারীদের মুণ্ডপাত ঘটানোর অভিপ্রায়ে।
তারকা উঠবে আর করোনা বিদায় নেবে— বিষয়টি এমন নয়! না বুঝার কারণে অনেকেই আজ ঈমানহারা হয়ে যাচ্ছেন। আকাশের একটা তারা উঠবে, আর করোনা চলে যাবে, বিষয়টি এমন হলে হযরত ওমর (রাঃ) সেদিন হজরে আসওয়াদে চুম্বন করতে গিয়ে বলতেন না, 'তুমি আমার কাছে একটি পাথর বৈ অন্য কিছুই নও, আমি দেখেছি আল্লাহর হাবীব (সাঃ) তোমাকে চুমু খেয়েছেন, তাই আমিও খাচ্ছি!'
আকাশের একটা তারার আরবি নাম সুরাইয়া; যেটার বাংলা নাম কৃত্তিকা, ইংরেজিতে বলা হয় Pleiades । মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের ভোরবেলায় এর উদয় হয়। এই তারকার উদয়ে মানুষের উপর থেকে রোগব্যাধি বিদায় নিয়ে চলে যেতে পারে বলে একটি হাদিসে আলোচিত হয়েছে। তাছাড়া এই তারকা নিয়ে অন্য আরেকটি হাদীসও আছে। যথাস্থানে আমি হাদীস দুইটি তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, 'যখন সুরাইয়া উঠবে, তখন প্রতিটি শহরবাসী থেকে ব্যাধি উঠিয়ে নেয়া হবে।' এই ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলছেন, 'মহানবী (সাঃ) ব্যাধি চলে যাওয়ার আগে ফল বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন।' বর্ণনাকারী বলেন, আমি ইবনে ওমর-এর কাছে জানতে চাই, কখন যাবে সেই ব্যাধি? তিনি বলেন, ঐ সুরাইয়া তারকা উদয়ের পর।' এই হাদীসের সাথে বর্তমান করোনা মহামারীর কোন সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয়নি। তাই হাদীসের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি।
দীর্ঘ হাদীসের খণ্ডিত একটি অংশ নিয়ে সুরাইয়া তারকার উদয় নিয়ে অপব্যাখ্যা করে আমাদের দেশের এক শ্রেণীর আলেম-ওলামা এরই মধ্যে বেশ বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছেন। বিষয়টি বিস্তারিত বলার আগে প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া উচিত— ইসলাম মিথ্যা আশ্বাসের ধর্ম নয়। কোথাকার হাদীস কোথায় এনে মোল্লারা সংযোগ করছে??
এর আগেও করোনাভাইরাস নিয়ে এদেশের তথাকথিত মোল্লাদের অনেক দম্ভোক্তি শুনেছি; মুসলমানের জন্য নাকি করোনা আসেনি! আরও কত কি মিথ্যাচার! আপনাদের স্মরণ রাখা উচিত মিথ্যা দিয়ে সত্য ধর্ম প্রচার করা যায় না; ইসলাম প্রচারে মিথ্যা লাগে না। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে শুধু শুধু কেন আপনারা এইভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন? ঈমান নষ্ট করছেন?? মৃত্যুর ভয় কি আপনাদের মোটেও নেই?? তবে চাল চোর আর আপনার মধ্যে পার্থক্যটা থাকলো কি??
এই আপনারা বারবার হুজুর পাক (সাঃ)-এর নামে মিথ্যা ছড়িয়েছেন, এখনো ছড়াচ্ছেন! কেন?? আমি তো স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আপনাদের বদান্যতার জন্যই আজ দুনিয়া আজাব-গজবে ভরে গেছে।
আপনাদের উদ্দেশ্যে আজ দু'এক কথা বলতেই হয়। একবার মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রঃ)-র দরবারে এক লোক এসে দর্শন শাস্ত্রের বেশ প্রশংসা শুরু করে। তার প্রশংসার ধরন এমন ছিল যে, যেখানে পূর্বের আলেম-ওলামাদের হেয় করা হয়। তার যুক্তি খণ্ডনে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রঃ) ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-র মর্যাদাপূর্ণ বাণী তুলে ধরলেন। তাতে লোকটি মুখ বিকৃত করে বলে উঠলো, 'গাজ্জালী অযৌক্তিক কথা বলেছেন!'
ইমাম গাজ্জালী (রঃ) -র শা'নে এমন বেয়াদবীমূলক বাক্য শুনে তিনি রাগান্বিত হয়ে গেলেন। তৎক্ষনাৎ তিনি সেখান থেকে উঠে গেলেন এবং ধমক দিয়ে সেই লোকটিকে বললেন, 'যদি জ্ঞানীদের সংস্পর্শের আগ্রহ থাকে, তবে এরূপ বেয়াদবীমূলক বাক্য বলা থেকে নিজের মুখ বন্ধ রেখো।' আর আজকের তথাকথিত মোল্লারা ও অতি সাধারণ না জানা নামধারী মুসলমানরাও বিখ্যাত সব আলেম-ওলামাদের নিয়ে কি যে বাজে বাজে মন্তব্য করে, সেসব শুনলে মাথা আর ঠিক রাখতে পারি না।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, 'আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় সূরা জুমুআ নাযিল হয়। রাসূল (সাঃ) তিলাওয়াত করে যখন এই পর্যন্ত পৌঁছলেন, '…… তাদের থেকে পরবর্তীতে যখন কেউ মিলিত হবে', মজলিস থেকে কেউ প্রশ্ন করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখন পর্যন্ত আমাদের সাথে মিলিত হয়নি, পরে মিলিত হবে তারা কারা? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিরব থাকলেন। প্রশ্নকারী এভাবে আরো দুইবার অথবা তিনবার প্রশ্ন করলেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) সালমান ফারসী (রাঃ)-র কাঁধে হাত রেখে বললেন, 'যদি ঈমান সুরাইয়া তারকাতেও থাকে তবুও এদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি (পারস্যের বংশদ্ভূত) তা অর্জন করবে।' —( সহীহ্ বোখারী)
তাফসীরে মাযহারীতে কাযী ছানাউল্লাহ পানিপথী (রঃ) সূরা জুমুআ-র উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেছেন মুজাদ্দিদে আলফে সানী হলেন সেই ব্যক্তি যিনি ইসলামকে পুন জাগরিত করেছেন। ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-কে অনেক মনীষীই পাঁচশ হিজরির মোজাদ্দিদ বলেছেন। আর মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রঃ)-কে বলা হয় ইসলামের নব্য জাগরণের পুরোধা। পূর্ববর্তী আলেমদের প্রতি পরবর্তী আলেমদের শ্রদ্ধা-ভক্তি কেমন ছিল তা উপরোক্ত ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেনি? না কি তা বুঝা যায় না? আজকের মোল্লারা একে অন্যের বিরুদ্ধে করে কি??
'ইত্তেহাফুস সা'দাত লিয যাবীদি' কিতাবে একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। তাজুদ্দীন আবদুল ওয়াহহাব বিন আলী সুবকী (রঃ) বলেন— এক ফকীহ আমাকে বললেন যে, এক ব্যক্তি ফিকহে শাফেয়ীর দরসে ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-কে গালমন্দ করলো, আমি এতে অনেক কষ্ট পেলাম। রাতে ব্যথিত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-র সাক্ষাৎ লাভ হলো। আমি সেই গালমন্দকারী ব্যক্তির কথা আলোচনা করতেই তিনি বললেন, 'চিন্তা করো না, সে আগামীকাল মারা যাবে।'
সকালে যখন আমি দরসের হালকায় পৌঁছলাম, তখন হাসিখুশি অবস্থায় তাকে সেখানে দেখলাম। কিন্তু যখন সে সেখান থেকে বের হলো, ঘরে যাওয়ার সময় রাস্তায় বাহন থেকে পড়ে সে আহত হলো এবং সূর্যাস্তের পূর্বেই মারা গেলো।
বুজুর্গানে দ্বীনদের সম্বন্ধে মিথ্যা বলা বা উপহাস করার প্রায়শ্চিত্ত দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই পেতে হয়। আজকের দিনের মোল্লাদের ও মুসলমানের হাল দেখে পাঁচশ হিজরির সেই বিখ্যাত সুফি ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-র কিতাবের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল।
তৎকালিন সময়ের তুস-এর একজন সুফি একবার মদিনা মনোওয়ারা সফরে যান। সেখানে গিয়ে তিনি মক্কা-মদিনার প্রধান মুফতীর সাথে সাক্ষাৎ প্রত্যাশা করলেন। কিন্তু তাঁর পোশাক-আশাকের দৈন্য দশা দেখে কেউ তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। একাধারে কয়েকদিন সেই সুফি রওজামুবারক-এর রিয়াজুল জান্নাহ-য় পড়ে রইলেন। কখনো তাকে কেউ তেমন একটা খেতেও দেখেনি, ওখানটা ছেড়ে কোথাও যেতেও দেখেনি। বেশ কয়েকটা রাতদিন ওখানে পড়ে থাকার পর একদিন বের হলেন এবং প্রধান মুফতীর সাথে সাক্ষাত করতে গেলেন।
পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে যথা সময়ে সুফি উপস্থিত হলেন মুফতীর কুটিরে। দেখতে পেলেন, ইয়া বড় আলিশান এক চেয়ারে বসে আছেন মুফতী সাহেব। তাকে বাতাস করছে একজন, বিশাল এক পাখা নিয়ে! সুফি সালাম দিয়ে তার সম্মুখে উপস্থিত হতে মুফতী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনি কি জানতে চান আমার কাছে?'
সুফি জবাব দিলেন, ' জনাব, আমি আপনার কাছ থেকে অজু শিখতে এসেছি।'
মুফতী সাহেব বললেন, 'ঠিক আছে।' অতপর তিনি অন্য একটি চেয়ারে বসে অজুর পানি আনালেন দাস দিয়ে এবং দাস পানি ঢেলে দিল, মুফতী সাহেব অজু করে দেখালেন।
মুফতী সাহেব অজু শেষ করে সুফিকে অজু করার জন্য নির্দেশ দিলেন। সুফি অজু করতে গিয়ে হাত ধুইতে যেয়ে চারবার পানি খরচ করে ফেললেন। মানে তিনবারের জায়গায় চারবার হাত ধুইলেন। এতে করে মুফতী সাহেব ক্ষেপে গিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, ' আপনি অতিরিক্ত পানি খরচ করেছেন কেন?'
সুফি চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। অতপর জিজ্ঞেস করলেন, 'মুফতী সাহেব, হুজুর পাক (সাঃ)-এর প্রাসাদটি যেন কোন খানে? হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ)-র প্রাসাদ দুটো আমাকে একটু দেখাবেন কি?'
মুফতী সাহেব রেগে উত্তর করলেন, 'ওনাদের কোন প্রাসাদ ছিল না, আপনি জানেন না?'
সুফি ক্ষেপে গিয়ে বলতে থাকলেন, ঠিক বলেছেন, তবে আপনার মতো একজন অতি সাধারণের (মুফতীর) আজ এতো শানশওকত কেন? অজুতে আমি এক মুঠো পানি বেশি খরচ করেছি বলে আপনি আমাকে তিরস্কার করলেন, ফতোওয়া দিলেন; আর আপনি ও আপনারা যে তামাম ইসলামের চৌদ্দটা বাজিয়ে আলিশান বাড়িতে বসবাস করে দুনিয়ার সব প্রাচুর্য আর ভোগবিলাসে মত্ত হয়েছেন, এতে কোন ফতোওয়া কাজ করে না?
আজকের মোল্লা-মৌলুভীর বেশিরভাগই তো ওই মুফতী সাহেবের সাগরেদ। তারা সত্যমিথ্যা বলে মুসলমানদের আজ শুধু ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোর তালে থাকে! আর দলবাজি করে মানুষকে বিপদে ফেলার পায়তারা করে!
মুসলমান! আপনারা যতটা সময় বিভিন্নভাবে অযথা নষ্ট করেন, তার কিছুটা সময় কোর'আন হাদিস-কে দেন, জানার চেষ্টা করেন। নয়তো তারা আপনাদের মাথায় বেল রেখে তা ভেঙে আরও বেশি মজা খাবে! স্মরণ রাখবেন, ইসলামে দাখিল হতে হলে এবং আল্লাহ-কে পেতে চাইলে অবশ্যই পড়তে হবে, জানতে হবে; জ্ঞানার্জনের কোন বিকল্প নেই। জ্ঞানার্জন ইসলামে ফরজে আইন। প্রতিটি মুসলমানের জন্য যা ফরজ।
করোনা বিপর্যয়ে যেসব মোল্লারা দিন তারিখ নির্দিষ্ট করে বলছেন, করোনা চলে যাবে; আল্লাহর দোহাই আপনারা আর ইসলামকে উপহাসকারীদের খোরাক বানাবেন না। বাস্তবতা দেখে কথা বলতে চেষ্টা করেন। আপনারা কেমন দ্বীনধার তা আপনাদের কার্যকলাপেই সুস্পষ্ট। অতএব আপনাদের কথা আল্লাহ শুনবেন না। আর আপনারা, যারা তাদের সাগরেদ সেজে বলছেন, 'তারকা উঠলেই করোনা চলে যাবে'; দোহাই আপনাদের, অফ যান!
বরং নিজের ভুল স্বীকার করে বেশি বেশি তওবা ইস্তিগফার করেন; আল্লহর দিকে ফিরে আসতে চেষ্টা করেন। নিশ্চয় মহান রাব্বুল আ'লামীন মাফ করে দিবেন।।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৩ মে, ২০২০.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন