বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রঃ) প্রায় পাঁচশ বছর পূর্বে অন্তর দৃষ্টির মাধ্যমে মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র আগমন সংবাদ অবগত হয়ে স্বীয় বরকতময় জুব্বাহ মোবারক তাঁর পুত্র তাজউদ্দিন আবদুল রাজ্জাকের কাছে রেখে বলেছিলেন, "মুজাদ্দেদ আলফেসানীর আবির্ভাব হলে এই জুব্বাহ তাঁকে পৌঁছে দিও।" যথাসময়ে এই মোবারকময় জুব্বাহ মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র হস্তগত হয়েছিল।
বস্তুতঃ মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) ছিলেন একাধারে একজন মুজতাহিদ, ফকিহ এবং এলমে শরিয়ত ও এলমে মা'রেফতের বিশাল এক মহীরূহ। তাঁর বিশাল জ্ঞান ও ঈমানী দাপটের কাছে মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট, ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক, পৃথিবীর ইতিহাসে মহান শাসকদের অন্যতম, মহামতি আকবর নামে পরিচিত, জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর-এর অহংকারও ধুলায় মিশে গিয়েছিল; সম্রাট আকবরের পুত্র দিল্লীর নেশাগ্রস্ত সম্রাট জাহাঙ্গীরের কপালে তওবাহ নসীয়ত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে সম্রাট শাহাজাহান ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো ঈমানদার সম্রাট-এর আবির্ভাব ঘটেছিল।
আমাদের এই পাকভারত উপমহাদেশে আজ মুসলমানদের যে আধিক্য, শিক্ষা-দীক্ষা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সব কিছুতেই মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-এর অবদান অনস্বীকার্য; বরং সবার শীর্ষে। জাগতিক, আধ্যাত্মিক, শরীয়ত, মারফত তথা ইসলামের সকল শিক্ষার পরতে পরতে তাঁর অবদানের কথা অনস্বীকার্য ও অদ্বিতীয়। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র আজীবন সাধনার ফলেই মধ্যপ্রাচ্য, আরব জাহান, আফ্রিকা, সুদূর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে মুসলিম ঐতিহ্য এতোটা দেদীপ্যমান হতে পেরেছে।
ইসলামী আদর্শের উপর অটল ও অবিচল থাকতে গিয়ে যুগে যুগে ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছেন অনেক ইমাম, মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ, মুজাহিদ, দ্বীনের দাঈসহ অসংখ্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব; যারা জালিমের জুলুম ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র সত্য ও ন্যায়ের জন্য দ্বীনের পথে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার প্রত্যাশায় হাসিমুখে সকল অপবাদ, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করেছেন।
আহমদ সরহিন্দ মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) ১৫৬৩ খৃস্টাব্দে জন্ম গ্রহন করেন। সেই সময় সম্রাট আকবর ছিলেন দিল্লীর সিংহাসনে আসীন। আকবর প্রথম জীবনে ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি 'দীন-ই- ইলাহী' নামক এক নতুন ধর্মনীতি চালু করেন। প্রকৃতপক্ষে আকবরের ধর্মনীতি বিভিন্ন ভ্রান্তনীতি প্রভাবিত ছিল। প্রথমতঃ ভ্রান্ত সুফীবাদ ও মিথ্যা শিয়া মতবাদ তাঁর উপর প্রভাব ফেলে; দ্বিতীয়তঃ সমকালীন হিন্দু ধর্মযাজকদের ধর্ম সংস্কার আন্দোলন তাঁর উপর প্রভাব ফেলে; তৃতীয়তঃ শেখ মোবারক ও তাঁর পুত্রদ্বয় আবুল ফজল ও ফৈজী-র প্রভাব পড়ে।
১৫৭৫ সালে ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক বলে পরিচিত মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর ধর্ম নিয়ে আলোচনার জন্য ফতেহপুরে একটি ইবাদতখানা স্থাপন করেন। প্রথম পর্যায়ে শুধু মুসলিম আলেমরাই সেখানে আমন্ত্রিত হতেন। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে হিন্দু, বৈদ্ধ, জৈন, খৃস্টানসহ সকল ধর্মাবলম্বীরাই সেখানে আমন্ত্রিত হতো। তাঁরা আলাপ আলোচনা করে ১৫৭৯ সালে অভ্রান্ত মতবাদ বলে একটি নতুন মতবাদ চালু করেন। তারই ফলে ১৫৮১ সালে 'দীন-ই-ইলাহী' নামক এক নতুন ধর্মমত প্রচার করেন।
আকবর মূলতঃ রাজনৈতিক কারণে উক্ত ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন; বিভিন্ন ধর্মের লোকজনককে একই ধর্মে এনে ভারতবর্ষে তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি 'দীন-ই-ইলাহী'কে জাতীয় ধর্মের রূপ দিতে প্রয়াস চালান। উক্ত ধর্ম প্রচার শুরু করার পরই আকবর ইসলাম বিরোধী হয়ে উঠেন। তখন তিনি মনে করতেন যে, ইসলাম বেদুঈনদের ধর্ম এবং তা সভ্য সমাজের উপযোগী নয়। ইসলামী আক্বীদা তথা রিসালাত, আখেরাত, হাশর, ওহী প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিদ্রুপ মন্তব্য করতেন। কুর'আন যে আল্লাহর কালাম এই বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতেন এবং নবীর মিরাজকে অসম্ভব গণ্য করতেন। এমনকি আহমদ ও মুহাম্মদ নাম নিয়েও কটুক্তি করতেন তিনি।
স্বার্থবাদী কিছু আলেমের সহযোগিতা নিয়ে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের সংমিশ্রনে সম্রাট আকবর 'দ্বীন-ই-ইলাহী' নামক এক নতুন ধর্মের সুচনা করেন এবং 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আকবর খলীফাতুল্লাহ'-এই নতুন ধর্মের কালিমা হিসাবে ঘোষিত করেন। 'আসসালামুআলাইকুম ওযারাহমাতুল্লাহ'-র পরিবর্তে ’আল্লাহু আকবর' বলে সালাম দেয়ার প্রচলন করেন। সালামের জবাব দানকারীকে তখন বলতে হতো ’জাল্লা জালালুহু’। আকবরকে সেজদা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ইসলামী কৃষ্টি -কালচার ও আইন কানুনের প্রতি ঘৃণা ছড়াতেন তিনি। দেশের মধ্যে খ্রিষ্ট ধর্মানুসারে ঘন্টা বাজানো চালু করা হয় এবং হিন্দু ধর্মের অনুসরণে প্রতিকৃতি পুজা শুরু হয়। মুসলমানদের জন্য গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয় এবং মুসলমানদেরকেও সুর্যের উপাসনা, কপালে তিলক লাগানো, কোমর ও কাঁধে পৈত্যা বাঁধতে নির্দেশ দেয়া হয়।
সুদ, মদ ও জুয়াকে হালাল ঘোষণা করা হয় এবং দাঁড়ি ছেঁটে ফেলার ফ্যাশন শুরু হয়, রাজ দরবারে মদ পান করার রেওয়াজ চালু হয়; তখন আলেমদেরকেও রাজ দরবারে মদ পান করতে হতো। ইসলামের অনুমোদিত একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ হয়। ইসলামের নির্দেশের বিরোধীতা করে পুরুষদের জন্য রেশমের ব্যবহার বৈধ করা হয়। মুসলমানেরা শুকর খায় না, কিন্তু আকবর উক্ত শুকরকে অতি পবিত্র প্রাণী হিসাবে ঘোষণা করেন এবং সকালে ঘুম থেকে উঠার পর শুকর দর্শনকেই কল্যাণকর বলে ঘোষণা দেন। মুসলমানদের মৃতদেহ কবরে দেয়ার পরিবর্তে আগুণে পুড়ে ফেলা বা পানিতে ভাসিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কোন মুসলমান তার মৃত আত্মীয়কে কবরস্থ করতে চাইলে উক্ত মাইয়্যাতের পা কিবলার দিকে দিয়ে কবর দিতে বলা হতো। অথচ মুসলমানদেরকে কিবলামুখী করেই কবর দেয়ার নির্দেশ রয়েছে। আরবী ভাষা শিক্ষা ও ফিক্হ চর্চাসহ দ্বীনি ইলম চর্চার পরিবর্তে দর্শনসহ আধুনিক জ্ঞান চর্চার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়।
শত চেষ্টা করেও সম্রাট আকবর তার নতুন ধর্ম প্রচারে সফল হতে পারেননি। তাঁর জীবদ্দশায় মাত্র আঠারজন উক্ত ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং তাঁর মৃত্যুর পর তারা পুনরায় নিজ ধর্মে ফিরে গিয়েছিল। অবশ্য এই ক্ষেত্রে আহমদ সরহিন্দ মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র ভূীমকাই ছিল মুখ্য। তিনি আকবরের 'দ্বীন-ই-ইলাহী'কে দ্বীন থেকে বিচ্যুত বলে অভিহিত করেন এবং তা প্রত্যাখ্যান করেন।
একবার মুগল সম্রাট আকবর এক বিশাল উৎসবের আয়োজন করেন, যেখানে দুটি দরবার নির্মিত হয়; একটির নাম - 'আকবরী দরবার' এবং অপরটির নাম রাখা হয় - 'মুহাম্মদী দরবার'। 'আকবরী দরবার' প্রস্তত করা হলো বহু অর্থকরী খরচ করে; সেখানে করা হলো চোখ ঝলসানো আলোকসজ্জা, সুসজ্জিত মনোরম মঞ্চ, নিমন্ত্রিত অতিথিদের উপবেশনের জন্য প্রস্তত করা হলো জৌলুসময় গালিচা। পুষ্প সৌরভ ও আতরের সুঘ্রাণে 'আকবরী দরবার' পরিণত হলো ছোটখাটো এক শাদ্দাত-এর বেহেশত-এ; শাহী খাবারেরও ব্যবস্থা করা হলো।
অপরদিকে 'মোহাম্মদী দরবার'-এর অবস্থা ছিল বড়ই করুণ; ছিন্ন তাবু, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ফরাস দিয়ে নির্মিত করা হলো সেই দরবার, খাবারের ব্যবস্থা করা হলো খুবই নিকৃষ্ট মানের! মোটেও কোন আলোকসজ্জার ব্যবস্থা ছিল না সেখানে। নিতান্ত মামুলী সাধারণভাবে নির্মিত এই দরবারটিকে আকবরী দরবারের নিকট খুবই জীর্ণ-শীর্ণ ও কুড়েঘরের মতো মনে হতে লাগলো।
এইরূপ করার মূলে সম্রাট আকবরের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, মানুষ দেখুক ও জানুক ইসলাম শেষ, ইসলামের কার্যকারিতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে! জীর্ণ-শীর্ণ এই ধর্ম বর্তমান যুগে অচল! 'দ্বীন-ই-এলাহী' একটি শান শওকতময় ও যুগোপযোগী ধর্ম। এখন আর কারো এ বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়, উচিতও নয়! মনে-প্রাণে সবারই নতুন ধর্মে দাখিল হওয়া উচিত।
উৎসবের দিন নির্দিষ্ট সময়ে বাদশাহ আকবর তার পারিষদবর্গ, আমির ওমরাহ ও বিশিষ্ট অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে মহাসমারোহে তাবুতে প্রবেশ করলেন; লোভী দুনিয়াদার লোকেরাও তাকে অনুসরণ করল। আনন্দে উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠলো 'আকবরী দরবার'।
এমন সময় কেমন করে যেন মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) তাঁর মুরিদানসহ সেখানে উপস্থিত হলেন, সব কিছু দেখেশুনে বুঝতে আর তাঁর কিছু বাকি রইল না; কী উদ্দেশ্যে এই উৎসবের আয়োজন এবং কেনই-বা এই দুই দরবারের সাজ-সজ্জার মধ্যে এমন আকাশ-পাতাল ব্যবধান! মুসলমানদের অপদস্থ ও কোনঠাসা করা ছাড়া এইসব অর্থহীন কার্যকলাপের আর যে কোনই উদ্দেশ্য নেই তা তিনি ঠিকই বুঝতে পারলেন।
মান-সম্মান-ইজ্জত নিজের অর্জিত কোন সম্পদ নয়; এ'সব আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামত। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) তাঁর মুরিদান ও কিছু দরিদ্র মুসলমানসহ 'মুহাম্মদী দরবার'-এ প্রবেশ করলেন। আহারের সময় হতেই মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) তাঁর একজন মুরিদের হাতে একটি লাঠি দিয়ে বললেন, "যাও এই লাঠি দিয়ে তুমি 'মুহাম্মদী দরবার'-এর চতুর্দিকে একটি বৃত্তাকার দাগ কেটে আসো।"
কথা মতো মুরিদ লাঠি দিয়ে দরবারের চর্তুদিকে বৃত্তাকার একটি দাগ কেটে ফিরে এলেন। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) হাতে এক মুষ্টি ধূলি নিয়ে তা তুলে দিলেন সেই মুরিদের হাতেই এবং বললেন, "এইবার বাহিরে গিয়ে এই ধূলি আকবরী দরবারের দিকে ছুঁড়ে মারো।"
মুরিদ আকবরী দরবারের দিকে ধূলি ছুঁড়ে মারার মুহূর্তের মধ্যে এক প্রলয়কান্ড ঘটে গেল। ভয়ঙ্কর তুফান শুরু হলো, আকবরী দরবার ঘিরে ফেললো; দরবারে তখন মহা ধুমধাম চলছিল। হঠাৎ তুফান দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। কী করবে বুঝে উঠার আগেই সমস্ত তাবু উড়ে গেল। আসবাবপত্র, সাজ-সজ্জা, খাদ্যসামগ্রী সব কিছুই তছনছ হয়ে গেল। তুফানে তাবুর খুটিগুলো উপড়ে উঠে গেল এবং সেগুলো অথিতিদের আঘাত করতে শুরু করল। একটি খুটি উপড়ে গিয়ে সম্রাট আকবর-এর মস্তকে পর পর সাতটি আঘাত করল। পাশেই মুহাম্মদী দরবার, আল্লাহপাকের অপার মহিমায় সেখানে তুফান এতটুকু স্পর্শও করল না। দরবারের সবাই মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র এই কারামত দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এবং উপস্থিত সবাই মিলে আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন।
আঘাত খুবই মারাত্মক ছিল, অনেক চিকিৎসা করা হলো, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। মস্তকের সেই আঘাতেই সম্রাট আকবর শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন এবং শয্যা হতে আর উঠতেই পারলেন না; কয়দিন পর সম্রাট আকবর মৃত্যুবরণ করলেন। এর সাথেই সমাপ্ত হলো সম্রাট আকবর-এর সুদীর্ঘ ৫০ বৎসরের রাজত্ব। দিল্লীর মসনদে সমাসীন হলেন তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর। সম্রাট আকবর-এর জীবদ্দশায় দিল্লীর সাম্রাজ্যে 'দ্বীন-ই-এলাহী'র ভ্রান্ত ধর্মীয় মতবাদের যে প্রভাব পড়েছিল সম্রাট জাহাঙ্গীর তা হতে মুক্ত হতে পারেননি।
বিশ্বনবী হুজুরপাক হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহম্মদ মুস্তবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তিরোধানের পর হাজার বছর পর দেখা গেল দ্বীন ইসলাম এবং মুসলমানদের মধ্যে শিরক, কুফর ও বিদ'আত ঢুকে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। মুগল সম্রাট আকবরের দরবারে মোল্লা মোবারক নাগোরী তদীয় পুত্রদ্বয় যথাক্রমে আবুল ফজল ও ফৈজী ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ এবং সম্রাটের মনোরঞ্জনের মানসে, পার্থিব ধনসম্পদ, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও সম্মানের লোভে নিজেদের ইমানকে জলাঞ্জলী দিয়ে কোরআন হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা করে 'দ্বীন-ই-ইলাহী' নামে একটি বিতর্কিত ধর্মমতের প্রবর্তন করেছিল।
দুনিয়াদার আলেম এবং চাটুকার অমাত্যদের হীন মানসিকতায় প্ররোচিত হয়ে সম্রাট আকবর শাহী ফরমান জারী করে নব ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের জন্যে ধর্মভীরু প্রজাদের বাধ্য করেন। সম্রাটের আনুগত্যশীল এই বানোয়াট ধর্মের বিরুদ্ধে ঈমানী দায়িত্ব নিয়ে মুজাদ্দেস আলফেসানী (রঃ) প্রথম কলম হাতে তুলে নেন। 'দ্বীন-ই-ইলাহী'-র অসারতা ব্যাখ্যা করে সম্রাটের দরবারে আমীর ওমরাহ ও তৎকালীন আলেমে দ্বীন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে তিনি এমনসব যুক্তিপূর্ণ চিঠিপত্র লেখা শুরু করেন যে, তাঁর ক্ষুরধার যুক্তির সামনে দ্বীন-ই-ইলাহী কোন সারবত্তাই খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে সম্রাট আকবর 'দ্বীন-ই-ইলাহী'কে ঐচ্ছিক ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন।
আকবরের মৃত্যুর পর সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। জীবনের প্রথমাবস্থায় তার চরিত্র, চেহারায়, পোশাক-পরিচ্ছেদ পুরোপুরি ইসলাম বিরোধী ছিল। তার শাসনামলেই একাদশ হিজরী শতকের মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-কে কারাগারে বন্দী করা হয়। আশফজাহ নামক এক ব্যক্তি সম্রাটকে পরামর্শ দিয়েছিল, বাদশাহী কর্মচারী, উজীর-নাজীর যেভাবে মুজাদ্দেদ সাহেবের শিষ্য হতে শুরু করেছে তাতে একদিন রাজ্যে বিপ্লব আসতে পারে, তাই তাঁর দিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। এরপরই মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-কে রাজ দরবারে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি জানতেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে প্রত্যেককে সেজদা বা প্রণিপাত এবং সম্মুখে নত হয়ে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে কুর্নিশ করতে হয়।
মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) ঘৃণাভরে এ'সব কূপ্রথাকে অবজ্ঞা করে মাথা উচুঁ করেই গিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর-এর সামনে দাড়াঁলেন। জাহাঙ্গীর জানতে চাইলেন ,তিনি কেন দরবারের আইন অনুসারে সেজদা বা কুর্নিশ করলেন না? অন্ততঃ আসসালামু আলাইকুম তো বলতে পারতেন!
উত্তরে মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) বলেন, "আমি জাহাঙ্গীরের দরবানের ভৃত্য নই, আমি মহান আল্লাহপাক-এর দরবারের ভৃত্য। আর তোমাকে সালাম দেই নাই এই জন্য যে তুমি অহঙ্কারী, হয়তো সালামের উত্তর দিবে না। তখন আমার সালাম দেওয়ার অর্থ হবে হুজুরপক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি সুন্নতকে পদদলিত করা।"
সম্রাট জাহাঙ্গীর রেগে গিয়ে মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-কে বন্দী করে গোয়ালিয়র দুর্গের কারাগারে পাঠান। এ সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে লোকজন সম্রাট জাহাঙ্গীরের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র হাজার হাজার অনুসারি রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। অবশেষে মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র একনিষ্ঠ ভক্ত কাবুলের শাসনকর্তা মোহাব্বত খানের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী অত্যন্ত কৌশলে সম্রাট জাহাঙ্গীর-কে বন্দি করে ফেলেন। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) মুহব্বত খানকে জাহাঙ্গীরের সাথে ভাল ব্যবহার করতে বললেন এবং কারাগার থেকে মুক্ত করে দিতে আদেশ দিলেন; মুহব্বত খানও তাই করলেন।
জেলে থেকেই তিনি এসব করলেন এবং ভক্তদের উদ্দেশ্যে তিনি লিখলেন - "যদি সম্রাট আমাকে জেলখানায় প্রেরণ না করতেন তাহলে এক সহস্র কয়েদী কিভাবে দ্বীন ইসলামের ছায়াতলে আগমন করতো এবং আমার উপর এই বিপদ আপতিত হওয়া ব্যতীত আমার আধ্যাত্মিক উন্নতির অন্য কোন উপায় ছিল না।"
ইতিহাস থেকে জানা যায় মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট আকবর প্রথম জীবনে অত্যন্ত ধর্মভীরু ছিলেন। এবাদত বন্দেগিতে যথেষ্ট সময় কাটাতেন, এমনকি ঘরে বাইরে সকল স্থানেই তিনি জামাতে নামাজ আদায় করতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে দুনিয়াদার বদ আলেমদের প্ররোচনায় তিনি নতুন ধর্মমতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তাঁর মৃত্যুর পর নূরজাহানের প্ররোচনায় তাঁর পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-কে গোয়ালিয়র দুর্গে কারাবন্দী করেছিলেন।
মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট, সম্রাট আকবর ও মুঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট, সম্রাট জাহাঙ্গীরের মনগড়া দ্বীন-ই-এলাহীর বেদাতী, শিরকী ও কুফরী মতবাদ নস্যাৎ করে ইসলামকে পুনর্জাগরণ করেন মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)। বিশাল মোঘল সাম্রাজ্যের শতকরা পচাঁনব্বই ভাগই তখন ছিল হিন্দু; তারা সবাই ছিল তখন সম্রাটের পক্ষের লোক।
এ ছাড়া দুনিয়াদার আলেম, ভন্ড সুফী ও শিয়া প্রভৃতি গুষ্ঠিও সম্রাটের হাতকে শক্তিশালী করেছিল। জৈন, পারসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকদেরও ছিল সম্রাটের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন। সুতরাং সম্রাট নির্বিঘ্নে ইসলাম বিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। সমগ্র হিন্দুস্থানে ইসলামের এই ঘোর দুর্দিনে আহমেদ ফারুকী শেরহিন্দি মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) তাঁর মুজাদ্দেদ সুলভ প্রজ্ঞা ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সংস্কারের কার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বেদাতী ও কুফরীর যাঁতাকলে পিষ্ট ইসলামের ভয়াবহ দুরবস্থা দেখে তাঁর রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠেছিল।
মুঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট, সম্রাট জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-কে মুক্তির আদেশ প্রদান করলেন এবং তাঁকে শাহী দরবারে আমন্ত্রণ জানালেন। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) মুক্ত হলেন বটে, কিন্তু বাদশাহর সাথে সাক্ষাত করতে গেলেন না; বরং তিনি সাতটি শর্ত প্রদান করলেন এবং বললেন, শর্তগুলি মেনে নিলে তিনি বাদশাহর সাথে সাক্ষাৎ করবেন।
শর্তগুলো হলো—
১) তমিজি সেজদার প্রচলন দরবার হতে উঠিয়ে দিতে হবে।
২) ভগ্ন ও বিরান মসজিদগুলো আবাদ করতে হবে।
৩) গরু জবেহ-র উপর যে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে, তাহা রহিত করতে হবে।
৪) ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য বিভিন্ন স্থানে কাজী, মুফতি নিয়োগ করতে হবে।
৫) জিজিয়া কর পূনরায় প্রবর্তন করতে হবে।
৬) সকলপ্রকার বেদাতী কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
এবং
৭) সকল রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর নির্দ্বিধায় সমস্ত শর্ত মেনে নিলেন এবঃ শর্তগুলো বাস্তবায়িত করার জন্য শাহী ফরমান জারী করলেন; তমিজি সেজদা বন্ধ হলো, গরু জবেহ-এর উপর নিষেধাজ্ঞা আর রইল না, জিজিয়া কর পূন:প্রবর্তিত হলো, সকল প্রকার বেদাতী কার্যকলাপ কঠোর হস্তে দমন করার ব্যবস্থা করা হলো, শরিয়তভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্থানে স্থানে কাজী নিয়োগ করা হলো, শহর ও গ্রামে মসজিদ-মাদ্রাসা স্থাপনের ব্যবস্থা করা হলো।
সম্রাট জাহাঙ্গির নিজের দরবারের সম্মুখেই একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন। হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজধানীতে আসলেন। মুগল সম্রাট মহা সমাদরে ও সসম্মানে তাঁকে দরবারে নিয়ে গেলেন। সম্রাট তাঁর নিকট নিজের অপরাধ স্বীকার করে মাফ চাইলেন এবং মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র পবিত্র হাতের উপর হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করলেন। পরবর্তীতে এই পরিবার থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি হলেন সম্রাট শাহাজাহান ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো ঈমানদার শাসক।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২ মার্চ, ২০১৮.
ঠিক তাই।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ!
উত্তরমুছুন