বর্তমান দুনিয়া করোনাভাইরাস আতঙ্কে মুহ্যমান। ভাইরাসকে আমরা চিনি; তারা হলো এক প্রকার অতিক্ষুদ্র জৈব কণা বা অনুজীব। যারা জীবিত কোষের ভিতরেই বংশবৃদ্ধি করে থাকে। কিন্তু করোনা নামের এই ভাইরাস মুহ্যমান এক আতঙ্কের নাম। সারা বিশ্ব আজ এ নামে শঙ্কিত। এ নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। কেউ বলছেন এটা মানুষের তৈরি পারমাণবিক অস্র, আবার কেউবা বলছেন প্রাকৃতিক দূর্যোগ, আবার কেউবা বলছেন আল্লাহর গজব। কিন্তু, কেউই এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছে না এটা আসলে কি? তবে সে ঠিকই একাধারে মানুষ মেরে সাফ করে যাচ্ছে!
যুগে যুগে পৃথিবীতে বেশ কিছু অনুজীব আবিষ্কৃত হয়েছে, যার সবগুলোই ভাইরাস হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। যেগুলো মানুষকে প্রচণ্ড রকমের ক্ষতি করে গেছে যাচ্ছে। এসব ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মহামারী দেখা দেয় দিয়েছিল। এসব প্রাণঘাতী ভাইরাসের মধ্যে রয়েছে জিকা ভাইরাস, ইবোলা, হলুদ জ্বর, কুষ্ঠরোগ, কালাজ্বর, বসন্ত, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া, প্লেগ, যক্ষ্মা, টাইফয়েড, হাম ইত্যাদি ইত্যাদি; কোভিড-১৯-ও তেমনই একটি ভাইরাস। যে ভাইরাসটি বর্তমান দুনিয়ায় ত্রাস সৃষ্টিকারী মহামারি।
জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস অ্যাঢানম গেব্রেইসাস এ রোগটির নাম দিয়েছেন কোভিড-১৯; যা 'করোনাভাইরাস ডিজিজ ২০১৯'-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এ ভাইরাসটি এখন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। গত প্রায় পাঁচ মাসে বিশ লাখেরও বেশি মানুষ এতে নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত হয়েছে, আর মারা গেছে এক লাখ ২৭ হাজারেরও বেশি। কিন্তু এর বাইরেও একটা হিসাব আছে এবং সেই হিসাবটা বেশ বড়!
কোন কোন গবেষণায় দেখা গেছে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরও সামান্য কিছু উপসর্গ দেখা দেয় বা রোগীর শরীরে কোন লক্ষণই দেখা যায় না- এরকম মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ। করোনাভাইরাস সংক্রমণে সমগ্র বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর; গত সন্ধ্যায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
করোনাভাইরাস মহামারিতে রূপ নিয়ে বিশ্ব মানবতাকে বিপন্ন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ভাইরাসটি এতো ভয়ানক যে, ক্ষণে ক্ষণে সে তার রূপ পাল্টাচ্ছে! এ'টি আসলে কি? ইসলামের দৃষ্টিতে— মানুষ যখন আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হয় তখন তাদের সরল সঠিক পথের সন্ধান দিতে এ ধরনের মহামারী দেখা দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জহারাল ফাসাদু ফিল বাররি ওয়াল বাহরি বিমা কাসাবাত আইদিন্নাসি লিইউযীকাহুম বা-দাল্লাযী আমিলুলা আল্লাহুম ইয়ারজি'ঊন।’ অর্থাৎ—‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে স্থলে ও জলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে; আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে। —(সূরা রূম : ৪১)।
বিগত দশক সারা বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই? জনগণ সব মিথ্যুক-ভণ্ড-ব্যভিচারী, শাসকরা সব দাম্ভিক-স্বৈরাচার-অত্যাচারী। সারা দুনিয়া আজ আধুনিকতার নামে অশ্লীলতা নগ্নতার জোয়ারে ভাসছে! সারে চৌদ্দশ বছর আগে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যখন কোনো সম্প্রদায়ের মাঝে অশ্লীলতার প্রসার ঘটে তখন তাদের মাঝে মহামারি এবং এমন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যার নমুনা তারা পূর্বপুরুষদের মাঝে দেখেনি। —(ইবনে মাজাহ: ৪০১৯)। পৃথিবীর এমন একটি দেশ এখন কেউ কি খুঁজে পাবেন, যেখানে অশ্লীলতার বিস্তার ঘটেনি?
আমরা তো মুসলমান? নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, হজ্জ করি, যাকাত দেই, তবে কেন করোনা আসবে? গভীর ভাবে আত্মবিশ্লেষণ করে বলেন দেখি আমরা মোটেও মুসলমানের কাতারে পড়ি কি না? না না আমরা তো হারাম-হালাল বেছে চলি, মদ খাই না। আমরা যা ভক্ষণ করছি, তা কি সম্পূর্ণ হালাল? জেনেশুনে তো হারাম খাই না। ডাইরেক্ট ইনডাইরেক্ট সুদ খাচ্ছি। সুদ তো মদের চেয়েও জঘন্য। নামাজও পড়ি, আবার সুদও খাই! ঘুষও খাই অপাটে, আবার বছর বছর হজ্জও করি! একটু বয়স হতেই হেঁটে মসজিদে গিয়ে চেয়ারম্যান সাজি!
নামের আগে বড় বড় টাইটেল লাগিয়ে ওয়াজ করছি, আর হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলছি 'ইলিটারেট'! যার কল্যাণে মিষ্টি খাই, তাঁকেই চিনলাম না! আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস করলেন কে? কেন?? পড়ি সবই, কিন্তু বুঝি না কিছুই! আবার ওয়াজের মঞ্চে বসে বড় বড় বয়ান দেই; এক বান্ডিল টাকার জন্য। লোকজনের হেদায়েতের জন্য বলেন তো দেখি কোন কাজটা করছি আমরা?
আবার আরেকজন মসজিদে ইমাম সাজি। মদখোর ঘুষখোরের তাবেদারী করি উঠতে বসতে! চাকুরির ভয়? ফজরের পর জপ করি— ইয়া রাজ্জাকু, ইয়া রাজ্জাকু; রিজিকের জন্য ধন্যা দেই সভাপতি/সেক্রেটারির দরবারে! মদখোর সুদখোর ঘুষখোরের টাকায় মসজিদ মাদ্রাসা বানাচ্ছি দেদারসে! কত বড় বেইমান কত বড় নাফরমান আমরা একবার ভেবে দেখেছেন কি?
আমরা সাধারণ মুসলমান, আমরা এমনিতেই পাড় পেয়ে যাবো! রাখেন মিঞা, রাখেন আপনার আঁতলামি! বাবা-মা আকিকা দিয়ে মুসলিম নাম রাখলেই মুসলমান হওয়া যায় না। মুসলমান হতে হলে আত্মসমর্পণ করতে হয় আল্লাহ-র কাছে। নামাজ কালামের বালাই নেই, আবার নিজেকে মুসলমান দাবী করছি! ইসলামের কোন কাজটা সঠিকভাবে করছি আমরা?
মোল্লা-মুন্সি জ্ঞানী-অজ্ঞানী সাধারণ-অসাধারণ, কতজন বুকে হাত রেখে আমরা, বর্তমান দুনিয়ার মুসলমানরা কে বলতে পারবো যে আমি সঠিক? আমরা সবাই অন্যের ভুল ঠিকই ধরি, কিন্তু নিজের ভুল মোটেও অন্বেষণ করি না। একান্ত নিবৃতে একবার চিন্তা করেন, নিশ্চয় বুঝে যাবেন আল্লাহ কেন এই ভয়াবহ করোনা নামের ভাইরাস পাঠিয়েছেন? এর ব্যাপারে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি— এটা আল্লাহর সৈনিক; আমাদের পাপের প্রতিফল।
হযতর মুসা (আঃ) এর যুগে বনি ইসরাইলে একবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল; কারণ, বৃষ্টি হয় না। জনসাধারণ মুসা (আঃ) এর কাছে গেল, এবং বৃষ্টির জন্য দোওয়া করতে অনুরোধ করলো। সবার অনুরোধে মুসা (আঃ) সত্তর হাজার বা ততোধিক লোক নিয়ে এক মরু প্রান্তরে উপস্থিত হয়ে দোয়া করলেন— "হে প্রভু! আমাদের উপর আপনার রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করুন; আপনার রহমত বিস্তৃত করুন; আপনার দয়া উন্মুক্ত করুন; দুগ্ধপোষ্য শিশুদের, তৃনভোজী পশুদের এবং রুকুকারী বয়োবৃদ্ধদের ওসিলায় আমাদের উপর রহম বর্ষণ করুন, করুণা করুন।"
এ দোয়ার পর আকাশের কঠোরতা, সূর্যের তীব্রতা আরো বেড়ে গেল! হযরত মুসা (আঃ) আবারও আল্লাহ-র দরবারে আর্জি পেশ করলেন— "হে দয়াময় প্রভু! যদি আপনার সুমহান দরবারে আমার মান মর্যাদা এতোই জীর্ন হয়ে থাকে, তবে উম্মি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উসিলায় আমাদের উপর আপনার রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করুন।"
তখন মুসা (আঃ)-এর কাছে ওহি এলো— "হে মুসা! আমার দরবারে তোমার মর্যাদা জীর্ন হয়নি, আমার কাছে তুমি মর্যাদাবান হিসেবেই অবস্থান করছো। তবে তোমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি উপস্থিত আছে, যে চল্লিশ বছর যাবত গোনাহ ও অবাধ্যতা করে আসছে। তুমি উপস্থিত লোকজনের মাঝে ঘোষণা দাও, যাতে সে লোকটি তোমাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে যায়। তার কারণেই তোমাদেরকে আমার রহমতের বারিধারা থেকে বঞ্চিত রেখেছি।"
হযতর মুসা (আঃ) নিবেদন করলেন— "হে করুনাময় প্রভু! আমি একজন দূর্বল বান্দা, আমার আওয়াজও দূর্বল, এই বিশাল সমাগমে কিভাবে আমার আওয়াজ উপস্থিত সবার কাছে পৌছাবে?"
আল্লাহ উত্তর করলেন— "তোমার কাজ আওয়াজ দেয়া, আর আমার কাজ তা পৌঁছে দেয়া।"
আল্লাহর নির্দেশে হযতর মুসা (আঃ) দাঁড়িয়ে এই বলে আওয়াজ তুললেন— "উপস্থিত লোকসকল! এখানে একজন এমন বান্দা আছে, যে দীর্ঘ চল্লিশ বছর যাবৎ মহান স্রষ্টার সংগে যুদ্ধে লিপ্ত! তুমি আমাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে যাও। তোমার কারণে আমরা সবাই রহমতের বৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।"
যার উদ্দেশ্যে এ ঘোষণা সে ভাবলো, যদি আমি এই দল থেকে বেরিয়ে যাই, তাহলে বনি ইসরাইলের সামনে আমি লজ্জিত ও অপমানিত হবো, আর যদি তাদের মাঝে অবস্থান করি তাহলে আমার কারণে সবাই রহমতের বৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হবে। তাই সে তৎক্ষনাৎ তওবা করলো— "হে আমার প্রভু! হে আমার প্রতিপালক! হে দীন-দুনিয়ার মালিক! চল্লিশ বছর ধরে আপনার অবাধ্যতা করে আসছি, আর আপনিও আমাকে অবকাশ দিয়েছেন। আজ আপনার অনুগত হয়ে আপনার কাছে করুণা প্রার্থনা করছি। আমাকে মাফ করুন। আমাকে এতো লোকের মধ্যে অপমানিত করবেন না। হে আমার প্রভু! আমাকে মাফ করে দিন। আমার অনুগত হওয়াকে আপনি কবুল করুন, মন্জুর করুন।"
তার কথা শেষ না হতেই আকাশে এক খন্ড মেঘ ভেসে উঠলো এবং মুসলধারে বৃষ্টি শুরু হলো! হঠাৎ বৃষ্টি বর্ষনের দৃশ্য দেখে হযতর মুসা (আঃ) আরজি করলেন, "হে আল্লাহ! কি কারণে আপনি আমাদের প্রতি এমন সদয় হলেন? আপনার রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করলেন? আপনার ঘোষণামতে আমাদের মধ্য থেকে তো কেউই বের হয়ে যায়নি?"
আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা জানালেন— "যার কারণে তোমাদেরকে বৃষ্টি বর্ষণ থেকে বঞ্চিত রেখেছিলাম, তার কারণেই আজ তোমাদের উপর এই রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করলাম।"
হযতর মুসা (আঃ) অনুরোধ করলেন— "হে আল্লাহ! আপনার একান্ত সেই অনুগত বান্দাকে অন্তত একবার আমাকে দেখার সুযোগ করে দিন।"
আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা উত্তর করলেন— "হে মুসা! দীর্ঘ চল্লিশ বছর সে আমার নাফরমানী করেছে, অবাধ্যতা করেছে, অথচ আমি তাকে কোনদিন অপদস্ত ও অপমানিত করিনি; এখন সে আমার অনুগত ও বাধ্যগত হয়েছে; এখন তাকে আমি অপদস্ত ও অপমানিত করবো, এ কথা ভাবলে কি করে?"
তওবার দরজা সবার জন্যই উন্মুক্ত। খাঁটি তওবা করুন। হারাম-হালাল বেছে চলুন। পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন অধীনস্হ প্রতিবেশির হক প্রতিষ্ঠা করুন। অন্যকে ঠকানো বন্ধ করুন, সবার মঙ্গল কামনা করুন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ুন। রাত জেগে কান্নাকাটি করুন। নিশ্চয় মহান আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন মাফ করে দেবেন এবং বন্ধু করে নেবেন। আর বন্ধুর জন্য তিনি বলেন, ‘জেনে রাখো, আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।' —(সূরা ইউনূস : ৬২)।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১৭ এপ্রিল, ২০২০.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন