রবিবার, ২১ জুন, ২০২০

বাবা এবং আমি:

সেই কবে বাবা আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন অথচ আজকাল তাঁর স্মৃতিগুলো খুব বেশি আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে ততোই যেন তাঁকে বেশি মনে পড়ছে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হয় আমি যেন তাঁরই প্রতিচ্ছবি প্রতিবিম্ব। অনমনে অপলক নিজের দিকে তাকিয়ে বারবার বাবাকে খুঁজে ফিরি। সেই চোখ, সেই কপাল, সেই চুল; সব সেইয়ের মাঝে নির্বোধ নির্লোভ অতি সাধারণ অতি অল্প চাহিদার সেই মানুষটার প্রতিচ্ছবি সর্বক্ষণ মানসপটে ভেসে বেড়ায়, সেই মানুষটাই যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে একান্তে আনমনে চুলে ব্যাক-ব্রাশ করছে।  

কেমন করে কখন কিভাবে যে নিজে বাবার মত অথর্বতার অতলে তলিয়ে গেলাম বুঝতেই পারলাম না, কবে যে সেই একই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে উপনীত হয়ে ধাপেধাপে জীবন সায়াহ্নের দিকে অগ্রসর হলাম, টেরই পেলাম না। আজকাল মাঝেমধ্যেই মনের অজান্তে একান্তে বাবাকে কাছে পাই। তাঁর একটা কথা খুব বেশি কানে বাজে - 'তুই যদি আমাকে দুই কদম হাঁটাছ, মনে রাখিস তোর পোলা তোকে চার কদম হাঁটাবে।' 

আমার বাবা ছিলেন অতি সাধারণ অতি সহজসরল সম্পূর্ণ আত্মভোলা নিঃশব্দ নিঃসঙ্গ প্রকৃতির একজন মানুষ; দুনিয়াতে যার কোন শত্রু ছিল না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কখনো কারো সাথে কোন ধরনের কথা বলতেন না; শুধু হ্যাঁ না-ই ছিল তাঁর মুখের অভিব্যক্তি। মায়ের সাথে প্রয়োজনের চাইতে আরো বেশি কমকথা বলতেন। তদুপরি মাকে দেখতাম এটা-ওটা নিয়ে প্রায়শই অভিযোগ করতে, লেগে থাকতে। আমরাও বেশিরভাগ সময় মা'য়ের পক্ষই নিতাম। এতে বাবার কোন আপত্তি বা কোন ধরনের অভিযোগ ছিল না! চাহিদা তাঁর এতোই কম ছিল, যা বলা বাহুল্য। 

আমি যখন ঢাকা চলে আসি বাড়ি যাবার সময় বাবার জন্য দুটো টোস্ট বিস্কেটের প্যাকেট নিতাম, এতেই তিনি মহা খুশি। ঈদেচাঁন্দে একটা পাঞ্জাবী একটা হাতাওয়ালা গেঞ্জি আর একটা লুঙ্গি পেলে বাবার সে যে কি আনন্দ, যা আজ আর ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না! সেই নতুন পাঞ্জাবী লুঙ্গিটা একদিন পড়েই বাঁজ করে নিজের ট্রাঙ্কে যত্ন করে রেখে দিতেন, পুরোনাটাই আবার পড়তেন। একটা মানুষের যে এত কম চাহিদা থাকতে পারে তা আমার বাবাকে না দেখলে হয়তো কখনো ভাবাতেও পারতাম না। 

মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাঁর কখনো খুব একটা ছিল না; তাই হয়তো সংসারে কোন মতামতই তিনি দিতেন না। সংসারের অতি প্রয়োজনে যদি তাঁর মতামত জানার একান্তই দরকার পড়তো তিনি শুধু বলতেন, 'দেখ, যা ভাল মনে করস তাই কর।' জন্মের পরই তিনি তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন; তিন-চার বছর বয়সে বাবাকেও! হয়তো তাই এমন হয়ে গিয়েছিলেন। নানী ও পরবর্তীতে মামীর কাছে মামা বাড়িতে বড় হন বাবা; কোন ভাইবোন ছিল না। তাই বলেই হয়তো তিনি অতোটা আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন। আমার জন্মও সেই বাড়িতেই। তাই জন্মের পর থেকে বাবার মামা বাড়িতেই আমরা বড় হয়েছি, ওই বাড়িটাকেই আমাদের বাড়ি বলে জানতাম চিনতাম এবং বাবার মামা-মামীকেই দাদা-দাদী জানতাম। সেই পরিবারই ছিল আমাদের পরিবার; যে পরিবারটি ছিল বিশাল৷  

বাবা-মায়ের বড় সন্তান আমি; তাছাড়া আমাদের বিশাল পরিবারেরও বড় (আমার প্রজন্ম)। শুনেছি - বাবা-মায়ের বিয়ের তেরো বছর পর আমার জন্ম! আমি নাকি সবার খুব আদরের এবং অনেক সাধনার ধন ছিলাম। ছোটকালে 'পিঁপড়ে ধরবে বলে আমাকে নাকি মাটিতে রাখত না, আবার মাছির ভয়ে শূন্যেও চড়াত না!' এক কথায় 'সোনার চামচ' মুখে নিয়ে জন্মানো বলতে যা বুঝায় আমার শৈশবটা অনেকটা সেই রকমই ছিল। বুঝ হওয়ার পর বেশ বুঝতে পারতাম পরিবারে আমার কদর কত(!), আমি যেন এক ও অনন্য। সবার অনেক অনেক আদর পেয়ে বড় হয়েছি বলেই হয়তো আজও অনাদর অবহেলা দেখলে অন্তরাত্মা খাঁ খাঁ করে উঠে, নিজকে খুব অসহায় মনে হয়। 

যতটুকো মনে পরে- ছোটকালে প্রতি হাটবার বাবা আমাকে হাটে নিয়ে যেতেন শুধুমাত্র রসগোল্লা খাওয়ানোর জন্যে। কোনদিন যদি হাটে আমার যাওয়া না হতো, সেদিন পুটুলিতে করে তিনি বালুসাইর নিয়ে আসতেন। হাট থেকে ফিরতে ফিরতে বাবার বেশ রাত হয়ে যেতো, ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে পরতাম। সকালে জেগেই সেই বালুসাইর আর মুড়ি নিয়ে মহা আনন্দে মেতে উঠতাম! স্মৃতিমাখা সেই শৈশব আজ আমায় খুব বেশি কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। মিষ্টির প্রতি আমার চিরাচরিত প্রচণ্ড দুর্বলতা। প্রায় প্রতি হাটবারেই বাবা আমাকে তাঁর সাথে হাটে নিয়ে ঘোষের দোকানে বসিয়ে বাজার করতেন। ঘোষকাকু ছোট্ট প্লেটে দুটো রসগোল্লা ও কিছু রস দিতে থাকতেন যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার তৃপ্তি মিটতো। 

আমি যত বড় হতে থাকলাম বাবা ততো নির্জীব নিস্তব্ধ হতে থাকলেন। যদিও এটা পৃথিবীর চিরাচরিত নিয়ম। তদুপরি আমার বাবার ব্যাপারটি ছিল কিছুটা ভিন্ন ও ব্যতিক্রমী। যৌবন থেকে কঠিন গ্যাস্ট্রিক আলসার রোগ নিয়ে এই ধরায় তিনি প্রায় ৭০ বছর জীবনযাপন করে গেছেন। তাই সময়ের আগেই তিনি অনেকটা চুপসে সংসারবৈরী হয়ে পড়েছিলেন। আমি যখন খুব ছোট সেই সময় লাশের খাটে শুইয়ে একদিন বাবাকে ঢাকা থেকে বাড়িতে আনা হয়েছিল। সেই যাত্রা মৃত্যুমুখ থেকে ভাগ্যগুণে বেঁচে উঠলেও জীবনের প্রতি তাঁর কেমন যেন একটা উদাসীন ভাব চলে এসেছিল। 

আমার ছোট ভাই-বোন আরো চারজন। সবার ছোট বোন এবং আমার বয়সের ব্যবধান অনেক। আমার ছাত্রজীবনের সমাপ্তির দিকে ছোটবোনের জন্ম। তাই ছাত্রজীবনেই ভাইবোনদের দায়িত্ব আমার কাঁধে উঠে, নিতে হয়েছিল। স্বাধীনতাপূর্ব ও তৎপরবর্তী সময়ে দেশের সার্বিক পরিবর্তনে এবং সাংসারিক নানান উত্থান-পতনে পরবর্তীতে আমাদের পরিবারে বেশ কিছুটা বিপর্যয় নেমে আসে; আর এতে বাবা আরো বেশি ভেঙে পড়েন এবং একসময় অনেকটা নির্জীব নিস্তব্ধ হয়ে যান। তাই আমার ছোট ভাই-বোনদের কাউকেই তখন তিনি আর সরাসরি মানুষ করার দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। 

বেশ ভূ-সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও এক সময় অভাব অভিযোগ ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী; জমি ছিল কিন্তু চাষাবাদ করার মতো বা দেখাশোনার মতো কোন লোক ছিল না। সেই সময়ে বাবার অনেক পৈত্রিক সম্পত্তিও বেহাত হয়ে গিয়েছিল। তাই বুঝ হওয়ার পর থেকেই আমার কাঁধে অনেক বেশি দায়িত্ব বর্তায় এবং বলতে গেলে এক হাতেই সংসারটা আগলে রাখতে হয়েছিল। গ্যাস্ট্রিক আলসারে আক্রান্ত বাবা শুধু আমাকে যে কোন কাজের মৌন সম্মতি দিয়ে জীবন্মৃতের মত পরে থাকতেন। তাঁর নির্বাক চাহনিই ছিল আমার বড় শক্তি। অনেক বছর কোন খাবার খেয়েই তিনি হজম করতে পারতেন না। কত ডাক্তার কত কবিরাজ কত চিকিৎসা করানো হয়, কিন্তু তিনি আর কোন দিনও পুরোপুরি সুস্থ হলেন না। 

বাবার অসুস্থতার কারণে মা কিছুটা বেশি দায়িত্ব পালন করতেন। তাই সংসারে তাঁর গুরুত্বটাও একটু বেশি মনে হতো; সবকিছু আমরা আমাদের মায়ের কাছেই চাইতাম। এক সময় আমি আবিষ্কার করি, সবাই আব্বাকে কেমন যেন একটু এড়িয়ে চলছি, অনেকটা অবহেলার মত! বাবা মনে হয় সবই বুঝতেন- কিন্তু কিছুই বলতেন না, চুপচাপ শুধু তাকিয়ে থাকতেন আর কি যেন ভাবতেন। সবার সাথে বসে একসাথে তিনি খেতেনও না! কারণ তাঁর খাবারও ছিল ভিন্ন; শুধুমাত্র জাউ (নরম ভাত) খেয়ে জীবনের অনেকগুলো বছর তিনি পার করেছিলেন। অবশ্য পরে একসময় সবই অল্প অল্প খেতেন আর সারাক্ষণ পেট ধরে বসে থাকতেন, রাত হলেই বমি করতেন; সে অনেক কষ্টের এক উপাখ্যান...... 

কেন জানি আব্বা আমার উপরই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতেন। সাধারণত গ্রামে থাকতেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আমি যখন স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করি তখন মাঝেমধ্যে তিনি ঢাকায় আমার বাসায় বা বোনের বাসায় বেড়াতে আসতেন। কয়েকদিন থাকতেন; কোনভাবেই তাঁকে বেশিদিন আটকে রাখা যেতো না। দুই ভাই তখন আব্বার সাথে বাড়িতেই থাকতো। কিন্তু পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার বছর আম্মার সাথে কিছু হতে না হতেই হুটহাট কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপিচুপি ঢাকায় চলে আসতেন, এক নাগাড়ে বেশ কিছুদিন থাকতেনও। 

অসুস্থ শরীরেও প্রতিদিন সকালে বাজারে যাওয়া আব্বার একটা সখের বিষয় ছিল। জীবনের শেষ দিকে আমরা যখন বাড়ি যেতাম কোন ফাঁকে তিনি বাজারে চলে যেতেন তা কেউ বলতেই পারতো না; এটা-ওটা নিয়ে আস্তে আস্তে আবার বাড়ি ফিরতেন। আমরা যতো বাজারই করতাম না কেন, তাঁর যেন বাজারে যাওয়া চাইই চাই। বিশেষ করে গুড়ামাছ তাঁর বাজারের প্রধান ফর্দ ছিল। মাছের প্রতি তাঁর প্রচণ্ড দুর্বলতা ছিল, প্রতিদিন গুড়ামাছের তরকারি তাঁর চাই-ই চাই। আর এ নিয়েই মা বাবার পিছু লেগে থাকতেন। মা বলতেন প্রতি লোকমায় একটা করে মাছের মাথা খাওয়া তাঁর চাই-ই চাই!

ভাবতে খুব আশ্চর্য লাগে, জীবনের অনেকগুলো বছর তিনি যাদের সাথে যে সমাজে অতিবাহিত করে গেছেন মৃত্যুর পর অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সেখানে তাঁর কোন পাওনাদার খুঁজে পাইনি। প্রতিদিন সকালে যে বাজারে না গেলে তাঁর পেটের ভাত হজম হতো না সেই বাজারের একটিমাত্র মুদি দোকানে অত্যন্ত অল্প কয়েক টাকা ছাড়া সাড়া বাজার তন্যতন্য করে খুঁজেও তাঁর আর কোন পাওনাদার পাইনি। সবাই বললো, আব্বা নাকি কখনো বাকিতে কোন কিছুই নিতেন না। 

শেষবার যখন তিনি ঢাকায় আসেন সেইবার বাড়িতে রাগ করে চলে এসেছিলেন! সেই আসাটায় আব্বার আচার আচরণ ছিল কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাকে মসজিদে না যেতে দিয়ে একদিন মাগরিবে তিনি আমার ইমামতি করেছিলেন। সেইবার বেশ বড় একটা রুইমাছ এনেছিলাম; মাছ দেখে বাবার সে কি আনন্দ! যা মনে হলে আজও আমার চোখে পানি এসে যায়। বাবা মাছের মাথা খেতে খুব পছন্দ করতেন, তাই আমাদের সংসারে নিয়ম ছিল যে কোন মাছের মাথা বাবার পাতে দেয়া। আমার স্ত্রী যখন রুইয়ের মাথাটা আব্বার পাতে তুলে দিয়েছিল, স্পষ্ট মনে পড়ছে তখন তিনি শিশুর মত তাকিয়ে বলেছিলেন, 'মা, এতো বড় মাথা আমি খাবো কিভাবে?' আব্বার চোখেমুখে সে কি তৃপ্তির হাসি; যা আজও আমার চোখে ভাসছে। 

রুইয়ের সেই মাথাটাই বাবার জীবনের খাওয়া শেষ মাছের মাথা। আমাদের সংসারে এখন আর কেউ মাছের আস্ত মাথা খাওয়ার নেই। সেইদিন বিকেলেই হটাৎ তিনি বাড়ি যাওয়ার জন্য বায়না ধরেন। কাল পাঠাবো বলতেই রেগেমেগে একাই বাড়ি রওনা দেন এবং সম্পূর্ণ সুস্থভাবে বাড়ি পৌঁছেন। বাড়ি যেয়েই মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। যাওয়ার পরদিনই আবার আমাদের বাড়িতে ডেকে পাঠান। 

আমি যখন বাড়ি পৌঁছি তখন বাবা প্রায় মৃত্যুমুখে। দেখি সবাই তাঁকে ঘিরে বসে কাঁদছে। হটাৎ ওয়াক ওয়াক করে বমি করার কিছুক্ষণ পরই আবার সুস্থ হয়ে উঠে বসলেন। বিকেলে আব্বাসহ আমরা সবাই উঠানে বসে আছি, তিনি এদিক-ওদিক তাকিয়ে হটাৎ বললেন 'চল গ্রাম ঘুড়ে আসি।' তাঁর এই ভিন্নধর্মী চাহনি ও আচরণ আমাকে বিস্মিত করে তোলে। তৎক্ষণাৎ রিক্সা ডেকে বেড়িয়ে পরি। সারা পথ আব্বা আমাকে আঁকড়ে ধরে শুধু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। মাঝপথে এক ফাঁকে হাসপাতালে রিক্সা থামিয়ে ডাক্তারও দেখালাম। 

ডাক্তার আমার বোনজামাইকে শুধু বললেন, যা ইচ্ছা হয় খাইয়ে দিন; সে গিয়ে দোকান থেকে দই মিষ্টি নিয়ে এলো। বাবা হাসপাতালে বসেই তার কিয়দংশ খেলেন, বাড়ি ফিরে আর কিছুই খেলেন না। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। সন্ধার আগেই আমরা বাপ-বেটা বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরেই আব্বা কেমন যেন করতে থাকলেন। সেই ছটফটানির পরিসমাপ্তি ঘটলো শুক্রবার ঠিক সুবেহ-সাদিকের পূর্বক্ষণে। আমার কোলে মাথা রেখে তিনি দুনিয়া ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। 

এক নিমিষে আমার পৃথিবী যেন নিস্তব্ধ নিথর হয়ে গেল। মুহূর্তে আমি কেমন যেন অসহায় হয়ে গেলাম। জায়গা-সম্পত্তি ধন-সম্পদ কিছুই তিনি সাথে করে নিয়ে যাননি, কিন্তু আমার মনে হতে থাকলো- আমার পৃথিবী যেন অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। এখন আর আমি কাউকে আব্বা বলে ডাকতে পারি না, কারো কাছে কোন কিছু আবদার করতে পারি না, কারো কাছে কোন অভিযোগও করতে পারি না, সামান্যতম কিছু চাওয়া-পাওয়ার ইচ্ছাও পোষণ করতে পারি না। সবার যত চাওয়া-পাওয়া সব যেন আমা থেকে! 

আমি আজ বাবার সেই একই অবস্থানে! আজ রন্দ্রে রন্দ্রে উপলব্ধি করতে পারছি প্রত্যেকের জীবনে বাবার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব কতটা। বাবা নির্জীব হলেও তাঁর গুরুত্ব অপরিসীম। শৈশবে একজন মানুষের জীবনে 'বাবা' কতটা মধুর, জীবনের প্রতিটাক্ষণে প্রতিটা পোরোতে বাবা কতটা প্রয়োজনীয় তা বাবা থাকতে আমরা হয়তো কেউ টের পাই না। 'বাবা' একজন মানুষের কাছে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ তা বুঝার মত বোধবুদ্ধি জ্ঞানও আমাদের নেই; হয় তখন, যখন না থাকেন! 

আমার মা আজও বেঁচে আছেন এবং আলহামদুলিল্লাহ, ভাল আছেন; দোয়া করি আমার হায়াত নিয়ে হলেও আল্লাহ তাঁকে যেন আরো অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখেন। কিন্তু, কখনো মা'কে কিছু বলতে পারি না, একটুতেই অনেক বেশি টেনশন করেন। অথচ বাবাকে সব কিছুই নির্দ্বিধায় বলতে পারতাম; অন্তত তিনি শুনতেন তো? তাই বাবাকে আজ খুব বেশি মনে পড়ছে। দাঁত থাকতে আমরা কেউ দাঁতের মর্যাদা দেই না, যখন দাঁত পড়ে যায় তখন সব টের পাই। এই তো জীবন! 

আজকের ছেলেমেয়েরা একটু বড় বেশি স্পর্শকাতর, অনেক বেশি পরিপক্ব মনে করে তারা তাদের নিজেদের। ভাব অনেকটা এমন - বাপ কি বুঝে? কেউ কেউবা আরো এক ধাপ উপরে উঠে বাবাকে ভাবছে অপাংতেয় অস্পৃশ্য। 
হে আজকের তরুণ/তরুণী/ যুবক! 
মনে রেখো, কাল তুমি বৃদ্ধ হবে। এমন ভাবার কোন অবকাশ নেই, কাল তুমি আসছো বাবার কাতারে। তাই কোন অজুহাত ছাড়াই বাবার কথা মেনে নাও, বাবাকে মান্য করতে চেষ্টা করো এবং মেনে নিতে চেষ্টা করো। মনে রাখবে, বাবা যা বুঝে জানে, তুমি তা জানতে ও বুঝতে পারবে আরো অনেক অনেক পরে; এখনো অনেক অনেক দেরি অনেক বাকি বাবাকে বুঝতে। অতএব, সাবধান।। 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
৫ ডিসেম্বর, ২০১৫.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন