"Education Is the backbone of a nation' কে বলেছিলেন তা আমার জানা নেই, তবে তিনি যে সঠিক কথাটিই বলেছিলেন এটা কিন্তু আজকের আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষের দিকে তাকালে মোটেও অনুধাবন করতে পারা যায় না; সহমর্মিতা সহনশীলতা সহঅবস্থান সমব্যথীতার মনোভাব এখন আর অনেকের মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায় না। আগেকার দিনে দেশে এতো এতো শিক্ষিত মানুষজন ছিল না সত্য, কিন্তু কারো মাঝে শ্রদ্ধাভক্তির মোটেও কমতি ছিল বলে কখনও শুনিনি। দিন দিন দেশে শিক্ষিতের হার যতটা বাড়ছে তার সাথে ততোধিক পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তথাকথিত শিক্ষিতের সংখ্যা, চলছে স্বার্থ নিয়ে অযথা হিংসে বিদ্বেষ ও শ্রেষ্ঠত্বের কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি। তাই আমি বলবো, প্রকৃতপক্ষে সুশিক্ষাই একটি জাতির মেরুদন্ড।
এদেশের বহু ধারার শিক্ষাব্যবস্থার জন্য দেখা যায় এক পক্ষ আরেক পক্ষকে সবসময়ই কোন না কোনভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে এবং একে অন্যকে দোষারোপ করতে; এক ধরণের তথাকথিত শিক্ষিতরা তো তাদের নিজ ধারার শিক্ষাব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ইঁদুর দৌঁড়ে নেমে আছে বহু দিন ধরে। দেশ জাতি তো সবার; কাকে ছাড়া কার চলবে? বা কে চলতে পারবে? সবাই মিলেমিশেই দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। এখানে শ্রেষ্ঠত্বের কি আছে? আমাদের বর্তমান সমাজের অবস্থা এতোটা নাজুক কেন? শেষমেশ এদেশের আলেম সমাজকেও দেখছি এই ইঁদুর দৌঁড়ে শরিক হতে। তবে কি সবায়-ই আমরা ভ্রান্ত পথে হাটছি?
একসময় এদেশের বিখ্যাত সব আলেম ওলামার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অত্যন্ত সুদৃঢ় ছিল। সেই সুবাদে কাওমী মাদ্রাসার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। প্রতি বছর দাওরায়ে হাদীস সমাপ্তে 'খতমে বোখারী' অর্থাৎ বোখারী শরীফের খতম উপলক্ষে ছাত্রদের মাথায় পাগড়ি পড়িয়ে দেয়ার অনুষ্ঠানে শরিক হতাম। দেখতাম, সদ্য তরুণ থেকে যুবক হওয়ারা দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করে মাথায় পাগড়ি নিয়ে বের হচ্ছে; কতই না মধুর লাগত সেই দৃশ্য। তাদের সম্পর্কে আমার বেশ উঁচু একটা ধারণা ছিল। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করছি তারাই এখন এদেশের বিভিন্ন ধারার শিক্ষার্থীদের, এমন কি আলিয়ায় পড়া আলেমদেরও অবমূল্যায়ন করছে এবং জামাতে ইসলামীর স্টাইলে তারাও সর্বেসর্বা হতে চাচ্ছে; একমাত্র তারাই ইসলামের ধারক ও বাহক, অসীম ইসলামী জ্ঞানের অধিকারী বলে নিজেদেরকে জাহির করতে চাইছে; এসব মোটেও ভাল কোন ভাব নয়। আমার কাছে ভালো ঠেকছে না।
আমরা প্রায় সবাই এখন সব কিছুতে একে অন্যকে দোষারোপ করে যাই; বড় থেকে ছোট্ট শিশুটি পর্যন্ত। নিজের দোষটা একবারও কেউ ধরতে চাই না বা ধরার চেষ্টাও করি না, কেউ ধরিয়ে দিলেও তা খারাপভাবে নেই। মানুষ হিসেবে ন্যূনতম যেটুকো মমত্ব মনুষ্যত্ব মানবতাবোধ সৌহার্দ, একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার তার বিন্দুবিসর্গও এখন আর আমাদের মাধ্যে অবশিষ্ট নেই, সবটাই আজ আমরা কেন যেন বিসর্জন দিয়েছি বা হারাতে বসেছি। এসব আসবেই-বা কোথ্থেকে (?), পরিবার নাকি স্কুল মাদ্রাসা থেকে? তা নিয়েও আমরা দোষারোপ করে যাচ্ছি একে অন্যের। এটা এখন আমাদের জাতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও এর নানান ধারা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি অনেকেই করেছেন করছেন, আমিও করেছি করছি। কিন্তু কেউই আমরা হয়তো আসল ব্যাপারটা তুলে ধরতে পারছি না, নতুবা কেউই অনুধাবন করতে পারছি না আসল সমস্যাটা কোথায়? সমস্যার গোড়ার গলদ রেখে হয়তো সবাই আমরা আগায়ই পানি ঢেলে যাচ্ছি। যতই এভাবে পানি দেই না কেন আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এসবে কোন কাজই হবে না।
পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় ও উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই? উন্নত দেশে ২/৩ বছর বয়সের শিশুদের বেশির ভাগই ডে কেয়ার হোমে বেড়ে উঠে। তারা যখন ওখানে যেতে শুরু করে তখন থেকেই তাদের শেখানো শুরু হয় নিয়মানুবর্তিতা এবং নিজের কাজ নিজে করা। ঐ বয়সের বাচ্চাদেরই নিজের জামা নিজে পড়া, জুতা পায় দেয়া, জায়গা নোঙড়া হলে তা পরিষ্কার করা শিখানো হয়। সেই ছোট্টটি থেকে জাপানের বাচ্চাদের নিজের নেপকিন নিজে ডাস্টবিনে ফেলানোর অভ্যাস করানো হয়। খেলার ছলে শেখানো হয় সময়-রুটিন- জীবন সম্পর্কিত ব্যাপারগুলো। আস্তে আস্তে শেখানো হয় তাদের কোন কাজের পর কোন কাজ করতে হবে, কোন কাজে কতটুকু সময় ব্যয় করা যাবে এইসব। শিশুকাল থেকেই সেইসব তাদের ট্রেনিং দেয়া হয়।
নিজের খাওয়া নিজেকেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খেতে হবে, সময় জ্ঞান, সময়ের মূল্য, সময় ভাগ করে নেয়া, স্বনির্ভরতা এইসব শিখানো হয় এবং তাদের বুঝানো হয় জীবনে সাফল্য অর্জনে এগুলোর কোনো বিকল্প নেই।
সেই সঙ্গে আরও তাদের শেখানো হয় সমাজে একজন মানুষ হিসেবে বাস করতে হলে কি কি গুণাবলি থাকা দরকার, সবকিছু অন্যের সঙ্গে সমভাবে ভাগ করে নিতে হবে, মিথ্যা কথা বলা যাবে না, ধাক্কাধাক্কি করা যাবে না, মারামারি করা যাবে না, বাজে কথা বলা চলবে না, নিজের রাগ ও মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আরো শেখানো হয় টিমওয়ার্ক, দল বেঁধে সবার কাধে কাধ মিলিয়ে কি করে কাজ করতে হবে তা; যেসবের প্রতিটি জিনিস আজীবন মানুষের কাজে লাগে।
অথচ, আমাদের বাচ্চারা পরিবারের সাথে থেকেই বেড়ে উঠছে, আমরা তাদের কি শেখাচ্ছি?
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ প্রতিবছর 'গ্লোবাল স্টুডেন্টস কম্পিটিটিভনেস রিপোর্ট’ নামের একটি জরিপ প্রকাশ করে থাকে; ওখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষার মান যাচাইয়ে পিআইএসএ (প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট) নামক খুব জনপ্রিয় একটি মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে সুশিক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা সম্পন্ন জাতীয় মান নির্ধারণ করা হয়। গণিত, বিজ্ঞান ও পাঠ অভ্যাস এসবের উপর ভিত্তি করে সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে এই মূল্যায়নটি করা হয়ে থাকে। সেই র্যাঙ্কিং-এ বরাবরই সামনের দিকে অবস্থান করে নেয় ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা না করে শিক্ষার্থীদের মননশীলতা তৈরির মাধ্যমে প্রতিভা বিকাশের বিষয়টি অগ্রাধিকার পায়।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা যতটা চমকপ্রদ ততটাই সহজসরল। ফিনিশ শিশুরা ৭ বছরের আগে স্কুলে যায় না; এমনকি ৬ বছর পর্যন্ত তাদের স্কুলে ভর্তির অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। সেখানকার শিশুদের যে শুধু মোটা মোটা বইয়ের বোঝাই বইতে হয় না তা নয়, ১৬ বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার আগে এই দীর্ঘ ৯ বছর তাদের কোন ধরণের বার্ষিক পরীক্ষাও দিতে হয় না। আরও চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, সব স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ৯:০০ টা থেকে ৯:৪৫ টার মধ্যে এবং সমাপ্ত হয় দুপুর ২:০০ টা থেকে ২:৪৫ টার মধ্যে; এমনকি একই স্কুলে একেকদিন একেক সময়ে ক্লাস শুরু হয় অর্থাৎ পাঠ কার্যক্রম শুরু করার বাঁধাধরা কোন নিয়মনীতি নেই ।
ফিনিশরা মনে করে সকাল ৯টার আগে কোন ভাবেই স্কুলে ক্লাস শুরু করা উচিত নয়, এতে বাচ্চাদের ঘুমের ব্যাঘাত হবে। স্কুলে সচরাচর দিনে তিন থেকে চারটি ক্লাস হয়; একেকটি ক্লাসের দৈর্ঘ্য হয় ৭৫ মিনিট। প্রতি ক্লাসের পর ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বিরতি দেওয়া হয়, যাতে ঐ সময়ের মধ্যে বাচ্চারা তাদের পড়াটা আত্মস্থ করতে পারে এবং কিছুক্ষণ হাঁটাচলা ও কথাবার্তার মাধ্যমে নতুন উদ্যমে পরের ক্লাসটা শুরু করতে পারে। প্রতি ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা থাকে গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন। হোমওয়ার্কের পেছনেও ফিনল্যান্ডের শিশুদের ব্যয় করতে হয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম সময়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি দ্বীপদেশ সিঙ্গাপুর; এই ক্ষুদ্র দেশটিই আজকের আধুনিক বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যকেন্দ্র। বর্তমানে দেশটি পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন, খাটি গণতান্ত্রিক ও শীর্ষ মাথাপিছু আয়ের দেশে। জনগণের জীবনযাত্রার মান এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ৪র্থ ও বিশ্বে ২৫তম এবং পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর মধ্যে ২২তম। অথচ আজ থেকে ৫০ বছর পেছনে তাকালেও দেখা যায় সিঙ্গাপুরের চেহারায় ভেসে উঠত অনেকটা আজকের আমাদের বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি।
সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং অনেক উন্নত দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থা অন্যতম; পিআইএসএ মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও শীর্ষ স্থানীয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে নিতান্ত গ্রাম্য জীবন থেকে সিঙ্গাপুর যে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশগুলোর মধ্যে একটি অনন্য হিসেবে স্থান করে নিতে পেরেছে এর মূলে কিন্তু রয়েছে তাদের সুচিন্তিত শিক্ষাব্যবস্থা। তিন জাতির বসবাসস্থল হলেও সততা সৌহার্দ ও সুসংহতিতে গড়া সিঙ্গাপুরের সামাজিক জীবন।
দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকেও এদেশের শিক্ষাব্যবস্থাটি আজও আমি ভাল করে বুঝে উঠতে পারি নি; অবশ্য সেটা আমার অক্ষমতাও হতে পারে। যতটুকোই বুঝতে পেরেছি তা থেকেই বলতে পারছি, এদেশে শিক্ষা নিয়েই সবচেয়ে বেশি রাজনীতি হয় এবং শিক্ষাক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি দূর্নীতি হয়। শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ জাতীয় বরাদ্ধ দেয়া থাকলেও অনৈতিকতা গ্রাস করে নিয়েছে এর সকল ক্ষেত্র, সকল সাফল্য।
এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার ধারা আজও আমার বোধগম্য হয় নি; সবখানে কেমন যেন এক ধরনের গোজামিল। শিক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে বিভিন্ন স্তর ও ধারা; বয়সভেদে এদেশে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্তরে লেখাপড়া করে থাকে। আবার প্রতিটি স্তরে রয়েছে একাধিক ধারা; প্রাক প্রাথমিক স্তরে সাধারণ ধারায় যেমন নার্সারী ও কিন্ডারগার্টেন এর অস্তিত্ব রযেছে, তেমনি ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে মক্তব এর ভুমিকাও উল্লেখযোগ্য।
সরকারি শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ছয় বৎসর থেকে এগারো বৎসরের শিশুদের নির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে ও তিনটি ধারা রয়েছে যা সাধারণত দেশীয় কারিকুলামে বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজী ভার্সনে পড়ানো হয়ে থাকে। মাদ্রাসা শিক্ষায় এবতেদায়ী স্তরে ইসলাম ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে দেশীয় কারিকুলামে শিক্ষা প্রদান করা হয়। কিন্ডারগার্টেনে বিদেশী কারিকুলামে ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়। পাঁচ বছর মেয়াদী মাধ্যমিক স্তরে ও সাধারণ ধারায় এস.এস.সি, মাদ্রাসা ধারায় দাখিল ও ইংরেজী মাধ্যমে "ও" লেভেল সার্টিফিকেটের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা হয়।
পাশাপাশি বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে কারিগরী শিক্ষাবোর্ডের আওতায় বৃত্তিমূলক ও কারিগরী শিক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুই বছর মেয়াদী উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ও সাধারণ ধারায় এইচএসসি, মাদ্রাসা ধারায় আলীম ও ইংরেজী মাধ্যমে "এ" লেভেল সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা রয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে কারিগরি ধারায় পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট সমূহে ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদান করা হয়। পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞান, কৃষিসহ বিভিন্ন ধারায় কারিগরি শিক্ষার প্রসারতা বেড়েছে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও সাধারণ, কারিগরী ও মাদ্রাসা ধারার আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। সাধারণ ধারায় তিন বছর মেয়াদী স্নাতক ও চার বছর মেয়াদী স্নাতক (সম্মান) ও এক বছর মেয়াদী স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে দুই বছর মেয়াদী ফাজিল ও দুই বছর মেয়াদী কামিল সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা রয়েছে; কারিগরী শিক্ষার ক্ষেত্রে চার বছর মেয়াদী স্নাতক প্রকৌশল, পাঁচবছর মেয়াদী চিকিৎসা বিজ্ঞানে এম.বি.বি.এস ডিগ্রি, কৃষি বিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) সহ নানাবিধ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভের সুযোগ রযেছে। পাশাপাশি বিশেষায়িত পেশাগত বিষয় যেমন: আইন, শিক্ষা, ক্রীড়া, নার্সিং, সামরিক বিজ্ঞানসহ নানান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের সুযোগ রয়েছে।
কয়দিন আগে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীসকে মাস্টার্সের সম পর্যায়ের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যদিও এই শিক্ষা ব্যবস্থা আজও অনেকটা আত্নকেন্দ্রিকতার মোরকে আবদ্ধ। শিক্ষার এই ধারা নিয়ে দেশের সংখ্যাগড়িষ্ট মানুষের স্পষ্ট কোন ধারণাই নেই; তাই অনেকেই অনেকটা উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমি এখানে মোটেও উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু দেখছি না; বরং আমাদের সমাজের অলস একটি শিক্ষিত শ্রেণীকে কর্মমুখী করার উগ্যোগ নেয়ায় সরকারের এই উদ্যোগের তারিফই করবো।
তবে সরকারকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে, স্বাভাবিকভাবে স্কুল-কলেজ থেকে একটা ছেলে বা মেয়েকে মাস্টার্স পাশ করতে যেখানে সময় লাগে ন্যূনতম ১৭/১৮ বছর, আলিয়া মাদ্রাসা থেকে মাস্টার্স করে বের হতে লাগে প্রায় ১৫ বছর; সেখানে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করতে একজন ছাত্রছাত্রীকে বড়জোর জীবনের ১১ বছর সময় ব্যয় করতে হয়। কেমন করে কোন হিসেবে তড়িগড়ি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার তা আমি মোটেও মেলাতে পারছি না।
আমার মতে, কওমি মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতির দেয়ার আগে অন্তত একমুখী মাদ্রাসা শিক্ষা নীতি বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। আলিয়া বা কওমী সবাই যেন একই সিলেবাসে পড়তে পারে এবং একই প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারে নিদেন পক্ষে এই ব্যবস্থাটুকো করা উচিৎ ছিল।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ৩ শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায়; প্রাচীন কাঠামোভিত্তিক দরসে নিজামি, পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত পাঠক্রম-ভিত্তিক দরসে নিজামি এবং আলিয়া নেসাব। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর মাদ্রাসাগুলোকে কওমী বা বেসরকারি মাদ্রাসা বলে, তৃতীয় ধারা আগে থেকেই সরকার স্বীকৃত। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি শিক্ষা বোর্ড এসবের কার্যক্রম সমম্বয় করে। ১৯৯৮ সালে সারাদেশে ২,০৪৩টি মাদ্রাসা কওমী মাদ্রাসা হিসেবে বোর্ডে নিবন্ধিত হয়েছিল। শিক্ষার স্তর তখন ৭টি ছিল; তাকমিল (স্নাতকোত্তর), ফজিলত (স্নাতক), সানুবিয়্যা উলায়া (উচ্চ মাধ্যমিক), মুতাওয়াস ফিতাহ (মাধ্যমিক), ইবতেদায়্যা (প্রাথমিক) এবং ইলমুল কিরাত ওয়াত তাজদিদ (উচ্চতর কুরআন পাঠ) ও হিফজুল কুরআন।
'কওম' মানে জাতি, আর 'কওমী' মানে জাতীয়; আরবী 'মাদ্রাসা' শব্দের মানে হলো বিদ্যালয়। সুতরাং কওমী মাদ্রাসার মানে দাঁড়ায় - জাতীয় বিদ্যালয়। যা সম্পূর্ণরুপে সাধারণ মানুষের সাহায্য সহযোগিতায় ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ-এর শিক্ষা কারিকুলাম অনুসরণ ও অনুকরণ করে এদেশে চলছে। মানুষের দানখয়রাতে এগুলো প্রতিষ্ঠিত। কারো দান করা জায়গায় অথবা ক্ষমতার দাপটে ইচ্ছেমত অবৈধ যে কোন একটা জায়গা দখল করেই সাধারণতঃ এসব মাদ্রাসা এদেশে গড়ে উঠেছে।
ইসলামের প্রচার প্রসার ও মুসলমানের জীবনমরণে মাদ্রাসা শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তদুপরি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে যতটা না ধর্মের প্রয়োজনে তার চেয়ে বেশি এক শ্রেণীর স্বার্থন্বেষী মহলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্যের আর্থিক সহযোগিতায় ব্যঙের ছাতার মতো এদেশে গজিয়ে উঠেছে এইসব মাদ্রাসা এবং সমাজের পিছিয়ে পরা মানুষের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে ও এতিম মিসকীনদের নামে চলছে এই শিক্ষাব্যবসা। অতি দুঃখের বিষয় হলো, যে হারে এদেশে এইসব মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে সে হারে স্কুল কলেজ গড়ে উঠে নি; এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সবার।
২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ি এদেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ।
কওমী শিক্ষাব্যবস্থায় নির্দিষ্ট কোন স্তর বা বাধাঁধরা কোন নিয়মনীতি নেই। সাধারণতঃ দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায় বিভিন্ন নামে সুবিধামত শ্রেণী স্তরবিন্যাস করা হয়। ঢাকার বিখ্যাত এক কওমী মাদ্রাসার বর্তমান শ্রেণীবিন্যাসের একটি চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করছি :
১) ইবতিদায়ী আউয়াল (১ম শ্রেণী);
২) ইবতিদায়ী ছানী (২য় শ্রেণী);
৩। ইবতিদায়ী ছালেছ (৩য় শ্রেণী)
৪। ইবতিদায়ী রাবে (৪র্থ শ্রেণী);
৫। ইবতিদায়ী খামেস ( ৫ম শ্রেণী);
৬। মুতাওয়াস্সিতাহ্ উলা (মীযান);
৭। মুতাওয়াস্সিতাহ্ ছানিয়াহ্ (নাহবেমীর);
৮। ছানাভিয়্যাহ্ উলা (কুদূরী);
৯। ছানাভিয়্যাহ্ ছানিয়াহ্ (হেদায়া-শরহে বেকায়া);
১০। ফাযীলাত (মিশকাত);
১১। তাকমীল (দাওরায়ে হাদীস)।
বছর শেষে নতুন শ্রেণী হিসেবে ইবতিদায়ী আউয়াল (১ম শ্রেণী) থেকে তাকমীল অর্থাৎ দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত পাশ করতে একটা ছেলেমেয়ের বড় জোর ১১ বছর সময় লাগে। কিন্তু এদেশের মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বা ফার্সি বিভাগে বাংলা, ইংরেজি এবং অন্যান্য বিষয়গুলো সাপ্লিমেন্টারী কোর্স হিসেবে থাকে এবং ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করে তাদের ডিগ্রি নিতে হয়, সময় লাগে প্রায় ১৭/১৮ বছর (ওয়ান-মাস্টার্স); অন্যান্য বিষয় বাদই দিলাম।
একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক গণমুখী সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষাকেও অবশ্যই আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করা দরকার। তাঁদেরকে সময়ের মূল স্রোতাধারায় সংযুক্ত ও সমন্বিত করা বর্তমান সরকারের একটি যুগোপযুগী সিদ্ধান্ত; এতে সাধুবাদ তাঁরা পেতেই পারেন। তবে কোন হীন রাজনৈতিক স্বার্থ ও অশুভ চক্রান্ত যেন এই শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার প্রক্রিয়া থেমে বিরত না রাখতে পারে সেদিকে আমাদের সবারই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা উচিত। তাছাড়া কওমী শিক্ষাকে বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নততর করা অত্যন্ত জরুরী।
অবশ্যই কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন আনতে হবে এবং ওদের পাঠ্যক্রমে গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, বাংলা এবং ইংরেজির মতো বিষয়গুলো যতটা সম্ভব অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সর্বোপরি শুধুমাত্র জন্ম মৃত্যু বিয়েতে আবদ্ধ না রেখে মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের বাস্তবমুখী শিক্ষার মাধ্যমে অবশ্যই জনকল্যাণমূলক দুনিয়াবী কর্মকান্ডেও সম্পৃক্ত করতে হবে; তবেই হয়তো একদিন দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনবে এই বিশাল জনশক্তি।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১৯ এপ্রিল, ২০১৭.
অসাধারণ লিখা,যাদের উদ্দেশ্য করে এই লিখা তারা কতটা গ্রহন করবে,আমার মতে গ্রহন করা দরকার এতে অলাভের কিছু নেই ��
উত্তরমুছুন