শনিবার, ২৭ জুন, ২০২০

'হুজুর' বিশেষণটি কি খাস নয়?

খোদা বলা যাবে না, আল্লাহ বলতে হবে! নামাজ বলা যাবে না, সালাত বলতে হবে! রোজা বলা যাবে না, সাওম বলতে হবে!......... আরো  কত কি যে ফেতনা, বলে আর শেষ করা যায় না যাবে না! এসব করছে কারা? ইহুদী-নাসারা? মোটেও তা না; ইহুদী-নাসারা এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজ এখন আমরা মুসলমানরাই ব্যপকভাবে হাতে নিয়েছি। বুঝে কিছু কায়িক স্বার্থলোভে বা না বুঝে অনেকেই আবার বোকার মতো সেসব বাস্তবায়নও করছি।       

‘হুজুর’ শব্দটা আমাদের সমাজে এখন বহুল প্রচলিত; সাধারণতঃ ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মাদ্রাসায় পড়ানেওয়ালা কোন আলেম বা মসজিদের ইমাম, এমনকি দ্বীনদার-পরহেযগার মানুষদেরকেও আমরা  ‘হুজুর’ বলে সম্বোধন করে থাকি। 'হুজুর' শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো— উপস্থিত হওয়া। পরিভাষাগত ব্যবহাতে সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মানসূচক সম্বোধনে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত; যেমন—নৃপতি, বিচারপতি, মনিব ইত্যাদির ক্ষেত্রে সম্মানসূচক বিশেষণে শব্দটি প্রয়োগ হয়। বাংলা ভাষায়— সাধারণত জনাব, মহাশয়, মহোদয় ইত্যাদি এবং ইংরেজিতে স্যার-এর মত সম্মানসূচক বিশেষণে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। 

ইসলামের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় নবী কারীম (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে হুজুর শব্দের ব্যবহার পূর্বযুগে ব্যাপক প্রচলিত ছিল এবং এখনো কোন কোন মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে শব্দটি ঠিক আগের মতোই প্রচলিত আছে; এখানে মূলতঃ হুজুর পাক (সাঃ)-কে সম্মান দেখানোর নিমিত্তে একমাত্র তাঁর শা'নে এ শব্দটি প্রয়োগ করা হতো এবং হয়ে আসছে। এখন প্রশ্ন আসে— তাহলে 'হুজুর' শব্দটি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য খাস, নাকি যে কারো সাথে এই শব্দটি ব্যবহার করা যায় বা যাবে? 

পবিত্র কালাম পাকে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন, 'ইয়া আইয়ুহাল্লাযীনা আ-মানু লা-তাকুলু রা-'ইনা ওয়া কুলুন ঊনযুরনা ওয়াসমাঊ ওয়া লিল কা-ফিরীনা আযা-বুন  আলীম।' অর্থাৎ— 'হে মু'মিনগণ! তোমরা 'রায়িনা' বলো না, ঊনযুরনা' বল এবং শুনতে থাকো;আর কাফেরদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। –[সুরা বাকারা; ১০৪]

এই আয়াতের আভ্যন্তরীণ বিষয় বুঝানোর জন্য সংক্ষেপে আয়াতটি নাজিল হওয়ার প্রেক্ষাপট আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে হিযরত করে মদীনায় যান, তখন মদীনার চারপাশে অতি দ্রুত  ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। সেই অবস্থায় ইহুদীরা স্থানে স্থানে মুসলমানদেরকে ধর্মীয় বিতর্কে জড়িয়ে তাদেরকে ব্যস্ত রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত হলো। তাদের উল্লেখযোগ্য বাধা-দানকারী কার্যক্রমগুলি ছিল—

১). তুচ্ছ ব্যাপারকে কেন্দ্র করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটানো। 
২). গুরুত্বহীন বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের অবতারণা করা। 
৩). অপপ্রচারের মাধ্যমে নব্য মু'মিনদের অন্তরে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করার চেষ্টা। 
৪). প্রশ্নের উপর অনর্থক প্রশ্ন করে কুরআন ও মহানবী [হুজুর পাক (সাঃ)]-এর বক্তব্যকে দূর্বোধ্য করে তোলা; এবং 
৫). নবী কারীম (সাঃ)-এর মজলিসে বসে প্রতারণামূলক কথাবার্তা বলে গোলযোগ সৃষ্টি করা।

পবিত্র কুর'আনুল কারীমের উক্ত রুকু হতে পরবর্তী রুকুগুলোতে মহানবী (সাঃ)-এর অনুসারী তথা মু'মিনদেরকে এসব অনিষ্টকর কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, যা তাদের বিরুদ্ধে ইহুদীরা করছিল। সেসব সন্দেহ-সংশয়ের জবাবও দেয়া হয়েছে, যেগুলো তারা মুসলমানদের অন্তরে সৃষ্টির অপচেষ্টা করছিল।

'রায়িনা 'শব্দটির অর্থ 'আমাদের একটু সুযোগ দিন'; কিন্তু ইহুদীদের ভাষায় এর অর্থ 'শোনো, তুমি বধির হয়ে যাও'। তাফসীরের কিতাবে এসেছে— ইহুদীরা যখন মুসলমানদেরকে মহানবী (সাঃ)-এর কথা ভাল করে বুঝে নেয়ার উদ্দেশ্যে শব্দটি ব্যবহার করতে দেখল, তখন তারা এটাকে সুযোগ হিসেবে গণ্য করে তাদের ভাষায় ব্যবহৃত গালির অর্থে এই শব্দটি প্রয়োগ করতে লাগলো; আবার কখনো-বা তারা শব্দটির উচ্চারণ একটু টেনে বা দীর্ঘ স্বরে 'রা—ঈয়ানা'-ও বলার চেষ্টা করতে লাগলো; যার অর্থ দাঁড়ায় 'ওহে আমাদের রাখাল'! 

এর পিছনের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাহমাতুল্লিল আলামীন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তুচ্ছজ্ঞান ও অপদস্ত করা। অন্য এক হাদিসে এসেছে, ইহুদিরা যখন কোন মুসলমানকে সালাম করতো, তারা তখন এই ভাবে বলতো, আস সামু আলাইকুম; ওরা ‘সালামু’ না বলে মুখের ভিতর রেখে ‘সামু’ বলতো। এখানে সামু শব্দের অর্থ মৃত্যু; মূল অর্থ দাঁড়ায়— আপনার উপর মৃত্যু আসুক। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মুসলমানদেরকে এর উত্তর শিখিয়ে দিয়েছিলেন এভাবে— তারা যেন বলে শুধু ‘ওয়ালাইকুম'; অর্থাৎ তোমার উপর ও তাই হোক। যাই হউক, ইহুদীদের এই ছলচাতুরি বন্ধ করার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা মু'মিনদেরকে 'রাইনা' শব্দটি  বর্জন করতে ঘোষণা দিলেন, এবং এর একার্থবোধক শব্দ 'ঊনযুরনা' অর্থাৎ— 'আমাদের প্রতি নজর দিন' বলতে নির্দেশ দিলেন। 

মূল কথা হলো রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর শা'নে বিশেষণ ব্যবহার বা কোন শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাবধানতার বিষয়টি আমরা এ আয়াত থেকে স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারি।
স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত মু'মিনদেরকে যথাযথ কুলুষমুক্ত শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন যে— 'রাইনা' বলো না, বরং বলো 'উন্‌যুর্‌না'; যার অর্থ 'আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন' বা 'আমাদের প্রতি দৃষ্টি দিন' অথবা 'আমাদেরকে একটু বুঝতে দিন'।

আজকালকার দিনে আমরা খাসভাবে হুজুর শব্দটি ব্যবহার করছি, কিন্তু প্রাক যুগে শব্দটির এমন ব্যপক প্রচলন ছিল না; হযরত আবু বকর (রাঃ), ওমর (রাঃ) উসমান (রাঃ), আলী (রাঃ)-র নামের আগেও কেউ এই শব্দটি ব্যবহার করেননি। অথচ কালে কালে আমরা সবাই হয়ে গেছি হুজুর, আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষণ দিয়েছি জনাবে রাসুলুল্লাহ! হায়রে মুসলমান!  

ইহুদীদের অপকাজগুলো এখন মুসলমানরাই করছে, পদে পদে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অপমান-অপদস্ত করার মতো বিষয়ে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে! শিক্ষা গ্রহণ করছে না মহান রাব্বুল ইজ্জতের কাছ থেকেও। পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে যেখানেই মহান রব হুজুর পাক (সাঃ)-কে সম্বোধন করেছেন, সেখানেই তিনি  বিশেষ বিশেষণে সম্বোধন করেছে, বিশেষভাবে   ডেকেছেন; যা অন্যান্য নবী-রাসুলদের বেলায় দেখা যায় না, বাকী সকল নবী-রাসুলদের তিনি নাম ধরে ডেকেছেন। 

যাঁর জন্য ইসলাম ও ঈমান,  সেই হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শা'ন ও মান খর্ব করার উদ্দেশ্যে বেয়াদবি করে কি নিজেকে মুসলমান দাবী করা যায় বা যাবে? তাই, বলি কি— হে মুসলমান! জ্ঞানের প্রদীপ্ত শিখা জ্বালাতে চেষ্টা করুন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে অন্তর থেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে এসব বন্ধ করতে। দেখবেন, পৃথিবী আবার সুন্দর হয়ে যাবে এবং সমগ্র পৃথিবীকে আবারও মুসলানের করতলে করে দেবেন মহান রব।। 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২৭ জুন, ২০২০.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন