আজকালকার দিনে ঘরে ঘরে অসংখ্য ফকিহ্/মুফতীর জন্ম হয়েছে! আসলে ইউটিউব/ফেইসবুক থেকেই এসব ওলামাদের জন্ম। কোন একটা বিষয়ে কথা বলতে গেলে দেখা যায় চায়ের দোকানদারও ফতোওয়া বা একটা মাসালা দিয়ে বসেন; হউক তা সঠিক বা বেঠিক! আলটামর্ডান মর্ডারেট মুসলিমরা তো আরো এক ধাপ উপর দিয়ে চলেন! তারা মনে করেন, যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে বর্তমান অবস্থারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে, সুতরাং বর্তমান সময়ে হুকুমের পরিবর্তন হওয়া জরুরী। এ প্রেক্ষিতে তারা আরও জোর দিয়ে বলেন, 'যুগের পরিবর্তনের কারণে হুকুমের অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে'। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণীর তথাকথিত ফকিহ্-রাও এ ব্যাপারে গবেষণার গভীরে না গিয়েই ভুল ফতোওয়া দিয়ে বসেন; এবং সামাজিক বিশৃংখলা উস্কে দেন। ইজতিহাদের মূল নীতি বা মূল বিষয়ের প্রতি তারা মোটেও দৃষ্টি দেন না বা ধার ধারেন না।
ইসলামি শরিয়তের বিষয়ে মাসলা বের করতে হলে প্রকৃতার্থে কুর'আন ও সুন্নাহর জ্ঞানে জ্ঞানী, নাসেক মানসুক, শানে নুযূল, তাফসীরসহ ইজমা কিয়াস বুঝা একজন মুফতী বা গবেষকমাত্রই অবগত আছেন যে, ইজতেহাদের মূল ভিত্তি হলো 'ইল্লাত' ও 'হিকমত'। কোন ফিকহি হুকুমের যে পরিবর্তন আসে তা ইল্লাতের পরিবর্তনের কারণে আসে, হিকমত বা উপকারিতার পরিবর্তনের কারণে নয়। যে জিনিষের শরিয়ত কোন হুকুমের ইল্লাত সাব্যস্ত করে গেছে, সেটা পরিবর্তনের কারণে হুকুমও পরিবর্তিত হতে পারে। অর্থাৎ কোথাও যদি শরিয়তের পক্ষ থেকে নির্ধারিত ইল্লাতের অনুপস্থিতি ঘটে, তাহলে হুকুম পরিবর্তন হতে পারে; কিন্তু যদি ইল্লাত বাকি থাকে, আর শুধু আমাদের চিন্তা ও ধারণাতে তার হিকমত না পাওয়া যায়, তাহলে সে কারণে হুকুমে কোনো পরিবর্তন আসবে না।
তাই বলা যায়, ইসলামি শরিয়তে হুকুমের মূল ভিত হলো ইল্লাত, হিকমত নয়। যারা ইদানীং ইজতিহাদের দাবি করেন,অর্থাৎ তথাকথিত মোল্লাদের বেশিরভাগের ক্ষেতে একটি অবস্থা পরিলক্ষিত হয়, তারা হিকমতকে ইল্লাত সাব্যস্ত করেন। আর এ কারণেই তারা বলেন, হুকুম পরিবর্তন হয়ে গেছে; অতএব মাসালাও পরিবর্তন হবে। এটা সম্পূর্ণই ভুল ধারণা এবং ভ্রান্ত চিন্তা।
উক্ত নীতিমালার ফিকহি উদাহরণ দেয়ার আগে একটি বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি। কেননা, অনেক সময় ফিকহি উদাহরণে ইল্লাত ও হিকমতের মধ্যে পার্থক্য বুঝা অনেকের জন্য খুব কঠিন হয়ে যায় এবং সাধারণ মানুষ ইল্লাত ও হিকমতের মধ্যে পার্থক্য মোটেও বুঝে না; আমি দেখেছি অনেক তথাকথিত মুফতী নামধারীরাও তা বুঝে না! আমরা যখন গাড়ি চালাই তখন দেখি চৌরাস্তায় সিগনাল লাগানো থাকে। আইন রয়েছে যে, লাল বাতি জ্বললে গাড়ি থামিয়ে রাখতে হবে; এবং সে সময়ে গাড়ি চালানো নিষেধ। আর সবুজ বাতি জ্বললে গাড়ি চলবে, তখন গাড়ি চালানো বৈধ। লাল বাতি জ্বলাকালীন সময়ে থেমে যাওয়া হলো হুকুম। এখানে লাল বাতি জ্বলা হলো ইল্লাত; আর দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে থাকাটা হলো হিকমত।
এখানে বুঝতে হবে, থেমে যাওয়ার যে হুকুম সেটির মূল ভিত্তি কি লাল বাতি জ্বলার উপর, না কি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে থাকার উপর? ধরে নিন, আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন; ফাঁকা রাস্তা পড়ে আছে, দূর পর্যন্ত অন্যকোনো গাড়ি চোখে পড়ছে না, অন্য দিকে লাল বাতি জ্বলছে। তাহলে এমন সময় থেমে যাওয়ার হুকুম কার্যকরী হবে কি না? এখানে স্পষ্ট কথা হলো যে, থেমে যাওয়ার হুকুম কার্যকরী হবে। অথচ তখন থেমে যাওয়ার হুকুমটি অনর্থক বলে মনে হয় এবং থেমে থাকার কারণে সময়ের অপচয় বলেও মনে হয়। কেননা, তখন তো আর সংঘর্ষের কোনো আশঙ্কাই নেই, সোজা পথে চললে কোনো গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষও লাগবে না। কিন্তু তারপরও থামতে হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু কেন থামতে হচ্ছে বা হবে? কেননা, তার ইল্লাত এখানে বিদ্যমান; যদিও হিকমাত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এখান থেকেই বুঝা যায় যে, হুকুমের মূল ভিত্তি ইল্লাতের উপর নির্ভর করে হয়, হিকমতের উপর নয়।
গভীর দৃষ্টিতে একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় ফাঁকা রাস্তা হওয়ার পরও সেখানে লাল বাতি জ্বালিয়ে রাখার মধ্যে যথেষ্ট হিকমত রয়েছে। আসল হিকমত হলো প্রত্যেককে যদি এই স্বাধীনতা দেওয়া হয়, সংঘর্ষের সম্ভাবনা আছে কি না এ ব্যপারে আপনি নিজে সিদ্ধান্ত নিবেন, যদি সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে আপনি থেমে যাবেন; আর সংঘর্ষের আশঙ্কা না থাকলে গাড়ি চালাবেন; সবাইকে যদি এমন স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তাহলে রাস্তায় অরাজকতা ছড়িয়ে পড়বে, যুদ্ধ বেধে যাবে। কেননা, প্রত্যেকে তার ইচ্ছা অনুযায়ী সে স্বাধীনতা ব্যবহার করবে এবং সে কারণে লাল বাতি লাগানোর উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
উক্ত বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমেই এ কথাটি এখন খুব ভালোভাবেই বুঝে আসে যে, শরিয়তের হুকুমের মূল ভিত্তি হলো ইল্লাতের উপর, হিকমতের উপর নয়। ইল্লাতের অর্থ হলো- এমন গুণ বা আলামত শরিয়ত যার উপর হুকুমের ভিত্তি রেখেছে।
ফিকহি উদাহরণ হিসেবে একটি উদাহরণ দিচ্ছি— নামাজে কসর করার ইল্লাত হলো 'সফর'। আর হিকমাত হলো 'কষ্ট থেকে বাঁচা'। এখন এই হুকুমের মূল ভিত্তি হলো সফর। সফর হলেই সেখানে কসর করতে হবে; চাই বিশেষ কোনো সফরে কষ্ট না হউক। যেমন- বিমানে সফর করে বিজনেস ক্লাসে যাওয়া এবং দামী হোটেলে অবস্থান করা। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এমন সফরে কোনো কষ্টই হয় না। সুতরাং সেখানে হিকমত পাওয়া যাচ্ছে না। বরং অনেক সময় আমাদের মতো মানুষ বাসস্থানে থাকা অবস্থায় খুব বেশি ব্যস্ত থাকি এবং নামাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো আদায় করাও তখন অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা যখন সফরে যাই, তখন সফরের মধ্যে এতো বেশি সময় পাই যে, একাগ্রচিত্তে ফরজ সুন্নত নফল নামাজ ও তেলাওয়াত সব কিছুই নিঃশ্চিন্তে করতে পারি। এমন বিশেষ সফরে তেমন কোনো কষ্টই হয় না। কিন্তু সে কারণে সেখানে কসরের হুকুমের কোনো পরিবর্তন আসে না; কেননা, মূল ইল্লাত এখানে 'সফর'।
নামাজ হলো ইল্লাত, আর কেমন করে আদায় করবো তা হলো হিকমত; তেমনই মাজুরের নামাজ হলো ইল্লাত, এর হিকমত স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাতলে গেছেন। এখন আমাদের বুঝতে হবে, 'মসজিদে চেয়ারে বসে নামাজ' আসলে কি? 'ইল্লাত' না কি 'হিকমত'? এখানে ইল্লাত হলো 'মাজুরের নামাজ', যা দাঁড়িয়ে বা বসে বা শুয়ে আদায়ের সঠিক পদ্ধতি শরিয়তে নির্ধারিত করা রয়েছে। যেহেতু মাজুরের নামাজের ফয়সালা হুজুর পাক (সাঃ) কতৃক নির্ধারিত; অতএব, নতুন করে আবার 'চেয়ারে বসে নামাজ আদায়'-এর ব্যাপারে মাসালা তৈরী করার অধিকার আপনাকে আমাকে কে দিয়েছে??
মুহাম্মাদ ওয়ালিউল্লাহ্
০৩ অক্টোবর, ২০১৯।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন