বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের নতুন নতুন অনেক কিছু দিয়েছে এবং দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রতি মিনিটে একেকটি নতুন ইলেক্ট্রিক-ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইস উদ্ভাবিত হচ্ছে এবং আমাদের জীবনের সাথে সেসব সংযুক্ত হচ্ছে। এ'সবকে স্বাগত জানিয়ে সাথে সাথেই আমরা সুবিধা গ্রহণ করে পৃথিবীবাসির সাথে একাত্ম ঘোষণা করছি। সারা বিশ্বব্যাপি বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রা অগ্রগতি অগ্রযাত্রা অসম্ভবভাবে অব্যাহত। শুনতে কঠিন শোনালেও নির্মম বাস্তবতা হলো— এই যান্ত্রিকতা দিনে দিনে আমাদের জীবনের সব কিছুকে গ্রাস করে ফেলেছে এবং ফেলছে, কেড়ে নিচ্ছে আমাদের প্রাণচাঞ্চল্য; আবেগ অনুভূতি ভাল লাগা ভালবাসার বিষয় ও বন্ধনগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে। আমাদের জীবন এখন পুরোটাই যান্ত্রিক, এবং আমরা অনেকটাই প্রযুক্তি নির্ভরশীল হয়ে পরছি।
আত্মিয়তা, আতিথেয়তা, সামাজিকতা, জন্ম-বিয়ে-মৃত্যু, রাজনীতি সব কিছুই আজকাল অনেকটা যান্ত্রিক এবং সম্পূর্ণরূপে শুধুই লৌকিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিস্তেজ নিস্তব্ধ যান্ত্রিকতার মাঝে প্রতিনিয়ত আমরা যে ভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি এবং পড়ছি তাতে শংকা হয়, না জানি আমাদের সমাজ-সামাজিকতায় এই যান্ত্রিকতা কোন এক মহা বিপর্যস্ত ঘটিয়ে দেয়! উন্মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস, দৌড়-ঝাপ সব কিছুই এখন শুধুই তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিনোদন, আর লৌকিক বর্ণনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোলা আকাশের নিচে মুক্ত বাতাসে গা ঠান্ডা করার কথা এখন আর ভাবাও যায় না; বিশেষ করে শহরাঞ্চলে তো প্রশ্নই উঠে না। কোথাও বেড়াতে গেলেও দেখা যায় শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা ও ছবি সেশনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকছে সবকিছু! অন্তরিকতার সাথে উপভোগ করার কোন প্রচেষ্টাই কারো মাঝে নেই; মনে হয় সব কিছুই যেন যান্ত্রিক। যন্ত্রদানবের মতো এখন আমাদের প্রতিটি মানুষের জীবনযাপন ও পথচলা। ভিডিও বা ছবি তুলে তা ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ায় আপলোড করে শেয়ার, ট্যাগ আর বর্ণনার মাঝেই যেন সব আত্মতৃপ্তি খুঁজে ফিরি আমরা সবাই! এ কেমন জীবন?
দেশের শিক্ষিত শ্রেণীর বিরাট একটি অংশ এখন সারাক্ষণ কম্পিউটার বা মোবাইল ডিভাইস নিয়েই ব্যস্ত থাকছে। প্রজন্ম পরিক্রমায় দেখা যায় বর্তমান সমাজে এমন একটি শ্রেণী অলরেডি তৈরি হয়ে গেছে যারা অনেকটা রোবট সদৃশ। হটাৎ কোন সামাজিক প্রয়োজনে যদিও-বা তারা ঘরের বাহির হয়, তখনও তাদের মোবাইল নেটে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। বাস্তবতা, সামাজিকতা তাদের কাছে ফেসবুক, গুগল, টুইটার বা অন্য কোন যোগাযোগ মাধ্যম। প্রকৃত বাস্তবতা— বাস্তব প্রকৃতি ও পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে তাদের যেন কোন চিন্তা নেই ভাবনা নেই মাথা ব্যথা নেই। আর, সব কিছুতে সব সময় তারা অন্যের উপর সব দায় চাপাতে সদা তৎপর।
তাদের মতে— সকল রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক দায় শুধুমাত্র সরকারের। সব কাজেরই মন্দ সমালোচনা, আর মিথ্যা প্রচার প্রচারণা যেন তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা; তাও শুধুমাত্র নেট ভিত্তিক! সামাজিক দায় দায়িত্ব বলতে তারা তেমন কিছু বুঝেই উঠতে পারে না। সমাজের যে কোন অসংগতি নিয়ে একটি ষ্টেটাস করেই তারা খালাস; লাইক, কমান্ট ট্যাগ ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। এতে করে এই শ্রেণীর লোকজন প্রচন্ড এককেন্দ্রিকতায় ডুবে গেছে এবং যাচ্ছে। সমাজ সংসারের কোন চিন্তা তাদের মোটেও স্পর্শ করে না, চিন্তিত করতে পারে না। রাস্তায় বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে খুব কম লোককেই এগিয়ে আসতে দেখা যায়। বরং মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে কিছু লোক রেডি! ফেসবুক বা টুইটারে ডুকলেই ও'সবের শত শত স্টেটাস, এমন কি ভিডিও পর্যন্ত চোখে পরে; ওতে আবার লক্ষ লক্ষ লাইক শেয়ারও হয়! আমাদের পুরো সমাজ যেন আজ মোবাইল ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থরথর করে কাপছে, কাপাচ্ছে সমগ্র জাতিকেও।
একজন শিক্ষক হিসেবে সমাজের আনেক অসংগতির সাথেই প্রতিনিয়ত আমার সাক্ষাত ঘটে; দেখেছি এবং দেখতে হচ্ছে অনেক কিছু, জানতে পাড়ছি খুঁটিনাটি। তাই একটি কথা আজ বেশ নিশ্চিত হয়েই বলতে পারি— মৌলিক শিক্ষার অভাবে আমাদের সমাজের এই বিপর্যয়, এমন করুণ দশা। ভয় হচ্ছে, না জানি তা জেনারেশন গ্যাপের পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। মৌলিক শিক্ষা ব্যতীত কোন মানুষই পরিপূর্ণ এবং প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। তাই ছোট বাচ্চাদের মৌলিক শিক্ষার দিকে প্রত্যেক অভিভাকের দৃষ্টি দেয়া এখন একান্ত জরুরি বলে আমি মনে করছি। যে সব শিশুরা ১০০% পাঠ নির্ভর হয়ে বড় হচ্ছে তারা মৌলিক শিক্ষা বঞ্চিত থাকছেই। মৌলিক বিষয় না জেনে আপনার বাচ্চা বিদ্যাপীঠে যত ভাল রেজাল্টই করুক না কেন তা কখনো তার জন্য বা আপনার জন্য, সর্বোপরি জাতির জন্য সুফল বয়ে আনবে না; বরং এক সময় বুঝা যাবে তা কত বড় অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন করতে পারেন— তাহলে সন্তানকে মৌলিক শিক্ষা দেবো কি করে? মৌলিক শিক্ষা নির্ভর করে অনেকটা প্রকৃতির উপর; প্রকৃতিই একজন মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। প্রকৃতির বাস্তবতা থেকে শিক্ষা দিতে হবে বাচ্চাদের। এতে করে বাচ্চাদের চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পাবে, দৃষ্টি শক্তির সৃজনশীলতার দ্বার উন্মুক্ত হবে। শহর কেন্দ্রিক অভিভাবকরা মাঝে মধ্যে বাচ্চাদের নিয়ে প্রকৃতির কাছে যাবেন, প্রকৃতিতে ছেড়ে দেবেন বাচ্চাদের। দেখবেন এতে করে বাচ্চা অনেক কিছু শিখে যাবে এমনি এমনিই; যা বলে কয়ে বা মুখস্ত করিয়ে কখনো শিখানো যায় না, সম্ভব নয়।
বিশেষ করে শহরের বাচ্চারা তো এখন অনেকটা ফার্মের মুরগির মত জীবনযাপনে অভ্যস্ত; স্কুল-বাসা আর কোচিং এই করে করে তাদের জীবন অতিষ্ঠ। আবার অনেক অভিভাবককেই দেখি কর্মব্যস্ততা ও সামাজিকতা নিয়ে তাঁরা এতটাই ব্যস্ত, নিজের সন্তানকে নন্যুতম সময়ও দেয়ার ফুসরত পান না। বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন না এ দেশের প্রায় ৯০% অভিভাবক। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিক্ষণে বাবা মায়েরা তো বাচ্চার সাথে মুখই খুলতে চান না। একটু বেশি কিছু জানতে চাইলেই অনেক অভিভাবককে দেখেছি ধমক দিতে; এটা মস্ত বড় অন্যায়। বিশেষ করে ওই বয়সের বাচ্চাদের সাথে অভিভাকের আচরণ হওয়া উচিৎ অত্যন্ত বন্ধুত্বসুলভ। ওদের কথা মন দিয়ে শোনা উচিত, ওদের বেশি বেশি বলতে দেয়া উচিত। ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলে ওদের মস্তিষ্কের উপর চাপ পড়ে, আর এতে মস্তিষ্কে অনেক বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। আর এ'সব কষ্ট থেকেই তাদের মাঝে হতাশার অভিব্যক্তির উন্মেষ ঘটে।
আমি অনেক বাচ্চাকে বিগরে যেতে দেখেছি শুধুমাত্র অভিভাকের অবহেলা, অবজ্ঞা ও অদূরদর্শিতার জন্য। শুধুমাত্র ওদের সাথে যদি আপনি একটু ভাল আচরণ করেন— আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি বাচ্চাটি অন্তত বিপথে যাবে না। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার বারো-তেরো বছরের বাচ্চাটি অবুঝ, কিছুই বুঝে না; তাই আপনার মতই তার উপর চাপিয়ে দেন বা দিচ্ছেন। না, আমি তা মোটেও বিশ্বাস করি না। ওদের সাথে কথা বলে আমি দেখেছি ওরা অনেক বুদ্ধিমান, অনেক কিছু তাদের মাথায়; ওরা সব কিছু অনেক ভাল বুঝে, যদি ধৈর্য ধরে আপনি বুঝিয়ে দিতে পারেন। অনেক সময় ওদের মাঝে এমন সব চিন্তার বহ্নিপ্রকাশ ঘটতে আমি দেখেছি যা আমরা বড়রাও কখনো ভাবতে পারি না বা ভাবি না। তাই ওদেরকে একটু বুঝিয়ে বলুন; দেখবেন বুঝবে এবং মেনে নেবে।
জাতীয়ভাবে লক্ষ করে দেখেছি, বর্তমান প্রজন্ম কেমন যেন হতাশায় নিমজ্জিত; তাই তারা একগুঁয়েমিতে ডুবে আছে এবং প্রতিনিয়ত ওদিকেই ধাবিত হচ্ছে গন্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিটি কাজে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের এখন তেমন একটা অংশগ্রহণ নেই বা একেবারে নেই বললেই চলে। আমার জানাশোনা ৯৯% ছেলেমেয়ের মুখ থেকে জানতে পেরেছি তারা এদেশের রাজনীতি একেবারেই পছন্দ করে না। আমি ওদের অনেককে প্রশ্ন করেছি— রাজনীতিতে মেধারা যদি এগিয়ে না আসে তবে আমাদের সামাজিক পরিবর্তন আসবে কি করে? বেশিরভাগ উত্তরে চুপ থেকেছে। কেন যেন রাজনীতিবিদদের উপর তাদের প্রচন্ড রকমের ক্ষোভ ও ঘৃণা; তাই ওতে তাদের ভয়ানক রকমের অনাগ্রহ। কিন্তু এমন কেন হবে?
আমি জানি অনেকেই বলবেন, এ জন্য এ দেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাই দায়ী; এ দেশে ভাল কাজের মূল্যায়ন হয় না, ভাল মানুষের মূল্যায়ন হয় না, ইত্যাদি ইত্যাদি.....। এ সব কথা আমি মোটেও বিশ্বাস করি না। প্রকৃত সত্য হলো স্বার্থপরের সংখ্যা এখন আমাদের সমাজে অনেক বেশি বেড়ে গেছে; যে কোন কিছুতেই কিছু মানুষ স্বার্থের গন্ধ খোঁজে, স্বার্থ অনুসন্ধান করে; তাই তাদের এমন মনে হতে পারে। আর এইসব লোকেরা নিজেরা কোন কাজে অংশগ্রহণ করবে না, উপরন্তু অযথা অপাংতেয় সমালোচনা তাদের প্রত্যেকের নিত্য সঙ্গী। ভালকে ভাল বলে উৎসাহিত তারা কখনো করতে পারে না বা করে না। আর মন্দকে মন্দ বলে গৃণা করার অনুশিলন তো উঠে গেছে, এখন আর আমাদের কারো মাঝেই নেই! তাই তো দিনেদিনে আমরা তলিয়ে যাচ্ছি, এক অনিশ্চিত জেনারেশন গ্যাপ-এ পড়ে গেছি হয়তো, বা ওদিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছি।
আমি নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করি বর্তমান প্রজন্ম আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি অগ্রসরমান অগ্রগামী। জন্ম নিয়েই তারা পরিচিত হচ্ছে আধুনিক সব তৈজসপত্র, ব্যবহার্য, প্রযুক্তি ও ডিভাইসের সাথে, তথা অত্যাধুনিক সব কিছুর সাথে। পুরোনো শাড়ীর সেলাই ছোট্ট নক্সি কাঁথা বা ঘাঁনি ভাঙা খাঁটি সঁড়িষার তেল তাদের গায়ে এখন আর চাপে না বা উঠে না। মৌঁচাক ভাঙা খাঁটি মধুও খোঁজা হয় না সদ্যপ্রসূত নবজাতকের মুখে প্রথম মিষ্টি দেয়ার জন্য। ইউরোপ আমরিকায় তৈরি খাবার-দাবার ও প্রেম্পাস, প্রসাধন সামগ্রী এখনকার বাচ্চাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিস। বিশ্বায়ন ও আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় আমাদের জীবনযাত্রা পুরোপুরিই পাল্টে গেছে; শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মাঝেই পরিবর্তনের ছাপ সুস্পষ্ট। প্রতি ক্ষেত্রেই শুধু আমাদের বাহ্যিক অবয়বের পরিবর্তন অনেকটাই ঘটেছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন কতটা ঘটেছে বা ঘটছে?
অনেকে মনে করতে পারেন বিজ্ঞানের নব আবিষ্কার অগ্রযাত্রার বিরোধী আমি, নয়তো ব্যাকডেটেড; অবশ্যই আমি কোনটাই নই। বরং বিজ্ঞান তথ্য-প্রযুক্তি ও আধুনিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন ভোক্তা আমি। আর বিজ্ঞান যে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আশির্বাদ বয়ে এনেছে তার জন্য সব সময় মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ'লামিনের দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করি এবং সকল বিজ্ঞানীর মঙ্গল কামনা করি। এবং সব সময় আপ্রাণ চেষ্টা করি বিজ্ঞান ভিত্তিক কিছু করার এবং তা অন্যকে জানানোর। আমার নাতির দুই বছর হলো; জন্ম নিয়েছে সে ইউরোপে, তাই জন্মগতভাবেই ইউরোপিয়ান। আজ তার দ্বিতীয় জন্মদিন ছিল। তাই কিছুক্ষন আগে স্কাইপিতে যখন কথা বলছিলাম মেয়ে ও ছোট্ট নাতির সাথে; এপাশ থেকে আমি উপলব্ধি করছিলাম- নাতি তার জন্মদিন বেশ ভাল ভাবেই উপভোগ করছে, মনে হয় সবকিছু বুঝতে পারছে। ভালভাবেই হাসছিল আর আমাকে ভেঙাচ্ছিল! ইউরোপের নির্মল আবহাওয়ায় আল্লাহ্-র ফজলে সে বেশ ভালই আছে; সবার দোয়ায় বেড়েও উঠছে সঠিকভাবে।
গত বছর সে যখন ঢাকায় বেড়াতে এসেছিল, বেশির ভাগ সময়ই দেখেছি তাকে অসুস্থ থাকতে। ইউরোপীয় ডাক্তারের পরামর্শে খাবার পানি, গোসলের পানি থেকে শুরু করে তার ব্যবহার্য সব কিছুই সাথে করে নিয়ে এসেছিল তার মা-বাবা। তারপরও আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে তাকে বেশ কষ্ট পেতে হয়েছিল। এখানে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেই ডাক্তার বলতেন তাকে বেশি বাহিরে বের না করতে। কয়েক দিনের জন্য তাকে নিয়ে দেশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গ্রামের বাড়িতে নাতির কোনই সমস্যা হয়নি। কারণ সুস্পষ্ট— গ্রামের দুষণমুক্ত বাতাস, উন্মুক্ত আকাশ, খোলা মাঠ, অক্সিজেন মেশিন গাছগাছালি তো আছেই পর্যাপ্ত; আর এ'সবই হলো যে কোন জীবের জীবনের সুস্থতার মূল উপাদান।
আমাদের দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক অবস্থায় একটি শিশুর বেড়ে উঠা ও মেধার বিকাশ ঘটানোর ব্যাপারে আমরা কতটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি বা দিচ্ছি? কতটুকোই-বা শিশুদের বিকশিত হতে সাহায্য করছি? নাকি অযাচিতভাবে শুধু প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করছি তাদের বেড়ে উঠতে? এ'সব নিয়ে আমরা খুব কমই ভাবি বা অনেকে ভাবার ফুসরতই পাই না। সাধারণভাবে আমরা যারা শহরবাসী কর্মব্যস্ততায় আমরা হয়তো তা কখনো অনুধাবনও করতে পারি না। কিন্তু কখনো কি একবার ভেবে দেখেছি এই বড় বড় শহরগুলোর বাতাস আজ কতটা দুষিত হয়ে উঠেছে, কতটা বিষাক্ত??
জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে হয়তো আমরা শহরমুখি শহরকেন্দ্রিক। ছোট্ট একটি পরিসরে আমরা বসবাস করছি গাদাগাদি করে, বেড়েও উঠছি ঠিক একই ভাবে একই পরিবেশে। এখানে নেই কোন গাছ, মুক্ত বাতাস বা খোলা আকাশ। বলতে গেলে এক চিলতে খাঁচায় বন্দি আমাদের জীবন। একটি শিশুর বেড়ে উঠার জন্য যতটুকো আলো, বাতাস, খোলাস্থান, গাছগাছালি প্রয়োজন, বলতে গেলে শহরাঞ্চলে তার কিয়দংশও আমরা শিশুটিকে দিতে পারিনি পারছি না। সব কিছুতেই চতুর্দিকে আমাদের আছে শুধুই সীমাবদ্ধতা! এমতাবস্থার মাঝেও যে শিশুটি জন্ম নিচ্ছে, বেড়ে উঠছে, তাকে অবশ্যই কিছুটা বাড়তি সুবিধা আমাদের দেয়া প্রয়োজন। তাই তাদের মানসিক বৃদ্ধির অনুকুলে অবশ্যই আমাদের প্রত্যেকের কিছু না কিছু কাজ করা উচিত। কিন্তু তা না করে না বুঝে আমরা অনেকেই করছি ঠিক তার উল্টো; তিন চার বছরের বাচ্চাকেই ভর্তি করে ঢুকিয়ে দিচ্ছি স্কুল নামক আলো-বাতাসহীন একটি খোঁয়াড়ে! অবশ্য এ'সব এখন রীতিমতো আমাদের সামাজিক কালচারে পরিনত হয়েছে!
এতে করে কি তার মেধার বিকাশ ঘটবে বলে আপনি মনে করেন? আমি তো তা মোটেও মনে করি না। দু/তিন/চার বছরের যে অবুঝ শিশুটিকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়, সে সময়টায় ছোট্ট পরিসরের স্কুলিং তার ব্রেনের বিকাশের সম্পুর্ন প্রতিকুলে চলে যায়; যা মোটেও শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পরিপূরক কোন বিষয় নয়। এখন হয়তো বুঝতে পারছেন না, কিন্তু বড় হলে তা ঠিকই অনুধাবন করতে পারবেন। একটি চারা গাছে ফুল ফুটাতে হলে যেমন পরিচর্চার পাশাপাশি সার পানি আলো বাতাস সব কিছুরই সময় মতো ও পরিমাণ মতো দেয়ার প্রয়োজন পড়ে; একটি ছোট্ট শিশুর বেলায়ও ঠিক তদ্রুপ কাজ করতে হয়।
মা-বাবা ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে মুক্ত বাতাসে উন্মুক্ত পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা দেখে দেখে শিখে শিখে যে শিশুটির বেড়ে উঠার কথা, সেই শিশুটিকে সে সুযোগ না দিয়ে তার কাঁধে চাঁপিয়ে দিচ্ছেন বিশাল একটি বই-খাতার বোঁঝা! তা কখনো খারাপ বৈ ভাল কিছু বয়ে আনতে পারে না বা আনে না। নিজের চেয়ে তিনগুণ বড় বোঁঝার ভার বহন করা এতো ছোট্ট একটি শিশুর পক্ষে কি করে সম্ভব? কিছুতেই সম্ভব নয়। অযাচিতভাবে অভিভাবক হয়েও আপনি আমি সেই মন্দ কাজটিই করছেন; এটি ভয়ানক রকমের অন্যায়, নির্মম নিষ্ঠুরতা। তাছাড়া কোন ভাবেই তা বিজ্ঞান সম্মত নয়, বাস্তব সম্মতও নয়।
আমাদের দেশে স্কুলিং এর বয়স সম্বন্ধীয় কোন নীতিমালা নেই; কিন্তু ইউরোপ আমরিকায় একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। একটু ভাল করে লক্ষ্য করলেই হয়তো দেখতে পাবেন, আমাদের দেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোও সেই নীতিমালা অনুসরণ করে বাচ্চা ভর্তি করানো হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো— এ দেশে এ পর্যন্ত এ ব্যাপারে সরকারের কোন নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই; থাকলেও শুধু কাগুজে। সেই সুযোগে এ দেশের এক শ্রেণীর তথাকথিত শিক্ষিত লোকজন ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ানোর নাম করে কিছু ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে। যেখানে বাচ্চাদের পরিচর্চার কোন ধরনের পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিকতাই নেই। এমন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সরজমিনে দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে। ঐ সব স্কুলের শিক্ষকরূপী ব্যবসায়ীর দল বাচ্চাগুলোর কাঁধে চাপিয়ে দেয় মস্ত বড় এক একটা বোঁঝা, আর পড়ানোর নামে করে একচেটিয়া মুখস্ত পাঠের অনুশীলন। অত ছোট্ট বাচ্চার পক্ষে তা কি সম্ভব? বহনক্ষমতা না থাকার কারণে সেই থেকেই সেই ছোট্ট শিশুটি ভয়ের সাম্রাজ্যে প্রবেশ করতে থাকে। ব্রেনের বিকাশ হওয়ার বদলে পর্যায়ক্রমে তাদের ব্রেনের সংকোচন ঘটতে থাকে। একটু বড় হলেই দেখা যায় অনেক বাচ্চারই পড়া মনে থাকে না, লেখাপড়া বিরক্তিকর জিনিস বলে মনে হয় তাদের কাছে; আরেকটু বড় হলে তো অভিভাবকদের পড়তে বিশাল সমস্যায়!
দেশের সমাজবিজ্ঞানীদের এ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই, এ সব নিয়ে কারো যেন কোন চিন্তা নেই। সরকারেরও কোন চিন্তা-ভাবনা পদক্ষেপ গ্রহণ বা দায় আছে বলে মনে হয় না। জাতীয়ভাবে আমরা সবায় এখন কেমন যেন গন্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে বেড়াচ্ছি। স্বাধীনতার এতো বছর পাড় হলেও শিশুদের শিক্ষা ও বিকাশ নিয়ে এদেশে বাস্তবমুখী কোন পরিকল্পনা বা পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি বা হচ্ছে না কেন তা ভাবতে গেলে আমার বুকটা কষ্টে ফেটে যেতে চায়। প্রতিটি শিশু জাতির ভবিষ্যৎ; আর সেই শিশুই যদি সঠিকভাবে বিকশিত হতে না পারে, তবে এ জাতির বিকাশ ঘটবে কি করে? সে তো শুধুই দু:স্বপ্ন।
শুধু শুধু অন্যের উপর দোষ না চাপিয়ে পরনিন্দা পরচর্চা বাদ দিয়ে আসুন আমরা প্রত্যেকে অন্তত শিশুদের ব্যাপারে কিছুটা সচেতন হই। জাতি গঠনে যার যার অবস্থান থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করি। দেখবেন - আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আর এমন অনিশ্চয়তার মাঝে বসবাস করতে হবে না। এই ছোট্ট পরিসরেও সব কিছুই করা সম্ভব, যদি ইচ্ছাশক্তি আমাদের প্রবল থাকে। জনসংখ্যা কোন দেশের জন্যই অভিশাপ নয়, বরং আশির্বাদ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে শুধু জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে, এবং সবাইকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে আমাদের।
পরিশেষে একটি কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি— জ্ঞানই মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি। দেশের প্রতিটি মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে পারলেই আসবে প্রকৃত সুখ শান্তি এবং জাগবে প্রবৃত্তি।।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৯ মে, ২০১৪.
Excellent writing!
উত্তরমুছুনThanks!
মুছুনএই মন্তব্যটি একটি ব্লগ প্রশাসক দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে।
উত্তরমুছুনReally you show us actual picture of the society. Please keep it up. God bless you.
উত্তরমুছুনঅতুলনীয় 👍
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুন