সোমবার, ২২ জুন, ২০২০

জীবনের চেয়ে জীবিকার গুরুত্ব কি বেশি?

জীবন বাঁচলেই তো জীবিকা, নয়তো কেন আমি কাজ করবো? আজ পহেলা মে; মহান মে দিবস। বিশ্বজুড়ে করোনা আতঙ্কের মাঝেই চলে এসেছে এবারের এই দিনটি। এবার নাকি সরকার প্রতিপাদ্য বিষয় করেছে— ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, সোনার বাংলা গড়ে তুলি’! মে দিবস আসে বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দিবসের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু বিগত শোয়াশ বছরেও কি শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার পেয়েছে, না-কি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? পারবে কি করে, একজন শ্রমিকই যখন আবার মালিক হয়ে যান, ভুলে যান অতীত, হয়ে যান শোষক!

করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে বার্লিন থেকে বান্দরবান তথা গোটা পৃথিবী যখন থমকে গেছে, সারা বিশ্বের শ্রমিকরা সবায় যখন লকডাউনে গৃহবন্দী, ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা জীবনকে বাজী রেখে জীবিকা ঠিক রাখার অভিপ্রায়ে কর্মক্ষেত্রে চলে আসছে হয়েছে এবং কারখানায় কর্মব্যস্ত। গাদাগাদি করে তারা কাজ করছে, বসবাসও করছে গিঞ্জি এলাকায় ঠাসাঠাসি করে। তাদের নেই ন্যুনতম কোন অধিকার! তবে কেন এবং কিসের জন্য এই মে দিবস?? 

অতি ক্ষুদ্র এই করোনা ভাইরাসের কাছে সারা বিশ্ব আজ কূপকাত! যত হম্বিতম্বিই করুক না কেন বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত এর কোন নিশ্চিত ঔষধই আবিষ্কার করতে পারেননি! কারণ হিসেবে তারা বলছেন, প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটি নাকি বারবার নিজের জিন বদলে উত্তোরত্তর ভয়াবহ হয়ে উঠেছে এবং উঠছে; এরই মধ্যে সে টিকে থাকার স্বার্থে ৩৮০ বার নিজের জিন বদলে ফেলেছে!

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোভিড-১৯ এর এই জিন মিউটেশনই ভয়ের আসল কারণ। যার ফলে বিশ্বের সব বিজ্ঞানীদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সর্বসাধারণের মাঝেও। মাঝেমধ্যেই শোনা যাচ্ছে এবার এই ভাইরাসকে জব্দ করার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু ওসব প্রতিষেধক কতটা কাজের কাজ করতে পারবে তা নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আছেন বেজায় চিন্তায়। 

অথচ আমরা বাঙালিরা আছি মহা শান্তিতে! জীবনের চেয়ে জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে খুলে দেয়া হয়েছে গার্মেন্টসগুলো, কর্মচঞ্চল হয়ে উঠতে শুরু করেছে শহর বন্দর। বলতে গেলে অনেকটা স্বাভাবিকের মতোই হয়ে গেছে ঢাকা শহরের পরিবেশ। করোনা বলে কিছু একটা আছে, মানুষের এ চিন্তাই যেন নেই! অথচ আজও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করেছে দেশে দেশে আরও কঠিনভাবে লকডাউন কার্যকর করতে। কে মানে কার কথা??

ল্যাটিন আমেরিকার ইকুয়েডরে সরকারিভাবে ঘোষণায় এসেছে এ পর্যন্ত ২৪,৯৩৪ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৯০০ জন মারা গেছেন। অথচ সেখানকার চিকিৎসকদের বর্ণনায় উঠে এসেছে সম্পূর্ণ অন্য চিত্র। দ্য জাকার্তা পোস্ট-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কেন্দ্রস্থল গয়াকিলের একটি হাসপাতালের ভয়াবহ বর্ণনা। চিকিৎসকদের মতে সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ রোগীর লাশে ভরে গেছে হাসপাতালটির মর্গ। বাধ্য হয়েই লাশগুলো বাথরুমে স্তূপ করে রাখতে হচ্ছে। 

একজন চিকিৎসক বলেছেন, তারা বাধ্য হয়ে হাসপাতালের বিছানা পুনরায় ব্যবহার করতে সেখানে থাকা লাশ জড়িয়ে রাখতে এবং সংরক্ষণে বাধ্য হয়েছেন। হাসপাতালটির একজন নার্স বলেন, তিনি যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন, এর বিরূপ প্রভাব পেশাগত ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার ওপর পড়েছে। মার্চে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রত্যেক নার্সকে প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ জন রোগীকে সেবা দিতে হতো। এরপর এত রোগী আসতে শুরু করল যে শুশ্রূষা করতে করতে তারাই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। করোনায় সংক্রমিত রোগীদের বেড খালি করতে অনেক রোগীকে অন্য কোথাও যেতে বলা হয়েছে, আবার অনেক রোগীকে বের করে দেয়া হয়েছে।

ওই নার্স আরও বলেন, পরিস্থিতি এমন যে মানুষ একা, দুঃখে, ব্যথায় চিৎকার করতে শুরু করলো, কেউ মলত্যাগ করলো, কেউ অক্সিজেন চেয়ে হট্টগোল শুরু করলো। পরিস্থিতি বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছিল। শুধু হাসপাতাল নয়, মর্গের অবস্থাও অবর্ণনীয় হয়ে উঠলো। মর্গের কর্মীরা আর মরদেহ নিতে আগ্রহী নন। তাই অনেক সময় মরদেহ মুড়িয়ে বাথরুমে স্তূপ করে রাখা হলো। মরদেহের সংখ্যা বেড়ে গেলে সেগুলো একসঙ্গে নিতে আসতো।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য মতে ইকুয়েডরে কোভিড-১৯ রোগে এ পর্যন্ত ২৪,৯৩৪ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৯০০ জন মারা গেছেন বলে প্রকাশিত; সেখানে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের শিকার হয়েছে গয়াকিল শহরটি। এছাড়া এপ্রিলের প্রথমার্ধে ইকুয়েডরের গায়াজ প্রদেশে মোট ৬ হাজার ৭০০ মানুষ মারা গেছেন, যা মাসিক গড়ের তিন গুণ বেশি। কিন্তু সরকার বলছে, সারা দেশে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে ৯০০ জন মারা গেছেন। 

ধারণা করা হচ্ছে, দেশটিতে করোনায় প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক বেশি। সেদেশের  প্রেসিডেন্ট লেনিন মরেনোও এই পরিস্থিতির সত্যতা স্বীকার করেছেন। তিনি মনে করেন, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম দখানো হচ্ছে। গোয়াকিল হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, জরুরি ওয়ার্ডের করিডোরেও লাশ ভর্তি, কারণ মর্গে কোনো জায়গা নেই। ২০ থেকে ২৫ লাশ সরানোর জন্য এখনো অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
একজন চিকিৎসক বলেন, ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন শেষে বাসায় গিয়ে তারা ঘুমাতে পারছেন না। পা ব্যথা হয়ে যায়, দুঃস্বপ্ন তাড়া করে। বাড়িতেও তাদের কঠোর আইসোলেশনে থাকতে হয়। পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ নেই। এটা তাদের মানসিক পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলছে।

আজকে প্রকাশিত আমাদের দেশের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার হেডলাইন, '৮৮১ স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত'! বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন-এর তথ্য মতে— ৩৯২ চিকিৎসকসহ ৮৮১ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত; যা দেশে ঘোষিত মোট করোনায় আক্রান্তের প্রায় ১২ শতাংশ। অন্যদিকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অগুনিত সদস্য করোনায় আক্রান্ত, মৃত্যু সংবাদও কম নয়। যারা আমাদের ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা তাদেরই যদি এই অবস্থা হয়, তবে দেশের সার্বিক চিত্র কি? বিধাতাই ভালো জানেন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে।

অনেকে বিশ্বাস করেন জীবনের চেয়ে জীবিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাদের উদ্দেশ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবারই বলে যাচ্ছে— 'স্বাস্থ্যই সত্য, স্বাস্থ্য রাজনৈতিক এজেন্ডার শীর্ষে থাকার যোগ্য। স্বাস্থ্যই অর্থনীতির চালিকাশক্তি। স্বাস্থ্য ছাড়া অর্থনীতি অচল, সেই সাথে নেই জাতীয় নিরাপত্তা।' আমাদের দেশ এই ব্যাপারে নজর দিচ্ছে বলে মোটেও মনে হয় না। দায়সারা গোছের একটা লকডাউন ঘোষণা করেই তারা দায়মুক্তির চিন্তা করছে।

নিঃসন্দেহে সরকারের হযবরল সীদ্ধান্ত দেশবাসীকে মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে দিচ্ছে। বেশিবুঝা আধমরা বাঙালি জীবনের চেয়ে জীবিকার মূল্য বেশি দিতে গিয়ে অতীতেও যেমন মরেছে, এবারও মরবে! দেশের কর্তাব্যক্তিদের স্মরণ রাখা উচিত- কোন অবস্থাতেই জীবনের চেয়ে জীবিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। অতএব, সাধু সাবধান!!

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১ মে, ২০২০.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন