মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০২৪

কিছু সহজ কথা :

আমরা যখন ছোট ছিলাম, সেই ছোট্টটি থেকেই মাঠ ঘাট প্রান্তর চষে বেড়িয়ে বড় হয়েছি; বৌ ছি, দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, হা-ডু-ডু, কাবাডি, ভলিবল, ফুটবল কত কি খেলেছি। কোন গাছে কোন পাখির বাসা আছে, কার গাছে কোন ফল ধরেছে, কোন গাছে কলা পেকেছে, কার গাছের আম মিষ্টি, কার মুরগী কয়টা ডিম পেড়েছে, কার গাই কোন রঙ্গের বাছুর দিয়েছে এসব ছিল আমাদের নখদর্পণে। বাবা বলতেন - বেশি বেশি সবুজের দিকে তাকাতে, মাটির দিকে চোখ রাখতে; এতে নাকি চোখের জ্যোতি বাড়ে, সহ্য ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। 
শহরের বাচ্চারা এখন আর এসব কল্পনাও করতে পারে না; গ্রামের বাচ্চাদের মাঝ থেকেও এখন এসব হারিয়ে যেতে বসেছে, তাদের মাঝেও প্রযুক্তি নির্ভরতার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে; তারাও এখন আক্রান্ত হয়ে পরেছে স্মার্টফোন বা ট্যাব নামের এইসব মস্তিস্কের কোষ নিধনকারী ভাইরাসে; পৃথিবীর সমগ্র শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশে এখন সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক আধুনিক প্রযুক্তি নামের এইসব যন্ত্রদানব।

অনেক বাবা-মা হয়তো যুক্তি দেখিয়ে বলতে পারেন যুগের চাহিদা মেটাতে এসবের বিকল্প কি? প্রোগ্রামিং বাচ্চাদের মেধা বিকাশে ভূমিকা রাখে,  ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু একবার ভাল করে ভেবে দেখেছেন কি, বেশিরভাগ বাচ্চারা স্মার্টফোনের কোন কোন দিকে আসক্ত?

গত বছর আমার মেয়ে যখন ইউরোপ থেকে দেশে বেড়াতে আসে তখন প্রথম প্রথম তিন বছরের নাতিকে দেখতাম সারাক্ষণ সে মোবাইলে পরে থাকছে; ব্যাপারটা আমার কাছে অসহনীয় লাগত। তিন বছরের একটা ছোট্ট শিশুর স্মার্টফোন চালানোর দক্ষতা দেখে আমার কাছে তা অনেকটা বিষ্ময়ই মনে হতো। তখনো সে লিখতে শিখেনি কেবল টুকটাক কথা বলতে শিখেছে, দেখি মুখের শব্দ দিয়ে মা'য়ের স্মার্টফোনে ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও খুঁজে বেড়াচ্ছে, বিভিন্ন গেম বা মারপিটের ভিডিও আনছে, চুপচাপ বসে বসে ঐসব দেখছে, হাসছে বা চোখেমুখে হাতপায়ে মারামারির অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে; মোবাইল স্কিন থেকে কখনো মুখ তুলেও অন্য দিকে তাকাচ্ছে না। 
এইসব দেখে তাকে দেখিয়ে আমিও কায়দা করে আমার ফোনে কয়েকটা কার রেসের গেম ডাউনলোড করলাম এবং তাকে দেখিয়ে সেসব খেলতে শুরু করলাম; এতে দেখি সে আমার দিকে আকৃষ্ট হতে শুরু করেছে; তবে, মোবাইল তার চাই-ই-চাই। মেয়েকে বললাম - এ তুই কি করেছিস? ওকে স্মার্টফোনে অভিজ্ঞ করে আসক্তি করিয়েছিস কেন? 
সে যা বলল তা মোটামুটি এরকম- সারাদিন তোমাদের জামাই থাকে কাজে, আমিও নানান কাজে ব্যস্ত থাকি, ঘরে ও একা কি করবে? আমাকে সারাক্ষণ বিরক্ত করে; ফোনটা হাতে দিলে আর কোন বিরক্ত করে না। 

মেয়ের কথা শুনে আমার তো আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা। ভাবতে থাকলাম এই ছোট্ট শিশুটিকে কি করে এই অসক্তি থেকে বের করে আনা যায়। প্রথমেই লক্ষ্য করলাম ইউটিউবে সে কি দেখে? দেখি, কার্টুন দেখছে নয়তো মারামারি বা  গাড়ির রেস; ভিডিও গেমস-এ কার রেসিং করছে। ভাবতে ভাবতে আমি তার সাথে মারামারি করা শুরু করে দিলাম; সেও নানীর কাছ থেকে লাঠিটাঠি যোগার করে প্রথম প্রথম আমাকে মারতে শুরু করল, আমিও পাল্টা মারের অভিনয় করতাম; ইয়া হু বলে সে আমাকে কিক মারতে শুরু করল। মেয়ে তো আমার উপর ক্ষেপেই গেল; ভাবল আমি তার ছেলেকে বেয়াদব বানাচ্ছি, খারাপ করে দিচ্ছি। দুদিন পরই দেখা গেল স্মার্টফোন আসক্তি তার অনেকটাই কমতে শুরু করেছে। এখন যখনতখন সে ইয়া হু, ডিসুম ডাসুম করে আমার উপর ঝাপিয়ে পরতে শুরু করল, ছোট্ট মুষ্ঠিতে ঘুসি মেরে আমাকে কাত করে ফেলে দিতে পারলে তার সে কি আনন্দ, হা হা করে অট্ট হাসিতে ফেটে পরছে। কয়েক দিনেই সে আমার খুব লউগ্গা হয়ে গেল। 

ইউরোপে জন্ম নেয়া রোগশোকমুক্ত দূষণমুক্ত একটি শিশু এদেশের এই বিষাক্ত আবহাওয়ায় কতটা খাপ খাওয়াতে পারে নিজেকে? সেও বেশ কিছুদিন পারেনি, বাইরে বেরুলেই তার গায়ে ফোসকা উঠে যেত; ঢাকা শহরের দূষণ তার শরীরে একেবারেই সহ্য হতো না। তারপরও একদিন মেয়েকে না জানিয়ে চুপিচুপি আমি নাতিকে নিয়ে বাইরে বের হলাম, তার ইচ্ছে মতো ফল খেলনা কিনে নিয়ে এলাম। আস্তে আস্তে নাতিকে নিয়ে প্রকৃতিতে চলে যেতাম, রিক্সায় বা হেটে দুজনে রাস্তায় বের হয়ে যেতাম। 
এভাবেই তাকে একে একে এদেশের আবহাওয়া খাদ্য মাটি ও মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকলাম। বাসে চড়ার তার খুব সখ ছিল, তাই আমি মাঝেমধ্যেই ফাঁকা বাস পেলে তাকে নিয়ে এই ষ্টপিজ ঐ ষ্টপিজ করতাম। প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা খেলনা তাকে কিনে এনে দিতাম এবং ওটা নিয়ে তার সাথে কিছুটা সময় খেলতাম। বেশ কয়েক মাস তারা দেশে ছিল; এরই মাঝে লক্ষ্য করলাম আগের সেইসব বদ অভ্যাসগুলো তার থেকে অনেকটা দূর হয়ে গেছে।  

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্মার্টফোন থেকে নিঃসরিত তেজস্ক্রিয় রশ্মি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে আমাদের ডি এন এ-কে। কোন কারণে মস্তিষ্কের কোষের ডি এন এ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা স্নায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন শারীরিক কাজের প্রচন্ড ক্ষতিসাধন করে। শিশুদের মস্তিস্কের কোষ বা নিউরণ অত্যন্ত নরম বলে স্মার্টফোন বা ট্যাব তাদের মারত্মক ক্ষতি করছে। বিজ্ঞানী হাইল্যান্ড বলেছেন - তড়িৎ চুম্বকীয় দূষণের কারনেই বেশিরভাগ শিশুরা এপিলেপসি ও অ্যাজমারোগে ভুগছে। চোখের খুব কাছাকাছি দূরত্বে রেখে শিশুরা স্মার্টফোন বা ট্যাব ব্যবহার করে বলে ধীরে ধীরে তারা মাথাব্যথা, চোখ ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, শ্রবণশক্তি হ্রাস - এরকম নানান সব সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশে সবচেয়ে বড় বাধা স্মার্টফোন বা ট্যাব নিঃসরিত তেজস্ক্রিয় রঙ্গিন রশ্মি।  হূ-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমান বিশ্বে যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছর, তাদের মাধ্যে শ্রবণশক্তি হ্রাসের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে।

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি মানব সভ্যতা বিকাশে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য; এসব ছাড়া একটি দিনও আমাদের কল্পনা করা যায় না। প্রযুক্তিই স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে মানুষকে, রোগ সুখ ভোগ তৃপ্তিতে সহজ স্পর্শ এনে দিয়েছে, কিন্তু শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্রযুক্তিই।

  'আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ’ এ সত্যটা আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারলেও, একটি শিশুকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তার মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধি, মেধা ও মননের বিকাশ ঘটাতে পিতা-মাতা তথা পরিবার ও সমাজের কী করা উচিত তা নিয়ে আমরা মোটেও সচেতন নই। এসবের জন্য অশিক্ষা, কুসংস্কার অজ্ঞতাই যে প্রতিবন্ধক তা কিন্তু নয়; শিশুদের প্রতি পারিবারিক উদাসীনতাই এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।  

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৮ এপ্রিল, ২০১৭.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন