মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০২০

'শিক্ষা' নিয়ে কিছু সোজা কথা:

'পোষাক হচ্ছে বাইরের আবরণ, মানুষের আসল সৌন্দর্য হলো তার জ্ঞান।'—উক্তিটি কার নিশ্চয় ধরে ফেলেছেন? 'Try to know thyself' বলা সেই মহান শিক্ষক সক্রেটিসের। খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০, পৃথিবীর আলোতে এসেছিলেন এই মহান মনীষী; যাকে বলা হয় আজকের প্রথাগত শিক্ষার পথ-প্রদর্শক ও প্রবর্তক। স্কুলিং করে জ্ঞানের প্রদীপ্ত শিখা জ্বালিয়ে তিনিই শিক্ষার আলোতে আলোকিত করে এই পৃথিবীকে উদ্ভাসিত করে গিয়েছিলেন। অবশ্য আমরা বেশিরভাগ তাঁকে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক হিসেবেই চিনি ও জানি। এই মহান দার্শনিক সম্পর্কে জানার জন্য আজকের প্রজন্ম তেমন একটা আগ্রহ প্রকাশ করে না বা জানতেও চায় না। অনেকে আবার প্রশ্ন করে বসে, এই সব জেনে কি লাভ? 

ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে মনীষীদের জীবনী থেকে প্রকৃত জ্ঞানের অন্বেষণে প্রকৃতি থেকে প্রকৃতপক্ষে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ বলে আমি মনে করি। প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি থেকে যতোটা শিখতে পারা যায় তা অন্য কারো কাছ থেকে বা বইপুস্তক পাঠ করে শিখতে পারা যায় বলে আমার মনে হয় না। মহান মনীষীগন তাঁদের জীবনী থেকে সেই শিক্ষাই আমাদের দিয়ে গেছেন। এই সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে আজ পর্যন্ত একটিবারের জন্যও আমার মনে হয়নি আমি একজন শিক্ষক, সব সময় মনে হয়েছে আমি একজন শিক্ষার্থী; সত্যিকার অর্থে ছাত্রছাত্রীদের সাথে থেকে আমি শিখেছি, শিখছি, প্রতিক্ষেত্রে প্রতিপদে। আর এই শিক্ষা হেকেই দু চার কথা লেখতে চেষ্টা করি। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হলো সত্যিকারের জ্ঞানার্জন। জ্ঞানহীন শিক্ষা সলতেহীন মোমবাতির মতো। শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা দিয়েই যা অর্জন করা মোটেও সম্ভব নয়। তাই আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের সব সময় বলি বেশি বেশি বই পড়তে এবং সুযোগ পেলেই প্রকৃতির সাথে মিশতে। 

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন আমাদের শিক্ষকরা আশপাশ, প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং মনীষীদের জীবনী থেকে আমাদের অনেক বেশি শিক্ষা দিতেন, তখনকার দিনের জাতীয় পাঠ্যপুস্তকও সেইভাবেই সাজানো ছিল। প্রায় প্রত্যেক পাঠ্যবইয়েই বিখ্যাত মনীষীদের কারো না কারো জীবনী সম্পৃক্ত থাকতো। কিন্তু কেমন করে পরে একসময় সেইসব তুলে নেয়া হয় তা টেরই পাইনি। না থাকলে কতটা দোষই-বা এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দেয়া যায়? দোষ তো আমাদের। আজও আমরা পারিনি এদেশের জন্য একটা সঠিক সুনির্দিষ্ট একক শিক্ষানীতি প্রবর্তন করতে, শিক্ষাকে একটা পূর্ণাঙ্গ কাঠামোতে দাঁড় করাতে। হযবরল শিক্ষানীতি পদ্ধতি ও ব্যবস্থা দিয়েই যেনতেন ভাবে যেন ঠেকার কাজ এই দেশে চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। জাতি গঠনে শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা আজও এ জাতীর গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তির কেউ অনুধাবন করতে পারেনি বা করেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে বা হচ্ছে - শিক্ষার মান নামতে নামতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। 

আমার এই কথায় হয়তো অনেকেই দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন, কষ্ট পেতে পারেন। এবং এ ও জিজ্ঞেস করতে পারেন, যে সব লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী প্রতিবছর মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছে তারা কি সবাই অজ্ঞানী? তারা মানসম্পন্ন শিক্ষিত নয়? আমি মোটেও তা বলছি না। অনেকেই বেশ ভাল করছে। তাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। দেশের সার্বিক শিক্ষার কথা বিবেচনায় এনে প্রকৃত জ্ঞানের সংজ্ঞায় ফেললে হয়তো আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন মোল্লার দৌঁড় কত? আপনি যদি একটু চোখকান খোলা রেখে থাকেন তবে নিজেই টের পাবেন ওদের আসল সমস্যাটা কোথায় এবং কি? 

আমি অনেক চিন্তা করে আবিষ্কার করেছি - প্রকৃতির সাথে বেড়ে উঠা ছেলেমেয়েরাই তুলনামূলকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে নিজেদের স্থান বেশি করে নিচ্ছে, মাশরাফি বা মোস্তাফিজুর হয়ে দেশের সম্মান উজ্জ্বল করছে। সাংসারিক সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রায় প্রতিক্ষেত্রে একটু লক্ষ করলেই টের পাবেন শহুরে হাইব্রিড মুরগীর মত বেড়ে উঠা ছেলেমেয়েরা অনেকটা পিছিয়ে পরছে। এতে করে এরই মধ্যে একটা বিরাট কমিউনিকেশন গ্যাপ এর সৃষ্টি হয়ে গেছে। শুধুমাত্র অর্থের মাপকাঠিতে ফেলে চিন্তা করলে হবে না, সার্বিক দিক বিবেচনায় আনতে হবে। নতুন প্রজন্ম অত্যন্ত ধীর গতিতে হাঁটছে এবং সামাজিকভাবে অনেক পিছনে পরে আছে। সক্রেটিসের " Try to know thyself "-এ পরে তারা তাদের নিজেদের দুর্বলতার কথা ঠিকই জানতে পারছে, যা তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যতার বড় বেশি অভাব বোধ করছে। পোশাকি চাকচিক্যে মেকী জ্ঞান অনেকটা ঠুনকো কাঁচের মতই হয়। 

আগের দিনের একজন মেট্রিক পাশের জ্ঞানের কাছে আজকের দিনের একজন মাষ্টার্সও ঘেষতে পারছে না। আজকের অনার্স মাষ্টার্স করা কাউকে যদি প্রকৃত মৌলিক সংখ্যা কয়টি ও কি কি প্রশ্ন করা হয়, দেখা যায় খুব কম সংখ্যকই এর সঠিক উত্তর দিতে পারছে। কাউকে যদি বলা হয় হাতে হাতে বর্গমূল বের করতে, সে এক লজ্জাসকর মহা মুশকিলের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মৌলিক বিষয়গুলো এখন আর বইপুস্তকে সন্নিবেশিত করা হয় না। যতোটুকোইবা আছে প্রযুক্তির কল্যাণে শিক্ষকরা তাও শিখাচ্ছে না; যোগ অংঙ্ক শিখাচ্ছে মোবাইল বা ক্যালকুলেটর দিয়ে। তাই আজকের প্রজন্ম সম্পূর্ণভাবে মৌলিক শিক্ষা বঞ্চিত হয়ে বড় হচ্ছে এবং মৌলিক বিষয় শিক্ষার প্রতি তাদের অনাগ্রহও দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত অশিক্ষিত প্রায় সকল অভিভাবকই এখন বাণিজ্যিক শিক্ষার পিছনেই ছুটছে। 

নতুন এক প্রথা চালু হয়েছে, গ্রামের সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদেরও এখন শহর কেন্দ্রিক শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বাচ্চার শিক্ষার ক্ষেত্রে কোথায় ভর্তি করালে কার কাছে গেলে কি করে কত সহজ উপায়ে একটা A+ পাওয়া যায় এটাই যেন সবার এক মৌন প্রতিযোগিতা এবং সকলের একমাত্র প্রচেষ্টা। কতটুকো জ্ঞানার্জন করে বাচ্চাটা বড় হচ্ছে তা জানার কারো মোটেও আগ্রহ নেই। A+ পেলেই আমরা সবায় বুঝে নেই সে একজন ভাল ছাত্র; বুয়েট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকুক বা না টিকুক। কতটা জ্ঞানার্জন করে কি ভাবে এই A+ পেয়েছে তা আমরা ভেবে দেখি না। কি করে প্রকৃত জ্ঞানার্জন করা যায় এ নিয়েও আমাদের কারো কোন ভাবনাচিন্তা নেই। তাই, দিনদিন এদেশে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু তুলনামূলকভাবে শিক্ষার মান কমছে। 

সেন্ট নিকোলাস স্কুলে আমাদের গণিত শিক্ষক ছিলেন সচীন স্যার। ব্রিটিশ আমলে শুধুমাত্র মেট্রিকুলেশন করে তিনি সেন্ট নিকোলাস স্কুলের মত আমেরিকান ব্রাদারস পরিচালিত স্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত গণিত ক্লাস নিতেন এবং যে কোন ধরনের গণিতের সমাধান তিনি অতি সহজ ও সাবলীল অনন্য একাধিক পদ্ধতিতে অনায়াসে করে দিতেন। একটা অংককে যে কত ভাবে কত পদ্ধতিতে তিনি সমাধান করতে পারতেন এবং কত সহজভাবে আমাদের তা বুঝাতে পারতেন সে কথা মনে হলে আজও শিহরিত হই। এতো সুচারুভাবে তিনি গণিত শিখাতেন যা সেই স্কুলের অন্য কারো পক্ষে আদৌ সম্ভব ছিল না। 

সেই সময় ঐ স্কুল বা অন্য কোন স্কুলের বিএসসি এমএসসি টিচাররাও গণিত নিয়ে অন্তত তাঁর সাথে টেক্কা দিতে সাহস পেতেন না। প্রধান শিক্ষক সহ তৎকালে সেন্ট নিকোলাসে ৪/৫ জন ইংরেজ ব্রাদারস সব সময় থাকতেন; দেখেছি তাঁরাও সচীন স্যারকে 'পণ্ডিত স্যার' বলে বেশ সমিহ করতেন। ঐ স্কুলের ছাত্ররা নিশ্চয় নির্দ্বিধায় স্বীকার করবে তৎকালে গণিতের জন্য 'সচীন স্যার'-এর বিকল্প অন্য কেউ ছিলেন না। আমার প্রিয় শিক্ষক এই সচিন স্যার। প্রকৃতপক্ষে, যতটুকো মৌলিক গণিত আমি শিখেছি বা শিখতে পেরেছি তা এই স্যারের কাছ থেকেই শিখেছি। উচ্চ শিক্ষায় যা হয়েছে তা হলো শুধু সংযোজন আর সংবর্ধন। ছাত্র জীবনের বিন্যাস-সমাবেশে শিক্ষকতার শেষ জীবনে এসে আজ আমার কাছে মনে হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে স্কুল জীবনটাই হলো মৌলিক শিক্ষা অর্জনের উৎকৃষ্ট ও প্রকৃত সময়। 

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিক্রমায় সব কিছুর পাশাপাশি এদেশের জাতীয় পাঠ্যপুস্তকও বদলে যায়! প্রতিযোগীতা করে বই সংশোধন সংবর্ধন ও পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়। এই দলকানা জাতি সব সময় যে যার দলের হয়েই পক্ষপাতমূলক কাজ করে চলছে; তাও ঐ অশিক্ষারই জন্য। উপড়ের নির্দেশ পবিত্র বাণী সম তারা আওড়াচ্ছে। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করলে এই কথাটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে এদেশে শিক্ষা সব সময় সবার কাছেই একটি অতি উপেক্ষিত বিষয় হয়েই রয়ে গেছে। অন্য সব সেক্টরে উন্নতি উন্নয়ন হলেও শিক্ষার ক্ষেত্রে কতটা উন্নতি ঘটেছে তা সর্বজনবিদিত। অনেক চিন্তা করে আমি আবিষ্কার করেছি এতো এতো জ্ঞানীগুণী এদেশে জন্ম নেয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষা নিয়ে কোন বড় ধরনের হইচই বা বিপ্লব ঘটেনি। ভাবছি, কেন হয়নি? 

শিক্ষার্থীর স্বার্থ রক্ষার্থে আজও এদেশে কোন বড় ধরণের আন্দোলন হয়নি। যা হওয়ার দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি এবং সব কিছুর আগে। কোন দলই শিক্ষা নিয়ে কখনো কোন বড় ধরণের উচ্চবাচ্য করেনি; এমন কি শিক্ষকরাও। একমাত্র ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকে দেখেছি একমুখী শিক্ষা, প্রশ্নপত্র ফাঁস বা শিক্ষার মৌলিক বিষয়গুলি নিয়ে ছাত্রছাত্রীর স্বার্থে রাস্তায় নামতে। অথচ এই মহান শিক্ষককেই এদেশের কোন দল দেখতে পারে না। একদল মনে করে জাফর ইকবাল তাদের শত্রু, অন্যদল তাদের দলীয় দৃষ্টিকোণের ব্যত্যয় ঘটলেই অপদস্থ অপমানিত করে। এদেশে অন্যরাও আন্দোলন করেছে, তবে যতটুকো করেছে তা হয়তো করেছে ব্যক্তিস্বার্থে নয়তো গোষ্ঠীস্বার্থে; শিক্ষকরা করেছে তাদের বেতনভাতা বৃদ্ধি বা অন্য কোন সুবিধার স্বার্থে, অন্যরা করেছে দলীয় স্বার্থে। জাতি গঠন ও শিক্ষার স্বার্থে, ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে, শিক্ষার মান উন্নয়নের স্বার্থে এদেশে কেউ কখনো কোন আন্দোলন করেছে কি? যদি করতো, তাহলে হয়তো আজ শিক্ষা এতোটা উপেক্ষিত থাকতো না; শিক্ষাকে সর্বাপেক্ষা গুরুত দেয়া হত এবং একটি সুন্দর জাতি গঠিত হত। 

তৎকালীন গ্রিস ছিল পৃথিবীর অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর মতই অত্যন্ত গোষ্ঠী প্রাধান্য বিস্তারকারী অসভ্য জাতির একটি। সেই সমাজে জ্ঞানের প্রদীপ প্রজ্বলিত করেছিলেন সক্রেটিস। তিনি ছিলেন মহান অসাধারণ একজন শিক্ষক। যিনি কেবল শিষ্য গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানে বিশ্বাসী ছিলেন না, শিষ্য বানিয়েও শিক্ষা দিতেন। তাঁর কোন নির্দিষ্ট শিক্ষায়তন ছিলনা। যেখানেই যাকে পেতেন সেখানেই তাকে মৌলিক প্রশ্নবানে জর্জরিত করতেন এবং উত্তর বোঝানোর চেষ্টা করতেন। তিনিই প্রথম মানব চেতনায় আমোদের ইচ্ছাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন এবং ইচ্ছার নিন্দাও করেছিলেন। কিন্তু ইচ্ছার সৌন্দর্য্য দ্বারা নিজেও আনন্দিত হয়েছিলেন অপরকেও আন্দোলিত করেছিলেন। মহান মনীষী প্লেটো তাঁরই একজন সার্থক ছাত্র। সক্রেটিস সম্বন্ধে আমরা যতোটুকু জেনেছি তা এই প্লেটোর কল্যাণে; কারণ সক্রেটিস কোন বই লিখে যাননি। 

আড়াই হাজার বছরেরও আগে পৃথিবীতে আসা এই গ্রিক শিক্ষক ও দার্শনিককে আমরা চিনি শুধুমাত্র একজন জ্ঞানের প্রদীপ প্রোজ্জ্বলনকারী হিসেবে। এই সক্রেটিস কখনো খাবার পেতেন আবার কখনোবা ভূখা থাকতেন। অজ্ঞানী ধনীক সুবিধাভোগীর দল জ্ঞানী সক্রেটিসকে মেনে নিয়ে পারেনি, তাই মিথ্যা অপবাদ দিয়ে 'হেমলক' নামক বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছিল। পরবর্তীতেও শুধুমাত্র জ্ঞানের জন্য অজ্ঞানীরা অনেক জ্ঞানতাপসকেই মেরে ফেলেছিল; কিন্তু জ্ঞানের প্রদীপ্ত শিখা কিন্তু থেমে থাকেনি। 

মহান শিক্ষক সক্রেটিসের মাত্র একজন ছাত্র প্লেটোর মাধ্যমে আজ পৃথিবীতে জ্ঞানের প্রদীপ্ত শিখা প্রোজ্জ্বলীত, দাউ দাউ করে জ্বলছে। সেই সব ধনীদের কিন্তু আজ আর কেউ চিনে না জানেও না। আমাদের যুগের এদেশেরই হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক জহিরুল ইসলামকে এখনকার প্রজন্ম আর চিনেই না! তার সম্পদের খবর এখনই আর কেউ জানে না। কিন্তু জ্ঞানের যে প্রদীপ্ত শিখা সক্রেটিস তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন প্লেটোর হাতে, সেই প্লেটো তা তুলে দিয়েছিলেন এরিস্টটলের হাতে, এরিস্টটল দিয়েছেন আলেকজান্ডার দি গ্রেটকে, আলেকজান্ডার দি গ্রেট সাড়া পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। 

তাই, শুধুমাত্র অর্থ-যশের লোভ না করে প্রত্যেকের উচিত প্রকৃত জ্ঞান অন্বেষণ করা। আর এই দীক্ষাই আমাদের সবার নেয়া-দেয়া উচিত; সন্তানকে বলা উচিত- পড় এবং কিছু শিখতে চেষ্টা কর।।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
০৭ - ১২ - ২০১৫।

শনিবার, ২৭ জুন, ২০২০

'হুজুর' বিশেষণটি কি খাস নয়?

খোদা বলা যাবে না, আল্লাহ বলতে হবে! নামাজ বলা যাবে না, সালাত বলতে হবে! রোজা বলা যাবে না, সাওম বলতে হবে!......... আরো  কত কি যে ফেতনা, বলে আর শেষ করা যায় না যাবে না! এসব করছে কারা? ইহুদী-নাসারা? মোটেও তা না; ইহুদী-নাসারা এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজ এখন আমরা মুসলমানরাই ব্যপকভাবে হাতে নিয়েছি। বুঝে কিছু কায়িক স্বার্থলোভে বা না বুঝে অনেকেই আবার বোকার মতো সেসব বাস্তবায়নও করছি।       

‘হুজুর’ শব্দটা আমাদের সমাজে এখন বহুল প্রচলিত; সাধারণতঃ ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মাদ্রাসায় পড়ানেওয়ালা কোন আলেম বা মসজিদের ইমাম, এমনকি দ্বীনদার-পরহেযগার মানুষদেরকেও আমরা  ‘হুজুর’ বলে সম্বোধন করে থাকি। 'হুজুর' শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো— উপস্থিত হওয়া। পরিভাষাগত ব্যবহাতে সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মানসূচক সম্বোধনে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত; যেমন—নৃপতি, বিচারপতি, মনিব ইত্যাদির ক্ষেত্রে সম্মানসূচক বিশেষণে শব্দটি প্রয়োগ হয়। বাংলা ভাষায়— সাধারণত জনাব, মহাশয়, মহোদয় ইত্যাদি এবং ইংরেজিতে স্যার-এর মত সম্মানসূচক বিশেষণে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। 

ইসলামের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় নবী কারীম (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে হুজুর শব্দের ব্যবহার পূর্বযুগে ব্যাপক প্রচলিত ছিল এবং এখনো কোন কোন মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে শব্দটি ঠিক আগের মতোই প্রচলিত আছে; এখানে মূলতঃ হুজুর পাক (সাঃ)-কে সম্মান দেখানোর নিমিত্তে একমাত্র তাঁর শা'নে এ শব্দটি প্রয়োগ করা হতো এবং হয়ে আসছে। এখন প্রশ্ন আসে— তাহলে 'হুজুর' শব্দটি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য খাস, নাকি যে কারো সাথে এই শব্দটি ব্যবহার করা যায় বা যাবে? 

পবিত্র কালাম পাকে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন, 'ইয়া আইয়ুহাল্লাযীনা আ-মানু লা-তাকুলু রা-'ইনা ওয়া কুলুন ঊনযুরনা ওয়াসমাঊ ওয়া লিল কা-ফিরীনা আযা-বুন  আলীম।' অর্থাৎ— 'হে মু'মিনগণ! তোমরা 'রায়িনা' বলো না, ঊনযুরনা' বল এবং শুনতে থাকো;আর কাফেরদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। –[সুরা বাকারা; ১০৪]

এই আয়াতের আভ্যন্তরীণ বিষয় বুঝানোর জন্য সংক্ষেপে আয়াতটি নাজিল হওয়ার প্রেক্ষাপট আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে হিযরত করে মদীনায় যান, তখন মদীনার চারপাশে অতি দ্রুত  ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। সেই অবস্থায় ইহুদীরা স্থানে স্থানে মুসলমানদেরকে ধর্মীয় বিতর্কে জড়িয়ে তাদেরকে ব্যস্ত রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত হলো। তাদের উল্লেখযোগ্য বাধা-দানকারী কার্যক্রমগুলি ছিল—

১). তুচ্ছ ব্যাপারকে কেন্দ্র করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটানো। 
২). গুরুত্বহীন বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের অবতারণা করা। 
৩). অপপ্রচারের মাধ্যমে নব্য মু'মিনদের অন্তরে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করার চেষ্টা। 
৪). প্রশ্নের উপর অনর্থক প্রশ্ন করে কুরআন ও মহানবী [হুজুর পাক (সাঃ)]-এর বক্তব্যকে দূর্বোধ্য করে তোলা; এবং 
৫). নবী কারীম (সাঃ)-এর মজলিসে বসে প্রতারণামূলক কথাবার্তা বলে গোলযোগ সৃষ্টি করা।

পবিত্র কুর'আনুল কারীমের উক্ত রুকু হতে পরবর্তী রুকুগুলোতে মহানবী (সাঃ)-এর অনুসারী তথা মু'মিনদেরকে এসব অনিষ্টকর কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, যা তাদের বিরুদ্ধে ইহুদীরা করছিল। সেসব সন্দেহ-সংশয়ের জবাবও দেয়া হয়েছে, যেগুলো তারা মুসলমানদের অন্তরে সৃষ্টির অপচেষ্টা করছিল।

'রায়িনা 'শব্দটির অর্থ 'আমাদের একটু সুযোগ দিন'; কিন্তু ইহুদীদের ভাষায় এর অর্থ 'শোনো, তুমি বধির হয়ে যাও'। তাফসীরের কিতাবে এসেছে— ইহুদীরা যখন মুসলমানদেরকে মহানবী (সাঃ)-এর কথা ভাল করে বুঝে নেয়ার উদ্দেশ্যে শব্দটি ব্যবহার করতে দেখল, তখন তারা এটাকে সুযোগ হিসেবে গণ্য করে তাদের ভাষায় ব্যবহৃত গালির অর্থে এই শব্দটি প্রয়োগ করতে লাগলো; আবার কখনো-বা তারা শব্দটির উচ্চারণ একটু টেনে বা দীর্ঘ স্বরে 'রা—ঈয়ানা'-ও বলার চেষ্টা করতে লাগলো; যার অর্থ দাঁড়ায় 'ওহে আমাদের রাখাল'! 

এর পিছনের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাহমাতুল্লিল আলামীন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তুচ্ছজ্ঞান ও অপদস্ত করা। অন্য এক হাদিসে এসেছে, ইহুদিরা যখন কোন মুসলমানকে সালাম করতো, তারা তখন এই ভাবে বলতো, আস সামু আলাইকুম; ওরা ‘সালামু’ না বলে মুখের ভিতর রেখে ‘সামু’ বলতো। এখানে সামু শব্দের অর্থ মৃত্যু; মূল অর্থ দাঁড়ায়— আপনার উপর মৃত্যু আসুক। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মুসলমানদেরকে এর উত্তর শিখিয়ে দিয়েছিলেন এভাবে— তারা যেন বলে শুধু ‘ওয়ালাইকুম'; অর্থাৎ তোমার উপর ও তাই হোক। যাই হউক, ইহুদীদের এই ছলচাতুরি বন্ধ করার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা মু'মিনদেরকে 'রাইনা' শব্দটি  বর্জন করতে ঘোষণা দিলেন, এবং এর একার্থবোধক শব্দ 'ঊনযুরনা' অর্থাৎ— 'আমাদের প্রতি নজর দিন' বলতে নির্দেশ দিলেন। 

মূল কথা হলো রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর শা'নে বিশেষণ ব্যবহার বা কোন শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাবধানতার বিষয়টি আমরা এ আয়াত থেকে স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারি।
স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত মু'মিনদেরকে যথাযথ কুলুষমুক্ত শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন যে— 'রাইনা' বলো না, বরং বলো 'উন্‌যুর্‌না'; যার অর্থ 'আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন' বা 'আমাদের প্রতি দৃষ্টি দিন' অথবা 'আমাদেরকে একটু বুঝতে দিন'।

আজকালকার দিনে আমরা খাসভাবে হুজুর শব্দটি ব্যবহার করছি, কিন্তু প্রাক যুগে শব্দটির এমন ব্যপক প্রচলন ছিল না; হযরত আবু বকর (রাঃ), ওমর (রাঃ) উসমান (রাঃ), আলী (রাঃ)-র নামের আগেও কেউ এই শব্দটি ব্যবহার করেননি। অথচ কালে কালে আমরা সবাই হয়ে গেছি হুজুর, আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষণ দিয়েছি জনাবে রাসুলুল্লাহ! হায়রে মুসলমান!  

ইহুদীদের অপকাজগুলো এখন মুসলমানরাই করছে, পদে পদে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অপমান-অপদস্ত করার মতো বিষয়ে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে! শিক্ষা গ্রহণ করছে না মহান রাব্বুল ইজ্জতের কাছ থেকেও। পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে যেখানেই মহান রব হুজুর পাক (সাঃ)-কে সম্বোধন করেছেন, সেখানেই তিনি  বিশেষ বিশেষণে সম্বোধন করেছে, বিশেষভাবে   ডেকেছেন; যা অন্যান্য নবী-রাসুলদের বেলায় দেখা যায় না, বাকী সকল নবী-রাসুলদের তিনি নাম ধরে ডেকেছেন। 

যাঁর জন্য ইসলাম ও ঈমান,  সেই হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শা'ন ও মান খর্ব করার উদ্দেশ্যে বেয়াদবি করে কি নিজেকে মুসলমান দাবী করা যায় বা যাবে? তাই, বলি কি— হে মুসলমান! জ্ঞানের প্রদীপ্ত শিখা জ্বালাতে চেষ্টা করুন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে অন্তর থেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে এসব বন্ধ করতে। দেখবেন, পৃথিবী আবার সুন্দর হয়ে যাবে এবং সমগ্র পৃথিবীকে আবারও মুসলানের করতলে করে দেবেন মহান রব।। 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২৭ জুন, ২০২০.

প্রজন্ম ভাবনা:

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের নতুন নতুন অনেক কিছু দিয়েছে এবং দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রতি মিনিটে একেকটি নতুন ইলেক্ট্রিক-ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইস উদ্ভাবিত হচ্ছে এবং আমাদের  জীবনের সাথে সেসব সংযুক্ত হচ্ছে। এ'সবকে স্বাগত জানিয়ে সাথে সাথেই আমরা সুবিধা গ্রহণ করে পৃথিবীবাসির সাথে একাত্ম ঘোষণা করছি। সারা বিশ্বব্যাপি বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রা অগ্রগতি অগ্রযাত্রা অসম্ভবভাবে অব্যাহত। শুনতে কঠিন শোনালেও নির্মম বাস্তবতা হলো— এই যান্ত্রিকতা দিনে দিনে আমাদের জীবনের সব কিছুকে গ্রাস করে ফেলেছে এবং ফেলছে, কেড়ে নিচ্ছে আমাদের প্রাণচাঞ্চল্য; আবেগ অনুভূতি ভাল লাগা ভালবাসার বিষয় ও বন্ধনগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে। আমাদের জীবন এখন পুরোটাই যান্ত্রিক, এবং আমরা অনেকটাই প্রযুক্তি নির্ভরশীল হয়ে পরছি। 

আত্মিয়তা, আতিথেয়তা, সামাজিকতা, জন্ম-বিয়ে-মৃত্যু,  রাজনীতি সব কিছুই আজকাল অনেকটা যান্ত্রিক এবং সম্পূর্ণরূপে শুধুই লৌকিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিস্তেজ নিস্তব্ধ যান্ত্রিকতার মাঝে প্রতিনিয়ত আমরা যে ভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি এবং পড়ছি তাতে শংকা হয়, না জানি আমাদের সমাজ-সামাজিকতায় এই যান্ত্রিকতা কোন এক মহা বিপর্যস্ত ঘটিয়ে দেয়! উন্মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস, দৌড়-ঝাপ সব কিছুই এখন শুধুই তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিনোদন, আর লৌকিক বর্ণনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোলা আকাশের নিচে মুক্ত বাতাসে গা ঠান্ডা করার কথা এখন আর ভাবাও যায় না; বিশেষ করে শহরাঞ্চলে তো প্রশ্নই উঠে না। কোথাও বেড়াতে গেলেও দেখা যায় শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা ও ছবি সেশনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকছে সবকিছু! অন্তরিকতার সাথে উপভোগ করার কোন প্রচেষ্টাই কারো মাঝে নেই; মনে হয় সব কিছুই যেন যান্ত্রিক। যন্ত্রদানবের মতো এখন আমাদের প্রতিটি মানুষের জীবনযাপন ও পথচলা। ভিডিও বা ছবি তুলে তা ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ায় আপলোড করে শেয়ার, ট্যাগ আর বর্ণনার মাঝেই যেন সব আত্মতৃপ্তি খুঁজে ফিরি আমরা সবাই! এ কেমন জীবন?

দেশের শিক্ষিত শ্রেণীর বিরাট একটি অংশ এখন সারাক্ষণ কম্পিউটার বা মোবাইল ডিভাইস নিয়েই ব্যস্ত থাকছে। প্রজন্ম পরিক্রমায় দেখা যায় বর্তমান সমাজে এমন একটি শ্রেণী অলরেডি তৈরি হয়ে গেছে যারা অনেকটা রোবট সদৃশ। হটাৎ কোন সামাজিক প্রয়োজনে যদিও-বা তারা ঘরের বাহির হয়, তখনও তাদের মোবাইল নেটে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। বাস্তবতা, সামাজিকতা তাদের কাছে ফেসবুক, গুগল, টুইটার বা অন্য কোন যোগাযোগ মাধ্যম। প্রকৃত বাস্তবতা— বাস্তব প্রকৃতি ও পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে তাদের যেন কোন চিন্তা নেই ভাবনা নেই মাথা ব্যথা নেই। আর, সব কিছুতে সব সময় তারা অন্যের উপর সব দায় চাপাতে সদা তৎপর। 

তাদের মতে— সকল রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক দায় শুধুমাত্র সরকারের। সব কাজেরই মন্দ সমালোচনা, আর মিথ্যা প্রচার প্রচারণা যেন তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা; তাও শুধুমাত্র নেট ভিত্তিক! সামাজিক দায় দায়িত্ব বলতে তারা তেমন কিছু বুঝেই উঠতে পারে না। সমাজের যে কোন অসংগতি নিয়ে একটি ষ্টেটাস করেই তারা খালাস; লাইক, কমান্ট ট্যাগ ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। এতে করে এই শ্রেণীর লোকজন প্রচন্ড এককেন্দ্রিকতায় ডুবে গেছে এবং যাচ্ছে। সমাজ সংসারের কোন চিন্তা তাদের মোটেও স্পর্শ করে না, চিন্তিত করতে পারে না। রাস্তায় বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে খুব কম লোককেই এগিয়ে আসতে দেখা যায়। বরং মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে কিছু লোক রেডি! ফেসবুক বা টুইটারে ডুকলেই ও'সবের শত শত স্টেটাস, এমন কি ভিডিও পর্যন্ত চোখে পরে; ওতে আবার লক্ষ লক্ষ লাইক শেয়ারও হয়! আমাদের পুরো সমাজ যেন আজ মোবাইল ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থরথর করে কাপছে, কাপাচ্ছে সমগ্র জাতিকেও। 

একজন শিক্ষক হিসেবে সমাজের আনেক অসংগতির সাথেই প্রতিনিয়ত আমার সাক্ষাত ঘটে; দেখেছি এবং দেখতে হচ্ছে অনেক কিছু, জানতে পাড়ছি খুঁটিনাটি। তাই একটি কথা আজ বেশ নিশ্চিত হয়েই বলতে পারি— মৌলিক শিক্ষার অভাবে আমাদের সমাজের এই বিপর্যয়, এমন করুণ দশা। ভয় হচ্ছে, না জানি তা জেনারেশন গ্যাপের পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। মৌলিক শিক্ষা ব্যতীত কোন মানুষই পরিপূর্ণ এবং প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। তাই ছোট বাচ্চাদের মৌলিক শিক্ষার দিকে প্রত্যেক অভিভাকের দৃষ্টি দেয়া এখন একান্ত জরুরি বলে আমি মনে করছি। যে সব শিশুরা ১০০% পাঠ নির্ভর হয়ে বড় হচ্ছে তারা মৌলিক শিক্ষা বঞ্চিত থাকছেই। মৌলিক বিষয় না জেনে আপনার বাচ্চা বিদ্যাপীঠে যত ভাল রেজাল্টই করুক না কেন তা কখনো তার জন্য বা আপনার জন্য, সর্বোপরি জাতির জন্য সুফল বয়ে আনবে না; বরং এক সময় বুঝা যাবে তা কত বড় অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

প্রশ্ন করতে পারেন— তাহলে সন্তানকে মৌলিক শিক্ষা দেবো কি করে? মৌলিক শিক্ষা নির্ভর করে অনেকটা প্রকৃতির উপর; প্রকৃতিই একজন মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। প্রকৃতির বাস্তবতা থেকে শিক্ষা দিতে হবে বাচ্চাদের। এতে করে বাচ্চাদের চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পাবে, দৃষ্টি শক্তির সৃজনশীলতার দ্বার উন্মুক্ত হবে। শহর কেন্দ্রিক অভিভাবকরা মাঝে মধ্যে বাচ্চাদের নিয়ে প্রকৃতির কাছে যাবেন, প্রকৃতিতে ছেড়ে দেবেন বাচ্চাদের। দেখবেন এতে করে বাচ্চা অনেক কিছু শিখে যাবে এমনি এমনিই; যা বলে কয়ে বা মুখস্ত করিয়ে কখনো শিখানো যায় না, সম্ভব নয়। 

বিশেষ করে শহরের বাচ্চারা তো এখন অনেকটা ফার্মের মুরগির মত জীবনযাপনে অভ্যস্ত; স্কুল-বাসা আর কোচিং এই করে করে তাদের জীবন অতিষ্ঠ। আবার অনেক অভিভাবককেই দেখি কর্মব্যস্ততা ও সামাজিকতা নিয়ে তাঁরা এতটাই ব্যস্ত, নিজের সন্তানকে নন্যুতম সময়ও দেয়ার ফুসরত পান না। বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন না এ দেশের প্রায় ৯০% অভিভাবক। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিক্ষণে বাবা মায়েরা তো বাচ্চার সাথে মুখই খুলতে চান না। একটু বেশি কিছু জানতে চাইলেই অনেক অভিভাবককে দেখেছি ধমক দিতে; এটা মস্ত বড় অন্যায়। বিশেষ করে ওই বয়সের বাচ্চাদের সাথে অভিভাকের আচরণ হওয়া উচিৎ অত্যন্ত বন্ধুত্বসুলভ। ওদের কথা মন দিয়ে শোনা উচিত, ওদের বেশি বেশি বলতে দেয়া উচিত। ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলে ওদের মস্তিষ্কের উপর চাপ পড়ে, আর এতে মস্তিষ্কে অনেক বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। আর এ'সব কষ্ট থেকেই তাদের মাঝে হতাশার অভিব্যক্তির উন্মেষ ঘটে। 

আমি অনেক বাচ্চাকে বিগরে যেতে দেখেছি শুধুমাত্র অভিভাকের অবহেলা, অবজ্ঞা ও অদূরদর্শিতার জন্য। শুধুমাত্র ওদের সাথে যদি আপনি একটু ভাল আচরণ করেন— আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি বাচ্চাটি অন্তত বিপথে যাবে না। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার বারো-তেরো বছরের বাচ্চাটি অবুঝ, কিছুই বুঝে না; তাই আপনার মতই তার উপর চাপিয়ে দেন বা দিচ্ছেন। না, আমি তা মোটেও বিশ্বাস করি না। ওদের সাথে কথা বলে আমি দেখেছি ওরা অনেক বুদ্ধিমান, অনেক কিছু তাদের মাথায়; ওরা সব কিছু অনেক ভাল বুঝে, যদি ধৈর্য ধরে আপনি বুঝিয়ে দিতে পারেন। অনেক সময় ওদের মাঝে এমন সব চিন্তার বহ্নিপ্রকাশ ঘটতে আমি দেখেছি যা আমরা বড়রাও কখনো ভাবতে পারি না বা ভাবি না। তাই ওদেরকে একটু বুঝিয়ে বলুন; দেখবেন বুঝবে এবং মেনে নেবে।

জাতীয়ভাবে লক্ষ করে দেখেছি, বর্তমান প্রজন্ম কেমন যেন হতাশায় নিমজ্জিত; তাই তারা একগুঁয়েমিতে ডুবে আছে এবং প্রতিনিয়ত ওদিকেই ধাবিত হচ্ছে গন্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিটি কাজে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের এখন তেমন একটা অংশগ্রহণ নেই বা একেবারে নেই বললেই চলে। আমার জানাশোনা  ৯৯% ছেলেমেয়ের মুখ থেকে জানতে পেরেছি তারা এদেশের রাজনীতি একেবারেই পছন্দ করে না। আমি ওদের অনেককে প্রশ্ন করেছি— রাজনীতিতে মেধারা যদি এগিয়ে না আসে তবে আমাদের সামাজিক পরিবর্তন আসবে কি করে? বেশিরভাগ উত্তরে চুপ থেকেছে। কেন যেন রাজনীতিবিদদের উপর তাদের প্রচন্ড রকমের ক্ষোভ ও ঘৃণা; তাই ওতে তাদের ভয়ানক রকমের অনাগ্রহ। কিন্তু এমন কেন হবে? 

আমি জানি অনেকেই বলবেন, এ জন্য এ দেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাই দায়ী; এ দেশে ভাল কাজের মূল্যায়ন হয় না, ভাল মানুষের মূল্যায়ন হয় না, ইত্যাদি ইত্যাদি.....। এ সব কথা আমি মোটেও বিশ্বাস করি না। প্রকৃত সত্য হলো স্বার্থপরের সংখ্যা এখন আমাদের সমাজে অনেক বেশি বেড়ে গেছে; যে কোন কিছুতেই কিছু মানুষ স্বার্থের গন্ধ খোঁজে, স্বার্থ অনুসন্ধান করে; তাই তাদের এমন মনে হতে পারে। আর এইসব লোকেরা নিজেরা কোন কাজে অংশগ্রহণ করবে না, উপরন্তু অযথা অপাংতেয় সমালোচনা তাদের প্রত্যেকের নিত্য সঙ্গী। ভালকে ভাল বলে উৎসাহিত তারা কখনো করতে পারে না বা করে না। আর মন্দকে মন্দ বলে গৃণা করার অনুশিলন তো উঠে গেছে, এখন আর আমাদের কারো মাঝেই নেই! তাই তো দিনেদিনে আমরা তলিয়ে যাচ্ছি, এক অনিশ্চিত জেনারেশন গ্যাপ-এ পড়ে গেছি হয়তো, বা ওদিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছি। 
  
আমি নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করি বর্তমান প্রজন্ম আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি অগ্রসরমান অগ্রগামী। জন্ম নিয়েই তারা পরিচিত হচ্ছে আধুনিক সব তৈজসপত্র, ব্যবহার্য, প্রযুক্তি ও ডিভাইসের সাথে, তথা অত্যাধুনিক সব কিছুর সাথে। পুরোনো শাড়ীর সেলাই ছোট্ট নক্সি কাঁথা বা ঘাঁনি ভাঙা খাঁটি সঁড়িষার তেল তাদের গায়ে এখন আর চাপে না বা উঠে না। মৌঁচাক ভাঙা খাঁটি মধুও খোঁজা হয় না সদ্যপ্রসূত নবজাতকের মুখে প্রথম মিষ্টি দেয়ার জন্য। ইউরোপ আমরিকায় তৈরি খাবার-দাবার ও প্রেম্পাস, প্রসাধন সামগ্রী এখনকার বাচ্চাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিস। বিশ্বায়ন ও আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় আমাদের জীবনযাত্রা পুরোপুরিই পাল্টে গেছে; শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মাঝেই পরিবর্তনের ছাপ সুস্পষ্ট। প্রতি ক্ষেত্রেই শুধু আমাদের বাহ্যিক অবয়বের পরিবর্তন অনেকটাই ঘটেছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন কতটা ঘটেছে বা ঘটছে? 
 
অনেকে মনে করতে পারেন বিজ্ঞানের নব আবিষ্কার অগ্রযাত্রার বিরোধী আমি, নয়তো ব্যাকডেটেড; অবশ্যই আমি কোনটাই নই। বরং বিজ্ঞান তথ্য-প্রযুক্তি ও আধুনিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন ভোক্তা আমি। আর বিজ্ঞান যে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আশির্বাদ বয়ে এনেছে তার জন্য সব সময় মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আ'লামিনের দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করি এবং সকল বিজ্ঞানীর মঙ্গল কামনা করি। এবং সব সময় আপ্রাণ চেষ্টা করি বিজ্ঞান ভিত্তিক কিছু করার এবং তা অন্যকে জানানোর। আমার নাতির দুই বছর হলো; জন্ম নিয়েছে সে ইউরোপে, তাই জন্মগতভাবেই ইউরোপিয়ান। আজ তার দ্বিতীয় জন্মদিন ছিল। তাই কিছুক্ষন আগে স্কাইপিতে যখন কথা বলছিলাম মেয়ে ও ছোট্ট নাতির সাথে; এপাশ থেকে আমি উপলব্ধি করছিলাম- নাতি তার জন্মদিন বেশ ভাল ভাবেই উপভোগ করছে, মনে হয় সবকিছু বুঝতে পারছে। ভালভাবেই হাসছিল আর আমাকে ভেঙাচ্ছিল! ইউরোপের নির্মল আবহাওয়ায় আল্লাহ্‌-র ফজলে সে বেশ ভালই আছে; সবার দোয়ায় বেড়েও উঠছে সঠিকভাবে। 
  
গত বছর সে যখন ঢাকায় বেড়াতে এসেছিল, বেশির ভাগ সময়ই দেখেছি তাকে অসুস্থ থাকতে। ইউরোপীয় ডাক্তারের পরামর্শে খাবার পানি, গোসলের পানি থেকে শুরু করে তার ব্যবহার্য সব কিছুই সাথে করে নিয়ে এসেছিল তার মা-বাবা। তারপরও আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে তাকে বেশ কষ্ট পেতে হয়েছিল। এখানে  ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেই ডাক্তার বলতেন তাকে বেশি বাহিরে বের না করতে। কয়েক দিনের জন্য তাকে নিয়ে দেশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গ্রামের বাড়িতে নাতির কোনই সমস্যা হয়নি। কারণ সুস্পষ্ট— গ্রামের দুষণমুক্ত বাতাস, উন্মুক্ত আকাশ, খোলা মাঠ, অক্সিজেন মেশিন গাছগাছালি তো আছেই পর্যাপ্ত; আর এ'সবই হলো যে কোন জীবের জীবনের সুস্থতার মূল উপাদান। 
  
আমাদের দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক অবস্থায় একটি শিশুর বেড়ে উঠা ও মেধার বিকাশ ঘটানোর ব্যাপারে আমরা কতটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি বা দিচ্ছি? কতটুকোই-বা শিশুদের বিকশিত হতে সাহায্য করছি? নাকি অযাচিতভাবে শুধু  প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করছি তাদের বেড়ে উঠতে? এ'সব নিয়ে আমরা খুব কমই ভাবি বা অনেকে ভাবার ফুসরতই পাই না। সাধারণভাবে আমরা যারা শহরবাসী কর্মব্যস্ততায় আমরা হয়তো তা কখনো অনুধাবনও করতে পারি না। কিন্তু কখনো কি একবার ভেবে দেখেছি এই বড় বড় শহরগুলোর বাতাস আজ কতটা দুষিত হয়ে উঠেছে, কতটা বিষাক্ত??
  
জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে হয়তো আমরা শহরমুখি শহরকেন্দ্রিক। ছোট্ট একটি পরিসরে আমরা বসবাস করছি গাদাগাদি করে, বেড়েও উঠছি ঠিক একই ভাবে একই পরিবেশে। এখানে নেই কোন গাছ, মুক্ত বাতাস বা খোলা আকাশ। বলতে গেলে এক চিলতে খাঁচায় বন্দি আমাদের  জীবন। একটি শিশুর বেড়ে উঠার জন্য যতটুকো আলো, বাতাস, খোলাস্থান, গাছগাছালি প্রয়োজন, বলতে গেলে শহরাঞ্চলে তার কিয়দংশও আমরা শিশুটিকে দিতে পারিনি পারছি না। সব কিছুতেই চতুর্দিকে আমাদের আছে শুধুই সীমাবদ্ধতা! এমতাবস্থার মাঝেও যে শিশুটি জন্ম নিচ্ছে, বেড়ে উঠছে, তাকে অবশ্যই কিছুটা বাড়তি সুবিধা আমাদের দেয়া প্রয়োজন। তাই তাদের মানসিক বৃদ্ধির অনুকুলে অবশ্যই আমাদের প্রত্যেকের কিছু না কিছু কাজ করা উচিত। কিন্তু তা না করে না বুঝে আমরা অনেকেই করছি ঠিক তার উল্টো; তিন চার বছরের বাচ্চাকেই ভর্তি করে ঢুকিয়ে দিচ্ছি স্কুল নামক আলো-বাতাসহীন একটি খোঁয়াড়ে! অবশ্য এ'সব এখন রীতিমতো আমাদের সামাজিক কালচারে পরিনত হয়েছে!
  
এতে করে কি তার মেধার বিকাশ ঘটবে বলে আপনি মনে করেন?  আমি তো তা মোটেও মনে করি না। দু/তিন/চার বছরের যে অবুঝ শিশুটিকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়, সে সময়টায় ছোট্ট পরিসরের স্কুলিং তার ব্রেনের বিকাশের সম্পুর্ন প্রতিকুলে চলে যায়; যা মোটেও শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পরিপূরক কোন বিষয় নয়। এখন হয়তো বুঝতে পারছেন না, কিন্তু বড় হলে তা ঠিকই অনুধাবন করতে পারবেন। একটি চারা গাছে ফুল ফুটাতে হলে যেমন পরিচর্চার পাশাপাশি সার পানি আলো বাতাস সব কিছুরই সময় মতো ও পরিমাণ  মতো দেয়ার প্রয়োজন পড়ে; একটি ছোট্ট শিশুর বেলায়ও ঠিক তদ্রুপ কাজ করতে হয়। 

মা-বাবা ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে মুক্ত বাতাসে উন্মুক্ত পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা দেখে দেখে শিখে শিখে যে শিশুটির বেড়ে উঠার কথা, সেই শিশুটিকে সে সুযোগ না দিয়ে তার কাঁধে চাঁপিয়ে দিচ্ছেন বিশাল একটি বই-খাতার বোঁঝা! তা কখনো খারাপ বৈ ভাল কিছু বয়ে আনতে পারে না বা আনে না। নিজের চেয়ে তিনগুণ বড় বোঁঝার ভার বহন করা এতো ছোট্ট একটি শিশুর পক্ষে কি করে সম্ভব? কিছুতেই সম্ভব নয়। অযাচিতভাবে অভিভাবক হয়েও আপনি আমি সেই মন্দ কাজটিই করছেন; এটি ভয়ানক রকমের অন্যায়, নির্মম নিষ্ঠুরতা। তাছাড়া কোন ভাবেই তা বিজ্ঞান সম্মত নয়, বাস্তব সম্মতও নয়। 

আমাদের দেশে স্কুলিং এর বয়স সম্বন্ধীয় কোন নীতিমালা নেই; কিন্তু ইউরোপ আমরিকায় একটি সুনির্দিষ্ট  নীতিমালা আছে। একটু ভাল করে লক্ষ্য করলেই হয়তো দেখতে পাবেন, আমাদের দেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোও সেই নীতিমালা অনুসরণ করে বাচ্চা ভর্তি করানো হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো— এ দেশে এ পর্যন্ত এ ব্যাপারে সরকারের কোন নির্দিষ্ট  নীতিমালা নেই; থাকলেও শুধু কাগুজে। সেই সুযোগে এ দেশের এক শ্রেণীর তথাকথিত শিক্ষিত লোকজন ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ানোর নাম করে কিছু ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে। যেখানে বাচ্চাদের পরিচর্চার কোন ধরনের পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিকতাই নেই। এমন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সরজমিনে দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে। ঐ সব স্কুলের শিক্ষকরূপী ব্যবসায়ীর দল বাচ্চাগুলোর কাঁধে চাপিয়ে দেয় মস্ত বড় এক একটা বোঁঝা, আর পড়ানোর নামে করে একচেটিয়া মুখস্ত পাঠের অনুশীলন। অত ছোট্ট বাচ্চার পক্ষে তা কি সম্ভব? বহনক্ষমতা না থাকার কারণে সেই থেকেই সেই ছোট্ট শিশুটি ভয়ের সাম্রাজ্যে প্রবেশ করতে থাকে। ব্রেনের বিকাশ হওয়ার বদলে পর্যায়ক্রমে তাদের ব্রেনের সংকোচন ঘটতে থাকে। একটু বড় হলেই দেখা যায় অনেক বাচ্চারই পড়া মনে থাকে না, লেখাপড়া বিরক্তিকর জিনিস বলে মনে হয় তাদের কাছে; আরেকটু বড় হলে তো অভিভাবকদের পড়তে বিশাল সমস্যায়!
  
দেশের সমাজবিজ্ঞানীদের এ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই, এ সব নিয়ে কারো যেন কোন চিন্তা নেই। সরকারেরও কোন চিন্তা-ভাবনা পদক্ষেপ গ্রহণ বা দায় আছে বলে মনে হয় না। জাতীয়ভাবে আমরা সবায় এখন কেমন যেন গন্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে বেড়াচ্ছি। স্বাধীনতার এতো বছর পাড় হলেও শিশুদের শিক্ষা ও বিকাশ নিয়ে এদেশে বাস্তবমুখী কোন পরিকল্পনা বা পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি বা হচ্ছে না কেন তা ভাবতে গেলে আমার বুকটা কষ্টে ফেটে যেতে চায়। প্রতিটি শিশু জাতির ভবিষ্যৎ; আর সেই শিশুই যদি সঠিকভাবে বিকশিত হতে না পারে, তবে এ জাতির বিকাশ ঘটবে কি করে? সে তো শুধুই দু:স্বপ্ন।
 
শুধু শুধু অন্যের উপর দোষ না চাপিয়ে পরনিন্দা পরচর্চা বাদ দিয়ে আসুন আমরা প্রত্যেকে অন্তত  শিশুদের ব্যাপারে কিছুটা  সচেতন হই। জাতি গঠনে যার যার অবস্থান থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করি। দেখবেন - আমাদের পরবর্তী  প্রজন্মকে আর এমন অনিশ্চয়তার মাঝে বসবাস করতে হবে না। এই ছোট্ট পরিসরেও সব কিছুই করা সম্ভব, যদি ইচ্ছাশক্তি আমাদের প্রবল থাকে। জনসংখ্যা কোন দেশের জন্যই অভিশাপ নয়, বরং আশির্বাদ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে শুধু জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে, এবং সবাইকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে আমাদের। 

পরিশেষে একটি কথা আবারও  স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি— জ্ঞানই মানুষের  সবচেয়ে বড় শক্তি। দেশের প্রতিটি মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে পারলেই আসবে প্রকৃত সুখ শান্তি এবং জাগবে প্রবৃত্তি।। 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৯ মে, ২০১৪.

শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০২০

বিশ্বাস অবিশ্বাসের নাগরদোলা:

আল্লাহ্-র  বাণী   সম্বলিত  আসমানি  কিতাব পবিত্র  কোর'আনুল কারিম, এতে  সন্দেহের কোন     অবকাশ    নেই।    এক    দল    সেই কোর'আনুল  করিমের  তির্যক   সমালোচক; তারা   নিজেদের  নাস্তিক  বলে  দাবি  করে। অন্য  আরেক  দল  ধর্মকে  ব্যবহার  করে যে কাউকে   নাস্তিক  হিসেবে  আখ্যায়িত  করে, কোপিয়ে   মেরে   নিজেদের   সাচ্চা  মুসলিম হিসেবে প্রকাশ করে! এই  দুই  দলই  জ্ঞানের অন্তর্নিহিত      সৌন্দর্য     উপভোগ ৷   করতে অপারগ।   আল্লাহ্-র   বাণী   সম্বলিত  পবিত্র কোর'আনুল কারিম নাযিল হয়েছে জগতের সকল   কল্যাণের   উদ্দেশ্যে,  ফতোয়া  দিয়ে কাউকে   হত্যার   উদ্দেশ্যে   নয়। এই মহাগ্রন্থ হতেই   যুগে   যুগে    স্বার্থক    মানুষের    দল অনুসন্ধান করেছে  মৌলিকত্বের এবং করছে প্রকৃত সত্য  উদঘাটন। চেষ্টা ও সাধনা করলে আল্লাহ্  রাব্বুল  আলামিন  যাকে ইচ্ছা তাকে যে   কোন   বিষয়ে  প্রকৃত  'নূর' তথা জ্ঞানের আলো দান করতে পারেন। প্রকৃত নূরের মূল উৎস   হলো    পবিত্র   কোর'আনুল  কারিম।

সভ্যতার বিবর্তনে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় অনেকেই আজ মুসলিমদের ছোট করে আত্নতৃপ্তির ডেকুর তোলে। তা কতটুকো যৌক্তিক? যুগের পরিক্রমায় দেখা যায় মুসলিম মনিষীগণই প্রকৃত মৌলিকত্বের ধারক ও বাহক, প্রবর্তক ও উপস্থাপক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সেই ভাগ্যবান মুসলিম জাতির বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানে না তাদের অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য। এমন কি জানার তেমন প্রয়োজনও বোধ করে না বা জানার আগ্রহও প্রকাশ করে না। মুসলমানের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আজ বিকৃত করে পৃথিবীবাসীর কাছে উপস্থাপিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এর মুল কারন- বর্তমান মুসলমানের উদাসিনতা, অজ্ঞতা-জ্ঞানহীনতা, বিজ্ঞান বিচ্যুত শিক্ষা ও ভোগবাদী চিন্তাচেতনা। 

একসময় ইউরোপিয় পন্ডিতগণ মুসলিম সভ্যতাকে, বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের অধিকাংশকেই বিকৃত করে উপস্থাপন করেছিল, এমন কি মুসলিম মণিষীদের অধিকাংশের নাম বিকৃত করে উপস্থাপন করেছিল; তাই আজ আমরা খুব বেশি একটা অবগত হতে পারি না তাঁদের সম্পর্কে। অথচ মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করে অমুসলিমরা আজ বিশ্বে উন্নত।
অন্য দিকে মুসলিম বিশ্ব আজ তাদের পূর্বপুরুষের দেয়া জ্ঞান-বিজ্ঞান হারিয়ে মুর্খ ও পরনির্ভরশীল জাতিতে পরিনত হয়েছে। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছায় মুসলিম জাতির মধ্যেই সব ধন্য মানুষের জন্ম হয়েছিল, যারা ছিল ঐশী জ্ঞানে মহিমান্বিত। আল্ খারিযামী তেমনই একজন মুসলিম মণিষীর নাম; যার জন্ম ৮২০ খ্রিষ্টাব্দে।

আল-খারিযমী হিসেবে আমরা যাকে চিনি তিনি আসলে মুহাম্মদ আবু আব্দুল্লাহ্ ইবনে মূসা আল খারিযমী। বীজগণিত ও ত্রিকোনোমিতির ভিত তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসে সর্বাধিক বিখ্যাত এই মুসলিম মণিষী পৃথিবীতে গণিতের নতুন এক ধারাকে উন্মুক্ত করেছিলেন নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে। বীজগণিতের আবিষ্কারক আল খারিযমী 'হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালাহ্' নামক এক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থের নামানুসারেই পরবর্তিতে ইউরোপিয়রা গণিতের এই শাখাকে 'ALGEBRA' নামকরণ করেন। 'আলজাবর' থেকেই 'অ্যালজেবরা' শব্দের উৎপত্তি। পরবর্তীতে ইউরোপীয় মণিষীরা আল খারিযমীকে 'The father of Algebra' খেতাবেও ভূষিত করেন। তাঁর উদভাবিত গণিতই আজ পৃথিবী সভ্যতার প্রাণপ্রদীপ।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই মুসলিম মণিষী গ্রীক ও ভারতীয় গ্রন্থের সমন্বয়ে মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চার পথকে সুগম করেছিলেন। বীজগণিতের মৌলিক সংখ্যা ও অঙ্কগুলো তাঁর অমর সৃষ্টি। 'হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালাহ্' গ্রন্থটিতে তিনি আট শতাধিক বিভিন্ন ধরনের উদাহরন সন্নিবেশ করে গেছেন। সমীকরণকে সমাধানের প্রায় ছয়টি নিয়ম তিনি আবিষ্কার করেন। গ্রন্থটি দ্বাদশ শতাব্দিতে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে তখন থেকে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ষোড়শ শতাব্দি পর্যন্ত শ্রেষ্ট ও প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে পঠিত হয়। এ ছাড়াও পাটিগণিত বিষয়ে তিনি একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যা পরবর্তিতে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। 

বর্তমান যুগ পর্যন্ত গণিত বিদ্যার যে উন্নয়ন এবং গণিতের সহায়তায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার যে উন্নতি ও নব্য আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে তার মূলে রয়েছে আল খারিযমীর উদ্ভাবিত গণিত বিষয়ক নীতিমালা। গণিত ছাড়াও তিনি গ্রীক ভূগোলবিদ টলেমির গ্রন্থ অনুবাদ করেন এবং তার একটি মানচিত্র সংযোজন করেন। তিনি ও তাঁর কয়েকজন সাথী মিলে 'সূরত আল আরদ' তথা বিশ্বের একটি বাস্তব রুপ প্রস্তুত করেন, পরবর্তিতে বিশ্বের মানচিত্র অঙ্কনে যা মডেল হিসেবে গৃহিত হয়েছিল। খারিযমী পৃথিবীকে সপ্ত 'ইকলীম' তথা সপ্তমন্ডলে ভাগ করেছিলেন, যার সূত্র ধরে পরবর্তীকালে ভূগোলবিদরা আবহাওয়ার তারতম্য অনুসারে পৃথিবীকে সাতটি মহাদেশে বিভক্ত করেন। এ ছাড়াও বিশ্বের পরিধি ,অক্ষরেখা, দ্রাঘিমা এবং জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর গবেষণালব্দ জ্ঞানই পরবর্তিতে পথিকৃতের কাজ করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান অন্যান্য জাতির জন্য ইর্ষা ও বিস্ময়ের বিষয়।

হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদ্বীন ও সাহাবায়ে আজমাইনদের কথা তুলে ধরার বদান্যতা আমার নেই, তৎপরবর্তীতে অসংখ্য মুসলিম মণিষী এই পৃথিবীকে সম্বৃদ্ধ করেছেন আমি তাঁদের নিয়ে দুই-এক কথা লিখতে চেষ্টা করবো মাত্র। ইবনে জাবির তাবারী তাফসির ও ইতিহাসকে এবং ইমাম গাজ্জালী ইসলামী অনুশাসন সমূহের ব্যাখ্যা দর্শনের সাহায্যে অত্যন্ত সুনিপুনভাবে তুলে ধরেন। তাঁদের লিখা অনেক বইপুস্তক এখন বাংলায়ও অনুবাদিত হয়েছে। ঐ সব মৌলিক পুস্তক থেকে অনেক কিছুই শিক্ষা নেয়া যায়। আধুনিক ধারণা থেকে শুরু করে আধ্যাতিক  ও আত্মিক উন্নতি লাভের নৈতিক শিক্ষার আবশ্যিকতাও তুলে ধরেছেন অগেকার মুসলিম মণিষীরাই। 

আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে মুসলমানদের ভূমিকা অগ্রনী ও অনশ্বীকার্য। জ্ঞানের সল্পতা হেতু বর্তমান দুনিয়ার  অনেকেই অনেক বিষয়েই অযথা একপেশে ভাবে শুধু মুসলমানদের দোষারোপ করে থাকে; প্রকৃতপক্ষে এমনটা করা ভুল। তারা হয়তো জানে না চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান ও ভূমিকা অবিশ্বরনীয়। আবু বকর আল-রাযী, ইবনে সীনা, হাসান ইবনে হাইসাম, আবুল কাসেম জাহরাবী, আলি তারাবী উল্লেখযোগ্য হলেও নাম না জানা আরো অনেকে আছেন এই দলে। রসায়নে জাবির ইবনে হাইয়াম বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট, যার লিখা গ্রন্থের পরিমাণ দুই হাজারেরও অধিক। গণিতে আল খারিযমী ছাড়াও আল বিরুনী, নাসিরুদ্দীন তুসী, উমর খাইয়াম, আল বাত্তানীর অবদানও অগ্রনী। বিজ্ঞানের প্রত্যেক শাখায় জ্ঞাত-অজ্ঞাত মুসলমান মণিষীদের অবদান আজ ইতিহাস বিলুপ্তির রোষানলে পরে হারিয়ে যাওয়ার পথে। প্রকৃতপক্ষে, বিজ্ঞান ও সভ্যতার ইতিহাস মুসলমানদের দ্বারাই রোপিত।

বর্তমান সময়ে মুসলিম নামধারী অনেক ব্যক্তি অনেক সময় বিজ্ঞানকে অন্যের অবদান বলে তির্যক কটাক্ষ করেন; আবার ইসলামকে বিজ্ঞান বিবর্জিত বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন; কেউবা  প্রশ্ন করে মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়েও; তারা আসলে অজ্ঞ, নয়তো জ্ঞানপাপি সুবিধাবাদী; ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করা যাদের মূখ্য উদ্দেশ্য। জ্ঞান আর অজ্ঞানতার এই দ্বন্ধ নতুন কিছু তো নয়; ছিল, আছে এবং থাকবে।

'Big Bang' 'Black Hole' আজ আবিষ্কৃত হলেও এসব বেশিরভাগ মানুষের কাছে আবছা নয় কি? তাছাড়া এসব সম্পূর্ণরুপে বৈজ্ঞানিক প্রমাণীত কি? বিজ্ঞান হলো সম্পূর্ণভাবে বাস্তব ভিত্তিক একটি জ্ঞান। সৃষ্টির কসড়া এ ক্ষেত্রে বাতুলতা নয় কি? প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টির সঠিক ইতিহাস বিজ্ঞানীদের কাছে আজও অস্পষ্ট এবং অস্পষ্টই থেকে যাবে। এই বিষয়গুলো সম্পূর্ণরুপে স্রষ্টার মজ্জাগত ও সত্তাগত বিষয়, এখানে যে কোন সৃষ্টির প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। একজন বিজ্ঞানী শুধু আল্লাহ্ সৃষ্ট মৌলিক উপাদানগুলোর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারেন এবং পারবেন। এই সব বিষয়গুলো নিয়ে অন্য এক সময় আলোচনার প্রত্যাশা রাখছি, যেই বিষয়টি দিয়ে লিখার সূচনা করেছিলাম সেই দিকে আসা যাক।

 যা বলছিলাম— আল্লাহ্কে মানে না এমন এক দল যেমন আবির্ভূত হয়েছে, ঠিক আরেক দল সম্পূর্ণ তার উল্টো। এক দল আল্লাহ্কে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য উঠেপরে লেগেছে , অন্যদল আল্লাহ্কে রক্ষার কাজে নিজের জীবন উৎসর্গ করছে। আল্লাহ্কে অস্বীকার করলে, বকা দিলে এতে আল্লাহ্-র কি আসে যায়? আল্লাহ্-র যদি কিছু আসে না যায়,তবে আপনার কি? এক দলের সদস্যরা আল্লাহ্কে গালি দিচ্ছে, অন্য দলের সদস্যরা তাকে বধ করার জন্য মরনপণ করে বসে আছে। আমার দৃষ্টিতে এই দুই দলই পৃথিবীর উচ্ছিষ্ঠ্য আবর্জনা। মানলাম আপনি একজন নাস্তিক, ধর্মকর্ম করেন না, আল্লাহকে মানেন না। আপনার বিশ্বাস নিয়ে আপনি থাকেন না! একজন ধর্মবিশ্বাসীর অন্তর্মূলে আঘাত করতে আসেন কেন? ধর্ম ও ধর্ম জ্ঞানীদের সমালোচনা দিয়ে আপনার অজ্ঞানের এতো বিকাশ ঘটাতে চান কেন? সমাজ সংসারে আরো তো বলার মত অনেক কিছু আছে, অনেক বিষয় আছে এই পৃথিবীতে; সব কিছু বাদ দিয়ে স্পর্ষকাতর এই বিযয়টি নিয়ে লাফানোর এত ইচ্ছা কেন?  

আমি বলি কি- রাতারাতি নিজেকে কুখ্যাত করার এক দূর্ভিসন্ধি এটি। এতে করে নাস্তিক ও ধর্মবিরোধী সমাজের আনুকূল্য পাওয়াই মুল উদ্দেশ্য। এক সময় দেখতাম রাজনীতি না করেও একশ্রেণী যেনতেনভাবে  রাজনৈতিক সার্টিফিকেট বাগিয়ে ইউরোপ আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতো; সফলও হতো। এখন কেউ আর এই দেশের কাউকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় বলে মনে হয় না, তাই বিদেশ গমনের এক সহজ ভিন্ন অপকৌশল এটি - মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে একশ্রেণীর মূর্খকে খেপিয়ে নিজের উপর নাস্তিকের সিল পাকাপোক্ত করে পশ্চিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। স্ব-ঘোষিত নাস্তিক শ্রণীর দূর্ভিসন্ধি  না বুঝে স্ব-ঘোষিত অতি আস্তিক শ্রেণীও বিরোধীতা করে রাতারাতি তাদেরকে কুখ্যাত করে দেয়, ধর্মীয় অজ্ঞতা ও জ্ঞান স্বল্পতাই যার মূল কারণ।

কোন ধরনের উচ্চ আবেগী মাত্রাকেই ইসলাম সমর্থণ করে না। 'মধ্যপ্রন্থা' রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম স্বীকৃত সর্ব উৎকৃষ্ট প্রন্থা। অথচ নিকৃষ্টভাবে আমাদের মাঝে একশ্রেণী সেই প্রন্থা পরিত্যাগ করে ইহুদী খ্রীষ্টানদের অতি উগ্রবাদের বিশেষণ 'মৌলবাদ' মুসলমানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে! অবশ্য এর পিছনেও দূর্ভিসন্ধি নিহীত আছে। তারাও পশ্চিমা মদদেই সৃষ্ট; উদ্দেশ্য ঘোলা পানিতে মাছ শিকাড়। মুসলমানে মুসলমানে দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে মুসলিম সমাজে বিশৃঙ্খলা বাধানোই যার একমাত্র উদ্দেশ্য। অনেকে দ্বীমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু একটি গভীরভাবে ভেবে দেখবেন।

যারা নাস্তিক তারা ভোগবাদী, পরকাল বলতে তাদের কাছে কিছু নেই। দুনিয়ার সুবিধার জন্য তারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কিন্তু মুসলিম হিসেবে দাবী করে মুসলিম সমাজে বিশৃঙ্খলার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? ভেবে দেখুন -  আপনি একজন মুনাফিক কিনা? মুনাফিকের জন্য পূর্ণ সুরা নাজিল হয়েছে, অন্য কোন গোষ্ঠির জন্য কিন্তু নয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের কাছ থেকে আসা  উস্কনীমূলক কোন শিক্ষার বাণী বা মানুষকে পুড়িয়ে মারা বা গলা কেটে রগ কেটে বা কুপিয়ে হত্যার শিক্ষা কোন গ্রন্থে পেয়েছেন কি? যদি না পেয়ে থেকে থাকেন তো এসব কেন করেন? অপনি কি তবে মুসলিম হিসেবে নিজকে দাবী করতে পারেন?  মুসলিমের মাঝে উগ্রতার কোন স্থান নেই; সকল ধরনের উগ্রতাই ইসলামে নিষিদ্ধ। অতএব আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ)-কে মানলে এইসব বাদ দিন।।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
০৬-০৩-২০১৫.


বুধবার, ২৪ জুন, ২০২০

আক্রান্ত কোটি পার হতে যাচ্ছে!

ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারের লকডাউন গতকাল মঙ্গলবার চৌদ্দদিন পূর্ণ হলো, তা আরও সাত দিন বাড়িয়ে ২১ দিন করা হয়েছে; মানে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত ঘোষণা বহাল থাকবে। কিন্তু কাজের কাজ কি এবং কতটা হয়েছে বা হচ্ছে? গত ২৩ দিন আগে ১ জুন সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক সভায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকাকে লাল, হলুদ, সবুজ জোনে ভাগ করা হয়েছিল বলে জেনেছিলাম; 'অন্যরকম' এলাকা ভিত্তিক লকডাউন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতায় কি দেখা গেল? ঢাকার আর কোথাও লকডাউন নেই!

অবশ্য ঢাকার বাইরে ১৮টি জেলায় ছোট ছোট দেড় শ'রও বেশি এলাকা রেডজোন করে লকডাউন চলছে, ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছে; যদিও লকডাউন সেই আগের মতোই ঢিলেঢালাভাবেই পালিত হচ্ছে! অথচ সংক্রমণ অনেক বেশি থাকার পরও ঢাকায় লকডাউন নিয়ে হেলাফেলা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় কারিগরি দল প্রাথমিকভাবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অধীন মোট ৪৫টি এলাকাকে রেডজোন হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ কার্যকরী লকডাউনের ঘোষণা দিবে বলেছিল। কিন্তু বাস্তবতায় কিছুই করা হয়নি হচ্ছে না। সব কিছু কেমন যেন সেই আগের মতোই লেজেগোবরে অবস্থায় উপনীত হচ্ছে।

এদিকে দেশে হুহু করে বাড়ছে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা; গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৭ জন, এ নিয়ে মোট ১ হাজার ৫৮২ জনের মৃত্যু হলো। একই সময়ে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে আরও ৩ হাজার ৪৬২ জনের দেহে; ফলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১ লাখ ২২ হাজার ৬৬০ জনে। দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে ৮৪ হাজার হয়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়েই হয়তো বাড়ছে কোভিড-১৯-তে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা! পত্রপত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী মনে হচ্ছে না কোন কোটিপতি এই করোনার কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছেন বা পাবেন। দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে হয়তো কেউ-ই আর রক্ষা পাবেন না। 

কোভিড-১৯ ভয়ঙ্কর থাবা সারা বিশ্বকে তচনচ করে দিয়েছে এবং মেসাকার চালিয়েই যাচ্ছে বিগত ছয়মাস ধরে; বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই এমন কোন জায়গা নেই যেখানে এই মরণ ভাইরাস মানুষকে সংক্রমিত করেনি। দিনদিন সংক্রমিতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে যে ভাবে বাড়ছে, তাতে আগামীতে এদেশে আমরা কেউ সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবো কিনা জানিনা। এমনভাবে চলতে থাকলে এ সন্দেহ হয়তো বাস্তব রূপ নিতে খুব একটা বেশি সময় নেবে না! আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন প্রথম বিশ্বের প্রথম সারির সব দেশগুলোই এই মহামারির কাছে অসহায়, বলা যায় কুপোকাত; এবং তা প্রমাণিত। 

সারা পৃথিবীতে এরই মধ্যে (২৩ জুন পর্যন্ত) এই মরণ ভাইরাস ৯৩.৫৯ লক্ষ মানুষকে সংক্রমিত করেছে এবং ৪.৭৯ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এখনো সংক্রমণের উর্ধগতি চলমান; এখনো প্রায় প্রতিদিন বিশ্বে দেরলাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। ২৪ জুন ২০২০ ওয়ার্ল্ডোমিটারের সকালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারাবিশ্বে কোভিড-১৯ পজিটিভ মানুষের সংখ্যা ৯৩.৫৯ লক্ষ পেরিয়েছে; নতুন করে আর ৬.৪১ লক্ষ যোগ হলেই সংখ্যাটি পৌঁছে যাবে ১ কোটিতে৷ খেয়াল করেছিলাম ১৫ থেকে ২০ জুন— ওই পাঁচ দিনের মধ্যে ৯ লক্ষ নতুন সংক্রমণের খবর এসেছিল; এই গতিতে সংক্রমণ চলতে থাকলে আগামী ২৬ বা ২৭ জুনের মধ্যেই বিশ্বে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি।

আজকের হিসাব অনুযায়ী চীন, কাতার, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বাংলাদেশ ১৭ তম স্থান দখল করে নিয়েছে! বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিতের সংখ্যা ১,১৯,১৮৯ এবং মৃতের সংখ্যা ১,৫৪৫। এ পর্যন্ত সারাবিশ্বে সংক্রমিত হয়েছে ২১৫টি দেশ এবং এর মধ্যে ১৮৫ টি দেশে কোভিড-১৯তে মৃত্যু হয়েছে; তার মধ্যে ইউরোপ মহাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সেখানে প্রায় ১.৯০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে৷ ভুটান, ভিয়েতনামস উগান্ডা, মঙ্গোলিয়া, নামিবিয়া, লাওস, ফিজি, ম্যাকাও-সহ ২৭ টি দেশে আক্রান্ত ব্যক্তি থাকলেও আক্রান্ত হয়ে একজনেরও মৃত্যু খবর ওয়ার্ল্ডোমিটারে উঠেনি।

সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ টেস্ট হয়েছে আমেরিকায়; সেখানকার ৩৩ কোটির উপর জনগণের মধ্যে টেস্ট করেছে ২.৯৫ কোটির উপরে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণ সারে ১৬ কোটির মধ্যে অদ্যাবধি টেস্ট হয়েছে ৬.৪৭ লক্ষ। সারা বিশ্বে কোভিড-১৯তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার— ৬০ (প্রতি ১০ লক্ষ); ভারতে— ১০, বাংলাশে— ৯, এবং পাকিস্তানে— ১৬ ৷

ওয়ার্ল্ডোমিটারের কোভিট-১৯-র সার্বিক চিত্র পর্যালোচনায় একটি কথা আজ স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে— এশিয়ায় সংক্রমিতের সংখ্যা এখন তুলনামূলক বাড়ছে; বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে। সে সাথে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। বিগত কয়মাস ধরে চতুর্দিকে শুধু মন খারাপ হওয়ার মতো সংবাদই পেলাম এবং পাচ্ছি। আশেপাশের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন, কেউ কেউ আবার মৃত্যুবরণও করেছেন। কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করা মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, বরং টেস্টে ধরা পড়া আক্রান্তের মৃত্যুর সংখ্যার বেশ কয়েকগুণ বেশি। সংক্রমণের উর্ধগতি থাকা অবস্থায় 'সীমিত পরিসর' নামের গোল্লাছুট টাইপ দায়সারা লকডাউন দিয়ে সারাদেশে কোভিড-১৯-র বরং বিস্তার ঘটানো হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনের ব্রিফিং থেকে জানা যায়, পোনে দুই লক্ষ থেকে দুই লক্ষ মানুষ প্রায় প্রতিদিন ফোন করছেন তাদের কাছে! নিশ্চয় অসুবিধায় না পড়ে কেউ ওসব ফোন দেননি বা করেননি? যদি টেস্ট আরো বেশি করা তা হলে হয়তো বুঝা যেতো দেশের প্রকৃত অবস্থা আসলে কি?  হয়তো আরও অনেক অনেক বেশি আক্রান্তের খবর জানা যেতো; সাবধান হওয়া যেতো। 

যেহেতু সীমাবদ্ধতার দেয়াল অনেক উঁচু এবং অনেক বেশি তাই আভ্যন্তরীণ কোন বিষয়ই আমরা জানতে পারছি না; তাই বুঝাও যাচ্ছে না কোনকিছু। পথেঘাটে সবায় আমরা একসাথে চলছি কাজ করছি, বুঝতেও পারছি না কে আক্রান্ত আর কে আক্রান্ত নয়। প্রয়োজন/অপ্রয়োজনে আমাদের প্রত্যেককেই কমবেশি ঘরের বাইরে বের হতে হয় হচ্ছে। কিন্তু মনে সব সময় অযাচিত এক ভয় ও শঙ্কা কাজ করছে; না জানি কখন কে কোথা থেকে আক্রান্ত হই? কখন কে কোথা থেকে আক্রান্ত হয়ে ঘরে এই মরণ ভাইরাসকে নিয়ে আসবো তা কেউ জানি না। 

এরই মাঝে বিবিসি গতকাল একটি ভয়ঙ্কর ভীতিকর সংবাদ প্রচার করেছে— ল্যাবরেটরি এবং টেস্টিং কিটের ঘাটতি দেখা দেয়ায় নাকি করোনাভাইরাস পরীক্ষা সংকটের মুখে পড়েছে বাংলাদেশে। নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষার সাথে জড়িতদের অনেকে নাকি জানিয়েছেন, এখন নমুনা সংগ্রহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে এবং একেবারে প্রয়োজন ছাড়া পরীক্ষা করা হচ্ছে না! দেশে সংক্রমণের এই উচ্চহারের মুখে ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষার টার্গেটের কথা বলা হলেও এখন তা সীমাবদ্ধ থাকছে ১৬ বা ১৭ হাজারের মধ্যে! স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, কিট নয়, ল্যবরেটরির অভাবে পরীক্ষার ক্ষেত্রে জট লেগে যাচ্ছে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন গা-ছাড়া দায়সারা কথাবার্তা আমরা লক্ষ্য করে আসছি সেই প্রথম থেকেই; রেড জোন, ইয়েলো জোন, গ্রীন জোন আরও কত কি করলো, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোনটাই! আর কত মরলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সজাগ হবে? দেশের সব মানুষ আক্রান্ত হলে কি?? আমরা সাধারণ জনগণ, এসব বগিজগি বুঝি কম। আমরা বেশি বেশি টেস্ট করাতে চাই, নিশ্চিত হতে চাই; কিন্তু কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। 

আবার কি আমরা আমাদের সেই আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো? কবে হবে এ'সব দুশ্চিন্তার অবসান? কবে আসবে সেই সুদিন??  

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২৪ জুন, ২০২০.

আকাশ ও মহাকাশ নিয়ে বিজ্ঞান ও পবিত্র কোর'আন:

আকাশ ও মহাকাশ নিয়ে পৃথিবীর মানুষের আগ্রহ  আর  উৎকন্ঠার কোন অন্ত নেই। আর সেই  আগ্রহ ও উৎকন্ঠা থেকেই যুগে যুগে এই দুনিয়ার মানুষ অনবরত গবেষণা করে গেছেন এবং  যাচ্ছেন;  সেইসব  গবেষণালব্ধ ফলের নির্যাসকে বলি বিজ্ঞান,  আর  যারা গবেষণা করেছেন বা করছেন তাদেরকে বলি বিজ্ঞানী। আমরা  একটু  গভীরভাবে   খেয়াল   করলেই বুঝতে  পারবো,  বিজ্ঞানীরা  প্রতিটি   জটিল জিনিসের  জাল  উন্মুক্ত করেছেন বা করছেন পবিত্র   কোল'আন   ও   হাদিস-এর  মৌলিক উৎস থেকেই।  জ্ঞান  আহরণে  প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তি মাত্রই প্রকৃতি নির্ভর,  আর এই প্রকৃতির স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তা কে? এমন কেউ কি আছেন, যিনি প্রকৃতি ছাড়া  সম্পূর্ণ শূন্য থেকে বা অন্য কোন   উৎস  থেকে   কোন   কিছু   আবিষ্কার করতে  পারেন   বা   পেরেছেন  বা  পারবেন?

অনেকেই  ভেবে  থাকেন  আকাশ ও মহাকাশ এক   ও   অভিন্ন;    প্রকৃতপক্ষে   আকাশ  ও মহাকাশ  দুটো  সম্পূর্ণ  ভিন্ন জিনিস। মহাশূণ্য অথবা  মহাকাশ  বলতে  সাধারণভাবে মাথার উপরকার   অনন্ত   আকাশ বুঝানো   হলেও বস্তুত   পৃথিবীর   বায়ুমণ্ডলসমৃদ্ধ আকাশকে পৃথিবীর   আকাশ   বলা   হয়।  তাই  পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে  মহাকাশ   হলো  পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের  বাইরের  অনন্ত    স্থান।   এ আকাশসীমায় অতি অল্প   ঘনত্বের   বস্তু বিদ্যমান;  অর্থাৎ  শূন্য   মহাশূন্য পুরোপুরি ফাঁকা   নয়।   প্রধানতঃ   অতি   অল্প পরিমাণ হাইড্রোজেন  প্লাজমা, তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ, চৌম্বক   ক্ষেত্র এবং নিউট্রিনো   এই   শূন্যে অবস্থান  করে।  তাত্ত্বিকভাবে, এতে  কৃষ্ণবস্তু এবং  কৃষ্ণশক্তি   বিদ্যমান।   মহাশূন্যে   এমন অনেক কিছু আছে যা মানুষ এখনও কল্পনাও করতে   পারেনি;   আর  কোন দিন পারবে কি না, তাও বলা অসম্ভব।

বিজ্ঞানের   একজন   শিক্ষক   হিসেবে  আমি অনেক  গভীরভাবে   চিন্তা   করে     দেখেছি, আজকের  আধুনিক বিজ্ঞানের  সকল আবিষ্কারই পবিত্র  কোর'আন  ও হাদিস-এর গবেষণালব্ধ ফল; বিজ্ঞানীরা  তাদের আবিষ্কারের মৌলিক প্রেরণা পেয়েছেন পবিত্র কোর'আন বা হাদিস থেকেই। বিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা ও অনেক সাধ্য-সাধনা করে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যামে আমাদের চাতুর্দিকের অদৃশ্য বায়ু স্তরকে সনাক্ত করেছেন এবং ধারণা দিয়েছেন, এই বায়ুমণ্ডলের বায়ুস্তর বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন রকম। আমাদের ভূ-পৃষ্ঠকে আবৃত করা এই বায়ুমণ্ডলকে বিজ্ঞান সাতটি স্তরে বিভক্ত করেছে; প্রতিটি স্তরেরই রয়েছে আলাদা নিজস্ব কিছু স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য। ফলে প্রতিটি স্তর সম্পূর্ণভাবে একেকটি আলাদা স্তরের মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের চারপার্শ্বের এই বায়ুমণ্ডলই পৃথিবীর বুকে জীবনকে সম্ভব সকল সুরক্ষার প্রাচীর গড়ে তুলেছে। এই বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরের যে কোন একটির অনুপস্থিতি পৃথিবীর বুকে থাকা জীবনকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে — আজকের বিজ্ঞান এমনটাই মন্তব্য করেছে। এখন ভেবে দেখুন, মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার কেমন ত্রুটিহীন সৃষ্টিশৈলী সকল ক্ষেত্রে দৃশ্যমান?

ভূপৃষ্ঠ থেকে ঊর্ধ্বে যে অদৃশ্য গ্যাসের আবরণ পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে তাকে বায়ুমণ্ডল বা Atmosphere বলে। বায়ুমণ্ডল বলতে পৃথিবীকে চারপাশে ঘিরে থাকা বিভিন্ন গ্যাস মিশ্রিত স্তরকে বুঝায়; যা পৃথিবী তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা ধরে রাখে। একে অবার আবহমণ্ডলও বলা হয়। বায়ুমণ্ডল চোখে দেখা যায় না,শুধু এর অস্তিত্ব আমরা অনুভব করতে পারি। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে এই বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর আবর্তনের সঙ্গে আবর্তিত হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে মোটামুটিভাবে প্রায় ১০,০০০ কিমি পর্যন্ত বায়ুমন্ডলের অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা হয়। মোটামুটিভাবে প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত অবস্থিত এই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে উপাদান ও রাসায়নিক গঠন অনুসারে মূলতঃ ২ টি স্তরে ভাগ করা যায়; যথা — (১) Homosphere বা সমমন্ডল, এবং (২) Heterosphere বা বিষমমন্ডল।

সমমন্ডল ও বিষমমন্ডলকে সর্বসাকুল্যে বিজ্ঞানীরা ৭ টি ভাগে বিভক্ত করেছেন; অর্থাৎ - উচ্চতা, উষ্ণতা ও বায়ুমন্ডলের উপাদানের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর উপরের চতুর্দিকের বায়ুমণ্ডলকে ভাগ করা স্তরের এই বিভক্তিগুলো মোটামুটিভাবে ৭ প্রকার — (১) ট্রোপোস্ফিয়ার, (২) স্ট্রাটোস্ফিয়ার, (৩) মেসোস্ফিয়ার, (৪) ওজোনোস্ফিয়ার, (৫) থার্মোস্ফিয়ার, (৬) আয়নোস্ফিয়ার, ও (৭) এক্সোস্ফিয়ার।

এখন দেখা যাক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই স্তরগুলো অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য —
১) ট্রপোস্ফিয়ার (Troposphere) বা আবহাওয়া স্তর :- ভু-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত হোমোস্ফিয়ারের প্রথম স্তরকে ট্রপোস্ফিয়ার (Troposphere) বলে; এটি সর্বনিম্ন বায়ুস্তর। বলতে গেলে এটি ভূপৃষ্টের লাগোয়া স্তর; যা আমরা অনুভব করি। এই স্তরের সাধারন উচ্চতা ৬ কিমি; বিষুব রেখার দিকে ১২ কিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারনতঃ বায়ুমণ্ডলীয় ব্যবস্থাদী তিন থেকে চার কিমি পর্যন্ত বিরাজমান থাকে; প্রায় ৭৫% বায়ুমণ্ডলীয় গ্যাস এই স্তরেই থাকে। 

২) স্ট্রাটোস্ফিয়ার [Stratosphere] বা শান্তমণ্ডল :- ট্রপোস্ফিয়ার-এর উপরের ১৮ থেকে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুস্তরকে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডল বলে। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে ধূলিকণা, মেঘ প্রভৃতি না থাকায় এখানে ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে না। স্ত্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে বায়ুপ্রবাহ, মেঘ, ঝড়, বৃষ্টি ও বজ্রপাত দেখা যায় না বলে দ্রুতগতিসম্পন্ন জেটবিমানগুলো ঝড়-বৃষ্টি এড়িয়ে চলার জন্য স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের মধ্য দিয়ে চলাচল করে। জেটবিমানগুলি সাধারণত এই স্তরের মধ্যে দিয়ে চলার সময়ে আকাশে সাদা দাগ রেখে যায়।

৩) মেসোস্ফিয়ার (Mesosphere) :- স্ট্রাটোস্ফিয়ারের উপরে ৫০ কিমি থেকে ৮০ কিমি পর্যন্ত হোমোস্ফিয়ারের তৃতীয় স্তরকে মেসোস্ফিয়ার (Mesosphere) বলে।

৪) ওজোনোস্ফিয়ার (Ozonosphere) :- মেসোস্ফিয়ারের উপরে ওজন গ্যাসের স্তরটিকে ওজোনোস্ফিয়ার বলা হয়। মেসোস্ফিয়ার থেকে ২০-৫০ কি.মি. উচ্চতার মধ্যে এ স্তরটি; এটি সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষাকারী স্তর। 

৫) থার্মোস্ফিয়ার (Thermosphere) :- মেসোপজের পর থেকে প্রায় ৫০০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত অবস্থিত হালকা বায়ূস্তরকে থার্মোস্ফিয়ার (Thermosphere) বলা হয়। থার্মোস্ফিয়ারের বিস্তার প্রায় ৯০-৫০০ কিমি। এর বৈশিষ্ট্যগুলি হলো - উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই স্তরের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকে। হালকা বায়ু দিয়ে গঠিত এই স্তরের ভর বায়ুমণ্ডলের মোট ভরের মাত্র ০.৫%। এই স্তরের নিম্নভাগে তড়িৎযুক্ত কণা বা আয়নের উপস্থিতি দেখা যায়। এখানে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, ওজোন প্রভৃতি গ্যাস আয়নিত অবস্থায় থাকে।

৬) আয়নোস্ফিয়ার(Ionosphere) :- এই স্তরের শেষ সীমানা প্রায় ৫০০ কিমি। 
এই স্তরের বায়ু আয়নিত অবস্থায় রয়েছে (এই বিরাট অঞ্চলটি বিদ্যুতযুক্ত অসংখ্য কণা অর্থাৎ, আয়ন ও ইলেকট্রনে পূর্ণ হয়ে আছে)। তড়িতযুক্ত কণা বা আয়নের উপস্থিতির জন্য এই স্তরকে আয়নোস্ফিয়ারও বলা হয় । অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের এই স্তরের দুটি নাম রয়েছে, যেমন- থার্মোস্ফিয়ার ও আয়নোস্ফিয়ার। তবে এই স্তরটি আয়োনোস্ফিয়ার নামেই বেশি পরিচিত। এখানে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, ওজোন প্রভৃতি গ্যাস আয়নিত অবস্থায় থাকে। তড়িতাহত অণুর চৌম্বক বিক্ষেপের ফলে সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলে এক রকম উজ্জ্বল আলোক বিচ্ছুরণ দেখা যায়, একে মেরুজ্যোতি বা মেরুপ্রভা বলে। ভূপৃষ্ঠের বেতার তরঙ্গগুলি আয়নোস্ফিয়ার ভেদ করে আর উপরে যেতে পারে না বলে এই স্তর থেকে বেতার তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে । তাই বিভিন্ন রেডিও স্টেশন থেকে প্রচারিত গান, বাজনা, নাটক, কবিতা, সংবাদ প্রভৃতি আমরা রেডিও মারফত বাড়ি বসে শুনতে পাই। এই স্তর থেকে রেডিও তরঙ্গ প্রতিফলিত হয় বলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নিতকরন সম্ভব হয়েছে; এটিকে ঝালর স্তরও বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এটি বায়ুস্তরের অলঙ্কার স্বরূপ। 

৭) এক্সোস্ফিয়ার (Exosphere) :- থার্মোস্ফিয়ারের উর্দ্ধে প্রায় ১৫০০ কিমি পর্যন্ত বায়ূস্তরকে এক্সোস্ফিয়ার (Exosphere) বলা হয়। এক্সোস্ফিয়ারের বিস্তার প্রায় ৫০০-১৫০০ কিমি। এর বৈশিষ্ট্যগুলো হলো - এই স্তরের বায়ু এত হালকা যে, এর অস্তিত্ব প্রায় বোঝাই যায় না। এই স্তরে হিলিয়াম ও হাইড্রোজেন গ্যাসের প্রাধান্য দেখা যায়। কৃত্রিম উপগ্রহ, স্পেস স্টেশন প্রভৃতি এই স্তরে অবস্থান করে। এই স্তরে উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়, তবে তা দ্রুত নয়। এই স্তরে গ্যাসের ঘণত্ব অত্যান্ত কম এবং আয়নিত অবস্থায় আছে। 

এই ভাবেই বিজ্ঞানীরা বায়ুমন্ডলের বায়ুস্তরকে সাতটি ভাগে বিভক্ত করেছেন, যার প্রতিটি স্তর অত্যান্ত সঠিকতার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে; মিলিত সমন্বয়তার মাধ্যমে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার কাজটি সার্বক্ষানিক অত্যান্ত সুনিপুন ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করে যাচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে বায়ুমণ্ডলে প্রাণহীন পরমানুগুলো নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে প্রাণময় পৃথিবীর জন্ গড়ে তুলছে সচেতন অস্তিত্ব; যা করছে মহান স্রষ্টার নির্দেশে।

বিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে বায়ুমণ্ডলের স্তরকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে সকলেই একমত হয়েছেন যে, এর স্তরভেদ প্রধানতঃ দুটি হলেও মূল স্তর সাতটি। আর এই তথ্যটির ধারণা আশ্চর্যজনকভাবে পবিত্র কোর'আন ও হাদিসের সাথে মিলেও যায়। সহীহ মুসলিম শরীফ-এর কিতাবুল ঈমান অধ্যায়ের মি'রাজ এবং নামায ফরয হবার বর্ণনায়, ৩০৮ নং হাদীসে উল্লেখ আছে — হযরত আনাস ইব্নে মালিক ইবনে সা’সাআ’হ (রাঃ) হতে বর্ণিত - রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে যেই রাতে আল্লাহ তা'আলা পরিভ্রমণে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই রাতের ঘটনা বর্ণনায় সাহাবীগণের সম্মুখে তিনি বলেছেন - যখন আমি কা’বা গৃহে উন্মুক্ত অংশ হাতিমে (উপনীত হলাম এবং তখনও আমি ভাঙ্গা ঘুমে ভারাক্রান্ত) ঊর্ধ্বমুখী শায়িত ছিলাম, হঠাৎ এক আগন্তুক ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ) আমার নিকট আসিলেন এবং আমাকে নিকটবর্তী/ জমজম কূপের সন্নিকটে নিয়ে আসলেন। 

অতঃপর আমার বক্ষে ঊধর্ব র্সীমা হইতে পেটের নিম্ন সীমা পর্যন্ত চিরিয়া ফেলিলেন এবং আমার হৃৎপিণ্ড বা কল্বটাকে বাহির করিলেন। অতঃপর একটি স্বর্ণপাত্র উপস্থিত করা হইল, যাহা ইমান (পরিপক্ব সত্যিকার জ্ঞানবর্ধক) বস্তুতে পরিপূর্ণ ছিল। আমার কল্বটাকে (জমজমের পানিতে) ধৌত করিয়া তাহার ভিতরে ঐ বস্তু ভরিয়া দেওয়া হইল এবং কল্বটাকে নির্ধারিত স্থানে রাখিয়া আমার বক্ষকে ঠিকঠাক করিয়া দেওয়া হইল। অতঃপর আমার জন্য খচ্চর হইতে একটু ছোট, গাধা হইতে একটু বড় শ্বেত বর্ণের একটি বাহন উপস্থিত করা হইল, তাহার নাম “বোরাক”; যাহার প্রতি পদক্ষেপ দৃষ্টির শেষ সীমায়। সেই বাহনের উপর আমাকে সওয়ার করা হইল। 

ঘটনা প্রবাহের ভিতর দিয়ে জিবরাইল (আঃ) আমাকে লইয়া নিকটবর্তী, তথা প্রথম আসমানের দ্বারে পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। ভিতর হইতে পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হইল, জিবরাইল স্বীয় পরিচয় প্রদান করিলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হইল, আপনার সঙ্গে কে আছেন? জিবরাইল বলিলেন, মুহাম্মদ (সাঃ) আছেন। বলা হইল, তাঁহাকে নিয়া আসিবার জন্যই তো আপনাকে তাঁহার নিকট পাঠান হইয়াছিল? জিবরাইল বলিলেন, হাঁ। তারঃপর আমাদের প্রতি মোবারকবাদ জানাইয়া দরজা খোলা হইল। গেটের ভিতরে প্রবেশ করিয়া তথায় আদম (আঃ)-কে দেখিতে পাইলাম। জিবরাইল আমাকে তাঁহার পরিচয় করাইয়া বলিলেন, তিনি আপনার আদি পিতা আদম (আঃ), তাঁহাকে সালাম করুন। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। আমার সলামের উত্তরদানে আমাকে “সুযোগ্য পুত্র ও সুযোগ্য নবী” আখ্যায়িত করিলেন এবং খোশ আমদেদ জানাইলেন।

অতঃপর জিবরাইল আমাকে লইয়া দ্বিতীয় আসমানের দ্বারে পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। এখানেও পূর্বের ন্যায় কথোপকথন হইল এবং শুভেচ্ছা মোবারকবাদ জানাইয়া দরজা খোলা হইল। ভিতরে প্রবেশ করিয়া তথায় ইয়াহইয়া (আঃ) ও ঈসা (আঃ)-এর সাক্ষাৎ পাইলাম; তাঁহাদের উভয়ের নানী পরস্পর ভগ্নী ছিলেন। জিবরাইল আমাকে তাঁহাদের পরিচয় দানে সালাম করিতে বলিলেন, আমি তাঁহাদিগকে সালাম করিলাম। তাঁহারা আমার সালামের উত্তর প্রদান করতঃ “সুযোগ্য ভ্রাতা সুযোগ্য নবী” বলিয়া আমাকে খোশ আমদেদ জানাইলেন।

অতঃপর জিবরাইল (আঃ) আমাকে লইয়া তৃতীয় আসমানের দ্বারে পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। তথায়ও পূর্বের ন্যায় কথোপকথনের পর শুভেচ্ছা স্বাগত জানাইয়া দরজা খোলা হইল। ভিতরে প্রবেশ করিয়া ইউসুফ (আঃ)-এর সাক্ষাৎ পাইলাম। জিবরাইল (আঃ) আমাকে তাঁহার সহিত পরিচয় করাইয়া সালাম করিতে বলিলেন; আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি সালামের উত্তর দান করতঃ আমাকে “সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী” বলিয়া মোবারকবাদ জানাইলেন। 

অতঃপর আমাকে লইয়া জিবরাইল চতুর্থ আসমানের নিকটে পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। সেখানেও পূর্বের ন্যায় প্রশ্নোত্তরের পর শুভেচ্ছা স্বাগত জানাইয়া দরজা খোলা হইল। ভিতরে প্রবেশ করিয়া আমরা তথায় ইদ্রিস (আঃ)-এর সাক্ষাৎ পাইলাম। জিবরাইল (আঃ) আমাকে তাঁহার পরিচয় করাইয়া সালাম করিতে বলিলেন। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি সালামের উত্তর দিলেন এবং “সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী” বলিয়া আমাকে মারহাবা জানাইলেন।
 
অতঃপর জিবরাইল আমাকে লইয়া পঞ্চম আসমানে পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। এই স্থানেও পূর্বের ন্যায় প্রশ্নোত্তর চলার পর শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ দানের সহিত দরজা খোলা হইল। আমি ভিতরে পৌঁছিয়া হারুন (আঃ)-এর সাক্ষাৎ পাইলাম, জিবরাইল আমাকে তাঁহার পরিচয় দানে সালাম করিতে বলিলেন। আমি সালাম করিলাম। তিনি আমার সালামের উত্তর দিলেন এবং “সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী” বলিয়া আমাকে খোশ আমদেদ জানাইলেন।

তারঃপর জিবরাইল আমাকে লইয়া ষষ্ঠ আসমানের দরজায় পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। এস্থানেও পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হইলে জিবরাইল স্বীয় পরিচয় দান করিলেন, অতঃপর সঙ্গে কে আছে জিজ্ঞাস করা হইল; তিনি বলিলেন, মুহাম্মদ (সাঃ)। বলা হইল, তাঁহাকে তো নিয়া আসিবার জন্য অপনাকে পাঠান হইয়াছিল? জিব্রাঈল বলিলেন, হাঁ। তৎক্ষণাত শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানাইয়া দরজা খোলা হইল। তথায় প্রবেশ করিয়া মুসা (আঃ)-এর সাক্ষাৎ পাইলাম । জিবরাইল (আঃ) আমাকে তাঁহার পরিচয় জ্ঞাত করিয়া সালাম করিতে বলিলেন। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি সালামের উত্তর প্রদান করিলেন এবং “সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী” বলিয়া আমাকে মোবারকবাদ জানাইলেন। যখন আমি এই এলাকা ত্যাগ করিয়া যাইতে লাগিলাম তখন মুসা (আঃ) কাঁদিতেছিলেন। তাঁহাকে কাঁদিবার কারণ জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেন, আমি কাঁদিতেছি এই কারণে যে, আমার উম্মতে বেহেশত লাভকারীর সংখ্যা এই নবীর উম্মতের বেহেশত লাভকারীর সংখ্যা অপেক্ষা কম হইবে, অথচ তিনি বয়সের দিক দিয়া যুবক এবং দুনিয়াতে প্রেরিত হইয়াছেন আমার পরে। 

তারঃপর জিবরাইল (আঃ) আমাকে লইয়া সপ্তম আসমানের প্রতি আরোহণ করিলেন, এবং তাহার দ্বারে পৌঁছিয়া দরজা খুলিতে বলিলেন। এস্থানেও পূর্বের ন্যায় সকল প্রশ্নোত্তরই হইল এবং দরজা খুলিয়া শুভেচ্ছা ও স্বাগত জনান হইল। আমি ভিতরে প্রবেশ করিলাম। তথায় ইবরাহিম (আঃ)-এর সাক্ষাৎ লাভ হইল। জিবরাইল আমাকে বলিলেন, তিনি আপনার (বংশের আদি) পিতা, তাঁহাকে সালাম করুন। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি আমার সালামের উত্তর দিলেন এবং “সুযোগ্য পুত্র, সুযোগ্য নবী” বলিয়া মারহাবা ও মোবারকবাদ জানাইলেন। (সংক্ষিপ্ত করলাম হাদীস)   

আমরা পৃথিবীবাসিরা আমাদের পরিচিত আকাশ বলতে যদি আমাদের ভূপৃষ্ঠের চতুর্দিকের খোলা শূণ্যতাকে ধরে নেই, তবে তার একটি নির্দিষ্ট সীমানাও ধরে নেওয়া যায়; আর সেই চিন্তায় আমরা যদি আমাদের বায়ুমণ্ডলকে ধরে নেই, তবে তার একটি সুনির্দিষ্ট সীমানা পাওয়া যায় এবং এই অঞ্চলটিও সাতটি অংশেই বিভক্ত। কিন্তু পবিত্র কোর'আনের সূরা আল মুলক-এর ৩ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন —
الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا مَّا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِن تَفَاوُتٍ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَى مِن فُطُورٍ 
অর্থাৎ - 'তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টিতে কোন তফাত দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফেরাও; কোন ফাটল দেখতে পাও কি?'

পবিত্র কোর'আনুল কারীমে এই সাত স্তরের আকাশ বলতে মহাবিশ্বের সাতটি আলাদা স্তরকেই বুঝিয়েছেন, মাথার উপর দেখতে পাওয়া খোলা আকাশটি নয়; যা হতে পারে সাতটি আলাদা মাত্রায় বা সাতটি আলাদা আকর্ষণ ক্ষেত্র। অনেকে এ বিষয়টিকে আমাদের ভূপৃষ্টের সাত স্তরের বায়ু মণ্ডলকে বুঝানো হয়েছে বলে মনে করেন। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে বর্তমানে অনেকের কাছেই এই কথাটি পরিস্কার হয়ে গেছে যে, এই সাত স্তরের আকাশ বলতে আসলে আমাদের এই বায়ু মণ্ডলকে বুঝানো হয়নি; বুঝানো হয়েছে কোর'আনুল কারীমের ভিন্ন আয়াতে ভিন্ন আঙ্গিকে; আমরা তা পরে দেখবো। তবে এখানে এই স্তরভেদ বলতে একের অধিক বিশ্বকেই বুঝানো হয়েছে এবং তার সংখ্যা সাতটি বলেও পরিস্কার ধারনা দেওয়া হয়েছে। যার ধারে কাছেও বিজ্ঞান এখনো পৌঁছতে পারে নি।

মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা সূরা আম্বিয়ার ৩২ নং আয়াতে বলেন — 
وَجَعَلْنَا السَّمَاء سَقْفًا مَّحْفُوظًا وَهُمْ عَنْ آيَاتِهَا مُعْرِضُونَ
অর্থাৎ - 'আমি আকাশকে সুরক্ষিত ছাদ করেছি; অথচ তারা আমার আকাশস্থ নিদর্শনাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।'

বলা চলে আমাদের উপরস্থিত বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর চার দিকের এক গ্যাসীয় আবরণ; যার গড় উচ্চতা প্রায় দশ হাজার কিমি। হয়তো বলতে পারেন এতো উচু গ্যাসের স্তরের কি প্রয়োজন ছিল? এই উঁচু গ্যাসের স্তরই আমাদের পৃথিবীকে আবাসযোগ্য করে তুলেছে; এর সামান্য ব্যতিক্রমই এই আবাসযোগ্যতা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞান বলছে - মহাকাশের শেষ প্রান্তে থাকা লক্ষ লক্ষ বিভিন্ন আকৃতির মিটিওরাইট বা উল্কাপিণ্ড প্রতি নিয়ত আমাদের পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। বায়ু স্তরের ঘর্ষনে এই পাথরখণ্ডের উল্কাপিণ্ডগুলো ভষ্মে পরিণত হয়ে যাচ্ছে; রক্ষা পাচ্ছে আমাদের মাটির পৃথিবী। 

দিনে অন্ততঃ দু’চারটি উল্কাপিণ্ডও যদি আমাদের পৃথিবীতে চলে আসতো, তাতে পৃথিবীতে নির্বিগ্নে জীবনধারন অসম্ভব হয়ে পড়তো। তাছাড়া, সূর্য থেকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর হাজারো রকমের অতিবেগুণী রশ্মি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে; বায়ুস্তর এগুলোকে বাঁধা দিচ্ছে। এই কাজে এইসব বায়ুস্তরগুলো এমনই সিদ্ধহস্ত যে, ভাবলে মনে হয় যেন কোন অশরীরী মহাশক্তি দূরে বসে অনায়াসে এইসব ক্রিয়াগুলো সুনিপুনভাবে পরিচালনা করছেন। অবশ্য, ধর্মবিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেন, মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার নির্দেশে আসমানের ফেরেশতাগণ এসব কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করছেন।

বিজ্ঞানের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, আমাদের আজকের পৃথিবী আর জন্মলগ্নের পৃথিবী এক রকম নয়; অতিনবতারা বা সুপারনোভা (এটি হলো এক ধরনের নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ যার ফলশ্রুতিতে নক্ষত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং অবশেষরূপে থাকে নিউট্রন তারা কিংবা কৃষ্ণবিবর) বিস্ফোরণ থেকে ছায়পথের উৎপত্তি। সেই ছায়াপথের বিবর্তনের ধারায় তার অসংখ্য নক্ষত্রের একটি নগণ্য সদস্য সূর্যের দেহাংশ থেকে আমাদের পৃথিবীর জন্ম হয়েছে বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা। এই জন্ম ইতিহাস থেকেই বুঝা যায় যে, আদি পৃথিবী আজকের মত এতোটা সুরম্য ছিল না, ছিল এক জ্বলন্ত অগ্নিগোলক; যা ধীরে ধীরে বহু বছরের বিবর্তনে সৌন্দর্যের রাণী হয়ে উঠেছে, গড়ে উঠেছে প্রাণের আবাসভুমি। আজকের দিনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় মানুষ বুঝতে পারছে যে, কত কঠিন পরিস্থিতির ও সুক্ষ্ম জটিলতার মধ্য দিয়ে কত আশ্চর্যজনক ভাবে গড়ে উঠেছে আমাদের এই পৃথিবী।

এইসব ভাবতে গিয়ে মানুষ বিষ্ময়ে অবিভূত হয়ে পড়ছে এই ভেবে যে, কি করে এই অভাবিত সমন্বয় সাধিত হলো, যেখানে রয়েছে অসামান্য এক পারস্পারিক ভারসাম্যতার নিঁখুত সমন্বয়; যার যৎসামান্য পরিবর্তনে বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে পৃথিবী ও সমগ্র প্রাণী জগৎ। অথচ সৃষ্টিতে কত নিগূঢ় ভারসাম্যতা বিরাজিত, নেই কোন অপ্রতুলতা; চারিদিকেই আছে শুধু বিপুল প্রাচুর্যতা। অনেকেই সীমিত জ্ঞানের পরিসীমায় আবদ্ধ হয়ে এই প্রাচুর্যতার ব্যাখ্যা খুঁজে না পেয়ে সহজ করে বলে ফেলেন,‘বিশাল এই বস্তু সকল অনাদিকাল ধরে অবাদ বিচরণের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে প্রাণ; প্রাণ সৃষ্টির জন্য কোন স্রষ্টার প্রয়োজন হয়নি; প্রাণ বিশৃঙ্খল প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত দান।’

প্রাণ সৃষ্টির মহিমায় আমরা গর্বিত; আর সম্ভবতঃ এ কারণেই ইংরেজ দার্শনিক স্যার ফ্রন্সিস বেকন বলেছিলেন, 'সামান্য দর্শন জ্ঞান মানুষকে নাস্তিকতার দিকে টেনে নিয়ে যায়, আবার গভীর দর্শন জ্ঞান মানুষকে ধর্মের দিকে টেনে নিয়ে আসে।' সময়ের বিবর্তনে আজকের পরিপক্ক বিজ্ঞান সঠিক তথ্যের সন্ধান দিয়ে সৃষ্টিকর্তাকেই প্রতিষ্ঠিত করে যাচ্ছে। তাইতো বিজ্ঞানী ফ্রেড ওয়েল তার বৈজ্ঞানিক হিসেব-নিকেশ কষে বলেছিলেন, 'স্রষ্টাহীন, পরিকল্পনাহীন এবং অবাদ বিস্তৃতির ফলে যে ভাবনার ভূবন সৃষ্টি হতে পারে তাতে জীবন সৃষ্টির একান্ত পূর্বশর্ত প্রাণরস বা এনজাইম একটি কার্যক্ষম দল সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা যদি হয় একভাগ, তবে সম্ভবনাহীনতা হবে ১০৪০০০০ ভাগ।' অথচ অসীম সংখ্যক প্রাণ পৃথিবীর মুক্ত হাওয়ায় অবাদে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে; এত প্রাণের আবাসস্থল এই পৃথিবীকে কে দিল এমন আবাসযোগ্যতা? 

তাইতো মহান দয়াময় আল্লাহ সূরা ক্কাফের ৫ নং আয়াতে বলেন —
مَّا لَهُم بِهِ مِنْ عِلْمٍ وَلَا لِآبَائِهِمْ كَبُرَتْ كَلِمَةً تَخْرُجُ مِنْ أَفْوَهِهِمْ إِن يَقُولُونَ إِلَّا كَذِبًا
অর্থাৎ - 'এ সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও নেই। কত কঠিন তাদের মুখের কথা। তারা যা বলে তা তো সবই মিথ্যা।'

আমার এই প্রশ্নে আরও অনেক জবাব রয়েছে বিজ্ঞানের হাতে। তবে জীবনের এই আবাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে কত হাজার হাজার সমন্বয় করতে হয়েছে তাঁকে তা একমাত্র তিঁনিই জানেন, যিঁনি এইসব সমন্বয় সুচারুভাবে সাধন করেছেন। তবে কিছু কিছু বিষয় আজকের বিজ্ঞানীরা তাদের অক্লান্ত চেষ্টায় জানতে পেরেছেন।

'আপনা আপনি গজিয়ে উঠেছে এই বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড' - এমন একটি ধারনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কানাডার রয়েল সোসাইটির জীব ও পদার্থ বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক এ্যালন ‘The Evidence of God in expanding Universe' গ্রন্থে বলেছেন, 'এ পৃথিবীকে এত নিপুন সমন্বয়ের মাধ্যমে এমনি করে প্রাণীদের বসবাসের উপযোগী করে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, সেগুলোকে বিবেচনা করলে কোন ভাবেই বলা যায় না যে, এই পৃথিবী আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে।’ এই কথার উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা নিজে, সূরা আল মুরসালাত-এর ২৫ নং আয়াতে; তিনি বলেন —
أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ كِفَاتًا
অর্থাৎ - 'আমি কি পৃথিবীকে সৃষ্টি করিনি ধারণকারিনী রূপে?' 
এবং ২৬ নং আয়াতে বলেন — أَحْيَاء وَأَمْوَاتًا অর্থাৎ - 'জীবিত ও মৃতকে।' 

উপরোক্ত আয়াতে কাজী জাহান মিয়া (আল-কোরআন দ্য চ্যালেঞ্জ মহাকাশ পর্ব) ‘ধারনকারিনী' শব্দের জায়গায় ‘উপযুক্ত আবাস স্থল’ ব্যবহার করেছেন। ২৫ নং আয়াতে كِفَاتًا শব্দটির সঠিক অর্থ কি? মিসরের কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড. রাশেদ আল খলিফা তার ইংরেজী তরজমায় এই শব্দটিকে তরজমা করেছেন abode; যার অর্থ গৃহ, বাসস্থান,আবাসস্থল ইত্যাদি। আয়াত ২৫-এ বলা হয়েছে ‘ধারণকারিনী রূপে’; কাকে ধারণকারিনী বলা হয়েছে? আবার আয়াত ২৬ এ বলা হয়েছে ‘জীবিত বা মৃতকে’; তাহলে একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যাওয়া যায় যে, এখানে প্রাণীর কথা বলা হয়েছে এবং আমরা জানি জীবিত প্রাণীরা তাদের আবাস গৃহে বসবাস করে; সেই সূত্রে পৃথিবীকে প্রাণীর আবাস গৃহ বলাটাই বাঞ্চণীয়। 

সূরা আল আম্বিয়ার ১৬ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন —
وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاء وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَاعِبِينَ
অর্থাৎ - ‘আমি আকাশ ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী বস্তুপুঞ্জকে খেলার ছলে সৃষ্টি করি নাই।'

এবং সুরা বাকারা-র ১৬৩ নম্বর আয়াতে তিনি বলেন —
وَإِلَـهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ
অর্থাৎ - 'আর তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি অতি দয়াময়, পরম দয়ালু।'

এবং ১৬৪ নম্বর আয়াতে বলেন —
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاخْتِلاَفِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنزَلَ اللّهُ مِنَ السَّمَاء مِن مَّاء فَأَحْيَا بِهِ الأرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَآبَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخِّرِ بَيْنَ السَّمَاء وَالأَرْضِ لآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
অর্থাৎ - 'নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে, সে নৌকায় যা সমুদ্রে মানুষের জন্য কল্যাণকর বস্তু নিয়ে চলে এবং আসমান থেকে আল্লাহ যে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন অতঃপর তার মাধ্যমে মরে যাওয়ার পর যমীনকে জীবিত করেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সকল প্রকার বিচরণশীল প্রাণী ও বাতাসের পরিবর্তনে এবং আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী স্থানে নিয়োজিত মেঘমালায় রয়েছে নিদর্শনসমূহ এমন কওমের জন্য, যারা বিবেকবান।'

তাই বলা যায়, এমনোতর হাজার হাজার সমন্বয়ের মধ্যে একটি বিশেষ সমন্বয় হলো - পৃথিবীর অক্ষ তির্যকতা। আমরা জানি পৃথিবী তার কক্ষতলে নিজ অক্ষের সাথে ২৩.৫০ ডিগ্রী কৌণিক অবস্থানে অবস্থিত। এই অবস্থান যে কত সুক্ষ্ম হিসেব ব্যবস্থা, তা বিজ্ঞানী মাত্রই জানেন। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, এই অবস্থান সকল গ্রহ বা নক্ষত্রের জন্য এক রকম নয়। আর এ থেকেই পরিস্কার বুঝা যায় যে, এ ব্যবস্থা আপনা আপনি হতে পারে না। হয়তো বলতে পারেন, প্রকৃতির নিয়মে ব্যবস্থাটি আগে থেকেই হয়েছিল; সেই হয়ে থাকার সুবাদে পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ আপনা আপনি হয়েছে। 

অনুভবশক্তির পরিসর অনুযায়ী আমার জ্ঞানের সীমা অতি ক্ষুদ্র; তারপরও মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা সুযোগ করে দিলে, প্রাণ সৃষ্টি যে কত জটিল ও সুক্ষ্ম সমন্বয়তার মধ্যে ঘটেছে, তার আলোচনা অন্য পরিসরে অন্য সময় আরেকদিন করবো; তখন দেখবেন, তা এই সব মহাজাগতিক সমন্বয়ের চেয়েও বহুগুন জটিল। ফলে এসব কথা কোন উপায়েই বলা চলে না যে, এ সব আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে। 

আমি আলোচনা করছিলাম পৃথিবীর তীর্যকতা নিয়ে, আসুন সেখানেই থাকি। আজকের বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা- নিরীক্ষায় এ বিষয়টি স্বতসিদ্ধ যে, এই তীর্যকতার জন্যেই পৃথিবীতে ঋতুচক্রের সূচনা হয়; শীত গ্রীষ্মে তাপমাত্রার তারতম্যের মাধ্যমে দেখা দেয় ঋতু বৈচিত্র। আমরা জানি পৃথিবী তার কক্ষপথে নিজ অক্ষের সাথে ২৩.৫০ ডিগ্রী কৌণিক অবস্থানে অবস্থিত। এই তীর্যকতা সঠিক মাত্রায় না হলে পৃথিবী হতো আবাসের অনুপোযুক্ত; যার প্রকৃত উদাহরণ হলো - ইউরেনাস। ইউরেনাসের এই তীর্যকতা ৯০ ডিগ্রী বা তারও বেশী; যার ফলে গ্রহটিতে বিরাজ করছে উদ্ভট এক চরম ভাবাপন্নতা। এই গ্রহের মেরু অঞ্চলে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কাল পৃথিবীর হিসেবে প্রায় বিশ বছর। বিজ্ঞানীরা সুক্ষ্ম হিসেব করে দেখেছেন যে, এই তীর্যকতাও একেবারে স্থির নয়; খুব ধীর গতিতে এর পরিবর্তন ঘটে। কমতে কমতে একসময় বিপরীত মুখী হয়ে আবারও তা পূর্বাবস্থানে ফিরে আসে; এই পর্যায় কালটি প্রায় ২৬,০০০ বছর; একে বলা হয় পৃথিবীর অক্ষঘূর্ণির অগ্রগমন চক্র। 

এই তীর্যকতা পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তীত হয় পৃথিবীর আবহাওয়া। এই পরিবর্তন এতোটাই ধীরলয়ে ঘটে যে, প্রাণীকুল বেঁচে থাকার তাগিদে নিজেদেরকে অনায়াসে খাপ খাইয়ে নেয়; ২৬ ,০০০ বছর পরে আবার ফিরে আসে সেই আদি অবস্থানে। এই ফিরে আসার চক্রটি যদি সুনিশ্চিত করা না হত তাহলে পৃথিবী আটকে যেতো কোন এক নির্দষ্ট ভাবাপন্ন অবস্থায়; যার প্রভাব পড়তো প্রাণীকুলের জীবনচক্রে। হয়ত পৃথিবীর পরিবেশ একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় স্থির হয়ে যেতো কিছুসংখ্যক প্রাণীর চারণ ভূমি হিসেবে। পৃথিবীতে আবহাওয়ার এই পরিবর্তন আছে বলেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতি, আবার দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন প্রাণ। সম্ভবতঃ দয়াময় এই চক্রটি বিধিত করেছেন পৃথিবীর রূপ বৈচিত্রকে বিভিন্ন প্রাণীর জন্যে উপযোগী করে তোলার প্রয়োজনেই।

নিশ্চয়ই এই বিবর্তন প্রকৃতি জগতে এক মহা সুসংবাদ; হয়তো তা পৃথিবীতে দয়াময়ের সৃষ্টি বৈচিত্রের এক মহা নিয়ামক। হয়তো এই ব্যবস্থাই প্রাণ সৃষ্টির এই উদ্দীপনাকে ক্ষুদ্রত্বের সীমাবদ্ধতা থেকে বৃহৎ পরিসরে মুক্তি দিয়েছে। আর সৃষ্ট প্রাণগুলো আবাস যোগ্যতা পেয়েছে নিজ নিজ সময় সীমা পর্যন্ত। তাইতো হাজার হাজার বছরের নিরলস পরিশ্রমের ফলে প্রাপ্ত ধারনার সারমর্ম দয়াময়ের কাছ থেকে নেমে এসেছে চিন্তাশীল মানুষের জন্যে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। জানলো না কেউ, বুঝলো না কেউ, শুধু গুমরে কাঁদলো কোর'আনের বাণী; আজো থামলো না সে কান্না। রয়ে গেল আরো কত না জানা রহস্য তারই পাতায়।

তাই, সূরা আল মুমিনুন-এর ১৭ নং আয়াত দিয়ে আজকের মতো সমাপ্ত করছি; আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন —
وَلَقَدْ خَلَقْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعَ طَرَائِقَ وَمَا كُنَّا عَنِ الْخَلْقِ غَافِلِينَ
অর্থাৎ- 'আমি তোমাদের উপর স্তরে স্তরে সাত মহাকাশ সৃষ্টি করিয়াছি, আমি সৃষ্টি বিষয়ে অসতর্ক নহি।’

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
০৩ জানুয়ারি, ২০১৮.

মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০২০

আলোর পরশমনি মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ):

বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রঃ) প্রায় পাঁচশ বছর পূর্বে অন্তর দৃষ্টির মাধ্যমে মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র আগমন সংবাদ অবগত হয়ে স্বীয় বরকতময় জুব্বাহ মোবারক তাঁর পুত্র তাজউদ্দিন আবদুল রাজ্জাকের কাছে রেখে বলেছিলেন, "মুজাদ্দেদ আলফেসানীর আবির্ভাব হলে এই জুব্বাহ তাঁকে পৌঁছে দিও।" যথাসময়ে এই মোবারকময় জুব্বাহ মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র হস্তগত হয়েছিল। 

বস্তুতঃ মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) ছিলেন একাধারে একজন মুজতাহিদ, ফকিহ এবং এলমে শরিয়ত ও এলমে মা'রেফতের বিশাল এক মহীরূহ। তাঁর বিশাল জ্ঞান ও ঈমানী দাপটের কাছে মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট, ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক, পৃথিবীর ইতিহাসে মহান শাসকদের অন্যতম, মহামতি আকবর নামে পরিচিত, জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর-এর অহংকারও ধুলায় মিশে গিয়েছিল; সম্রাট আকবরের পুত্র দিল্লীর নেশাগ্রস্ত সম্রাট জাহাঙ্গীরের কপালে তওবাহ নসীয়ত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে সম্রাট শাহাজাহান ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো ঈমানদার সম্রাট-এর আবির্ভাব ঘটেছিল।

আমাদের এই পাকভারত উপমহাদেশে আজ মুসলমানদের যে আধিক্য, শিক্ষা-দীক্ষা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সব কিছুতেই মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-এর অবদান অনস্বীকার্য; বরং সবার শীর্ষে। জাগতিক, আধ্যাত্মিক, শরীয়ত, মারফত তথা ইসলামের সকল শিক্ষার পরতে পরতে তাঁর অবদানের কথা অনস্বীকার্য ও অদ্বিতীয়। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র আজীবন সাধনার ফলেই মধ্যপ্রাচ্য, আরব জাহান, আফ্রিকা, সুদূর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে মুসলিম ঐতিহ্য এতোটা দেদীপ্যমান হতে পেরেছে।

ইসলামী আদর্শের উপর অটল ও অবিচল থাকতে গিয়ে যুগে যুগে ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছেন অনেক ইমাম, মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ, মুজাহিদ, দ্বীনের দাঈসহ অসংখ্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব; যারা জালিমের জুলুম ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র সত্য ও ন্যায়ের জন্য দ্বীনের পথে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার প্রত্যাশায় হাসিমুখে সকল অপবাদ, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। 

আহমদ সরহিন্দ মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) ১৫৬৩ খৃস্টাব্দে জন্ম গ্রহন করেন। সেই সময় সম্রাট আকবর ছিলেন দিল্লীর সিংহাসনে আসীন। আকবর প্রথম জীবনে ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি 'দীন-ই- ইলাহী' নামক এক নতুন ধর্মনীতি চালু করেন। প্রকৃতপক্ষে আকবরের ধর্মনীতি বিভিন্ন ভ্রান্তনীতি প্রভাবিত ছিল। প্রথমতঃ ভ্রান্ত সুফীবাদ ও মিথ্যা শিয়া মতবাদ তাঁর উপর প্রভাব ফেলে; দ্বিতীয়তঃ সমকালীন হিন্দু ধর্মযাজকদের ধর্ম সংস্কার আন্দোলন তাঁর উপর প্রভাব ফেলে; তৃতীয়তঃ শেখ মোবারক ও তাঁর পুত্রদ্বয় আবুল ফজল ও ফৈজী-র প্রভাব পড়ে।

১৫৭৫ সালে ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক বলে পরিচিত মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর ধর্ম নিয়ে আলোচনার জন্য ফতেহপুরে একটি ইবাদতখানা স্থাপন করেন। প্রথম পর্যায়ে শুধু মুসলিম আলেমরাই সেখানে আমন্ত্রিত হতেন। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে হিন্দু, বৈদ্ধ, জৈন, খৃস্টানসহ সকল ধর্মাবলম্বীরাই সেখানে আমন্ত্রিত হতো। তাঁরা আলাপ আলোচনা করে ১৫৭৯ সালে অভ্রান্ত মতবাদ বলে একটি নতুন মতবাদ চালু করেন। তারই ফলে ১৫৮১ সালে 'দীন-ই-ইলাহী' নামক এক নতুন ধর্মমত প্রচার করেন।

আকবর মূলতঃ রাজনৈতিক কারণে উক্ত ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন; বিভিন্ন ধর্মের লোকজনককে একই ধর্মে এনে ভারতবর্ষে তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি 'দীন-ই-ইলাহী'কে জাতীয় ধর্মের রূপ দিতে প্রয়াস চালান। উক্ত ধর্ম প্রচার শুরু করার পরই আকবর ইসলাম বিরোধী হয়ে উঠেন। তখন তিনি মনে করতেন যে, ইসলাম বেদুঈনদের ধর্ম এবং তা সভ্য সমাজের উপযোগী নয়। ইসলামী আক্বীদা তথা রিসালাত, আখেরাত, হাশর, ওহী প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিদ্রুপ মন্তব্য করতেন। কুর'আন যে আল্লাহর কালাম এই বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতেন এবং নবীর মিরাজকে অসম্ভব গণ্য করতেন। এমনকি আহমদ ও মুহাম্মদ নাম নিয়েও কটুক্তি করতেন তিনি। 

স্বার্থবাদী কিছু আলেমের সহযোগিতা নিয়ে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের সংমিশ্রনে সম্রাট আকবর 'দ্বীন-ই-ইলাহী' নামক এক নতুন ধর্মের সুচনা করেন এবং 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আকবর খলীফাতুল্লাহ'-এই নতুন ধর্মের কালিমা হিসাবে ঘোষিত করেন। 'আসসালামুআলাইকুম ওযারাহমাতুল্লাহ'-র পরিবর্তে ’আল্লাহু আকবর' বলে সালাম দেয়ার প্রচলন করেন। সালামের জবাব দানকারীকে তখন বলতে হতো ’জাল্লা জালালুহু’। আকবরকে সেজদা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ইসলামী কৃষ্টি -কালচার ও আইন কানুনের প্রতি ঘৃণা ছড়াতেন তিনি। দেশের মধ্যে খ্রিষ্ট ধর্মানুসারে ঘন্টা বাজানো চালু করা হয় এবং হিন্দু ধর্মের অনুসরণে প্রতিকৃতি পুজা শুরু হয়। মুসলমানদের জন্য গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয় এবং মুসলমানদেরকেও সুর্যের উপাসনা, কপালে তিলক লাগানো, কোমর ও কাঁধে পৈত্যা বাঁধতে নির্দেশ দেয়া হয়।

সুদ, মদ ও জুয়াকে হালাল ঘোষণা করা হয় এবং দাঁড়ি ছেঁটে ফেলার ফ্যাশন শুরু হয়, রাজ দরবারে মদ পান করার রেওয়াজ চালু হয়; তখন আলেমদেরকেও রাজ দরবারে মদ পান করতে হতো। ইসলামের অনুমোদিত একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ হয়। ইসলামের নির্দেশের বিরোধীতা করে পুরুষদের জন্য রেশমের ব্যবহার বৈধ করা হয়। মুসলমানেরা শুকর খায় না, কিন্তু আকবর উক্ত শুকরকে অতি পবিত্র প্রাণী হিসাবে ঘোষণা করেন এবং সকালে ঘুম থেকে উঠার পর শুকর দর্শনকেই কল্যাণকর বলে ঘোষণা দেন। মুসলমানদের মৃতদেহ কবরে দেয়ার পরিবর্তে আগুণে পুড়ে ফেলা বা পানিতে ভাসিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কোন মুসলমান তার মৃত আত্মীয়কে কবরস্থ করতে চাইলে উক্ত মাইয়্যাতের পা কিবলার দিকে দিয়ে কবর দিতে বলা হতো। অথচ মুসলমানদেরকে কিবলামুখী করেই কবর দেয়ার নির্দেশ রয়েছে। আরবী ভাষা শিক্ষা ও ফিক্হ চর্চাসহ দ্বীনি ইলম চর্চার পরিবর্তে দর্শনসহ আধুনিক জ্ঞান চর্চার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়।

শত চেষ্টা করেও সম্রাট আকবর তার নতুন ধর্ম প্রচারে সফল হতে পারেননি। তাঁর জীবদ্দশায় মাত্র আঠারজন উক্ত ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং তাঁর মৃত্যুর পর তারা পুনরায় নিজ ধর্মে ফিরে গিয়েছিল। অবশ্য এই ক্ষেত্রে আহমদ সরহিন্দ মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র ভূীমকাই ছিল মুখ্য। তিনি আকবরের 'দ্বীন-ই-ইলাহী'কে দ্বীন থেকে বিচ্যুত বলে অভিহিত করেন এবং তা প্রত্যাখ্যান করেন। 

একবার মুগল সম্রাট আকবর এক বিশাল উৎসবের আয়োজন করেন, যেখানে দুটি দরবার নির্মিত হয়; একটির নাম - 'আকবরী দরবার' এবং অপরটির নাম রাখা হয় - 'মুহাম্মদী দরবার'। 'আকবরী দরবার' প্রস্তত করা হলো বহু অর্থকরী খরচ করে; সেখানে করা হলো চোখ ঝলসানো আলোকসজ্জা, সুসজ্জিত মনোরম মঞ্চ, নিমন্ত্রিত অতিথিদের উপবেশনের জন্য প্রস্তত করা হলো জৌলুসময় গালিচা। পুষ্প সৌরভ ও আতরের সুঘ্রাণে 'আকবরী দরবার' পরিণত হলো ছোটখাটো এক শাদ্দাত-এর বেহেশত-এ; শাহী খাবারেরও ব্যবস্থা করা হলো। 

অপরদিকে 'মোহাম্মদী দরবার'-এর অবস্থা ছিল বড়ই করুণ; ছিন্ন তাবু, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ফরাস দিয়ে নির্মিত করা হলো সেই দরবার, খাবারের ব্যবস্থা করা হলো খুবই নিকৃষ্ট মানের! মোটেও কোন আলোকসজ্জার ব্যবস্থা ছিল না সেখানে। নিতান্ত মামুলী সাধারণভাবে নির্মিত এই দরবারটিকে আকবরী দরবারের নিকট খুবই জীর্ণ-শীর্ণ ও কুড়েঘরের মতো মনে হতে লাগলো।

এইরূপ করার মূলে সম্রাট আকবরের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, মানুষ দেখুক ও জানুক ইসলাম শেষ, ইসলামের কার্যকারিতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে! জীর্ণ-শীর্ণ এই ধর্ম বর্তমান যুগে অচল! 'দ্বীন-ই-এলাহী' একটি শান শওকতময় ও যুগোপযোগী ধর্ম। এখন আর কারো এ বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়, উচিতও নয়! মনে-প্রাণে সবারই নতুন ধর্মে দাখিল হওয়া উচিত।

উৎসবের দিন নির্দিষ্ট সময়ে বাদশাহ আকবর তার পারিষদবর্গ, আমির ওমরাহ ও বিশিষ্ট অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে মহাসমারোহে তাবুতে প্রবেশ করলেন; লোভী দুনিয়াদার লোকেরাও তাকে অনুসরণ করল। আনন্দে উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠলো 'আকবরী দরবার'। 

এমন সময় কেমন করে যেন মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) তাঁর মুরিদানসহ সেখানে উপস্থিত হলেন, সব কিছু দেখেশুনে বুঝতে আর তাঁর কিছু বাকি রইল না; কী উদ্দেশ্যে এই উৎসবের আয়োজন এবং কেনই-বা এই দুই দরবারের সাজ-সজ্জার মধ্যে এমন আকাশ-পাতাল ব্যবধান! মুসলমানদের অপদস্থ ও কোনঠাসা করা ছাড়া এইসব অর্থহীন কার্যকলাপের আর যে কোনই উদ্দেশ্য নেই তা তিনি ঠিকই বুঝতে পারলেন। 

মান-সম্মান-ইজ্জত নিজের অর্জিত কোন সম্পদ নয়; এ'সব আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামত। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) তাঁর মুরিদান ও কিছু দরিদ্র মুসলমানসহ 'মুহাম্মদী দরবার'-এ প্রবেশ করলেন। আহারের সময় হতেই মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) তাঁর একজন মুরিদের হাতে একটি লাঠি দিয়ে বললেন, "যাও এই লাঠি দিয়ে তুমি 'মুহাম্মদী দরবার'-এর চতুর্দিকে একটি বৃত্তাকার দাগ কেটে আসো।" 

কথা মতো মুরিদ লাঠি দিয়ে দরবারের চর্তুদিকে বৃত্তাকার একটি দাগ কেটে ফিরে এলেন। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) হাতে এক মুষ্টি ধূলি নিয়ে তা তুলে দিলেন সেই মুরিদের হাতেই এবং বললেন, "এইবার বাহিরে গিয়ে এই ধূলি আকবরী দরবারের দিকে ছুঁড়ে মারো।" 

মুরিদ আকবরী দরবারের দিকে ধূলি ছুঁড়ে মারার মুহূর্তের মধ্যে এক প্রলয়কান্ড ঘটে গেল। ভয়ঙ্কর তুফান শুরু হলো, আকবরী দরবার ঘিরে ফেললো; দরবারে তখন মহা ধুমধাম চলছিল। হঠাৎ তুফান দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। কী করবে বুঝে উঠার আগেই সমস্ত তাবু উড়ে গেল। আসবাবপত্র, সাজ-সজ্জা, খাদ্যসামগ্রী সব কিছুই তছনছ হয়ে গেল। তুফানে তাবুর খুটিগুলো উপড়ে উঠে গেল এবং সেগুলো অথিতিদের আঘাত করতে শুরু করল। একটি খুটি উপড়ে গিয়ে সম্রাট আকবর-এর মস্তকে পর পর সাতটি আঘাত করল। পাশেই মুহাম্মদী দরবার, আল্লাহপাকের অপার মহিমায় সেখানে তুফান এতটুকু স্পর্শও করল না। দরবারের সবাই মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র এই কারামত দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এবং উপস্থিত সবাই মিলে আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন।

আঘাত খুবই মারাত্মক ছিল, অনেক চিকিৎসা করা হলো, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। মস্তকের সেই আঘাতেই সম্রাট আকবর শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন এবং শয্যা হতে আর উঠতেই পারলেন না; কয়দিন পর সম্রাট আকবর মৃত্যুবরণ করলেন। এর সাথেই সমাপ্ত হলো সম্রাট আকবর-এর সুদীর্ঘ ৫০ বৎসরের রাজত্ব। দিল্লীর মসনদে সমাসীন হলেন তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর। সম্রাট আকবর-এর জীবদ্দশায় দিল্লীর সাম্রাজ্যে 'দ্বীন-ই-এলাহী'র ভ্রান্ত ধর্মীয় মতবাদের যে প্রভাব পড়েছিল সম্রাট জাহাঙ্গীর তা হতে মুক্ত হতে পারেননি। 

বিশ্বনবী হুজুরপাক হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহম্মদ মুস্তবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তিরোধানের পর হাজার বছর পর দেখা গেল দ্বীন ইসলাম এবং মুসলমানদের মধ্যে শিরক, কুফর ও বিদ'আত ঢুকে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। মুগল সম্রাট আকবরের দরবারে মোল্লা মোবারক নাগোরী তদীয় পুত্রদ্বয় যথাক্রমে আবুল ফজল ও ফৈজী ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ এবং সম্রাটের মনোরঞ্জনের মানসে, পার্থিব ধনসম্পদ, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও সম্মানের লোভে নিজেদের ইমানকে জলাঞ্জলী দিয়ে কোরআন হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা করে 'দ্বীন-ই-ইলাহী' নামে একটি বিতর্কিত ধর্মমতের প্রবর্তন করেছিল। 

দুনিয়াদার আলেম এবং চাটুকার অমাত্যদের হীন মানসিকতায় প্ররোচিত হয়ে সম্রাট আকবর শাহী ফরমান জারী করে নব ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের জন্যে ধর্মভীরু প্রজাদের বাধ্য করেন। সম্রাটের আনুগত্যশীল এই বানোয়াট ধর্মের বিরুদ্ধে ঈমানী দায়িত্ব নিয়ে মুজাদ্দেস আলফেসানী (রঃ) প্রথম কলম হাতে তুলে নেন। 'দ্বীন-ই-ইলাহী'-র অসারতা ব্যাখ্যা করে সম্রাটের দরবারে আমীর ওমরাহ ও তৎকালীন আলেমে দ্বীন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে তিনি এমনসব যুক্তিপূর্ণ চিঠিপত্র লেখা শুরু করেন যে, তাঁর ক্ষুরধার যুক্তির সামনে দ্বীন-ই-ইলাহী কোন সারবত্তাই খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে সম্রাট আকবর 'দ্বীন-ই-ইলাহী'কে ঐচ্ছিক ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন।

আকবরের মৃত্যুর পর সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। জীবনের প্রথমাবস্থায় তার চরিত্র, চেহারায়, পোশাক-পরিচ্ছেদ পুরোপুরি ইসলাম বিরোধী ছিল। তার শাসনামলেই একাদশ হিজরী শতকের মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-কে কারাগারে বন্দী করা হয়। আশফজাহ নামক এক ব্যক্তি সম্রাটকে পরামর্শ দিয়েছিল, বাদশাহী কর্মচারী, উজীর-নাজীর যেভাবে মুজাদ্দেদ সাহেবের শিষ্য হতে শুরু করেছে তাতে একদিন রাজ্যে বিপ্লব আসতে পারে, তাই তাঁর দিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। এরপরই মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-কে রাজ দরবারে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি জানতেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে প্রত্যেককে সেজদা বা প্রণিপাত এবং সম্মুখে নত হয়ে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে কুর্নিশ করতে হয়।

মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) ঘৃণাভরে এ'সব কূপ্রথাকে অবজ্ঞা করে মাথা উচুঁ করেই গিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর-এর সামনে দাড়াঁলেন। জাহাঙ্গীর জানতে চাইলেন ,তিনি কেন দরবারের আইন অনুসারে সেজদা বা কুর্নিশ করলেন না? অন্ততঃ আসসালামু আলাইকুম তো বলতে পারতেন!

উত্তরে মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) বলেন, "আমি জাহাঙ্গীরের দরবানের ভৃত্য নই, আমি মহান আল্লাহপাক-এর দরবারের ভৃত্য। আর তোমাকে সালাম দেই নাই এই জন্য যে তুমি অহঙ্কারী, হয়তো সালামের উত্তর দিবে না। তখন আমার সালাম দেওয়ার অর্থ হবে হুজুরপক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি সুন্নতকে পদদলিত করা।"

সম্রাট জাহাঙ্গীর রেগে গিয়ে মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-কে বন্দী করে গোয়ালিয়র দুর্গের কারাগারে পাঠান। এ সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে লোকজন সম্রাট জাহাঙ্গীরের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র হাজার হাজার অনুসারি রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। অবশেষে মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র একনিষ্ঠ ভক্ত কাবুলের শাসনকর্তা মোহাব্বত খানের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী অত্যন্ত কৌশলে সম্রাট জাহাঙ্গীর-কে বন্দি করে ফেলেন। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) মুহব্বত খানকে জাহাঙ্গীরের সাথে ভাল ব্যবহার করতে বললেন এবং কারাগার থেকে মুক্ত করে দিতে আদেশ দিলেন; মুহব্বত খানও তাই করলেন। 

জেলে থেকেই তিনি এসব করলেন এবং ভক্তদের উদ্দেশ্যে তিনি লিখলেন - "যদি সম্রাট আমাকে জেলখানায় প্রেরণ না করতেন তাহলে এক সহস্র কয়েদী কিভাবে দ্বীন ইসলামের ছায়াতলে আগমন করতো এবং আমার উপর এই বিপদ আপতিত হওয়া ব্যতীত আমার আধ্যাত্মিক উন্নতির অন্য কোন উপায় ছিল না।" 

ইতিহাস থেকে জানা যায় মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট আকবর প্রথম জীবনে অত্যন্ত ধর্মভীরু ছিলেন। এবাদত বন্দেগিতে যথেষ্ট সময় কাটাতেন, এমনকি ঘরে বাইরে সকল স্থানেই তিনি জামাতে নামাজ আদায় করতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে দুনিয়াদার বদ আলেমদের প্ররোচনায় তিনি নতুন ধর্মমতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তাঁর মৃত্যুর পর নূরজাহানের প্ররোচনায় তাঁর পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-কে গোয়ালিয়র দুর্গে কারাবন্দী করেছিলেন। 
মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট, সম্রাট আকবর ও মুঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট, সম্রাট জাহাঙ্গীরের মনগড়া দ্বীন-ই-এলাহীর বেদাতী, শিরকী ও কুফরী মতবাদ নস্যাৎ করে ইসলামকে পুনর্জাগরণ করেন মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)। বিশাল মোঘল সাম্রাজ্যের শতকরা পচাঁনব্বই ভাগই তখন ছিল হিন্দু; তারা সবাই ছিল তখন সম্রাটের পক্ষের লোক। 

এ ছাড়া দুনিয়াদার আলেম, ভন্ড সুফী ও শিয়া প্রভৃতি গুষ্ঠিও সম্রাটের হাতকে শক্তিশালী করেছিল। জৈন, পারসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকদেরও ছিল সম্রাটের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন। সুতরাং সম্রাট নির্বিঘ্নে ইসলাম বিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। সমগ্র হিন্দুস্থানে ইসলামের এই ঘোর দুর্দিনে আহমেদ ফারুকী শেরহিন্দি মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) তাঁর মুজাদ্দেদ সুলভ প্রজ্ঞা ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সংস্কারের কার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বেদাতী ও কুফরীর যাঁতাকলে পিষ্ট ইসলামের ভয়াবহ দুরবস্থা দেখে তাঁর রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠেছিল। 

মুঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট, সম্রাট জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদ (রহ.)-কে মুক্তির আদেশ প্রদান করলেন এবং তাঁকে শাহী দরবারে আমন্ত্রণ জানালেন। মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) মুক্ত হলেন বটে, কিন্তু বাদশাহর সাথে সাক্ষাত করতে গেলেন না; বরং তিনি সাতটি শর্ত প্রদান করলেন এবং বললেন, শর্তগুলি মেনে নিলে তিনি বাদশাহর সাথে সাক্ষাৎ করবেন।

শর্তগুলো হলো—  
১) তমিজি সেজদার প্রচলন দরবার হতে উঠিয়ে দিতে হবে।
২) ভগ্ন ও বিরান মসজিদগুলো আবাদ করতে হবে।
৩) গরু জবেহ-র উপর যে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে, তাহা রহিত করতে হবে।
৪) ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য বিভিন্ন স্থানে কাজী, মুফতি নিয়োগ করতে হবে।
৫) জিজিয়া কর পূনরায় প্রবর্তন করতে হবে। 
৬) সকলপ্রকার বেদাতী কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
এবং
৭) সকল রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে।

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর নির্দ্বিধায় সমস্ত শর্ত মেনে নিলেন এবঃ শর্তগুলো বাস্তবায়িত করার জন্য শাহী ফরমান জারী করলেন; তমিজি সেজদা বন্ধ হলো, গরু জবেহ-এর উপর নিষেধাজ্ঞা আর রইল না, জিজিয়া কর পূন:প্রবর্তিত হলো, সকল প্রকার বেদাতী কার্যকলাপ কঠোর হস্তে দমন করার ব্যবস্থা করা হলো, শরিয়তভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্থানে স্থানে কাজী নিয়োগ করা হলো, শহর ও গ্রামে মসজিদ-মাদ্রাসা স্থাপনের ব্যবস্থা করা হলো।

সম্রাট জাহাঙ্গির নিজের দরবারের সম্মুখেই একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন। হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ) সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজধানীতে আসলেন। মুগল সম্রাট মহা সমাদরে ও সসম্মানে তাঁকে দরবারে নিয়ে গেলেন। সম্রাট তাঁর নিকট নিজের অপরাধ স্বীকার করে মাফ চাইলেন এবং মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ)-র পবিত্র হাতের উপর হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করলেন। পরবর্তীতে এই পরিবার থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি হলেন সম্রাট শাহাজাহান ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো ঈমানদার শাসক।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২ মার্চ, ২০১৮.

চেয়ারে বসে নামাজ আদায়- কখন জায়েয?

মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক-এর একটি রেওয়ায়েত- 'উমর বিন মায়মূন (রঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, রোগীর জন্য বসে নামায জায়েয হওয়ার আলামত কি? তিনি বললেন, যখন সে তার দুনিয়াবী কাজের জন্য দাঁড়াতে পারেনা, তখন বসে নামায পড়বে।’ 

যে ব্যক্তি জমিনে সিজদা করতে সক্ষম নয় তার ব্যাপারে হানাফী ফকীহগণের প্রসিদ্ধ মত- 'এমন ব্যক্তির উপর দাড়িয়ে নামায আদায় করা জরুরী নয়, বরং সে বসে ইশারায় নামায আদায় করবে।' 

এ বক্তব্যটি যদিও একেবারে দলীলবিহীন নয়, কিন্তু অনেক মুহাক্কিক ফকীহের দৃষ্টিতে এই মাসআলায় দলীলের বিচারে ফিকহে হানাফীর এই বক্তব্য বেশি শক্তিশালী, যা ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-র শাগরিদ ইমাম যুফার ইবনে হুযাইল (রঃ)-এর মতামত; আর এটাই বাকী তিন ইমামের {ইমাম মালেক (রঃ), ইমাম শাফেয়ী (রঃ) এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ)} মত। আর তা হলো- এমন ব্যক্তি (যে ব্যক্তি জমিনের উপর সিজদা করতে অক্ষম) যদি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে সক্ষম হয়, তাহলে তাকে দাঁড়িয়েই নামায আদায় করতে হবে। আর যেহেতু সে সিজদা করতে অক্ষম তাই সে ইশারায় সিজদা করবে (যদি রুকু করতেও অক্ষম হয়, তাহলে রুকুও ইশারায় আদায় করবে)। জমিনে সিজদা করতে অক্ষম হওয়ার কারণে কোন অবস্থায়ই দাঁড়ানোর ফরয ছাড়া যাবে না। 

বর্তমান বিশ্বের খ্যাতনামা মুফতী জাস্টিস মুহাম্মাদ তকী উসমানী নতুন ফতওয়ায় এ মাসআলাটির উপর বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, কিয়ামের ফরয আদায় থেকে শুধু ঐ ব্যক্তি ছাড় পাবে, যে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম। সিজদা করতে অক্ষম হওয়ার কারণে কিয়াম-এর ছাড় পাবে না। তিনি সেখানে বিশদভাবে এ কথারও খন্ডন করেছেন যে, শুধু সিজদার জন্য কিয়াম ফরয করা হয়েছে। তাই সিজদা করতে অক্ষম হলেই তার জন্য কিয়াম জরুরী থাকে না। একাধিক দলীল দ্বারা তিনি এ কথাটি প্রমাণ করেছেন যে, কিয়াম নামাযের একটি স্বতন্ত্র ফরয, যা শুধু সিজদার জন্য নয়। 

এমন কি মুফতি তকী উসমানী এই ফতওয়ায় এ কথাটিও লিখেছেন যে, যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামায শুরু করতে পারে, কিন্তু সিজদার জন্য জমিনে বসার পর আবার দাঁড়াতে তার অনেক কষ্ট হয়, এমন ব্যক্তিও কিয়াম (দাঁড়িয়ে নামায পড়া) একেবারে ছাড়বে না। বরং প্রথম রাকাত দাঁড়িয়ে আদায় করবে। এরপর দাঁড়াতে কষ্ট হওয়ার কারণে বাকী নামায বসে আদায় করবে। 

এর সাথে তিনি এ বিষয়টিও অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, জমিনের উপর সিজদা করতে অক্ষম কোন মুসল্লী যদি ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী আমল করে এবং পুরা নামায বসে আদায় করে এবং ইশারায় রুকু সিজদা করে তাহলে তার নামায ফাসেদ হয়েছে বলব না; কারণ, গায়রে মুজতাহিদের (মুজতাহিদ নয় এমন) জন্য মুজাতাহিদের ‘কওল'ও (বক্তব্য) দলীলে শরয়ী। সুতরাং যে ব্যক্তি সে অনুযায়ী আমল করেছে আমরা বলবো না তার নামাজ ফাসেদ হয়েছে। 

যে ব্যক্তি শুধু আরামের জন্য অথবা মামুলি কষ্টের বাহানায় চেয়ারে নামায আদায় করছেন তিনি মস্ত বড় ভুল কাজ করছেন; এভাবে নামায আদায় করার দ্বারা তার নামাযই হবে না। তার উপর ফরয দাঁড়িয়ে নামায আদায় করা এবং যথা নিয়মে রুকু সিজদা আদায় করা। 

আর যে ব্যক্তি জমিনের উপর বসে নামায আদায় করতে সক্ষম তার জন্য শুধু এই বাহানায় চেয়ারে বসে নামায আদায় করা ঠিক নয় যে, সে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে বা রুকু সিজদা করতে অক্ষম। বরং এ ধরণের লোকেরা জমিনে বসে নামায আদায় করবে। চেয়ারে বসে নামায আদায় করবেন শুধু ঐ লোকেরা যারা জমিনে বসে নামায আদায় করতে অক্ষম। 

মুফতি তকী উসমানী তাঁর সদ্য লেখা এ ফতওয়ায় চেয়ারে বসে নামায আদায় করার ক্ষতির দিকগুলো আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘জমিনে বসে নামায আদায় করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও ইদানীং চেয়ারে বসার যে প্রচলন দেখা যায় তাতে বিভিন্ন দিক থেকে আপত্তি রয়েছে।

১). মাযুর ব্যক্তিদের জন্য জমিনে বসে নামায আদায় করাই উত্তম ও মাসনূন তরীকা। এর উপরই সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম এবং পরবর্তীদের আমল চলে আসছে। চেয়ারে বসে নামায আদায় করার রেওয়াজ কেবল শুরু হয়েছে! খায়রুল কুরূনে এর নযীর নেই; অথচ সে যুগে মাযুরও ছিল, চেয়ারও ছিল। 
২). যে ব্যক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে মাযুর নয়, অর্থাৎ কিয়াম, রুকু সিজদা করতে সক্ষম, তার জন্য জমিনে বা চেয়ারে বসে ফরয এবং ওয়াজিব নামায আদায় করাই জায়েয নয়; অথচ কখনো কখনো দেখা যায় এ ধরণের সুস্থ ব্যক্তিও সামনে চেয়ার পেয়ে চেয়ারে বসে নামায আদায় করে নেয়। ফলে, তার নামাযই হয় না। 
৩). চেয়ারের ব্যবহারের কারণে কাতার সোজা করা ও সোজা রাখার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অথচ মিলে মিলে দাঁড়ানো ও কাতার সোজা করার বিষয়ে হাদীস শরীফে জোর তাকীদ এসেছে। 
৪). বিনা প্রয়োজনে মসজিদে চেয়ারের অধিক্যের কারণে তা নাসারাদের গির্জা ও ইহুদীদের উপাসনালয়ের সাদৃশ দেখা যায়; তারা গির্জায় চেয়ার ও বেঞ্চে বসে উপাসনা করে। আর দ্বীনী বিষয়ে ইহুদী নাসারা ও অন্যান্য জাতির সাদৃশ্য থেকেই নিষেধ করা হয়েছে। 
৫). নামায তো এমন ইবাদত যা আদায় করতে হয় বিনয়াবনত হয়ে বিগলিতচিত্তে। আর চেয়ারে বসে নামায আদায় করার চেয়ে জমিনে বসে নামায আদায়ের মাঝে তা পূর্ণমাত্রায় পাওয়া যায়। 
৬). কোন কোন যুবক ও সুস্থ ব্যক্তি নামাযের পর মসজিদে রাখা চেয়ারে বসে আরাম করে। কখনো কখনো চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসে আলাপচারিতায় লিপ্ত হয়। এটা মসজিদের পবিত্রতা, মার্যাদা ও আদবের খেলাফ। 
৭). মসজিদে চেয়ারের ব্যবহারের কারণে কোন কোন ছুরতে কুরআনে কারীম এবং মুরববী নামাযীদের আদব ও এহতেরামের ব্যত্যয় ঘটে।' 

এমন স্পষ্ট বক্তব্য দেয়ার পর তিনি আবার এটাও লিখেছেন যে, রুকু সিজদা করতে অক্ষম ব্যক্তিগণ জমিনের উপর বসে ইশারায় নামায আদায় করতে সক্ষম হওয়ার পরও যদি চেয়ারে বসে নামায আদায় করে থাকেন, তাহলে সেটাও জায়েয, কিন্তু অনুত্তম কাজ। আর দারুল উলূম দেওবন্দের ফতওয়ায় এটাকে শুধু অনুত্তমই বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে, তা বিভিন্ন কারণে কারাহাত মুক্ত নয়। 

আমার যতদূর জানা আছে তা হলো- আমাদের দেশের বিভিন্ন দারুল ইফতার ফতওয়াও এটাই; মারকাযুদ দাওয়ার দারুল ইফতার ফতওয়াও এটাই যে, রুকু সিজদায় অক্ষম ব্যক্তিগণ জমিনে বসতে সক্ষম হলে তাদের জন্য চেয়ারে বসে নামায আদায় করা মাকরূহ; যা পরিহার করা জরুরী। আর রুকু সিজদায় সক্ষম ব্যক্তি যদি এমনটি করে তাহলে তো তার নামাযই শুদ্ধ হবে না। 

মোদ্দাকথা, যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পদ্ধতি হলো- জমিনে বসে তা আদায় করা। আর যে রুকু সিজদা করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পন্থা হলো- ইশারায় তা আদায় করা। আর যে ব্যক্তি যমিনে বসে নামায আদায় করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প হলো- চেয়ারে বসে নামায আদায় করা। কেবলমাত্র প্রথম ও দ্বিতীয় ওযরের কারণে চেয়ারে বসে নামায আদায় জায়েয নয়। 

যদি কেউ দাঁড়াতে সক্ষম না হয় তাহলে সে বসে নামাজ আদায় করবে। বসতে সক্ষম না হলে শুয়ে নামাজ আদায় করতে হবে। বসে নামাজ আদায় করা মানেই জমিনে বা ফ্লোরে বসে আদায় করা। সহীহ বুখারি শরিফসহ হাদিসের বিভিন্ন কিতাবে এসেছে- সওয়ারি থেকে পড়ে একবার হুজুরপাক (সাঃ) আহত হয়েছিলেন, তখন তিনি জমিনে বসে নামাজ আদায় করেছেন। নবী কারীম (সাঃ)-এর যুগেও কিন্তু চেয়ার বা চেয়ার সদৃশ বস্তু ছিল। তাছাড়া মাজুর অবস্থায়ও হুজুরপাক (সাঃ) চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করেননি। 

হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) বলেন, আমি হুজুরপাক (সাঃ)-কে অসুস্থ ব্যক্তির নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে; তা সম্ভব না হলে বসে। তাও সম্ভব না হলে শুয়ে নামাজ আদায় করবে। (বুখারি ১/১৫০ তিরমিজি ১/৮৫) এ হাদিস দ্বারা স্পষ্ট এ'টাই বুঝা যায় যে, দাঁড়াতে সক্ষম না হলে (জমিনে) বসে, তাও সম্ভব না হলে শুয়ে নামাজ আদায় করতে হবে। সুতরাং হাদিস থেকে এ কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, চেয়ারে বসে নামাজ কোনো অবস্থাতেই সহি নয়। 

সুতরাং যিনি দাঁড়াতে সক্ষম কিন্তু নিয়ম মতো রুকু সিজদা করতে অক্ষম তিনি দাঁড়িয়ে-ইশারা করে নামাজ আদায় করবেন। চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করলে সহি হবে না। -(বাদায়ে ১/২৮৬) 

যারা দাঁড়াতে ও রুকু সিজদা করতে অক্ষম তারা জমিনে বসে ইশারায় নামাজ আদায় করবেন। তাশাহুদের নিয়মে বসতে না পারলে যেভাবে বসতে পারেন সেভাবেই বসবেন। চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করলে নামাজ সহি হবে না। 

কোনোভাবে বসতে না পারলে শুয়ে নামাজ আদায় করতে হবে; তা-ও চেয়ারে বসে নয়। 

মো:আবু বকর ছিদ্দীক নামের একজন আললামা শামী (রঃ)-কে প্রশ্ন করেছিলেন, 'আস্সালামু আলাইকুম। হযরত, আমার নানীর কোমরের সমস্যা। এখন দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে সমস্যা হয় এবং রুকু করতে এবং সেজদা করতে খুব বেশি ব্যাথা করে এখন উনি কি চেয়ারে নামাজ পড়তে পারবে?' 

তাঁর জবাব - ওয়ালাইকুম সালাম! আপনার নানী যদি জমিনে বসে নামায পড়তে পারেন, তাহলে জমিনে বসে নামায পড়বেন। এক্ষেত্রে তাশাহুদ অবস্থার মতো বসা আবশ্যক নয়; বরং যে আসনে বসলে আরাম হয়, সেভাবেই মাটিতে বসে ইশারা করে নামাজ আদায় করবেন। চেয়ারে বসা উচিত নয়। কারণ, শরিয়ত এমন অপারগদের মাটিতে বসার ব্যাপারে পূর্ণ ছাড় দিয়েছে। যে আসনে সম্ভব হয়, সেভাবেই বসে নামাজ আদায় করবে। (দুররে মুখতার মাআ শামী- ২/৫৬৬) 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
৫ মে, ২০১৯.