সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০২০

কেমন হবে আগামীর শিক্ষা?

করোনা ভাইরাস আবির্ভাবের প্রথম দিকে বিশ্বের অনেক বিশেষজ্ঞই নানান ধরনের ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, এই মূহুর্তে যাকে মনে পড়ছে তিনি হলেন  হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েল লিওং; গত ফেব্রুয়ারীর দিকে  তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। তাঁর সেই আশঙ্কা যে নেহায়েতই অমূলক তা কিন্ত নয়; এখনো পর্যন্ত তা পুরোপুরি সত্য না হলেও একটি নিশ্চিত ঘটনা অলরেডি ঘটে গেছে— সারা বিশ্বের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মানুষ, অর্থাৎ প্রায় ৪৬০ কোটি মানুষ একই সময়ে ঘরে বন্দী জীবনযাপন করেছেন এবং করছেন। বলতে গেলে পুরোপুরি কর্মহীন অবস্থায় শুধু শুয়ে বসে সময় পার করেছেন সারা বিশ্বের মানুষ। উৎকন্ঠা নিয়ে চুপচাপ এক জায়গায় বন্দী জীবন কাটানো সে যে কতটা কঠিন একটি বিষয় এমন পরিস্থিতিতে না পড়লে হয়তো আমরাও কোনদিন তা বিশ্বাস করতে পারতাম না, অনুধাবন তো দূরের কথা। এমন অসহনীয় উৎকণ্ঠিত একাকী জীবনের কথা কি কখনও কেউ আগে থেকে চিন্তা করতে পেরেছেন, না কি ভাবা যায়? 

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে করোনা ভাইরাস আবারও ফিরে এসেছে বা আসছে, অনেক দেশের মানুষ পুনরায় বন্দীত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। ঘরে বন্দী জীবন কাটাবেন বা কাটাচ্ছেন এবং সাথে থাকছে অনাকাঙ্ক্ষিত উৎকন্ঠা— না জানি আমি কখন এই মরণ ভাইরাসে আক্রান্ত হই? মানবসভ্যতার ইতিহাসে এত বেশি সংখ্যক মানুষ একই সাথে একই সময়ে একটানা এতো দীর্ঘক্ষণ ঘরে বন্দী থেকেছেন বা এমন করে লকডাউন করেছেন নিজে নিজেকে বা কোথাও বন্দী  হয়ে বসে থেকেছেন এমনতর নজির পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমার জানা নেই। এক অদৃশ্য অতি ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে মানুষ নামক অনন্য অসাধারণ গর্বিত প্রাণীটি এতো অসহায় হয়ে পড়লো, যার আক্রমণে তছনছ হয়ে গেল গোটা বিশ্ব; ভেঙে পড়লো একবিংশ শতাব্দীর সর্বোত্তম নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সকল  বিশ্বব্যবস্থা! এসব কি ভাবা যায়?

এই অবস্থা থেকে বিশ্ববাসী আর কখনো কোনদিনও পুরোপুরি মুক্তি পাবেন কিনা বা বিশ্ববাসী আর কখনও মোটেও আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবেন কিনা তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে; হয়তো পরবর্তী পৃথিবী হবে করোনাময় অথবা  করোনা সম্পৃক্ত পৃথিবী! আসলে কি করোনার থাবা থেকে আমাদের কখনও  মুক্তি মিলবে? তা নিশ্চিত কেউ জানি না, তার কোন সুস্পষ্ট ধারণাও এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের দিতে পারছেন না। কিন্তু পরবর্তী বিশ্ব সম্পর্কে অনেকে অনেক রকম কথাই বলেছেন বলছেন, এবং বিশেষজ্ঞরা যার যার মতো করে তাদের মতও প্রকাশ করছেন। সব কিছুতে দ্বিমত থাকলেও একটি বিষয়ে কিন্তু প্রায় সকলেই একমত— পৃথিবী আর আগের মতো নেই, থাকবে না; আর কখনো আগের মতো হবেও না। বিগত কয়েক মাস ধরে যা ঘটেছে ঘটছে তার প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী হবে এই ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই, প্রত্যেকেই অনেকটা নিশ্চিত। এই মহামারী শুরুর পর থেকে একে একে বদলে গেছে পুরো বিশ্বপ্রকৃতি এবং সাথে সাথে  পাল্টে গেছে বিশ্বপরিস্থিতিও। আমাদের কামকাজ, আমাদের  প্রাত্যহিক জীবনযাপন, ভ্রমন-বিনোদন থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য সমেত অর্থনীতি-রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতি-সমাজনীতিসহ সব সবকিছু বদলে গেছে।

দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর শতকোটি মানুষ ঘরে বন্দী, সেই সুযোগে প্রকৃতি তার আসল রূপ পেয়েছে, আপন রূপে ফিরে গেছে। পৃথিবীর সব বড় বড় শহর-নগর-বন্দরগুলোকে মনে হয়েছে হচ্ছে ওসব যেন প্রাণহীন মৃত্যুপুরী; দিনের বেলায়ও রাস্তা-ঘাট থাকছে জনমানবশূন্য। বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বন্ধ থেকেছে দোকানপাট-বার-রেস্টুরেন্ট-শপিংমল, বন্ধ হয়ে গেছে খেলাধূলা, এমন কি বাতিল হয়ে গেছে অলিম্পিক গেমসও। বিশ্বের অনেক দেশে জেলখানা থেকে বন্দীদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে, বাড়ি গিয়ে তাদেরকে চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে বলা হয়েছে। ছোট-বড় ধনী-দরিদ্র বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের যার যার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিমান চলাচলও। সকল প্রকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড— আভ্যন্তরীণ কিম্বা বৈশ্বিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে; শেয়ার বাজারে  ধস নেমেছে। সর্বোপরি  বেকার হয়ে পড়েছে বিশ্বের কোটি কোটি কর্মজীবী কর্মোদ্যোগী  মানুষ। এক অদৃশ্য শত্রুর আতংকে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আজ ভীত-সন্ত্রস্ত! 

কি ঘটতে যাচ্ছে এবং কেমন হতে যাচ্ছে করোনামুক্ত পরবর্তী পৃথিবী? আদৌও পৃথিবী করোনামুক্ত হবে কি? এ'সবের সার্বিক আলোচনায় আপাততঃ  যাচ্ছি না, আজ শুধুমাত্র শিক্ষার্থী তথা ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষতির দিক নিয়ে কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আমার বিবেচনায় সারা বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং নাজুক অবস্থায় পড়ে আছে শিক্ষার্থীরা। শিশুদের কল্যাণে কাজ করা 'সেইভ দ্য চিলড্রেন' থেকে বলা হয়েছে— বিশ্ব মহামারীর এই কঠিন পরিস্থিতিতে শিক্ষার সুযোগ হারাবে প্রায় এক কোটি শিশু। তারা আরও বলেছে— বাল্যবিবাহ, শিশু শ্রম, শিশু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। এই সংস্থা আরও বলেছে— করোনা পরবর্তীতেও আর কোন দিন হয়তো স্কুলেই যাওয়া হবে না এক কোটি শিশুর। সেভ দ্যা চিলড্রেন-এর এক আলোচনায় উঠে এসেছে এমনতর সব ভয়ঙ্কর তথ্য। ইউনেস্কোর তথ্যের উপর ভিত্তি করে আরও জানা গেছে যে, গত এপ্রিল থেকে ১.৬ বিলিয়ন তরুণ-তরুণী স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে দিয়ে বসে আছে, অলস সময় কাটাচ্ছে; যা বিশ্বের পুরো শিক্ষার্থীর সংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ।

উক্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মানব ইতিহাসে এই প্রথমবার এমন চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে বিশ্বের শিক্ষা ক্ষেত্রে। চরম এই সংকট থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে ইতিমধ্যে গোটা বিশ্বপরিস্থিতি পর্যালোচনা করা শুরু হয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, পারিবারিক আর্থিক সংকট কাটাতে আগামীতে তরুণ তরুণীরা রোজগারের চেষ্টা করা শুরু করবে। অভাব অভিযোগ ও পারিবারিক দায় মুক্ত হতে বা দায় মুক্ত করতে অধিকাংশ মেয়েকেই খুব অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে পরিবারের পক্ষ থেকেই। এসবের  ফলশ্রুতিতে ৯.৭ মিলিয়ন শিশু স্থায়ীভাবে স্কুল ছাড়বে। ইউনেস্কো ইতিমধ্যেই সতর্ক করে বলেছে করোনা পরবর্তী বিশ্বে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলি ২০২১ সাল থেকেই কাটছাঁট করবে শিক্ষা বাজেটে। আর এতে করে গোটা বিশ্বের শিক্ষা বাজেটে প্রায় ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘাটতি দেখা দেবে। 

শিশুদের স্কুলে ফেরাতে বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকারেরই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। আর তা যদি না করা হয় তাহলে আগামী দিনে ধনী এবং দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের মধ্যে প্রবলভাবে প্রকোট হয়ে উঠবে অসাম্য। তাই ইউনেস্কোর দাবী করোনা পরবর্তী বিশ্বে কোটি কোটি শিশুর স্কুল ছুট বন্ধ করতে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। পাশাপাশি বিশ্ব জুড়ে একটি তহবিল গঠনের ডাক দিয়েছে এই সংস্থা। সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, করোনাপরবর্তী বিশ্বে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র ও প্রান্তিক শিশুরা; আর যারা দূরশিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষম তাদের সমস্যা আরো বেশি বাড়বে। সমস্যা কাটাতে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে শিক্ষা ঋণ পরিশোধে কিছু ছাড় দেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে। সংস্থার পক্ষ থেকে আশঙ্কা করা হয়েছে, এই সংকট যদি প্রথমে মোকাবিলা করা না হয় বা না যায় তাহলে আগামী দিনে সমস্যা আরও বাড়বে, এমনকি প্রকট রূপ ধারণ করবে।

সংস্থার পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্যই হলো ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সমস্ত শিশুকে ন্যূনতম শিক্ষা পরিসেবার আওতাভুক্ত করা বা আওতায় আনা। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করায় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রই তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তাই এখন থেকে বিশ্বের সকল দেশগুলোর কাছে এসব নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে ইউনেস্কো। সংস্থার তৈরি তালিকায় যেসব দেশে সবথেকে বেশি প্রভাব পড়তে পারে এমন দেশগুলো হচ্ছে— নাইজেরিয়া, মালি, চাদে, লাইবেরিয়া, আফগানিস্তান, গিনি, মরিশানিয়া, ইয়েমেন, নাইজার, পাকিস্তান, সেনেগাল আর আইভোরিকোস্ট। ইতিমধ্যেই ২৫৮ মিলিয়ন শিশু ও কিশোর-কিশোরী স্কুল ছেড়ে দিয়েছে বলে তাদের প্রথমিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে। 

আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের কি অবস্থা? এমনতর দুর্যোগের পর সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং নির্দেশনাই-বা কি? দেশের সমগ্র  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে সেই মার্চ থেকে; করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে। কবে নাগাদ স্কুল-কলেজ খুলবে তাও কেউ জানে না বা কেউ বলতে পারে না। ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা এখনও পর্যন্ত সংঘটিত হয়নি, কবে নাগাদ তা সংঘটিত হবে তাও কেউ জানে না; তাই অভিভাবক ও  শিক্ষার্থীরা চরম উৎকন্ঠিত।  ক্লাস এবং পরীক্ষার অনিশ্চয়তা নিয়ে এক মহা দুশ্চিন্তার মধ্যে কালাতিপাত করছে দেশের সমস্ত ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা। প্রত্যেকেই এখন অলস সময় পার করছে এবং সেশনজট  নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন; কিন্তু কিছুই তো আর করার নেই।  প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা স্কুলে পড়াশোনা করতে না পারায় তারা মানসিকভাবে অনেক বেশি  ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বা করোনা সিম্পটমে মৃত্যুর সংখ্যা কিন্তু এদেশে এখনো নেহায়েত কম নয়, তাছাড়া কেন যেন এখনো পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত হওয়া মানুষের সংখ্যা এদেশে কিছুতেই কমছে না, বরং কোন কোন অঞ্চলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই যে কোনো স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে; তাই সরকারও শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে বারংবার  সতর্ক থাকার বা হওয়ার  নির্দেশ দিচ্ছে। এমনতর  পরিস্থিতিতেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও অনলাইন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে এবং কোথাও কোথাও তা শুরুও হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাস নিতে শুরু করছেন, তারা অ্যাসাইনমেন্ট ও হোমওয়ার্কও দিচ্ছেন এবং তা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে জমাও নিচ্ছেন। 
 
দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে নিশ্চিত করেই বলা যায়, এ'দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের; আর্থিক সংকটের কারণে তারা অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে না। অনেকেরই নেই অনলাইন শিক্ষায় অংশগ্রহণ করার মতো ন্যূনতম সরঞ্জাম— স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ  আলাদা, সেখানকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের এবং তারা সবকিছুই সামাল দিতে পারবে। কিন্তু স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অবস্থা কি হবে বা কি হচ্ছে? ঘোষণা দিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরা টিভিতে ক্লাস নিচ্ছেন। কিন্তু তা শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা মঙ্গলজনক বা কার্যকরী হচ্ছে? অনলাইন ক্লাস এদেশে কার্যকর করার মতো সার্বিক পরিস্থিতি এখনো অনেক দূর;  বাচ্চাদের জন্য তো তা মোটেও প্রযোজ্য নয় বা আদৌও কার্যকরী হবে বলে আমার মনে হয় না। বাচ্চাদের জন্য শ্রেণীকক্ষে সরাসরি ক্লাসের কোন বিকল্প নেই। তাই এতসব উদ্ভট চিন্তা বাদ দিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে বা অন্য কোন উপস্থিত প্রক্রিয়ায় বাস্তব কারিকুলামে কি করে শ্রেণীকক্ষে তাদের  ক্লাস নেয়া যায় তা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত।  

গত ১৭ই মার্চ থেকে বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে, ৬ই আগস্ট ছুটি শেষ হলেও স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া হবে কিনা সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। আর এ'সব বিষয়ে এখনও পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে কোন সিদ্ধান্ত না আসায় উদ্বেগে আছেন শিক্ষক-অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীরা। বাংলাদেশের সকল প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম সমন্বয়ের কাজে ফেসবুককে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর; বিষয়টি বড়ই চিন্তার। কারণ, ছোট ছোট বাচ্চারা একবার ফেসবুকে ঢুকলে এবং ফেসবুক আসক্ত হয়ে গেলে পরিস্থিতি কি হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া কতটাই-বা কাজে আসবে বা কাজ হবে বা করতে পারবে শিক্ষা সমন্বয়ে ফেসবুকের ব্যবহার?  এইবারের এসএসসি পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা ভর্তির অপেক্ষায় আছে। দেশের গ্রামগঞ্জসহ সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কলেজ, সে সব কলেজে একাদশ শ্রেণীতে অনলাইনে ভর্তির পরিপত্র জারি করা হয়েছে; সেখানেই ঠিক মতো ভর্তি  কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারছে না এদেশের এসএসসি পাশ ছাত্রছাত্রীরা। এমতাবস্থায় অনলাইনে পড়ালেখা কি চাট্টিখানি কথা?  

গত মাসে এক ভিডিওবার্তায় মাননীয়  শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছেন, চলতি শিক্ষাবর্ষ আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে; সেইসাথে পরের শিক্ষাবর্ষ কমিয়ে নয় মাস করার কথাও ভাবা হচ্ছে। যদিও এ'সব বিষয়ে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য  বিভাগগুলো চেষ্টা করছে এই বছরের মধ্যেই শিক্ষাবর্ষ শেষ করতে। তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিবেচনায় যদি ছুটি আরও বাড়ানো হয়, তাহলে এই শিক্ষাবর্ষ মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়ানো নিয়েও আলোচনা হচ্ছে বলে জানান আন্ত:শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে মূলতঃ দু'টো বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে— প্রথমতঃ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা যায় এবং দ্বিতীয়তঃ মেধার মূল্যায়নের দিকটিও যেন আপোষ করতে না হয়। তবে কবে নাগাদ এ'সব সিদ্ধান্ত আসতে পারে সে বিষয়ে এখনো পর্যন্ত  স্পষ্ট করে কোন কিছুই জানা যায়নি।

চলতি শিক্ষাবর্ষ আরও কিছুটা বাড়ানো হলে আগে যেমন নভেম্বর ডিসেম্বরে সমাপনী পরীক্ষা শেষ হতো, সেই পরীক্ষা শেষ হবে সামনের বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চে। অন্যদিকে সামনের শিক্ষাবর্ষ ১২ মাস থেকে কমিয়ে ৯ মাসে নামিয়ে আনার কথা চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, একটি শিক্ষাবর্ষে ১৪০ দিনের মতো পড়ানো হয়, ৩৬৫ দিনের বাকিটা সময় ধরে থাকে ছুটি আর ছুটি। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক এমনতর কার্যক্রম কাটছাঁট করে পরের শিক্ষাবর্ষের সমাপনী পরীক্ষা যেন ডিসেম্বরেই নেয়া যায় সে দিকে খেয়াল রেখে সিলেবাস কমানোর পাশাপাশি ঐচ্ছিক ছুটিছাটাও বাতিল করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা।

করোনার এই সময়টা নিশ্চয়ই একদিন কেটে যাবে, বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও হয়তো আবার খুলে দেয়া হবে; প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে শহর-নগর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীতে আবারও মুখরিত হয়ে উঠবে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ক্যাম্পাস। কিন্তু সময়টা আরও বেশি দীর্ঘস্থায়ী হলে আগামীর শিক্ষা ব্যবস্থার কি হবে, কেমনই-বা হবে? করোনার কারণে তৈরি হওয়া অনলাইন আর অফলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার এই অসম বৈষম্য আমরা কি করে দূর করবো?  এসব প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে গেলে বা সমাধান করতে গেলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা অবশ্যই আরো বাড়াতে হবে এবং সবাইকে সৎ ভূমিকা রাখতে হবে। 

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন— ১৯৩০ সালের পর সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে আছে বিশ্ব; সে কারণে করোনা পরবর্তী বিশ্ব হবে ক্ষুধাময়।  ওদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছে না! কবে নাগাদ এই করোনাভাইরাস বিশ্ব থেকে নির্মূল হবে, বা আদৌও নির্মূল হবে কি? যতই বলা হউক না কেন কোভিড-১৯-এর ভেকসিন আবিষ্কার হয়ে গেছে; কিন্তু তা  বাস্তবায়িত হতে এবং মানবজাতির কল্যাণে আসতে সময় নেবে আরও অনেক। ততদিন কি শিক্ষা থেমে থাকবে আর সভ্যতা বিপর্যস্ত হবে??

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২৭ জুলাই, ২০২০.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন