'ইন্নাদ্দীনা ইন্দাল্লাহ্হীল ইসলাম'— নি:সন্দেহে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম হলো শান্তি (ইসলাম); কিন্তু কোথায় শান্তি? কোথায় স্বস্তি? শান্তি স্বস্তি কি পৃথিবী থেকে বিদাই নিয়েছে? - অনেকের মনে এ'রকম হাজার প্রশ্ন; বর্তমান সময়ে ইসলাম মানেই যেন অশান্তি! ভিন্ন ভিন্ন ছোট ছোট দল-উপদল ও মতের প্রাধান্য বিস্তারের অপচেষ্টা, হানাহানি মারামারি; ধর্ম নিয়েই যত সব বাড়াবাড়ি! কিন্তু কেন? কারণ, কেউ মদ বেচে দুধ খান, কেউ-বা দুধ বেচে মদ খায়!
মাওলানা আব্দুর রহমান (আসল নাম নয়; মাওলানা অনুরোধ করেছিলেন যেন তাঁকে প্রচার না করি।) ধর্মীয় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একজন বিজ্ঞ আলেম। এই বাংলারই কোন এক উপজেলা পরিষদ মসজিদে তিনি ইমামতি করেন। এক অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাত। আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে এমন সব কিছু কথা তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো যা সচারাচর আজকের আলেম বা কোন ইমামদের কাছে প্রত্যাশাও করা যায় না। যতই তাঁর কথা শুনছিলাম ততোই ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইকে মনে পড়ছিল।
আজ থেকে হাজার বছর আগে ইমাম গাজ্জালী (রঃ) ইসলামকে পুনঃ জাগরিত করে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে এই ধরাধাম ত্যাগ করেছিলেন। যিনি বলে গেছেন - 'প্রস্রাব দিয়ে কাপড় দৌত করতে যেয়ে যত দামী সাবান সোডাই ব্যবহার করা হউক না কেন যেমন কাপড়ের পরিত্রতা আনয়ন করা যায় না, তদ্রুপ হারাম উপার্জিত পয়সা দিয়ে দান-খয়রাত বা ছদগা-যাকাত করলেও তা পাপ বৈ পুণ্য বয়ে আনে না।'
উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে জানতে পারি মাওলানা আব্দুর রহমান উপজেলা পরিষদ থেকে ইমামতির জন্য কোন বেতন বা টাকাপয়সা নেন না। উপজেলা পরিষদের পতিত জমি তিনি চাষাবাদ করেন এবং উৎপাদিত ফসলের ভাগের এক অংশ উপজেলা কোষাগারে জমা দিয়ে বাকীটা দিয়ে তিনি জীবনযাপন করেন। আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেন যেন কথাগুলো আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না। তাই উৎসাহ ও উৎগ্রীবতা নিয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করার অভিপ্রায়ে তাঁর সাথে বাসায় দেখা করতে চাইলাম; তাৎক্ষনিক সাক্ষাতে তিনি রাজি হলেন না। আমার সম্বন্ধে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে বেশ কয়েকদিন পর উপজেলা চেয়ারম্যান মারফত আমাকে জানালেন, যে কোন দিন আমি যেন তাঁর বাসায় যাই। প্রথমদিন কেন তিনি আমার সাথে সাক্ষাত দিতে চাননি তার কারণও সেদিন সাক্ষাতে জানতে পেরেছিলাম; বর্তমান প্রেক্ষাপটে তিনি আমাকেও অন্য দশ জনের মতোই ভেবেছিলেন।
আমি যেদিন মাওলানার বাসায় প্রথম যাই সেদিন সকাল ১০.১৫ টায় গিয়ে পৌঁছি, তিনি তখন বাসার পাশে একটা বেগুন ক্ষেতে আগাছা পরিস্কার করছিলেন। প্রায় পনে দু'ঘন্টা ঐ বেগুন ক্ষেতেই আমাদের দু'জনের দীর্ঘ আলাপচারিতা। যদিও তিনি আমাকে দেখেই কাজ বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি তা করতে দেইনি। তাঁর কাছে গিয়েই বুঝেছিলাম এই জীবনে এখনো আমার অনেক কিছু শিখার বাকী আছে। পরবর্তীতে সময় ও সুযোগ পেলেই হুটহাট তাঁর ওখানে চলে যেতাম এবং মত বিনিময় করতাম।
আত্মিক ও বাহ্যিক এবাদত-সংযমের এক জ্বলন্ত উদাহরণ, উৎকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী এই মাওলানা আব্দুর রহমান; যাঁর মাঝে আমি দেখতে পেয়েছি আল্লাহর নূর, তাঁর চেহারায় তা সুস্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে। তিনি বর্তমানের তথাকথিত কমার্শিয়াল আলেম বা ইমামদের মত নন; তিনি বলেন, 'নামাজ তো আমার জন্যও ফরয। আমার ফরয তো আমাকে আদায় করতেই হবে। নিজ ইমামতিতে আমি নিজে আমার ফরয আদায় করছি, অন্যরাও আমার পিছনে যার যার ফরয আদায় করে নিচ্ছেন, এবাদত-বন্দেগীর প্রতিদানের মালিক তো একমাত্র আল্লাহ্; এর জন্য আমি অন্যের কাছ থেকে বিনিময় নেবো কেন?'
ইসলামের আসল বুনিয়াদ এই আব্দুর রহমান মাওলানাদের হাতেই। তাঁরাই প্রকৃত ইসলামের ধারক ও বাহক। কে বলে ইসলামে শান্তি নেই? মাওলানা আব্দুর রহমানের মতো অনেক মু'মিন মুসলমান এখনো এই ধরণীতে জিন্দা আছেন, তাঁদের সংসার দেখতে যান; দেখবেন, তাঁদের কোন কিছুরই ঘাটতি নেই, অভাব নেই। আল্লাহ-র খাস রহমত ও বরকত তাঁদের উপর সব সময়ই বিদ্যমান।
ইসলাম মানে শান্তি, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ এক পরম শান্তির বিষয়; এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত বা ভিন্নমত থাকার কথা নয়। হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আহাম্মদ মুস্তোবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী রাসুলগণ পৃথিবীতে এই শান্তির ধর্মের বুনিয়াদই রচনা করে গেছেন, আমরন তাঁরা চেষ্টা করে গেছেন শান্তি-সাম্য-সৌহার্দ্যের পৃথিবী গড়ে তুলতে। কোন নবী বা রাসুলের জীবনীই আমাদের ধর্মীয় উস্কানি, সন্ত্রাসবাদ বা অশান্তির শিক্ষা দেয় না।
ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ করার জন্যই পবিত্র কুর'আনুল কারীমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নবী-রাসুলগণের জীবনী ও ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে; শান্তি, সাম্য ও সৌহার্দ্যের বাণী সমেত। যা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে আমরা পথের দিক নির্দেশনা পাই এবং নিজ জীবনের দিক নির্ণয় করতে পারি। তাছাড়া ভিন্ন ধর্মমত ও পথেরও যারা দুনিয়াতে জ্ঞানের তাপস হিসেবে এসেছিলেন সেই সব গ্রেট দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টেটল, আলেকজান্ডার দি গ্রেটরাও কিন্তু পৃথিবীতে শান্তির বুনিয়াদই বপন করে গেছেন; জ্ঞানের বিকাশে তাঁরাও রেখে গেছেন স্মরণীয় বরণীয় সব অবদান। ধর্মকর্ম বা মৌলিক এবাদত-বন্দেগীর কথা বাদ দিয়ে দেখলে দেখা যায় যে বিশ্বশান্তির প্রশ্নে পৃথিবীতে আসা সকল মনীষীর মত ও পথ এক ও অভিন্ন।
সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বার বার ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। সারে চৌদ্দশ বছর আগেই তিনি জানতেন, মুসলিমদের মাঝে ধর্ম নিয়েই বাড়াবাড়ি হবে সবচেয়ে বেশি। তাই তিনি অসংখ্যবার মুসলিমদের মধ্যপ্রন্থা অবলম্বন করার তাগিদ দিয়ে গেছেন। সহীহ ছিত্তায় এরূপ অসংখ্য হাদীসের সন্নিবেশ দেখা যায়। পরবর্তীতে পৃথিবীর সকল মুসলিম মনীষীর লেখা থেকেও হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের কথার অনুসরণ ও অনুকরণের মিলও খুঁজে পাওয়া যায়।
উম্মতে মুহাম্মদী মানেই মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের অনুসরণ ও অনুকরণ। যা করতে হবে তা আত্মিক ও বাহ্যিক উভয় প্রন্থায়ই করতে হবে। সাধারণভাবে ইসলাম বলতে আমরা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের প্রবর্তিত ও প্রচারিত ধর্মকেই বুঝি। আর এই ইসলামের সকল মূল নীতি, বাণী ও উদ্দ্যেশ্য-বিদেয় পুরোপুরিভাবে শান্তির সাপেক্ষে, অশান্তির বিপক্ষে। মুলতঃ বিশ্বশান্তিই ইসলামের মূল নীতি; আর সকল নবী-রাসুলের প্রচার-প্রচারণা এই নীতিমালার উপরই প্রতিষ্ঠিত।
অনেকেই ভাবতে পারেন— তবে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন সহ সকল মুসলিম খলিফাগণ এতো যুদ্ধ করেছেন কেন? তখনকার পরিবেশ, পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতা মুলতঃ অন্য রকম ছিল। তৎকালীন জাজিরাতুল আরব ছিল আইয়ামে জাহেলিয়াতের নিকৃষ্ট একটি চারণভূমি। নেংটো হয়ে সেই সময় তারা কাবাঘর তাওয়াফ করতো। পৌত্তলিকতা ছিল আরবিয়দের বেশিরভাগের ধর্ম। বংশ ও গুষ্টিগত দাঙ্গা হাঙ্গামা তাদের মাঝে লেগেই থাকতো। সে সময় সেখানে পিতারা পিতা হয়েও নিজ কন্যা সন্তানকে জ্যান্ত মাটিচাপা দিত!
সমাজ সভ্যতা বলতে আজকের আমরা যা বা যতটুকো বুঝি, তৎকালীন আরবের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ তার বিপরীত। হিংস্রতা নিষ্ঠুরতা বর্বরতা ছিল তাদের পৌরুষত্ত্ব জাহিরের মানদণ্ড। আরবের সেই চরম পর্যায়ে আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন আলোর দিশারি রূপে তাঁর প্রিয় হাবীব, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মহানবী হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামকে সেই পংকিল সমাজে প্রেরণ করেন। মহানবী (সাঃ) তাঁর কাঁধে বর্তানো দায়িত্ব সম্পুর্ণ সুচারুভাবে সম্পন্ন করে দুনিয়া থেকে ওফাত নেয়ার পর থেকেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ভিন্ন মতবালম্বীরা; আজও সেই একই গতিতে তাদের কুকর্ম অব্যাহত রয়েছে।
সময়ের প্রেক্ষিতে কেন জানি বিদাই হজ্জে রাসুলপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের সেই দিকনির্দেশনা শেষ ভাষণ খুব বেশি মনে পড়ছে। সুরা আন-নাছর নাজিল হওয়ার পর ৬৩২ খৃষ্টাব্দে ২৩ ফেব্রুয়ারি লক্ষাধিক সাহাবী (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে মহানবী (সাঃ) হজ্জ করতে মক্কা যান। ৯ যিলহজ্জ আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত বিশাল জনসমুদ্রে 'জাবালে রহমত'-এর উঁচু টিলায় দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেন—
১। হে মানব সকল! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন, কারণ আগামী বছর আমি তোমাদের সাথে এখানে সমবেত হতে পারবো কিনা জানি না।
২। আজকের এই দিন, এই স্থান, এই মাস যেমন পবিত্র, তেমনই তোমাদের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্র।
৩। মনে রাখবে অবশ্যই একদিন সকলকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে। সেদিন সকলকে নিজ নিজ কাজের হিসাব দিতে হবে।
৪। হে বিশ্বাসীগণ! স্ত্রীদের সাথে সদয় ব্যবহার করবে। তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে, তেমনই তোমাদের উপরও তাদের অধিকার রয়েছে।
৫। সর্বদা অন্যের আমানত রক্ষা করবে এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে ও সুদ খাবে না।
৬। আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না, আর অন্যায়ভাবে একে অন্যকে হত্যা করবে না।
৭। মনে রেখো দেশ বর্ণ গোত্র সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মুসলিম সমান। আজ থেকে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বিলুপ্ত হলো। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হলো আল্লাহ ভীতি বা সৎকর্ম। সে ব্যক্তিই সবচেয়ে সেরা যে নিজের সৎকর্ম দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।
৮। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না, পূর্বের অনেক জাতি এ কারণে ধ্বংস হয়েছে। নিজ যোগ্যতা বলে ক্রীতদাস যদি নেতা হয় তার অবাধ্য হবে না। এবং তার আনুগত্য করবে।
৯। দাস দাসীদের প্রতি সদ্ধ্যবহার করবে। তোমরা যা আহার করবে ও পরিধান করবে তাদেরও তা আহার করাবে ও পরিধান করাবে। তারা যদি কোন অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলে, তবে তাদের মুক্ত করে দেবে; তবু তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে না। কেননা তারাও তোমাদের মতোই মানুষ, আল্লাহর সৃষ্টি। সকল মুসলিম একে অন্যের ভাই এবং তোমরা একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
১০। জাহিলি যুগের সকল কুসংস্কার ও হত্যার প্রতিশোধ বাতিল করা হলো। তোমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর বাণী এবং তাঁর রাসুলের আদর্শ রেখে যাচ্ছি। একে যতদিন তোমরা আঁকড়ে থাকবে ততোদিন তোমরা বিপদগামী হবে না।
১১। আমিই শেষ নবী, আমার পর আর কোন নবী আসবেন না।
১২। তোমরা যারা উপস্থিত আছো তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেবে।
এই ছিল মোটামুটিভাবে বিদাই হজ্জ-এ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের মূল বাণী, যা উম্মতে মুহাম্মদী (সাঃ)-এর প্রত্যেকের জীবন চলার পথের পাথেয়।
কত কাঠখড় পেড়িয়ে আজকের এই ইসলাম তা হয়তো বর্তমান প্রজন্ম খুব একটা বেশি জানে না। জানবেই-বা কি করে? বিকৃত আর ভ্রান্ত মত ও পথের প্রচার প্রসার দুনিয়ায় যে ভাবে বিস্তার লাভ করেছে, তাতে প্রকৃত সত্য অনেকটাই ধামাচাপা পড়ে গেছে। ইসলামের অপ্রিয় সত্য কেউ তুলে ধরতে চায় না, আবার কেউ তুলে ধরলে তার জন্য তাকেও গালমন্দ শুনতে হয়। অসত্য অসুন্দর ইতিহাস ও ইসলামের বিরুদ্ধে ইহুদী-নাসারা ষড়যন্ত্র চক্রান্ত তুলে না ধরলে প্রকৃত সত্য ও সুন্দর প্রজন্মের কাছে খোলসা হবে কি করে? না বললে, না জানলে তো তুলনা করা সম্ভব হবে না, ভুলও সংশোধন করা যাবে না।
আমার লেখা নিয়ে এরই মাঝে একটি শ্রেণী খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তারা অনেকেই অনেক ধরনের বিকৃত রুচির পরিচয় দিচ্ছে। তাদের উদ্দ্যেশে বলছি— ধর্ম সম্বন্ধে ভালভাবে না জেনে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে কেউ কখনো আসে না; বিশেষ করে পবিত্র কুর'আনুল কারীম ও হাদীস নিয়ে আলোচনা করার তো প্রশ্নই উঠে না। পবিত্র কালাম পাক নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করতে হলে যে সব জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন, আখলাক ইবাদত দরকার, আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীনের খাস রহমত, আমি সেগুলো অর্জন করতে চেষ্টা করেছি, করছি। আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীনের দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া, কোন ভ্রান্ত মতবাদ কোনদিনও আমাকে প্রভাবিত করতে পারেনি।
আমি মনে করি পবিত্র কুর'আনুল কারীম ও সহীহ ছিত্তাহ অনুসরণ করে মহান স্রষ্টার কৃপা প্রার্থনা করলেই সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যায়, তা পাওয়া দুষ্করও নয়। তাছাড়া বিশিষ্ট মুসলিম মনীষী— ইমামে আযম ও হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-সহ পাইওনিয়র মুসলমানদের লেখা অজস্র কিতাব আমাদের পথ প্রদর্শনে সহায়িকা হিসেবে কাজ করবে। অবশ্য বর্তমানে বহু পথভ্রষ্ট দল বেরিয়েছে, যারা ইমামে আযম বা ইমামে রাশেদীন অথবা হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-কে মানতে নারাজ! তারা মনে করে শুধু কুর'আন পড়লেই যথেষ্ট। তাদের এই যুক্তি আমি অবশ্যই মানি; কিন্তু সঠিক ধারাবাহিকতার অনুসরণ?
ধারাবাহিকতা ছাড়া সরাসরি আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন বা হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামকে অনুসরণ করা কি করে কার পক্ষে সম্ভব? ঈমান ও ইসলামকে জানতে হলে বুঝতে হলে অবশ্যই আমাদের কারো না কারো লেখার উপরই নির্ভর করতে হবে, কোন না কোন ধারাবাহিকতার উপর আমল করতে হবে। আমি মনে করি হুজ্জাতুল ইসলামের ক্ষুরধার লেখাই আমাদের সঠিক পথ বাতলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সঠিকভাবে কুর'আনুল কারীম জানতে ও বুঝতে হলেও অবশ্যই সঠিক তাফসীর কারকের তাফসীর পড়তে হবে, অনুসরণ করতে হবে। ব্রিটিশ মদদে গড়া মৌদুদীর তাফসীর পড়ে সঠিক ইসলামের নাগাল মোটেও পাওয়া যাবে না। এতে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই বরবাদ হবে।
ইসলামের সেই প্রথম যুগেই বেইমানী, নেমকহারামী, মোনাফেকী নামক বিষফোঁড়াগুলো মুসমানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছিল। শ্রেষ্ঠ সাহাবী হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর ঘরেই জন্ম নিয়েছিল কুখ্যাত মালাউন ইয়াজিদ; যে কিনা মসজিদে নববীকে ঘোড়ার আস্তাকূর বানিয়েছিল! ইয়াজিদের মতো অসংখ্য মালাউন মুসলিম সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়েছে! স্বীকৃত মোনাফেক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথা ইতিপূর্বে বহুবার আলোচনা করেছি। ইহুদী-নাসারা চক্রান্তে যুগের পরিক্রমায় সেই উবাইরা ও খাচ্চোর শাসকরা মিলে পৃথিবীর শান্তির ধর্ম ইসলামকে বিতর্কিত করেছে, ভ্রান্ত মতবাদ ও নতুন নতুন ফিতনার উৎপত্তি ঘটিয়েছে। তারা তাদের দুনিয়াবি হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দ্যেশেই এ'সব করেছে।
ইসলামে ধর্মীয় সন্ত্রাস বা ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদ উগ্রবাদের সূচনা মূলতঃ হযরত ওসমান (রাঃ) -র শাসনামলের শেষ দিকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দে যা ব্যাপক রূপ ধারণ করে; আব্দুল আজিজ আল সাউদ ও মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব নাজদী মিলে ইসলামে জঙ্গিবাদের বীজ বোপণ করে, যা পরবর্তীতে মুসলিম রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। ভ্রান্তমতবালম্বী আব্দুল ওহাব নাজদী ধর্মীয় নেতা সেজে একের পর এক বিকৃত ফতোয়া দিতে থাকে, আর ডাকাত সর্দার আব্দুল আজিজ আল সাউদ রাষ্ট্রনায়ক সেজে (যার নামে জাজিরাতুল আরব সৌদি আরব হয়েছে ) নাজদীর ফতোয়া বাস্তবায়ন করতে থাকে!
তৎকালীন জাজিরাতুল আরবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের বংশধরগণকে নিধনের যে জঘন্য প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছিল আব্দুল ওহাব নাজদী ও আব্দুল আজিজ আল সাউদ তা ভাষায় বর্ণনা করার মত নয়। সকল সাহাবী রাদি'আল্লাহু আনহুগণের কবরের শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকো মুছে দেয়াই যেন ছিল নাজদীর ফতোয়ার মুখ্য বিষয়। এমন কি শালা-ভগ্নীপতি মিলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের পবিত্র রওজা মোবারক গুঁড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টাও করেছিল। সে এক বিকৃত ইতিহাস; অন্য আরেক সময় তা তুলে ধরার আশা পোষণ করছি।
সেই থেকেই শুরু হয় নামধারী মুসলিমের হাতে ঈমানদার সব মুসলিম নিধন! একদিকে ঈমান ও আকিদাগত বিষয়গুলো পরিবর্তিত হতে থাকে ধর্মীয় সংস্কারের নামে, অন্যদিকে চলতে থাকে সারে তেরশ বছরের ইসলামের ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্নগুলোর মুন্ডুপাত। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নবী কারীম (সাঃ)-এর বংশধারগণ প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আফগানিস্তান পাকিস্তানের বন জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। স্বভাবতই নবীর বংশধরগণ শান্ত ভদ্র নম্র হন; হিংস্রতা বর্বরতা তাঁরা বুঝেন কম। ডাকাতদের সাথে কুলিয়ে উঠা তাঁদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না।
ডাকাতদের বর্বরতার কাছে হার মেনে মাতৃভূমি ছেড়ে তাই তাঁরা আত্নগোপন করেছিলেন এই অঞ্চলে। নির্মম নিষ্ঠুর নিয়তি, সেই একই অবস্থা আজও বিদ্যমান। মার্কিনরা ওসামা-বিন-লাদেনকে আরবে তৈরী করে, শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানে আত্মগোপনের বাহানাকে ইস্যু করা ছিল আফগানিস্তানে মার্কিনী আক্রমনের একটি কূটকৌশল; আসল উদ্দ্যেশ্য ছিল অন্য, প্রকৃত মুসলিম দমন।
বর্তমান পৃথিবীর নব্য আকিদার মুসলিম শুধুমাত্র নামকাওয়াস্তেই মুসলিম। কার কতটুকো ঈমানী জোর আছে তা একটু স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বা স্বার্থ সম্পৃক্ত ব্যাপারে জড়ালেই স্পষ্ট হয়ে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য ওহাবী মতবাদ আজ সাড়া মুসলিম জাহানকে খণ্ড-বিখণ্ডিত করে দিয়েছে; অন্যদিকে মওদুদীবাদ আমাদের এই উপমহাদেশকে উত্তপ্ত করেছে। এই দুই ভ্রান্ত দল মিলে সমগ্র ইসলামী জাহানকেই আজ এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বানিয়ে ছেড়েছে। একদিকে ইহুদী-নাসারা চক্রান্ত, অন্যদিকে মুসলিম রূপি এই সব মুনাফিকদের আধিপত্য, সমগ্র মুসলিম জাহানকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। এর মুল কারণ মুসলিম বিশ্বে আল্লাহ প্রদত্ত ধনসম্পদের পর্যাপ্ত সমাহার।
অতি সাধারণ একটি চিন্তা— ইসরাইলে ইহুদী সন্ত্রাসীরা প্রতিদিন নিরস্ত্র মুসলিম নর-নারী-শিশুর উপর পশুর মতো হামলে পড়ছে, অকাতরে অকারণে ছোট ছোট অবোধ শিশুদেরকেও হত্যা করছে। আর আল কায়েদার বর্তমান প্রধান জাওয়াহিরি ইসরাইল বাদ দিয়ে এশিয়ার মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চলে আঘাতের পরিকল্পনা করছে! সত্যি সত্যিই আল কায়েদা যদি প্রকৃত ইসলামী চেতনা সমৃদ্ধ কোন গ্রুপ হতো, তবে জাওয়াহিরি সকল ইসলামী গ্রুপগুলো নিয়ে অতর্কিতে ইসরাইলের উপরই ঝাঁপিয়ে পড়তো; বাংলাদেশ বা মুসলিম দেশে সাধারণ মুসলিম মারার পরিকল্পনা করতো না। আমাদের দেশে বা মুসলিম বিশ্বে যে সব সন্ত্রাসী উগ্রবাদী গ্রুপগুলো আছে, তারাও কোনভাবেই আল কায়েদার সাহায্যে এগিয়ে আসতো না। ইসলামী বলে পরিচিত এই সব সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো আসলে মার্কিনীদের তৈরী, মার্কিন চক্রান্ত বাস্তবায়নের এজেন্ট ওরা। মুখ ও অবয়বে ইসলামী লেবাস এঁটে ইহুদী-নাসারাদের চড় হিসেবে মুসলিম বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদা দুটি বিষয়। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুগে যুগে মুসলমানের ঘরেই জন্ম নিয়েছে বেইমান আর মুনাফিক। যারা কূটচালে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে ইসলামকে বার বার বিতর্কিত করেছে। হিংসা প্রতিহিংসা তাদের মূল চালিকাশক্তি; তারাই ভিন্ন মতবালম্বী। ইসলামকে সব সময়ই তারা হাতিয়ার বা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং আজও করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের কোন মূলনীতিরই তারা ধার ধারে না। বাহ্যিক ঈমানদার ও ইবাদতি ভাব প্রকাশ করে তারা ইসলামিষ্ট সাজার ভান করে মাত্র।
ইসলাম আল্লাহ মনোনীত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান; রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, ব্যক্তি কোন কিছুই এই বিধানের বাহিরে নয়। ইসলামের মুল বিষয়গুলো মানুষের মৌখিক, আত্নিক ও বাহ্যিক অবস্থার সাথে পুরোপুরিভাবে সম্পৃক্ত; যেমন— আল্লাহ ও আল্লাহর হাবীব (সাঃ)-কে মুখে স্বীকার করা, অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা ও আল্লাহর আদেশ নিষেধ মান্য করা ও নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করা। সেই হিসেবে ঈমান ও ইসলাম প্রধানতঃ তিন ধরনের দেখা যায়। কেউ মনে করেন - ঈমান ও ইসলাম এক ও অভিন্ন। আবার কেউ মনে করেন - দুটোই ভিন্ন ভিন্ন, পরস্পরের কোন মিল নেই। এবং কারো কারো মতে - দুটো আলাদা হলেও একটি অপরটির সাথে সম্পর্কযুক্ত।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-র মতে - আভিধানিক অর্থে ঈমান হলো সত্যায়ন করা; অর্থাৎ সত্যি বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস ও প্রকাশ করা। এবং ইসলামের প্রকৃত অর্থ হলো আনুগত্য স্বীকার করা ও অস্বীকৃতি, অবাধ্যতা, হটকারিতা হতে নিজকে দূরে রাখা। ঈমান প্রশ্নে, সত্যায়ন বা বিশ্বাস এক বিশেষ স্থান, তথা অন্তর দিয়ে হয়ে থাকে; যার প্রকাশক হলো মুখ, আর স্বীকার করা হয় মুখ, অন্তর ও প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে। অভিধানের ভাষায় ইসলাম একটি ব্যাপক বিষয়, আর ঈমান হলো একটি বিশেষ বিষয়।
ইসলাম যদি একটি প্রকান্ড গাছ হয় ঈমান হলো তার একটি শাখা মাত্র। মূলতঃ ইসলামের শ্রেষ্ঠ অংশের নাম হলো ঈমান। ঈমানহীন কোন মানুষ কখনো একজন সত্যিকার মুসলিম হতে পারে না। যারা না বুঝে ভ্রান্ত সব ইসলামী গ্রুপের পাল্লায় পড়ে ঈমান নাশক টেবলেট খাচ্ছে, শহীদ বা গাজি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, হে আল্লাহ আপনি তাদেরকে হেফাজত করুন এবং হেদায়েত দান করুন।
শত সহস্র পথের মধ্যে
সত্য কেবল একটি পথ।
সেই পথের যাত্রী সবায়
একই লক্ষ্য একই মত।
কেউ কি কোন খবর রাখে
তাদের লক্ষ্য-কাম্য কি?
ভ্রান্ত পথের যাত্রী যারা
তারাই-বা বুঝবে কি?
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
০৮-০৯-২০১৪.
👍👍👍👍👍
উত্তরমুছুনধন্যবাদ!
মুছুন