বদলে যাচ্ছে চতুর্দিক, উন্নত হচ্ছে দেশ; কিন্তু পাল্টাচ্ছে না দেশের মানুষ। বিশ্বায়নের ছোঁয়ায় হু হু করে পাল্টে যাচ্ছে চতুর্দিকের সবকিছুই; কিন্তু দেশের মানুষের মাঝে অস্থিরতা অসহিষ্ণুতা বর্বরতা দিন দিন বেড়েই চলছে। পারিবারিক বন্ধনগুলোতে চির ধরেছে, বিশ্বাসের ভীতগুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে, শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা এখন শুধুই মৌখিক অভিব্যক্তির বহ্নিপ্রকাশ মাত্র; ঘরে বাইরে সর্বত্র সব জায়গায় এখন একই অবস্থা। ব্যক্তি, সরকার, বিরোধীপক্ষ, বিরোধীদল যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ভালো কোন কাজ বা ভালো কোন সিদ্ধান্তের কথা তুলে ধরেও যখন তা জনসন্মুখে প্রকাশ বা উপস্থাপন করা হয়, তখনও দেখা যায় কিছু সংখ্যক মানুষ নেতিবাচক মন্তব্য করে মত প্রকাশ করতে! এর পিছনে অবশ্য যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি কাজ করছে তা হলো জন্মগতভাবে বেড়ে উঠার এক ধরণের নেতিবাচক প্রভাব।
এদেশে শিশুদের বেড়ে উঠার ব্যাপারটি সমাজ বিজ্ঞানীদের কাছে সব সময়ই উপেক্ষিত থেকেছে। ছেলে শিশুরা বেড়ে উঠছে এক ভাবে, অন্যদিকে মেয়ে শিশুরা বেড়ে উঠছে অন্যভাবে। তাই আমাদের সমাজে দিন দিন এমনসব অসহিষ্ণুতা এবং সামাজিক অস্থিরতা বেড়েই চলছে। এসব ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রেই ইতিবাচক তেমন কোন দিক খুজে পাওয়া যায় না, তাই হয়তো তেমন ভালো কিছু ভাবতেও পারেন না অনেকে। তাছাড়া, শিশুকাল থেকে নেতিবাচক প্রভাবে বেড়ে উঠায় অভ্যস্ত শিশুরা বড় হয়েও ইতিবাচক কোন কিছু করতে পারে না; এমন কি ইতিবাচক কোন কিছু মেনেও নিতে পারে না। কিন্তু প্রকৃত বাস্তব শিক্ষার একটি মৌলিক দিক হলো - সব কিছুতে ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা করা; যে জাতির মানুষ যত বেশি ইতিবাচক চিন্তায় অভ্যস্ত, দেখা যায় সে জাতি ততো উন্নত।
কেন যে এদেশে এখন ইতিবাচক চিন্তার মানুষের চেয়ে নেতিবাচক চিন্তার মানুষের সংখ্যা বেশি তা বুঝে উঠতে পারছি না। অনেকের মাঝেই বদ্ধমূল একটি ধারণার জন্ম নিয়েছে— সব শেষ, কিচ্ছু আর হবে না এদেশের! তাই তারা সদা সর্বদা চেষ্টায় থাকে, কি করে অন্য কোন উন্নত দেশে অভিবাসন নেয়া যায়। আবার অনেকে এদেশ থেকে অবৈধভাবে টাকা কামিয়ে অন্য দেশকে সেকেন্ড হোম বানাতে ব্যস্ত বা পার্মানেন্টলি চলে যাওয়ার চিন্তায় মত্ত। মালয়েশিয়াকে এরই মাঝে অনেকে সেকেন্ড হোম বানিয়েও নিয়েছে! দেশের প্রতি টান, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে যা হওয়ার তা তো হবেই। অবশ্য কোনভাবেই এজন্যে এককভাবে কোন ব্যক্তিকে দায়ী বা দোষারোপ করা যাবে না, দোষ আমাদের জাতির সবার। কেন না, স্বাধীনতার এতো বছর পেড়িয়ে গেলেও আজও পারলাম না আমরা আমাদের দেশের একটি পূর্নাঙ্গ জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে এবং তা বাস্তবায়ন করতে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে আমার অভিযোগের শেষ নেই, সারা জীবন শুধু সেই একই প্যাচাল বার বার পেড়েই গেলাম। লোকজন এখন আর এসব তেমন একটা শুনতে চায় না, জানতেও চায় না। কিন্তু উপায় কি? দেশের অবকাঠামোগত উন্নতি যথেষ্ট হয়েছে, হচ্ছে; বড় বড় সব ফ্লাইওভার হয়েছে, ঢাকায় স্বপ্নের মেট্রো রেল হচ্ছে, কল্পিত পদ্মা সেতুও বস্তব রূপ পেতে যাচ্ছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেশে শিক্ষায় মৌলিক কিছুর কি উন্নতি ঘটেছে? মৌলিক শিক্ষা বঞ্চিত এদেশের বাচ্চারা বড় হয়ে কি করে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করবে? 'আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ' - এ কথাটি শুধু আমাদের কথার কথা। কতটা আমারা বাক্যটির অন্তর্নিহিত ভাব উপলব্ধি করি? মুখে আমরা সবাই বলি, কিন্তু একটি শিশুকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিসহ মেধা ও মননের বিকাশের ক্ষেত্রে যা যা করণীয় তা সম্বন্ধে আমরা কতটা কি ভাবছি বা করছি? বরং এসব বিষয়ে আমাদের ন্যুনতম সচেতনাও নেই।
শুধুমাত্র অশিক্ষা, কুসংস্কার বা অজ্ঞতাই এসবের জন্য দায়ী নয়, মূল প্রতিবন্ধকতা আমাদের মানসিকতা। সামগ্রিকভাবে পারিবারিক উদাসীনতা, ব্যক্তির জানার অনাগ্রহ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও ইচ্ছার অভাব মূলত এসবের জন্য দায়ী। শারীরিক সুস্থতা ও মানসিক পরিপূর্ণতা সম্পন্ন একটি আগামী প্রজন্ম নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই আমাদের এখনই শিশুদের বেড়ে উঠার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এবং অতীব গুরুত্বপূর্ণ হলো শিশুর নিরাপদে বেড়ে ওঠার বিষয়টি নিশ্চিত করা। জাপানের একটি শিশু যখন স্কুলে যেতে শুরু করে তখন প্রথমেই তাদের শিখানো হয় সবার সাথে চলা; অভিবাদন, প্রশংসা, একতা, অন্যের ক্ষতি না করা, স্বাস্থ্য ও জিনিসের যত্ন নেয়া, নিজের কাজ নিজে করা ইত্যাদি। আর আমাদের এখানে শেখানো হয় কি?
জাপানের প্রতিটি শিশুকেই এক বছর বয়স থেকেই স্কুলে পাঠানো হয়। সেখানেই হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ও খেলাধুলায় বেড়ে ওঠে তারা; এই বিশেষ স্কুলের নাম - ‘হুকশু'। কোন ভাবেই এ'গুলোকে কিন্ডারগার্টেন বা পশ্চিমা ধাঁচের ডে কেয়ার স্কুল বলা যাবে না; পুরোপুরিভাবে এসব প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল, অনেকটা আমাদের দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো। সব শিশুর জন্যই এই স্কুলগুলো বাধ্যতামূলক; এমনকি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্যও। ভিন্ন ধরনের এইসব স্কুলে সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে বাবা-মায়েরা তাদের শিশুকে দিয়ে যান এবং বিকেল ৪টা-৫টার মধ্যে সব বাবা-মা'ই আবার তাদের শিশুকে নিয়ে আসেন।
ছোট্ট এই শিশুরা সারাদিন স্কুলেই অতি নিরাপদে থাকে; তাই বাবা-মাকেও শিশু নিয়ে চিন্তিত শঙ্কিত হতে হয় না। এই ছোট্ট বয়স থেকেই স্কুলে শিশুরা সব কিছুই করে থাকে; খেলা করা, খাবার খাওয়া, দুপুরে সবাই একসঙ্গে ঘুমানো, গরমের সময় একসঙ্গে জলকেলি করা। এভাবে এক বছর বয়স থেকেই একতার সাথে সব শিশুরা অনবদ্য এক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে বেড়ে উঠে। ওদের স্কুল ব্যাগে কোন বই থাকে না, থাকে দাঁত পরিষ্কারের ব্রাশ, ছোট টাওয়াল, পানি পানের গ্লাস, রুমাল, ভাতের ছোট টিফিন বাটি, চপস্টিক আর ছোট্ট একটি নোট খাতা। স্কুলে রান্না করা একই রকম সুষম খাবার; সবজি, তরকারি ও ফলমূল প্রতিটি শিশুকে ক্লাসেই খেতে দেয়া হয়।
বন্ধু বা বান্ধবীর কোন কিছু পছন্দ না হলে স্কুলে তারা তা নিয়ে সরাসরি কোন প্রতিবাদ বা ঝগড়া করে না। কোন কিছু অপছন্দ বা খারাপ লাগলে তারা সাধারণত কাঁদতে কাঁদতে শিক্ষক বা পিতামাতাকে জানায়; তখন শিক্ষক ও পিতা-মাতারা শিশুদের কথায় শাসন করে, গায়ে হাত দিয়ে নয়। যেসব পিতা-মাতা বা শিক্ষক শিশুর গায়ে হাত তোলেন, তাদের সমাজে মন্দ মানুষ হিসাবে বিবেচিত করা হয়। কোন শিশু ভুল করলে তাকে ততক্ষণ পর্যন্ত বোঝানো হয়, যতক্ষণ না সে বলে যে ‘আমি বুঝেছি’। শিশুরা সাধারণত ভুল বোঝার পর কান্না করে থাকে, তখন নিজ থেকেই প্রতিজ্ঞা করে, আর কখনো সে সেই ভুলটি করবে না। জাপানিরা পৃথিবীর অন্যতম সুশৃঙ্খল ও সৎ জাতি হওয়ার পেছনে এই ‘হুকশো’-র অবদান অনস্বীকার্য।
শুনে হয়তো আশ্চর্য হবেন— এক বছরের বাচ্চারাও সেখানে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে; যেহেতু শিশুরা তখনো নিজে পুরোপুরি বুঝতে পারে না, তাই বাবা বা মায়ের সঙ্গী হয়ে কোলে থেকে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তারা অংশ নেয়। আনন্দই তাদের শিক্ষার প্রধান উপকরণ। শহর কিংবা গ্রাম, সব স্কুলেই তাদের শিক্ষাপদ্ধতি এক ও অভিন্ন। প্রকৃতি দেখা, জীবন থেকে শেখা, সুনাগরিক হিসাবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করতে ‘হুকশু’ থেকেই নিয়মিত ভ্রমণ, সংস্কৃতি অনুষ্ঠান ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। শিল্পচর্চা সব শিশুর জন্য এখানে অত্যাবশ্যক; আঁকাআকি, নাচ-গান, খেলা, আনন্দ-উল্লাসে প্রতিটি শিশু দক্ষতার সঙ্গে সেখানে বেড়ে ওঠে। পিতা-মাতার পেশার বা সামাজিক অবস্থানের কারণে কোন বাচ্চা ভর্তি সুবিধা বা অতিরিক্ত প্রশংসা বা অনুপ্রেরণা পায় না।
স্কুলের আচার-আচরণ ও পদ্ধতিতে শিশুর ধনী-গরীব, সাদা-কালো, ধর্ম-বর্ণের পরিচয় বোঝার কোন উপায় নেই; ওখানে সবাই সমান। কেউ কাউকে ছোট বা বড় করে দেখে না বা ভাবে না। 'হুকশু' স্কুলের প্রতিটি উপাদান ও আয়োজন শিশুদের আনন্দ, চিন্তা ও দক্ষতার উন্নয়নের পাশাপাশি চরিত্র গঠনের অনুকূলে। কোন কিছু ভুল প্রমাণিত হলে তৎক্ষনাৎ তা পরিবর্তন বা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এসব স্কুলে নারী শিক্ষকের সংখ্যাই বেশি; তাদের সবাই শিশুযত্নের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। মায়ের মতই এইসব শিক্ষকরা শিশুর যত্ন নেন এবং শিক্ষা দেন। তাই হৃদয়ের বন্ধন এমন দৃঢ় হয় যে স্কুল পরিবর্তন বা বিদায়ের সময় শিশু তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষককে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদে। জাপানের কোন স্কুলেই কখনো নেতিবাচক কোন শব্দ একেবারেই ব্যবহার করা হয় না; সততা, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেয়া হয় প্রতি পদে।
আদর্শ ও আচরণের যেসব জিনিস আমরা শিশুদের শেখাতে চাই, তা শিশুর সামনে প্রতিদিন চর্চা করে শিখাতে হয়; জাপানি স্কুলে শিশুদের এসব অভ্যাসে পরিণত করা হয়। আনন্দের সঙ্গে স্কুলে সব ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে খেলে গড়ে উঠে একই পরিবারে সদস্যের মতো ভালোবাসার এক অমৃত বন্ধনে। সাধারণত ছয় বছর পর্যন্ত শিশুরা এসব স্কুলে যায়; এরপর প্রাথমিক স্কুলে যাওয়া শুরু করে। ইতোমধ্যে 'হুকশো' স্কুলেই শিশু নিজের শরীরের যত্ন নেয়া, অন্যকে ভালোবাসা, লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়া, সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা ইত্যাদি শিখে ফেলে। পিতা-মাতা তো পরের কথা, জাপানি শিশুদেরকেও কখনো রুক্ষ স্বরে ঝগড়া করতে দেখা যায় না; তাই তো তাদের বলা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নম্র ও ভদ্র জাতি।
মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে— যে কোন শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে পাঁচ বছরের রেকডিং-এর উপর ভিত্তি করে। এসময় শিশুরা যা দেখে-শুনে ও বুঝে তার উপর ভিত্তি করেই তাদের চরিত্র, ভাবনা, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। বৈজ্ঞানিক এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই পৃথিবীতে আজ উন্নত জাতিগুলো তাদের শিশু শিক্ষার উপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের দেশের শিশুরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেই থেকে যায়। ধনী শিশুদের কিছুটা সুযোগ থাকলেও তারা বড় হয় কাজের বুয়াদের কোলে, আর গরীর শিশুদের শিশুকাল কেটে যায় পথেঘাটে। ফলে শিশু মস্তিষ্কের নিউরণের বিকাশের অপূর্ণতার খেসারত গুনতে হয় ব্যক্তির সারাজীবন দিয়ে।
অনেকেই এসবের জন্য আমাদের দেশে এককভাবে শুধু সরকারকেই দোষারোপ করে থাকেন; কিন্তু কোন সরকারকেই তারা আবার দীর্ঘ সময় স্থায়ী থাকতেও দিতে চান না। একটি জাতিকে গঠন ও উন্নত করতে হলে অবশ্যই দীর্ঘ মেয়াদের কিছু পরিকল্পনা ও সেসবের বাস্তবায়নের দরকার হয় এবং এর জন্য প্রকৃত দেশ প্রেমিক একজন নেতারও দরকার হয়। কিন্তু আমাদের জাতির দূর্ভিগ্য - সেই সুযোগ পেয়েও আমরা হারিয়েছি। তাই, আজ আমি এমন একটি দেশ ও এমন একজন নেতার গল্প আপনাদের শোনাবো যে দেশটি আজকের পৃথিবীর মডেল, কিন্তু সে দেশের নেতা ছিলেন দেশের তখনকার জনগণ কতৃক ধিকৃত; যদিও তিনি সে দেশের জাতির পিতা।
সিঙ্গাপুর— আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পরিচ্ছন্ন এবং গোছানো একটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে আজকের পৃথিবীতে সর্বজনবিদিত; কিন্তু আজ থেকে ৫০ বছর পেছনে ফিরে তাকালেই দেখা যায় এই সিঙ্গাপুরের ভিন্ন এক দৃশ্য। কেমন ছিল তখনকার সিঙ্গাপুর? ১৯৫৯ সালে সেই নগর রাষ্ট্রটিকে শুধু অপরাধ ও দারিদ্রে জর্জরিত একটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেই গণ্য করা হতো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অতি ছোট্ট একটি দ্বীপদেশ এই সিঙ্গাপুর; মাত্র ৭১৬ বর্গ কিলোমিটারের একটি নগররাষ্ট্র এটি। এই নগর রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা উল্লেখ করার মতো। প্রকৃত অর্থে কিছুই ছিল না তাদের; এখনো পান করার পানিও পাশের রাষ্ট্র থেকে আমদানি করতে হয়। তখন তাদের পেশা-নেশা, বেঁচে থাকা সব কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল ফিশিং; আর সেই সূত্রে ওটার পরিচিত ছিল মাছ ধরার একটি কেন্দ্র হিসেবেই।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দ্বীপে সংখ্যাগরিষ্ঠ চীনাদের সঙ্গে সংখ্যালঘু মালয় ও কিছু ভারতীয়দের মধ্যে তখন দ্বন্দ্ব-বিভেদ ছিল চরমে; অপরাধ আর খুন-খারাবির কোনো অন্ত ছিল না। একক সিঙ্গাপুরীয় পরিচয়ের চিন্তাও তখন তাদের ছিল না। দুর্নীতি, অশিক্ষা আর ঘিঞ্জি ছিল চারপাশ; কিন্তু সেদিন তাদের পাল্টে গেছে। মাত্র ৫০ বছরের পথপরিক্রমায় সিঙ্গাপুর এখন এশিয়ার, এমন কি বিশ্বের বুকে অন্যতম একটি বাসযোগ্য ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন একজন অনন্য মানুষ; তিনি হলেন লি কুয়ান ইউ। দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ-র নেতৃত্বে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি থেকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মাথপিছু আয়ের দেশে পরিণত হয়েছিল ৫৫ লক্ষ মানুষের এই দেশ সিঙ্গাপুর।
মাত্র ৭১৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লি কুয়ান ইউ দেশটি শাসন করেন দীর্ঘ ৩১ বছর; বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীত্ব সামলানোর রেকর্ডও এটি। তাঁর পূর্বপুরুষ চীন থেকে এই দ্বীপে এসেছিলেন তিন পুরুষ আগে। যদিও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ের সাবেক ছাত্র লি কুয়ান ইউ-র বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা ও এক নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অভিযোগ উঠেছিল বারবার; কারণ বিরোধীদের মতামতের কোনো গুরুত্বই দিতেন না তিনি। এরপরও তিনিই আধুনিক সিঙ্গাপুরের জাতির জনক; একটি ছোট্ট বন্দরনগর থেকে বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন তিনিই সিঙ্গাপুরকে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের বিশেষ অনুরাগী লি কুয়ান ইউ-র বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর বড় অভিযোগ ছিল, তিনি তার শাসনামলে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়ার পায়ে আগুনের মোটা বেড়ি পড়িয়েছিলেন। বিশ্বে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে (ডাব্লিউপিএফআই) ১৮০ টি দেশের তালিকায় তখন সিঙ্গাপুরের অবস্থান ছিল ১৫৩ তম। লি কুয়ান ইউ-র শাসনামলে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যাও ছিল বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানো, এমন কি বিনা বিচারে আটকের জন্যও 'কুখ্যাত' ছিল লি কুয়ান ইউ প্রশাসন। অথচ, ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুরকে এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত এবং এর আধুনিকায়নে লি কুয়ান ইউ-এর অবদান ব্যাপক এবং অনস্বীকার্য।
লি কুয়ান ইউ ১৯৫৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার নেতৃত্বে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি থেকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মাথাপিছু আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে ৫৫ লক্ষ মানুষের দেশ সিঙ্গাপুর; আর এ কারণেই তাকে আজ বলা হয় আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক।
আধুনিক সিঙ্গাপুরে স্বপ্নদ্রষ্টা লি কুয়ান ইউ, আধুনিক চীনের স্বপ্নদ্রষ্টা মাও সেতুং, আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ও রুপকার ড. মাহাথির মুহাম্মদ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জনক ও স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এখন আমাদের জন্য দরকার একজন আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। শত বাধা, শত বিপত্তি, শত না পেড়িয়েও আজ আমাদের দরকার দেশপ্রেমিক একজন লি কুয়ান ইউ বা মাও সেতুং বা মাহথির। আমার মনে হয় বিগত ১০ বছরে আমরা এরই মধ্যে দেখেছি এদেশের জন্য শেখ হাসিনার অবদান। সব কিছুতে তিনি যে ভালো করেছেন বা সফল হয়েছেন তা কিন্তু নয়; তারপরও এদেশের বিগত সব সরকারের সার্বিক বিবেচনায় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে শেখ হাসিনার দেশপ্রেম ও অবদান অনস্বীকার্য। উন্নত দেশের স্বপ্নসাধ পূরণে শেখ হাসিনার কোন বিকল্প আছে কি?
এদেশের দ্বিধাবিভক্ত মানুষের সবচেয়ে খারাপ দিকটি হলো অন্যের ভালো কাজেরও সমর্থন না দিতে পারা। অতি ইমোশনাল ও হটাৎ কিছু পাওয়ার আশা করা এই জাতিকে হয়তো নতুন করে আবারও ভাবতে হবে। তবেই হয়তো আসবে জাতির মুক্তি; গড়তে পারবো স্বনির্ভর বাংলাদেশ।।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১৬ অক্টোবর, ২০১৭.
বাস্তবভিত্তিক উপস্হাপন কিন্তু এই সমাজটা কে পরির্বতন করবে? পরতে পরতে ভুল ডিসেশন ও দুর্নীতি বিরাজমান!
উত্তরমুছুনআমরা যদি ঠিক হয়ে যাই কোন কিছু কি অসম্ভব?
মুছুনWow!
উত্তরমুছুনExcellent writings.
উত্তরমুছুন