বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০২০

কর্মসংস্থানে পৃষ্ঠপোষকতা নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো যোগ্যতা ও আত্মবিশ্বাস:

জীবন চলার পথে ‌হাজারো প্রতিকূলতা— দারিদ্রতার কষাঘাত, এক বেলা খাবার জোটে তো আরেক বেলা জোটে না, পরিধানে ভালো পোশাক নেই, ধার-দেনা করে পড়াশোনা শেষ করতে না করতেই আইটি জায়ান্ট মাইক্রোসফট-এর নিয়োগপত্র হাতে পাওয়া; বছরে বেতন ১.০২ কোটি রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এটি হলো ভারতের সেই বাৎসল্য চৌহানের জীবনের গল্প। 

নিশ্চয় আপনারা ভুলে যাননি ২০১৬ সালের প্রথম দিকে ভারতের আনন্দবাজার ও বাংলাদেশের কিছু পত্রিকায় ঝড় তোলা সেই খবর - 'কোটি টাকার চাকরি পেলেন ঝালাই মিস্ত্রির ছেলে'। ভারতের বিহার রাজ্যের খাগাড়িয়ার বাৎসল্য চৌহান আইআইটি খড়গপুর-এর শেষ বর্ষের ছাত্র ছিল সে তখনও, বয়স মাত্র ২১ বছর। বাবা একজন ঝালাই মিস্ত্রি, মা অতি সাধারণ গৃহবধূ; ছয় ভাই-বোনের মাঝে প্রচণ্ড অভাবের সংসারে সংগ্রাম চালিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছিল বাৎসল্য চৌহান। তার সেই সংগ্রাম ছিল শিক্ষার মাধ্যমে মেধা বিকাশ করে জীবনযুদ্ধে নামার সংগ্রাম; আত্মবিশ্বাস ও একাগ্রতা তাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। 

অনেকেই এখানে ভাগ্যকে বড় করে দেখতে চাইবেন। হ্যাঁ, মুসলিম হিসেবে ভাগ্যকে অবশ্যই মানতে হবে, তবে বাস্তবতা থেকে একটি জিনিস আমি আবিস্কার করেছি, প্রচেষ্টা না থাকলে কারো ভাগ্য কোন দিনও সুপ্রসন্ন হয় না। কলেজ জীবনে আমাদের একজন বন্ধু ছিল, তার বেশভূষা ও চালচলন ছিল সম্পূর্ণ  অন্যরকম। সেই ৭০-এর দশকেও সে দু'টো প্রাইভেট কার অদল বদল করে কলেজে আসতো; মা-বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা তার জন্য অগাধ অর্থ-সম্পদ, মিল-কারখানা ও ঢাকায় বিশাল বাড়ি রেখে গেছেন। আমাদের এই সংক্ষিপ্ত জীবনেই আমরা তাকে একসময় প্রচন্ড রকমের অভাবগ্রস্থ হতেও দেখেছি! শুনেছি তার বাবার মৃত্যুর পর সে খারাপ লোকজনের সংস্পর্শে পড়ে বাবার রেখে যাওয়া সেই বিশাল সম্পদের সব কিছই ধ্বংস করে ফেলেছে। 

অতিরিক্ত অর্থ-সম্পদ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষকে অমানুষ বানিয়ে ফেলে। সন্তানকে প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে পারলে বা বানাতে পারলে তার জীবনে সম্পদের কোন অভাব কখনো হয় না। ছোট থেকে বাস্তবতা ও কিছুটা দারিদ্রতার সাথে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা দিয়ে বড় করতে পারলে দেখবেন আপনার সন্তান বাস্তবতার নিরিখেই জীবন গড়বে এবং কর্মজীবনেও সফলতাকে অতি সহজে কুক্ষিগত করে ফেলতে পারবে।

কেএফসির ফাস্টফুড এখন এদেশেও বেশ জনপ্রিয়। বড় বড় শহর থেকে শুরু করে ছোট ছোট মফস্বল শহরেও এখন কেএফসি ফাস্টফুড শপের দেখা মেলে। তাই কেএফসির লোগোর সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা হাসিমুখের লোকটিকে আমরা অনেকেই চিনি, তিনি হলেন কনোনেল স্যান্ডার্স; যিনি কেএফসি নামের বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় ফাস্টফুড চেইন শপের প্রতিষ্ঠাতা। 

তুমি যদি তোমার এলাকায় কেএফসির একটি শাখা খুলতে চাও, তবে তোমাকে শুধু তাদের ফ্রেঞ্চাইজি ব্যবহারের জন্য ৪৫ হাজার ডলার বা প্রায় ৩৮ লাখ টাকা দিতে হবে।  এতবড় কোম্পানী যাঁর রেসিপি থেকে শুরু, সেই রেসিপি বিক্রি করতে গিয়ে তাঁকে ১০০৯ বার ব্যর্থ হতে হয়েছিল!

৫ বছর বয়সে বাবা হারানোর পর থেকে তাঁর জীবন সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। নিজের রান্নার দক্ষতার কারণে কাজ পেতে তাঁকে কখনও তেমন একটা অসুবিধায় পড়তে হয়নি;  কিন্তু যখনই তিনি নিজে কিছু করতে গেছেন – তখনই ব্যর্থ হয়েছেন। ১৯৩৯ সালে ৪৯ বছর বয়সে অনেক কষ্টেসৃষ্টে তিনি একটি মোটেল শুরু করেন। ৪ মাস চলার পরই মোটেলটিতে আগুন ধরে ধ্বংস হয়ে যায়। ৫০ বছর বয়সে তিনি তাঁর সিক্রেট চিকেন ফ্রাই রেসিপি নিয়ে আবার কাজ করতে শুরু করেন।

১৯৫৫ সালে তাঁর আরও একটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। চার রাস্তার মোড়ে তিনি একটি রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন। ভালোই চলছিল, কিন্তু নতুন রাস্তা হওয়ার ফলে সেই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে রেস্টুরেন্টও বন্ধ করে দিতে হয়। সেই বছর ৬৫ বছর বয়সী কনোনেলের হাতে মাত্র ১৬৫ ডলার ছিল। এরপর তিনি তাঁর চিকেন রেসিপি বিক্রী করার চেষ্টা করেন। ১০০৯টি রেস্টুরেন্ট তাঁকে ফিরিয়ে দেয়ার পর একটি রেস্টুরেন্ট তাঁর রেসিপি নিয়ে কাজ করতে রাজি হয়; বাকিটা ইতিহাস! 

আমি লক্ষ্য করেছি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা অন্যের সাফল্যের গল্পগাঁথা শুনতে বা পড়তে প্রচন্ড ভালোবাসে; অবশ্যই এটা খুবই ভাল একটি লক্ষণ, যদি ঐ গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করার প্রত্যয়ে সে তা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই নিজের জীবনে এসব বাস্তবায়ন করতে চায় না বা পারে না; বরং অনেককে আমি দেখেছি হতাশায় সাগরে হাবুডুবু খেতে। তাদের অভিযোগ ঘুষ, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বা মামা চাচার জোর ছাড়া এদেশে কিছুই হয় না; চাকুরীর তো প্রশ্নই উঠে না। 

কিছু ছেলেমেয়ের কাছ থেকে এমনসব হতাশাজনক কথাবার্তা শুনে অনেক সময় আমার মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়। আসলে কি এসব অভিযোগ পুরোপুরি সত্য? আমার তো তা মোটেও মনে হয় না। এমনটা সত্য হলে সুবিধা বঞ্চিত পরিবারের ছেলেমেয়েরা বিসিএস কোয়ালিফাই করে সরকারী চাকুরীতে অহরহ ডুকছে কি করে? এমন উদাহরণ দেশে কি খুবই কম? মোটেও কম নয়। তাছাড়া দেশের সব বিখ্যাত ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালেই দেখা যায় মেধা ও যোগ্যতার বলেই যথেষ্ট পরিমাণে হতদরিদ্র পরিবারের অতি সাধারণ ছেলেমেয়েরা স্থান করে নিচ্ছে।

ছোট্ট ভূখণ্ডের বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশের পারিপার্শ্বিকতার বাস্তবতাকে তোমাদের অবশ্যই মেনে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। জীবন ধারণের সকল ক্ষেত্রেই বর্তমান দুনিয়ায় প্রত্যেককে প্রতিটি প্রতিযোগিতায় কোয়ালিফাই করতে হয়, আর এটাই স্বাভাবিক; চাকুরী ক্ষেত্রে তো আরো অনেক বেশি, করতেই হবে। তাই গো ধরে বসে থাকলে চলবে না, আত্মকর্মসংস্থানের জন্যও প্রচেষ্টা চালাতে হবে; কোন কর্মকেই কখনও খাটো করে দেখা যাবে না। তোমরা কি জানো বিদেশে ভার্সিটিতে পড়তে থাকা ছেলেমেয়েরা গ্রুপ করে বাসা বাড়ি বা অফিস আদালত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করার কায়িক পরিশ্রমের কাজ করে বা বাসাবাড়ির টয়লেট পরিস্কারের কাজ কন্ট্রাক্ট নেয়? আর ওসব করে অল্প সময়ে কায়িক পরিশ্রম দ্বারা তারা বেশ কিছু বাড়তি ডলার কামিয়ে নিতে পারে। 

তোমাদের জন্য আমার উপদেশ, শিক্ষা জীবন শেষ না হতেই কর্মসংস্থানের দিকে পা বাড়াও, এটা ওটা করে অভ্যাস করো; পাশ করে যদি কিছুদিন বসে থাকো বিশ্রাম নাও, দেখবে আস্তে আস্তে তোমার কর্মস্পৃহা কমে যাবে, লোপ পেতে শুরু করবে এবং এক সময় হতাশায় নিমজ্জিত হবে। অবিরামভাবে চলে যারা শিক্ষা জীবন থেকে কর্মজীবনে প্রবেশ করে তারা তুলনামূলক সাফল্য পায় অনেক বেশি। তাছাড়া, একটু খেয়াল করে সঠিকটা জেনে দেখো, এদেশেও বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা নিজ যোগ্যতা বলে চাকুরী পেয়েছে এবং পাচ্ছে, অন্যের টেলিফোনের জোরে নয়। 

আমি এমন অনেক ছেলেমেয়েকে চিনি ও জানি যারা বাবা-চাচা-মামার জোর বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই নিজের যোগ্যতায় শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাসের জোরে উপরে উঠেছে। রাবারের স্পঞ্জ পায়ে লুঙ্গি পড়ে আমাদের অফিসে এসেছিলেন কোন একজন,  কর্ম গুণে আজ তিনি আমাদের পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। সফলতার আগে মানুষের জীবনে আসে ব্যর্থতা; আর ব্যর্থতা আসে বারবার। প্রতিটি মানুষের জীবনেই ব্যর্থতা আসে এবং আসবেই। মানুষের কোনও বড় স্বপ্নই একবারে পূরণ হয় না। স্মরণ রাখতে হবে— ব্যর্থতা  জীবনের অবিচ্ছেদ্য  অংশ। 

পৃথিবীতে অসাধারণ সাফল্য সেইসব মানুষরাই অর্জন করতে পেরেছেন যাঁরা বারংবার ব্যর্থ হয়েও চেষ্টা করে গেছেন। একবার ব্যর্থ হলে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁরা আবার শুরু করেছেন, তারপর আবার ভুল করেছেন, আবার শুরু করেছেন। এভাবে শত শত বা হাজার হাজার বার ব্যর্থ হতে হতে একটা সময়ে গিয়ে ঠিকই সফল হয়েছেন। এমন অনেক আত্মবিশ্বাসী মানুষের সাফল্যের কাহিনী আমার জানা আছে, এই ছোট্ট পরিসরে এসব বলা সম্ভব নয়, তাতে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে; তাই সেদিকে আজ আর যাচ্ছি না। 

আমার মনে হয় আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারলেই জীবনে অনেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যায়; আত্মকর্মসংস্থান তো তেমন কোন ব্যাপারই নয়। তাছাড়া আত্মবিশ্বাস মানুষকে সব অসাধ্য সাধনে সহযোগিতা করে। আত্মবিশ্বাস শুধু একটি শব্দ নয়, এটি একটি শক্তি; যা মানুষের জীবনের কঠিন পরিস্থিতিও সহজ ভাবে মোকাবেলা করতে সাহায্য করে; আর এর অভাব মস্তিস্কের ভিতরের সমস্ত সম্ভাবনাকে কুঁড়িতেই ঝরিয়ে দেয়। 

পুঁথিগতবিদ্যা কোন বিদ্যা নয়, যদি তা বাস্তব বিবর্জিত হয়। পুস্তক থেকে বিদ্যা মস্তিস্কে ধারণ করে নিজ জীবনে সেসব বাস্তবায়ন করতে হবে, আর গ্রুপ ওয়ার্কিং করে বাস্তবমুখী শিক্ষার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ছোট থেকেই প্রত্যেককে গড়ে উঠতে হবে; সফলতা আসবেই।। 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২২ জুলাই, ২০১৭.


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন