বুধবার, ২২ জুলাই, ২০২০

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কিছু কথা:

৭৫ পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু, তাঁর সন্তান ও আওয়ামী লীগ নিয়ে এদেশে নানান ধরনের কোটারি (বঙ্গবন্ধুর ভাষায়) বা ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং ধারাবাহিকভাবে সেসব প্রচার হয়ে আসছে। স্বাধীনতা ও তৎপূর্ববর্তী-পরবর্তী সময়ের ইতিহাস, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে এদেশে একসময় বিভিন্ন কল্পকাহিনী তৈরি করা হতো এবং অত্যন্ত কূটকৌশলে একটা গোষ্ঠী সেইসব মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিত। আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগকে এক কাতারে দাঁড় করানোর হীন অপচেষ্টা সেই গোষ্ঠী সব সময়ই করতো। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো - মুসলিম লীগ পাক-ভারত বিভক্তির দল আর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ - পাকিস্তান বিভক্তির দল। এক সময় এদেশের মুক্তিকামী ভাল মানুষেরা মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগ গঠন করে এবং জনগণ সেই দলকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে রুপান্তরিত করে; মুসলিম লীগ আস্তে আস্তে পাকিস্তান প্রন্থী সুবিধাবাদী বুর্জোয়া শ্রেণীর দলে পরিণত হয়। 
সুতরাং মুসলিম লীগার বা পাক-প্রন্থী দলগুলোর লোকদের কাছে বাংলাদেশ তাদের নিজের দেশ মনে হবে না - এমনটাই স্বাভাবিক(!) এবং তারা বঙ্গবন্ধুকে খারাপ হিসেবে প্রমাণ করতে চাইবে - এমনটাই চরম সত্য ও নির্মম বাস্তবতা! 

অনেকটা না বুঝে ছাত্রজীবনে বাধ্য হয়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে আঁতাত করা একটা গোষ্ঠীর সাথে আমাকে একই প্লাটফর্মে দাঁড়াতে হয়েছিল। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক কোটারি কখনো আমার কাছে তেমন একটা ভাল লাগতো না, তাদের হত্যার রাজনীতিও কোনদিন পছন্দ করতাম না। জিয়াউর রহমানের নৃশংস হত্যা আমার স্বচক্ষে দেখা অত্যন্ত নোংরা রাজনীতির একটা নির্মম অধ্যায়। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডটা আমার কাছে কিছুটা দোয়াসা ও আবছা বিষয় হলেও জিয়ার হত্যাকান্ডটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার ব্যাপার মনে হয়েছে। জিয়ার ছাত্র সংগঠন ঘটন করার সুবাদে অনেকটা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, কিছুটা সময় তাঁর খুব কাছেও ছিলাম। সেই সুবাদে কেমন করে যেন মানুষটাকে প্রচণ্ড ভালও বেসে ফেলেছিলাম। অনেকের মতো না বুঝে তখন আমিও জিয়াকে খলিফা ওমর (রা)-এর সাথে তুলনা করতাম। 

স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তীর অনেক মিথ্যা ইতিহাস ও কল্পগল্প আমার মাঝেও দানা বাঁধা ছিল। মানিক মিয়া এভিনিউর সেই বিশাল জনসমুদ্রে অনেকের সাথে সেদিন আমিও ষ্টেজে ছিলাম। বিউগলের করুণ সুর আর হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের কান্নার আওয়াজ আজও আমার কানে বাঁজে। যারা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল পরবর্তীতে তারাই একজন আনাড়ি আনকোরা শতভাগ গৃহবধূ বেগম জিয়াকে রাজনীতির পঙ্কিল ময়দানে নামিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে এদেশের রাজনীতিকে গুডবাই জানিয়ে সবসময় তা থেকে একশ গজ দূরে থাকতে চেষ্টা করেছি এবং সকল ধরনের রাজনীতিমুক্ত থেকেছি।
শুকরিয়া! আল্লাহ আমাকে অনেক ভাল রেখেছেন। 

স্বাধীনতার ঘোষণা, জিয়ার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, খালেদা জিয়া বা তারেক জিয়া প্রসঙ্গ উঠলেই প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আজকের বিএনপির রাজনৈতিক নেতাদের অনেক বড় বড় কথা বলতে শুনি, অতিরিক্ত তোষামোদ ও এক ধরনের হীন ভ্রষ্টাচার করতে দেখি; তখন আনমনে শুধু মুচকি হাসি এবং কল্পনা করি - জিয়া যদি আজ বেঁচে থাকতেন হয়তো এই সব নীতিহীন ভ্রষ্টাচার নেতানেত্রীদের মাথায় ফাইভ স্টার ঠেকিয়ে গুলি করতেন। 

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের কত মিথ্যা বিকৃত ইতিহাসই না সেইসময় আমরা জানতাম। মাওলানা ভাসানী ও অন্যান্য আরোও কিছু নেতা সম্বন্ধে কত কি বাড়াবাড়ি কথাই না শুনতাম। বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে অন্যদের গুরুত্ব দিয়ে কত মিথ্যা ইতিহাসই না আমাদের মাঝে প্রচার করা হতো, ভুল শিখানো হতো। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী না পড়লে হয়তো অনেক কিছু অজানা অপূর্ণই থেকে যেত; স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট ও প্রকৃত ইতিহাস এতোটা কোনদিনও জানতে বা বুঝতে পারতাম না। আমার মাঝে বদ্ধমূল থাকা অনেক মিথ্যা ইতিহাস ও ভুল ধারনার আজ পরিসমাপ্তি ঘটেছে। 

যত ধরনের মিথ্যা অপপ্রচার ও প্রোপাগাণ্ডা  আছে তার সবই একসময় রাষ্ট্রীয়ভাবে এদেশে প্রচার করা হতো, মুক্তিযোদ্ধারাও তখন খুব অসহায় ছিল। ৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ সময়টা এদেশটাকে যারা শাসন করেছে তাদের আসল রূপ-স্বরূপ কি ছিল তা আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার মত অনেকের কাছেই। ৪৭ পূর্ববর্তী সেই ষড়যন্ত্রকারী বেনিয়াগোষ্ঠি, বঙ্গবন্ধুর ভাষায় সেদিনের কোটারি করা লোকগুলোই বংশ পরম্পরায় বার বার ঘুরেফিরে এ অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত হয়েছিল, ছলে-বলে কৌশলে তারাই বার বার ক্ষমতায় এসেছে; যারা সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে শুধু নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। খুব অল্প কয়েকটা দিন বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনব্যবস্থা চালাতে পেড়েছিলেন।

একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলেই বুঝা যাবে সেই কয়কটা দিনের প্লানিংই আজ পর্যন্ত এখনো এদেশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তারপরও কমবেশি যতটুকো উন্নতি উন্নয়ন বাংলাদেশে হয়েছে, বর্তমান পাকিস্তানে কি তার কিয়দংশও হয়েছে? তবে কেন এতো পাকিস্তান প্রীতি? যদি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও বেঁচে থাকতেন তবে হয়তো পৃথিবীর সব দেশ সব জাতিকে অতিক্রম করে আজ আমরা উন্নত একটা দেশে রূপান্তরিত হতাম, অগ্রগামীদের দলে শরিক হতাম। তিনি এদেশটাকে এদেশের মানুষকে কতোটা ভালবাসতেন তা তাঁর লেখার প্রতিটি শব্দ প্রতিটি লাইন থেকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট প্রতীয়মান।
 
মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বাঙালি জাতির প্রকৃত স্বাধীনতার মূলমন্ত্র পাঠকারী, সৌহার্দের প্রতীক ও স্বাধীনতার স্থপতি সৃষ্টিকারী। তাঁকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে এই আত্মজীবনীতে তিনি বাঙালি জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। বইয়ের ৪৮ নং পৃষ্টায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন - "শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, নীচতা ছিল না, দল মত দেখতেন না, কোটারি করতে জানতেন না, গ্রুপ করারও চেষ্টা করতেন না। উপযুক্ত হলেই তাকে পছন্দ করতেন এবং বিশ্বাস করতেন। কারণ তাঁর আত্মবিশ্বাস  ছিল অসীম। তাঁর সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন। এজন্য তাঁকে বার বার অপমানিত ও পরাজয়বরণ করতে হয়েছে। উদারতা দরকার, কিন্তু নিচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগ্ণের ক্ষতি হয়।

আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল 'আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি।' পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, 'পরশ্রীকাতরতা'। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে 'পরশ্রীকাতর' বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ার খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।

অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।"

স্বাধীনতার এতোগুলো বছর পেরিয়ে গেল, একটা স্বাধীন দেশ আমরা পেলাম, স্বাধীন দেশে বসবাস করছি, অথচ আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন অগ্রগতি এখনো তেমন একটা আহামরি কিছু হয়নি; সামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধত্ব সেই আগের মতো একই রকম আছে। ধর্মকে আজও এক দল রাজনৈতিক ঢাল হিসেবেই সব সময় ব্যাবহার করছে। আজকের জাপান চিনের কথা চিন্তা করলে মনে হয় আমরা তাদের থেকে যোজন যোজন দূরে পিছিয়ে আছি। 

আমাদের দেশে কতোটুকো কি হয়েছে এই মুহুর্তে তা আমি বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না; প্রত্যেকে নিজে নিজের মতো মূল্যায়ন করে নিবেন। যতটুকো যা হয়েছে তাও অত্যন্ত ধীরগতিতে হয়েছে। মনে হয় যেন সেই ৪৭ পূর্ববর্তী বা ৫২ পূর্ববর্তী বা ৭১ পূর্ববর্তী সময়েই আমরা বার বার ফিরে গিয়েছিলাম, সেই সব শাসকরাই ঘুরেফিরে আমাদের দেশটাকে শাসন করেছিল। আশ্চর্য! আজও এদেশে ধর্মীয় উস্কানিতে দাঙ্গা হয়।

জীবনযাত্রার মানের কিছুটা পরিবর্তন ঘটলেও রাজনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন তেমন কিছুই ঘটেনি। রাজনীতিবিদদের মানসিকতার পরিবর্তন এতটুকোও হয়নি, বরং রাজনীতিবিদদের চারিত্রিক অবক্ষয় সর্বনিন্ম ও নিকৃষ্ট পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। চাটুকারিতা, মিথ্যাচার, শঠতা এখন রাজনৈতিক নেতানেত্রীর চারিত্রের অন্যতম ভূষণ। তখন আমরা যারা স্কুল কলেজে পড়তাম, বিশেষ করে তাদের কাছে স্বাধীনতা সম্বন্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন সব তথ্য ও অপপ্রচার করা হতো, যেন আমরা সবায় মনে করি - বঙ্গবন্ধু খুবই সাধারণ একজন। স্বাধীনতার স্থপতিকে সবায় যেন ভুল বুঝে এই অপচেষ্টাই তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হতো এবং নানানভাবে তখনকার প্রজন্মকে মিথ্যা বুঝানোর চেষ্টা চলতো। 

দীর্ঘদিন এমন অপপ্রচারের ফলে তখনকার প্রজন্মের অনেকের মাঝেই এমন সব প্রশ্নের অবতারণা হয়েছিল - হয়তো বঙ্গবন্ধু তাঁর সন্তানকে সত্যি সত্যি মানুষ করতে পারেননি, শাসন করেননি। শেখ কামাল সত্যি সত্যিই বুঝি মেজর ডালিমের স্ত্রীকে অপহরণ করেছিল বা বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতির সাথে জড়িত ছিল। আরো কত সব মিথ্যা অপপ্রচার চলত তার কোন ইয়ত্তা নেই।

যদিও যুদ্ধের সময়ের প্রজন্ম আমরা, কিন্তু বয়স ছিল কম। ৭৫-এর পর অনেকের মুখে এই সব মিথ্যা কথা আমরা শুনতাম। যেমন - আমাদের পাড়ার এক বড়ভাই একদিন তার এক বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল - এই সেই সাদেক যে শেখ কামালের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করেছে। আমরা অনেকে কথাটা শুনে তার মুখ থেকে সেই ঘটনা শোনার জন্য উৎগ্রীব হয়ে উঠলাম। যা শুনেছিলাম তা অনেকটা এই রকম - একটা জীপ নিয়ে তারা বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করে টাকা ছড়াতে ছড়াতে বাসাবো হয়ে মাদারটেক তালতলার দিকে চলে গিয়েছিল। 

কিছুদিন পর এমন আরেকজনকে সে নিয়ে আসল এবং বলল - সেও নাকি বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতির সাথে জড়িত। কিন্তু তার মুখ থেকে অন্য এক আজগুবি গল্প শুনেছিলাম। একটা গল্পের সাথে আরেকটা গল্পের কোন মিল ছিল না। এমনভাবে অনেক গল্প কল্পকাহিনী তখন বাতাসে ভেসে বেড়াত। যারা এসব কল্পকাহিনী তৈরি করত তারা বা তাদের সন্তানরা হয়তো ৭১-এ গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে বাড়ির পর বাড়ি ডাকাতি করত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কি কখনো তা করেছিলেন? খুব সাধারণ বিবেকও তো এসব বুঝবে? কোন ভদ্রলোকের সন্তান কোনদিনও ব্যাংক ডাকাতি করতে পারে না। তাছাড়া একজন জাতিরপিতার সন্তান, দেশের প্রেসিডেন্টের সুশিক্ষিত সন্তান, কি করে ব্যাংক ডাকাতি করতে পারে বা নিজের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও কি করে অন্যের স্ত্রীকে অপহরণ করতে পারে তা কতটুকো বিশ্বাসযোগ্য, কতটা গ্রহণযোগ্য? 

আমরা তখন গুলবাগ থাকতাম। আমাদের বাসার খুব কাছাকাছি মালিবাগ পাবনা কলোনীর ঠিক উত্তর পাশে চিকণ রাস্তার ওপারে মেজর ডালিমের একটা বাড়ি ছিল। ঐ বাড়ির আশেপাশে আমরা বন্ধুরা মিলে প্রায়ই আড্ডা দিতাম। পাবনা কলোনির সামনে ফাঁকা স্থানে কোট করে শীতে ব্যাডমিন্টনও খেলতাম। জনশ্রুতি ছিল ঐ বাড়ি থেকেই নাকি শেখ কামাল ডালিমের বউকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল; যা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। গুলবাগ আমাদের বাসা ও ডালিমের বাসার দূরত্ব ছিল খুবই কম; যদি সত্য হতো অবশ্যই আমরা জানতে পারতাম। আমরা কোনদিনও দেখিনি সেই বাসায় মেজর ডালিম বা তার স্ত্রী বসবাস করতে। 

একদিন এক পত্রিকায় পড়লাম, সেখানে লেখা - লেডিস ক্লাব থেকে শেখ কামাল মেজর ডালিমের বউকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এখনো অনেক সময় ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে এইসব মিথ্যাচার দেখে অনেকটা আঁতকে উঠি, চোখে পড়লেই প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করি। যতসব বানানো আজগুবি গল্প দীর্ঘদিন ধরে এদেশের মানুষের মাঝে অত্যন্ত কূটকৌশলে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, হচ্ছে। যারা এসব ছড়াত বা ছড়ায় তারা হয়তো সত্যের মহিমা জানে না? ব্রিটিশ আমল থেকেই এমন একটি অর্বাচীন গোষ্ঠীর উদয় হয়েছিল, যারা আজও আমাদের সমাজে আমাদের সাথে আমাদের মাঝেই মিশে আছে। ধর্মের দোহাই, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা প্রোপাগান্ডা যাদের মূল হাতিয়ার, সাময়িক স্বার্থ হাসিল যাদের মূল উদ্দেশ্য। তারা কোনদিনও এই দেশ এই জাতিকে ভালবাসেনি, ভালবসতে পারেনি আর পারবেও না।

অনেকদিন ধরে বিভিন্ন টিভি মিডিয়ায় অনেকের মুখে শুনে আসছি, বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া ভার্চুয়াল মিডিয়া জুড়েও এই সব অপপ্রচার বেশ জোরালো - শেখ মুজিব স্বাধীনতা চাননি, চেয়েছিলেন স্বায়ত্তশাসন। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে এদেশের অতি উৎসাহী একটি দলের একটি গ্রুপের অতি বাড়াবাড়ি প্রায়শই চোখে পরে। আমার ধারণা এইসব এক ধরনের রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি। যারা এই সব বলেন বা করেন, তাদের আমি সবিনয় অনুরোধ করবো বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্নজীবনী পড়তে, স্বাধীনতার গোড়াপত্তন ও প্রকৃত ইতিহাস জানতে। বাংলাদেশ শুধুমাত্র ১৯৭১-এর যুদ্ধের ফসল যারা ভাবেন বা শুধুমাত্র মেজর জিয়ার একটিমাত্র ঘোষণার ফসল যারা মনে করেন, আমার মনে হয় তারা এখনো বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন এবং তাদের বলছি - জিয়া যদি বেঁচে থাকতেন আমি নিশ্চিত আপনার মাথায় ফাইভ স্টার ঠেকিয়ে তিনি একটা গুলি করে আপনার পৈত্রিক খুলিটা উড়িয়ে দিতেন।

১৯৪২ বা তারও পূর্ব থেকে এই বাংলাদেশ সৃষ্টির স্বপ্নের সূচনা। আমি নিজে দেখেছি এবং নিজ কানে জিয়ার মুখ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রশংসার কথা শুনেছি; জিয়াকে দেখেছি - একান্তে বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, পটভূমি ও মতধারায় ভিন্নতা থাকলেও ব্যক্তি জিয়া মিথ্যাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও বঙ্গবন্ধুর খুন দেশবিদেশের একটা বিশাল ষড়যন্ত্রের ফসল। এসব বুঝার ক্ষমতা আমাদের মত ছোট চিন্তাশক্তির মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। 

আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিশেষ করে আশি নব্বই দশকের প্রজন্ম মিথ্যা ইতিহাস ও মিথ্যা প্রোপাগান্ডা শুনতে শুনতেই বড় হয়েছে। অনেকবার অনেকদিন এইসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লেখেছি কিছু প্রত্যক্ষ ও আবছা ধারণা থেকে, বিভিন্ন ইতিহাসভিত্তিক বইপুস্তক থেকে। কিন্তু যেদিন আমি জাতিরজনকের নিজ হাতে লেখা অসমাপ্ত আত্নজীবনী প্রথম পড়লাম সেইদিন থেকে আমার সব ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সংকোচ-সংশয় কেটে গেছে। এখন আর কোন ধরনের কোন দোয়াসা আমার মাঝে নেই, আমি দ্বিধাহীনভাবে এখন অনেক কিছুই বুঝতে পারি বলতে পারি, যা ১০০% সঠিক। 

এদেশ সৃষ্টির সব সত্য ইতিহাসই আজ আমার চোখের সামনে সূর্যের মত জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। কারো কাছ থেকে এখন আর কোন কিছু আমার ধার করার নেই জানার নেই। কারো কাছ থেকে কোন স্বার্থ আদায় করার ইচ্ছা বা চাওয়া পাওয়ার প্রত্যাশা আমার কোনদিনও ছিল না আজও নেই। প্রকৃত সত্যকে উন্মোচনের অভিপ্রায়ে লেখেছি লেখি লেখে যাবো। কাউকে কোনদিন ভয় বা তোয়াজ করে জীবনে কিছু করিনি আর করবও না। সত্য উন্মোচনে ব্রত ছিলাম আছি থাকবো ইনশাল্লাহ। 

বহুদিন ধরে ভাবছি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী নিয়ে দু'চার কথা লেখতে চেষ্টা করব, কিন্তু পর মুহুর্তেই নিজকে সংবরণ সংযত করেছি। এতোবড় মহান ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আমার মত একজন ক্ষুদ্র মানুষ কি করে কি করবো? আমার পক্ষে কতোটুকো কি-ই-বা করা বা লেখা সম্ভব বা আউদ তা সম্ভব হবে কি-না? পাঠক সমাজই-বা তা কেমনভাবে নেবে? - এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অনেকদিন পার করলাম, আর নয়; কেউ পড়ুক বা না পড়ুক আমার হৃদয় নিঃসৃত কথাগুলো লেখে যাচ্ছি, কেউ প্রকাশ করুক বা না করুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণের নেতা, বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কিছু কথা কিছু অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে ইচ্ছে করছে, করছি।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম যখন তা হাতে পাই তৎক্ষণাৎ অনেক উৎগ্রীবতা নিয়ে বইয়ের প্রতিটা পৃষ্টা প্রতিটা লাইন প্রতিটা শব্দ অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পড়েছি এবং আজও বার বার পড়ি; যতই পড়ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি, চমৎকৃত হচ্ছি।
কত সরলসরলভাবে সহজসরল ভাষায় তিনি এদেশের জন্মের আদি অন্ত পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তুলে ধরেছেন এবং সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিখ্যাত সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও কত চমৎকারভাবে তিনি বুঝতে পেরেছেন, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লেখায় অতি সহজ ভাবে তুলে ধরেছেন। কত সহজভাবে তিনি এদেশের সাধারণ মানুষ থেকে বিখ্যাত সব মানুষের আপন হয়েছেন এবং সবার সাথে মিশেছেন; জনগণকে কতটা বুঝতেন এবং আপন করে নিতেন, সবার কতটা কাছের মানুষ ছিলেন। এই বইটা না পড়লে হয়তো আলোছায়ার ঘূর্ণিপাক থেকে কোন দিনও আমি মুক্ত হতে পারতাম না। আমার মনে হয় - এই অসমাপ্ত আত্নজীবনীর খণ্ডিত অংশ ক্লাশ অনুযায়ী জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত; আওয়ামী লীগের সমালোচকদের এই বই অবশ্যই পড়া উচিত। আওয়ামী লীগের প্রতি নেতাকর্মীর এই বইটি বারংবার মনোযোগ দিয়ে পড়া উচিত এবং এদেশের রাজনীতিবিদদের জন্য এই বইটা হতে পারে অন্যতম দিকনির্দেশনা। 

যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অযথা অপ্রয়োজনে কটাক্ষ করেন তাদের বলবো - ইতিহাসের মূল না যেনে শুধুমাত্র আগা নিয়ে লাফালাফি করবেন না। ইতিহাস বিকৃতির কবলে পড়ে যারা বিভ্রান্ত হয়েছেন তাদের বলবো সত্য ইতিহাস জানার অভিপ্রায়ে এই বইটি পড়তে। যারা বঙ্গবন্ধুকে একেবারে দেখতে পারেন না, তারাও একটিবার বইটি পড়েন এবং অন্তর দিয়ে সত্য বুঝার ও জানার চেষ্টা করেন। আমি যখন প্রথম এই বইটি পড়তে শুরু করি তখন অযাচিতভাবে মনের অজান্তেই নিজের মধ্যে কেমন যেন একটা শিহরণ অনুভব করতে থাকি, খাওয়া দাওয়া ভুলে বিরামহীনভাবে পড়ে অসমাপ্ত এই পাণ্ডুলিপি সমাপ্ত করি। এই বয়সে এমন ইমোশনাল হয়ে বই নিয়ে বসে থাকব তা কল্পনারও অতীত। কি করবো?

বইয়ে প্রতিটি পাতায় যেন লুকিয়ে আছে আমার প্রিয় বাংলাদেশ এবং আমার বাংলাদেশের ইতিকথা। কিছু নিন্দুক বঙ্গবন্ধুর বংশ পরিচয় ও মর্যাদা নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ার বিভিন্ন বিভ্রান্ত আজও ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের জন্য একটি চপটেঘাত - বইয়ের ১২ নং পৃষ্টায় তিনি লিখেছেন- "আমার জন্ম হয় টুঙ্গিপাড়া শেখ বংশে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশের যে একদিন সুদিন ছিল তার প্রমাণস্বরূপ মোগল আমলের ছোট ছোট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলি আজও আমাদের বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করে আছে। বাড়ির চার ভিটায় চারটা দালান। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের একটা মাত্র দরজা, যা আমরাও ছোট সময় দেখেছি বিরাট একটা কাঠের কপাট দিয়ে বন্ধ করা যেত। একটা দালানে আমার এক দাদা থাকতেন। এক দালানে আমার এক মামা আজও কোনোমতে দিন কাটাচ্ছেন। আর একটা দালান ভেঙে পড়েছে, যেখানে বিষাক্ত সর্পকুল দয়া করে আশ্রয় নিয়েছে। এই সকল দালান চুনকাম করার ক্ষমতা আজ তাদের অনেকেরই নাই। এই বংশের অনেকেই এখন এ বাড়ির চারপাশে টিনের ঘরে বাস করেন। আমি এই টিনের ঘরের এক ঘরেই জন্মগ্রহণ করি।"

অতঃপর ১৮ নং পৃষ্ঠায় তিনি লেখেন- "আমার জন্ম হয় ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে। আমার আব্বার নাম শেখ লুৎফর রহমান। আমার ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদ একটা এম ই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের অঞ্চলের মধ্যে সেকালে এই একটা মাত্র ইংরেজি স্কুল ছিল, পরে এটা হাইস্কুল হয়, সেটি আজও আছে। আমি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে লেখাপড়া করে আমার আব্বার কাছে চলে যাই এবং চতুর্থ শ্রেণীতে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হই। আমার মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। তিনি কোনোদিন আমার আব্বার সাথে শহরে থাকতেন না। তিনি সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন আর বলতেন, "আমার বাবা আমাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন যাতে তাঁর বাড়িতে আমি থাকি। শহরে চলে গেলে ঘরে আলো জ্বলবে না, বাবা অভিশাপ দেবে।"

এই আত্নজীবনীর লেখাগুলো ব্রিটিশ থেকে পাক-ভারত বিভক্তির ইতিহাস অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে, ভাষা আন্দোলন ও তৎপরবর্তী পাকিস্তান আমলের পাকিস্তানিদের বাংলা শাসনের গভীর ষড়যন্ত্র - শাসন শোষণের নমুনাচিত্র সবই প্রকাশিত হয়েছে। 

১৯৪১ সালে বঙ্গবন্ধু মেট্রিক পরীক্ষা দেন, সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেই থেকে তিনি অখণ্ড ভারতের নিঃস্বার্থ মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সান্নিধ্য লাভ করতে সামর্থ্য হন এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সান্নিধ্যে অল্প বয়সে আল্প সময়েই ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং সুষ্ঠ রাজনীতির খুঁটিনাটি আয়ত্ত করতে সক্ষম হন। সেই থেকে ওতপ্রোতভাবে তিনি মিশে থাকেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে এবং সোহরাওয়ার্দীর আদর্শ বুকে ধারণ করে কলেজ জীবনের শুরু থেকেই তিনি এই বড় মাপের নেতার সান্নিধ্য ও বিশ্বস্ততা অর্জন করে নিতে সক্ষম হন।

বইয়ের ২৯ নং পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- "তিনি যে সত্যি আমাকে ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিন পর্যন্ত। যখনই তাঁর কথা এই কারাগারে বসে ভাবি, সেকথা আজও মনে পড়ে। দীর্ঘ বিশ বৎসর পরেও একটুও এদিক ওদিক হয় নাই। সেইদিন থেকে আমার জীবনের প্রত্যেকটা দিনই তাঁর স্নেহ পেয়েছি। এই দীর্ঘদিন আমাকে তাঁর কাছ থেকে কেউই ছিনিয়ে নিতে পারে নাই এবং তাঁর স্নেহ থেকে কেউই আমাকে বঞ্চিত করতে পারে নাই।"

এতো বড় মাপের একজন মানুষের সান্নিধ্যে থেকে যিনি রাজনীতি ও মানবসেবা শিখেছেন, নিশ্চয় তিনি কোন সাধারণ মানুষ নন? তাছাড়াও শেরেবাংলা একে ফজলুল হক সাহেবও তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, এমনকি নাতি বলে সম্বোধন করতেন। বঙ্গবন্ধু যখনই তাঁর স্মরণাপন্ন হতেন তিনি সাড়া দিতেন। 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' ঘটনের প্রথম মিটিংয়েও শেরেবাংলা উপস্থিত ছিলেন। 

মাওলানা আব্দুল হামীদ খাঁন ভাসানী ছিলেন 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু জয়েন সেক্রেটারি; এটি একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কিছুদিন পরই যা 'আওয়ামী লীগ'-এ রুপান্তরিত হয় এবং ভাসানী সভাপতি, বঙ্গবন্ধু সাধারণ সম্পাদক হন। মাওলানা আব্দুল হামীদ খাঁন ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক সহপাঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; যিনি কিনা দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর কারাসাথিও ছিলেন।

শুধুমাত্র এদেশ ও এদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তির চিন্তায় যে মানুষটা মা-বাবা, স্ত্রী সন্তান ও আত্নিয়স্বজন আপনজন সবাইকে ফেলে রেখে জীবনের বেশিরভাগ সময় জেলের অভ্যন্তরে আলোবাতাসহীন ঘরে অন্তরীণ থাকতেন, নিশ্চয় তিনি কোন অর্থলোভে বা ক্ষমতালোভে এসব করেননি? এই মহা মানবের জন্ম না হলে হয়তো বাঙালির মুক্তি কোনদিনও মিলত না।

মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে ১২৮ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন- "মাওলানা ভাসানীর উদারতার অভাব, তবু তাঁকে আমি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। কারণ, তিনি জনগণের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত। যে কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারে নাই - এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এদেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং ত্যাগ আমাদের করতে হবে পাকিস্থানের জনগণকে সুখী করতে হলে।"

১২৫ পৃষ্ঠার তিনি একটি মজার ঘটনা তুলে ধরেন। সিরিয়াস কথার ফাঁকে হটাৎ এই অংশ পড়ে আমার খুব ভাল লেগেছে তাই আপনাদের জন্য তা তুলে ধরলাম। কত সহজসরল ও বড় মনের মানুষ হলে অকপটে একজনের পক্ষে এমন সব কথা তুলে ধরা সম্ভব - তাই ভাবছি। অবশ্য এই বইয়ের অনেক জায়গায়ই তিনি রসিকতার মাধ্যমে তাঁর মনের এমন বিশালতার পরিচয় দিয়ে গেছেন।

"আমি ও আলতাফ হোসেন সাহেব ঠিক করলাম, মাওলানা শামসুল হক সাহেবের (যিনি এখন লালবাগ মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল) সাথে দেখা করব। মাওলানা সাহেবের বাড়ি আমার ইউনিয়নে। জনসাধারণ তাঁকে আলেম হিসেবে খুবই শ্রদ্ধা করত। আমরা দুইজন রাত দশটায় একটা এক মাঝির নৌকায় রওয়ানা করলাম। নৌকা ছোট, একজন মাঝি। মধুমতী দিয়ে রওয়ানা করলাম। কারণ, তাঁর বাড়ি মধুমতীর পাড়ে। মধুমতীর একদিকে ফরিদপুর, অন্যদিকে যশোর ও খুলনা জেলা। নদীটা এক জায়গায় খুব চওড়া। মাঝে মাঝে, সেই জায়গায় ডাকাতি হয়, আমাদের জানা ছিল। ঠিক যখন আমাদের নৌকা সেই জায়গায় এসে হাজির হয়েছিল আমি তখন ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পানির দেশের মানুষ নৌকায় ঘুমাতে কোন কষ্ট হয় না। কাজী সাহেব তখনও ঘুমান নাই। এই সময় একটা ছিপ নৌকা আমাদের নৌকার কাছে এসে হাজির হল। চারজন লোক নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করল, আগুন আছে কি না? আগুন চেয়েই এই ডাকাতরা নৌকার কাছে আসে, এই তাদের প্রন্থা। আমাদের নৌকার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, "নৌকা যাবে কোথায়?" মাঝি বলল, টুঙ্গিপাড়া, আমার গ্রামের নাম। নৌকায় কে? মাঝি আমার নাম বলল। ডাকাতরা মাঝিকে বৈঠা দিয়ে ভীষণভাবে একটা আঘাত করে বলল, "শালা আগে বলতে পার নাই শেখ সাহেব নৌকায়।" এই কথা বলে নৌকা ছেড়ে দিয়ে তারা চলে গেল। মাঝি মার খেয়ে চিৎকার করে নৌকার হাল ছেড়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। মাঝির চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কাজী সাহেব জেগে ছিলেন, তার ঘড়ি টাকা আংটি সব কিছু লুকিয়ে ফেলেছিলেন ভয়ে। কাজী সাহেব সৌখিন লোক ছিলেন, ব্যবসায়ী মানুষ, টাকা পয়সাও ছিল অনেক। আমি জেগে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি? কাজী সাহেব ও মাঝি আমাকে এই গল্প বলল। কাজী সাহেব বললেন, "ডাকাতরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে, আপনার নাম করেই বেঁচে গেলাম, না হলে উপায় ছিল না।" আমি বললাম, "বোধহয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের একজন বলে ধরে নিয়েছে।"

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে, পাক-ভারত স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭ সালে। তাঁর জীবনের প্রথম বিদেশ সফর ছিল চিনের এক শান্তি সম্মেলনে। জীবনের প্রথম বিরোধী দলের একজন সদস্য হয়ে তিনি সেই সফর করেন। এই বইয়ের ২৪৪ পৃষ্ঠায় তিনি তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন - "আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চিনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউ নয়। ফলে দেশের জনগণের মধ্যে ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। একটা মাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল সাদা চামড়ার জায়গায় কালা চামড়ার আমদানি হয়েছে।" 

দুই পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ মূল্যায়নে ২৫০ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেন- "পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাট প্রভেদ রয়েছে। সেখানে রাজনীতি করে সময় নষ্ট করার জন্য জমিদার, জায়গিরদার ও বড় বড় ব্যবসায়ী। আর পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত না থাকার জন্য জনগণ রাজনীতি সম্বন্ধে বা দেশ সম্বন্ধে কোন চিন্তাও করে না। জমিদার বা জায়গিরদার অথবা তাদের পীব সাহেবরা যা বলেন, সাধারণ মানুষ তাই বিশ্বাস করে। বহুকাল থেকে বাংলাদেশে কৃষক আন্দোলন হওয়াতে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের চেয়ে অনেক বেশি। এছাড়াও স্বাধীনতা আন্দোলনেও বাঙালিরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে।"

৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৫৬-র নির্বাচন, নির্বাচনে জিতে স্বল্পকালীন সরকারের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ এবং তারই পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিকতায় ৭১-এ আমাদের স্বাধীনতা। সকল রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতিটিতেই বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল অগ্রণী। বাংলাদেশ সৃষ্টিরই ইতিহাস যেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিচ্ছবি। অসমাপ্ত এই আত্মজীবনী যদি সমাপ্ত হতো পূর্ণতা পেতো, হয়তো বাঙালি জাতির ভাগ্যই বদলে যেতো; কিন্তু হায়েনা বেনিয়া গোষ্ঠী দেয়নি এই জীবনীর স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি হতে।

বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। বাংলাদেশ সৃষ্টির অদ্বিতীয় মহানায়ক বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালির মুক্তির পথপ্রদর্শক। অতএব, বাংলাদেশের যে নাগরিক তাঁকে বাঙালির জাতিরপিতা হিসেবে স্বীকৃতি না দেবে আমি নিশ্চিত বলতে পারি - সে বাঙালি নয় পাকিস্তানি। আমার ধারনা - তার কোন অধিকারই নেই এদেশের আলো বাতাস গ্রহণ করার।। 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
০৮-০১-২০১৬.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন