প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ডিজিটাল যুগে এসে নিঃসন্দেহে অবারিতভাবে আমরা আমাদের নিজেদের স্বাধীন মত প্রকাশ করার অনেক সহজ সুযোগ পেয়েছি; যা হওয়া উচিত ছিল ইসলাম প্রচারে একটি অতিব উত্তম মাধ্যম। কিন্তু তা না করে, না জেনে না বুঝে অনেকেই আমরা ধর্মের মত বলে নির্দ্বিধায় নিজের মতকে ইসলাম-এর উপর চাপিয়ে দিচ্ছি এবং নানাবিধ ধারণা ও মত প্রকাশ করে যে যার মতো করে তা প্রচার করছি। কেউ যদি ধর্ম নিয়ে কিছু বলেন বা বলতে চান, লিখেন বা লিখতে চান, আমার মনে হয় সেই ব্যক্তিটিকে অবশ্যই আগে তা বলা বা লিখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে, নয়তো সমস্যা।
এরই মধ্যে এদেশের মুসলমানদের মাঝে অনবরত অদ্ভুত ও উদ্ভট একটি ঘটনা ঘটেই চলছে - প্রায় প্রত্যেকেই ইসলাম সম্পর্কে ব্যক্তিগত যে ধারনা তা-ই ফেইজবুকসহ বিভিন্ন ব্লক বা অনলাইন মিডিয়ায় উগলে দিচ্ছেন এবং দিয়েছেন; এসব নিয়েই বর্তমানে এদেশের বেশিরভাগ মুসলিম তর্কবিতর্কে মেতে আছেন। এমনকি, মতের মিল না হলে বড় বড় সব বুজুর্গানে দ্বীন-কেও তারা বিশ্রি ভাষায় খিস্তি-খেউড় করছেন। ধর্ম কিসের জন্যে? নিশ্চয় শান্তির জন্যে, ঐক্যের জন্যে; আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা-কে রাজি খুশি করার জন্যে, সর্বপরি ইহ ও পরকালীন মুক্তির জন্যে। তা-ই যদি হয়ে থেকে থাকে, তবে এসব হচ্ছে কেন?
ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দেয়া আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার পক্ষের একটি খাস নিয়ামত। ব্যক্তিগত ভাবে কেউ যদি আমার ভুল ধরিয়ে দেন, আমি মনে করি তা আমার উপর রহমত; যিনি তা করেছেন তিনি আমাকে আশির্বাদ করেছেন। কিন্তু আজকাল অন্যের ভুলভ্রান্তি ধরার কথা বাদই দিলাম কিছু বলতে গেলেও দেখা যায় অনেকেই অনেক সময় বেশ ক্ষেপে গিয়ে তীর্যক কটাক্ষ করে বসেন। অনেকে আবার কথায় কথায় কোর'আন ও হাদিস টানার তালে বা প্রতিটি লেখার দলিল বা রেফারেন্স খোঁজেন। সুরা কামার-এর ১৭ নং আয়াত - وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ অর্থাৎ - 'আমি কোর'আনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্যে; অতএব, কোন চিন্তাশীল আছে কি?' - (সূরা কামারা - ৫৪:১৭) -এর উদ্বৃতি দিয়ে কত জন কত সময় কত কি যে বলেন, তার কোন ইয়ত্তা নেই। তাদের বেশিরভাগেরই যুক্তি হলো - আল্লাহ যেখানে বলেছেন কোর'আন সহজ করে নাজিল করেছেন, তবে এটা বুঝতে কঠিন কি আছে? তারা হয়তো একবারের জন্যও ভাবেন না, উক্ত আয়াতের পরের অংশের 'চিন্তাশীল' শব্দটির কথা।
চিন্তাশীল ব্যক্তিই হলেন জ্ঞানী। জ্ঞান আসলে কি? এক কথায় জ্ঞান হলো পরিচিত থাকা, কোন কিছু সম্পর্কে বা কারো বিষয়ে জানা বা বুঝা; হতে পারে তা কোন কিছুর প্রকৃত অবস্থা, তথ্য, বিবরণ, বা গুনাবালী সম্পর্কে, যা অর্জিত হয় উপলব্ধির মাধ্যমে, অনুসন্ধানের মাধ্যমে বা শিক্ষা গ্রহণের ফলে অভিজ্ঞ হওয়ায় বা পড়াশুনা করার মাধ্যমে। ইংরেজীতে Knowledge, বাংলায় যা জ্ঞান; Knowledge-এর সংজ্ঞা দেয়া যায় এ'ভাবে - Knowledge is a familiarity, awareness, or understanding of someone or something, such as facts, information, descriptions, or skills, which is acquired through experience or education by perceiving, discovering, or learning. Knowledge can refer to a theoretical or practical understanding of a subject.
ভাষাগত সংজ্ঞা যা-ই হউক না কেন, তা অর্জন করতে গেলে অবশ্যই প্রয়োজন পরে শিক্ষার; হতে পারে তা প্রকৃতি থেকে, বা কোন প্রাতিষ্ঠান থেকে। এই পৃথিবীতে অদ্যবধি এমন কোন মানুষ পাওয়া যায়নি যিনি কিনা একই সাথে সর্বজ্ঞানে জ্ঞানী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানেই প্রতিটি মানুষ বিশেষ জ্ঞানী হয়ে থাকেন; যিনি যে বিষয় নিয়ে চর্চা করেন তার জ্ঞান সে বিষয়ের উপর ততো বেশি হয়ে থাকে। একজন এমবিবিএস ডাক্তারকে যদি পাওয়ার স্টেশন নির্মানের কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়, কেমন হবে?
তবে আমাদের দেশে অনেকেই জীব বিজ্ঞানে মাস্টার্স করে জজসাব হন, বাংলা সাহিত্যে লেখাপড়া করে ইংরেজী বিভাগের প্রধান হন, বিজ্ঞানে লেখাপড়ে শেষ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি হন। তাই হয়তো এদেশে এখন বেশিরভাগ মুসলমানই মনে করেন ইসলাম জানতে এবং বুঝতে এখন আর বিশেষ কোন শিক্ষার প্রয়োজন নেই, কারো কাছে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই! কোর'আন ও হাদিস বাংলায় অনূদিত হয়েছে; গুগোল সার্চ দিলেই অনলাইনে থাকা সেসব ধর্মীয় জ্ঞান ছোট স্কিনে চোখের সামনে এসে হাজির হয়ে যায়, সেগুলো দেখলে জানলেই হয়। অতএব, সমস্যা কি? ইহ ও পরকাল তো ফকফকা! তাই হয়তো সবাই একেকজন এখন কোর'আন ও হাদিস বিশেষজ্ঞ সেজে সোজা সরাসরি অন্যকে বলে বসেন - দলিল দে!
মাসরুক বর্ণিত একটি হাদিস - আমরা আব্দুল্লাহ বিন আমর এর নিকট গমন করতাম ও কথাবার্তা বলতাম। একদা ইবনে নুমাইর তার নিকট আব্দুল্লাহ বিন মাসুদের নাম উল্লেখ করলো। তখন তিনি (আমর) বললেন - তোমরা এমন একজন ব্যক্তির নাম বললে যাকে আমি অন্য যে কোন মানুষের চেয়ে বেশী ভালবাসি। আমি আল্লাহর রাসুল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি - চারজন ব্যাক্তির কাছ থেকে কোর'আন শিক্ষা করো; অত:পর তিনি ইবনে উম আবদ (আব্দুল্লাহ মাসুদ)-এর নাম থেকে শুরু করে মুয়াদ বিন জাবাল, উবাই বিন কাব ও শেষে আবু হুদায়ফিয়ার নাম উল্লেখ করলেন। - (সহিহ মুসলিম- ৩১ : ৬০২৪)
সহিহুল বুখারীতে হাদিসটি এভাবে এসেছে- মাসরুক বর্ণিত - আমি রাসুল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি- চারজন ব্যক্তির কাছ থেকে কোর'আন শিক্ষা করো, তারা হলো - আব্দুল্লা বিন মাসুদ, সালিম, মুয়াদ ও উবাই ইবনে কাব। - (সহি বুখারি, ভলিউম-৬, বই -৬১, হাদিস-৫২১) এখন আর এ কথাটি বলতে অবশ্যই কোন দ্বিধা নেই, স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-ই সেই সময়ও বিশেষজ্ঞ দেখিয়ে দিয়েছেন। অতএব, সারে চৌদ্দশ বছর পর এসে আমরা নিজেরাই অনলাইন ঘেটে যদি একা একাই সর্বজ্ঞানে জ্ঞানী সেজে যাই, তবে কেমনে কি?
আমার ধারণা, কোর'আনের আয়াত বিচ্ছিন্ন ভাবে পড়লে আয়াতের সঠিক অর্থ বুঝা খুবই কঠিন। আয়াতের অর্থ বুঝতে গেলে অবশ্যই আগে পিছের আয়াতগুলো ভালভাবে পড়তে হবে জানতে হবে। আয়াতের পটভূমিকা বা শানে নুযুল জানাও অত্যন্ত জরুরী; অর্থাৎ কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে কোন আয়াত নাজিল হয়েছিল তা জানতে হবে। তা না হলে আয়াতের সঠিক অর্থ বুঝা কঠিন বা মোটেও বুঝা যাবে না। এবং পুরোপুরি সঠিক অর্থ জানতে হলে অবশ্যই আরবী ভাষা জ্ঞানও থাকতে হবে, অর্থাৎ আরবী বুঝে কোর'আন পড়তে হবে। তাছাড়া কোর'আন ও হাদিস-এর একটি ধারাবাহিকতা আছে; এর সার্বিক ইতিহাস ও ঘটনাপ্রবাহও ভালভাবে জানতে হবে। জীবনের সাধারণ বিষয়ে যদি শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার জন্য দক্ষ একজন শিক্ষক বা ওস্তাদের প্রয়োজন থেকে থাকে, তবে ধর্ম কর্ম শিক্ষা এমনি এমনিই হয়ে যাবে যারা ভাবেন, তাদের ভাবনাটি আমি বলবো সঠিক নয়, পুরোপুরি ভুল। তাই, সঠিক পথ অন্বেষণ করতে হবে, ওস্তাদের কাছে যেতে হবে। সঠিকতা যাচাই করে তা-ও নিজেকেই বুঝে নিতে হবে এবং তা করতে হবে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে।
হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত - আমি হাসিম বিন হাকিম-কে রসুলুল্লাহ (সাঃ)-র জীবনকালেই সুরা ফুরকান তেলাওয়াত করতে দেখলাম এবং লক্ষ্য করলাম ভিন্ন পদ্ধতিতে সে তা তেলাওয়াত করছে, যা রাসুল (সাঃ) আমাকে শিক্ষা দেন নি। আমি তার উপর ঝাপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করলাম। অতঃপর আমি তার ঘাড় ধরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম - কে তোমাকে এই সূরা শিখিয়েছে, যা এই মাত্র আমি তোমাকে তেলওয়াত করতে শুনলাম? সে উত্তর দিল - আল্লাহর রাসুল (সাঃ) আমাকে এটা শিখিয়েছেন। আমি তাকে বললাম - তুমি মিথ্যা কথা বলছো; কারণ রাসুল (সাঃ) আমাকে তোমার থেকে ভিন্ন পন্থায় এটা শিখিয়েছেন।
সুতরাং আমি তাকে টানতে টানতে রাসুল (সাঃ)-এর কাছে নিয়ে গেলাম এবং বললাম - এই লোক সুরা ফুরকান এমনভাবে তেলাওয়াত করেছে যা আপনি আমাকে শিক্ষা দেননি। তখন রাসুল (সাঃ) বললেন - তাকে মুক্ত করো হে হিসাম, তুমি আবার তেলাওয়াত করো। সে তেলাওয়াত করলো সেভাবেই যা আমি শুনেছিলাম। তখন আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বললেন - এটা এভাবেই নাজিল হয়েছিল এবং বললেন - ওমর, তুমিও তেলাওয়াত করো। আমি সেটা তেলাওয়াত করলাম যেভাবে রাসুল (সাঃ) আমাকে শিখিয়েছিলেন। তিনি বললেন - এটা এভাবেই নাজিল হয়েছিল। কোর'আন সাতটি ভীন্ন উচ্চারণে নাজিল হয়েছিল , সুতরাং তোমরা যেভাবেই পারো, সেভাবে তেলাওয়াত করো। - (সহিহুল বুখারি, ভলিউম- ৬, বুক - ৬১, হাদিস- ৫১৪)
পবিত্র কোর'আন ও হাদিস আজ আমরা যেভাবে সহজে পাচ্ছি, আগের দিনে তা হাতের কাছে পাওয়া অত সহজ ছিল না। বর্ণনা ও ব্যাখ্যারও সঠিকতা, নির্ভরতা এবং একটি ধারাবাহিকতা আছে; সঠিকটা আমাদের নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে - মত ও পথের ভিন্নতা থাকলেও ইসলাম এক ও অভিন্ন। ইসলামের বৃহৎ স্বার্থে ব্যক্তিগত ইগো ও ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দুনিয়ার প্রত্যেক মুসলিম এক কাতারে দাঁড়ানোটা এখন খুবই জরুরি। সে ভুল আমি সঠিক, এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে।।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৭ ডিসেম্বর, ২০১৭.
অসাধারণ,অতুলনীয়,আপনাকে ধন্যবাদ👍✌🤗
উত্তরমুছুনঅসংখ্য মোবারকবাদ!
মুছুন