সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০২০

কেমন হবে আগামীর শিক্ষা?

করোনা ভাইরাস আবির্ভাবের প্রথম দিকে বিশ্বের অনেক বিশেষজ্ঞই নানান ধরনের ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, এই মূহুর্তে যাকে মনে পড়ছে তিনি হলেন  হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েল লিওং; গত ফেব্রুয়ারীর দিকে  তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। তাঁর সেই আশঙ্কা যে নেহায়েতই অমূলক তা কিন্ত নয়; এখনো পর্যন্ত তা পুরোপুরি সত্য না হলেও একটি নিশ্চিত ঘটনা অলরেডি ঘটে গেছে— সারা বিশ্বের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মানুষ, অর্থাৎ প্রায় ৪৬০ কোটি মানুষ একই সময়ে ঘরে বন্দী জীবনযাপন করেছেন এবং করছেন। বলতে গেলে পুরোপুরি কর্মহীন অবস্থায় শুধু শুয়ে বসে সময় পার করেছেন সারা বিশ্বের মানুষ। উৎকন্ঠা নিয়ে চুপচাপ এক জায়গায় বন্দী জীবন কাটানো সে যে কতটা কঠিন একটি বিষয় এমন পরিস্থিতিতে না পড়লে হয়তো আমরাও কোনদিন তা বিশ্বাস করতে পারতাম না, অনুধাবন তো দূরের কথা। এমন অসহনীয় উৎকণ্ঠিত একাকী জীবনের কথা কি কখনও কেউ আগে থেকে চিন্তা করতে পেরেছেন, না কি ভাবা যায়? 

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে করোনা ভাইরাস আবারও ফিরে এসেছে বা আসছে, অনেক দেশের মানুষ পুনরায় বন্দীত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। ঘরে বন্দী জীবন কাটাবেন বা কাটাচ্ছেন এবং সাথে থাকছে অনাকাঙ্ক্ষিত উৎকন্ঠা— না জানি আমি কখন এই মরণ ভাইরাসে আক্রান্ত হই? মানবসভ্যতার ইতিহাসে এত বেশি সংখ্যক মানুষ একই সাথে একই সময়ে একটানা এতো দীর্ঘক্ষণ ঘরে বন্দী থেকেছেন বা এমন করে লকডাউন করেছেন নিজে নিজেকে বা কোথাও বন্দী  হয়ে বসে থেকেছেন এমনতর নজির পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমার জানা নেই। এক অদৃশ্য অতি ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে মানুষ নামক অনন্য অসাধারণ গর্বিত প্রাণীটি এতো অসহায় হয়ে পড়লো, যার আক্রমণে তছনছ হয়ে গেল গোটা বিশ্ব; ভেঙে পড়লো একবিংশ শতাব্দীর সর্বোত্তম নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সকল  বিশ্বব্যবস্থা! এসব কি ভাবা যায়?

এই অবস্থা থেকে বিশ্ববাসী আর কখনো কোনদিনও পুরোপুরি মুক্তি পাবেন কিনা বা বিশ্ববাসী আর কখনও মোটেও আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবেন কিনা তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে; হয়তো পরবর্তী পৃথিবী হবে করোনাময় অথবা  করোনা সম্পৃক্ত পৃথিবী! আসলে কি করোনার থাবা থেকে আমাদের কখনও  মুক্তি মিলবে? তা নিশ্চিত কেউ জানি না, তার কোন সুস্পষ্ট ধারণাও এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের দিতে পারছেন না। কিন্তু পরবর্তী বিশ্ব সম্পর্কে অনেকে অনেক রকম কথাই বলেছেন বলছেন, এবং বিশেষজ্ঞরা যার যার মতো করে তাদের মতও প্রকাশ করছেন। সব কিছুতে দ্বিমত থাকলেও একটি বিষয়ে কিন্তু প্রায় সকলেই একমত— পৃথিবী আর আগের মতো নেই, থাকবে না; আর কখনো আগের মতো হবেও না। বিগত কয়েক মাস ধরে যা ঘটেছে ঘটছে তার প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী হবে এই ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই, প্রত্যেকেই অনেকটা নিশ্চিত। এই মহামারী শুরুর পর থেকে একে একে বদলে গেছে পুরো বিশ্বপ্রকৃতি এবং সাথে সাথে  পাল্টে গেছে বিশ্বপরিস্থিতিও। আমাদের কামকাজ, আমাদের  প্রাত্যহিক জীবনযাপন, ভ্রমন-বিনোদন থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য সমেত অর্থনীতি-রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতি-সমাজনীতিসহ সব সবকিছু বদলে গেছে।

দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর শতকোটি মানুষ ঘরে বন্দী, সেই সুযোগে প্রকৃতি তার আসল রূপ পেয়েছে, আপন রূপে ফিরে গেছে। পৃথিবীর সব বড় বড় শহর-নগর-বন্দরগুলোকে মনে হয়েছে হচ্ছে ওসব যেন প্রাণহীন মৃত্যুপুরী; দিনের বেলায়ও রাস্তা-ঘাট থাকছে জনমানবশূন্য। বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বন্ধ থেকেছে দোকানপাট-বার-রেস্টুরেন্ট-শপিংমল, বন্ধ হয়ে গেছে খেলাধূলা, এমন কি বাতিল হয়ে গেছে অলিম্পিক গেমসও। বিশ্বের অনেক দেশে জেলখানা থেকে বন্দীদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে, বাড়ি গিয়ে তাদেরকে চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে বলা হয়েছে। ছোট-বড় ধনী-দরিদ্র বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের যার যার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিমান চলাচলও। সকল প্রকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড— আভ্যন্তরীণ কিম্বা বৈশ্বিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে; শেয়ার বাজারে  ধস নেমেছে। সর্বোপরি  বেকার হয়ে পড়েছে বিশ্বের কোটি কোটি কর্মজীবী কর্মোদ্যোগী  মানুষ। এক অদৃশ্য শত্রুর আতংকে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আজ ভীত-সন্ত্রস্ত! 

কি ঘটতে যাচ্ছে এবং কেমন হতে যাচ্ছে করোনামুক্ত পরবর্তী পৃথিবী? আদৌও পৃথিবী করোনামুক্ত হবে কি? এ'সবের সার্বিক আলোচনায় আপাততঃ  যাচ্ছি না, আজ শুধুমাত্র শিক্ষার্থী তথা ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষতির দিক নিয়ে কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আমার বিবেচনায় সারা বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং নাজুক অবস্থায় পড়ে আছে শিক্ষার্থীরা। শিশুদের কল্যাণে কাজ করা 'সেইভ দ্য চিলড্রেন' থেকে বলা হয়েছে— বিশ্ব মহামারীর এই কঠিন পরিস্থিতিতে শিক্ষার সুযোগ হারাবে প্রায় এক কোটি শিশু। তারা আরও বলেছে— বাল্যবিবাহ, শিশু শ্রম, শিশু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। এই সংস্থা আরও বলেছে— করোনা পরবর্তীতেও আর কোন দিন হয়তো স্কুলেই যাওয়া হবে না এক কোটি শিশুর। সেভ দ্যা চিলড্রেন-এর এক আলোচনায় উঠে এসেছে এমনতর সব ভয়ঙ্কর তথ্য। ইউনেস্কোর তথ্যের উপর ভিত্তি করে আরও জানা গেছে যে, গত এপ্রিল থেকে ১.৬ বিলিয়ন তরুণ-তরুণী স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে দিয়ে বসে আছে, অলস সময় কাটাচ্ছে; যা বিশ্বের পুরো শিক্ষার্থীর সংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ।

উক্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মানব ইতিহাসে এই প্রথমবার এমন চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে বিশ্বের শিক্ষা ক্ষেত্রে। চরম এই সংকট থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে ইতিমধ্যে গোটা বিশ্বপরিস্থিতি পর্যালোচনা করা শুরু হয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, পারিবারিক আর্থিক সংকট কাটাতে আগামীতে তরুণ তরুণীরা রোজগারের চেষ্টা করা শুরু করবে। অভাব অভিযোগ ও পারিবারিক দায় মুক্ত হতে বা দায় মুক্ত করতে অধিকাংশ মেয়েকেই খুব অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে পরিবারের পক্ষ থেকেই। এসবের  ফলশ্রুতিতে ৯.৭ মিলিয়ন শিশু স্থায়ীভাবে স্কুল ছাড়বে। ইউনেস্কো ইতিমধ্যেই সতর্ক করে বলেছে করোনা পরবর্তী বিশ্বে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলি ২০২১ সাল থেকেই কাটছাঁট করবে শিক্ষা বাজেটে। আর এতে করে গোটা বিশ্বের শিক্ষা বাজেটে প্রায় ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘাটতি দেখা দেবে। 

শিশুদের স্কুলে ফেরাতে বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকারেরই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। আর তা যদি না করা হয় তাহলে আগামী দিনে ধনী এবং দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের মধ্যে প্রবলভাবে প্রকোট হয়ে উঠবে অসাম্য। তাই ইউনেস্কোর দাবী করোনা পরবর্তী বিশ্বে কোটি কোটি শিশুর স্কুল ছুট বন্ধ করতে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। পাশাপাশি বিশ্ব জুড়ে একটি তহবিল গঠনের ডাক দিয়েছে এই সংস্থা। সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, করোনাপরবর্তী বিশ্বে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র ও প্রান্তিক শিশুরা; আর যারা দূরশিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষম তাদের সমস্যা আরো বেশি বাড়বে। সমস্যা কাটাতে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে শিক্ষা ঋণ পরিশোধে কিছু ছাড় দেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে। সংস্থার পক্ষ থেকে আশঙ্কা করা হয়েছে, এই সংকট যদি প্রথমে মোকাবিলা করা না হয় বা না যায় তাহলে আগামী দিনে সমস্যা আরও বাড়বে, এমনকি প্রকট রূপ ধারণ করবে।

সংস্থার পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্যই হলো ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সমস্ত শিশুকে ন্যূনতম শিক্ষা পরিসেবার আওতাভুক্ত করা বা আওতায় আনা। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করায় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রই তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তাই এখন থেকে বিশ্বের সকল দেশগুলোর কাছে এসব নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে ইউনেস্কো। সংস্থার তৈরি তালিকায় যেসব দেশে সবথেকে বেশি প্রভাব পড়তে পারে এমন দেশগুলো হচ্ছে— নাইজেরিয়া, মালি, চাদে, লাইবেরিয়া, আফগানিস্তান, গিনি, মরিশানিয়া, ইয়েমেন, নাইজার, পাকিস্তান, সেনেগাল আর আইভোরিকোস্ট। ইতিমধ্যেই ২৫৮ মিলিয়ন শিশু ও কিশোর-কিশোরী স্কুল ছেড়ে দিয়েছে বলে তাদের প্রথমিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে। 

আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের কি অবস্থা? এমনতর দুর্যোগের পর সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং নির্দেশনাই-বা কি? দেশের সমগ্র  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে সেই মার্চ থেকে; করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে। কবে নাগাদ স্কুল-কলেজ খুলবে তাও কেউ জানে না বা কেউ বলতে পারে না। ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা এখনও পর্যন্ত সংঘটিত হয়নি, কবে নাগাদ তা সংঘটিত হবে তাও কেউ জানে না; তাই অভিভাবক ও  শিক্ষার্থীরা চরম উৎকন্ঠিত।  ক্লাস এবং পরীক্ষার অনিশ্চয়তা নিয়ে এক মহা দুশ্চিন্তার মধ্যে কালাতিপাত করছে দেশের সমস্ত ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা। প্রত্যেকেই এখন অলস সময় পার করছে এবং সেশনজট  নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন; কিন্তু কিছুই তো আর করার নেই।  প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা স্কুলে পড়াশোনা করতে না পারায় তারা মানসিকভাবে অনেক বেশি  ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বা করোনা সিম্পটমে মৃত্যুর সংখ্যা কিন্তু এদেশে এখনো নেহায়েত কম নয়, তাছাড়া কেন যেন এখনো পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত হওয়া মানুষের সংখ্যা এদেশে কিছুতেই কমছে না, বরং কোন কোন অঞ্চলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই যে কোনো স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে; তাই সরকারও শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে বারংবার  সতর্ক থাকার বা হওয়ার  নির্দেশ দিচ্ছে। এমনতর  পরিস্থিতিতেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও অনলাইন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে এবং কোথাও কোথাও তা শুরুও হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাস নিতে শুরু করছেন, তারা অ্যাসাইনমেন্ট ও হোমওয়ার্কও দিচ্ছেন এবং তা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে জমাও নিচ্ছেন। 
 
দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে নিশ্চিত করেই বলা যায়, এ'দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের; আর্থিক সংকটের কারণে তারা অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে না। অনেকেরই নেই অনলাইন শিক্ষায় অংশগ্রহণ করার মতো ন্যূনতম সরঞ্জাম— স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ  আলাদা, সেখানকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের এবং তারা সবকিছুই সামাল দিতে পারবে। কিন্তু স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অবস্থা কি হবে বা কি হচ্ছে? ঘোষণা দিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরা টিভিতে ক্লাস নিচ্ছেন। কিন্তু তা শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা মঙ্গলজনক বা কার্যকরী হচ্ছে? অনলাইন ক্লাস এদেশে কার্যকর করার মতো সার্বিক পরিস্থিতি এখনো অনেক দূর;  বাচ্চাদের জন্য তো তা মোটেও প্রযোজ্য নয় বা আদৌও কার্যকরী হবে বলে আমার মনে হয় না। বাচ্চাদের জন্য শ্রেণীকক্ষে সরাসরি ক্লাসের কোন বিকল্প নেই। তাই এতসব উদ্ভট চিন্তা বাদ দিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে বা অন্য কোন উপস্থিত প্রক্রিয়ায় বাস্তব কারিকুলামে কি করে শ্রেণীকক্ষে তাদের  ক্লাস নেয়া যায় তা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত।  

গত ১৭ই মার্চ থেকে বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে, ৬ই আগস্ট ছুটি শেষ হলেও স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া হবে কিনা সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। আর এ'সব বিষয়ে এখনও পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে কোন সিদ্ধান্ত না আসায় উদ্বেগে আছেন শিক্ষক-অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীরা। বাংলাদেশের সকল প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম সমন্বয়ের কাজে ফেসবুককে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর; বিষয়টি বড়ই চিন্তার। কারণ, ছোট ছোট বাচ্চারা একবার ফেসবুকে ঢুকলে এবং ফেসবুক আসক্ত হয়ে গেলে পরিস্থিতি কি হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া কতটাই-বা কাজে আসবে বা কাজ হবে বা করতে পারবে শিক্ষা সমন্বয়ে ফেসবুকের ব্যবহার?  এইবারের এসএসসি পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা ভর্তির অপেক্ষায় আছে। দেশের গ্রামগঞ্জসহ সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কলেজ, সে সব কলেজে একাদশ শ্রেণীতে অনলাইনে ভর্তির পরিপত্র জারি করা হয়েছে; সেখানেই ঠিক মতো ভর্তি  কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারছে না এদেশের এসএসসি পাশ ছাত্রছাত্রীরা। এমতাবস্থায় অনলাইনে পড়ালেখা কি চাট্টিখানি কথা?  

গত মাসে এক ভিডিওবার্তায় মাননীয়  শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছেন, চলতি শিক্ষাবর্ষ আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে; সেইসাথে পরের শিক্ষাবর্ষ কমিয়ে নয় মাস করার কথাও ভাবা হচ্ছে। যদিও এ'সব বিষয়ে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য  বিভাগগুলো চেষ্টা করছে এই বছরের মধ্যেই শিক্ষাবর্ষ শেষ করতে। তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিবেচনায় যদি ছুটি আরও বাড়ানো হয়, তাহলে এই শিক্ষাবর্ষ মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়ানো নিয়েও আলোচনা হচ্ছে বলে জানান আন্ত:শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে মূলতঃ দু'টো বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে— প্রথমতঃ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা যায় এবং দ্বিতীয়তঃ মেধার মূল্যায়নের দিকটিও যেন আপোষ করতে না হয়। তবে কবে নাগাদ এ'সব সিদ্ধান্ত আসতে পারে সে বিষয়ে এখনো পর্যন্ত  স্পষ্ট করে কোন কিছুই জানা যায়নি।

চলতি শিক্ষাবর্ষ আরও কিছুটা বাড়ানো হলে আগে যেমন নভেম্বর ডিসেম্বরে সমাপনী পরীক্ষা শেষ হতো, সেই পরীক্ষা শেষ হবে সামনের বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চে। অন্যদিকে সামনের শিক্ষাবর্ষ ১২ মাস থেকে কমিয়ে ৯ মাসে নামিয়ে আনার কথা চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, একটি শিক্ষাবর্ষে ১৪০ দিনের মতো পড়ানো হয়, ৩৬৫ দিনের বাকিটা সময় ধরে থাকে ছুটি আর ছুটি। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক এমনতর কার্যক্রম কাটছাঁট করে পরের শিক্ষাবর্ষের সমাপনী পরীক্ষা যেন ডিসেম্বরেই নেয়া যায় সে দিকে খেয়াল রেখে সিলেবাস কমানোর পাশাপাশি ঐচ্ছিক ছুটিছাটাও বাতিল করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা।

করোনার এই সময়টা নিশ্চয়ই একদিন কেটে যাবে, বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও হয়তো আবার খুলে দেয়া হবে; প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে শহর-নগর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীতে আবারও মুখরিত হয়ে উঠবে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ক্যাম্পাস। কিন্তু সময়টা আরও বেশি দীর্ঘস্থায়ী হলে আগামীর শিক্ষা ব্যবস্থার কি হবে, কেমনই-বা হবে? করোনার কারণে তৈরি হওয়া অনলাইন আর অফলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার এই অসম বৈষম্য আমরা কি করে দূর করবো?  এসব প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে গেলে বা সমাধান করতে গেলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা অবশ্যই আরো বাড়াতে হবে এবং সবাইকে সৎ ভূমিকা রাখতে হবে। 

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন— ১৯৩০ সালের পর সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে আছে বিশ্ব; সে কারণে করোনা পরবর্তী বিশ্ব হবে ক্ষুধাময়।  ওদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছে না! কবে নাগাদ এই করোনাভাইরাস বিশ্ব থেকে নির্মূল হবে, বা আদৌও নির্মূল হবে কি? যতই বলা হউক না কেন কোভিড-১৯-এর ভেকসিন আবিষ্কার হয়ে গেছে; কিন্তু তা  বাস্তবায়িত হতে এবং মানবজাতির কল্যাণে আসতে সময় নেবে আরও অনেক। ততদিন কি শিক্ষা থেমে থাকবে আর সভ্যতা বিপর্যস্ত হবে??

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২৭ জুলাই, ২০২০.

শনিবার, ২৫ জুলাই, ২০২০

সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নয় বিশ্বশান্তিই ইসলামের মূলনীতি:


'ইন্নাদ্দীনা ইন্দাল্লাহ্হীল ইসলাম'— নি:সন্দেহে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম হলো শান্তি (ইসলাম);  কিন্তু কোথায় শান্তি? কোথায় স্বস্তি? শান্তি স্বস্তি কি পৃথিবী থেকে বিদাই নিয়েছে? - অনেকের মনে এ'রকম হাজার প্রশ্ন; বর্তমান সময়ে ইসলাম মানেই যেন অশান্তি! ভিন্ন ভিন্ন ছোট ছোট দল-উপদল ও মতের প্রাধান্য বিস্তারের অপচেষ্টা, হানাহানি মারামারি; ধর্ম নিয়েই যত সব বাড়াবাড়ি! কিন্তু কেন? কারণ, কেউ মদ বেচে দুধ খান, কেউ-বা দুধ বেচে মদ খায়!  
   
মাওলানা আব্দুর রহমান (আসল নাম নয়; মাওলানা অনুরোধ করেছিলেন যেন তাঁকে প্রচার না করি।) ধর্মীয় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একজন বিজ্ঞ আলেম। এই বাংলারই কোন এক উপজেলা পরিষদ মসজিদে তিনি ইমামতি করেন। এক অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাত। আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে এমন সব কিছু কথা তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো যা সচারাচর আজকের আলেম বা কোন ইমামদের কাছে প্রত্যাশাও করা যায় না। যতই তাঁর কথা শুনছিলাম ততোই ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইকে মনে পড়ছিল। 

আজ থেকে হাজার বছর আগে ইমাম গাজ্জালী (রঃ) ইসলামকে পুনঃ জাগরিত করে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে এই ধরাধাম ত্যাগ করেছিলেন। যিনি বলে গেছেন - 'প্রস্রাব দিয়ে কাপড় দৌত করতে যেয়ে যত দামী  সাবান সোডাই ব্যবহার করা হউক না কেন যেমন কাপড়ের পরিত্রতা আনয়ন করা যায় না, তদ্রুপ হারাম উপার্জিত পয়সা দিয়ে দান-খয়রাত বা ছদগা-যাকাত করলেও তা পাপ বৈ পুণ্য বয়ে আনে না।' 

উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে জানতে পারি মাওলানা আব্দুর রহমান উপজেলা পরিষদ থেকে ইমামতির জন্য কোন বেতন বা টাকাপয়সা নেন না। উপজেলা পরিষদের পতিত জমি তিনি চাষাবাদ করেন এবং উৎপাদিত ফসলের ভাগের এক অংশ উপজেলা কোষাগারে জমা দিয়ে বাকীটা দিয়ে তিনি জীবনযাপন করেন। আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেন যেন কথাগুলো আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না। তাই উৎসাহ ও উৎগ্রীবতা নিয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করার অভিপ্রায়ে তাঁর সাথে বাসায় দেখা করতে চাইলাম; তাৎক্ষনিক সাক্ষাতে তিনি রাজি হলেন না। আমার সম্বন্ধে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে বেশ কয়েকদিন  পর উপজেলা চেয়ারম্যান মারফত আমাকে জানালেন, যে কোন দিন আমি যেন তাঁর বাসায় যাই। প্রথমদিন কেন তিনি আমার সাথে সাক্ষাত দিতে চাননি তার কারণও সেদিন সাক্ষাতে জানতে পেরেছিলাম; বর্তমান প্রেক্ষাপটে তিনি আমাকেও অন্য দশ জনের মতোই ভেবেছিলেন।  

আমি যেদিন মাওলানার বাসায় প্রথম যাই সেদিন সকাল ১০.১৫ টায় গিয়ে পৌঁছি, তিনি তখন বাসার পাশে একটা বেগুন ক্ষেতে আগাছা পরিস্কার করছিলেন। প্রায় পনে দু'ঘন্টা ঐ বেগুন ক্ষেতেই আমাদের দু'জনের দীর্ঘ আলাপচারিতা। যদিও তিনি আমাকে দেখেই কাজ বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি তা করতে দেইনি। তাঁর কাছে গিয়েই বুঝেছিলাম এই জীবনে এখনো আমার অনেক কিছু শিখার বাকী আছে। পরবর্তীতে সময় ও সুযোগ পেলেই হুটহাট তাঁর ওখানে চলে যেতাম এবং মত বিনিময় করতাম। 

আত্মিক ও বাহ্যিক এবাদত-সংযমের এক জ্বলন্ত  উদাহরণ, উৎকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী  এই মাওলানা আব্দুর রহমান; যাঁর মাঝে আমি দেখতে পেয়েছি আল্লাহর নূর, তাঁর চেহারায় তা সুস্পষ্ট  ফুঁটে উঠেছে। তিনি বর্তমানের তথাকথিত কমার্শিয়াল আলেম বা ইমামদের মত নন; তিনি বলেন, 'নামাজ তো আমার জন্যও ফরয। আমার ফরয তো আমাকে আদায় করতেই হবে। নিজ ইমামতিতে আমি নিজে আমার ফরয আদায় করছি, অন্যরাও আমার পিছনে যার যার ফরয আদায় করে নিচ্ছেন, এবাদত-বন্দেগীর প্রতিদানের মালিক তো একমাত্র আল্লাহ্‌; এর জন্য আমি অন্যের কাছ থেকে বিনিময় নেবো কেন?'

ইসলামের আসল বুনিয়াদ এই আব্দুর রহমান মাওলানাদের হাতেই। তাঁরাই প্রকৃত ইসলামের ধারক ও বাহক। কে বলে ইসলামে শান্তি নেই? মাওলানা আব্দুর রহমানের মতো অনেক মু'মিন মুসলমান এখনো এই ধরণীতে জিন্দা আছেন, তাঁদের সংসার দেখতে যান; দেখবেন, তাঁদের  কোন কিছুরই ঘাটতি নেই, অভাব নেই। আল্লাহ-র খাস রহমত ও বরকত তাঁদের উপর সব সময়ই বিদ্যমান। 

ইসলাম মানে শান্তি, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ এক পরম শান্তির বিষয়;  এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত বা ভিন্নমত থাকার কথা নয়। হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আহাম্মদ মুস্তোবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী রাসুলগণ পৃথিবীতে এই শান্তির ধর্মের বুনিয়াদই রচনা করে গেছেন, আমরন তাঁরা চেষ্টা করে গেছেন শান্তি-সাম্য-সৌহার্দ্যের পৃথিবী গড়ে তুলতে। কোন নবী বা রাসুলের জীবনীই আমাদের ধর্মীয় উস্কানি, সন্ত্রাসবাদ বা অশান্তির শিক্ষা দেয় না। 

ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ করার জন্যই পবিত্র কুর'আনুল কারীমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নবী-রাসুলগণের জীবনী ও ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে; শান্তি, সাম্য ও সৌহার্দ্যের বাণী সমেত। যা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে আমরা পথের দিক নির্দেশনা পাই এবং নিজ  জীবনের দিক নির্ণয় করতে পারি। তাছাড়া ভিন্ন ধর্মমত ও পথেরও যারা দুনিয়াতে জ্ঞানের তাপস হিসেবে এসেছিলেন সেই সব গ্রেট দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টেটল, আলেকজান্ডার দি গ্রেটরাও কিন্তু পৃথিবীতে  শান্তির বুনিয়াদই বপন  করে গেছেন; জ্ঞানের বিকাশে তাঁরাও রেখে গেছেন স্মরণীয় বরণীয় সব অবদান। ধর্মকর্ম বা মৌলিক এবাদত-বন্দেগীর কথা বাদ দিয়ে দেখলে দেখা যায় যে বিশ্বশান্তির প্রশ্নে পৃথিবীতে আসা সকল মনীষীর মত ও পথ এক ও অভিন্ন। 

সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম বার বার ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। সারে চৌদ্দশ বছর আগেই তিনি জানতেন, মুসলিমদের মাঝে ধর্ম নিয়েই বাড়াবাড়ি হবে সবচেয়ে বেশি। তাই তিনি অসংখ্যবার মুসলিমদের মধ্যপ্রন্থা অবলম্বন করার তাগিদ দিয়ে গেছেন। সহীহ  ছিত্তায় এরূপ অসংখ্য হাদীসের সন্নিবেশ দেখা যায়। পরবর্তীতে পৃথিবীর সকল মুসলিম মনীষীর লেখা থেকেও হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের কথার অনুসরণ ও অনুকরণের মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। 

উম্মতে মুহাম্মদী মানেই মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের অনুসরণ ও অনুকরণ। যা করতে হবে তা আত্মিক ও বাহ্যিক উভয় প্রন্থায়ই করতে হবে। সাধারণভাবে ইসলাম বলতে আমরা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের প্রবর্তিত ও প্রচারিত ধর্মকেই বুঝি। আর এই ইসলামের সকল মূল নীতি, বাণী ও উদ্দ্যেশ্য-বিদেয় পুরোপুরিভাবে শান্তির সাপেক্ষে, অশান্তির বিপক্ষে। মুলতঃ বিশ্বশান্তিই ইসলামের মূল নীতি; আর সকল নবী-রাসুলের প্রচার-প্রচারণা এই নীতিমালার  উপরই প্রতিষ্ঠিত।   

অনেকেই ভাবতে পারেন— তবে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন সহ সকল মুসলিম খলিফাগণ এতো যুদ্ধ করেছেন কেন? তখনকার পরিবেশ, পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতা মুলতঃ অন্য রকম ছিল। তৎকালীন জাজিরাতুল আরব ছিল আইয়ামে জাহেলিয়াতের নিকৃষ্ট একটি চারণভূমি। নেংটো হয়ে সেই সময় তারা কাবাঘর তাওয়াফ করতো। পৌত্তলিকতা ছিল আরবিয়দের বেশিরভাগের ধর্ম। বংশ ও গুষ্টিগত দাঙ্গা হাঙ্গামা তাদের মাঝে লেগেই থাকতো। সে সময় সেখানে পিতারা পিতা হয়েও নিজ কন্যা সন্তানকে জ্যান্ত মাটিচাপা দিত! 

সমাজ সভ্যতা বলতে আজকের আমরা যা বা যতটুকো বুঝি, তৎকালীন আরবের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ তার বিপরীত। হিংস্রতা নিষ্ঠুরতা বর্বরতা ছিল তাদের পৌরুষত্ত্ব জাহিরের মানদণ্ড। আরবের সেই চরম পর্যায়ে আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন আলোর দিশারি রূপে তাঁর প্রিয় হাবীব, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মহানবী হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামকে সেই পংকিল সমাজে প্রেরণ করেন। মহানবী (সাঃ) তাঁর কাঁধে বর্তানো দায়িত্ব সম্পুর্ণ সুচারুভাবে সম্পন্ন করে দুনিয়া থেকে ওফাত নেয়ার পর থেকেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ভিন্ন মতবালম্বীরা; আজও সেই একই গতিতে তাদের কুকর্ম অব্যাহত রয়েছে।  

সময়ের প্রেক্ষিতে কেন জানি বিদাই হজ্জে রাসুলপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের সেই দিকনির্দেশনা শেষ ভাষণ খুব বেশি মনে পড়ছে। সুরা আন-নাছর নাজিল হওয়ার পর ৬৩২ খৃষ্টাব্দে ২৩ ফেব্রুয়ারি লক্ষাধিক সাহাবী (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে মহানবী (সাঃ) হজ্জ করতে মক্কা যান। ৯ যিলহজ্জ আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত বিশাল জনসমুদ্রে 'জাবালে রহমত'-এর উঁচু টিলায় দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেন—
  
  ১। হে মানব সকল! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন, কারণ আগামী বছর আমি তোমাদের সাথে এখানে সমবেত হতে পারবো কিনা জানি না।
  ২। আজকের এই দিন, এই স্থান, এই মাস যেমন পবিত্র, তেমনই তোমাদের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্র।
  ৩। মনে রাখবে অবশ্যই একদিন সকলকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে। সেদিন সকলকে নিজ নিজ কাজের হিসাব দিতে হবে।
   ৪। হে বিশ্বাসীগণ! স্ত্রীদের সাথে সদয় ব্যবহার করবে। তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে, তেমনই তোমাদের উপরও তাদের অধিকার রয়েছে।
   ৫। সর্বদা অন্যের আমানত রক্ষা করবে এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে ও সুদ খাবে না।
   ৬। আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না, আর অন্যায়ভাবে একে অন্যকে হত্যা করবে না।
    ৭। মনে রেখো দেশ বর্ণ গোত্র সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মুসলিম সমান। আজ থেকে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বিলুপ্ত হলো। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হলো আল্লাহ ভীতি বা সৎকর্ম। সে ব্যক্তিই সবচেয়ে সেরা যে নিজের সৎকর্ম দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।
   ৮। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না, পূর্বের অনেক জাতি এ কারণে ধ্বংস হয়েছে। নিজ যোগ্যতা বলে ক্রীতদাস যদি নেতা হয় তার অবাধ্য হবে না। এবং তার আনুগত্য করবে।
   ৯। দাস দাসীদের প্রতি সদ্ধ্যবহার করবে। তোমরা যা আহার করবে ও পরিধান করবে তাদেরও তা আহার করাবে ও পরিধান করাবে। তারা যদি কোন অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলে, তবে তাদের মুক্ত করে দেবে; তবু তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে না। কেননা তারাও তোমাদের মতোই মানুষ, আল্লাহর সৃষ্টি। সকল মুসলিম একে অন্যের ভাই এবং তোমরা একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
  ১০। জাহিলি যুগের সকল কুসংস্কার ও হত্যার প্রতিশোধ বাতিল করা হলো। তোমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর বাণী এবং তাঁর রাসুলের আদর্শ রেখে যাচ্ছি। একে যতদিন তোমরা আঁকড়ে থাকবে ততোদিন তোমরা বিপদগামী হবে না।
    ১১। আমিই শেষ নবী, আমার পর আর কোন নবী আসবেন না।
     ১২। তোমরা যারা উপস্থিত আছো তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেবে।

এই ছিল মোটামুটিভাবে বিদাই হজ্জ-এ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের মূল বাণী, যা উম্মতে মুহাম্মদী (সাঃ)-এর প্রত্যেকের জীবন চলার পথের পাথেয়।

কত কাঠখড় পেড়িয়ে আজকের এই ইসলাম তা হয়তো বর্তমান প্রজন্ম খুব একটা বেশি জানে না। জানবেই-বা কি করে? বিকৃত আর ভ্রান্ত মত ও পথের প্রচার প্রসার দুনিয়ায় যে ভাবে বিস্তার লাভ করেছে, তাতে প্রকৃত সত্য অনেকটাই ধামাচাপা পড়ে গেছে। ইসলামের অপ্রিয় সত্য কেউ তুলে ধরতে চায় না, আবার কেউ তুলে ধরলে তার জন্য তাকেও গালমন্দ শুনতে হয়। অসত্য অসুন্দর ইতিহাস ও ইসলামের বিরুদ্ধে ইহুদী-নাসারা ষড়যন্ত্র চক্রান্ত তুলে না ধরলে প্রকৃত সত্য ও সুন্দর প্রজন্মের কাছে খোলসা হবে কি করে? না বললে, না জানলে তো তুলনা করা সম্ভব হবে না, ভুলও সংশোধন করা যাবে না। 

আমার লেখা নিয়ে এরই মাঝে একটি শ্রেণী খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তারা অনেকেই  অনেক ধরনের বিকৃত রুচির পরিচয় দিচ্ছে। তাদের উদ্দ্যেশে বলছি— ধর্ম সম্বন্ধে ভালভাবে না জেনে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে কেউ কখনো আসে না; বিশেষ করে পবিত্র কুর'আনুল কারীম ও হাদীস নিয়ে আলোচনা করার তো প্রশ্নই উঠে না। পবিত্র কালাম পাক নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করতে হলে যে সব জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন,  আখলাক ইবাদত দরকার, আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীনের খাস রহমত, আমি সেগুলো অর্জন করতে চেষ্টা করেছি, করছি। আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীনের দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া, কোন ভ্রান্ত মতবাদ কোনদিনও আমাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। 

আমি মনে করি পবিত্র কুর'আনুল কারীম ও সহীহ ছিত্তাহ অনুসরণ করে মহান স্রষ্টার কৃপা প্রার্থনা করলেই সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যায়, তা পাওয়া দুষ্করও নয়। তাছাড়া বিশিষ্ট মুসলিম মনীষী— ইমামে আযম ও হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-সহ পাইওনিয়র মুসলমানদের লেখা অজস্র কিতাব আমাদের পথ প্রদর্শনে সহায়িকা হিসেবে কাজ করবে। অবশ্য বর্তমানে বহু পথভ্রষ্ট দল বেরিয়েছে, যারা ইমামে আযম বা ইমামে রাশেদীন অথবা হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-কে মানতে নারাজ! তারা মনে করে শুধু কুর'আন পড়লেই যথেষ্ট। তাদের এই যুক্তি আমি অবশ্যই মানি; কিন্তু সঠিক ধারাবাহিকতার অনুসরণ? 

ধারাবাহিকতা ছাড়া সরাসরি আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন বা হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামকে অনুসরণ করা কি করে কার পক্ষে সম্ভব? ঈমান ও ইসলামকে জানতে হলে বুঝতে হলে অবশ্যই আমাদের কারো না কারো লেখার উপরই নির্ভর করতে হবে, কোন না কোন ধারাবাহিকতার উপর আমল করতে হবে। আমি মনে করি হুজ্জাতুল ইসলামের ক্ষুরধার লেখাই আমাদের সঠিক পথ বাতলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সঠিকভাবে কুর'আনুল কারীম জানতে ও বুঝতে হলেও অবশ্যই সঠিক তাফসীর কারকের তাফসীর পড়তে হবে, অনুসরণ করতে হবে। ব্রিটিশ মদদে গড়া মৌদুদীর তাফসীর পড়ে সঠিক ইসলামের নাগাল মোটেও পাওয়া যাবে না। এতে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই বরবাদ হবে।
  
ইসলামের সেই প্রথম যুগেই বেইমানী,  নেমকহারামী, মোনাফেকী নামক বিষফোঁড়াগুলো মুসমানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছিল। শ্রেষ্ঠ সাহাবী হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর ঘরেই জন্ম নিয়েছিল কুখ্যাত মালাউন ইয়াজিদ; যে কিনা মসজিদে নববীকে ঘোড়ার আস্তাকূর বানিয়েছিল! ইয়াজিদের মতো অসংখ্য মালাউন মুসলিম সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়েছে! স্বীকৃত মোনাফেক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথা ইতিপূর্বে বহুবার আলোচনা করেছি। ইহুদী-নাসারা চক্রান্তে যুগের পরিক্রমায় সেই উবাইরা ও খাচ্চোর শাসকরা মিলে পৃথিবীর শান্তির ধর্ম ইসলামকে বিতর্কিত করেছে, ভ্রান্ত মতবাদ ও নতুন নতুন ফিতনার উৎপত্তি ঘটিয়েছে। তারা তাদের দুনিয়াবি  হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দ্যেশেই এ'সব করেছে। 

ইসলামে ধর্মীয় সন্ত্রাস বা ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদ উগ্রবাদের সূচনা মূলতঃ হযরত ওসমান (রাঃ) -র শাসনামলের শেষ দিকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দে যা ব্যাপক রূপ ধারণ করে; আব্দুল আজিজ আল সাউদ ও মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব নাজদী মিলে ইসলামে জঙ্গিবাদের বীজ বোপণ করে, যা পরবর্তীতে মুসলিম রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। ভ্রান্তমতবালম্বী আব্দুল ওহাব নাজদী ধর্মীয় নেতা সেজে একের পর এক বিকৃত ফতোয়া দিতে থাকে, আর ডাকাত সর্দার আব্দুল আজিজ আল সাউদ রাষ্ট্রনায়ক সেজে (যার নামে জাজিরাতুল আরব সৌদি আরব হয়েছে ) নাজদীর ফতোয়া বাস্তবায়ন করতে থাকে! 

তৎকালীন জাজিরাতুল আরবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের বংশধরগণকে নিধনের যে জঘন্য প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছিল আব্দুল ওহাব নাজদী ও আব্দুল আজিজ আল সাউদ তা ভাষায় বর্ণনা করার মত নয়। সকল সাহাবী রাদি'আল্লাহু আনহুগণের কবরের শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকো মুছে দেয়াই যেন ছিল নাজদীর ফতোয়ার মুখ্য বিষয়। এমন কি শালা-ভগ্নীপতি মিলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের পবিত্র রওজা মোবারক গুঁড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টাও করেছিল। সে এক বিকৃত ইতিহাস; অন্য আরেক সময় তা তুলে ধরার আশা পোষণ করছি। 

সেই থেকেই শুরু হয় নামধারী মুসলিমের হাতে ঈমানদার সব  মুসলিম নিধন! একদিকে ঈমান ও আকিদাগত বিষয়গুলো পরিবর্তিত হতে থাকে ধর্মীয়  সংস্কারের নামে, অন্যদিকে চলতে থাকে সারে তেরশ বছরের ইসলামের ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্নগুলোর মুন্ডুপাত। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নবী কারীম (সাঃ)-এর বংশধারগণ প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আফগানিস্তান পাকিস্তানের বন জঙ্গলে  আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। স্বভাবতই নবীর বংশধরগণ শান্ত ভদ্র নম্র হন; হিংস্রতা বর্বরতা তাঁরা বুঝেন কম। ডাকাতদের সাথে কুলিয়ে উঠা তাঁদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না। 

ডাকাতদের বর্বরতার কাছে হার মেনে মাতৃভূমি ছেড়ে তাই তাঁরা আত্নগোপন করেছিলেন এই অঞ্চলে। নির্মম নিষ্ঠুর নিয়তি, সেই একই অবস্থা আজও বিদ্যমান। মার্কিনরা ওসামা-বিন-লাদেনকে আরবে তৈরী করে, শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানে আত্মগোপনের বাহানাকে ইস্যু করা ছিল আফগানিস্তানে মার্কিনী আক্রমনের একটি কূটকৌশল; আসল উদ্দ্যেশ্য ছিল অন্য, প্রকৃত মুসলিম দমন।  

বর্তমান পৃথিবীর নব্য আকিদার মুসলিম শুধুমাত্র নামকাওয়াস্তেই মুসলিম। কার কতটুকো ঈমানী জোর আছে তা একটু স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বা স্বার্থ সম্পৃক্ত ব্যাপারে জড়ালেই স্পষ্ট হয়ে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য ওহাবী মতবাদ আজ সাড়া মুসলিম জাহানকে খণ্ড-বিখণ্ডিত করে দিয়েছে; অন্যদিকে মওদুদীবাদ আমাদের এই উপমহাদেশকে উত্তপ্ত করেছে। এই দুই ভ্রান্ত দল  মিলে সমগ্র  ইসলামী জাহানকেই আজ এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বানিয়ে ছেড়েছে। একদিকে ইহুদী-নাসারা চক্রান্ত, অন্যদিকে মুসলিম রূপি এই সব মুনাফিকদের আধিপত্য, সমগ্র মুসলিম জাহানকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। এর মুল কারণ মুসলিম বিশ্বে আল্লাহ প্রদত্ত ধনসম্পদের পর্যাপ্ত সমাহার।

অতি সাধারণ একটি চিন্তা— ইসরাইলে ইহুদী সন্ত্রাসীরা প্রতিদিন নিরস্ত্র মুসলিম নর-নারী-শিশুর উপর পশুর মতো হামলে পড়ছে, অকাতরে অকারণে ছোট ছোট অবোধ শিশুদেরকেও হত্যা করছে। আর আল কায়েদার বর্তমান প্রধান জাওয়াহিরি ইসরাইল বাদ দিয়ে এশিয়ার মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চলে আঘাতের পরিকল্পনা করছে! সত্যি সত্যিই আল কায়েদা যদি প্রকৃত ইসলামী চেতনা সমৃদ্ধ কোন গ্রুপ হতো, তবে জাওয়াহিরি সকল ইসলামী গ্রুপগুলো নিয়ে অতর্কিতে ইসরাইলের উপরই ঝাঁপিয়ে পড়তো; বাংলাদেশ বা মুসলিম দেশে সাধারণ মুসলিম মারার পরিকল্পনা করতো না। আমাদের দেশে বা মুসলিম বিশ্বে যে সব সন্ত্রাসী উগ্রবাদী গ্রুপগুলো আছে, তারাও কোনভাবেই  আল কায়েদার সাহায্যে এগিয়ে আসতো না। ইসলামী বলে পরিচিত এই সব সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো আসলে মার্কিনীদের তৈরী, মার্কিন চক্রান্ত বাস্তবায়নের এজেন্ট ওরা। মুখ ও অবয়বে ইসলামী লেবাস এঁটে ইহুদী-নাসারাদের চড় হিসেবে মুসলিম বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। 

ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদা দুটি বিষয়। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুগে যুগে মুসলমানের ঘরেই জন্ম নিয়েছে বেইমান আর মুনাফিক। যারা কূটচালে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে ইসলামকে বার বার বিতর্কিত করেছে। হিংসা প্রতিহিংসা তাদের মূল চালিকাশক্তি; তারাই ভিন্ন মতবালম্বী। ইসলামকে সব সময়ই তারা হাতিয়ার বা ঢাল  হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং আজও করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের কোন মূলনীতিরই তারা ধার ধারে না। বাহ্যিক ঈমানদার ও ইবাদতি ভাব প্রকাশ করে তারা ইসলামিষ্ট সাজার ভান করে মাত্র। 

ইসলাম আল্লাহ মনোনীত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান; রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, ব্যক্তি কোন কিছুই এই বিধানের বাহিরে নয়। ইসলামের মুল বিষয়গুলো মানুষের মৌখিক, আত্নিক ও বাহ্যিক অবস্থার সাথে পুরোপুরিভাবে সম্পৃক্ত;  যেমন— আল্লাহ ও আল্লাহর হাবীব (সাঃ)-কে মুখে স্বীকার করা, অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা ও আল্লাহর আদেশ নিষেধ মান্য করা ও নিজ জীবনে  বাস্তবায়ন করা। সেই হিসেবে ঈমান ও ইসলাম প্রধানতঃ তিন ধরনের দেখা যায়। কেউ মনে করেন - ঈমান ও ইসলাম এক ও অভিন্ন। আবার কেউ মনে করেন - দুটোই ভিন্ন ভিন্ন, পরস্পরের কোন মিল নেই। এবং কারো কারো মতে - দুটো আলাদা হলেও একটি অপরটির সাথে সম্পর্কযুক্ত। 
 
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-র মতে - আভিধানিক অর্থে ঈমান হলো সত্যায়ন করা; অর্থাৎ সত্যি বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস ও প্রকাশ করা। এবং ইসলামের প্রকৃত অর্থ হলো আনুগত্য স্বীকার করা ও অস্বীকৃতি, অবাধ্যতা, হটকারিতা হতে নিজকে দূরে রাখা। ঈমান প্রশ্নে, সত্যায়ন বা বিশ্বাস এক বিশেষ স্থান, তথা অন্তর দিয়ে হয়ে থাকে; যার প্রকাশক হলো মুখ, আর স্বীকার করা হয় মুখ, অন্তর ও প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে। অভিধানের ভাষায় ইসলাম একটি ব্যাপক বিষয়, আর ঈমান হলো একটি বিশেষ বিষয়। 

ইসলাম যদি একটি প্রকান্ড গাছ হয় ঈমান হলো তার একটি শাখা মাত্র। মূলতঃ ইসলামের শ্রেষ্ঠ অংশের নাম হলো ঈমান। ঈমানহীন কোন মানুষ কখনো একজন সত্যিকার মুসলিম হতে পারে না। যারা না বুঝে ভ্রান্ত সব ইসলামী গ্রুপের পাল্লায় পড়ে ঈমান নাশক টেবলেট খাচ্ছে, শহীদ বা গাজি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, হে আল্লাহ আপনি  তাদেরকে হেফাজত করুন এবং হেদায়েত দান করুন।
 
    শত সহস্র পথের মধ্যে
               সত্য কেবল একটি পথ।
   সেই পথের যাত্রী সবায়
               একই লক্ষ্য একই মত।
   কেউ কি কোন খবর রাখে
               তাদের লক্ষ্য-কাম্য কি?
   ভ্রান্ত পথের যাত্রী যারা
               তারাই-বা বুঝবে কি? 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
০৮-০৯-২০১৪.

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০২০

কর্মসংস্থানে পৃষ্ঠপোষকতা নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো যোগ্যতা ও আত্মবিশ্বাস:

জীবন চলার পথে ‌হাজারো প্রতিকূলতা— দারিদ্রতার কষাঘাত, এক বেলা খাবার জোটে তো আরেক বেলা জোটে না, পরিধানে ভালো পোশাক নেই, ধার-দেনা করে পড়াশোনা শেষ করতে না করতেই আইটি জায়ান্ট মাইক্রোসফট-এর নিয়োগপত্র হাতে পাওয়া; বছরে বেতন ১.০২ কোটি রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এটি হলো ভারতের সেই বাৎসল্য চৌহানের জীবনের গল্প। 

নিশ্চয় আপনারা ভুলে যাননি ২০১৬ সালের প্রথম দিকে ভারতের আনন্দবাজার ও বাংলাদেশের কিছু পত্রিকায় ঝড় তোলা সেই খবর - 'কোটি টাকার চাকরি পেলেন ঝালাই মিস্ত্রির ছেলে'। ভারতের বিহার রাজ্যের খাগাড়িয়ার বাৎসল্য চৌহান আইআইটি খড়গপুর-এর শেষ বর্ষের ছাত্র ছিল সে তখনও, বয়স মাত্র ২১ বছর। বাবা একজন ঝালাই মিস্ত্রি, মা অতি সাধারণ গৃহবধূ; ছয় ভাই-বোনের মাঝে প্রচণ্ড অভাবের সংসারে সংগ্রাম চালিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছিল বাৎসল্য চৌহান। তার সেই সংগ্রাম ছিল শিক্ষার মাধ্যমে মেধা বিকাশ করে জীবনযুদ্ধে নামার সংগ্রাম; আত্মবিশ্বাস ও একাগ্রতা তাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। 

অনেকেই এখানে ভাগ্যকে বড় করে দেখতে চাইবেন। হ্যাঁ, মুসলিম হিসেবে ভাগ্যকে অবশ্যই মানতে হবে, তবে বাস্তবতা থেকে একটি জিনিস আমি আবিস্কার করেছি, প্রচেষ্টা না থাকলে কারো ভাগ্য কোন দিনও সুপ্রসন্ন হয় না। কলেজ জীবনে আমাদের একজন বন্ধু ছিল, তার বেশভূষা ও চালচলন ছিল সম্পূর্ণ  অন্যরকম। সেই ৭০-এর দশকেও সে দু'টো প্রাইভেট কার অদল বদল করে কলেজে আসতো; মা-বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা তার জন্য অগাধ অর্থ-সম্পদ, মিল-কারখানা ও ঢাকায় বিশাল বাড়ি রেখে গেছেন। আমাদের এই সংক্ষিপ্ত জীবনেই আমরা তাকে একসময় প্রচন্ড রকমের অভাবগ্রস্থ হতেও দেখেছি! শুনেছি তার বাবার মৃত্যুর পর সে খারাপ লোকজনের সংস্পর্শে পড়ে বাবার রেখে যাওয়া সেই বিশাল সম্পদের সব কিছই ধ্বংস করে ফেলেছে। 

অতিরিক্ত অর্থ-সম্পদ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষকে অমানুষ বানিয়ে ফেলে। সন্তানকে প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে পারলে বা বানাতে পারলে তার জীবনে সম্পদের কোন অভাব কখনো হয় না। ছোট থেকে বাস্তবতা ও কিছুটা দারিদ্রতার সাথে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা দিয়ে বড় করতে পারলে দেখবেন আপনার সন্তান বাস্তবতার নিরিখেই জীবন গড়বে এবং কর্মজীবনেও সফলতাকে অতি সহজে কুক্ষিগত করে ফেলতে পারবে।

কেএফসির ফাস্টফুড এখন এদেশেও বেশ জনপ্রিয়। বড় বড় শহর থেকে শুরু করে ছোট ছোট মফস্বল শহরেও এখন কেএফসি ফাস্টফুড শপের দেখা মেলে। তাই কেএফসির লোগোর সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা হাসিমুখের লোকটিকে আমরা অনেকেই চিনি, তিনি হলেন কনোনেল স্যান্ডার্স; যিনি কেএফসি নামের বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় ফাস্টফুড চেইন শপের প্রতিষ্ঠাতা। 

তুমি যদি তোমার এলাকায় কেএফসির একটি শাখা খুলতে চাও, তবে তোমাকে শুধু তাদের ফ্রেঞ্চাইজি ব্যবহারের জন্য ৪৫ হাজার ডলার বা প্রায় ৩৮ লাখ টাকা দিতে হবে।  এতবড় কোম্পানী যাঁর রেসিপি থেকে শুরু, সেই রেসিপি বিক্রি করতে গিয়ে তাঁকে ১০০৯ বার ব্যর্থ হতে হয়েছিল!

৫ বছর বয়সে বাবা হারানোর পর থেকে তাঁর জীবন সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। নিজের রান্নার দক্ষতার কারণে কাজ পেতে তাঁকে কখনও তেমন একটা অসুবিধায় পড়তে হয়নি;  কিন্তু যখনই তিনি নিজে কিছু করতে গেছেন – তখনই ব্যর্থ হয়েছেন। ১৯৩৯ সালে ৪৯ বছর বয়সে অনেক কষ্টেসৃষ্টে তিনি একটি মোটেল শুরু করেন। ৪ মাস চলার পরই মোটেলটিতে আগুন ধরে ধ্বংস হয়ে যায়। ৫০ বছর বয়সে তিনি তাঁর সিক্রেট চিকেন ফ্রাই রেসিপি নিয়ে আবার কাজ করতে শুরু করেন।

১৯৫৫ সালে তাঁর আরও একটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। চার রাস্তার মোড়ে তিনি একটি রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন। ভালোই চলছিল, কিন্তু নতুন রাস্তা হওয়ার ফলে সেই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে রেস্টুরেন্টও বন্ধ করে দিতে হয়। সেই বছর ৬৫ বছর বয়সী কনোনেলের হাতে মাত্র ১৬৫ ডলার ছিল। এরপর তিনি তাঁর চিকেন রেসিপি বিক্রী করার চেষ্টা করেন। ১০০৯টি রেস্টুরেন্ট তাঁকে ফিরিয়ে দেয়ার পর একটি রেস্টুরেন্ট তাঁর রেসিপি নিয়ে কাজ করতে রাজি হয়; বাকিটা ইতিহাস! 

আমি লক্ষ্য করেছি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা অন্যের সাফল্যের গল্পগাঁথা শুনতে বা পড়তে প্রচন্ড ভালোবাসে; অবশ্যই এটা খুবই ভাল একটি লক্ষণ, যদি ঐ গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করার প্রত্যয়ে সে তা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই নিজের জীবনে এসব বাস্তবায়ন করতে চায় না বা পারে না; বরং অনেককে আমি দেখেছি হতাশায় সাগরে হাবুডুবু খেতে। তাদের অভিযোগ ঘুষ, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বা মামা চাচার জোর ছাড়া এদেশে কিছুই হয় না; চাকুরীর তো প্রশ্নই উঠে না। 

কিছু ছেলেমেয়ের কাছ থেকে এমনসব হতাশাজনক কথাবার্তা শুনে অনেক সময় আমার মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়। আসলে কি এসব অভিযোগ পুরোপুরি সত্য? আমার তো তা মোটেও মনে হয় না। এমনটা সত্য হলে সুবিধা বঞ্চিত পরিবারের ছেলেমেয়েরা বিসিএস কোয়ালিফাই করে সরকারী চাকুরীতে অহরহ ডুকছে কি করে? এমন উদাহরণ দেশে কি খুবই কম? মোটেও কম নয়। তাছাড়া দেশের সব বিখ্যাত ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালেই দেখা যায় মেধা ও যোগ্যতার বলেই যথেষ্ট পরিমাণে হতদরিদ্র পরিবারের অতি সাধারণ ছেলেমেয়েরা স্থান করে নিচ্ছে।

ছোট্ট ভূখণ্ডের বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশের পারিপার্শ্বিকতার বাস্তবতাকে তোমাদের অবশ্যই মেনে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। জীবন ধারণের সকল ক্ষেত্রেই বর্তমান দুনিয়ায় প্রত্যেককে প্রতিটি প্রতিযোগিতায় কোয়ালিফাই করতে হয়, আর এটাই স্বাভাবিক; চাকুরী ক্ষেত্রে তো আরো অনেক বেশি, করতেই হবে। তাই গো ধরে বসে থাকলে চলবে না, আত্মকর্মসংস্থানের জন্যও প্রচেষ্টা চালাতে হবে; কোন কর্মকেই কখনও খাটো করে দেখা যাবে না। তোমরা কি জানো বিদেশে ভার্সিটিতে পড়তে থাকা ছেলেমেয়েরা গ্রুপ করে বাসা বাড়ি বা অফিস আদালত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করার কায়িক পরিশ্রমের কাজ করে বা বাসাবাড়ির টয়লেট পরিস্কারের কাজ কন্ট্রাক্ট নেয়? আর ওসব করে অল্প সময়ে কায়িক পরিশ্রম দ্বারা তারা বেশ কিছু বাড়তি ডলার কামিয়ে নিতে পারে। 

তোমাদের জন্য আমার উপদেশ, শিক্ষা জীবন শেষ না হতেই কর্মসংস্থানের দিকে পা বাড়াও, এটা ওটা করে অভ্যাস করো; পাশ করে যদি কিছুদিন বসে থাকো বিশ্রাম নাও, দেখবে আস্তে আস্তে তোমার কর্মস্পৃহা কমে যাবে, লোপ পেতে শুরু করবে এবং এক সময় হতাশায় নিমজ্জিত হবে। অবিরামভাবে চলে যারা শিক্ষা জীবন থেকে কর্মজীবনে প্রবেশ করে তারা তুলনামূলক সাফল্য পায় অনেক বেশি। তাছাড়া, একটু খেয়াল করে সঠিকটা জেনে দেখো, এদেশেও বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা নিজ যোগ্যতা বলে চাকুরী পেয়েছে এবং পাচ্ছে, অন্যের টেলিফোনের জোরে নয়। 

আমি এমন অনেক ছেলেমেয়েকে চিনি ও জানি যারা বাবা-চাচা-মামার জোর বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই নিজের যোগ্যতায় শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাসের জোরে উপরে উঠেছে। রাবারের স্পঞ্জ পায়ে লুঙ্গি পড়ে আমাদের অফিসে এসেছিলেন কোন একজন,  কর্ম গুণে আজ তিনি আমাদের পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। সফলতার আগে মানুষের জীবনে আসে ব্যর্থতা; আর ব্যর্থতা আসে বারবার। প্রতিটি মানুষের জীবনেই ব্যর্থতা আসে এবং আসবেই। মানুষের কোনও বড় স্বপ্নই একবারে পূরণ হয় না। স্মরণ রাখতে হবে— ব্যর্থতা  জীবনের অবিচ্ছেদ্য  অংশ। 

পৃথিবীতে অসাধারণ সাফল্য সেইসব মানুষরাই অর্জন করতে পেরেছেন যাঁরা বারংবার ব্যর্থ হয়েও চেষ্টা করে গেছেন। একবার ব্যর্থ হলে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁরা আবার শুরু করেছেন, তারপর আবার ভুল করেছেন, আবার শুরু করেছেন। এভাবে শত শত বা হাজার হাজার বার ব্যর্থ হতে হতে একটা সময়ে গিয়ে ঠিকই সফল হয়েছেন। এমন অনেক আত্মবিশ্বাসী মানুষের সাফল্যের কাহিনী আমার জানা আছে, এই ছোট্ট পরিসরে এসব বলা সম্ভব নয়, তাতে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে; তাই সেদিকে আজ আর যাচ্ছি না। 

আমার মনে হয় আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারলেই জীবনে অনেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যায়; আত্মকর্মসংস্থান তো তেমন কোন ব্যাপারই নয়। তাছাড়া আত্মবিশ্বাস মানুষকে সব অসাধ্য সাধনে সহযোগিতা করে। আত্মবিশ্বাস শুধু একটি শব্দ নয়, এটি একটি শক্তি; যা মানুষের জীবনের কঠিন পরিস্থিতিও সহজ ভাবে মোকাবেলা করতে সাহায্য করে; আর এর অভাব মস্তিস্কের ভিতরের সমস্ত সম্ভাবনাকে কুঁড়িতেই ঝরিয়ে দেয়। 

পুঁথিগতবিদ্যা কোন বিদ্যা নয়, যদি তা বাস্তব বিবর্জিত হয়। পুস্তক থেকে বিদ্যা মস্তিস্কে ধারণ করে নিজ জীবনে সেসব বাস্তবায়ন করতে হবে, আর গ্রুপ ওয়ার্কিং করে বাস্তবমুখী শিক্ষার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ছোট থেকেই প্রত্যেককে গড়ে উঠতে হবে; সফলতা আসবেই।। 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২২ জুলাই, ২০১৭.


বুধবার, ২২ জুলাই, ২০২০

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কিছু কথা:

৭৫ পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু, তাঁর সন্তান ও আওয়ামী লীগ নিয়ে এদেশে নানান ধরনের কোটারি (বঙ্গবন্ধুর ভাষায়) বা ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং ধারাবাহিকভাবে সেসব প্রচার হয়ে আসছে। স্বাধীনতা ও তৎপূর্ববর্তী-পরবর্তী সময়ের ইতিহাস, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে এদেশে একসময় বিভিন্ন কল্পকাহিনী তৈরি করা হতো এবং অত্যন্ত কূটকৌশলে একটা গোষ্ঠী সেইসব মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিত। আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগকে এক কাতারে দাঁড় করানোর হীন অপচেষ্টা সেই গোষ্ঠী সব সময়ই করতো। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো - মুসলিম লীগ পাক-ভারত বিভক্তির দল আর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ - পাকিস্তান বিভক্তির দল। এক সময় এদেশের মুক্তিকামী ভাল মানুষেরা মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগ গঠন করে এবং জনগণ সেই দলকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে রুপান্তরিত করে; মুসলিম লীগ আস্তে আস্তে পাকিস্তান প্রন্থী সুবিধাবাদী বুর্জোয়া শ্রেণীর দলে পরিণত হয়। 
সুতরাং মুসলিম লীগার বা পাক-প্রন্থী দলগুলোর লোকদের কাছে বাংলাদেশ তাদের নিজের দেশ মনে হবে না - এমনটাই স্বাভাবিক(!) এবং তারা বঙ্গবন্ধুকে খারাপ হিসেবে প্রমাণ করতে চাইবে - এমনটাই চরম সত্য ও নির্মম বাস্তবতা! 

অনেকটা না বুঝে ছাত্রজীবনে বাধ্য হয়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে আঁতাত করা একটা গোষ্ঠীর সাথে আমাকে একই প্লাটফর্মে দাঁড়াতে হয়েছিল। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক কোটারি কখনো আমার কাছে তেমন একটা ভাল লাগতো না, তাদের হত্যার রাজনীতিও কোনদিন পছন্দ করতাম না। জিয়াউর রহমানের নৃশংস হত্যা আমার স্বচক্ষে দেখা অত্যন্ত নোংরা রাজনীতির একটা নির্মম অধ্যায়। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডটা আমার কাছে কিছুটা দোয়াসা ও আবছা বিষয় হলেও জিয়ার হত্যাকান্ডটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার ব্যাপার মনে হয়েছে। জিয়ার ছাত্র সংগঠন ঘটন করার সুবাদে অনেকটা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, কিছুটা সময় তাঁর খুব কাছেও ছিলাম। সেই সুবাদে কেমন করে যেন মানুষটাকে প্রচণ্ড ভালও বেসে ফেলেছিলাম। অনেকের মতো না বুঝে তখন আমিও জিয়াকে খলিফা ওমর (রা)-এর সাথে তুলনা করতাম। 

স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তীর অনেক মিথ্যা ইতিহাস ও কল্পগল্প আমার মাঝেও দানা বাঁধা ছিল। মানিক মিয়া এভিনিউর সেই বিশাল জনসমুদ্রে অনেকের সাথে সেদিন আমিও ষ্টেজে ছিলাম। বিউগলের করুণ সুর আর হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের কান্নার আওয়াজ আজও আমার কানে বাঁজে। যারা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল পরবর্তীতে তারাই একজন আনাড়ি আনকোরা শতভাগ গৃহবধূ বেগম জিয়াকে রাজনীতির পঙ্কিল ময়দানে নামিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে এদেশের রাজনীতিকে গুডবাই জানিয়ে সবসময় তা থেকে একশ গজ দূরে থাকতে চেষ্টা করেছি এবং সকল ধরনের রাজনীতিমুক্ত থেকেছি।
শুকরিয়া! আল্লাহ আমাকে অনেক ভাল রেখেছেন। 

স্বাধীনতার ঘোষণা, জিয়ার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, খালেদা জিয়া বা তারেক জিয়া প্রসঙ্গ উঠলেই প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আজকের বিএনপির রাজনৈতিক নেতাদের অনেক বড় বড় কথা বলতে শুনি, অতিরিক্ত তোষামোদ ও এক ধরনের হীন ভ্রষ্টাচার করতে দেখি; তখন আনমনে শুধু মুচকি হাসি এবং কল্পনা করি - জিয়া যদি আজ বেঁচে থাকতেন হয়তো এই সব নীতিহীন ভ্রষ্টাচার নেতানেত্রীদের মাথায় ফাইভ স্টার ঠেকিয়ে গুলি করতেন। 

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের কত মিথ্যা বিকৃত ইতিহাসই না সেইসময় আমরা জানতাম। মাওলানা ভাসানী ও অন্যান্য আরোও কিছু নেতা সম্বন্ধে কত কি বাড়াবাড়ি কথাই না শুনতাম। বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে অন্যদের গুরুত্ব দিয়ে কত মিথ্যা ইতিহাসই না আমাদের মাঝে প্রচার করা হতো, ভুল শিখানো হতো। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী না পড়লে হয়তো অনেক কিছু অজানা অপূর্ণই থেকে যেত; স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট ও প্রকৃত ইতিহাস এতোটা কোনদিনও জানতে বা বুঝতে পারতাম না। আমার মাঝে বদ্ধমূল থাকা অনেক মিথ্যা ইতিহাস ও ভুল ধারনার আজ পরিসমাপ্তি ঘটেছে। 

যত ধরনের মিথ্যা অপপ্রচার ও প্রোপাগাণ্ডা  আছে তার সবই একসময় রাষ্ট্রীয়ভাবে এদেশে প্রচার করা হতো, মুক্তিযোদ্ধারাও তখন খুব অসহায় ছিল। ৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ সময়টা এদেশটাকে যারা শাসন করেছে তাদের আসল রূপ-স্বরূপ কি ছিল তা আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার মত অনেকের কাছেই। ৪৭ পূর্ববর্তী সেই ষড়যন্ত্রকারী বেনিয়াগোষ্ঠি, বঙ্গবন্ধুর ভাষায় সেদিনের কোটারি করা লোকগুলোই বংশ পরম্পরায় বার বার ঘুরেফিরে এ অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত হয়েছিল, ছলে-বলে কৌশলে তারাই বার বার ক্ষমতায় এসেছে; যারা সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে শুধু নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। খুব অল্প কয়েকটা দিন বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনব্যবস্থা চালাতে পেড়েছিলেন।

একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলেই বুঝা যাবে সেই কয়কটা দিনের প্লানিংই আজ পর্যন্ত এখনো এদেশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তারপরও কমবেশি যতটুকো উন্নতি উন্নয়ন বাংলাদেশে হয়েছে, বর্তমান পাকিস্তানে কি তার কিয়দংশও হয়েছে? তবে কেন এতো পাকিস্তান প্রীতি? যদি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও বেঁচে থাকতেন তবে হয়তো পৃথিবীর সব দেশ সব জাতিকে অতিক্রম করে আজ আমরা উন্নত একটা দেশে রূপান্তরিত হতাম, অগ্রগামীদের দলে শরিক হতাম। তিনি এদেশটাকে এদেশের মানুষকে কতোটা ভালবাসতেন তা তাঁর লেখার প্রতিটি শব্দ প্রতিটি লাইন থেকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট প্রতীয়মান।
 
মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বাঙালি জাতির প্রকৃত স্বাধীনতার মূলমন্ত্র পাঠকারী, সৌহার্দের প্রতীক ও স্বাধীনতার স্থপতি সৃষ্টিকারী। তাঁকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে এই আত্মজীবনীতে তিনি বাঙালি জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। বইয়ের ৪৮ নং পৃষ্টায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন - "শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, নীচতা ছিল না, দল মত দেখতেন না, কোটারি করতে জানতেন না, গ্রুপ করারও চেষ্টা করতেন না। উপযুক্ত হলেই তাকে পছন্দ করতেন এবং বিশ্বাস করতেন। কারণ তাঁর আত্মবিশ্বাস  ছিল অসীম। তাঁর সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন। এজন্য তাঁকে বার বার অপমানিত ও পরাজয়বরণ করতে হয়েছে। উদারতা দরকার, কিন্তু নিচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগ্ণের ক্ষতি হয়।

আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল 'আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি।' পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, 'পরশ্রীকাতরতা'। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে 'পরশ্রীকাতর' বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ার খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।

অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।"

স্বাধীনতার এতোগুলো বছর পেরিয়ে গেল, একটা স্বাধীন দেশ আমরা পেলাম, স্বাধীন দেশে বসবাস করছি, অথচ আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন অগ্রগতি এখনো তেমন একটা আহামরি কিছু হয়নি; সামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধত্ব সেই আগের মতো একই রকম আছে। ধর্মকে আজও এক দল রাজনৈতিক ঢাল হিসেবেই সব সময় ব্যাবহার করছে। আজকের জাপান চিনের কথা চিন্তা করলে মনে হয় আমরা তাদের থেকে যোজন যোজন দূরে পিছিয়ে আছি। 

আমাদের দেশে কতোটুকো কি হয়েছে এই মুহুর্তে তা আমি বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না; প্রত্যেকে নিজে নিজের মতো মূল্যায়ন করে নিবেন। যতটুকো যা হয়েছে তাও অত্যন্ত ধীরগতিতে হয়েছে। মনে হয় যেন সেই ৪৭ পূর্ববর্তী বা ৫২ পূর্ববর্তী বা ৭১ পূর্ববর্তী সময়েই আমরা বার বার ফিরে গিয়েছিলাম, সেই সব শাসকরাই ঘুরেফিরে আমাদের দেশটাকে শাসন করেছিল। আশ্চর্য! আজও এদেশে ধর্মীয় উস্কানিতে দাঙ্গা হয়।

জীবনযাত্রার মানের কিছুটা পরিবর্তন ঘটলেও রাজনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন তেমন কিছুই ঘটেনি। রাজনীতিবিদদের মানসিকতার পরিবর্তন এতটুকোও হয়নি, বরং রাজনীতিবিদদের চারিত্রিক অবক্ষয় সর্বনিন্ম ও নিকৃষ্ট পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। চাটুকারিতা, মিথ্যাচার, শঠতা এখন রাজনৈতিক নেতানেত্রীর চারিত্রের অন্যতম ভূষণ। তখন আমরা যারা স্কুল কলেজে পড়তাম, বিশেষ করে তাদের কাছে স্বাধীনতা সম্বন্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন সব তথ্য ও অপপ্রচার করা হতো, যেন আমরা সবায় মনে করি - বঙ্গবন্ধু খুবই সাধারণ একজন। স্বাধীনতার স্থপতিকে সবায় যেন ভুল বুঝে এই অপচেষ্টাই তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হতো এবং নানানভাবে তখনকার প্রজন্মকে মিথ্যা বুঝানোর চেষ্টা চলতো। 

দীর্ঘদিন এমন অপপ্রচারের ফলে তখনকার প্রজন্মের অনেকের মাঝেই এমন সব প্রশ্নের অবতারণা হয়েছিল - হয়তো বঙ্গবন্ধু তাঁর সন্তানকে সত্যি সত্যি মানুষ করতে পারেননি, শাসন করেননি। শেখ কামাল সত্যি সত্যিই বুঝি মেজর ডালিমের স্ত্রীকে অপহরণ করেছিল বা বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতির সাথে জড়িত ছিল। আরো কত সব মিথ্যা অপপ্রচার চলত তার কোন ইয়ত্তা নেই।

যদিও যুদ্ধের সময়ের প্রজন্ম আমরা, কিন্তু বয়স ছিল কম। ৭৫-এর পর অনেকের মুখে এই সব মিথ্যা কথা আমরা শুনতাম। যেমন - আমাদের পাড়ার এক বড়ভাই একদিন তার এক বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল - এই সেই সাদেক যে শেখ কামালের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করেছে। আমরা অনেকে কথাটা শুনে তার মুখ থেকে সেই ঘটনা শোনার জন্য উৎগ্রীব হয়ে উঠলাম। যা শুনেছিলাম তা অনেকটা এই রকম - একটা জীপ নিয়ে তারা বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করে টাকা ছড়াতে ছড়াতে বাসাবো হয়ে মাদারটেক তালতলার দিকে চলে গিয়েছিল। 

কিছুদিন পর এমন আরেকজনকে সে নিয়ে আসল এবং বলল - সেও নাকি বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতির সাথে জড়িত। কিন্তু তার মুখ থেকে অন্য এক আজগুবি গল্প শুনেছিলাম। একটা গল্পের সাথে আরেকটা গল্পের কোন মিল ছিল না। এমনভাবে অনেক গল্প কল্পকাহিনী তখন বাতাসে ভেসে বেড়াত। যারা এসব কল্পকাহিনী তৈরি করত তারা বা তাদের সন্তানরা হয়তো ৭১-এ গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে বাড়ির পর বাড়ি ডাকাতি করত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কি কখনো তা করেছিলেন? খুব সাধারণ বিবেকও তো এসব বুঝবে? কোন ভদ্রলোকের সন্তান কোনদিনও ব্যাংক ডাকাতি করতে পারে না। তাছাড়া একজন জাতিরপিতার সন্তান, দেশের প্রেসিডেন্টের সুশিক্ষিত সন্তান, কি করে ব্যাংক ডাকাতি করতে পারে বা নিজের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও কি করে অন্যের স্ত্রীকে অপহরণ করতে পারে তা কতটুকো বিশ্বাসযোগ্য, কতটা গ্রহণযোগ্য? 

আমরা তখন গুলবাগ থাকতাম। আমাদের বাসার খুব কাছাকাছি মালিবাগ পাবনা কলোনীর ঠিক উত্তর পাশে চিকণ রাস্তার ওপারে মেজর ডালিমের একটা বাড়ি ছিল। ঐ বাড়ির আশেপাশে আমরা বন্ধুরা মিলে প্রায়ই আড্ডা দিতাম। পাবনা কলোনির সামনে ফাঁকা স্থানে কোট করে শীতে ব্যাডমিন্টনও খেলতাম। জনশ্রুতি ছিল ঐ বাড়ি থেকেই নাকি শেখ কামাল ডালিমের বউকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল; যা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। গুলবাগ আমাদের বাসা ও ডালিমের বাসার দূরত্ব ছিল খুবই কম; যদি সত্য হতো অবশ্যই আমরা জানতে পারতাম। আমরা কোনদিনও দেখিনি সেই বাসায় মেজর ডালিম বা তার স্ত্রী বসবাস করতে। 

একদিন এক পত্রিকায় পড়লাম, সেখানে লেখা - লেডিস ক্লাব থেকে শেখ কামাল মেজর ডালিমের বউকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এখনো অনেক সময় ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে এইসব মিথ্যাচার দেখে অনেকটা আঁতকে উঠি, চোখে পড়লেই প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করি। যতসব বানানো আজগুবি গল্প দীর্ঘদিন ধরে এদেশের মানুষের মাঝে অত্যন্ত কূটকৌশলে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, হচ্ছে। যারা এসব ছড়াত বা ছড়ায় তারা হয়তো সত্যের মহিমা জানে না? ব্রিটিশ আমল থেকেই এমন একটি অর্বাচীন গোষ্ঠীর উদয় হয়েছিল, যারা আজও আমাদের সমাজে আমাদের সাথে আমাদের মাঝেই মিশে আছে। ধর্মের দোহাই, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা প্রোপাগান্ডা যাদের মূল হাতিয়ার, সাময়িক স্বার্থ হাসিল যাদের মূল উদ্দেশ্য। তারা কোনদিনও এই দেশ এই জাতিকে ভালবাসেনি, ভালবসতে পারেনি আর পারবেও না।

অনেকদিন ধরে বিভিন্ন টিভি মিডিয়ায় অনেকের মুখে শুনে আসছি, বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া ভার্চুয়াল মিডিয়া জুড়েও এই সব অপপ্রচার বেশ জোরালো - শেখ মুজিব স্বাধীনতা চাননি, চেয়েছিলেন স্বায়ত্তশাসন। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে এদেশের অতি উৎসাহী একটি দলের একটি গ্রুপের অতি বাড়াবাড়ি প্রায়শই চোখে পরে। আমার ধারণা এইসব এক ধরনের রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি। যারা এই সব বলেন বা করেন, তাদের আমি সবিনয় অনুরোধ করবো বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্নজীবনী পড়তে, স্বাধীনতার গোড়াপত্তন ও প্রকৃত ইতিহাস জানতে। বাংলাদেশ শুধুমাত্র ১৯৭১-এর যুদ্ধের ফসল যারা ভাবেন বা শুধুমাত্র মেজর জিয়ার একটিমাত্র ঘোষণার ফসল যারা মনে করেন, আমার মনে হয় তারা এখনো বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন এবং তাদের বলছি - জিয়া যদি বেঁচে থাকতেন আমি নিশ্চিত আপনার মাথায় ফাইভ স্টার ঠেকিয়ে তিনি একটা গুলি করে আপনার পৈত্রিক খুলিটা উড়িয়ে দিতেন।

১৯৪২ বা তারও পূর্ব থেকে এই বাংলাদেশ সৃষ্টির স্বপ্নের সূচনা। আমি নিজে দেখেছি এবং নিজ কানে জিয়ার মুখ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রশংসার কথা শুনেছি; জিয়াকে দেখেছি - একান্তে বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, পটভূমি ও মতধারায় ভিন্নতা থাকলেও ব্যক্তি জিয়া মিথ্যাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও বঙ্গবন্ধুর খুন দেশবিদেশের একটা বিশাল ষড়যন্ত্রের ফসল। এসব বুঝার ক্ষমতা আমাদের মত ছোট চিন্তাশক্তির মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। 

আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিশেষ করে আশি নব্বই দশকের প্রজন্ম মিথ্যা ইতিহাস ও মিথ্যা প্রোপাগান্ডা শুনতে শুনতেই বড় হয়েছে। অনেকবার অনেকদিন এইসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লেখেছি কিছু প্রত্যক্ষ ও আবছা ধারণা থেকে, বিভিন্ন ইতিহাসভিত্তিক বইপুস্তক থেকে। কিন্তু যেদিন আমি জাতিরজনকের নিজ হাতে লেখা অসমাপ্ত আত্নজীবনী প্রথম পড়লাম সেইদিন থেকে আমার সব ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সংকোচ-সংশয় কেটে গেছে। এখন আর কোন ধরনের কোন দোয়াসা আমার মাঝে নেই, আমি দ্বিধাহীনভাবে এখন অনেক কিছুই বুঝতে পারি বলতে পারি, যা ১০০% সঠিক। 

এদেশ সৃষ্টির সব সত্য ইতিহাসই আজ আমার চোখের সামনে সূর্যের মত জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। কারো কাছ থেকে এখন আর কোন কিছু আমার ধার করার নেই জানার নেই। কারো কাছ থেকে কোন স্বার্থ আদায় করার ইচ্ছা বা চাওয়া পাওয়ার প্রত্যাশা আমার কোনদিনও ছিল না আজও নেই। প্রকৃত সত্যকে উন্মোচনের অভিপ্রায়ে লেখেছি লেখি লেখে যাবো। কাউকে কোনদিন ভয় বা তোয়াজ করে জীবনে কিছু করিনি আর করবও না। সত্য উন্মোচনে ব্রত ছিলাম আছি থাকবো ইনশাল্লাহ। 

বহুদিন ধরে ভাবছি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী নিয়ে দু'চার কথা লেখতে চেষ্টা করব, কিন্তু পর মুহুর্তেই নিজকে সংবরণ সংযত করেছি। এতোবড় মহান ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আমার মত একজন ক্ষুদ্র মানুষ কি করে কি করবো? আমার পক্ষে কতোটুকো কি-ই-বা করা বা লেখা সম্ভব বা আউদ তা সম্ভব হবে কি-না? পাঠক সমাজই-বা তা কেমনভাবে নেবে? - এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অনেকদিন পার করলাম, আর নয়; কেউ পড়ুক বা না পড়ুক আমার হৃদয় নিঃসৃত কথাগুলো লেখে যাচ্ছি, কেউ প্রকাশ করুক বা না করুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণের নেতা, বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কিছু কথা কিছু অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে ইচ্ছে করছে, করছি।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম যখন তা হাতে পাই তৎক্ষণাৎ অনেক উৎগ্রীবতা নিয়ে বইয়ের প্রতিটা পৃষ্টা প্রতিটা লাইন প্রতিটা শব্দ অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পড়েছি এবং আজও বার বার পড়ি; যতই পড়ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি, চমৎকৃত হচ্ছি।
কত সরলসরলভাবে সহজসরল ভাষায় তিনি এদেশের জন্মের আদি অন্ত পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তুলে ধরেছেন এবং সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিখ্যাত সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও কত চমৎকারভাবে তিনি বুঝতে পেরেছেন, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লেখায় অতি সহজ ভাবে তুলে ধরেছেন। কত সহজভাবে তিনি এদেশের সাধারণ মানুষ থেকে বিখ্যাত সব মানুষের আপন হয়েছেন এবং সবার সাথে মিশেছেন; জনগণকে কতটা বুঝতেন এবং আপন করে নিতেন, সবার কতটা কাছের মানুষ ছিলেন। এই বইটা না পড়লে হয়তো আলোছায়ার ঘূর্ণিপাক থেকে কোন দিনও আমি মুক্ত হতে পারতাম না। আমার মনে হয় - এই অসমাপ্ত আত্নজীবনীর খণ্ডিত অংশ ক্লাশ অনুযায়ী জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত; আওয়ামী লীগের সমালোচকদের এই বই অবশ্যই পড়া উচিত। আওয়ামী লীগের প্রতি নেতাকর্মীর এই বইটি বারংবার মনোযোগ দিয়ে পড়া উচিত এবং এদেশের রাজনীতিবিদদের জন্য এই বইটা হতে পারে অন্যতম দিকনির্দেশনা। 

যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অযথা অপ্রয়োজনে কটাক্ষ করেন তাদের বলবো - ইতিহাসের মূল না যেনে শুধুমাত্র আগা নিয়ে লাফালাফি করবেন না। ইতিহাস বিকৃতির কবলে পড়ে যারা বিভ্রান্ত হয়েছেন তাদের বলবো সত্য ইতিহাস জানার অভিপ্রায়ে এই বইটি পড়তে। যারা বঙ্গবন্ধুকে একেবারে দেখতে পারেন না, তারাও একটিবার বইটি পড়েন এবং অন্তর দিয়ে সত্য বুঝার ও জানার চেষ্টা করেন। আমি যখন প্রথম এই বইটি পড়তে শুরু করি তখন অযাচিতভাবে মনের অজান্তেই নিজের মধ্যে কেমন যেন একটা শিহরণ অনুভব করতে থাকি, খাওয়া দাওয়া ভুলে বিরামহীনভাবে পড়ে অসমাপ্ত এই পাণ্ডুলিপি সমাপ্ত করি। এই বয়সে এমন ইমোশনাল হয়ে বই নিয়ে বসে থাকব তা কল্পনারও অতীত। কি করবো?

বইয়ে প্রতিটি পাতায় যেন লুকিয়ে আছে আমার প্রিয় বাংলাদেশ এবং আমার বাংলাদেশের ইতিকথা। কিছু নিন্দুক বঙ্গবন্ধুর বংশ পরিচয় ও মর্যাদা নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ার বিভিন্ন বিভ্রান্ত আজও ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের জন্য একটি চপটেঘাত - বইয়ের ১২ নং পৃষ্টায় তিনি লিখেছেন- "আমার জন্ম হয় টুঙ্গিপাড়া শেখ বংশে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশের যে একদিন সুদিন ছিল তার প্রমাণস্বরূপ মোগল আমলের ছোট ছোট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলি আজও আমাদের বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করে আছে। বাড়ির চার ভিটায় চারটা দালান। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের একটা মাত্র দরজা, যা আমরাও ছোট সময় দেখেছি বিরাট একটা কাঠের কপাট দিয়ে বন্ধ করা যেত। একটা দালানে আমার এক দাদা থাকতেন। এক দালানে আমার এক মামা আজও কোনোমতে দিন কাটাচ্ছেন। আর একটা দালান ভেঙে পড়েছে, যেখানে বিষাক্ত সর্পকুল দয়া করে আশ্রয় নিয়েছে। এই সকল দালান চুনকাম করার ক্ষমতা আজ তাদের অনেকেরই নাই। এই বংশের অনেকেই এখন এ বাড়ির চারপাশে টিনের ঘরে বাস করেন। আমি এই টিনের ঘরের এক ঘরেই জন্মগ্রহণ করি।"

অতঃপর ১৮ নং পৃষ্ঠায় তিনি লেখেন- "আমার জন্ম হয় ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে। আমার আব্বার নাম শেখ লুৎফর রহমান। আমার ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদ একটা এম ই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের অঞ্চলের মধ্যে সেকালে এই একটা মাত্র ইংরেজি স্কুল ছিল, পরে এটা হাইস্কুল হয়, সেটি আজও আছে। আমি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে লেখাপড়া করে আমার আব্বার কাছে চলে যাই এবং চতুর্থ শ্রেণীতে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হই। আমার মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। তিনি কোনোদিন আমার আব্বার সাথে শহরে থাকতেন না। তিনি সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন আর বলতেন, "আমার বাবা আমাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন যাতে তাঁর বাড়িতে আমি থাকি। শহরে চলে গেলে ঘরে আলো জ্বলবে না, বাবা অভিশাপ দেবে।"

এই আত্নজীবনীর লেখাগুলো ব্রিটিশ থেকে পাক-ভারত বিভক্তির ইতিহাস অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে, ভাষা আন্দোলন ও তৎপরবর্তী পাকিস্তান আমলের পাকিস্তানিদের বাংলা শাসনের গভীর ষড়যন্ত্র - শাসন শোষণের নমুনাচিত্র সবই প্রকাশিত হয়েছে। 

১৯৪১ সালে বঙ্গবন্ধু মেট্রিক পরীক্ষা দেন, সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেই থেকে তিনি অখণ্ড ভারতের নিঃস্বার্থ মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সান্নিধ্য লাভ করতে সামর্থ্য হন এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সান্নিধ্যে অল্প বয়সে আল্প সময়েই ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং সুষ্ঠ রাজনীতির খুঁটিনাটি আয়ত্ত করতে সক্ষম হন। সেই থেকে ওতপ্রোতভাবে তিনি মিশে থাকেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে এবং সোহরাওয়ার্দীর আদর্শ বুকে ধারণ করে কলেজ জীবনের শুরু থেকেই তিনি এই বড় মাপের নেতার সান্নিধ্য ও বিশ্বস্ততা অর্জন করে নিতে সক্ষম হন।

বইয়ের ২৯ নং পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- "তিনি যে সত্যি আমাকে ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিন পর্যন্ত। যখনই তাঁর কথা এই কারাগারে বসে ভাবি, সেকথা আজও মনে পড়ে। দীর্ঘ বিশ বৎসর পরেও একটুও এদিক ওদিক হয় নাই। সেইদিন থেকে আমার জীবনের প্রত্যেকটা দিনই তাঁর স্নেহ পেয়েছি। এই দীর্ঘদিন আমাকে তাঁর কাছ থেকে কেউই ছিনিয়ে নিতে পারে নাই এবং তাঁর স্নেহ থেকে কেউই আমাকে বঞ্চিত করতে পারে নাই।"

এতো বড় মাপের একজন মানুষের সান্নিধ্যে থেকে যিনি রাজনীতি ও মানবসেবা শিখেছেন, নিশ্চয় তিনি কোন সাধারণ মানুষ নন? তাছাড়াও শেরেবাংলা একে ফজলুল হক সাহেবও তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, এমনকি নাতি বলে সম্বোধন করতেন। বঙ্গবন্ধু যখনই তাঁর স্মরণাপন্ন হতেন তিনি সাড়া দিতেন। 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' ঘটনের প্রথম মিটিংয়েও শেরেবাংলা উপস্থিত ছিলেন। 

মাওলানা আব্দুল হামীদ খাঁন ভাসানী ছিলেন 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু জয়েন সেক্রেটারি; এটি একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কিছুদিন পরই যা 'আওয়ামী লীগ'-এ রুপান্তরিত হয় এবং ভাসানী সভাপতি, বঙ্গবন্ধু সাধারণ সম্পাদক হন। মাওলানা আব্দুল হামীদ খাঁন ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক সহপাঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; যিনি কিনা দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর কারাসাথিও ছিলেন।

শুধুমাত্র এদেশ ও এদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তির চিন্তায় যে মানুষটা মা-বাবা, স্ত্রী সন্তান ও আত্নিয়স্বজন আপনজন সবাইকে ফেলে রেখে জীবনের বেশিরভাগ সময় জেলের অভ্যন্তরে আলোবাতাসহীন ঘরে অন্তরীণ থাকতেন, নিশ্চয় তিনি কোন অর্থলোভে বা ক্ষমতালোভে এসব করেননি? এই মহা মানবের জন্ম না হলে হয়তো বাঙালির মুক্তি কোনদিনও মিলত না।

মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে ১২৮ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন- "মাওলানা ভাসানীর উদারতার অভাব, তবু তাঁকে আমি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। কারণ, তিনি জনগণের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত। যে কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারে নাই - এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এদেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং ত্যাগ আমাদের করতে হবে পাকিস্থানের জনগণকে সুখী করতে হলে।"

১২৫ পৃষ্ঠার তিনি একটি মজার ঘটনা তুলে ধরেন। সিরিয়াস কথার ফাঁকে হটাৎ এই অংশ পড়ে আমার খুব ভাল লেগেছে তাই আপনাদের জন্য তা তুলে ধরলাম। কত সহজসরল ও বড় মনের মানুষ হলে অকপটে একজনের পক্ষে এমন সব কথা তুলে ধরা সম্ভব - তাই ভাবছি। অবশ্য এই বইয়ের অনেক জায়গায়ই তিনি রসিকতার মাধ্যমে তাঁর মনের এমন বিশালতার পরিচয় দিয়ে গেছেন।

"আমি ও আলতাফ হোসেন সাহেব ঠিক করলাম, মাওলানা শামসুল হক সাহেবের (যিনি এখন লালবাগ মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল) সাথে দেখা করব। মাওলানা সাহেবের বাড়ি আমার ইউনিয়নে। জনসাধারণ তাঁকে আলেম হিসেবে খুবই শ্রদ্ধা করত। আমরা দুইজন রাত দশটায় একটা এক মাঝির নৌকায় রওয়ানা করলাম। নৌকা ছোট, একজন মাঝি। মধুমতী দিয়ে রওয়ানা করলাম। কারণ, তাঁর বাড়ি মধুমতীর পাড়ে। মধুমতীর একদিকে ফরিদপুর, অন্যদিকে যশোর ও খুলনা জেলা। নদীটা এক জায়গায় খুব চওড়া। মাঝে মাঝে, সেই জায়গায় ডাকাতি হয়, আমাদের জানা ছিল। ঠিক যখন আমাদের নৌকা সেই জায়গায় এসে হাজির হয়েছিল আমি তখন ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পানির দেশের মানুষ নৌকায় ঘুমাতে কোন কষ্ট হয় না। কাজী সাহেব তখনও ঘুমান নাই। এই সময় একটা ছিপ নৌকা আমাদের নৌকার কাছে এসে হাজির হল। চারজন লোক নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করল, আগুন আছে কি না? আগুন চেয়েই এই ডাকাতরা নৌকার কাছে আসে, এই তাদের প্রন্থা। আমাদের নৌকার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, "নৌকা যাবে কোথায়?" মাঝি বলল, টুঙ্গিপাড়া, আমার গ্রামের নাম। নৌকায় কে? মাঝি আমার নাম বলল। ডাকাতরা মাঝিকে বৈঠা দিয়ে ভীষণভাবে একটা আঘাত করে বলল, "শালা আগে বলতে পার নাই শেখ সাহেব নৌকায়।" এই কথা বলে নৌকা ছেড়ে দিয়ে তারা চলে গেল। মাঝি মার খেয়ে চিৎকার করে নৌকার হাল ছেড়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। মাঝির চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কাজী সাহেব জেগে ছিলেন, তার ঘড়ি টাকা আংটি সব কিছু লুকিয়ে ফেলেছিলেন ভয়ে। কাজী সাহেব সৌখিন লোক ছিলেন, ব্যবসায়ী মানুষ, টাকা পয়সাও ছিল অনেক। আমি জেগে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি? কাজী সাহেব ও মাঝি আমাকে এই গল্প বলল। কাজী সাহেব বললেন, "ডাকাতরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে, আপনার নাম করেই বেঁচে গেলাম, না হলে উপায় ছিল না।" আমি বললাম, "বোধহয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের একজন বলে ধরে নিয়েছে।"

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে, পাক-ভারত স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭ সালে। তাঁর জীবনের প্রথম বিদেশ সফর ছিল চিনের এক শান্তি সম্মেলনে। জীবনের প্রথম বিরোধী দলের একজন সদস্য হয়ে তিনি সেই সফর করেন। এই বইয়ের ২৪৪ পৃষ্ঠায় তিনি তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন - "আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চিনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউ নয়। ফলে দেশের জনগণের মধ্যে ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। একটা মাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল সাদা চামড়ার জায়গায় কালা চামড়ার আমদানি হয়েছে।" 

দুই পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ মূল্যায়নে ২৫০ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেন- "পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাট প্রভেদ রয়েছে। সেখানে রাজনীতি করে সময় নষ্ট করার জন্য জমিদার, জায়গিরদার ও বড় বড় ব্যবসায়ী। আর পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত না থাকার জন্য জনগণ রাজনীতি সম্বন্ধে বা দেশ সম্বন্ধে কোন চিন্তাও করে না। জমিদার বা জায়গিরদার অথবা তাদের পীব সাহেবরা যা বলেন, সাধারণ মানুষ তাই বিশ্বাস করে। বহুকাল থেকে বাংলাদেশে কৃষক আন্দোলন হওয়াতে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের চেয়ে অনেক বেশি। এছাড়াও স্বাধীনতা আন্দোলনেও বাঙালিরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে।"

৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৫৬-র নির্বাচন, নির্বাচনে জিতে স্বল্পকালীন সরকারের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ এবং তারই পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিকতায় ৭১-এ আমাদের স্বাধীনতা। সকল রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতিটিতেই বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল অগ্রণী। বাংলাদেশ সৃষ্টিরই ইতিহাস যেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিচ্ছবি। অসমাপ্ত এই আত্মজীবনী যদি সমাপ্ত হতো পূর্ণতা পেতো, হয়তো বাঙালি জাতির ভাগ্যই বদলে যেতো; কিন্তু হায়েনা বেনিয়া গোষ্ঠী দেয়নি এই জীবনীর স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি হতে।

বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। বাংলাদেশ সৃষ্টির অদ্বিতীয় মহানায়ক বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালির মুক্তির পথপ্রদর্শক। অতএব, বাংলাদেশের যে নাগরিক তাঁকে বাঙালির জাতিরপিতা হিসেবে স্বীকৃতি না দেবে আমি নিশ্চিত বলতে পারি - সে বাঙালি নয় পাকিস্তানি। আমার ধারনা - তার কোন অধিকারই নেই এদেশের আলো বাতাস গ্রহণ করার।। 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
০৮-০১-২০১৬.

সোমবার, ২০ জুলাই, ২০২০

স্বীকৃত মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও কিছু কথা:

'মুনাফিক' আরবিতে - منافق, বহুবচনে মুনাফিকুন একটি ইসলামিক পরিভাষা, যার অর্থ প্রতারক বা 'ভন্ড ধার্মিক'; যে প্রকাশ্যে ইসলাম চর্চা করে, কিন্তু গোপনে অন্তরে কুফরী বা ইসলামের প্রতি অবিশ্বাস লালন করে। আর এ ধরনের প্রতারনাকে বলা হয় 'নিফাক', আরবি - نفاق‎‎। প্রকৃতপক্ষে 'মুনাফিক' শব্দটি 'নফক' শব্দ থেকে গঠিত; নফকের অর্থ—গর্ত, ছিদ্র, সুড়ঙ্গ, বের হওয়া, খরচ করা, ব্যয় করা ইত্যাদি। কারো কারো মতে, ‘নাফেকুল ইয়ারবু’ (পাহাড়ি ইঁদুর) থেকে মুনাফিক শব্দটি গঠিত; পাহাড়ি ইঁদুরকে ‘নাফেকুল ইয়ারবু’ বলা হয়। কারণ পাহাড়ি ইঁদুর অত্যন্ত ধূর্ত, এরা পাহাড়ে অনেক গর্ত খনন করে বসবাস করে। এদের মারার জন্য এক গর্তে পানি বা অন্য কিছু দিলে অন্য গর্ত দিয়ে তারা বের হয়ে পালিয়ে যায়, ফলে ওদের সহজে মারা যায় না। মুনাফিকরাও অনুরূপ ধূর্ত; তাদের সহজে ধরা যায় না চেনা যায় না। 

পবিত্র কুর'আনুল কারীমের শতাধিক আয়াতে মুনাফিকদের বিষয়ে স্পষ্ট আলোচনা এসেছে এবং মুসলমানদের জন্য তাদের অমুসলিম শত্রুদের তুলনায় মুনাফিকদের অধিক বিপজ্জনক শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সহীহ বুখারী হতে উদ্ধৃত; আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত — রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, "একজন মুনাফিকের তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে — ১). যখন সে কোন কথা বলে, সে মিথ্যা বলে। ২). যখন সে কোন প্রতিশ্রুতি দেয়, সবসময় তা ভঙ্গ করে। ৩). যদি তুমি তাকে বিশ্বাস করো, সে অসৎ উপায় অবলম্বন করে। -(বুখারী -২৬৮২, মুসলিম -১/২৫)

আরেক বর্ণনায় এসেছে — আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত; নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে বিদ্যমান সে হচ্ছে খাঁটি মুনাফিক। যার মধ্যে এর কোনো একটি স্বভাব থাকবে তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থেকে যায়। এগুলো হচ্ছে; ১). আমানতের খেয়ানত করা। ২). কথা বললে মিথ্যা বলা। ৩). অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করা। এবং ৪). বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীলভাবে গালাগালি করা। -(বুখারী -২২৫৯, মুসলিম -১/২৫) 

হুজুরপাক (সাঃ)-এর সময়কার মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই সম্বন্ধে অনেকেই জানতে চেয়েছেন, এবং তার জানাজা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) পড়িয়েছেন কি-না, পড়িয়ে থাকলে কেন পড়িয়েছিলেন এ'সব জানতে চেয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মাতৃসূত্রে যিনি ছিলেন ইবনে সালুল নামে পরিচিত, তিনি  বনু খাজরাজ গোত্রের প্রধান ছিলেন এবং মদিনার একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিও ছিলেন। হুজুরপাক (সাঃ) মদিনায় আসার পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, যদিও তার ধর্মান্তরিত হওয়ার বিশ্বস্ততা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। হুজুরপাক (সাঃ)-এর সাথে তার বারংবার দ্বন্দ্বের কারণে ইসলামী ঐতিহ্য অণুসারে তাকে একজন মুনাফিক (ভণ্ড, প্রতারক) এবং মুনাফিকদের সর্দার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়; এর পিছনের কারণ অনেক।

ইবনে উবাই ছিলেন বনু খাজরাজ গোত্রের দলনেতাদের মধ্যে অন্যতম একজন। তৎকালীন সময়ে বনু খজরাজ গোত্র বনু আউস গোত্রের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। ফিজার যুদ্ধের সময় প্রথম দিনের যুদ্ধে ইবনে উবাই খাজরাজ গোত্রের একটি অংশের নেতৃত্ব দেন, কিন্তু দ্বিতীয় দিনে তিনি সরে আসেন। এরপর অন্য আরেক নেতার সাথে ইহুদি জিম্মিদের হত্যার বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হওয়ার কারণে বুয়াস যুদ্ধেও তিনি যোগ দেন নি। উক্ত দ্বন্দ্বের সময় বনু কায়নুকা গোত্রের কিছু ইহুদি বন্ধু তার জীবন রক্ষা করে, যা তিনি এভাবে বলতেন : "গাড়িবহরে সজ্জিত ৩০০ সেনা, সাথে আরও ৪০০ জন খালি হাতে, তারা হাদাইক এবং বোয়াসের ময়দানে আমাকে প্রকৃত শত্রু থেকে রক্ষা করেছে।"

ইবনে উবাই সেই সময় মদিনার সেই গোত্রীয় শত্রুতা মেটানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন এবং ঐ দুই গোত্রের শত্রুতার আংশিক মিটমাটও করতে সক্ষম হন। এ কারণে উভয় গোত্রই তার নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দেয়। তাই ইসলামের পূর্বে মদিনায় তিনি উচ্চ সামাজিক মর্যাদা অর্জন করেছিলেন, এবং তার সমর্থকরা তাকে রাজা বানানোরও পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় হুজুরপাক (সাঃ)-এর আগমনের ফলে তা বাস্তবায়িত হতে পারে নি। গোত্রে গোত্রে বিবাদ তখনো পরিপূর্ণভাবে মিটছিল না, এ কারণে কিছু মদিনাবাসী বিকল্প কোনো বিরোধ নিষ্পত্তিকারকের সন্ধান করছিল এবং সে কারণেই তারা হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে মদিনায় নিয়ে আসেন; যার ধর্মপ্রচারের কারণে ইতোমধ্যেই তিনি তাঁর বাসস্থান মক্কায় সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। আর আল্লাহ কর্তৃক প্রতিশ্রুত হিসেবে দাবিদার হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমনে তখন জণমনে ইবনে উবাইয়ের প্রভাব নিমিষেই মিলিয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনা ইবনে উবাইয়ের মনে ঈর্ষার জন্ম দেয়, কিন্তু সে তার শান্তিপূর্ণ আচার ব্যবহারের মাধ্যমে সকলের কাছে তা গোপন রাখে। সবকিছুর পরও ইবনে উবাইয়ের মর্যাদা আগের মতোই অক্ষুণ্ণ থাকে।

মদিনায় হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রবেশ করার পর স্থানীয় আরব জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ ইসলাম গ্রহণ করে। ইবনে উবাইও এর সাথে মানিয়ে নিল (ম্যাক্সিম রবিন্সনের মতে) এই ভেবে যে, এর বিরোধিতা করার চেয়ে এতে যোগদান করাই অধিক বুদ্ধিমানের কাজ হবে। অনেকের মতে ইবনে উবাই হুজুরপাক (সাঃ)-এর হিজরতের পরপর সা'দ ইবনে মুয়াজ (রাঃ)-এর সাথে একই সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলামের ঐতিহ্যগত ইতিহাসে ইবনে উবাইয়ের ধর্মান্তরিত হওয়াকে প্রতারণা বলে মনে করা হয় এবং তাকে মুনাফিকদের সর্দার হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। রবিন্সনের মতে, "ইহুদিদের সাথে যোগাযোগ থাকার ফলে ইবনে উবাইর মনে একেশ্বরবাদের প্রতি আগ্রহ জন্মে, এবং সম্ভবত এ কারণেই সে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।"

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার কারণে, ইবনে উবাই প্রকাশ্যে ও গোপনে হুজুরপাক (সাঃ)-এর উপহাসকারীদের নেতা হয়ে উঠে এবং মদিনায় মুসলিমদের আগমনের ফলে আগত বিপদ ও বিভ্রান্তি নিয়ে অনবরত অভিযোগ করতে লাগল। ইতিহাসবীদ ইবনে ইসহাক লিখেছেন, "কিছুসংখ্যক আনসার সাহাবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করতে রাজি ছিলেন না, তারা মুখে ইসলাম গ্রহণ করলেও অন্তরে বিশ্বাসঘাতকতা লুকিয়ে রেখেছিল, এবং এ কারণে সে সময়েই তারা প্রতারক বা মুনাফিক বলে পরিচিত ছিল। ইসলাম বিরোধী প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম মুরের মতে, ইবনে উবাই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর রোষানলে পতিত লোকজনের পক্ষে থাকার কারণে ইসলামের প্রথাগত ইতিহাসে তাকে নেতিবাচকরূপে প্রদর্শন করা হয়েছে।

ইহুদিদের বনু কাইনুকা গোত্র ছিল পেশায় কর্মকার, স্বর্ণকার ও তৈজসপত্র নির্মাতা। বদর যুদ্ধের কিছুদিন পর তাদের বাজারে এক মুসলিম মহিলা এক ইহুদি-র স্বর্ণের দোকানে কোন এক কাজে গিয়েছিল। ঐ মুসলিম মহিলা যখন ঐ দোকানে গিয়েছিলেন তখন ঐ ইহুদি কর্মচারী মুসলিম মহিলাটির মুখ খুলতে বলে। কিন্তু মহিলাটি তাঁর মুখ খুলতে রাজি না হওয়ায় মহিলাটি যখন স্বর্ণের দোকানের একটি চেয়ারে বসে তখন ইহুদি কর্মচারীটি ঐ মহিলার পোশাকে পেরেক মেরে চেয়ারের সাথে আটকে দেয়, ফলে উঠতে গিয়ে ঐ মহিলার জামা ছিঁড়ে সারা শরীর অনাবৃত হয়ে যায়। মুসলিম মহিলার আর্তনাদ শুনে এক মুসলিম পথচারী এটা দেখে খেপে গিয়ে ঐ ইহুদি কর্মচারীকে হত্যা করেন, এরপর ইহুদি কর্মচারীর পক্ষের লোকেরা সবাই মিলে ঐ মুসলমানকে হত্যা করে ফেলে।

উক্ত ঘটনার ফলে, ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে, মুসলিমরা ইহুদি গোত্র বনু কায়নুকার উপর আক্রমণ চালায়, এবং ১৫ দিন তাদেরকে অবরোধ করে রাখার পর অবশেষে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। মুসলিম ঐতিহাসিকদের মতে, ইবনে উবাই তখন বনু কায়নুকার সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্কে আবদ্ধ থাকায় হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে তাদের শাস্তি লঘু করার জন্য আবেদন করে। এতে হুজুরপাক (সাঃ) তার অনুরোধ গ্রহণ করেন, এবং বনু কায়নুকাকে শহর ছেড়ে চলে যাবার জন্য তিন দিনের সময় দিলেন। এমনতর অনেক ঘটনাতে ইবনে উবাই একজন মুনাফিক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। 

৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ তথা ৬ষ্ঠ হিজরির শা’বান মাসে খাজায়া গোত্রের বনু মুস্তালিক শাখার বিরুদ্ধে হুজুরপাক (সাঃ) অভিযান চালান; ইবনে উবাইও সেই অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এক সময় হুজুরপাক (সাঃ) জানতে পারলেন যে, বুন মুসতালিক গোত্রও তাদের সৈন্য সমাবেশ করছে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে হারেস ইবনে আবু দিরার, যিনি হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অন্যতম স্ত্রী হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ)-র পিতা। এ খবর পেয়েই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সৈন্য সামন্ত নিয়ে তাদের মুকাবিলায় বেরুলেন। মুরাইসি নামক ঝরনার কিনারে তাদের সাথে তুমুল যুদ্ধ হলো। আল্লাহ বনু মুস্তালিককে পরাজিত করলেন। তাদের বহু লোক নিহত হলো। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাদের সন্তান, নারী ও সম্পদ গণিমত হিসেবে গণ্য করলেন। 

বনু কালব ইবনে আউফ গোত্রের হিশাব ইবনে সুবাবা নামক জনৈক মুসলিম এতে নিহত হন; তাঁকে শত্রুপক্ষীয় মনে করে উবাদা ইবনে সমিতের দলভুক্ত জনৈক সাহাবী ভুলক্রমে হত্যা করেন। 

ঝরনার কিনারে অবস্থানকালেই মুসলমানদের মধ্যে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে; জাহজাহ ইবনে মাসউদ নামক বনু গিফারের এক বেদুঈন ক্রীতদাসকে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) তাঁর ঘোড়া রাখার জন্য মজুর হিসাবে নিয়োগ করেন। পানি নিয়ে খাজরাজ গোত্রের সিনান ইবনে আবার জুহানির সাথে তার ঝগড়া হয় এবং ক্রমে ঝগড়া মারামারিতে রূপান্তরিত হয়। তখন জুহানি চিৎকার করে ডাকলো “হে আনসারগণ, বাঁচাও।” জাহজাহও চিৎকার করে বললো, “হে মুহাজিরগণ, আমাকে বাঁচাও।” 

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল তখন তার গোত্রের একদল লোকের সাথে অবস্থান করছিল। কিশোর জায়িদ ইবনে আরকাম (রাঃ)-ও সেই দলের মধ্যে ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই চিৎকার শুনে উত্তেজিত হয়ে বলে, "তারা কি শেষ পর্যন্ত এমন কাণ্ড ঘটাল? ওরাতো আমাদের মাঝে থেকেই দল ভারী করে অহমিকায় মেতে উঠেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের ও মুহাজিরদের অবস্থা সেই প্রবাদ বাক্যের মতোই গড়াচ্ছে যে, ‘নিজের কুকুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটাসোটা বানাও, দেখবে একদিন সে তোমাকেই কেটে খাবে।’ আল্লাহর কসম, এবার যদি আমরা মদিনায় ফিরে যাই তাহলে সবলরা দুর্বলদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেবে।” তারপর তার স্বগোত্রীয়দের বলতে লাগল, “তোমার নিজেদের কী সর্বনাশ করেছ, এখন দেখ। ওদেরকে এ দেশে ঠাঁই দিয়েছ। তোমাদের সম্পদের ভাগ দিয়েছ। ওদের প্রতি অমন বদান্যতা যদি না দেখাতে তাহলে ওরা অন্যত্র যেতে বাধ্য হতো।” 

জায়িদ ইবনে আরকাম (রাঃ) এসব কথাবার্তা শুনে হুজুরপাক (সাঃ)-কে জানালেন। এ সময় তিনি সবেমাত্র শত্রুকে পরাস্ত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। তিনি যখন এই খবর শুনলেন তখন তাঁর কাছে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, “আব্বাদ ইবনে বিশরকে নির্দেশ দিন তাকে যমের ঘরে পাঠাক।” হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন, “ওমর আমি যদি তা করি তাহলে লোকেরা বলবে যে, মুহাম্মাদ নিজেই তার সহচরদের হত্যা করছে; তা করা যায় না। তবে তুমি এখনই এখান থেকে রওনা হবার নির্দেশ জানিয়ে দাও।” যে সময় এ নির্দেশ দেওয়া হলো সে সময় সাধারণত হুজুরপাক (সাঃ) কোথাও রওনা হতেন না, তথাপি সবাই রওনা হলো। এছাড়া ইবনে উবাইয়ের নিজ পুত্র আবদুল্লাহও হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে নিজের পিতাকে হত্যার আবেদন জানিয়ে অণুরোধ করেছিল।

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল যখন জানতে পারল যে জায়িদ ইবনে আরকাম (রাঃ) তার কথাগুলো হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে বলে দিয়েছেন, তখন সে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে ছুটে গিয়ে কসম খেয়ে বলতে লাগে, “জায়িদ যা বলেছে, আমি সে সব কথা বলি নি।” আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যেহেতু স্বগোত্রে খুবই সম্মানিত লোক বলে গণ্য হত তাই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট যেসব আনসারী সাহাবী ছিলেন তারা বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, জায়িদ হয়ত ভুল শুনেছে এবং সে যা বলেছে তা হয়ত পুরোপুরি মনে রাখতে পারে নি।” এভাবে তারা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের প্রতি একটু সৌজন্য দেখালেন এবং তাকে বাঁচিয়ে দিলেন। 

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সেই অবেলায়ই রওনা হলেন, তাঁর সাথে উসায়েদ ইবনে হুদাইস দেখা করলেন। তাঁকে সালাম ও অভিবাদন পূর্বক বললেন, "হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! আপনি বড়ই অসুবিধাজনক সময়ে যাত্রা করেছেন। সাধারণত এরকম সময়ে আপনি কোথাও যাত্রা করেন না।” হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তখন বললেন, “তোমাদের সঙ্গী লোকটি কি বলেছে তা শোন নি?” তিনি বললেন, “কোন্ সঙ্গী ?” হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন, “আবদুল্লাহ ইবনে উবাই।” উসায়েদ বললেন, “সে কী বলেছে?" হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন, “তার ধারণা, সে যদি মদিনায় ফিরে যেতে পারে তাহলে সবলরা দুর্বলদেরকে সেখান থেকে বের করে দেবে।” উসায়েদ বলল, “হে আল্লাহর রাসুল, আপনি ইচ্ছা করলে তাকে আমরা বের করে দিতে পারি। সত্যই সে অত্যন্ত হীন ও নীচ। আর আপনি পরাক্রান্ত।” তিনি আরো বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, তার প্রতি একটু নমনীয় হোন। আল্লাহর কসম, আপনাকে আল্লাহ আমাদের এমন সময় এনে দিয়েছেন যখন তার গোত্র তাকে মুকুট পরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাই সে মনে করে, আপনি তার থেকে একটা রাজ্য কেড়ে নিয়েছেন।” 

কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিবাদের ঝুঁকি এড়াতে সেই দিনই পুনরায় যাত্রা শুরু করেন। তিনি তাঁর সাহাবীদের সাথে নিয়ে একদিন একরাত ধরে পথ চললেন। পথে প্রচণ্ড রৌদ্রে তাদের অসহনীয় কষ্ট হতে লাগল। তাই এক জায়গায় যাত্রাবিরতি করলেন। লোকেরা মাটিতে নামতেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। আগের দিন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথায় লোকদের ভেতর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এভাবে অসময়ে যাত্রা করেছিলেন। বিশ্রাম শেষে হুজুরপাক (সাঃ) পুনরায় সদলবলে যাত্রা শুরু করলেন। হিজাজের মধ্য দিয়ে যাত্রাকালে তিনি একটি ঝরনার কাছে যাত্রাবিরতি করলেন; সে স্থানটির নাম বাক্কা। সেখান থেকে পুনরায় যখন যাত্রা শুরু হলো তখন মুসলমানদের উপর দিয়ে হঠাৎ একটা কষ্টদায়ক ভীতিপ্রদ বাতাস বয়ে গেল। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন, “এ বাতাসকে তোমরা ভয় পেয়ো না। একটা মস্তবড় কাফিরের মৃত্যু ঘটেছে। সে জন্যই এ বাতাস।” মদিনায় ফিরে তাঁরা দেখেন বনু কাইনুকা গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তি রিফায়া ইবনে জায়িদ ঐ দিনই মারা গেছে। সে ছিল মুনাফিকদের আশ্রয়স্থল তথা কুমন্ত্রণাদাতা।

পবিত্র কুর'আনে সুরা মুনাফিকুন-এ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার মতো লোকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, "তারাই বলেঃ আমরা যদি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করি তবে সেখান থেকে সবল অবশ্যই দুর্বলকে বহিস্কৃত করবে। শক্তি তো আল্লাহ তাঁর রসূল ও মুমিনদেরই কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না (63:8)।" 
আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পুত্র আবদুল্লাহ তার পিতার ব্যাপারটা জানতে পেরে হুজুরপাক (সাঃ)-কে বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি শুনেছি, আপনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে তার বৈরী কথাবার্তার জন্য হত্যা করতে ইচ্ছুক। যদি সত্যিই আপনি ইচ্ছুক হয়ে থাকেন তাহলে আমাকে নির্দেশ দিন আমি তার মাথা আপনার কাছে পৌঁছিয়ে দিই। আল্লাহর কসম! খাজরাজ গোত্র জানে যে, ঐ গোত্রে আমার চেয়ে পিতৃভক্ত লোক আর নেই। আমার আশঙ্কা হয় যে, আপনি আমার পিতাকে হত্যার জন্য কাউকে নির্দেশ দেবেন। আর সে তাকে হত্যা করবে, তখন আমার পিতৃহত্নাকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখে হয়তো আমার প্রবৃত্তি কুপ্ররোচনা দিয়ে আমাকে অসহিষ্ণু করে তুলবে। ফলে তাকে হত্যা করে আমি জাহান্নামে যেতে বাধ্য হব। কেননা সেক্ষেত্রে আমি একজন কাফিরের বদলায় একজন মু’মিনকে হত্যার দায়ে দোষী হব।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না সে যতদিন আমাদের সাথে থাকে ততদিন তার প্রতি আমরা নমনীয় থাকব এবং ভালো ব্যবহার করব।” 

এরপর থেকে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যখনই কোনো অঘটন ঘটাতো, তার গোত্রের লোকেরাই তাকে শায়েস্তা করতো। তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করতো এবং পাকড়াও করতো। এই অবস্থা জেনে একদিন হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে বললেন, “ওমর, পরিস্থির পরিবর্তনটা দেখছো তো? তুমি যেদিন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে হত্যার পরামর্শ দিয়েছিলে সেদিন যদি তাকে হত্যা করতাম তাহলে অনেকেই নাক সিটকাতো। কিন্তু আজ যদি তাকে হত্যার নির্দেশ দিই তাহলে সেদিন যারা নাক সিটকাতো, তারাই আজ তাকে হত্যা করবে।” হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি জানি আল্লাহর রাসুল (সাঃ)-এর সিদ্ধান্ত আমার সিদ্ধান্তের চাইতে অধিক কল্যাণকর।” 

এরপর একই বছর মার্চ মাসে মা আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ)-র বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়ে অভিযোগ আনা হল এবং তখন ইবনে উবাই ছিলেন তাদের মধ্যে একজন যারা এই গুজবটি রটিয়ে বেড়াচ্ছিল। আওস গোত্রের একজন নেতা অপবাদ রটনাকারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন, কিন্তু খাজরাজ গোত্র এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মা আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ)-র সতীত্ব সম্পর্কে ঐশী নিশ্চয়তা প্রদানকারী আয়াত নাজিল হওয়ার খবর সবাইকে জানানোর পর প্রত্যেক অপবাদকারীকে আশিটি বেত্রাঘাতের শাস্তি দিলেন, কিন্তু ইবনে উবাইকে কোনো শাস্তি দিলেন না।

৬৩০ সালে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলে ইবনে উবাই তাবুক যুদ্ধের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদানকারীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে। মুসলিম সেনাবাহিনী তাবুকের পথে যাত্রা শুরু করলে ইবনে উবাই গোপনে তাঁর লোকজন নিয়ে সেনাদল থেকে পালিয়ে গিয়ে মদিনায় ফিরে আসে। অনেকে বলেন, তার শারীরিক অসুস্থতার কারণে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অনুমতিতেই সে যুদ্ধ ছেড়ে চলে এসেছিল। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাবুক থেকে ফিরে আসার পর যারা যুদ্ধের সমালোচনা করেছিল এবং যুদ্ধে না গিয়ে মদিনায় থেকে গিয়েছিল তাদেরকে তিরস্কার করে সুরা তওবার ৮১ তম আয়াত অবতীর্ণ হয়।

তাবুক থেকে ফিরে আসার পর ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মারা যায়। তার ছেলে আবদুল্লাহ নবী করিম (সাঃ)-এর সেবায় হাজির হয়ে কাফনে ব্যবহারের জন্য তার কোর্তা চাইলে তিনি কোর্তা দিয়ে দিলেন। তারপর আবদুল্লাহ তাকেই জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন; তিনি এ জন্যও তৈরি হয়ে গেলেন। হযরত ওমর (রাঃ) বারবার এ মর্মে আবেদন জানাতে লাগলেন, "হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি এমন ব্যক্তির জানাজার নামাজ পড়াবেন যে অমুক অমুক কাজ করেছে?" কিন্তু তিনি তাঁর এ সমস্ত কথা শুনেও মুচকি হাসতে লাগলেন৷ এমনকি তার মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেও ইতস্তত করলেন না। এরপর হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তার জানাজার সালাত আদায় করেন (ভিন্ন মতও আছে এ নিয়ে) এবং ফিরে আসেন। এর কিছুক্ষণ পরেই সুরা বারাআতের (সুরা তওবার) এ দুটি আয়াত নাজিল হল : 

"তাদের কেউ মারা গেলে আপনি কখনো তার জানাজার সালাত আদায় করবেন না। এমতাবস্থায় যে তারা ফাসিক।"— (আয়াত : ৮৪)

এ আয়াতগুলো নাজিল হওয়ার পর নবী করিম (সাঃ) নিয়ম করে নিয়েছিলেন যে কোনো জানাজার শরিক হবার জন্য তাকে ডাকা হলে তিনি প্রথমে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। জিজ্ঞেস করতেন, সে কেমন ছিল৷ যদি জানতে পারতেন সে অসৎ চরিত্রের অধিকারী ছিল, তাহলে তার পরিবারের লোকদের বলে দিতেন, তোমরা যেভাবে চাও একে দাফন করে দিতে পারো। 

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই কয়েকজন কন্যা এবং আবদুল্লাহ নামের একটি পুত্রসন্তান রেখে যায়, যারা সকলেই সারাজীবন ধর্মপ্রাণ মুসলিম হয়ে ছিলেন।

সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও বলিষ্ঠ সনদ হাদিসসমূহ থেকে এ কথাই প্রতিপন্ন হয় যে, রসূলপাক (সাঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এর জানাযা পড়িয়েছিলেন। কিন্তু পরে তাঁকে সূরা তওবার ৮৪ নং আয়াতের মাধ্যমে মুনাফিকদের জানাযার নামায পড়াতে বারণ করা হয়। ফলে রসূলপাক (সাঃ) পরবর্তীকালে আর কখনো এমন কোনো লোকের জানাযা পড়াননি, যার মুনাফিক হওয়া একেবারেই স্পষ্ট ছিলো এবং তা রসূলপাক (সাঃ)-এর জানা ছিলো। 

কিন্তু কিছু কিছু হাদিস থেকে এ কথাও জানা যায় যে, তিনি আব্দুল্লাহ বিন উবাইর জানাযা পড়াননি। তিনি পড়াতে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু ওহী দ্বারা তাঁকে নিষেধ করা হয়। যেসব হাদিসে রসূলপাক (সাঃ) কর্তৃক জানাযা পড়ানোর উল্লেখ রয়েছে, সেগুলো বুখারি, মুসলিম ও অন্য ছয়টি সহীহ হাদিসগ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে। বুখারি ও মুসলিমের জানাযা অধ্যায়ে এ ধরণের একাধিক হাদিস রয়েছে। বুখারিতে 'জামা দ্বারা কাফন দেয়া।' শিরোনামে হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) বর্ণিত প্রথম হাদিসের বক্তব্য এই যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর ছেলে পিতা মারা যাওয়ার পর রসূল (সাঃ)-এর নিকট আবেদন জানালেন, "আপনার জামাটা দিন এবং জানাযা পড়িয়ে দিন।" তিনি রাজি হয়ে গেলে হযরত ওমর (রাঃ) বললেন : "আল্লাহ তায়ালা কি আপনাকে মুনাফিকদের জানাযা পড়াতে নিষেধ করেননি।" রসূল (সাঃ) বললেন : "আমাকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে, পড়াতেও পারি, নাও পড়াতে পারি।" অবশেষে তিনি জানাযা পড়ালেন। পড়ানোর পর এ আয়াত নাযিল হয়।

কিন্তু এ অধ্যায়ে হযরত জাবির বর্ণিত অপর হাদিসটি এরূপ : "আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে এলেন। তিনি তার লাশ উঠালেন, তার উপর নিজের পবিত্র লালা দিলেন এবং নিজের জামাটি তার কাফনে জড়িয়ে দিলেন।"

এ হাদিসে রসূলপাক (সাঃ) কর্তৃক জানাযা পড়ানোর উল্লেখ নেই। উল্লেখ না থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বিবেচনা সাপেক্ষ। প্রতীয়মান হয় যে, রসূলপাক (সাঃ)-এর পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ায় লাশ দাফন সম্পন্ন হয়, কিংবা কমেরপক্ষে তাকে কবরে নামানের পর তিনি পৌঁছেন। জানাযা দাফনের আগেই হয়তো পড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে রসূলপিক (সাঃ) তার পুত্র ও গোত্রের মনসন্তুষ্টির জন্য এবং ইসলামের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য নিজের মুখের লালা ও জামা দিয়ে কৃতার্থ করেন। এটা ছিলো রসূলপাক (সাঃ)-এর সর্বোচ্চ মানের মহানুভবতা ও ক্ষমার বহি:প্রকাশ। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য তাঁকে কখনো কোনো মুনাফিকের জানাযা পড়াতে এমনকি তার কবরের কাছে দাঁড়িয়ে দোয়া বা শোক প্রকাশ করতেও নিষেধ করে দেয়া হয়। 

হাদিস ব্যাখ্যাকারীগণ হযরত জাবিরের বর্ণিত এই হাদিস এবং অন্যান্য হাদিসের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। তারা বলেছেন, রসূলপাক (সাঃ) যখন লাশ বের করে এমন অসাধারণ অনুকম্পার মনোভাব অবলম্বন করেছেন, তখন নামাযও হয়তো পড়িয়েছেন। কিন্তু হযরত জাবির এ কথার উল্লেখ করেননি। বস্তুতঃ রসূলপাক (সাঃ)-এর আগমনের আগে যে দাফনক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল, সেটা জানাযা বাদ দিয়ে হওয়ার কথা নয়। কেননা জানাযা আগে হয় এবং দাফনের পালা পরে আসে।

দ্বিতীয় হাদিসটি হযরত আনাস থেকে বর্ণিত; এ হাদিস থেকে জানা যায়, সূরা তাওবার ৮৪ নং আয়াত জানাযা পড়ার আগেই নাযিল হয়ে গিয়েছিল এবং এর কারণে রসূলপাক (সাঃ) জানাযা পড়া থেকে বিরত থাকেন। 'মাজমায়ুয্‌ যাওয়াইদ' গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে ৪২ পৃষ্ঠায় 'মুনাফিকদের জানাযায় নিষেধাজ্ঞা' শিরোনামের অধীনে হাদিসটির বিবরণ এরূপ : "হযরত আনাস বিন মালিক জানান, রসূলপাক (সাঃ) আব্দুল্লাহ বিন উবাইর জানাযা পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জিবরীল তাঁকে থামালেন এবং এই ওহী শোনালেন 'ওদের কারো জানাযা পড়োনা এবং কবরেও দাঁড়িওনা।' মুসনদে আবু ইয়ালাতে এ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এর বর্ণনাকারীদের মধ্যে একজন রয়েছেন ইয়াযীদ রাক্কাশী। কোনো কোনো হাদিসশাস্ত্রবিদ তাঁর সম্পর্কে আপত্তি তুলেছেন। আবার কেউ কেউ তাঁকে নির্ভরযোগ্যও বলেছেন।"

হাদিসটির বর্ণনাকারীদের সকলের নামসহ পুরো সনদ ইমাম ইবনে জারীর স্বীয় সূরা তাওবার তফসীরে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন : হযরত জাবির থেকে বর্ণিত যে হাদিসটি ইতিপূর্বে বুখারি শরিফ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, সেটি অল্পবিস্তর শাব্দিক পার্থক্যসহ মুসনদে আহমদ এবং অন্যান্য হাদিসগ্রন্থেও লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং সে সব গ্রন্থেও হযরত জাবির বলেননি যে, রসূলপাক (সাঃ) জানাযা পড়িয়েছেন।

মুসনদে আহমদ তৃতীয় খণ্ড, ৩৭১৬ পৃষ্ঠায় একটি বর্ণনা এরূপ লিপিবদ্ধ রয়েছে :
 "আব্দুল্লাহ বিন উবাই মারা গেলে তার ছেলে রসূলপাক (সাঃ)-এর নিকট এসে বললেন : ইয়া রসূলুল্লাহ! আপনি যদি জানাযায় না আসেন, তবে সেটা আমাদের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর ব্যাপার হবে। তাই রসূলপাক (সাঃ) উপস্থিত হলেন, কিন্তু ততোক্ষণে লাশ কবরে নামানো হয়ে গেছে। রসূলপাক (সাঃ) বললেন : তোমরা দাফনের আগে আমাকে জানালে না কেন? অত:পর তিনি কবর থেকে লাশ বের করলেন, তার সমগ্র শরীরে নিজের লালা মাখিয়ে দিলেন এবং নিজের জামা পরিয়ে দিলেন।"

যাই হউক, রসূলপাক (সাঃ) জানাযা হয়তো পড়াননি, হয়তো তিনি শুধু লালা ও জামা দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন। এমনও হতে পারে যে, জানাযা পড়াবেন বলে মনস্থ করেছিলেন, কিন্তু পড়ানোর আগেই ওহী নাযিল হয়ে যায়। এ সম্ভাবনার কথা আমি আগেও বলেছি। তবে বিশুদ্ধতর হাদিসে জানাযা পড়ানোর উল্লেখ রয়েছে এবং তাতেও কোনো জটিলতা নেই। কেননা এ জানাযার আগে দোয়া করতে নিষেধ করা হয়েছিল শুধু কাফের ও মুশরিকের জন্য। মুনাফিকদের ব্যাপার একটু স্বতন্ত্র। বাহ্যত তারা মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিলো এবং সামাজিক সুযোগ সুবিধা মুসলমানদের মতোই ভোগ করতো। তাই রসূলপাক (সাঃ)-কে অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীনভাবে নিষেধ না করা পর্যন্ত মুনাফিকদের জানাযা পড়া না পড়ার ব্যাপারে তিনি স্বাধীন ছিলেন।

তবে আসল লক্ষণীয় ও শিক্ষণীয় বিষয়টি এখানে এই যে, মুনাফিকের জন্য আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর মাগফিরাতের দোয়াও গ্রহণগোয্য নয়, এবং মুনাফিকের কবরে যদি আল্লাহর নবী (সাঃ)-র মুখের লালা এবং গায়ের জামাও রেখে দেয়া হয়, তবু এই বরকতময় জিনিস মুনাফিককে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাতে পারবে না। হে আল্লাহ! প্রত্যেক কালেমা পড়া মুসলমানকে মুনাফিকি থেকে বিরত রাখুন॥
[তথ্যসূত্র উইকি]

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
৩১ জুলাই, ২০১৮.

বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০২০

একবিংশ শতাব্দীর ওহাবীজম:

বিখ্যাত তাবেঈ ইবনে শিরিন (রঃ) বলেছেন, 'নিশ্চয় এই ইলম দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং লক্ষ্য রেখো! কার নিকট থেকে তুমি তোমার দ্বীন গ্রহণ করছো।' লা-মাজহাবী আধুনিক ওহাবী দল সালাফি তথা আহলে হাদীস নামধারি দলের অন্যতম একজন নেতা হলেন নাসিরুদ্দিন আলবানী; তার অনেকগুলো বদ আকিদার মধ্যে অল্প কয়েকটি প্রথমেই তুলে ধরে আজকের লিখার সূচনা করছি।

*** নাসিরউদ্দিন আলবানী হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর, রওজা মুবারক হতে সবুজ গম্ভুজ ভেংগে ফেলা এবং হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওজা শরীফকে মসজিদে নববী হতে বের করে দেয়ার আবেদন করেছিলেন। –(সূত্রঃ তাহযিরুজ সাজিদ মিন ইত্তিখাযিল কুবুরি মাসাজিদ, শায়েক আলবানী, পৃষ্ঠা নং - ৯৮)
*** সালাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হলেন আল্লাহ তা'আলা (নাউজুবিল্লাহ!)। –(সূত্রঃ ফাতাওয়াল আলবানী ফিল মদীনাতি ওয়াল ইমারত, পৃষ্ঠা নং - ১৮)
*** আশ্চর্য হওয়া আল্লাহর একটি সিফত (নাউজুবিল্লাহ!)। –(কিতাবুশ শায়েখ আলবানী)
*** এটা ঈমান রাখো যে আল্লাহ তা'আলা (শুধু) আসমানে রয়েছে (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আল হাবী মিন ফাতাওয়াশ শায়েখ আলবানী,১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং - ৪৩)
*** নবীগণ যে নিষ্পাপ এটা সাধারণ বা ব্যাপক নয় (নাউজুবিল্লাহ!)। –(ফাতাওয়াল আলবানী ফিল মাদীনাতি ওয়াল ইমারত,পৃষ্ঠা নং - ১৮)
*** নবী-রাসূলগণ বিভিন্ন ধরনের সগীরা গুনাহ ও আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে থাকেন (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আল ফাতাওয়াল কুয়্যেতিয়্যা লিল আলবানী,পৃষ্ঠা নং - ২৯)
*** আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে যে সমস্ত আয়াত শিখিয়েছেন তা তিনি ভুলে যেতে পারেন (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আল ফাতাওয়াল কুয়্যেতিয়্যা লিল আলবানী,পৃষ্ঠা নং - ৩০)
*** নবী করীম সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উসিলা করে দোয়া করা হারাম (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আহকামুল যানায়েজ ওয়া বিদাউহা, পৃষ্ঠা নং - ২৬৪)
*** রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নন (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আত তাওয়াসসুল আনওয়াউহু ওয়া আহকামুহু, পৃষ্ঠা নং - ১৪৯)
*** নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওজা জিয়ারতের উদ্দশ্যে সফর করা হারাম (নাউজুবিল্লাহ!)।  –(ফাতাওয়াল আলবানী ফিল মদীনাতি ওয়াল ইমারত, পৃষ্ঠা নং - ১২)
*** নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্য কোন মৃত্যুদের উদ্দেশ্যে কোন আমলের সোওয়াব প্রেরণ করা জায়েজ নয় (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আহাকমুল জানায়েয ওয়া বিদাউহা, শায়েখ আলবানী, পৃষ্ঠা নং : ২৬০-২৬১)
*** জুম্মার দিনে 'ইন্নাল্লাহা ওয়ামালাইকাতাহু' এই আয়াত শরীফ পাঠ করা জায়েজ নয় এবং এটি একটি বেদাত (নাউজুবিল্লাহ!)। –(আল আজউইবাতুন নাফেয়া, শায়েক আলবানী,পৃষ্ঠা নং - ৬৭)

বিগত অর্ধশতক ধরে 'সালাফি' পরিভাষাটি সারা বিশ্বে একটি ইসলামিক মেথডলজি হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার চেষ্টা  করছে। বর্তমান সালাফিরা  মুখে বলে তাদের লক্ষ্য হলো ইসলামের প্রথম প্রজন্মের মুসলমানদের ঈমান ও আমলের যে নবুয়তী মানদণ্ড ছিলো তার সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করা। আসলে কি তাই? আমরা প্রতিটি মুসলমান মাত্রই অবগত আছি যে নবুয়তী যুগ হলো রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সুন্নাহর সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তারপরের প্রথম তিন প্রজন্মের যুগ— সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর যুগের সবচেয়ে কাছাকাছি; তাই এই তিন প্রজন্মের সময়কালকে ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ  বিংশ শতাব্দীতে জন্ম নিয়ে পেশাগতভাবে একজন ঘড়ি মেরামতকারী নাসিরুদ্দিন আলবানী  প্রথম সালাফি শব্দটিকে একটি শ্রেণীগত প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন, তারপর ডাঃ জাকির নায়েক এ দলটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন।     

সালাফিরা হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী হলেও তাদের অনেকে আবার নির্দিষ্ট কোন মাজহাব অনুসরণ করেন না। শারয়ী অনেক বিষয়েই সালাফিদের সাথে অন্যান্য মতালম্বি মুসলিমদের যথেষ্ট  মতপার্থক্য রয়েছে। তারা কবর জিয়ারতকে কবর পূজা বলে, শবে বরাত, ঈদে মিলাদুনন্নবী ইত্যাদিকে ইসলামে যোগ হওয়া নতুন জিনিস হিসেবে বিশ্বাস করে এবং এগুলো উৎযাপন করে না। ২০১৫ সালে মিশরে মিশরীয় সরকার সালাফিদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

বর্তমানের এই ওহাবী দল তথা সৌদির সালাফিরা এই উপমহাদেশে আহলে হাদীস নাম নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ দলের অন্যতম বক্তা হলেন ডাঃ জাকির নায়েক; এবং মতিউর রহমান মাদানী হলেন তাদের অন্যতম দীক্ষাগুরু; আর তাদের নেতা হলেন  শায়েখ নাসিরুদ্দিন আলবানী। ডাঃ জাকির নায়েকের আকিদা ও রিসার্চ মুলতঃ আলবানীর আকিদা ও বই পুস্তক নিয়ে; যেমন - আলবানী যে হাদিস দুর্বল কিংবা জাল বলেছেন সেটি অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ সহিহ বললেও ডাঃ জাকির নায়েক আলবানীকেই সমর্থন দিয়ে থাকেন। আহলে হাদীসকে সালাফী নামে পরিচয়দানকারী ব্যক্তিটিও হলেন নাসির উদ্দিন আলবানী; যার ডাক নাম আবু আবদুর রহমান। 

ইউরোপের মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আলবেনীয়ায় জন্ম নেয়ায় তাকে আলবানী বলা হয়। তিনি ১৩৩৩ হিজরী মোতাবেক ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে আলবেনীয়ার রাজধানী স্কোডার (Shkoder), বর্তমান 'তিরানা'-য় জন্ম গ্রহন করেন। আলবানী লিখিত 'সিফাতুস সালাত' কিতাবের ভূমিকাতে উল্লেখ্য করা হয়েছে, নাসির উদ্দিন আলবানী ব্যক্তিগত জীবনে প্রথম অবস্থায় কাঠ মিস্ত্রির কাজ করতেন; এবং পরবর্তীতে পিতার ঘড়ি মেরামতের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
 
তার পিতা ছিলেন হানাফী মাজহাব-এর একজন অনুসরণকারী। আলবেনিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমদ জাগু নারীদের পর্দা নিষিদ্ধ করলে শিশু আলবানীকে নিয়ে তার পিতা সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে চলে আসেন। আলবানী নিজেও প্রথম জীবনে হানাফী মাজহাবের একজন অনুসারী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কেমন করে যেন তিনি মাজহাব থেকে ছিটকে পড়েন। হানাফী ফিকাহর কিতাব পাঠ করলেও একসময় তিনি হানাফী মাজহাবসহ সমস্ত মাজহাবকেই অস্বীকার করে বসেন, ঠিক মোহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী যেমন করে মাজহাব অস্বীকার করেছিলেন; এবং কোরআন হাদীস ও সলফে সালেহীনদের বিরুদ্ধেও তিনি অযথাই বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকেন। 

১৯৬০ সালের শুরুর দিকে প্রথম তিনি সকলের নজরে আসেন যখন ভিন্ন মতাবল্বনের জন্য পরপর দু'বার গ্রেপ্তার হন। প্রথম বার ১৯৬৮ সালের আগে দামেস্কের কেল্লা কারাগারে এক মাসের জন্য বন্দী ছিলেন; এটা সেই কারাগার, যেখানে ইবনে তাইমিয়াও বন্দী ছিলেন। ১৯৬৮ সালের যুদ্ধের সময় সিরিয়ান সরকার যখন সকল কারাবন্দীদের মুক্ত করে দেয় তখন তিনিও মুক্ত হন। কিন্তু আবারও তিনি তার ভ্রান্ত মত প্রচার করতে থাকেন। ফলে তাকে পুনরায় দামেস্কের পূর্ব-উত্তরাঞ্চলের আল হাসাকা কারাগারে বন্দী করা হয়; ওখানে তিনি আট মাস কারারুদ্ধ অবস্থায় অতিবাহিত করেন। কারগার হতে মুক্তি পেয়ে তিনি পরবর্তীতে সিরিয়া ত্যাগ করে জর্ডানে আশ্রয় নেন; এবং জর্ডানের রাজধানী আম্মানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। পরিশেষে সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ওহাবী কার্যাবলীর কারণে সৌদি রাজতন্ত্র তাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে; তাদের আর্থিক সহায়তায়ই তিনি ওহাবী মতবাদ প্রচার করার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেন। বর্তমান মুসলিম বিশ্বে আহলে হাদীস তথা সালাফী ওহাবীদের কেন্দ্রস্থল হলো সৌদিআরব। মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব নাজদী ও আল-সাউদের সেই ওহাবী মতবাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার হীন প্রচেষ্টায় তারা মক্কা-মদিনার বাহানা তুলে এবং সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সুবিধা গ্রহণ করে ব্যাপকভাবে তিনি প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে গেছেন, যা বর্তমানেও অব্যাহত আছে। ভারতের ঐতিহ্যবাহী আহলে হাদীস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া বেনারসে হাদীসের শিক্ষক হিসেবেও এক সময় আলবানীকে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল; কিন্তু তৎকালীন সময়ে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ চলছিল, সেই জন্য তিনি সেখানে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। 

সৌদি সরকার ওহাবী মতবাদকে শক্তিশালী করার জন্য আলবানীকে ১৩৯৫ হিজরী থেকে ১৩৯৮ হিজরী পর্যন্ত মদীনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট সদস্য হিসাবে মনোনীত করেন। পরে ১৪২০ হিজরী, ২ জুমাদাল আখেরা, শনিবার মোতাবেক ২ অক্টোবর, ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান।

নাসির উদ্দিন আলবানী ছিলেন কট্টর একজন ওহাবী ও একই সাথে সালাফী; সুন্নী চার মাজহাবকেই তিনি ভীষণভাবে কটাক্ষ করতেন করেছেন। তিনি তার কিতাবে লিখেছেন - 'মুসলিম ইমামগণের (মাজহাবের ইমামগণ) উমুক ইমাম কোন মাসয়ালার ইজতিহাদে বা তার রায়ে ভুল করেছেন, তা আমরা কেন বলতে পিছপা হবো?' তাই তো তার অনুসারী ও তার সাগরেদদেরও আজকাল দেখা যায় - মাজহাবের কথা শুনলেই ক্ষেপে যেতে, গায়ে আগুন ধরতে!

অথচ সারে চৌদ্দশ বছর আগেই হুজুর পাক (সাঃ) বলে গেছেন, 'আলোর উৎস থেকে যত দূরে যাবে তার দ্যোতি যেমন কমতে থাকবে, তদ্রুপ আমা হতে যত দূরে যাবে ঈমানের জ্যোতিও ততো কমতে থাকবে।' 
আমার কিছুতেই বুঝে আসে না আহলে হাদীস বা তথাকথিত সালাফি দলের লোকজন কি করে ভাবেন, একজন তাবেঈ বা তাবে-তাবেঈর চেয়েও উত্তম হাদীস ও ফিকাহ বুঝবেন ১৪শ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করা একজন তথাকথিত শায়েখ নাসিরুদ্দিন আলবানী বা অন্য কেউ?
 
হানাফী মাজহাবকে আলবানী খ্রিস্টধর্মের সাথে তুলনা করেছেন এবং লিখেছেন -
هذا صريح في أن عيسى عليه السلام يحكم بشرعنا ويقضي بالكتاب والسنة لا بغيرهما من الانجيل أو الفقه الحنفي و نحوه অর্থাৎ - 'এ থেকে স্পষ্ট যে, হযরত ঈসা (আঃ) আমাদের শরীয়ত অনুযায়ী ফয়সালা দিবেন এবং কিতাব ও সুন্নাহের মাধ্যমে বিচার করবেন। তিনি ইঞ্জিল, হানাফী ফিকহ কিংবা এজাতীয় অন্য কিছু দ্বারা বিচার করবেন না।' - (আল্লামা মুনযীরি (রহঃ) কৃত 'মুখতাসারু সহিহীল মুসলিম'-এর উপর শায়েখ নাসীরুদ্দিন আলবানীর টিকা সংযোজন, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৭৭, আল-মাকতাবুল ইসলামি, পৃষ্ঠা-৫৪৮)

অথচ তার পিতা নুহ নাতাজীও ছিলেন একজন হানাফী। তাছাড়া, তিনিও জীবনের দীর্ঘ একটি সময় হানাফী ছিলেন। তাঁর জীবনীতেই লিখা আছে -
الحنفي (قديماً) ، ثم الإمام المجتهد بعد  অর্থাৎ - 'প্রথম জীবনে হানাফী, পরবর্তী জীবনে নিজেই মুজতাহিদ ইমাম।' –(সাবাতু মুয়াল্লাফাতিল আলবানী, আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ আশ-শামরানী, পৃষ্ঠা-২, ১৬)

বর্তমান বিশ্বের ৯২.৫% মুসলমান চার মাজহাব-এর কোন না কোন একটির অনুসরণ করে থাকে, এবং অবশিষ্ট ৭.৫% লোক শিয়া ও অন্য সব মতাবলম্বী। দীর্ঘ সারে তেরশ বছর যাবৎ মুসলিম উম্মাহ মাজহাবের অনুসরণ করে আসছে। তবে কি তিনি সব মুসলমানকেই খ্রিস্টানদের মত পথভ্রষ্ট মনে করছেন?

জাল আর জয়ীফ বলে বলে আসলে তথাকথিত আহলে হাদীসরা হাজার হাজার হাদীসের অস্বীকারকারী;  অতএব তারা হলো 'মুনকারে হাদীস'। ওরা হাদীস মানার নামে বরং হাদীসকে সবসময় অস্বীকারই করে যাচ্ছে। আর যারা হাদীসকে অস্বীকার করবে, তারা মুরতাদের কাছাকাছি। তথাকথিত আহলে হাদীস দল যে মতের অনুসারী সে মতের বিরুদ্ধে কেউ কোন হাদিস বলতে গেলেই তা তারা বাতিল মনে করে, তাদের মতের বাইরের সব হাদীসকেই তারা জাল বা জয়ীফ বলে মুছকি হাসে! বড় বড় মুহাদ্দেসিন, সলফে সালেহিনগণ যেসব হাদীসকে আমলে এনেছেন, যেসব হাদীস গ্রহণ করেছেন, সেরূপ হাজার হাজার হাদীসকেও লা-মাযহাবী তথাকথিত আহলে হাদীস দল অনুসারীরা জাল বা জয়ীফ বলে এনকার করে; এটি আসলে হাদীস অস্বীকারের ভিন্ন একটি রূপ। 

লা-মাজহাবী তথাকথিত আহলে হাদীসরা আসলে মানুষের মগজে এই কথাটি ঢুকিয়ে দিতে চায় যে, জয়ীফ হাদীস কোন হাদীসই নয়, জয়ীফ হাদীস জাল হাদীসের মতই। তারা জয়ীফ হাদীসগুলোকে জাল হাদীস বলে অসংখ্য হাদীসকে অস্বীকার করছে। অথচ জাল আর জয়ীফ হাদীসের মধ্যে যে বিশাল পার্থক্য ব্যবধান রয়েছে তা তারা বুঝতেই চায় না বা বুঝার চেষ্টাও করে না।

হাদীস সহীহ হয়, জয়ীফ হয়, হাসান হয় সনদের উপর ভিত্তি করে। মুহাদ্দিসগণ যখন কোন হাদীসের রাবী (হাদীসের বর্নণাকারী)-র নাম পরিচয়, আমল, আখলাক ইত্যাদি যাচাই- বাছাই করেন, এর উপর ভিত্তি করেই তখন তাঁরা হাদীসের মান নির্ণয় করেন। এমন অনেক হাদীস আছে যেই হাদীসগুলো ইসলামের প্রাথমিক জামানাতে সহীহ শুদ্ধ ছিলো, কিন্তু পরবর্তীতে সনদের কারণে সেই একই হাদীসের মান দুর্বল হয়ে যায়। তাই বলে জয়ীফ দুর্বল হাদীসকে জাল হাদীস বলার কোন সুযোগ নেই। সমস্ত মুহাদ্দিসগণ একমত, যখন কোন বিষয়ে একাধিক জয়ীফ হাদীস থাকে তখন ঐ হাদীস সহীহ হাদীসের পর্যায়ে চলে যায়; এবং তখন ফাযায়েলের বিষয়ে জয়ীফ হাদীসের উপরও আমল করা যায়।

আর জাল হাদীস তো কোন হাদীসই নয়; বানানো বলে-ই তো ওটা জাল! মুহাদ্দিসগণ যখন কোন হাদীস গ্রহন করেন, অনেক সময় এমনও হয় যার কাছ থেকে হাদীসটি শুনছেন তার স্মরণ-শক্তি হয় তো কম, তাই হাদীসটি সম্পূর্ণভাবে পৌঁছাইতে পারেননি; তাই এখানে সতর্কতা স্বরূপ হাদীসের মান দুর্বল রাখা হয়েছে। এ কারণেই দেখবেন একই রকমের হাদীস এক রেওয়ায়েতে এসেছে একভাবে এবং অন্য আরেক রেওয়ায়েতে কিছু কম বেশি হয়ে এসেছে।

জাল আর জয়ীফের পার্থক্য একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বুঝার চেষ্টা করা যাক— 
 ধরা যাক, দু'জন লোক অসুস্থ হয়ে পাশাপাশি বেডে (খাটে) শোওয়া। একজন মারা গেলেন, আর আরেকজন মারা যাননি। যে মারা গেছেন তাকে সবায় কি বলবে? –লাশ। আর যে লোক অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন তাকে সবাই মানুষই বলবে; কারণ, তার ভিতর এখনও জান বা প্রাণ আছে।
জাল আর জয়ীফের ব্যাপারটি অনেকটা ঠিক এমনই। যে হাদীসটি জাল, সেটা লাশের মতো; ওটা কোন অবস্থায়ই হাদীস নয়। কিন্তু যে হাদীসটি জয়ীফ, সেটা অবশ্যই হাদীস। 

বিখ্যাত সব মুহাদ্দিসগণও তাঁদের কিতাবে প্রচুর জয়ীফ হাদীস উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দু:খের বিষয় হলো - তথাকথিত আহলে হাদীস শায়খ মিস্টার নাসিরউদ্দিন আলবানী তিরমিযী শরীফ ও আবু দাউদ শরীফের জয়ীফ হাদীসগুলোও আলাদা করে দু'টো কিতাব বের করেছেন! তাই আজকাল অনেকের কাছে সহীহ আবু দাউদও জয়ীফ আবু দাউদ এবং সহীহ তিরমিযীও জয়ীফ তিরমিযী! বিষয়টি ভাবতেই অবাক লাগে।

আলবানী কেমন করে যেন বুঝাতে চেয়েছেন - জয়ীফ হাদীস কোন হাদীসই নয়! হাদীস সহীহ না হওয়াকে বাতিল বলে গণ্য করা হচ্ছে; এবং আমলের অনুপযোগী মনে করা হচ্ছে। মূলতঃ এভাবে অনেক হাদীসকেই পুরোপুরি অস্বীকার করা হচ্ছে। একদিকে শুধু সহীহ হাদীস মানার কথা বলে তারা ইসলামকে অপরিপূর্ণ ও সংকীর্ণ করছে, অন্যদিকে অসংখ্য হাদীসকে এনকার (অস্বীকার) করছে।
আরেকটি কষ্টের বিষয় হলো  তারা তাদের সুবিধামত হাদীস নিচ্ছে, অন্যের বিরুদ্ধে বলার জন্য একটি সহীহ হাদীসকে জয়ীফ বলছে আবার তাদের পক্ষে সুবিধার জন্য অনেক জয়ীফ হাদীসকেও সহীহ বলে চালিয়ে দিচ্ছে! এসবের পিছনে কোন কূটিল চাল নেই তো?

ওলামায়েকেরামগণ অনেক আগ থেকেই মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে আসছেন যে, লা-মাযহাবী তথাকথিত আহলে হাদীস নামের দলটি আসলে একটি বাতিল ফের্কা ও গোমরাহি দল। তাঁরা বেশ ভাল করেই জানতেন তাদের জন্মের কাহিনী, ওদের হাদীস অস্বীকার করার বাস্তব অবস্থা, ওদের সাহাবা বিদ্বেষের নমুনা, ওদের নবী রাসূল বিদ্বেষের বাস্তব ঘটনা, সলফে সালেহীনদের প্রতি মুসলমানদের আস্তা ও ভক্তি নষ্ট করার প্রয়াস, মুসলমানদের মাঝে বিভ্রান্তি  ছড়িয়ে শতধা বিভক্ত করার ওদের বদ পরিকল্পনা, ইসলামের বেশকিছু হুকুম বাদ করে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্ত এবং জঘন্য সব অপপ্রয়াস। একটি কথা অনেক আগে থেকেই অনেকে জানেন, আসলে ওদের জন্মদাতা হলো ব্রিটিশ সরকার। তাই কখনো দেখবেন না তাদের পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধাচরণ করতে। 

ইংরেজ সরকার তো কখনো  ইসলামের এতো ভক্ত ছিল না যে ইসলামের প্রচারপ্রচারণায় ও বিকাশে তারা কোন দলকে টাকা পয়সা খরচ করে মার্কেটে নামাবে? বরং ইংরেজ সরকার ইসলামকে ধ্বংস করার জন্যই বিভিন্ন দল ও উপদল বানিয়েছিল; তার মধ্য থেকে কাদিয়ানীকে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে। লা-মাজহাবী তথাকথিত আহলে হাদীস দলও সেই ইংরেজ বাপের জন্ম দেয়া অন্যতম আরেকটি দল। সুতরাং তখন থেকেই এই উপমহাদেশের আলেম সমাজ বলে আসছেন - এই দলটিকে ইসলাম ধ্বংস করার জন্যই জন্ম দিয়েছে ব্রিটিশরা। সম্প্রতি তাদের মুখোশ অনেকটাই উন্মোচিত হয়েছে; এরই মধ্যে খাঁটি  মুসলমানদের কাছে সব কিছু অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে; যতই দিন যাচ্ছে এবং যাবে সারা বিশ্বের সামনে  তাদের মুখোশ আরো বেশি উন্মুচিত হবে। 

'মুযাহেরে হক্ব' কিতাবের স্বনামধন্য লেখক মাওলানা কুতুব উদ্দীন তার 'তুহফাতুল আরব ওয়াল আযম' গ্রন্থে লা-মাযহাবী গাইরে মুক্বাল্লিদ-এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন ঠিক এই ভাবে, 'সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ, মাওলানা ইসমাইল শহীদ ও মাওলানা আব্দুল হাই (রঃ) পাঞ্জাবে আগমন করার পরপরই কতিপয় বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীর সমন্বয়ে চার মাজহাবের ইমামগণের তাক্কলীদ অস্বীকারকারী নতুন ফের্কাটির সূত্রপাত লক্ষ্য করা যায়। যারা হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (রঃ)-র মুজাহিদ বাহিনীর বিদ্রোহী গ্রুপের সদস্য ছিল; ওদের মূখপাত্র ছিল মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী (মৃত- ১২৭৫ হি:)। তার এ ধরনের অসংখ্য ভ্রান্ত কর্মকান্ডের কারণে, সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (রঃ) ১২৪৬ হিজরীতে তাকে মুজাহিদ বাহিনী থেকে বহিষ্কার করেন। তখনই গোটা ভারতবর্ষের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগণ, বিশেষ করে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (রঃ)-এর খলীফা ও মুরীদগণ হারামাইন শরীফাইনের তদানীন্তন উলামায়ে কিরাম ও মুফতীগণের নিকট এ ব্যাপারে ফতওয়া তলব করেন। ফলে সেখানকার তৎকালীন চার মাযহাবের সম্মানীত মুফতীগণ ও অন্যান্য উলামায়ে কেরামগণ সর্বসম্মতিক্রমে মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী ও তার অনুসারীদেরকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ফির্কা বলে অভিহিত করেন; এবং মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসীকে কতল (হত্যা) করার নির্দেশ প্রদান করেন (এ ফতওয়া ১২৫৪ হিজরীতে তান্বীহুদ্দাল্লীন নামে প্রকাশ করা হয়, এখনো দেশের বিশিষ্ট লাইব্রেরীতে এর কপি সংরক্ষিত রয়েছে।)। মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী পলায়ন করতঃ কোনভাবে আত্মরক্ষা পায়। সেখানে গিয়ে তার নবআবিষ্কৃত দলের প্রধান হয়ে সরলমনা মুসলমানের মধ্যে তার বিষাক্ত মতবাদ ছড়াতে থাকে।' –(তুহফাতুল আরব ওয়াল আজম, পৃষ্ঠা নং - ১৬, খণ্ড - ২, আল-নাজাতুল কামেলা, পৃষ্ঠা নং - ২১৪, তন্বীহুদ্দাল্লীন, পৃষ্ঠা নং - ৩১)

লা-মাযহাবী গাইরে মুক্বাল্লিদ আলিম মৌলভী আসলাম জিরাজপুরী তার বিশিষ্ট রচনা 'নাওয়াদিরো'তে লিখেন, 'প্রথমতঃ এ জামাত নিজেদের বিশেষ কোন নাম রাখেনি। মাওঃ ইসমাইল শহীদ (রঃ)-এর শাহাদাতের পর প্রতিপক্ষের লোকেরা যখন দুর্নাম করার জন্য তাদেরকে ওহবী বলতে শুরু করে, তখন তারা নিজেরদেকে 'মুহাম্মাদী' বলতে থাকে; অতঃপর এ নামটি পরিহার করে 'আহলে হাদীস' উপাধি চয়ন করে; যা আজ পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে।' –(নাওয়াদিরাত, পৃষ্ঠা নং - ৩৪২)

উপরোক্ত দু'টি বিররণ থেকে এ'কথাটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী কর্তৃক ১২৪৬ হিজরীতে ভারতবর্ষে বর্তমান গাইরে মুক্বাল্লিদ তথা লা-মাযহাবী নামক নতুন ফের্কাটির জন্ম ও সূত্রপাত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তা 'ওয়াহাবী' হিসেবে পরিচিত ছিল; কিন্তু সে তখন নিজেকে 'মুহাম্মাদী' বলে প্রচার করতো। পরবর্তীতে 'ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম' এ মর্মে ফতওয়া দিয়ে ইংরেজের দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়; এবং এ সুযোগে সে সরকারী কাগজ-পত্র থেকে 'ওয়াহাবী' নাম রহিত করে আহলে হাদীস নাম বরাদ্দ করতে সক্ষম হয়।

ভারতবর্ষে ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসণ ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং ইংরেজ বিতাড়নে জিহাদী মুসলমানদের ব্রিটিশরা খুব বাজে ভাবে 'ওহাবী' উপাধিতে ভূষিত করতো; যদিও আরবের ব্রিটিশ স্পাই মিস্টার হামফ্রে-র হাতের তৈরী সেই মোহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নাজদী। ব্রিটিশ ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশনের প্রধান স্যার ডবলিও. ডবলিও. হান্টার-এর 'দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস' গ্রন্থ থেকেও বুঝতে পারা যায় যে, যেসব আলেম-ওলামা তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তাদেরকে তারা যতসব বাজে উপাধিতে ভূষিত করতেন। কিন্তু, তাদের 'ডিভাইড এন্ড রুল'-এর আওতাভূক্ত মুসলমান নামধারী মোনাফেকদের তারা তেমন মন্দ কোন উপধিতে ভূষিত করতেন না। কিন্তু, সত্য ইতিহাস কোন দিনও কোন ভাবেই চেপে রাখা যায় না, যায়ওনি; সে সময়ের পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে সব কিছু ঠিকই প্রকাশিত হয়েছে এবং হক প্রন্থিদের আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা ঠিকই ইতিহাসে অমর করে রেখেছেন।

সে সময় ইংরেজদের বিপক্ষে যাওয়া  মুসলমানদের ইংরেজ সরকার অতি সহজেই একটি 'ওহাবী' তকমা লাগিয়ে দিতো। গাইরে মুক্বাল্লিদরা এই ওহহাবী নামের তকমা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তাই তারা তখন নিজেদের 'মুহাম্মদী' এবং পরবর্তীতে 'আহলে হাদীস' নাম বরাদ্দ করার জন্য সম্ভাব্য সকল অপতৎপরতা চালিয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে গাইরে মুক্বাল্লিদদের তৎকালীন মুখমাত্র মৌলভী মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভী লাহোরী বৃটিশ সরকারের প্রধান কার্যালয় এবং পাঞ্জাব, সি-পি, ইউ-পি, বোম্বাই, মাদ্রাজ ও বাঙ্গালসহ বিভিন্ন শাখা অফিসে ইংরেজ প্রশাসনের আনুগত্যতা ও বশ্যতা স্বীকার করে তাদের জন্য 'আহলে হাদীস' নামটি বরাদ্দ দেয়ার জন্য দরখাস্ত করে। এ দরখাস্তগুলোর প্রতি-উত্তরসহ তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত তৎকালীন 'এশায়াতুস সুন্নাহ' পত্রিকায় (পৃষ্ঠা : ২৪-২৬, সংখ্যা: ২, খণ্ড : ১১) প্রকাশ করা হয়। যা পরে সাময়ীক নিবন্ধ আকারেও প্রকাশ পায় ও বাজারজাত করা হয়। তাদের মানসিকতা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কিছুটা আঁচ করার জন্য এখানে একটি উর্দু দরখাস্তের বাংলা অনুবাদ তুলে ধরছি।

'খেদমতে জনাব গভর্মেন্ট সেক্রেটারী,

আমি আপনার খেদমতে লাইন কয়েক লেখার অনুমতি এবং এর জন্য ক্ষমাও প্রার্থনা  করছি। আমার সম্পাদিত মাসিক 'এশায়াতুস সুন্নাহ' পত্রিকায় ১৮৮৬ ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলাম যে, ওহাবী শব্দটি ইংরেজ সরকারের নিমক হারাম ও রাষ্ট্রদ্রোহীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ শব্দটি হিন্দুস্তানের মুসলমানদের ঐ অংশের জন্য ব্যবহার সমীচিন হবে না, যাদেরকে 'আহলে হাদীস' বলা হয় এবং সর্বদা ইংরেজ সরকারের নিমক হালালী, আনুগত্যতা ও কল্যাণই প্রত্যাশা করে, যা বার বার প্রমাণও হয়েছে এবং সরকারী চিঠি প্রত্রে এর স্বীকৃতিও রয়েছে।
অতএব, এ দলের প্রতি ওহাবী শব্দ ব্যবহারের জোর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে এবং সাথে সাথে গভর্মেন্টের বরাবর অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে আবেদন করা যাচ্ছে যে, সরকারীভাবে এ ওহাবী শব্দ রহতি করে আমাদের উপর এর ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক এবং এ শব্দের পরিবর্তে 'আহলে হাদীস' সম্বোধন করা হোক।

আপনার একান্ত অনুগত খাদেম

আবু সাঈদ মুহাম্মদ হুসাইন

সম্পাদক : এশায়াতুস সুন্নাহ'

দরখাস্ত অনুযায়ী ইংরেজ সরকার তাদের জন্য 'ওহাবী' শব্দের পরিবর্তে 'আহলে হাদীস' নাম বরাদ্দ করেছে; এবং সরকারী কাগজপত্র, চিঠি ও সকল পর্যায়ে তাদের 'আহলে হাদীস' সম্বোধনের নোটিশ জারি করে নিয়মতান্তিকভাবে দরখাস্তকারীকেও লিখিতভাবে মঞ্জুরী নোটিশ দ্বারা অবহিত করেছে।

সর্বপ্রথম পাঞ্জাব গভার্মেন্ট সেক্রেটারী মি: ডব্লউ, এম, এন (W.M.N) বাহাদুর চিঠি নং-১৭৫৮ এর মাধ্যমে ৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৬ ইংরেজিতে অনুমোদনপত্র প্রেরণ করেন। অতঃপর ১৪ই জুলাই ১৮৮৮ইং সি.পি গভার্মেন্ট চিঠি নং-৪০৭ এর মাধ্যমে এবং ২০শে জুলাই ১৮৮৮ইং ইউ.পি গভার্মেন্ট চিঠি নং-৩৮৬ এর মাধমে এবং ১৪ই আগষ্ট ১৮৮৮ইং বোম্বাই গভার্মেন্ট চিঠি নং-৭৩২ এর মাধ্যমে এবং ১৫ই আগষ্ট ১৮৮৮মাদ্রাজ গভার্মেন্ট চিঠি নং ১২৭ এর মাধ্যমে এবং ৪ঠা মার্চ ১৮৯০ইং বাঙ্গাল গভার্মেন্ট চিঠি নং-১৫৫ এর মাধ্যমে দরখাস্তকারী মৌলভী আবু সাইদ মোহাম্মদ বাটালভীকে অবহিত করা হয়। –(এশায়াতুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা : ৩২-৩৯, সংখ্যা : ২, খণ্ড : ১১)

কোন মুসলিম দল বা জামাতের নাম অমুসলিম তথা মুসলামানদের চিরশত্রু খ্রিস্টান নাছারাদের মাধ্যমে বরাদ্দ করার ঘটনা সারে চৌদ্দশ বছরের ইসলামের ইতিহাসে এটিই প্রথম  এবং এটি একটি বিরল ঘটনা; যা কেবল এই উপমহাদেশের গাইরে মুক্বাল্লিদ আহলে হাদীসদেরই গৌরব ও সৌভাগ্যের ব্যাপার! তাই তারা এ ইতিহাসটি অত্যন্ত গৌরবের সাথে নিজেদের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করে সে'সময় বেশ তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিল!

সুরা মুহাম্মদ-এর ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন-  
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ  অর্থাৎ - হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রসূলের (সাঃ) আনুগত্য কর এবং নিজেদের কর্ম বিনষ্ট করো না।   
সুরা মুনাফিকুন-এর ১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন-
إِذَا جَاءكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ অর্থাৎ - মুনাফিকরা আপনার কাছে এসে বলেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। 

সুরা আল ইমরান-এর ৩১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন-
 قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ অর্থাৎ - বল, 'যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমার অনুসরণ করো। (তাহলে) আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।'

অনুসরণের নির্দেশবিষয়ক পবিত্র কুর'আনের বর্ণনা - 
১). ‘তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং অনুগত হও রাসূলের।' - (সূরা আল ইমরান : ৩২)
২). ‘ওহে যারা ঈমান এনেছো! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের।' (সূরা আননিসা : ৫৯) 
৩). ‘আর তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো আর রাসূলের আনুগত্য করো এবং সতর্ক হও।' - (সূরা আল মায়েদা : ৯২) 

অনুসরণকারীদের জন্য সুসংবাদ : রাসুল (সাঃ)-কে অনুসরণের নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকেও রাসূলুল্লাহর (সাঃ)-এর অনুসরণ-অনুকরণে বাধ্য করার জন্য, অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করার জন্য পুরস্কারস্বরূপ সুসংবাদও দিয়েছেন; পবিত্র কুর'আনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে - 
১). ‘আর যে কেউ আল্লাহর আনুগত্য করে এবং রাসূলের অনুসরণ করে, সে তো অবশ্যই মহাসাফল্য লাভ করবে।' - (সূরা আহযাব : ৭১) 
২). ‘আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত হয়, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে, এ হলো মহাসাফল্য।' - (সূরা নিসা : ১৩) 
৩). ‘আপনি বলে দিন, যদি তোমরা প্রকৃতই আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করো, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালো বাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন।' - (সূরা আল ইমরান : ৩১)

হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন, 'তোমরা আমার সুন্নাহকে অনুসরন কর।' 
এখন একটি বিষয় ভাল করে লক্ষ্য করুন - প্রত্যেক সুন্নাহই এক একটি হাদিস, কিন্তু প্রত্যেক হাদিসই সুন্নাহ নয়। দ্বীনের উপর চলার জন্য উম্মত সকল হাদীসকেই অনুসরন করতে পারবে কি? অবশ্যই না; যদি সেই হাদীসটি সহীহও হয়। কেননা অনেক সহীহ হাদীস আছে যা অন্য একটি বা একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা রহিত (বাতিল) হয়ে গেছে; বা যা পূর্বের বিধান ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হুকুম দ্বারা তা রহিত হয়ে গেছে। নিচে তেমনই  কয়েকটি হাদীস-এর উদাহরণ দেয়া হলো -

১). ইসলামের প্রথম যুগে নামাযরত অবস্থায় কথা বলা, সালাম দেওয়া , সালামের উত্তর দেওয়া সবই বৈধ ছিল। –(সহীহ্ বুখারী; হাদীস নং- ১১৯৯, ১২০০)
নামাজে কথা বলা যাবে এটা সহীহ হাদীসে আছে, কিন্তু আপনি কি এখন নামাজে কথা বলতে পারবেন? না পারবেন না; কারণ পরবর্তীতে এই বিধান রহিত হয়ে যায়।

২). হুজুর পাক (সাঃ)-সহ অন্যান্য মুসলিমগণ হিজরতের পর মদীনায় ১৬/১৭ মাস বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায আদায় করতেন। –)সহীহ্ বুখারী; হাদীস নং- ৭২৫২)
এখন কি আপনি পারবেন সহিহ হাদিসের ধোয়া তুলে মক্কার দিকে ফিরে নামাজ না আদায় করে বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতে?

৩). ইসলামের প্রথম যুগে বিধান ছিল যে, আগুনে রান্নাকৃত খাদ্য গ্রহণ করলে ওজু ভেঙ্গে যাবে। –(সহীহ্ বুখারী; হাদীস নং- ২০৮)
এটা তো সহীহ হাদীসেই আছে। আপনার জন্য কি এটা করা এখন বৈধ হবে? না, এটা হবে সুস্পষ্ট হারাম। কারণ, পরবর্তীতে এই বিধান বাতিল হয়ে গেছে।
এগুলো সবই সহীহ্ হাদীস, কিন্তু সুন্নাহ নয়; অর্থাৎ এই হাদীসগুলো উম্মতের জন্য এখন আর অনুসরণীয়  নয়।

৪). রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ১১টি বিয়ে করেছেন; এবং দেন মহর ছাড়াও তিনি বিয়ে করেছেন। –(সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ফী সীরাতি খাইরিল ইবাদ ১১/১৪৩-২১৭)
আপনি কি পারবেন ১১টি বিয়ে করতে? এগুলি তো সহীহ হাদিসেই আছে। তবে কেন পারবেন না? এমন অনেক হাদিস আছে যার বিধান নবী করীম (সাঃ)-এর সঙ্গে নির্দিষ্ট; উম্মতের জন্য সেসব আমল করা বৈধ নয়। এই বিষয়গুলো অবশ্যই বুঝতে হবে এবং বুঝা প্রয়োজনও।

৫). রাসুল পাক (সাঃ) দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছেন। –(সহীহ্ বুখারী; হাদীস নং- ১৯৩৮) কোমরে ব্যথা থাকার কারণে কিংবা এস্তেন্জা করার স্থানে বসার দ্বারা শরীরে বা কাপড়ে নাপাকি লাগার অশংঙ্কায় তিনি সারা জীবনে মাত্র ২বার দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেছেন; কিন্তু হাদীসের বর্ণনায় এসব কারণের কথা উল্লেখ নেই । শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার কথা আলোচিত হয়েছে। তো হাদীস সহীহ বলে এর উপর আমল করে কি দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করাকে সুন্নাহ বলা যাবে? এগুলো সবই সহীহ হাদীস, কিন্তু সুন্নাহ নয়; তাই, এই হাদীসগুলো উম্মতের জন্য অনুসরনীয় নয়।

যারা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে দাবী করছেন তাদের উচিৎ ১১টি বিয়ে করা, মহর ছাড়া বিয়ে করা, ইহরাম ও রোযা অবস্থায় শিঙ্গা লাগানো, দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা, বাইতুল মোকাদ্দেসের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করা, নামাজরত অবস্থায় কথা বলা; কারণ এর সবগুলোই সহিহ হাদীসে রয়েছে। কিন্তু  এসব এখন আর কোনভাবেই করতে পারবেন না। সুতরাং প্রকৃত সত্য হলো— কোন মুসলমানই কখনো আহলে হাদিস হতে পারে না পারবে না, প্রতিটি মুসলিমকে হতে হবে আহলে সুন্নাহ।

সহীহ হাদীসে মানবো ঠিক আছে, কিন্তু মাজহাব মানবো কেন? এই স্লোগানটি দিয়ে মুলতঃ ইসলাম না জানা অজ্ঞদেরই আই ওয়াশ করা হয়। আর যারা জেনে বুঝে এসব করে তাদের আসলে উদ্দেশ্য কি? এসব লিখতে গেলে লেখা আর কোনদিনই শেষ হবে না; এমন কি কাল কিয়ামত পর্যন্ত লিখলেও শেষ করা যাবে না। তবে যারা জেনে বুঝে এসব করে, তাদের উদ্দেশ্য কায়িক কিছু ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ। ওরা আসলে ব্রিটিশ-আমেরিকান মুসলিম বিরোধী মিশন বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে। আমেরিকা ও ইহুদীদের লক্ষ্য হচ্ছে, মুসলিমদের মধ্যে বিবাদ বাঁধিয়ে রেখে মুসলমানের উপর আধিপত্য বিস্তার করা।

এখন কথা হচ্ছে কোনটি সুন্নাহ আর কোনটি হাদীস? কোন হাদিসটি আমলযোগ্য নয়, কিংবা কোন হাদিসের চেয়ে কোন হাদিস অধিক আমলযোগ্য? এসব তো আমরা সবায়ই জানিনা, বুঝবো কি করে? এসব জানেন হাদীসবীদ ফকিহগণ। তাই, আমাদের উচিত তাঁদের অনুসরণ করা। আর তাদের অনুসরণ করাকেই বলে তাকলীদ করা; অন্য কথায় মাজহাব মানা। 

এ বিষয়ে রিয়াদুস সালেহিন রচনাকারী বিখ্যাত সালাফী ইমাম নববী বলেন, 'ব্যক্তি তাকলীদের অপরিহার্যতার কারণ এই যে, মুক্ত তাকলীদের অনুমতি দেয়া হলে প্রবৃত্তি তাড়িত মানুষ সকল মাজহাবের অনুকূল বিষয়গুলোই শুধু বেছে নিবে। ফলে হালাল-হারাম ও বৈধ-অবৈধ নির্ধারণের এখতিয়ার এসে যাবে তার হাতে। প্রথম যুগে অবশ্য ব্যক্তি তাকলীদ পুরাপুরি সম্ভব ছিলো না (তথাপিও ফকীহ সাহাবী (রাঃ)-গণের তাকলীদ করা হত )। কেননা, ফিকাহ বিষয়ক মাজহাবগুলো যেমন সুবিন্যস্ত ও পূর্নাঙ্গ ছিলো না, তেমনি সর্বত্র সেসব সহজলভ্যও ছিলো না। কিন্তু এখন তা সুবিন্যস্ত ও পূর্নাঙ্গ আকারে সর্বত্র সহজলভ্য। সুতরাং যে কোন একটি মাজহাব বেছে নিয়ে একনিষ্টভাবে তা অনুসরণ করাই এখন অপরিহার্য।'  –(আল মাজমু শরহুল মুহায্যাব; ১/১৯)

গাইরে মুকাল্লিদ আহলে হাদীসরা মানুষের আই ওয়াশ করার জন্য বলে থাকেন, মাজহাবের মধ্যে এতো মত পার্থক্য কেন? তারা দ্বীনের মধ্যে বিভাজন করছে। প্রথম কথা হচ্ছে, মাজহাবের ইমামদের মধ্যে যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে তা মুস্তাহাব। এগুলোর ভুল হলে কোন ক্ষতি নেই, সঠিকভাবে পালন করতে পারলে ভাল। যেমন– নামাজে কোথায় হাত বাধতে হবে এটা নিয়ে অনেক মতপার্থক্য। হাত যেখানেই বাধা হউক না কেন নামাজ আদায় হয়ে যাবে। এই মতপার্থক্যগুলো এতই সুক্ষ্ম যে, কাউকে ভুল বলা যায় না; প্রত্যেকের দলিল দেখলে মনে হয়, তারাই সঠিক।

মনে করুন, একটি অণুতে একটি পরমাণু কম হয়েছে; আরেকজন বলছেন, একটি বেশি হয়েছে। অণু-পরমাণু খুবই সুক্ষ্ম হওয়ায় আমরা জানি না আসলে কার কথাটি সঠিক। আমাদের পূর্ববর্তী মহান ইমামদের মাঝে মত পার্থক্যগুলোও ছিল ঠিক এতোটাই সুক্ষ্ম। সাহাবী (রাঃ)-গণের মধ্যেও এ'ধরনের মতপার্থক্য ছিল। অতএব, এসব বুঝতে হবে নিজের বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে।

হে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা! আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন॥

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২৩ মার্চ, ২০১৮.