শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আতাউল্লাহ বুখারী ও মির্জা কাদিয়ানীর তথাকথিত ডিবেট :



'সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারী ও মির্জা কাদিয়ানীর ডিবেট' নামের একটি কল্পকাহিনী আমাদের দেশের তথাকথিত কিছু বিবেকহীন মোল্লা/মৌলুভী একসময় প্রচার করেছে, না জেনে না বুঝে গবেষণা ছাড়া সেসব বয়ানের সূত্র ধরে বর্তমানে একশ্রেণীর তরুণ ওয়াজেরীয়ানও ওয়াজের মঞ্চে তা চাউর করছে; যা ইউটিউবসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে হচ্ছে এবং বলা যায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ তথাকথিত ইসলামিক বক্তাই এই কাল্পনিক ডিবেটের কথা তুলে ধরে কাদিয়ানীদের নাজেহাল করতে চেষ্টা করছে; ঘটনাটি আসলে কি, তা কি তারা একেবারও চিন্তা করেছে? বাস্তবতায় তারা নিজেরাই হাসির পাত্র হচ্ছে। একবারের জন্যও কেন তারা চিন্তা করে দেখে না মিথ্যা দিয়ে সত্য কখনও প্রতিষ্ঠা করা যায় না; বরং সমালোচিত হতে হয় এবং প্রকৃত সত্যটাও ধামাচাপা পড়ে যায়।  

কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে কেন? ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতে খামাখা কেনইবা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে? গবেষণা করে সত্যটা জেনে বুঝে নিলেই তো হয়। মির্জা কাদিয়ানী মারা গেছে ১৯০৮ সালে, তখন আতাউল্লাহ বুখারীর বয়স কত?    

 সৈয়দ আতাউল্লাহ শাহ বুখারী (রঃ), জন্ম: সেপ্টেম্বর ২৩, ১৮৯২ — মৃুত্যু: আগস্ট ২১, ১৯৬১; যিনি ছিলেন একজন মুসলিম হানাফী পণ্ডিত, ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মীয় ও সিনিয়র রাজনৈতিক নেতা। তিনি ছিলেন মজলিস-ই-আহরার-ই ইসলাম এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম একজন।  আতাউল্লাহ বুখারীর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান ছিল ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে শক্তিশালী ব্রিটিশ-বিরোধী অনুভূতির অঙ্কুরোদগম সৃষ্টি করা। আর মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানী, জন্ম: ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৫ — মৃত্যু: ২৬ মে ১৯০৮; একজন ভারতীয় ধর্মীয় নেতা, এবং আহমদিয়া মুসলিম জামাত নামক এক ধর্মের প্রবর্তক। তাঁর দাবীসমূহ— ১৪ শতাব্দীর  মুজাদ্দিদ  (আধ্যাত্মিক সংস্কারক), প্রতিশ্রুত মসিহ, মাহাদি, নবী এবং খলীফা; তিনি অবশ্য  ইসলামের পরিপূর্ণতা দানকারী একজন উম্মতি নবী হিসেবেও নিজেকে দাবী করেন। মুসলিম উম্মাহ যাকে একজন ভণ্ড নবী হিসেবে চিনে।

ভন্ডনবী মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ১৮৯১ সালের ২২শে জানুয়ারী যখন নিজেকে ‘প্রতিশ্রুত মাসীহ’ দাবী করে, তখন মাওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরী ছিলেন একজন ছাত্র, আতাউল্লাহ বুখারীর জন্মই হয়নি।  এই দাবীর দেড় বছর পর সানাউল্লাহ অমৃতসরী ফারেগ হন এবং উলূম ও ফুনূনে ঋদ্ধ হয়ে ১৮৯২ সালে নিজ জন্মভূমি অমৃতসরে ফিরে আসেন, আতাউল্লাহ বুখারী তখন সবে জন্মগ্রহণ করেন। অতএব আতাউল্লাহ বুখারীর সাথে মির্জা কাদিয়ানী ডিবেট কতটা যৌক্তিক?? 

মির্জা কাদিয়ানীর বিরুদ্ধে সে সময়কার সব বড় বড় আলেম-ওলামাই সোচ্চার হয়েছিলেন, তন্মধ্যে মাওনা সানাউল্লাহ অমৃতসরী অন্যতম; মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী (মৃঃ ১৯২০ খৃঃ), সৈয়দ নাজীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী, মাওলানা আব্দুল হক গযনভী, মাওলানা মুহাম্মাদ বাশীর সাহসোয়ানী (১৮৩৪-১৯০৮ খৃঃ), মাওলানা কাজী মুহাম্মাদ সুলাইমান মানছূরপুরী, মাওলানা আব্দুল জববার গযনভী, মাওলানা আহমাদুল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা গোলাম আলী কাছূরী, মাওলানা হাফেজ আব্দুল মান্নান ওয়াজীরাবাদী (১৮৫১-১৯১৫ খৃঃ), মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী, মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী, মহাকবি ড. মুহাম্মাদ ইকবাল, ‘জমীনদার’ পত্রিকার সম্পাদক জাফর আলী খান (১৮৭৩-১৯৫৬ খৃঃ) প্রমুখ কাদিয়ানীদের মুখোশ উন্মোচনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন; পরবর্তীতে সে দলের অন্যতম একজন সৈনিক হন সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারী। যার ফলে জনসম্মুখে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে। মাওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরী ভণ্ড নবী বিরুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে ময়দানে নেমে পড়েছিলেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেন; তাঁদের প্রচারণার ফলেই পৃথিবীর অন্যসব হাক্কানী ওলামায়ে কেরামগণও তখন চতুর্দিকে সোচ্চার হন। 

সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারীর সাথে মূলতঃ বাহাস হয়েছিল মির্জাপুত্র বশির উদ্দিন মাহমুদের; ভুল করে যা মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নামে প্রচার করা হয়! সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারীর জ্ঞানগর্ভ সেই বক্তব্য প্রায়ই আমাদের দেশের বক্তাদের বয়ানে শুনতে পাই, কিন্তু অধিকাংশ বক্তা  তখনকার সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারীর প্রতিপক্ষ ভুল করে মির্যা কাদিয়ানীকে করে ফেলে; যা চরম ভুল। মির্জা কাদিয়ানী যখন কলেরায় মারা যায়, তখন সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারীর বয়স মাত্র ১৬ বছর।

তবে কি উক্ত ঘটনাটি পুরোপুরি মিথ্যা? মোটেও না! সঠিক ঘটনাটি হলো, আতাউল্লাহ বুখারীর প্রতিপক্ষের ডিবেটার ছিল মির্জা বশির উদ্দিন মাহমুদ; মির্জা কাদিয়ানীর পুত্র ও কাদিয়ানী জামাত (একাংশ, রাবওয়া গ্রুপ)'র দ্বিতীয় খলিফা, যার মৃত্যু ১৯৬৫ সালে।

ঐতিহাসিক সেই মজার ঘটনাটি এখন আমি অতি সংক্ষেপে তুলে ধরতে যাচ্ছি। ১৯৫৩ সালের ঘটনা; সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে তখন খতমে নবুওত আন্দোলনে উত্তাল জনতা। 'খতমে নবুওত' এর শরয়ী অবস্থা, যুক্তিকতা এবং গুরুত্ব উঠিয়ে ধরার উদ্দেশ্যে তখন গঠিত হয় 'Monir Enquire Tribunal' (মুনির ইনকোয়ারি ট্রাইব্যুনাল); দেশের শীর্ষস্থানীয় সকল ওলামায়েকেরাম এই ট্রাইব্যুনালে যোগদান করেন। কাদিয়ানীদের প্রতিনিধিত্ব করতে যোগ দেয় মির্জাপুত্র মির্জা বশির উদ্দিন মাহমুদ, এদিকে খতমে নবুওত আন্দোলনের বীর সিপাহশালার সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারী ট্রাইব্যুনালে যোগ দেন। 

দুই পক্ষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে— সত্যের পক্ষে সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারী, আর অন্য পক্ষে শানে রেসালতের বিদ্রোহীপক্ষ কাদিয়ানী জামাতের দ্বিতীয় খলিফা মির্জা বশির উদ্দিন মাহমুদ। বক্তব্যের  এক পর্যায়ে মির্জা বশির বলে, সূরা আস সাফফ ৬ নং আয়াতের মধ্যে 'ইসমুহু আহমদ' হতে 'আহমদ' দ্বারা গোলাম আহমদ-ই উদ্দেশ্য। জবাবে সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারী বলেন, এই আয়াতে তো শুধুই 'আহমদ' আছে। কিন্তু তোমার বাপের নাম তো 'গোলাম আহমদ'! 
মির্জাপুত্র : 'গোলাম' শব্দ কেটে দিন তথা 'গোলাম' শব্দটি নামের শুরু থেকে বাদ দিয়ে দিন।
তখন সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারী : তাই নাকি! তাহলে তো আমার নামের শুরু থেকে 'আতা' বাদ দিতে পারি! তো 'আতা' শব্দ বাদ দিলে আমি হই 'আল্লাহ'। (তারপর সৈয়দ সাহেব বললেন)— لہذا میں نے اس الو کے پٹھے کو نبی بنا کر بھیجا ہی نہیں অর্থাৎ আমি এই উল্লুক পাঠাটিকে নবী বানিয়ে পাঠাইনি!

এমন বক্তব্যে মির্জাপুত্রের লম্বা জিহ্বা খামোশ বনে গেল, তার বাগাড়ম্বর আর সামনে এগোয়নি;  উপস্থিত দর্শকদের হাসি তামাশা তখন দেখে কে!!!

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১.

শুক্রবার, ৯ জুলাই, ২০২১

জাগো মুসলমান জাগো!


সভ্যতা ও সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে মুসলমানদের শিক্ষা জাগরণ ও এর উৎকর্ষতার ইতিহাস অনস্বীকার্য; ৭ম শতাব্দীর ২য় দশকে আইবেরীয় উপদ্বীপ, তথা বর্তমান স্পেন এবং পর্তুগাল বিজয় ছিল মুসলমানদের এক গৌরবোজ্জ্বল স্বর্ণালী ইতিহাস। সভ্যতা, সৌন্দর্য ও শিক্ষার লীলাভূমি ও কীর্তিমন্দির হিসেবে যেসব মহানগরী পৃথিবীতে খ্যাতি লাভ করেছিল, স্পেনের কর্ডোভা মহানগরী ছিল তাদের অন্যতম। কর্ডোভা পরিচিতি পেয়েছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার  প্রাণকেন্দ্র হিসেবে। তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা ইউরোপ থেকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা এসে জড়ো হতো মুসলিম শিক্ষা জগরণের প্রাণকেন্দ্র থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হতে।
 
যেখানে যাকিছু শিক্ষাউপকরণ হিসেবে পেত, সেখান থেকেই তার ভালটা তারা শিক্ষাব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করত; ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে তালাসের যুদ্ধে চাইনিজরা যখন বন্দী হয় তখন তাদের কাছ থেকে মুসলিমরা কাগজ তৈরির পদ্ধতি শিখে নেয়। বিজ্ঞান, তথা তথ্য ও প্রযুক্তির উন্নতি সাধনই ছিল ইসলামের স্বর্ণালী যুগের সূচনার উদ্দেশ্য এবং সে যুগের উত্থানের পেছনের এক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। জ্ঞান বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা তখন ছিল না যে শাখায় মুসলমানের উন্নতি অগ্রগতি ও পদচারণা ছিল না। আজকের এই যন্ত্র সভ্যতার ডিজিটাল যুগে এসে কেউ যদি আধুনিক শিক্ষাকে পাশকেটে শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে পরে থাকতে চায় তবে তা হবে সবচেয়ে বড় মূর্খতা; অন্ধকারের গহীনে নিজে নিজে তলিয়ে যাওয়া। 

রসায়ন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় মুসলিম গবেষক ও বিজ্ঞানীদের একসময় যথেষ্ট দখল ছিল। মুহাম্মদ ইবনে মূসা আল খোয়ারিজমি, আবু রায়হান আল বিরুনি, মুসা বিন সাকির, ওমর খৈয়াম, আবুল কাশেম ফেরদৌসী, আল-মাসুদী, আত-তাবারি, ইবনে খালদুন এমন আরো অনেক মুসলিম জ্ঞানতাপস যুগে যুগে জ্ঞান চর্চা করে বিশ্বে যে আলোকবর্তিকা উড্ডীন রেখে গেছেন তা আজও পাশ্চাত্য সভ্যতার অমূল্য সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত ও বিবেচিত। মুসলিমদের জ্ঞানচর্চা চলছিল ৫৫০ বছর; আর ঐসময়টা ছিল ইউরোপের ইতিহাসের এক অন্ধকার যুগ; একই সময়ে ভারতবর্ষ অবনত ছিল প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাহ্মণাত্যের অধীনে, যা বৌদ্ধধর্মকে বিধ্বস্ত কিংবা বিকৃত করেছিল।

দার্শনিক আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ নামের তৎকালীন মুসলিম মনীষীরা পৃথিবীর ‘জ্ঞানভাণ্ডার’ নামে পরিচিত ছিলেন; অবশ্য বিশ্বব্যাপী আজও তাঁরা তা-ই আছেন। আল-কিন্দি রসায়ন, চক্ষুরোগসহ চিকিৎসা ও দর্শনে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন; তিনি শতাধিক পুস্তক প্রণয়ন করে গেছেন। আবু আলী হোসাইন ইবনে সিনা মাত্র ১৮ বছর বয়সে চিকিৎসাশাস্ত্রের ব্যুৎপত্তি সৃষ্টি করে বিশ্বজোড়া অনন্য এক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন; চিকিৎসাবিজ্ঞানে যে দুটি বিশ্বকোষ তিনি রচনা করেছিলেন তা দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতো, সেসব পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ১৬ বার পুনঃমুদ্রিত হয়।

মোটামুটিভাবে ৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ১৩তম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত সময়কে ইসলামের স্বর্ণালী যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়; এই আলোকিত যুগেই আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের অগ্রদূত হিসাবে কাজ করেছেন অসংখ্য মুসলিম বিজ্ঞানী ও জ্ঞানতাপস। সাম্রাজ্যবাদের গভীর চক্রান্তে আজকের পৃথিবীর অনেকে মধ্যযুগকে অন্ধকার ও বর্বর যুগ হিসাবে আখ্যা দিয়ে থাকে, বিজ্ঞানময় ধর্ম ইসলামকে জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রগতির পথে অন্তরায় হিসাবে বিবেচনা করে; প্রকৃত সত্য কিন্তু তা নয়। মধ্যযুগে পৃথিবীর অগ্রগতি উন্নতিতে একমাত্র ইসলামই ছিল মূল চালিকাশক্তি; ইসলামের স্বর্ণালী যুগে মুসলমানরাই ছিল পৃথিবীর সর্বক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ।

University বা বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির উদ্ভব হয়েছে লাতিন Universitas Magistrorum et  Scholarium, which roughly means "community of teachers and scholars: যার অর্থ - শিক্ষক ও পণ্ডিতদের সম্প্রদায়। বিদ্যালয় শব্দটির সাথে বিশ্ব শব্দটি যোগ করার অর্থ হলো - এই বিদ্যাপীঠ শুধুমাত্র কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশ বা জাতির জন্য নয়, বরং এটি সারা বিশ্বের সব মানবজাতির জন্য। এখানে সারা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোন দেশের যেকোন মানুষ পড়তে ও পড়াতে পারবে। বর্তমানে পৃথিবীতে এমন লাখো ইউনিভার্সিটি আছে, কিন্তু কোনটি পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় তা নিয়ে বেশ কয়েকটি ভিন্ন অভিমত থাকলেও জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (United Nations Educational, Scientific and Cultural Organization) বা ইউনেস্কো (UNESCO)-এর ঘোষনানুযায়ী কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর প্রথম স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়।
 
[Ref : A History of the University in Europe. Vol. I : Universities in the Middle Ages, Cambridge University Press, 2003, ISBN 978-0-521-54113-8, pp. 35–76]

অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে আফ্রিকার সবচেয়ে পশ্চিমের একটি দেশ মরোক্কো; ইউরোপের খুব কাছে হলেও দেশটি ইউরোপীয় নয়। বর্তমানে রাজধানী রাবাত ছেয়ে গেছে বিদেশি গাড়িতে, অথচ সেখানেই এখনও উট ছাড়া কোথাও ভ্রমণ অকল্পনীয়৷ মরক্কোর ফেজ নগরীতে পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়টির ১১০০তম বর্ষপূর্তি ঘটে আরম্বর এক জাতীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় চালুর সময় ছিল ইসলামের স্বর্ণালী যুগ। নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে ফেজ নগরী ছিল অনেকটা গ্রামসদৃশ। তখন মরক্কোর শাসক আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন - ‘হে আল্লাহ! আপনি এ নগরীকে আইন ও বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে কবুল করুন।’ 

সে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ফেজ নগরীর এক বিধবা ধনাঢ্য মহীয়সী নারী চালু করেন কারাওইন মসজিদ; কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় সেই মসজিদের অংশ হিসেবেই ৮৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফাতিমা আল ফিহরি নামের এক মুসলিম মহীয়সী নারী; তাঁর বাবা ছিলেন ফেজ নগরীর ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আল ফিহরি। আল ফিহরি পরিবার ফেজে আসেন নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে; তাঁরা এখানে আসেন তিউনিসিয়ার কারাওইন থেকে। সে সূত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের সঙ্গে কারাওইন থেকে তাঁদের সমাজের বেশ কিছু লেখক ফেজে এসে নগরীর পশ্চিমের অংশে বসবাস করতে শুরু করেন। ফাতিমা আল ফিহরি ও তাঁর বোন মরিয়ম আল ফিহরি উভয়েই ছিলেন সুশিক্ষিত। তাঁরা উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার কাছ থেকে প্রচুর অর্থসম্পদ পেয়েছিলেন। ফাতিমা তাঁর অংশের সবটুকো অর্থ খরচ করে তাঁর সমাজের লেখকদের জন্য একটি মসজিদ তৈরি করে দেন।

ধীরে ধীরে এটি মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়। মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্ব ও ইউরোপের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞান বিনিময়ে কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা শিক্ষক ছিলেন ইবনে মাইমুন (১১৩৫-১২০৪), আল-ইদ্রিসি (মৃত ১১৬৬), ইবনে আরাবি (১১৬৫-১২৪০), ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৩৯৫), ইবনে খতিব, আল-বিতরুজি (অ্যালপে ট্রেজিয়াম), ইবনে হিরজিহিম ও আল ওয়্যাজ্জেন আরো অনেকে। ১৩৪৯ সালে সুলতান আবু ইনান ফ্যাবিস বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন; অসংখ্য মূল্যবান পাণ্ডুলিপি রাখা হয় ওখানে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব মূল্যবান পাণ্ডুলিপি রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে - হরিণের চামড়ার উপর ইমাম মালেক (রহ.)-এর লেখা মুয়াত্তার পাণ্ডুলিপি, ১৬০২ সালে সুলতান আহমাদ আল মনসুরের দেওয়া কোরআনের কপি, সিরাতে ইবনে ইসহাক, ইবনে খালদুনের বই ‘আল-ইবার’-এর মূল কপি। 

কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হতো কোরআন ও ফিকহ (ইসলামী আইনশাস্ত্র), ব্যাকরণ, বক্তৃতাদানবিদ্যা বা অলংকারশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, ইতিহাস, ভূগোল ও সংগীতবিদ্যা। শুরুতে এটি একটি ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র হলেও, অচিরেই এর ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় আট হাজারে; যারা সেখানে চিকিৎসাবিদ্যা থেকে শুরু করে ভূগোল পর্যন্ত অনেক বিষয়েই উচ্চশিক্ষা লাভ করতেন। আরব শক্তির সোনালি দিনগুলোতে মুসলমানরাই ছিল বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞান জগতের অভিজাত সম্প্রদায়। মুসলমানরাই পরিপূর্ণতা দিয়েছিল অ্যালজাবরা-র; আরবি ‘আল-জাবর’ থেকে এসেছে অ্যালজাবরা-র নাম। মুসলমানরাই বিশ্লেষণ জ্যামিতি, সমতলীয় ত্রিকোণোমিতি ও গোলকীয় ত্রিকোণোমিতির জনক; জ্যোতির্বিদ্যার অগ্রদূত। ফেজ নগরীতে তখন বিশ্বের সকল পণ্ডিতবর্গের সমাবেশ ঘটতো। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এক ফরাসি তরুণ, যিনি পরে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন পোপ দ্বিতীয় সিলভারস্টার (৯৯৯-১০০৩) নামে।

ইউরোপের জাগরণের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের স্বর্ণালী যুগের অবসান ঘটে; সাম্রাজ্যবাদের নতুন ইতিহাস শুরু হয়। মধ্য-অষ্টাদশ শতাব্দীতে কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কূটকৌশলে নেমে আসে এক কালো অধ্যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায় জ্ঞানী-গুণী আর বিজ্ঞানীরা; সেখানে অবশেষ পরে থাকে শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নেয়া আলেম-ওলামারা। ১৯১২-৫৬ সময়ে মরক্কো ছিল ফ্রান্সের প্রটেক্টরেট। সাম্রাজ্যবাদের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে সেই সময়টায় এ বিশ্ববিদ্যালয় একদম ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল; তখন সেখানে পরীক্ষা ও ডিগ্রি দেয়া বলতে গেলে বন্ধ হয়ে যায়, শুধু ধর্মশিক্ষা কোনোমতে  চালু থাকে।  ছাত্রদের তখন থাকতে হতো অনুপযুক্ত আলোহীন ও বায়ুহীন প্রকোষ্ঠে, জানালাহীন কক্ষে; ঘুমাতে হতো মেঝেতে,  রান্না করতে হতো কয়লার চুলোতে।

১৯৫৬ সালে মরক্কো পুনরায় স্বাধীন হয়; জাতিকে বিংশ শতাব্দীর উপযোগী করে গড়ে তোলার দৃঢ়তা নিয়ে বাদশাহ পঞ্চম মোহাম্মদ আরেকবার কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে ধর্মীয় পাঠপরিধি কমিয়ে চালু করেন গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, বিদেশী ভাষাবিষয়ক পাঠক্রমসহ নানাবিধ বিষয়। ১৯৫৭ সালেই তিনি সেখানে চালু করেন মহিলা শাখা; এর মাধ্যমে তিনি রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে একটি ঝাঁকুনি দিয়ে দেন। এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ছাত্রীও লেখাশোনা করছে। ১৯৬৩ সালে কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় মরক্কোর আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় পদ্ধতির সাথে যুক্ত হয়ে বর্তমানে এটি বিশ্বের অন্যতম একটি ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষা কেন্দ্র।

শিক্ষাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মৌলিকভাবে একে দুই ভাগে ভাগ করা যায়; জাগতিক শিক্ষা ও দ্বীনী শিক্ষা। মানুষের জাগতিক প্রয়োজন পূরণের উপযোগী জ্ঞান ও বিদ্যা হচ্ছে জাগতিক শিক্ষা; পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির জ্ঞান হচ্ছে দ্বীনী শিক্ষা। প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনগুলো পূরণে এবং দুনিয়াতে অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে মানুষকে দান করা হয়েছে পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা; এগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য ইসলামে পূর্ণমাত্রায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জাগতিক শিক্ষার। আর মানুষ হিসেবে উৎকর্ষতা লাভ ও পরকালের মুক্তিতে দ্বীনী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম, এর কোন বিকল্প নেই।

আর আমরা? বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর এই ডিজিটাল যুগে এসেও এক দল মেতে উঠেছে যথসব অসম প্রতিযোগীতায়; কওমী মাদ্রাসাতে আধুনিক জাগতিক শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রাখতে উঠেপড়ে লেগেছে তারা। কে কাকে কিভাবে দোষারোপ করতে পারে, কার উপর কি চাপিয়ে দেয়া যায়, কি করে অন্ধকার যুগকে আলিঙ্গন করা যায়, ভাস্কর্য নিয়ে নোঙড়া মাতামাতি - এইসব নিয়েই মেতে আছে। সেকেলে ধ্যানধারণা পরিহার করে মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে সময়োপযোগী শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে চলমান বিশ্বের সাথে সমতালে এগিয়ে যাওয়াই একজন খাঁটি মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ্
২৫ এপ্রিল, ২০১৭.

বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন, ২০২১

আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরকে নিয়ে কিছু কথা :


কুপি-হারিকেনের আলোতে লেখাপড়া শিখা মানুষ ভাইরালের জামানায় উপনীত হয়ে কত কি যে দেখলাম আর দেখছি শিখলাম আর শিখছি তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারবো না! ইমামে আজম আবু হানিফা (রঃ)-এর বিখ্যাত কিতাব আল-ফিকহুল আকবর-এর হার্ডকপি আমার কাছে আছে; এ'টা মূলতঃ আকিদার কিতাব। যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের জন্য অন্যন্য ও অদ্বিতীয় একটি  আকিদার কিতাব; ঈমানের মূল দিকনির্দেশনা। অনলাইনে এর পিডিএফ কপি খুঁজতে যেয়ে পড়লাম এক মহা বিপদে! সার্চ দিতেই গুগল যে ফিকহুল আকবর লিঙ্ক সাপ্লাই দিল তা দেখে আমি হতবাক! এ'টা এতো বড় কেন? ইমামে আজমের ৪৯ ধারা গেল কই?? যে বইটা অনুবাদ করেছে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, সে বইটা পড়ার পর জেনে বুঝেই মন্তব্য করছি— ঈমানদারকে বেইমান করার জন্য বইটি তৈরী করা হয়েছে, এবং ইমামে আজমের নাম ব্যবহার করে কূটচালে বাংলাভাষী মুসলমানদের ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে এতো ব্যাপকভাবে অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। 

আমি যে অনুবাদ খুঁজছি তা ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান অনুদিত ও সম্পাদিত 'আল-ফিকহুল আকবর'। যে বইয়ের সাথে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের বইয়ের কোন মিল নেই; বিশ্বাস না হলে মিলিয়ে দেখুন। দশবারের চেষ্টায়ও আসল বই পেলাম না, বারবার গুগল ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর কতৃক সম্পাদিত বইটিই দিল। অবশেষে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের বইটিই ডাউনলোড করে এটার পরিসর দেখে অবাক হলাম; এটি একটি বিশাল বই। বইটি ডাউনলোড করে বেশ কয়দিন লাগিয়ে পড়লাম। এ বইটিতে মূলতঃ ইমামে আজমের প্রতি অবিশ্বাসের তীর ছোড়া হয়েছে; নিশ্চিত একটি জঘন্য কাজ, প্রতারণা! ইমামে আজম আবু হানিফা (রঃ)-র নাম করে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর যে অকাজ-আকাম করে গেছে এবং পৃথিবীতে স্বাক্ষী রেখে গেছে, যা হাজার হাজার মানুষকে পথভ্রষ্টতার অতলে তলিয়ে দিচ্ছে; নিশ্চয় তার প্রতিদান সে ওপারে পাচ্ছে। 

খোঁজ নিয়ে জানতে পাড়লাম মৃত্যুর পর অনলাইন বাজারে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর প্রচণ্ড রকমের ভাইরাল! কিন্তু ওপারে তিনি কেমন আছেন? হায়রে মুসলমান! মরে নেন, সবই টের পাবেন! আসল আর নকল না দেখে না চিনে না বুঝে জাহান্নামের রসদ আর কত কিনবেন? ভাইরাল মিজান, মামুনুল, ত্বহা....  তারপর কে এবং কি?? ইসলামের নামে তথাকথিত আলেমদের এসব ভণ্ডামি আর কত? ভণ্ডামিপূর্ণ এসব কর্মকাণ্ডে পুরো জাতি আজ হতবাক হতভম্ব! তারপরও মুসলমানের জ্ঞানোদয় হয় না, হবে না; কারণ সেই একই— অন্ধত্ব। মুসলমান যতদিন পর্যন্ত 'ইকরা' বা পড়ায় অভ্যস্ত না হবে, ততদিন এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে না।

'রব্বুল আ’লামীন সর্ব প্রথম কি সৃষ্টি করেছেন?'— এ প্রশ্নটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে আমাদের বর্তমান সমাজে; কারণ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর নামের এই তথাকথিত আলেমই উস্কে দিয়ে গেছে ইস্যুটিকে। তার মতো আলেমরাই সৃষ্টি করে গেছে জগতে এতো মতপার্থক্য। 'সর্বপ্রথম সৃষ্টি  কি কলম, না কি নূরে মুহাম্মাদী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম?'— এ নিয়ে বর্তমান মুসলমানরা পুরাপুরি দুইভাবে বিভক্ত। এমন কেন? আমার গবেষণা বলছে— যারা মনে করে প্রথম সৃষ্টি কলম, তাদের চোখে নিশ্চিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদ্বেষী একটি পর্দা আছে। এ কথায় হয়তো অনেকে রাগ করবেন বা করতে পারেন। দুঃখিত! এক কথায় এর চেয়ে আর ভালো কিছু লিখতে পারলাম না। তারপরও আপনাদের অনুরোধ করবো লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়তে।  

হযরত উবাইদা ইবনে ছামিত (রাঃ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত; 'নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম ‘কলম’ সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর কলমকে বললেন, লিখ। কলম বললঃ হে প্রভূ! কি লিখবো? আল্লাহ বললেনঃ লিখ ইতিপূর্বে যা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যা কিছু হবে।' 
হাদিসটি যেসব কিতাবে উল্লেখ আছে— মুসনাদে আবু দাউদ তায়লাসী : হাদিস নং— ৫৭৮; মুসনাদে ইবনে জা’দ : হাদিস নং— ৩৪৪৪; মুসনাদে আহমদ : হাদিস নং— ২২৭০৭; তিরমিযী শরীফ : হাদিস নং — ২১৫৫; মান : সনদ সহীহ।

উক্ত হাদিসের প্রথম অংশ দ্বারা বুঝা যায় 'কলম' প্রথম সৃষ্টি। কিন্তু শেষ অংশটি দ্বারা কি বুঝা যায়?  নিশ্চয় 'কলম' প্রথম সৃষ্টি নয়; কারণ হাদিসটির শেষ অংশে রয়েছে 'আল্লাহ তা'আলা বললেন, 'লিখ ইতিপূর্বে যা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যা কিছু হবে।' যা দ্বারা স্পষ্টতই বুঝা যায়, কলম সৃষ্টির পূর্বেও অনেক কিছু ছিল; কারণ, আরবি এবারতে 'মা কানা' আছে, যা দ্বারা অতীতকালের ঘটনা বুঝায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায় 'কলম'-কে প্রথম সৃষ্টি বলা হয়েছে কলমের সম্মানার্থে; মূলত প্রথম সৃষ্টি ‘কলম’ নয়। আমাদের দেশের কিছু আলেম আছে যারা হাদিসের শেষের অংশ বাদ দিয়ে শুধু প্রথম অংশ বর্ণনা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে, এবং বলে— দেখ প্রথম সৃষ্টি কলম! অথচ হাদিসের পরের অংশ পড়লেই বুঝা যায় প্রথম সৃষ্টি কলম নয়; অন্য কিছু। 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মর্তবা, শা'ন-মান ও মু'জেজা সম্পর্কিত যে কোন হাদিস আলবানী মেশিনে ফেলে আজকাল একদল জাল/জয়ীফ বলছে; ওই মেশিনে পড়লেই যে কোন হাদিস জাল/জয়িফ হয়ে যায়; কোন সনদের প্রয়োজন পড়ে না! এই মেশিনের স্রষ্টা নাসিরুদ্দিন আলবানীকে আমাদের দেশের মানুষ তেমন একটা ভালো চিনে-জানে না, কিন্তু এক্সিডেন্টে মৃত তথাকথিত বিশিষ্ট আলেম ফেসবুক/ইউটিউব মাওলানা মরেও যে অনবরত জগতে ঘুরছে, সেই ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার বিতর্কিত কিতাব— 'হাদীসের নামে জালিয়াতি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিষয়ক জাল হাদীস'-এ নূরে মুহাম্মাদীই (সাঃ) প্রথম সৃষ্টি নয় বলে যে ব্যাখ্যা দাঁড় করেছেন, তা পড়ে ও জেনে-বুঝে এ দেশের মুসলমান আজ গোমড়াহীতে ডুবে যাচ্ছে। অথচ পূর্ববর্তী বিখ্যাত সব আলেম এ হাদিসটি সহীহ্ বলেছেন; যা পরে তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ। একজন মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমি কলম ধরেছি শুধুমাত্র ঈমানি দায় থেকে। ইমামে আজমের ফিকার কিতাব 'ফিকাহুল আকবর'কে তিনি বিকৃত করেছেন এবং 'হাদিসের নামে জালিয়াতি' বলে মুসলিম সমাজকে খণ্ডিত করেছেন, তাই তার বিরুদ্ধে আজকের কলম ধরা। 

আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেবের লেখা অনলাইন কিতাব থেকে কিয়দংশ আমি হুবহু তুলে ধরছি — "নূর মুহাম্মাদী প্রথম সৃষ্টি" অর্থে নিম্নের হাদীসটি সমাজে বহুল প্রচলিত:

أّوَّلُ مَا خَلَقَ اللهُ نُوْرِيْ

‘‘আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন’’। সুদীর্ঘ হাদীসটির সার সংক্ষেপ হলো, জাবির (রা) রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করেন? উত্তরে তিনি বলেন:

أوَّلُ مَا خَلَقَ اللهُ نُوْرَ نَبِيِّك مِنْ نُوْرِهِ....

‘‘সর্বপ্রথম আল্লাহ তোমার নবীর নূরকে তাঁর নূর থেকে সৃষ্টি করেন।’’ এরপর এ লম্বা হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ নূরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে তা থেকে আরশ, কুরসী, লাওহ, কলম, ফিরিশতা, জিন, ইনসান এবং সমগ্র বিশ্বকে সৃষ্টি করা হয়।....

এ হাদীসটির অর্থ ইতোপূর্বে উদ্ধৃত সহীহ মুসলিমের হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, তাতে বলা হয়েছে: ফিরিশতাগণ নূর থেকে, জিনগণ আগুন থেকে এবং মানুষ মাটি থেকে সৃষ্ট। আর এ হাদীসে বলা হচ্ছে যে, ফিরিশতা, জিন, ইনসান ও মহাবিশ্বের সব কিছুই নূর থেকে সৃষ্ট। তারপরও এ হাদীসটির বক্তব্য আমাদের কাছে আকর্ষণীয়। যদি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা বলার বা যা শুনব তাই বলার অনুমতি থাকতো তবে আমরা তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতাম ও বলতাম। কিন্তু যেহেতু তা নিষিদ্ধ তাই কুরআন ও সুন্নাহ-এর নির্দেশ অনুসারে আমরা সনদ অনুসন্ধান করতে বাধ্য হই এবং নিম্নের বিষয়গুলি জানতে পারি:
(ক) বিশ্বে বিদ্যমান কোনো হাদীস গ্রন্থে হাদীসটি সনদ-সহ পাওয়া যায় না। আমরা বলেছি, একটি হাদীস সাধারণত অনেকগুলি হাদীসের গ্রন্থে সনদ-সহ সংকলিত থাকে। কিন্তু এ হাদীসটি কোনো হাদীস গ্রন্থেই সংকলিত হয় নি।

(খ) আমরা দেখেছি যে, ইতিহাস, সীরাত, আকীদা, তাসাউফ, ওয়ায ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থগুলিতেও বহুসংখ্যক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস সনদবিহীন বা সনদ-সহ সংকলিত। ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরের মধ্যে এ সকল বিষয়ক কোনো একটি গ্রন্থেও এ হাদীসটির কোনো উল্লেখ নেই।

(গ)..............
সবগুলো পয়েন্ট তুলে ধরতে গেলে লেখা বিশাল হয়ে যাবে, তাই ওদিকে না গিয়ে.......... 

ইনিয়েবিনিয়ে আরও অনেক ব্যাখ্যা আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর দাঁড় করেছে উক্ত হাদিসটি জাল সাব্যস্ত করার উদ্দেশ্যে; অথচ তাবে-তাবেঈন যুগের ইমাম— ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (রঃ) এবং হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর মুজাদ্দেদ ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-সহ আরও ৩৬ জন জগৎবিখ্যাত মনীষী তাঁদের কিতাবে সহীহ্ সনদে উক্ত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। একজন আলেম কি করে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করতে পারে? কাকে বিশ্বাস করবো/করবেন??  

সত্যতা যাচাই:

অনেক উদাহরণ দেয়ার দরকার নেই, সর্ব প্রথম আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা যে তাঁর প্রিয় হাবীব হুজুরপাক (সাঃ)-এর নূর সৃষ্টি করেন তার প্রমাণে নিন্মের হাদিসটিই যথেষ্ট—

عن جابر رصي الله عنه قال قلت يا رسول صلي الله عليه و سلم بابي انت و امي اخبرني عن اول شييء خلق الله تعالي قبل الاشياء قال يا جابر ان الله تعالي قد خلق قبل الاشياء نور نبيك من نوره فجعل ذالك النور يدور بالقدرة حيث شاء الله تعالي ولم يكن في ذالك الوقت لوح ولا قلم ولا جتة ولا نار ولا ملك ولا سماء ولا ارض ولا شمس ولا قمر ولا جني ولا انسي ….الي اخر
অর্থাৎ— হযরত জাবের (রাঃ) হতে বর্নিত; তিনি বলেন, আমি হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবানি হউক, আপনি আমাকে জানিয়ে দিন যে, আল্লাহ পাক সর্ব প্রথম কোন জিনিস সৃষ্টি করেছেন?
তিনি বলেন, হে জাবের! নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক সর্ব প্রথম সব কিছুর পূর্বে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর সেই নূর আল্লাহ পাকের ইচ্ছা অনুযায়ী কুদরতের মাঝে ঘুরছিলো; আর সে সময় লওহে মাহফুজ, কলম, জান্নাত, জাহান্নাম, ফেরেশতা, আসমান, জমিন, চন্দ্র, সূর্য, মানুষ ও জ্বিন কিছুই ছিলো না।

উল্লেখিত হাদিসটি নিন্মলিখিত কিতাবসমূহে নকল করা হয়েছে—

১. মুসনাদে আব্দুর রাজ্জাক; ১/৯৯, হাদীস নং ১৮
২. দালায়েলুন নবুওয়াত ১৩/৬৩
৩. মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া ১/৯
৪. মাদারেজুন নবুওয়াত ২/২
৫. যুরকানী ১/৪৬
৬. রুহুল মায়ানী ১৭/১০৫
৭. সিরাতে হালবীয়া ১/৩০
৮. মাতালেউল মাসাররাত ২৬৫ পৃ:
৯. ফতোয়ায়ে হাদীসিয়া ১৮৯ পৃ:
১০. নি’মাতুল কুবরা ২য় পৃ:
১১. হাদ্বীকায়ে নদীয়া ২/৩৭৫
১২. দাইলামী শরীফ ২/১৯১
১৩. মকতুবাত শরীফ, ৩য় খন্ড, ১০০ নং মকতুব
১৪. মওজুয়াতুল কবীর ৮৩ পৃ:
১৫. ইনছানুল উয়ুন ১/২৯
১৬. নূরে মুহম্মদী ৪৭ পৃ:
১৭. আল আনোয়ার ফি মাওলিদিন নবী ৫ পৃ:
১৮. নশরুতত্বীব ৫ পৃ:
১৯. তারীখুল খমীস ১/২০
২০. নুজহাতুল মাজালিস ১ম খন্ড
২১. দুররুল মুনাজ্জাম ৩২ পৃ:
২২. কাশফুল খফা ১/৩১১
২৩. তারিখ আননূর ১/৮
২৪. আনোয়ারে মুহম্মদীয়া ১/৭৮
২৫. আল মাওয়ারিদে রাবী ফী মাওলীদিন নবী ৪০ পৃষ্ঠা 
২৬. মজমুয়ায়ে ফতোয়া ২/২৬০
২৭. দেওবন্দী আজিজুল হক অনুবাদ কৃত বুখারী শরীফ ৫/৩
২৮. আপকা মাসায়েল আওর উনকা হাল ৩/৮৩
২৯. শিহাবুছ ছাকিব ৫০
৩০. মুনছিবে ইছমত ১৬ পৃ :
৩১. রেসালায়ে নূর ২ পৃ:
৩২. হাদীয়াতুল মাহদী ৫৬পৃ :
৩৩. মা’ য়ারিফে মুহম্মদী
৩৪. আনফাসে রহীমিয়া
৩৫. আফদ্বালুল ক্বোরা
৩৬. তাওয়ারীখে মুহম্মদ

হাদিসের সনদ—
১. হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
২. হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু
৩. মুহাম্মাদ বিন মুনকাদার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি
৪. মা’মার বিন রাশীদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি
৫. আব্দুর রাজ্জাক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।

বর্ণিত হাদিসের রাবীদের সম্পর্কে মুহাদ্দীসগণের মন্তব্য—

ক) হাফেজে হাদিস, তাবে-তাবেঈন ইমাম আব্দুর রাজ্জাক রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে:
আহমাদ ইবন সালীহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, 'আমি একবার আহমাদ বিন হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি-কে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি হাদিস শাস্ত্রে আব্দুর রাজ্জাক রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে নির্ভরযোগ্য আর কাউকে পেয়েছেন কি? আহমাদ বিন হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন— না'। —(তাহজিবুত তাহজিব লি হাফিয ইবনে হাজর আসক্বলানী; ২/৩৩১)

খ) অপর রাবী মা’মার বিন রাশীদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে:
ওনার সম্পর্কে আহমাদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, 'আমি বাসরার সকল হাদীস শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞের থেকে মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাকে মা’মার বিন রাশীদ এর সূত্রে পাওয়া হাদীসগুলো পছন্দ করি'।
ইবনে হাজর আসকলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহিও ওনাকে প্রখর স্মরণশক্তি সম্পন্ন এবং নির্ভরযোগ্য বলেন। —(তাহজিবুত তাহজিব; ১/৫০৫, আসমাউর রেজাল।)

উক্ত মা’মার বিন রাশীদ রহমতুল্লাহি আলাইহি সূত্রে বর্ণিত বুখারী শরীফের হাদীস সংখ্যা প্রায় ২২৫ এবং মুসলিম শারীফে বর্ণিত হাদীস সংখ্যা প্রায় ৩০০।

গ) হাদিসটির আরেক রাবী মুহাম্মাদ বিন মুকদার রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে:
ইমাম হুমায়দি রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, মুকদার রহমতুল্লাহি আলাইহি একজন হাফিজ, ইমাম জারাহ তাদীলের ইমাম ইবন মা’ঈন রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, উনি নির্ভরযোগ্য।—(তাহজিবুত তাহজিব; ০৯/১১০৪৮,
আসমাউর রেজাল।)

হযরত মুকদার রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা বুখারী শারীফে ৩০টি এবং মুসলিম শারীফে ২২টি।

ঘ) আর মূল বর্ণনাকারী হলেন হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, যিনি একজন সুপ্রসিদ্ধ সাহাবী (রাঃ)। বুখারী ও মুসলিম শরীফে ওনার থেকে বর্ণিত অসংখ্য হাদিস আছে। 

দেখা যাচ্ছে যে, হাদিসটির সকল রাবীই নির্ভরযোগ্য এবং ওনাদের সূত্রে বোখারী ও মুসলিম শরীফেও অসংখ্য হাদীস বর্ণিত আছে; সুতরাং এ কথাটি বলার এখন আর কোন অপেক্ষা রাখে না, দ্বিধাহীন ভাবেই বলা যায়— ইমাম বুখারী ও মুসলিম-এর সংজ্ঞা ও শর্তানুসারে হাদীসটি সহীহ্। পরিশেষে একটি প্রশ্ন— আমরা কি পূর্ববর্তী জামানার বিশ্ববিখ্যাত মোহাদ্দেসদের বিশ্বাস করবো, না কি শেষ জামানার দুনিয়াবি সুযোগ-সুবিধা নেয়া ঘড়ি মেকার নাসিরুদ্দিন আলবানী আর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরকে বিশ্বাস করবো??

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২২ জুন, ২০২১.

বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন, ২০২১

দুই পূর্ব দুই পশ্চিমের ব্যাখ্যা :


'রাব্বুল মাশরিকাঈনি ওয়া রাব্বুল মাগরিবাঈন' নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে পবিত্র কুর'আনুল কারীমে এ ধরণের বেশ কিছু আয়াতের মুখামুখি হয়েছি; যেমন— '……রাব্বিল মাশরিকি ওয়াল মাগরিবি……' —(সুরা মুজাম্মেল : ৯), 'রাব্বুল মাশরিকাঈনি ওয়া রাব্বুল মাগরিবাঈন।' (সুরা আর রহমান : ১৭), ' ……বিরাব্বিল মাশরিকি ওয়াল মাগরিবি……' —(সুরা মা’আরিজ : ৪০)........। এমন সবগুলো আয়াত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে লেখা বিশাল হয়ে যাবে। তাই আজ শুধুমাত্র 'রাব্বুল মাশরিকাঈনি ওয়া রাব্বুল মাগরিবাঈন' নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করবো। 

'জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরয।'—(ইবনে মাজাহ : ১ম খণ্ড - ২২৪) আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদিস— 'দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর।' পবিত্র কুর'আনুল কারীমে 'তারা কি চিন্তা করে না', 'তারা কি গবেষণা করে না', 'তোমরা কি বোঝ না', 'তারা কি লক্ষ্য করে নাَ', 'তারা কি (সৃষ্টি প্রক্রিয়া) অবলোকন করে না?' এমনতর অসংখ্য বাক্য ব্যবহার করে মহান রাব্বুল আলামীন মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি- বিবেচনা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর এতেই প্রমাণ হয়— জ্ঞানার্জন ছাড়া কখনই মুসলমান হওয়া যাবে না; ঈমানদার মু'মিন হওয়ার পথ তো বহু দূরের।

তাছাড়া মহাগ্রন্থ কুর'আনুল কারীম বুঝতে হলে অবশ্যই কিছু বিশেষ জ্ঞানের দরকার; যা সাধনার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। অন্যথায় গোমড়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শুধুমাত্র শাব্দিক অর্থ দিয়ে কুর'আন বুঝা যাবে না, অবশ্যই হিকমা অবলম্বন করে আয়াতের অভ্যন্তরীণ তাৎপর্য বুঝতে হবে।  সূর্য, সূর্যের উদয়স্থল এবং সূর্যের অস্তাচল নিয়ে পবিত্র কুর'আনুল কারীমায় অসংখ্য আয়াত রয়েছে; এদের কোনটা একবচনে, কোনটা দ্বি-বচনে, আবার কোনটা বহু-বচনে ব্যবহৃত। এসব বুঝতে হলে অবশ্যই খেয়াল বা দৃষ্টি প্রখর করতে হবে এবং ব্যাকারণ জ্ঞানও রাখতে হবে। 

 'উদয়াচল' এবং 'অস্তাচল' বলতে আসলে বুঝানো হয়েছে— সূর্য/নক্ষত্রের উদিত হওয়ার এবং অস্ত যাওয়ার স্থান; সেই অর্থে সুরা আর-রহমানে ব্যবহৃত 'মাশরিকাঈন'  ও 'মাগরিবাঈন' শব্দদ্বয় পুরোপুরি অর্থব্যঞ্জক। কি করে? আরবি ব্যাকরণে 'মাশরিক' ও 'মাগরিব' ব্যবহৃত হয় এক বচনে, 'মাশরিকাঈন' ও 'মাগরিবাঈন' ব্যবহৃত হয় দ্বি-বচন/ দুই বচনে, আর 'মাশরিকি'ও 'মাগরিবি' ব্যবহৃত হয় বহু বচনের ক্ষেত্রে; সুতরাং, উক্ত আয়াত দ্বারা  আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা  বলেছেন, 'তিনিই দুই উদয়াচল আর দুই অস্তাচলের মালিক'। 

'দুই উদয়াচল আর দুই অস্তাচল' কি করে সম্ভব? তা হলে কুর'আন কি অবৈজ্ঞানিক? মোটেও না। স্বনামধন্য মুসলিম মনীষীদের তাফসীরের উদ্ধৃত তুলে ধরার আগে আমি আপনাদের বিবেকের কাছে অতি সাধারণ কিছু প্রশ্ন করছি। আপনার কি কখনো মনে হয়নি দুনিয়াতে প্রতিদিন প্রতি ক্ষণে  দুইটা উদয়াচল দুইটা অস্তাচল হয় হচ্ছে? যদি না মনে হয়ে থাকেন, সমস্যা নেই, এখন একটু মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করুন, ঢাকায় যখন সকাল হয় ঠিক সেই ক্ষণেই পৃথিবীর অন্য আরেক প্রান্তে কি সন্ধ্যা হয় না? আমাদের সকাল হয় যে সময়ে মক্কায় কি সকাল সেই একই সময়ে হয়? এতেই তো বুঝা যায় দুই উদয়াচল আর দুই অস্তাচলের কনসেপ্ট সঠিক। আমার গবেষণা, উক্ত আয়াতের দ্বারা পৃথিবীর পর্যায়ক্রমিক দুই সকাল দুই সন্ধ্যার কথা বলা হয়েছে। এমন করে  মিলাতে চেষ্টা করলে দেখবেন পবিত্র কুর'আনুল কারীমের কোন আয়াতই বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে যায় না।

পদার্থবিজ্ঞানে শক্তির নিত্যতা সূত্র বলে যে, বিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ ধ্রুবক; শক্তি অবিনশ্বর, শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, করা যায় না। এক রূপ থেকে শক্তিকে কেবলমাত্র অন্য রূপে রূপান্তরিত করা যায়; যেমন— একটি ডিনামাইট-এর বিস্ফোরণের ফলে রাসায়নিক শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয় | যারা সত্যিকারার্থে বিজ্ঞান বুঝে না, তাদের জন্য শক্তির নিত্যতার সূত্রটা ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করাটাই যথেষ্ট; এতেই বিজ্ঞানের অনেক কিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে। সারে চৌদ্দশ বছর আগে পবিত্র কুর'আনুল কারীম ঘোষণা দিয়েছে 'সূর্য পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র তার নিজ অক্ষে আবর্তনমান'। বিজ্ঞান বলে, কোন বস্তু আবর্তন করে যদি বস্তুটি গোলাকার হয় এবং সেই বস্তুর শক্তি নিত্য হয়। আমরা জানি, পৃথিবী সূর্য বা যে কোন গ্রহ নক্ষত্রের আকৃতি গোলাকার। তাই প্রতিটি গ্রহ নক্ষত্রই অনবরত নিজ অক্ষে আবর্তনমান। আর আবর্তনমান সকল বস্তুতে পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া বিদ্যমান। সূর্যের আলো ঠিক এই মূহুর্তে পৃথিবীর যে অংশে পড়ছে, একটু পরেই তা আর সেখানে থাকবে না, সরে যাবে; আমেরিকায় এখন রাত, আমাদের এখন দিন। তাই বলা যায়, প্রতি মূহুর্তেই পৃথিবীতে উদয়াচল ও অস্তাচল ঘটছে; যা যুগপৎ ঘটনা। এ কি দুই উদয়াচল দুই অস্তাচল নয়? 

বিজ্ঞান বলে সূর্য ৩৬০ দিন ৩৬০টি রেখায় চলে, আর তার এ চলার প্রতিটি রেখা স্বাতন্ত্র্য; ফলে প্রতিক্ষণেই সূর্যের উদয়াচল ও অস্তাচলের পরির্বতন ঘটছে। গোলাকার পৃথিবীর সব অংশে কখনো কি এক সাথে রাত দিন হচ্ছে, না হওয়া সম্ভব? আামাদের এখানে যখন সকাল, আমেরিকায় তখন রাত; একই সময়ে দু স্থানে দুই রকম অবস্থা বিরাজমান; এটি একটি যুগপৎ ঘটনা, যা দিনে দুই দুই বার ঘটছে। পৃথিবীর এক স্থানে যখন সকাল, ঠিক সেইক্ষণেই পাশের আরেক অংশে ভোর হতে অনেক দেরি। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়— দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলে আয়াত শতভাগ সত্য ও বৈজ্ঞানিক। যারা ভাবেন অনেক বিষয়ে বিজ্ঞানের সাথে কোর'আনের বর্ণনা মেলে না বা যায় না; তাদের বলছি— আপনি আমার একটি স্পষ্ট কথা আজ শুনে যান— বিজ্ঞান সৃষ্টি করেছে কোর'আন, আর বিজ্ঞানী সৃষ্টি করেছে যে তাঁর বাণী হলো কোর'আন। বিজ্ঞান আলাদা কোন কিছু নয়, কোর'আনের অতি ক্ষুদ্র একটি নির্যাস।

বিজ্ঞান কি? ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের ইংরেজি শব্দ Science মূলত ল্যাটিন Scientia থেকে এসেছে, যার মানে Knowledge, অর্থাৎ জ্ঞান। বিজ্ঞান-এর অর্থ বিশেষ জ্ঞান। ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলে কোন বিষয়ে প্রাপ্ত ব্যাপক ও বিশেষ জ্ঞানের সাথে জড়িত ব্যক্তি বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানবিদ কিংবা বৈজ্ঞানিক নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীরা বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে জ্ঞান অর্জন করেন এবং প্রকৃতি ও সমাজের নানা মৌলিক বিধি ও সাধারণ সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। বর্তমান বিশ্ব এবং এর প্রগতি নিয়ন্ত্রিত হয় বিজ্ঞানের মাধ্যমে; তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যাপক অর্থে যে কোনো জ্ঞানের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণকে বিজ্ঞান বলা হয়।

জ্ঞানের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ না জেনে আজকাল তথাকথিত কিছু আলেম কোর'আন-হাদিসের সাথে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করতে গিয়ে এমন সব আবোলতাবোল কথা বলছেন যার কোন মাথামুণ্ডু নেই। আর এর খেসারত শুনতে হচ্ছে আমাদের; পুরো মুসলমান জাতিকে তারা হাসির পাত্র বানাচ্ছে! বিজ্ঞানের সাথে কম্পেয়ার বা তুলনা করে যারা পবিত্র কুর'আনুল কারীমের আয়াত বা হাদিসের ব্যাখ্যা করেন, তাদের অবশ্যই জানা ও বুঝা উচিত— বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই আগে আপনাকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে; নয়তো কাজী ইব্রাহীমের মতো হাসির পাত্র হতে হবে। অবশ্য ইদানীং লক্ষ্য করছি আমাদের দেশের বেশকিছু তরুণ আলেমে-দ্বীন বেশ গুছিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়াজ-নসীহত করছেন; এটা শুভ লক্ষ্মণ, খুবই ভালো। 

বিজ্ঞান না জানা এবং গবেষণাবিহীন অনভিজ্ঞ আলেমদের বিজ্ঞানভিত্তিক মিথ্যা ওয়াজ শুনে আজকাল অনেক মুসলমানের মনেই প্রশ্ন জাগে— কোর'আন-হাদিস সত্য, নাকি বিজ্ঞান সত্য? পবিত্র কুর'আনুল কারীম ও হাদিসের একজন সাধারণ অনুসারী এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক-গবেষক হিসেবে আমি আবিষ্কার করেছি— বিজ্ঞানের প্রতিটি সীদ্ধান্ত ক্ষণস্থায়ী, অস্থির, সাময়িক ও পরিবর্তনশীল; আর পবিত্র কুর'আনুল কারীম ও হাদিসের প্রতিটি বর্ণ-শব্দ-বাক্য চিরস্থায়ী, শ্বাশত, স্থির ও চিরসত্য। অতএব বিজ্ঞান দিয়ে একজন মুসলমানকে কোর'আন হাদিস  বুঝতে হবে না বুঝাতে হবে না, কোর'আন হাদিস দিয়ে বিজ্ঞান বুঝতে হবে বুঝাতে হবে। আপনারা যদি তা করতে পারেন, আমি নিশ্চিত— আবারও পৃথিবী মুসলমানদের পদানত হবে।

সূর্য ঘুরে না পৃথিবী ঘুরে? এ বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের অনেক মতানৈক ছিল; যেমন— একসময় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করতেন মহাবিশ্বের সব কিছুই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, অর্থাৎ পৃথিবী স্থির। এ ধারণাটি পরবর্তী বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ভুল বলে প্রমাণিত হয়। পোল্যান্ডের জ্যোতিবিজ্ঞানী কোপানিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) প্রথম বলেন— পৃথিবী সূর্যের চতুর্দিকে ঘুরে; কিন্তু তখনকার মানুষ  তার এ কথাটি বিশ্বাস করেনি। পরবর্তীযুগে বিজ্ঞানী নিউটন এসে যখন আবিস্কার করলেন— পৃথিবী সূর্যের চতুর্দিকে ঘুরে এবং পক্ষান্তরে সূর্যও তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে; সূর্য কেন্দ্রিক এই মডেলটিই বর্তমানে প্রমানিত এবং বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষ এ কথাটি গ্রহনও করে নিয়েছে। এ থিওরীও  হয়তো একদিন পালটে যাবে, যেমন করে চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তাই বলি কি— ক্ষণস্থায়ী বিজ্ঞান নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করার কিছু নেই; অস্থায়ী পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য শুধু জানতে ও বুঝতে হবে।

সাড়ে ১৪শত বছর আগে কোর'আন যা বলেছে বিজ্ঞান আজ তার কিয়দংশ মাত্র প্রমাণ করেছে; চন্দ্র, সূর্য ওপৃথিবীসহ মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্র-উপগ্রহই নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তনমান; সুরা আম্বিয়ার ৩৩ নং আয়াত— 'এবং তিনিই দিবা-নিশি এবং চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করেছেন। সবাই আপন আপন কক্ষ পথে বিচরণ করে।'  এ আয়াত বুঝাতে গিয়ে সেই সময় হুজুর পাক (সাঃ)-এর চাচাতো ভাই ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছিলেন, 'লাটিম যেমন তার কেন্দ্র বিন্দুর চার দিকে ঘুরতে থাকে, সূর্যও তেমনিভাবে ঘুরে।' এখন বুঝুন জ্ঞানী মুসলমানরা কতটা বুদ্ধিদীপ্ত ছিলেন।  

সুরা ইয়াসীনের ৩৮-৪০ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত বলেন, 'সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা, পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নির্ধারণ। চন্দ্রের জন্যে আমি বিভিন্ন মনযিল নির্ধারিত করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খর্জুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। সূর্যের পক্ষে চন্দ্রকে নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। রাতের পক্ষেও দিনের অগ্রবতী হওয়া সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে।' সুরা যুমারের  ৫ নং আয়াতে রাব্বুল ইজ্জত বলেন, 'তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে। তিনি রাত্রিকে দিবস দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে কাজে নিযুক্ত করেছেন। প্রত্যেকেই বিচরণ করে নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত জেনে রাখুন, তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।' এসব আয়াতে যে পৃথিবী ঘুর্নায়মানের ইঙ্গিত রয়েছে তা নিশ্চিত। সুতরাং পৃথিবীর ঘুর্নায়মান হওয়াটাই স্বাভাবিক। 

'রাব্বুল মাশরিকাঈনি ওয়া রাব্বুল মাগরিবাঈন' নিয়ে 'আল-কুরআনুল করীম', ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ— 'তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের নিয়ন্তা।' প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান সাহেবের অনুবাদও প্রায় একই রকম— 'তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই আস্তাচলের নিয়ন্ত্রণকারী।' ইসরাইলী চক্রান্তের ফসল গুগল প্লে-স্টোরের মোবাইল অ্যাপের অনুবাদগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করুন; সেসবে দেখতে পাবেন কত ভিন্ন ওদের অনুবাদ। আমি যেটা পেলাম সেখানে  অনুবাদ করা আছে— 'তিনি দুই পূর্ব ও দুই পশ্চিমের রব।'  বর্তমান যুগের শর্টকাটে জান্নাত পাওয়ার প্রত্যাশা করা মুসলমানরাই এসব অনুবাদ ডাউনলোড করে। তারা হার্ডকপি কিনতে চায় না; গুগল প্লে-স্টোরের এইসব  মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করেই কোর'আন বুঝতে চায় জানতে চায়, বিজ্ঞ সাজতে চায়। আর এতেই ঘটছে যত বিপত্তি। তথাকথিত ইমামসাব মুফতিসাব মাওলানা সাবরা বুঝতেও পারে না এসব বিভ্রান্ত অর্থ বয়ান করে মুসলিম সমাজকে তারা কতটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। সমাজের সবখানে আজ এসব নিয়ে তর্কাতর্কি বিতর্ক চলছে, দুই লাইন পড়েই আবার কেউ কেউ চেহারা আর কণ্ঠকে পুঁজি করে মুফতীসাব/পীরসাব সাজছে, এবং দেদারছে লোক ঠকাচ্ছে। 

ইসরাইলী চক্রান্তের এ'সব ভ্রান্ত অর্থ পড়ে পড়ে নিজেরা তো গোমড়া হচ্ছেই, বলদরা বলদার মতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে আবার অন্যকেও ও'সব শোনাচ্ছে এবং পথভ্রষ্ট করছে। তাই, উপদেশ দেবো বাংলা অনুবাদের ইসলামিক কিতাব কিনতে বা পবিত্র কুর'আনুল কারীমের বাংলা অনুবাদ পড়তে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং সচেতন হতে হবে। উপদেশ দেবো ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ কেনা ও পড়ার জন্য; অথবা যাচাই-বাছাই করে সঠিক অনুবাদ কিনুন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বা বাংলা একাডেমির অনুবাদকে আমি  প্রেফারেন্স করি, কারণ ওখানে অনুবাদকদের একটা বোর্ড থাকে।

যাই হউক, উক্ত আয়াতের তাফসিরে তাফসীরে মাযহারীতে কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী (র) লিখেছেন, এখানে 'দুই উদয়স্থল' ও 'দুই অস্তস্থল' অর্থ গ্রীষ্ম ও শীতকালে সূর্যের পৃথক পৃথক উদয়স্থল ও অন্তস্থল। তাফসীরে তাবারী ও ইবনে কাসির-এ প্রায় একই ধরনের বিষয়  উল্লেখ্য— গ্রীষ্ম ও শীতকালে সূর্যের উদয়াচল এবং অস্তাচল পরিবর্তিত হয়। আলোচ্য আয়াতে 'মাশরিকাঈনি বলে এই শীত ও গ্রীষ্মের দুই উদয়াচল এবং মাগরিবাঈন বলে শীত ও গ্রীষ্মের দুই অস্তাচলকে বুঝানো হয়েছে। এখানে দ্বিবচন দ্বারা বহুবচন উদ্দেশ্য; যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি শপথ করছি উদয়াচল সমূহের ও অস্তাচল সমূহের প্রতিপালকের (মা'আরজি ৭০/৪০)। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত অন্যত্র বলেন, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর পালনকর্তা এবং পালনকর্তা উদয়াচল সমূহের (সাফফাত ৩৭/৫)। এসব আয়াতসমূহে আসলে সৌর বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস বর্ণিত হয়েছে। 

২০১১ সালে নাসা মহাকাশে এমন একটি গ্রহ আবিষ্কার করেছে যা দুটি সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে; সেখানে একই দিনে দুই সূর্যোদয় এবং দুই সূর্যাস্ত একটি গতানুগতিক বিষয়। নাসা জানিয়েছে, দূরবীক্ষণ যন্ত্র কেপলারের সহায়তায় পৃথিবী থেকে ২০০ আলোকবর্ষ দূরে কেপলার-১৬বি নামের এরূপ একটি গ্রহ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে; খোদ বিজ্ঞানী মহলের কাছে এটি একটি চমকপ্রদ বিষয়। শনি গ্রহের মতোই বিশাল শীতল এই গ্যাসীয় গ্রহটির দুটি সূর্য আমাদের সূর্যের চেয়ে ৬৯ ও ২০ শতাংশ ছোট ও তুলনামূলকভাবে শীতল। তাই কেপলার- ১৬বি এর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা -৭৩ এবং -১০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি ২২৯ দিনে একবার দুই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এখন একবার চিন্তা করে দেখুন আল্লাহর পুরো রাজত্ব 'সামাওয়াতি ওয়াল আর্দ' কতটা বিশাল। এই বিশাল সাম্রাজ্যের কতটা খবর আপনি রাখেন? 

কুর'আনুল কারীমের সঠিক বুঝ না থাকায় আজকের মুসলিম সমাজের অনেকেই বিজ্ঞানকে প্রাধান্য দেয়! অথচ বিজ্ঞান হলো নাম্বার 7 (সাত)-এর অসংখ্য  নির্যাসের মাত্র একটি। আল্লাহর বিশাল রাজত্বে সৌরজগত পরের কথা, সংখ্যা তত্ত্বের ছোট্ট একটি মৌলিক সদস্য 7 (সাত)-এর রহস্যই এখনো পর্যন্ত মানুষ বেধ করতে পারেনি, মহাকাশের দ্বার উন্মোচন— সে তো বহু দূর! 

তবে, এরই মাঝে ১১৮টি  মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা; যার মধ্যে ৯৮টি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, বাকী ২০টি কৃত্রিম উপায়ে তৈরী করা হয়েছে।  বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে, যাচ্ছে;  হয়তো নতুন আরও অনেক কিছু আবিষ্কার করবে; ধাপে ধাপে মানুষ হয়তো রহস্যের অনেক দ্বারই উন্মোচন করবে। কিন্তু তা-ই-বা কতটুকু? নিশ্চয়  স্রষ্টার রাজত্বের এক কানাকড়িও নয়।।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
১৪ জুন, ২০২১.

রবিবার, ৩০ মে, ২০২১

ভূমিকম্প:


ফের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠলো সিলেট, খবরে জানানো হচ্ছে দুটো বাড়ি হেলে পড়েছে; গতকাল লাগাতারের পর আজও পর পর তিনবার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে গোটা সিলেট। বাংলাদেশের জন্য সিলেট বরাবরই একটি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা; ওখানে ভূমিকম্প অনুভব হওয়া কিছুটা স্বাভাবিক ব্যাপারই। জাপানের বিভিন্ন শহরে এবং আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রায় প্রতি দিনই কয়েকবার করে ভূমিকম্প হচ্ছে; ওখানে এটা নাগরিক জীবনের খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এ নিয়ে ওরা এতটুকুও চিন্তিত নয়, শুধু আর্থকোয়েক সক্ষমতা সম্পন্ন বাড়ি-ঘর/স্থাপনা নির্মাণ করে তারা বসবাস করছে। আর্থকোয়েক নিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার কিছু নেই; শুধু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

ভূমিকম্প আসলে কি? বিজ্ঞান কি বলে ভূমিকম্প নিয়ে?— ভূতত্ত্ববিজ্ঞান বলে, ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভূপৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়; এমন আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প (Earthquake) বলে। সাধারণত তিনটি কারণে ভূমিকম্পের উত্পত্তি ঘটে— ভূপৃষ্ঠজনিত, আগ্নেয়গিরিজনিত ও শিলাচ্যুতিজনিত কারণে; অর্থাৎ  ভূমিকম্পনের কারণ—ভূ-পৃষ্ঠের হঠাৎ পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরি সংঘটিত হওয়া ও ভূ-অভ্যন্তরে শিলাচ্যুতি। 

ইসলাম কি বলে? ভূমিকম্প নিয়ে পবিত্র কুর'আনুল কারীমে 'যিলযাল' নামে পূর্ণাঙ্গ একটি সুরা আছে। তাছাড়া প্রাকৃতিক দূর্যোগের উপর পবিত্র কুর'আনুল কারীমে অসংখ্য আয়াত আছে; যেমন— মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, 'আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনগুলো পাঠাই।' —(সুরা বনি ইসরাইল; ৫৯) তিনি আরও বলেন, 'বলে দাও, আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম।' —(সুরা আনআম; ৬৫) জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, 'যখন তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম' আয়াতটি নাজিল হলো, তখন রাসুল (সা.) বললেন, 'হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।' —(বুখারি)

মহান রাব্বুল আলামীন বলেন  'যে বিপদ-আপদই তোমাদের উপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই। আর আল্লাহ তোমাদের অনেক (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন।' —(সুরা শুরা : ৩০) প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হলাম আমরা, অর্থাৎ মানুষ, মানুষের অপকর্ম। আর মানুষের অপকর্মের ধারাবাহিকতায়ই একদিন কিয়ামত নেমে আসবে; পৃথিবী সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে । এ প্রসঙ্গে আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী হুজুর পাক (সা.) বলেন, 'যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে। কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখা হবে, কিন্তু তা আত্মসাত করা হবে (অর্থাৎ যার সম্পদ সে আর ফেরত পাবে না)। জাকাত দেখা হবে জরিমানা হিসেবে। ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বিদ্যা অর্জন করা হবে, একজন পুরুষ তার স্ত্রীর বাধ্যগত হয়ে মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে। বন্ধুকে কাছে টেনে নেবে, আর পিতাকে দূরে সরিয়ে দেবে। মসজিদে উচ্চস্বরে শোরগোল (কথাবার্ত) হবে। যখন সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটি সমাজের শাসক রূপে আবির্ভূত হবে। সে সময় তোমরা অপেক্ষা করো— রক্তিম বর্ণের ঝড়ের (এসিড বৃষ্টি), ভূকম্পনের, ভূমিধসের, রূপ বিকৃতির (লিঙ্গ পরিবর্তন), পাথর বৃষ্টির এবং সুতো ছেঁড়া (তাসবিহ) দানার ন্যায় একটির পর একটি নিদর্শনগুলোর জন্য।' —(তিরমিজি; ১৪৪৭)

ভূমিকম্প আসলে কেয়ামতের অন্যতম আলামতের একটি; এ ব্যাপারে হুজুর পাক (সাঃ) এক দীর্ঘ হাদিসে বলেছেন, 'যে পর্যন্ত না ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং খুনখারাবি বাড়বে, তোমাদের সম্পদ এতো বাড়বে যে, উপচে পড়বে।..........' —(বোখারি; ৯৭৯)

করোনা ঘূর্ণিঝড় ভূমিকম্পসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দূর্যোগ একের পর এক ধেয়ে আসছে, বিধস্ত করে দিয়েছে মানুষের  জীবনের গতি; তারপরও আমাদের হুশ হচ্ছে না! সবার উচিত মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের কাছে অতি দ্রুত লুটিয়ে পড়া, তাওবা করা; মহান রাব্বুল ইজ্জত-কে বেশি বেশি স্মরণ করা এবং ক্ষণে ক্ষণে ক্ষমা প্রার্থনা করা। কালক্ষেপণ না করে নিজেদের শুধরে নেওয়া এবং একমাত্র রব-এর কাছে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় চাওয়া।।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
৩০ মে, ২০২১.

শনিবার, ১ মে, ২০২১

আলোর দীপাধার:


কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
              রয়েছে দীপ না আছে শিখা,
              এই কি ভালে ছিল রে লিখা--
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো।

আলো নিয়ে মানুষের অনুসন্ধিৎসা চিরকালের; কত কি চিন্তা, কত কি সে কবিতা— যার কোন অন্ত ছিল না এবং নেই। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আলো হলো এক ধরনের শক্তি বা বাহ্যিক কারণ, যা চোখে প্রবেশ করে দর্শনের অনুভূতি জাগায়; বস্তুকে দৃশ্যমান করে, কিন্তু নিজে অদৃশ্য। আলোকে আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু যে কোন আলোকিত বস্তুকে সহজেই দেখতে পাই; যদি চোখে জ্যোতি থাকে। প্রকৃতপক্ষে আলো হলো এক ধরনের বিকীর্ণ শক্তি, যা তরঙ্গ হিসেবে প্রস্ফুটিত; তির্যক তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের আকারে আলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতে পারে, মাধ্যমভেদে যার বেগের পরিবর্তন হয়। বৈজ্ঞানিক সত্য— মাধ্যম ভেদে আলোর বেগ মাধ্যমের ঘনত্বের ব্যস্তানুপাতিক। শুন্য মাধ্যমে আলোর বেগ সবচেয়ে বেশি, কিন্তু অসীম নয়; শূন্যস্থানে আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ২৯,৯৭,৯২,৪৫৪ মিটার বা ১,৮৬,০০০ মাইল। আলোর গতিকে কোন ভাবেই স্পর্শ করা যায় না, সম্ভব নয়। তাছাড়া আলোর কোনো আপেক্ষিক বেগ নেই; এ বেগ সর্বদাই সমান। 

আলো আসলে কি? আমরা যা দেখি সেই দৃশ্যমান আলো মূলতঃ তড়িৎ চুম্বকীয় বর্ণালির ছোট একটি অংশ মাত্র। সাদা আলো সাতটি রঙের মিশ্রণ, প্রিজম এর দ্বারা আলোকে বিভিন্ন রঙে (৭ রঙ) আলাদা করা যায়; যা আমরা রামধনু হিসেবেি দেখতে পাই। আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরন, আপবর্তন, ব্যাতিচার ইত্যাদি  হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো আলোর একই সাথে কণা ধর্ম ও তরঙ্গ ধর্ম বিদ্যমান। দীপ্তমান বস্তু থেকে আলো কীভাবে আমাদের চোখে আসে তা ব্যাখ্যার জন্য বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত চারটি তত্ত্ব প্রদান করেছেন— 
১). স্যার আইজ্যাক নিউটনের Corpuscular Theory বা কণা তত্ত্ব; 
২). বিজ্ঞানী হাইগেনের Wave Theory বা  তরঙ্গ তত্ত্ব; 
৩). ম্যাক্সওয়েলের Electromagnetic Theory বা তড়িতচৌম্বক তত্ত্ব; 
এবং 
৪). ম্যাক্স প্লাঙ্কের  Quantum Theory বা কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন আলোর ঘটনার একটি  বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করান, যার স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯২১ সালে তিনি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারও পান। 

পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের আলোর এবং সকল শক্তির মূল উৎস হলো  সূর্য; সৌর ধ্রুবক নামে একটি পদের ব্যবহারই এই উৎসের প্রয়োজনীয়তার দিকে ইঙ্গিত করে। সূর্যের দিকে সরাসরি মুখ করে থাকা পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রতি একক ক্ষেত্রফলের উপর সূর্য প্রদত্ত শক্তির পরিমাণকে সৌর ধ্রুবক বলে; এর আপাত মান হচ্ছে ১,৩৭০ ওয়াট/বর্গমিটার। এই মানটি সূর্য থেকে এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক দূরত্বে অবস্থানকারী যে কোন বস্তুর পৃষ্ঠের জন্য প্রযোজ্য। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বকেই এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক দূরত্ব বলা হয়। পৃথিবীতে এতোটা শক্তি পৌঁছালেও তার পুরোটা পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছে না। যখন আবহাওয়া সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকে এবং সূর্য সর্বোচ্চ বিন্দুতে থাকে তখন ভূ-পৃষ্ঠে সরাসরি পতিত সৌর শক্তির পরিমাণ হয় প্রায় ১,০০০ ওয়াট/বর্গমিটার। এই শক্তিকে কাজে লাগানোর অনেকগুলো প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপায় আছে। উদ্ভিদ এই শক্তি ব্যবহার করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চালু রাখে, যা থেকে প্রাপ্ত শক্তি তারা রাসায়নিক শক্তি অক্সিজেন ও স্বল্প পরিমাণ কার্বন যৌগে পরিণত করে। আবার কৃত্রিমভাবে সৌর শক্তির মাধ্যমে সরাসরি উত্তপ্ত করে বা সৌর কোষ জাতীয় বৈদ্যুতিক পরিবর্তকের মাধ্যমে সৌর শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করে, যা আমাদের অনেক কাজে লাগে। পেট্রোলিয়ামসহ অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানীতে যে শক্তি নিহিত থাকে তা-ও উদ্ভিদ সৌর শক্তি থেকে লাভ করে। সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত শক্তিই নানাভাবে পরিবর্তীত হয়ে এ ধরনের জ্বালানীর দাহিকাশক্তির যোগান দেয়। তাছাড়া সূর্যের আলোর বেশ কিছু চমৎকার জীববৈজ্ঞানিক ধর্ম রয়েছে।

সৌর আলোর লুমেন ও ওয়াটের মধ্যে যে অনুপাত তা ভাল মানের প্রতিপ্রভ আলোর সাথে তুলনীয়। এর মাধ্যমে বোঝা যায় সূর্য যে আলো দেয় তা তার উত্তপ্ত করার ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং প্রদত্ত এই আলোর পরিমাণ বিপুল। এ থেকেই গ্রীষ্মকালে গৃহাভ্যন্তরের আলোকসজ্জার জন্য সূর্যের আলোর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়। কারণ এটি যত না উত্তপ্ত করে তার চেয়ে বেশি আলোকিত করে, আর গ্রীষ্মকালে উত্তাপ কমানো প্রয়োজন। অবশ্য সূর্যের আলোও কিছু উত্তাপ ছড়ায়। কিন্তু বৈদ্যুতিক বাতি একদিকে বেশি উত্তাপ তো ছড়ায়ই, আবার বিদ্যুৎও ব্যবহার করে। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির কিছু প্রতিষেধক গুণ রয়েছে যা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্তকরণে কাজে লাগে। সূর্যের আলোতে ভিটামিন ডি তৈরি করে যা মানব শরীরের জন্য উপকারী। 

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আলোর প্রধান উৎস এই রবি বা সূর্য হলো আমাদের এই সৌরজগতের প্রধান নক্ষত্র; সকল শক্তির উৎস। লক্ষ তারার মাঝে প্রায় আদর্শ গোলক আকৃতির সূর্য নামের এই তারাটি প্রধানত প্লাজমা তথা আয়নিত পদার্থ দিয়ে গঠিত, যার মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে চৌম্বক ক্ষেত্র। এর ব্যাস প্রায় ১৩ লক্ষ ৯২ হাজার কিলোমিটার; যা পৃথিবীর ব্যাসের ১০৯ গুণ বেশি। আর ভর প্রায় ২×১০৩০ কিলোগ্রাম, তথা পৃথিবীর ভরের ৩ লক্ষ ৩০ হাজার গুণ বেশি; এই ভর সৌরজগতের মোট ভরের শতকরা ৯৯.৮৬ ভাগ। সূর্যের প্রধান গাঠনিক উপাদান হলো হাইড্রোজেন; মোট ভরের তিন চতুর্থাংশই হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেনের পরেই সবচেয়ে প্রাচুর্য্যময় মৌলটি হলো হিলিয়াম। হিলিয়ামের চেয়ে ভারী মৌল সূর্যের মাত্র ১.৬৯% ভরের জন্য দায়ী; তারপরও এদের সম্মিলিত ভর পৃথিবীর ভরের ৫,৬২৮ গুণ। এই ভারী মৌলগুলোর মধ্যে রয়েছে অক্সিজেন, কার্বন, নিয়ন, লোহা ইত্যাদি।

সূর্যও একটি তারা; তারার শ্রেণীবিন্যাস করার একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে, সেই অনুসারে সূর্য জিটুভি (G2V) শ্রেণীর মধ্যে পড়ে। অনেক সময় একে হলদে বামন বলেও ডাকা হয়; কারণ তার তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি বর্ণালীর হলুদ-সবুজ অংশে। সূর্যের রঙ সাদা হলেও ভূপৃষ্ঠ থেকে একে হলুদ দেখাতে পারে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নীল আলোর বিচ্ছুরণের কারণে। বর্ণালী ধরন 'জিটু' বলে দেয় সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা আনুমানিক ৫৭৭৮ কেলভিন বা ৫৫০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস; আর 'ভি' দিয়ে বুঝায় আকাশগঙ্গার অধিকাংশ তারার মত সূর্যও একটি প্রধান ধারার তারা; অর্থাৎ যার কেন্দ্রভাগে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে অবিরাম হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম উৎপাদন করে যাচ্ছে। কেন্দ্রে সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ৬২ কোটি মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পোড়ায়। 

আগের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যকে অনুজ্জ্বল ও বেশ তাৎপর্যহীন একটি তারা মনে করতেন, কিন্তু  বর্তমান বিজ্ঞান থেকে জানা যাচ্ছে আকাশগঙ্গার শতকরা ৮৫ ভাগ তারার চেয়ে সূর্যের উজ্জ্বলতা বেশি; প্রকৃতপক্ষে আকাশগঙ্গার অধিকাংশ তারাই লোহিত বামন। সূর্যের পরম মান +৪.৮৩; কিন্তু পৃথিবীর খুব কাছে হওয়ার কারণে আকাশে একে অন্য যেকোন বস্তুর চেয়ে অনেক উজ্জ্বল দেখায়, তাই আপাত মান অনেক কম; -২৬.৭৪। সূর্যের করোনা অবিরত মহাশূন্যে প্রসারিত হতে থাকে যে কারণে সৌরঝড়ের জন্ম হয়। সৌরঝড় মূলত আয়নিত কণার ধারা, যা হেলিওপজ তথা প্রায় ১০০ নভো-একক (সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্বের ১০০ গুণ) পর্যন্ত ধেয়ে যায়। সৌরঝড়ের মাধ্যমে আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমে সৃষ্ট হেলিওস্ফিয়ার বা সৌরমণ্ডল সৌরজগতের বৃহত্তম অবিচ্ছিন্ন কাঠামো।

সূর্য বর্তমানে স্থানীয় বুদবুদ অঞ্চলের স্থানীয় আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করছে যা আকাশগঙ্গার কালপুরুষ বাহুর ভেতরের দিকে অবস্থিত। পৃথিবী থেকে ১৭ আলোকবর্ষ দূরত্বের মাঝে, তথা সবচেয়ে নিকটবর্তী ৫০টি তারার (সবচেয়ে নিকটবর্তী তারা প্রক্সিমা সেন্টরি ৪.২ আলোকবর্ষ দূরে) মধ্যে সূর্য ভরের দিক দিয়ে চতুর্থ। সূর্য আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে আনুমানিক ২৪ - ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এবং কেন্দ্রের চারদিকে ২২.৫ থেকে ২৫ কোটি বছরে একবার ঘুরে আসে। ছায়াপথীয় উত্তর মেরু থেকে দেখলে সূর্যের এই আবর্তন ঘড়ির কাঁটার দিকে। 

আমাদের ছায়াপথ যেহেতু মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের (পটবিকিরণ) সাপেক্ষে হ্রদসর্প মণ্ডলের দিকে সেকেন্ডে ৫৫০ কিলোমিটার বেগে ধাবিত হচ্ছে সেহেতু পটবিকিরণের সাপেক্ষে সূর্যের বেগ কাংস্য বা সিংহ মণ্ডলের দিকে সেকেন্ডে প্রায় ৩৭০ কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব আনুমানিক ১৪.৯৬ কোটি কিলোমিটার যাকে ১ নভো-একক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে পৃথিবীর কক্ষপথ যেহেতু উপবৃত্তাকার সেহেতু সূর্য থেকে তার দূরত্ব পরিবর্তিত হয়, জানুয়ারি মাসে সে সূর্যের সবচেয়ে কাছে (অনুসূর) আসে এবং জুলাইয়ে সবচেয়ে দূরে (অপসূর) সরে যায়। যাহোক, গড় দূরত্বে সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড সময় নেয়। এই সূর্যালোকের শক্তি পৃথিবীর প্রায় সকল জীবকে বাঁচিয়ে রাখে। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় এই আলো থেকে খাদ্য উৎপাদন করে, এবং প্রাণীরা খাদ্যের জন্য এসব উদ্ভিদ বা অন্য প্রাণীর উপর নির্ভর করে। পাশাপাশি জলবায়ু এবং আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণেও সূর্যালোক প্রধান ভূমিকা রাখে। 

পৃথিবীর উপর সূর্যের বিশাল প্রভাব সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ অনুধাবন করে আসছে। অনেক সংস্কৃতিতেই সূর্যকে দেবতা মনে করা হতো এবং এখনো হয়। প্রকৃতপক্ষে সূর্য তার কেন্দ্রভাগে সংঘটিত নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে অবিরাম হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম উৎপাদন করে তাপ-উত্তাপ সৃষ্টি করে সৌরজগতে বিকিরণ ঘটাচ্ছে, যার কিয়দংশ পৃথিবীতে আপতিত হচ্ছে। তবে সূর্যের প্রকৃত কাঠামো সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণা গড়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরাও সূর্যের গাঠনিক উপাদান এবং শক্তির উৎস সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতেন না। এখনও সূর্য নিয়ে গবেষণা চলছে কারণ তার কিছু ব্যবহার এখনও পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায়নি, যায় না।

সূর্যের আলোয় কত কি উপকার, কত কি হিসাব-নিকাশ, কত কি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা; কিন্তু সূর্য এলো কোত্থেকে, আলোই-বা পায় কোয়ায়? বিজ্ঞান কি এর কোন সঠিক ব্যাখ্যা দাঁড় করতে পেরেছে, না-কি পারবে? হাজার জীবনেও কি এর সমাধান সম্ভব??   

পবিত্র কুরআনুল কারিমে উল্লেখ্য— 'আল্লা-হু নূরুস্ সামা-ওয়া-তি অল্-আদ্ব্; মাছালু নূরিহী কামিশ্কা-তিন্ ফীহা-মিছ্বাহ্; আল্ মিছ্বা-হু ফী যুজ্বা-জ্বাহ্; আয্যুজ্বা-জ্বাতু কাআন্নাহা-কাওকাবুন্ র্দুরিইয়ুঁই ইয়ূক্বদু মিন্ শাজারতিম্ মুবা-রকাতিন্ ইতূনাতিল্লা-র্শাক্বিয়্যাতিঁও অলা-র্গবিয়াতিঁ ইয়াকা-দু যাইতুহা-ইয়ুদ্বী-য়ু অলাও লাম্ তাম্সাস্হু নার্-; নূরুন্ ‘আলা র্নূ; ইয়াহ্দিল্লা-হু লিনূরিহী মাই ইঁয়াশা-য়্; অইয়াদ্ব্রিবুল্লা-হুল্ আম্ছা-লা লিন্না-স্; অল্লা-হু বিকুল্লি শাইয়িন্ ‘আলীম্।' যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়— আল্লাহ আসমানসমূহ ও যমীনের নূর। তাঁর নূরের উপমা একটি তাকের মতই। তাতে রয়েছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি রয়েছে একটি চিমনির মধ্যে। চিমনিটি উজ্জ্বল তারকার মতই। প্রদীপটি বরকতময় যাইতূন গাছের তেল দ্বারা জ্বালানো হয়, যা পূর্ব দিকেরও নয় এবং পশ্চিম দিকেরও নয়। এর তেল যেন আলো বিকিরণ করে, যদিও তাতে আগুন স্পর্শ না করে। নূরের উপর নূর। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন তাঁর নূরের দিকে। আর আল্লাহ মানুষের জন্য উপমাসমূহ উপস্থাপন করেন। আর আল্লাহ প্রতিটি বস্তু সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।' 

নূর শব্দের বাংলা অর্থ হলো আলো বা জ্যোতি; প্রকৃত অর্থে এ শব্দটি দ্বারা 'দৃশ্যমান' আলো বুঝায়, রূপক অর্থে 'অদৃশ্যমান আলো' তথা হেদায়েত, জ্ঞান ইত্যাদি বুঝায়। জগৎ বিখ্যাত মনীষী হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ) বলেছেন—আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলাই হলেন আলোর একমাত্র উৎস; আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুর বেলায় আলো শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়, বাস্তব অর্থে নয়। জ্ঞানের তারতম্যানুসারে আলো শব্দটি এক এক জনের কাছে একেক রকম হয়; যেমন— ১). সাধারণের কাছে, ২). বিশেষ লোকদের কাছে, এবং ৩). বিশিষ্ট লোকদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়; যার আবার ভিন্ন ভিন্ন স্তরও রয়েছে। মূল কথা হলো আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলাই হলেন চরম আলো এবং পরম নূর। তিনিই সত্যিকার ও প্রকৃত একক জ্যোতি এবং অন্য কেউ বা কোনকিছু তাঁর মতো নয়, এর সাথে অন্য কোন কিছুর শরীকও নেই।

সাধারণের দৃষ্টিতে আলো মানে 'প্রকাশ' বা 'পরিদৃশ্যমান জগত'। আর এই প্রকাশ হচ্ছে একটি সম্বন্ধযুক্ত ক্রিয়া; কেননা এখানে প্রতিটি জিনিস অপরটির কাছে প্রকাশিত হয়, আবার অপরটি হতে লুকায়িতও থাকে। অতএব, প্রকাশ এবং গোপন উভয়ই সম্বন্ধযুক্ত। সাধারণের কাছে পঞ্চইন্দ্রিওয়ের মধ্যে দৃষ্ট শক্তির সাথে সম্পৃক্ত কোন একটা  অনুভূতিই আলো। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে বস্তুকে তিনভাগে ভাগ করা যায়— 
১). যা দৃষ্টিগোচর হয় না; কালো বস্তু। 
২). যা দৃষ্টিগোচর হয়, কিন্ত তা দিয়ে অন্য কোন বস্তু দেখা যায় না; উজ্জ্বল বস্তু, নক্ষত্র, অনুজ্জ্বল অগ্নি। 
৩). যা দৃষ্টি গোচর হয় এবং তা দিয়ে অন্য বস্তুও দেখা যায়; চন্দ্র, সূর্য, স্ফুলিঙ্গ, অগ্নি, প্রদীপ ইত্যাদি;  এই তৃতীয় প্রকারই আলো নামে অভিহিত। কখনো কখনো আবার উজ্জ্বল বস্তু হতে বস্তুর উপর প্রতিফলিত আলোকেও 'আলো' বলা হয়। সংক্ষেপে বললে বলতে হয়— যে বস্তু দৃষ্টিগোচর হয় এবং তা দিয়ে অন্য বস্তুও দেখা যায় তাকেই আলো বলে।

আলোর বৈশিষ্ট্য হলো প্রকাশ ও দর্শন; আর এই প্রকাশ ও দর্শন নির্ভর করে দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন চোখের উপর। আলো প্রকাশ পেলে এবং অন্য বস্তুকে প্রকাশিত করলেও অন্ধ ব্যক্তির পক্ষে তাতে কোন উপকার হয় না। 'আলো' শব্দ দ্বারা প্রকৃত অর্থে আমরা আলো দেখার যন্ত্র চোখকেই বুঝি। এ কারণেই তত্ত্বানুসন্ধানীরা দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন চোখের আলোকেই 'আলো' বলে অভিহিত করেছেন। তাই চামচিকে সম্বন্ধে বলা হয় যে তার চোখের আলো ক্ষীণ, দূর্বল। 

মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয়  হাবীব হুজুর পাক (সাঃ)-কে জগতের আলো বা নূর হিসেবে সৃষ্টি করে সীমাহীন উজ্জ্বল মুনাওয়ার হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং নাম দিয়েছেন নূর এবং সীরাজুম্মুনীরা। এই নামকরণের যৌক্তিকতা ও স্বার্থকতা তো অবশ্যই আছে এবং থাকবে,  তাই নয় কি? যেহেতু জগৎবাসী তাঁর মাধ্যমেই আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের পথ পেয়েছে, এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জামাল ও কামালের মাধ্যমেই জগৎবাসী দৃষ্টিশক্তি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। সেটা কোন সাধারণ ব্যক্তি বা মানুষের দ্বারা কি সম্ভব ছিল?

এ মর্মে আল্লাহ তা'য়ালা পবিত্র কুর'আনুল করীমে স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন, 'নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে একটি উজ্জ্বল জ্যোতি (নূর) এসেছে এবং একটি সমুজ্জ্বল গ্রন্থ।' —(সূরা মায়েদা : ১৫) উক্ত আয়াতের তাফসীরে তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে খাজেন, তাফসীরে ইবনে আব্বাস, তাফসীরে বায়জাবীসহ অনেক শ্রেষ্ঠ তাফসীরকারক এখানে এ 'নূর'-কে আমাদের প্রিয় নবী হুজুর পাক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কেই বুঝানো হয়েছে বলে মত দিয়েছেন এবং 'কিতাবুমমুবীন' দিয়ে কুর'আনুল কারীম-কে বুঝানো হয়েছে বলেছেন। উক্ত  আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে মাযহারীতে কাজী মুহাম্মদ ছানাউল্লাহ পানীপথী (রঃ) লিখেছেন, 'আলাহর নিকট থেকে তোমাদের নিকট এক জ্যোতি এসেছে' অর্থাৎ 'নূর' জ্যোতি দ্বারা উদ্দেশ্য মুহাম্মদ (সাঃ; 'এবং এক সুস্পষ্ট কিতাব' অর্থাৎ আহকাম ও বিধানকে সুস্পষ্টকারী কিংবা স্পষ্ট মু’জিযা বিশিষ্ট কিতাব, কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য 'কুরআন' বলেছেন।

আলোর সৃষ্টি ও এর উৎস-উৎপত্তির সারকথা জানতে হলে অবশ্যই সৃষ্টির গোড়ায় যেতে হবে, নয়তো এ রহস্য কোন মানুষের পক্ষে কোনভাবেই  ভেদ করা সম্ভব হবে না। স্রষ্টার সৃষ্টির ইতিহাসের শুরুটা সারসংক্ষেপে কিয়দংশ হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-র কিতাব  'দাকায়েকুল আকবার' থেকে নকল করছি। বইয়ের শুরুতেই 'হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর  সৃষ্টি রহস্য' লিখতে গিয়ে তিনি একটি দীর্ঘ  হাদিস তুলে ধরেছেন— 

আল্লাহ পাক সর্ব প্রথম 'শাজ্বারাতুল ইয়াকীন' নামে চারি কাণ্ড বিশিষ্ট একটি বৃক্ষ সৃষ্টি করেন। তারপর নূরে মুহাম্মদীকে ময়ুরের আকৃতিতে শুভ্র মুক্তার আবরণের মধ্যে সৃষ্টি করিয়া উক্ত বৃক্ষের উপর রাখিয়া দেন। সত্তুর হাজার বৎসর তিনি এইরূপ অবস্থায় আল্লাহ পাকের তাসবীহ পাঠে নিবিষ্ট থাকেন।
অতপর আল্লাহ পাক লজ্জার আয়না তৈরী করিয়া তাঁহার সন্মুখে রাখেন। তিনি যখন স্বীয় সুন্দর লাবণ্যময় ও জাঁকজমকপূর্ণ ছবি আয়নার মধ্যে দেখিতে পান, তখন লজ্জিত হইয়া আল্লাহ তাআ'লাকে অবনত মস্তকে পাঁচবার সেজদা করেন। এই কারণেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মতের উপর দৈনিক নির্দিষ্ট সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হইয়াছে।
আল্লাহ পাক পূণরায় যখন উক্ত নূরের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, তখন ইহা আল্লার ভয়ে লজ্জিত ও ঘর্মাক্ত হইয়া যায়। আল্লাহ পাক তাঁহার মাথার ঘর্ম হইতে ফেরেশতাদিগকে এবং মুখমন্ডলের ঘর্ম হইতে আরশ-কুরসি, লৌহ-মাহফুজ, কলম,  চন্দ্র, সূর্য, পর্দাসমূহ, তারকারাজি এবং আকাশস্থিত যাবতীয় বস্তু সৃষ্টি করেন।........... 
একমাত্র চক্ষুষ্মান ব্যক্তির পক্ষেই উপরোক্ত হাদিসের মর্ম বুঝা সম্ভব। আত্মচক্ষু যার খোলা আছে তার পক্ষে আলোর উৎস খোঁজা ও বুঝা যেমন কঠিন নয়, তার জন্য তেমন কঠিন নয় জ্ঞানের মহাসাগরের ডুব দেয়াও। এই অনন্ত মহাসাগর হাতড়ে যারাই ঝিনুক কুড়াতে পারে তারাই সার্থকজন।   

পরিশেষে, গীতাঞ্জলি থেকে রবী ঠাকুরের 'কোথায় আলো' শুরুর কবিতার  শেষাংশ দিয়ে যবনিকা টানছি—
কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
              ডাকিছে মেঘ, হাঁকিছে হাওয়া,
              সময় গেলে হবে না যাওয়া,
নিবিড় নিশা নিকষঘন কালো।
পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো।।
  
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
১ মে, ২০২১.

রবিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২১

আল্লাহ ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না:



আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা-র কৃতজ্ঞতায় ও প্রশংসায় বান্দার নেয়ামত বেড়ে যায়; আর যদি এর ব্যতিক্রম হয় তবে কঠোর শাস্তির ঘোষণাও রয়েছে। তিনি সরাসরি ঘোষণা করেছেন— 'যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে নেয়ামত আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।’ —(সুরা ইবরাহিম : ৭) 

একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের স্মরণ রাখা উচিত— সকল নেয়ামতের একমাত্র মালিক আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা; দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানের সকল অনুগ্রহের মালিক একমাত্র আল্লাহ। সুতরাং মালিকের অনুগ্রহ স্বীকার করায়ই রয়েছে পরম আনন্দ ও চরম পুরস্কার। আর আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের অনুগ্রহকে অস্বীকার করা বা অবজ্ঞা করা কোনো ভাবেই আদব ও কৃতজ্ঞতার মাঝে পড়ে না। আল্লাহ সুবহানাহু  তা'আলা মানুষকে তাঁর অফুরন্ত নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন— 'তোমরা যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না।' —(সুরা নহল : ১৮) 'তোমাদের কাছে যেসব নেয়ামত রয়েছে, তা তো আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছে।' —(সুরা নহল : ৫৩) 'সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব; আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না।' —(সুরা বাক্বারা : ১৫২) 

কোন বান্দা যখন শুধুমাত্র  আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলাকে ভয় করে, তখনও তিনি বান্দার সব অবস্থা দেখেন এবং জানেন; আর যখন কোন বান্দা আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ ও আনুগত্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যায়, তখন তিনি কি করেন? বান্দাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন— 'তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের পরওয়া করছ না। অথচ তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পর্যায়ক্রমে।' —(সুরা নুহ : ১৩-১৪) অন্যত্র তিনি আরও বলেছেন— 'আর তিনি জানেন তোমরা যা গোপনে কর এবং তোমরা যা প্রকাশ্যে কর।' —(সুরা তাগাবুন : ৪) 

তাই আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার অবধ্যতা না করে তাঁর দিকে ফিরে আসাই বান্দার একমাত্র কাজ হওয়া উচিত। তিনি বান্দার উপর অসীম ক্ষমতাবান, বান্দা তাঁর অধীন। অতএব, তাঁর দিকে ফিরে যাওয়া ছাড়া বান্দার কোনোই মুক্তির পথ বা উপায় খোলা নেই। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন— 'এমন কোন জীব-জন্তু নেই, যে তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।' —(সুরা হুদ : ৫৬)' 'এবং আল্লাহর উপরই তোমরা নির্ভর কর, যদি তোমরা মুমিন হও।' —(সুরা মায়েদা : ২৩) 

মামুনুল হক প্রসঙ্গ নিয়ে কিছুই আর বলার নেই। কারণ, আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা যাদের অন্তরে বক্রতা দেন, তিনি তাদের থেকে সকল নেয়ামত কেঁড়ে নেন; কারো রুহানি সন্তানরা এসব বুঝে না, বুঝবে না। গতকাল শনিবার দুপুরে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম নিজ কার্যালয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় জানান— পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মামুনুল জানিয়েছেন, প্রথম বিয়ে শরিয়ত বা আইনসম্মতভাবে হয়েছে। আর পরবর্তী যে দুটি বিয়ের কথা তিনি স্বীকার করেছেন সেগুলো চুক্তিভিত্তিক, কোনো কাবিননামা নেই। 

মামুনুল হকের পরের দুটো বিয়ের চুক্তিগুলো হচ্ছে তারা স্ত্রী থাকবে, কিন্তু কোনো মর্যাদা পাবে না। স্ত্রী হিসেবে মেলামেশা করতে পারবে, কিন্তু সম্পর্কের কোনো অধিকার তারা পাবে না। একই সাথে কোনো দাবি-দাওয়া বা সন্তান ধারণ করতেও পারবে না তারা। আমরা সকলেই জানি প্রচলিত আইনের পরিপন্থী এ ধরনের বিয়ের চুক্তি, কিন্তু ইসলামি শরীয়া আইন কি বলে? আপনি কি জায়েজ মনে করেন?? 

পরিশেষে, দুটো কথা বলে শেষ করছি— জ্ঞানান্ধ-বধির কখনো আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার রহমতের চাদরে আবৃত হতে পারে না। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা আল-আদল, সর্বোত্তম ন্যায়-বিচারক। তিনি মানুষের অন্যায়ের অবশ্যই ভয়ংকর শাস্তি দেন এবং দেবেন। মনে রাখবেন—  মহান রাব্বুল আলামীন ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না; কোন মানুষেরই সাধ্য নেই অযথা খালি খালি কাউকে হয়রানি করার বা লা'নতপূর্ণ অপমান করার।।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২৫ এপ্রিল, ২০২১.

বুধবার, ৭ এপ্রিল, ২০২১

মামুনুল হক ও তার তথাকথিত দ্বিতীয় স্ত্রী:


টপ অব দ্যা কান্ট্রি— মামুনুল হক এবং তার তথাকথিত দ্বিতীয় স্ত্রী; পক্ষে বিপক্ষে কত কি হচ্ছে! প্রত্যেকেই তার ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করছে; কারো কাছে মামুনুল হক আদর্শের মূর্ত প্রতীক, আবার কারো কাছে চাক্ষুষ শয়তান। ও'দিকে মামুনুল হক চুপ! মামুনুল হক কি পারতো না এক নিমিষে এইসব জল্পনা কল্পনার অবকাশ দিতে, অবসান ঘটাতে? সব সমস্যার সমাধান করতে?? 

দেশের একদল আলেম এক প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছে— মহিলাটি মামুনুল হকের বৈধ স্ত্রী। এ ব্যাপারে সারা জাতির স্বাক্ষীর দরকার আছে কি? পারিবারিকভাবে  মামুনুল হক একাই তো পারে তার  স্ত্রীকে হাজির করে একটা প্রেস ব্রিফিং করে সব জল্পনা কল্পনার পাঠ চুকাতে; তাই নয় কি? 

একান্ত ব্যক্তিগত একটি বিষয় কেন রাষ্ট্রীয় বিষয়ে রূপ নিল? মামুনুল হক যদি সাধারণ কেউ হতেন, এমনটা কখনো ঘটতো না। সে নিজেকে দাবী করেন আলেম, মানুষও তাকে মনে করে আলেম; কেউ-বা আরও এক ধাপ এগিয়ে ভাবতে শুরু করেছে— মামুনুল হক জাতীয় বিপ্লবের স্বপ্নদ্রষ্টা, এদেশের এক শ্রেণীর তথাকথিত সন্তানের রূহানী বাবা! তাই তো এতো কিছু। পুরো জাতি আজ মামুনুল হককে নিয়ে দ্বিধ-বিভক্ত। 

কারো কারো চিন্তা— শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে মামুনুল হককে হেনস্তা করার উদ্দেশ্যে সরকার এমন বিষয়টি সাজিয়েছে; অন্ধত্ব বড় অপরাধ,  বড় পাপ। আবার আরেকদল এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তাদের যুক্তি দাঁড় করছে। এদের কে সঠিক আর কে বেঠিক??

গতকাল ব্যক্তিগত কাজে বাইরে বের হতেই এক নিকটজন সরকারের চৌদ্দটা বাজিয়ে আমাকেও সরকারের চামচা তকমা লাগিয়ে দিল! আমার দোষ, আমি ভণ্ড মোল্লাদের নিয়ে লিখি, স্টেটাস করেছি। তার বক্তব্য— শেষ পর্যন্ত আপনিও সরকারের কুটচালের পক্ষে, আলেমদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি!!

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ওর কথাগুলো আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম; ভাবলাম, মানুষ কতটা নির্বোধ হলে এমনসব কথা বলতে পারে। সত্য উন্মোচন করলে, সত্যের পক্ষে কথা বললেই আজ এক শ্রেণীর লোকের কাছ থেকে দালান উপাধি পেতে হয়, সুবিধাবাদীর চক্ষুশূল হতে হয়; প্রকৃত সত্যের ধারেকাছেও আজ লোকজন যেতে চায় না। তাদের বদ্ধমূল ধারণার প্রতিউত্তর এক কথায় বা দুই কথায় দেয়া সম্ভব না, যাবেও না।  

তাছাড়া ভার্চ্যুয়াল মিডিয়ায় বেশ কয়েকজন আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছে। এদিকে  ফেসবুকে আমার স্টেটাসগুলো নাকি আলেম-ওলামার বিপক্ষে গেছে; তাই হাসান দেওয়ান নামের নারায়ণগঞ্জের একজন জানাশোনা ব্যক্তি আমাকে যে  মেসেজ করেছে তার কপি পেস্ট করলাম— "আপনার জন্য দুঃখ হচ্ছে, মিথ্যাচার ছাপিয়ে, মিথ্যার পক্ষে দাড়িয়ে আলেম দের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, এতে কি আদৌ বুদ্ধিজীবী হতে পারবেন?  ভয় হয়না সেই রবের মুহুর্তের মাঝে গলাটিপে ধরতে পারেন নিঃশ্বাস বন্দ করে দিতে পারেন।  আপনি তো ইউসুফ আঃ এর জমানায় থাকলে তাকেও অপবাদ দিতেন, রাসূলে পাক সা এর সময় থাকলে আয়েশা রা এর বিরুদ্ধে অপবাদ দিতেন।  হয়তো ঈমানদার হয়ে জীবন কাটান না হলে কাফের,  মুনাফিক হয়ে না,  তাহলে কিন্তু দুনিয়া আখেরাত দুটো ই শেষ, আল্লাহ ছাড় দেন তবে ছেড়ে দেন না।"

আলেম কে? আলেম কাকে বলে?? ওসব আগে জানতে চেষ্টা করা উচিত। আলেম শব্দের অর্থ হলো জ্ঞানী। শরিয়তের পরিভাষায় আলেম বলা হয় তাঁকে, যিনি দ্বীন ও শরিয়তের গভীর জ্ঞান রাখেন এবং সেই জ্ঞান নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করেন; কোর'আন-সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করেন। পাশাপাশি সুন্নতের অনুসরণে নিজের জীবনকে পরিচালিত করেন, এবং আল্লাহর ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত থাকেন। একজন আলেম হওয়ার জন্য শুধুমাত্র  সার্টিফিকেটই কি বিবেচ্য? মোটেও নয়। কেউ মাদরাসায় পড়াশোনা করলেই তাকে আলেম বলা যায় না, যাবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।

বর্তমানের এই অতি ফেতনার যুগে মাদরাসাকে দ্বীনের সবচেয়ে বড় দুর্গ বিবেচনা করা হয়; অবশ্য তা অস্বীকার করারও কোন উপায় নেই। কারণ, বর্তমান সময়ে মাদরাসা থেকেই আলেমে-দ্বীন তৈরি হন এবং বের হয়। কিন্তু  আমাদের আজকের  এই অধঃপতিত সমাজের সর্বস্তরে যেভাবে পচন ধরেছে, তাতে সঠিক আলেম আছে কয় জন? এখন তো প্রকৃত দ্বীনই খুঁজে পাওয়া কঠিন। সুদ-ঘুষের টাকায় মসজিদ মাদ্রাসা হচ্ছে, অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে নেতা সাহেব আশেপাশের দশ মসজিদের দশ ইমামকে হজ্জে পাঠাচ্ছে , জাকাত যাচ্ছে শো-কল খাতে! ইসলামের আর থাকলো কি? তাই তো প্রকৃত মুমিনের নাগাল পাওয়াই এখন কঠিন। তাই তো কমিনরাই এখন মমিন সেজে সমাজে ফেতনা ছড়াচ্ছে। 

আল্লাহ-র রসুল (সাঃ) আখেরী জামানা সম্পর্কে স্পষ্ট করেই অনেক কিছু বলেছেন— 'এমন সময় আসবে যখন ইসলাম শুধু নামে থাকবে, কোর’আন শুধু অক্ষরে থাকবে, মসজিদসমূহ জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকে লোকারণ্য হবে, কিন্তু সেখানে হেদায়াত থাকবে না। আমার উম্মতের আলেমরা হবে আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব। তাদের তৈরি ফেতনা তাদেরই উপর পতিত হবে।' —হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত উক্ত হাদিসটি বায়হাকী ও  মেশকাতে নকল হয়েছে।

মামুনুল হক নিজেকে আলেম দাবী করেন; তাই সারা দেশে এতো তোলপাড়। এক শ্রেণীর লোকজন এখনও তাকে আলেম মনে করছে! সে কি আসলে  আলেম? আপনারা কি একজন প্রকৃত আলেমের সংজ্ঞা জানেন?  আপনারা কি জানেন কেয়ামতে সকল মানুষের তুলনায় কঠোর আযাব কার হবে? যাকে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা এলেম দ্বারা কোন উপকার দেননি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'এলেম দু'প্রকার— মৌখিক এলেম এবং অন্তরস্থিত এলেম; একটা মানুষকে জব্দ করার এলেম, অন্যটা উপকারী এলেম।' তিনি আরও বলেন, 'শেষ জামানায় এবাদতকারী মূর্খ হবে এবং আলেম পাপাচারী হবে।' এ'সবের বাস্তব প্রমাণ পাচ্ছেন??

মামুনুল হক ৩  মার্চ শনিবার এক নারীকে নিয়ে সোনারগাঁওয়ের রয়্যাল রিসোর্টের ৫০১ নম্বর কক্ষে ওঠেন। তিনি দাবি করেন, সাথে থাকা ওই নারী তার দ্বিতীয় স্ত্রী, তার নাম আমেনা তৈয়াবা। ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক ওই নারীকে তিনি বিয়ে করেছেন। যদিও ওই নারী নিজেকে জান্নাত আরা জান্নাত বলে পরিচয় দেন। ওই শনিবার (৩ এপ্রিল) রাত ১০টার দিকে ফেসবুক লাইভে এসে মামুনুল হক দাবি করেন, বন্ধুর সাবেক স্ত্রীকে তিনি বিয়ে করেছেন এবং তাকে নিয়েই রিসোর্টে বেড়াতে গিয়েছিলেন।

লাইভে মামুনুল হক বলেন, 'এ মুহূর্তে একটি বিষয় নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে, বিভ্রান্তিও সৃষ্টি হয়েছে দেশব্যাপী। প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরার জন্য আমি ফেসবুক লাইভে এসেছি। আমার সঙ্গে আছেন আমার বড় ভাই হাফেজ মাহমুদুল হক, মেজো ভাই মাহবুবুল হক এবং আমার ভাই বেফাকের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক। আমরা পারিবারিকভাবে যে বিষয়টি তুলে ধরার জন্য এসেছি, আশা করছি আমাদের বক্তব্যের পর এ বিষয়ে বিভ্রান্তি থাকবে না এবং ভিন্ন বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।'

আরও বলেন, 'আজ যে ঘটনাটি হয়েছে, সেটি হলো আমি বেশ কয়েকদিন টানা রাত-দিন পরিশ্রমের কারণে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। বিশ্রামের জন্য ঢাকার অদূরে সোনারগাঁওয়ে একটি সুন্দর দর্শনীয় এলাকা, জাদুঘরে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী ছিলেন। আমার স্ত্রীর পরিচয় নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।'  তিনি দাবি করেন, 'আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন, তিনি আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। উপস্থিত কেউ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। যিনি ওখানে উপস্থিত ছিলেন সম্ভবত পুলিশের সার্কেল এএসপি মোশারফ সাহেব, আমার কাছ থেকে তথ্য প্রমাণ নিয়ে যাচাই করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন। যিনি আমার সঙ্গে ছিলেন, তিনি আমার একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মীর সাবেক ওয়াইফ (স্ত্রী) ছিলেন। তাদের দু’টি সন্তান রয়েছে। আড়াই বছর ধরে পারিবারিক কলহ ছিল। পরে দু’বছর আগে পারিবারিকভাবে ও আমার ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধু-বান্ধবের উপস্থিতিতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। তিনি শরিয়ত সম্মত আমার বিবি। আমার এই বক্তব্য শুনে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন সন্তুষ্ট হয়েছে।'

লাইভে তিনি অভিযোগ করেন, ‘ঘটনাস্থলে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে স্থানীয় যুবলীগ ও সরকার দলীয় কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ছিলেন। তারা আমার সঙ্গে অসদাচরণ করেছেন এবং লাইভ ভিডিও ধারণ করে সেখানে তারা সন্ত্রাসী কায়দায় কিছু হামলা ও আক্রমণ চালিয়েছেন। এ বিষয়গুলো যখন তারা লাইভ ভিডিও সম্প্রচার করেছেন, দেশবাসী জেনেছে। আমার সেখানকার বক্তব্য দেশের মানুষ শুনেছেন। আমার সেই বক্তব্য শুনে আমার পারিবারিক পরিচয়, স্ত্রীসহ পরিচয়টা স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরার পর, সেটা ভাইরাল হয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। হেফাজতকর্মীরা আমাকে উদ্ধারের জন্য সেখানে উপস্থিত হন। তারা উত্তেজিত অবস্থায় সেখানে কিছু ভাঙচুর চালায়। আমি তাদের শান্ত করার চেষ্টা করি এবং উত্তেজিত জনতাকে ওইখান থেকে নিয়ে চলে আসি।’

মাওলানা মামুনুল হক বলেন, 'এই ঘটনা (দ্বিতীয় বিয়ে) আমার পরিবার জানে এবং পারিবারিক অভিভাকরাও জানেন। পুলিশের উপস্থিত কর্মকর্তা এসপি তিনিও ফোনে আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন এবং বিষয়টি নিশ্চিত হন। কাজেই আমি আহ্বান করবো, এ বিষয় নিয়ে কেউ যেন বিভ্রান্তিকর কিছু প্রচার না করে। সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, আপনারা কোনও অবস্থাতেই উত্তেজিত কোনও আচরণ করবেন না, শান্ত থাকবেন। কোনও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়, এমন আচরণ করবেন না। এটা আমার অফিসিয়াল বক্তব্য, আমার আইডি থেকে আমি এটি তুলে ধরলাম।'
কোনও ধরনের পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থান নিয়ে কেউ যেন সংঘাতমূলক কোনও আচরণ না করেন লাইভে সে আহ্বান জানান তিনি।

এমন কি কোন আলেম করতে পারে, না পারবে?? বাস্তবতায় আমরা কি জেনেছি বা জানতে পারছি? তার ফোনালাপ ও তার স্ত্রী এবং বোনের  ফোনালাপ কি প্রমাণ করে? তার তথাকথিত স্ত্রী ও তার সন্তানের ফোনালাপ কি প্রমাণ করে? মামুনুল হক কি এসবের কোনটার প্রতিউত্তর করেছেন? কেন নয়?? স্ত্রী হলে তিনি এখন রাস্তায় কেন? ঘরে তুলে নিয়ে একটা প্রেস ব্রিফিং দিলেই তো সব লেঠা চুকে যায়। 

অযথা মিথ্যাবাদীর সাপোর্ট করে মিথ্যা স্বাক্ষী হয়ে দুনিয়া ও আখেরাত হারাবেন না।মিথ্যাবাদীর উপর লা'নত; কেয়ামতকে ভয় করুন।  মোহগ্রস্ত এই দুনিয়ার জীবনটা অতি ক্ষুদ্র।।  

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
৭ এপ্রিল,  ২০২১.

শনিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২১

সিফফীনের যুদ্ধ ও কিছু কথাঃ


সিফফীনের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসের এক ন্যক্কারজনক অধ্যায়; এ গৃহযুদ্ধেই বদলে যায় মুসলমানদের ভাগ্য। পবিত্র  কুর'আনুল কারীম নিয়ে প্রথম বারের মতো ব্যবসা শুরু হয় এ যুদ্ধেই। কিছু নব্য মুসলিম যারা সুবিধাবাদী মুসলিম, মক্কা বিজয়ের সময় ঠেলায় পড়ে মুসলমান সেজেছে, সেইসব লোভী নামধারী মুসলমানরাই   দুনিয়াবি সুযোগ-সুবিধার লোভে পড়ে, ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে বা বিভিন্ন কূটকৌশলে সরলমনা সাধারণ মুসলমানকে ইমানহারা করেছে, ভ্রান্ত বানিয়েছে। শেষ পরিনতি— মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন এবং ভ্রান্ত দুনিয়া লোভীদের বিজয়! 

নিন্মের দৃশ্যপটগুলো একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠবে সে সময় কি ঘটেছিল— 

১) সিফফীনের যুদ্ধের সময় হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-র সাথে যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন; কিন্তু খাবার সময় হলে তিনি মুয়াবিয়া (রাঃ)-র কাছে যেয়ে খাবার খেতেন। কারণ মুয়াবিয়া (রাঃ)-র তাবুতে অত্যন্ত দামী খাবার তৈরি করা হতো। একদিন মুয়াবিয়া (রাঃ) এ ব্যাপারে আপত্তি  করলে আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, 'আলী (রাঃ) সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করি, আর এখানকার খাদ্য উত্তম ও বৈচিত্রপূর্ণ হয়; তাই এখানে এসে খাবার গ্রহণ করি।'

২) মুসকিলার গভর্ণর আর্দশির বায়তুলমাল থেকে ঋণ গ্রহণ করে পাঁচশ দাসদাসী খরিদ করে তাদেরকে মুক্তিদান করেন। খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী (রাঃ) কঠিনভাবে এ অর্থ দাবী করলে তিনি বলেন, 'আল্লাহর শপথ! এই পরিমাণ অর্থ ছেড়ে দেয়া উসমান (রাঃ)-র জন্য কোন ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু এঁকে তো দেখছি প্রতিটি কানাকড়িরও হিসেব নিতে চায়।' এরপর তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে মুয়াবিয়া (রাঃ)-র আশ্রয়ে চলে যান। 
আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) এ কথা শুনে বলেন, 'আল্লাহ তার অকল্যাণ করুন। সে কাজ করেছে প্রভূর মত, কিন্তু পালিয়ে গিয়েছে কৃতদাসের মত! এবং বিশ্বাসঘাতকতা করেছে পাপীদের মত।'

৩) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-র চাচাত ভাই। সেই সময় বসরার গভর্ণর ছিলেন। তিনি বাইতুলমাল থেকে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। খেলাফতের বায়াত গ্রহণ করে হযরত আলী (রাঃ) সেই ঋণের অর্থ দাবী করলে তিনি বসরা থেকে মক্কায় চলে যান; হিসাব চুকিয়ে দেয়ার পর তিনি বসরায় ফিরে আসেন।

৪) একবার হযরত আলী (রাঃ)-র ভাই হযরত অকীল (রাঃ) তাঁর কাছে এসে বায়তুলমাল থেকে কিছু অর্থ দাবী করলেন। হযরত আলী (রাঃ) বললেন, 'থামো! যখন অন্যদেরকে দেব তখন তোমাদেরকেও তাদের সমান দেব।' তিনি অনেক অনুরোধ ও কাকুতিমিনতি করলে হযরত আলী (রাঃ) বললেন, 'তুমি বরং বাজারে গিয়ে তালা ভেঙে মানুষের মাল চুরি করে নিয়ে যাও, সেটাই ভাল।' 
অকীল (রাঃ) বললেন, 'আপনি আমাকে চোর বানাতে চাচ্ছন?' আমিরুল মুমিনীন বললেন, 'তুমি তো আমাকে মানুষের কাছে চোর বানাতে চাচ্ছো। তুমি চাচ্ছো মুসলমানদের মাল মুসলমানদের না দিয়ে তোমাকে দিয়ে দেই।' এতে অসন্তুষ্ট হয়ে অকীল (রাঃ) সিরিয়া গিয়ে সিরিয়ার গভর্ণর মুয়াবিয়া (রাঃ)-কে তাঁর প্রয়োজনের কথা বললেন। মুয়াবিয়া (রাঃ) ততৎক্ষণাৎ বায়তুলমাল থেকে এক লাখ দিহরাম তাকে দিয়ে বললেন, 'মিম্বরে উঠে ঘটনাটা একটু বর্ণনা করুন।' অকীল (রাঃ) মিম্বরে দাঁড়িয়ে বললেন, 'আমি হযরত আলী (রাঃ)-র কাছে এমন জিনিস চেয়েছিলাম যা তাঁর দীনের ক্ষতি করতো; তাই তিনি তাঁর দীনকেই আঁকড়ে থাকলেন। আমি মুয়াবিয়া (রাঃ)-র কাছে সেই একই জিনিস প্রার্থনা করলাম। তিনি তাঁর দীনের চাইতে আমাকে বেশি অগ্রাধিকার দিলেন।'
  
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) খেলাফত গ্রহণ করার পর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ফারুকে আযম হযরত ওমর (রাঃ)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তাই তিনি লোভী গভর্ণরদের প্রথমেই ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন ভালো নির্লোভ  মানুষদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন  পদে নিয়োগ দেন। সবায় খলিফাতুল মুসলিনের আদেশ মেনে নিলেও একটিমাত্র বাহানা দাঁড় করিয়ে মুয়াবিয়া (রাঃ) মুসলিম খেলাফতের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরে পুরো মুসলিম জাহানকেই তছনছ করে দেয়। সর্বজন স্বীকৃত খলিফার বায়াত গ্রহণ না করা তো সবচেয়ে বড় অপরাধ, তার উপর খেলাফতের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরা; কতটা যৌক্তিক?  

সবচেয়ে দুঃখের বিষয়— সেই মুয়াবিয়া (রাঃ)-র অনুসারীর সংখ্যাই আজকের দুনিয়ায় সংখ্যায় বেশী; তারা শুধু দুনিয়াবি লাভের কথাই চিন্তা করে। আমার প্রশ্ন — তবে ইসলাম কেন, অন্য কিছু দিয়ে তো আরও অনেক বেশী দুনিয়াবি সুবিধা ভোগ করা যায়! তাই নয় কি? মুনাফেকি তো জঘন্য পাপ; আর মুনাফেকের জন্য নির্ধারিত রয়েছে সবচেয়ে ভয়াবহ জাহান্নাম।।  

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
৩ এপ্রিল, ২০২১.

রবিবার, ২৮ মার্চ, ২০২১

সাবধান মুসলমান!


পবিত্র কোর'আনুল কারীম নিয়ে প্রথম ব্যবসা শুরু হয়েছিল সিফফিনের যুদ্ধে— তলোয়ারের আগায় কোর'আন বেঁধে ধোঁকার মাধ্যমে; যা আজও অব্যাহত। বরং পরিসর বেড়েছে অনেক, হাজার-কোটিগুণ; তারাই ইসলামকে বানিয়েছে আজ পোশাকি ধর্ম। আদর্শ ও মতবাদের বৈপরীত্য, আর আলেম সমাজের মত ও পথের বিভিন্নতায় বিশ্ব মুসলিম ঐক্যসূত্র আজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে; এ যেন এক অতল মহাসাগর। এই দীর্ঘ জীবনে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রায় প্রত্যেক দলের ধর্মীয় বিশ্বাস বেশ ভালো করেই পরীক্ষা করেছি; আবিষ্কার করেছি তাদের গলদ আকিদা। আবার তারাই 'লাইলাতুল নিফসে মিন সাবান' পালনকারীকে অপবাদ দেয় 'বেদাতী' বলে, মাজার জেয়ারতকারীকে অপবাদ দেয় 'কবর পূজারী' বলে! বাপ-দাদারা তো ওসব পালন করতেন; তবে কি তাঁরা সবাই জাহান্নামী?(নাউজুবিল্লাহ!) তোমরা এ'সব নতুন কথা, নতুন বাহানা, নতুন ফেতনা কোথায় পেলে? 

সাধারণ মুসলমান এখন যাবে কোথায়? তারাও ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে; বিভিন্ন মতে চায়ের দোকান দাবিয়ে বেড়াচ্ছে! ভার্চ্যুয়াল এই যুগে এসে ভ্রান্ত মোল্লারা সব এখন মিডিয়ার মাঠ দখল করে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে ব্যতিব্যস্ত। আর তাই, সাধারণ মুসলমানরা ভ্রান্তদের মতবাদের অতল গহ্বরে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে; অনেকেই এই মহাসাগরে তলিয়েও গেছে, আবার কেউবা নাক ডোবা-ভাসা অবস্থায় হাবুডুবু খাচ্ছে। মহাসাগরে ডুব দিয়ে ঝিনুক কুড়ানো যতটা কঠিন, আর চেয়েও বেশী কঠিন বিভ্রান্তির এই মহাসাগরে ডুবে জ্ঞানের আলোকে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা। আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কিতাব 'এহইয়াউল উলুমুদ্দীন'-এ স্পষ্টতই আমাদের জন্য দিক নির্দেশনা রেখে গেছেন— 'একমাত্র আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত-ই হলো  নাজাত প্রাপ্ত দল' বলে।

বর্তমানের এই লোভাতুর কামার্ত বস্তুবাদী দুনিয়ায় যে কোন মুসলমানের পক্ষে সত্য পথ ধারণ এবং অবলম্বন করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ, হারাম এখন আমাদের রক্তে-মাংসে মিশে গেছে; হারাম উপার্জিত পয়সা দিয়ে মসজিদ মাদ্রাসা করে, মোল্লা বানিয়ে, হজ্জ করে, নামাজ পড়ে লাভ কি? তাই তো এতো এতো বয়ান শোনার পরও মানুষের জীবনযাপনে কোর'আন-হাদিসের কোন আসর পরিলক্ষিত হয় না; বরং দিনদিন সত্য থেকে মুসলমান যোজন-যোজন দূরে সরে যাচ্ছে। মিথ্যা ও হারামের জন্যই আজ মানুষের মাঝ থেকে হেদায়েতের নূর উঠে গেছে, সিরাতুল মোস্তাকিমের পথ খোঁজা ও সন্ধান কঠিন হয়ে পড়েছে। এ পথে হাঁটা ও সার্থক হওয়া ভাগ্যবানের সংখ্যা তাই দিন দিন অতি নগন্য হয়ে পড়ছে। 

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো— বাতিলরা প্রত্যেকেও নিজেকে সার্থক ও সিদ্ধ মনে করে! আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত-ই তো বলেছেন, 'প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদে খুশি '। এসব মতবিরোধ ও মতবাদ সম্বন্ধে হুজুরপাক (সাঃ) সারে চৌদ্দশ বছর আগেই ভবিষ্যৎ বাণী করে গেছেন, 'আমার উম্মত তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে; তন্মধ্যে একদলই শুধু মুক্তি পাবে।'  

দুনিয়ার ক্ষমতার জন্য যারা খলিফাতুল মুসলিমিন হযরত আলী (রাঃ)-র বায়াত নিতে  তালবাহানা করেছিল, কারবালার প্রান্তরে যারা ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে নির্মমভাবে শহীদ করেছিল, তারাও নামাজ পড়তো, তাশাহুদ শেষে দুরুদ পড়তো, রোজা রাখতো, লম্মা জুব্বা পড়তো। তাদের অনুসারীরা আজও দুনিয়াতে অধিক পরিমাণে আছে; বস্তুত ওরাই সংখ্যায় অধিক! নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা দুনিয়াটাকে জাহান্নাম বানাতে ব্যতিব্যস্ত। এ'সব মুনাফেক থেকে সাবধান মুসলমান।।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২৮ মার্চ, ২০২১.

রবিবার, ২১ মার্চ, ২০২১

রূহ্ এবং নফস:


আমরা অনেকেই রূহ্ ও নফস্-কে একই মনে করি; আসলে এ'দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস, একই বস্তু নয়। 'রূহ্' হলো পরমাত্মা, আর 'নফস' হলো জীবাত্মা (মন বা ইগো বা জীবনীশক্তি)।  সুরা সোয়াদ-এর ৭২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা বলেন, 'ফাইযা-সাওয়্যাইতুহূ ওয়া নাফাখ্তু ফীহি মির রূহ্বী ফাক্বাউ লাহূ সা-জ্বিদীন।'- অর্থাৎ, 'যখন আমি ওকে সুঠাম কবর এবং ওতে রূহ্ সঞ্চার করব তখন তোমরা ওর প্রতি সিজদাবনত হও।' এবং সূরা বনী ইসরাঈল-এর ৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা বলেন,'ইয়াস্আলূনাকা ‘অনির্ রূহ্বি; কূলির রূহ্ব মিন্ আমরি্ রাব্বী ওয়ামা~ ঊতীতুম্ মিনাল্ ‘ইলমি ইল্লা-ক্বালীলা।' - অর্থাৎ- 'তোমাকে ওরা রূহ্ সম্পর্কে প্রশ্ন করে; বল, ‘রূহ আমার রবের আদেশঘটিত, এ বিষয়ে তোমাদের সামান্য জ্ঞানই দেয়া হয়েছে।' 

পবিত্র কুর'আনুল কারীমে অন্তত বিশবার ‘রূহ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এবং তিনটি প্রসঙ্গে এ শব্দটি উদ্ধৃত হয়েছে। প্রথমতঃ ‘রূহ’ মানুষের ভেতর ফুঁ দিয়ে প্রাণের সঞ্চার করা বুঝাতে এসেছে; দ্বিতীয়তঃ ‘রূহ’ শব্দটি ওহীর দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা হযরত জিব্রাইল (আঃ) প্রসঙ্গে এসেছে; এবং তৃতীয়তঃ ‘রূহ’ শব্দটি এসেছে স্বয়ং কুরআন ও আল্লাহর ওহী সম্পর্কে, যে ওহী রাসূলপাক (সাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ। সহজভাবে এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় - 'রূহ' হলো প্রাণ; কিন্তু কোন প্রাণ? যে তিনটি প্রসঙ্গে এই ‘রূহ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের জীবন এবং মানব প্রাণের উৎস হিসেবে রূহ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে।

অতএব, আমরা এখন মোটামুটিভাবে এমন একটি সিদ্ধানে উপনীত হতে পারি যে, 'আররূহ্ব আমরূল্লাহ্' অর্থাৎ- রূহ্ হলো আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার নির্দেশ বা হুকুম। আর আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার হুকুম-এর কি কখনো মৃত্যু হওয়া সম্ভব? –কখনো নয়। তাই তো বলি - রূহের মৃত্যু নেই; যা চীরস্থায়ী। স্রষ্টার সৃষ্টির স্থায়ীত্বের ভিত্তি - ক্ষণস্থায়ী, দীর্ঘস্থায়ী ও চীরস্থায়ী-র উপর নির্ভর করেই  সবকিছু সৃষ্টি এবং প্রবর্তিত হয়, হবে। স্রষ্টার সৃষ্ট প্রতিটি বস্তুরই মৃত্যু আছে; এক সময় না এক সময় সব কিছুই মরে যায়, যাবে বা ধ্বংস হবে; কিন্তু চীরস্থায়ী রূহ বা পরমাত্মার কখনো মৃত্যু বা বিনাশ হবে না, নেই।

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে মানুষ মরে যায় কেন বা তা হলে মরে কি? মারা যায় আসলে মানুষের নফস বা জীবাত্মা বা জীবনীশক্তি; অর্থাৎ জীবন বা মন। মানুষের 'রূহ্' কখনো মরে না বা মরবেও না।  নফসের জীবনীশক্তি দেহের প্রতিটি রন্দ্রের সবখানেই বিরাজিত থাকে, এবং তা এক সময় মরে যায়। নফস বা জীবাত্মা আবার তিন প্রকার; যথা- ১). নফসে আম্মারা, ২). নফসে লাউয়ামাহ, ও ৩). নফসে মুতমাইন্নাহ্। পবিত্র কুর'আনুল কারীমের সূরা ইউসুফ-এর ৫৩ নম্বর, সূরা কিয়ামাহ-র ২ নম্বর ও সূরা ফাজর-এর ২৭ ও ২৮ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। একটু মনযোগ ও আন্তরিকতার সাথে খেয়াল করলেই হয়তো আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা আপনাকেও এ সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা দিতে পারেন।

পবিত্র কুর'আনুল কারীমে সুরা আম্বিয়া-র ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা স্পষ্টই বলেন, ' কুল্লু নাফ্সিন যা-ইক্বাতুল্ মাওত।" অর্থাৎ প্রত্যেক নফসই (জীব) মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।' মৃত্যুর স্বাদ বলতে এখানে আসলে কি বুঝানো হয়েছে? এখানে বুঝানো হয়েছে শান্তি বা শাস্তির কথা। সকল নফস-কেই শান্তি বা শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হয় বা হবে। তা দেহ ধারণের আগেই হউক বা দেহ ধারণের পরেই হউক বা দেহ ত্যাগের পরে হউক। তিন অবস্থাতেই নফস বা জীবাত্মা শান্তি বা শাস্তি ভোগ করে বা করবে। রূহ কখনই শাস্তি ভোগ করে না বা করবে না; রূহ নফসের শাস্তির ভাব প্রকাশ করে মাত্র। রূহ শাস্তি ভোগ করার অর্থ দাঁড়ায় স্রষ্টা নিজে শাস্তি ভোগ করা; যা কখনো সম্ভব নয়, হতে পারে না। 

মানবদেহে একমাত্র রূহই হলো আল্লাহর প্রতিনিধি; যা মানবদেহের মহারাজ। যে রূহ বা পরমাত্মা আল্লাহর তাজাল্লী বা আদেশ, তার ভুল-ত্রুটি কী করে সম্ভব? যেহেতু রূহ-র মৃত্যু নেই, সুতরাং তার কোনো শাস্তিও নেই। 

না বুঝে সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি অনেক জ্ঞানীগুণীজণও অনেক সময় ভুল করে বসেন এবং ভাবেন - রূহই আত্মা, ও নফসও আত্মা বা রূহ্ ও নফস একই। 'রূহ্ব' ও 'নফস' আরবি শব্দ দু'টির বাংলা অর্থ লিখার সময় একশ্রেণির পীর, আলেম-মৌলোভী ও তাফসীরকারক খেয়াল না করে আত্মা বলে একই অর্থ করে ফেলেন। আসল কথা হলো, আত্মা বলতে যদি নফস বুঝানো হয় তাহলে তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে; আর আত্মা বলতে যদি রুহও বুঝানো হয়, তাহলে তা-কেও শাস্তি ভোগ করতে হবে। কিন্তু কোনভাবেই রূহ কখনো শাস্তির উপযুক্ত নয়; কেননা, এ যে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলার তাজাল্লী। 

অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা মৃত্যুর পর তো দেহ থাকে না, তাহলে রূহকেই দুনিয়ার অপকর্মের শাস্তি ভোগ করতে হয় বা হবে। সত্যিকার অর্থে ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয় বা তা না; কারণ দেহ ধারণ ছাড়া রূহ-কে অনুভব করা কখনো সম্ভব নয়। রূহকে কোন ভাবে কারো পক্ষে বাধ্যও করা সম্ভব নয়। দেহ না থাকলে রূহ কখনই তাতে বসত করে না বা করতে পারে না। এজন্য মায়ের গর্ভে শিশুর দেহ জীবনীশক্তিসহ আগেই তৈরি হয়; এবং ৪ মাসের সময় সেই দেহের মাঝে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার তরফ হতে রূহ নাযিল হয়। আসলে, মানবদেহের জীবনশক্তি হলো নফস বা জীবাত্মা; আর রূহ বা পরমাত্মা হলো আল্লাহর অংশ, যা তাঁর ফুঁ বা হুকুম।

রূহ এবং নফস আসলে একে অপরের পরিপূরক এবং ওরা একে অন্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িতও। বান্দা নেককাজ বেশি বেশি করলে রূহ ও নফস একাকার হয়ে যায়, আর বদকাজে নফস থেকে রূহ দূরে সরে যায়। তবে, প্রধান ও প্রথম শর্ত হলো খাঁটি ঈমান। অতঃপর রূহ-কে সচল রাখতে হলে সর্বাবস্থায় স্মরণ করতে হবে সুরা তাকাছুর-এর উক্ত দু'আয়াত- 'আল্হা-কুমুত তাকা-ছুর, হ্বাত্তা- যুরতুমুল্ মাক্বা-বির।' অর্থাৎ- 'প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের ভুলিয়ে রেখেছে, যদিও তোমরা কবরের সন্মুখীন হও।'

রূহ চায় আল্লাহ্-র তুষ্টি, কিন্তু নফস চায় আরাম-আয়েস ভোগ-বিলাস। নফস-কে জয় করতে হলে অবশ্যই অসম প্রাচুর্যের লোভ-লালসা সম্ভরণ করতে হবে, এবং আমাদের মাঝে বসবাস করা আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'লার অংশ রূহ-কে সার্বক্ষণিক প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করতে হবে; তবেই আসবে অনন্ত সাফল্য॥

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২১ মার্চ, ২০১৯. 

শুক্রবার, ১ জানুয়ারী, ২০২১

Happy New Year 2021!

May this year 2021 bring new happiness, new goals, new achievements, and a lot of new inspirations on your life. Wishing you a year fully loaded with happiness. Wishing every day of the new year to be filled with success, happiness, and prosperity for you and your families. 
Happy New Year 2021!