শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আতাউল্লাহ বুখারী ও মির্জা কাদিয়ানীর তথাকথিত ডিবেট :



'সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারী ও মির্জা কাদিয়ানীর ডিবেট' নামের একটি কল্পকাহিনী আমাদের দেশের তথাকথিত কিছু বিবেকহীন মোল্লা/মৌলুভী একসময় প্রচার করেছে, না জেনে না বুঝে গবেষণা ছাড়া সেসব বয়ানের সূত্র ধরে বর্তমানে একশ্রেণীর তরুণ ওয়াজেরীয়ানও ওয়াজের মঞ্চে তা চাউর করছে; যা ইউটিউবসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে হচ্ছে এবং বলা যায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ তথাকথিত ইসলামিক বক্তাই এই কাল্পনিক ডিবেটের কথা তুলে ধরে কাদিয়ানীদের নাজেহাল করতে চেষ্টা করছে; ঘটনাটি আসলে কি, তা কি তারা একেবারও চিন্তা করেছে? বাস্তবতায় তারা নিজেরাই হাসির পাত্র হচ্ছে। একবারের জন্যও কেন তারা চিন্তা করে দেখে না মিথ্যা দিয়ে সত্য কখনও প্রতিষ্ঠা করা যায় না; বরং সমালোচিত হতে হয় এবং প্রকৃত সত্যটাও ধামাচাপা পড়ে যায়।  

কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে কেন? ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতে খামাখা কেনইবা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে? গবেষণা করে সত্যটা জেনে বুঝে নিলেই তো হয়। মির্জা কাদিয়ানী মারা গেছে ১৯০৮ সালে, তখন আতাউল্লাহ বুখারীর বয়স কত?    

 সৈয়দ আতাউল্লাহ শাহ বুখারী (রঃ), জন্ম: সেপ্টেম্বর ২৩, ১৮৯২ — মৃুত্যু: আগস্ট ২১, ১৯৬১; যিনি ছিলেন একজন মুসলিম হানাফী পণ্ডিত, ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মীয় ও সিনিয়র রাজনৈতিক নেতা। তিনি ছিলেন মজলিস-ই-আহরার-ই ইসলাম এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম একজন।  আতাউল্লাহ বুখারীর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান ছিল ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে শক্তিশালী ব্রিটিশ-বিরোধী অনুভূতির অঙ্কুরোদগম সৃষ্টি করা। আর মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানী, জন্ম: ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৫ — মৃত্যু: ২৬ মে ১৯০৮; একজন ভারতীয় ধর্মীয় নেতা, এবং আহমদিয়া মুসলিম জামাত নামক এক ধর্মের প্রবর্তক। তাঁর দাবীসমূহ— ১৪ শতাব্দীর  মুজাদ্দিদ  (আধ্যাত্মিক সংস্কারক), প্রতিশ্রুত মসিহ, মাহাদি, নবী এবং খলীফা; তিনি অবশ্য  ইসলামের পরিপূর্ণতা দানকারী একজন উম্মতি নবী হিসেবেও নিজেকে দাবী করেন। মুসলিম উম্মাহ যাকে একজন ভণ্ড নবী হিসেবে চিনে।

ভন্ডনবী মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ১৮৯১ সালের ২২শে জানুয়ারী যখন নিজেকে ‘প্রতিশ্রুত মাসীহ’ দাবী করে, তখন মাওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরী ছিলেন একজন ছাত্র, আতাউল্লাহ বুখারীর জন্মই হয়নি।  এই দাবীর দেড় বছর পর সানাউল্লাহ অমৃতসরী ফারেগ হন এবং উলূম ও ফুনূনে ঋদ্ধ হয়ে ১৮৯২ সালে নিজ জন্মভূমি অমৃতসরে ফিরে আসেন, আতাউল্লাহ বুখারী তখন সবে জন্মগ্রহণ করেন। অতএব আতাউল্লাহ বুখারীর সাথে মির্জা কাদিয়ানী ডিবেট কতটা যৌক্তিক?? 

মির্জা কাদিয়ানীর বিরুদ্ধে সে সময়কার সব বড় বড় আলেম-ওলামাই সোচ্চার হয়েছিলেন, তন্মধ্যে মাওনা সানাউল্লাহ অমৃতসরী অন্যতম; মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী (মৃঃ ১৯২০ খৃঃ), সৈয়দ নাজীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভী, মাওলানা আব্দুল হক গযনভী, মাওলানা মুহাম্মাদ বাশীর সাহসোয়ানী (১৮৩৪-১৯০৮ খৃঃ), মাওলানা কাজী মুহাম্মাদ সুলাইমান মানছূরপুরী, মাওলানা আব্দুল জববার গযনভী, মাওলানা আহমাদুল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা গোলাম আলী কাছূরী, মাওলানা হাফেজ আব্দুল মান্নান ওয়াজীরাবাদী (১৮৫১-১৯১৫ খৃঃ), মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী, মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী, মহাকবি ড. মুহাম্মাদ ইকবাল, ‘জমীনদার’ পত্রিকার সম্পাদক জাফর আলী খান (১৮৭৩-১৯৫৬ খৃঃ) প্রমুখ কাদিয়ানীদের মুখোশ উন্মোচনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন; পরবর্তীতে সে দলের অন্যতম একজন সৈনিক হন সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারী। যার ফলে জনসম্মুখে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে। মাওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরী ভণ্ড নবী বিরুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে ময়দানে নেমে পড়েছিলেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেন; তাঁদের প্রচারণার ফলেই পৃথিবীর অন্যসব হাক্কানী ওলামায়ে কেরামগণও তখন চতুর্দিকে সোচ্চার হন। 

সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারীর সাথে মূলতঃ বাহাস হয়েছিল মির্জাপুত্র বশির উদ্দিন মাহমুদের; ভুল করে যা মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নামে প্রচার করা হয়! সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারীর জ্ঞানগর্ভ সেই বক্তব্য প্রায়ই আমাদের দেশের বক্তাদের বয়ানে শুনতে পাই, কিন্তু অধিকাংশ বক্তা  তখনকার সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারীর প্রতিপক্ষ ভুল করে মির্যা কাদিয়ানীকে করে ফেলে; যা চরম ভুল। মির্জা কাদিয়ানী যখন কলেরায় মারা যায়, তখন সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারীর বয়স মাত্র ১৬ বছর।

তবে কি উক্ত ঘটনাটি পুরোপুরি মিথ্যা? মোটেও না! সঠিক ঘটনাটি হলো, আতাউল্লাহ বুখারীর প্রতিপক্ষের ডিবেটার ছিল মির্জা বশির উদ্দিন মাহমুদ; মির্জা কাদিয়ানীর পুত্র ও কাদিয়ানী জামাত (একাংশ, রাবওয়া গ্রুপ)'র দ্বিতীয় খলিফা, যার মৃত্যু ১৯৬৫ সালে।

ঐতিহাসিক সেই মজার ঘটনাটি এখন আমি অতি সংক্ষেপে তুলে ধরতে যাচ্ছি। ১৯৫৩ সালের ঘটনা; সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে তখন খতমে নবুওত আন্দোলনে উত্তাল জনতা। 'খতমে নবুওত' এর শরয়ী অবস্থা, যুক্তিকতা এবং গুরুত্ব উঠিয়ে ধরার উদ্দেশ্যে তখন গঠিত হয় 'Monir Enquire Tribunal' (মুনির ইনকোয়ারি ট্রাইব্যুনাল); দেশের শীর্ষস্থানীয় সকল ওলামায়েকেরাম এই ট্রাইব্যুনালে যোগদান করেন। কাদিয়ানীদের প্রতিনিধিত্ব করতে যোগ দেয় মির্জাপুত্র মির্জা বশির উদ্দিন মাহমুদ, এদিকে খতমে নবুওত আন্দোলনের বীর সিপাহশালার সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারী ট্রাইব্যুনালে যোগ দেন। 

দুই পক্ষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে— সত্যের পক্ষে সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারী, আর অন্য পক্ষে শানে রেসালতের বিদ্রোহীপক্ষ কাদিয়ানী জামাতের দ্বিতীয় খলিফা মির্জা বশির উদ্দিন মাহমুদ। বক্তব্যের  এক পর্যায়ে মির্জা বশির বলে, সূরা আস সাফফ ৬ নং আয়াতের মধ্যে 'ইসমুহু আহমদ' হতে 'আহমদ' দ্বারা গোলাম আহমদ-ই উদ্দেশ্য। জবাবে সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারী বলেন, এই আয়াতে তো শুধুই 'আহমদ' আছে। কিন্তু তোমার বাপের নাম তো 'গোলাম আহমদ'! 
মির্জাপুত্র : 'গোলাম' শব্দ কেটে দিন তথা 'গোলাম' শব্দটি নামের শুরু থেকে বাদ দিয়ে দিন।
তখন সৈয়দ আতাউল্লাহ বুখারী : তাই নাকি! তাহলে তো আমার নামের শুরু থেকে 'আতা' বাদ দিতে পারি! তো 'আতা' শব্দ বাদ দিলে আমি হই 'আল্লাহ'। (তারপর সৈয়দ সাহেব বললেন)— لہذا میں نے اس الو کے پٹھے کو نبی بنا کر بھیجا ہی نہیں অর্থাৎ আমি এই উল্লুক পাঠাটিকে নবী বানিয়ে পাঠাইনি!

এমন বক্তব্যে মির্জাপুত্রের লম্বা জিহ্বা খামোশ বনে গেল, তার বাগাড়ম্বর আর সামনে এগোয়নি;  উপস্থিত দর্শকদের হাসি তামাশা তখন দেখে কে!!!

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন