শনিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২১

সিফফীনের যুদ্ধ ও কিছু কথাঃ


সিফফীনের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসের এক ন্যক্কারজনক অধ্যায়; এ গৃহযুদ্ধেই বদলে যায় মুসলমানদের ভাগ্য। পবিত্র  কুর'আনুল কারীম নিয়ে প্রথম বারের মতো ব্যবসা শুরু হয় এ যুদ্ধেই। কিছু নব্য মুসলিম যারা সুবিধাবাদী মুসলিম, মক্কা বিজয়ের সময় ঠেলায় পড়ে মুসলমান সেজেছে, সেইসব লোভী নামধারী মুসলমানরাই   দুনিয়াবি সুযোগ-সুবিধার লোভে পড়ে, ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে বা বিভিন্ন কূটকৌশলে সরলমনা সাধারণ মুসলমানকে ইমানহারা করেছে, ভ্রান্ত বানিয়েছে। শেষ পরিনতি— মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন এবং ভ্রান্ত দুনিয়া লোভীদের বিজয়! 

নিন্মের দৃশ্যপটগুলো একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠবে সে সময় কি ঘটেছিল— 

১) সিফফীনের যুদ্ধের সময় হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-র সাথে যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন; কিন্তু খাবার সময় হলে তিনি মুয়াবিয়া (রাঃ)-র কাছে যেয়ে খাবার খেতেন। কারণ মুয়াবিয়া (রাঃ)-র তাবুতে অত্যন্ত দামী খাবার তৈরি করা হতো। একদিন মুয়াবিয়া (রাঃ) এ ব্যাপারে আপত্তি  করলে আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, 'আলী (রাঃ) সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করি, আর এখানকার খাদ্য উত্তম ও বৈচিত্রপূর্ণ হয়; তাই এখানে এসে খাবার গ্রহণ করি।'

২) মুসকিলার গভর্ণর আর্দশির বায়তুলমাল থেকে ঋণ গ্রহণ করে পাঁচশ দাসদাসী খরিদ করে তাদেরকে মুক্তিদান করেন। খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী (রাঃ) কঠিনভাবে এ অর্থ দাবী করলে তিনি বলেন, 'আল্লাহর শপথ! এই পরিমাণ অর্থ ছেড়ে দেয়া উসমান (রাঃ)-র জন্য কোন ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু এঁকে তো দেখছি প্রতিটি কানাকড়িরও হিসেব নিতে চায়।' এরপর তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে মুয়াবিয়া (রাঃ)-র আশ্রয়ে চলে যান। 
আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) এ কথা শুনে বলেন, 'আল্লাহ তার অকল্যাণ করুন। সে কাজ করেছে প্রভূর মত, কিন্তু পালিয়ে গিয়েছে কৃতদাসের মত! এবং বিশ্বাসঘাতকতা করেছে পাপীদের মত।'

৩) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-র চাচাত ভাই। সেই সময় বসরার গভর্ণর ছিলেন। তিনি বাইতুলমাল থেকে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। খেলাফতের বায়াত গ্রহণ করে হযরত আলী (রাঃ) সেই ঋণের অর্থ দাবী করলে তিনি বসরা থেকে মক্কায় চলে যান; হিসাব চুকিয়ে দেয়ার পর তিনি বসরায় ফিরে আসেন।

৪) একবার হযরত আলী (রাঃ)-র ভাই হযরত অকীল (রাঃ) তাঁর কাছে এসে বায়তুলমাল থেকে কিছু অর্থ দাবী করলেন। হযরত আলী (রাঃ) বললেন, 'থামো! যখন অন্যদেরকে দেব তখন তোমাদেরকেও তাদের সমান দেব।' তিনি অনেক অনুরোধ ও কাকুতিমিনতি করলে হযরত আলী (রাঃ) বললেন, 'তুমি বরং বাজারে গিয়ে তালা ভেঙে মানুষের মাল চুরি করে নিয়ে যাও, সেটাই ভাল।' 
অকীল (রাঃ) বললেন, 'আপনি আমাকে চোর বানাতে চাচ্ছন?' আমিরুল মুমিনীন বললেন, 'তুমি তো আমাকে মানুষের কাছে চোর বানাতে চাচ্ছো। তুমি চাচ্ছো মুসলমানদের মাল মুসলমানদের না দিয়ে তোমাকে দিয়ে দেই।' এতে অসন্তুষ্ট হয়ে অকীল (রাঃ) সিরিয়া গিয়ে সিরিয়ার গভর্ণর মুয়াবিয়া (রাঃ)-কে তাঁর প্রয়োজনের কথা বললেন। মুয়াবিয়া (রাঃ) ততৎক্ষণাৎ বায়তুলমাল থেকে এক লাখ দিহরাম তাকে দিয়ে বললেন, 'মিম্বরে উঠে ঘটনাটা একটু বর্ণনা করুন।' অকীল (রাঃ) মিম্বরে দাঁড়িয়ে বললেন, 'আমি হযরত আলী (রাঃ)-র কাছে এমন জিনিস চেয়েছিলাম যা তাঁর দীনের ক্ষতি করতো; তাই তিনি তাঁর দীনকেই আঁকড়ে থাকলেন। আমি মুয়াবিয়া (রাঃ)-র কাছে সেই একই জিনিস প্রার্থনা করলাম। তিনি তাঁর দীনের চাইতে আমাকে বেশি অগ্রাধিকার দিলেন।'
  
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) খেলাফত গ্রহণ করার পর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ফারুকে আযম হযরত ওমর (রাঃ)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তাই তিনি লোভী গভর্ণরদের প্রথমেই ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন ভালো নির্লোভ  মানুষদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন  পদে নিয়োগ দেন। সবায় খলিফাতুল মুসলিনের আদেশ মেনে নিলেও একটিমাত্র বাহানা দাঁড় করিয়ে মুয়াবিয়া (রাঃ) মুসলিম খেলাফতের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরে পুরো মুসলিম জাহানকেই তছনছ করে দেয়। সর্বজন স্বীকৃত খলিফার বায়াত গ্রহণ না করা তো সবচেয়ে বড় অপরাধ, তার উপর খেলাফতের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরা; কতটা যৌক্তিক?  

সবচেয়ে দুঃখের বিষয়— সেই মুয়াবিয়া (রাঃ)-র অনুসারীর সংখ্যাই আজকের দুনিয়ায় সংখ্যায় বেশী; তারা শুধু দুনিয়াবি লাভের কথাই চিন্তা করে। আমার প্রশ্ন — তবে ইসলাম কেন, অন্য কিছু দিয়ে তো আরও অনেক বেশী দুনিয়াবি সুবিধা ভোগ করা যায়! তাই নয় কি? মুনাফেকি তো জঘন্য পাপ; আর মুনাফেকের জন্য নির্ধারিত রয়েছে সবচেয়ে ভয়াবহ জাহান্নাম।।  

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
৩ এপ্রিল, ২০২১.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন