বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২০

জাতীয় শিক্ষানীতি সময়ের দাবী :


চলতে চলতে মাঝেমধ্যে অদ্ভুত কিছু মানুষের সাথে হটাৎ দেখা হয়ে যায় এবং চমৎকৃত সব অভিজ্ঞতারও সন্মুক্ষিন হতে হয়; কয়দিন আগে তেমনই একজন শিক্ষকের সাথে আমার সাক্ষাত, যিনি মনে করেন - সৃজনশীলতা মানে হলো শিশু নির্যাতন! এদেশের টিভি বা মিডিয়ার কোন অনুষ্ঠানে, কোন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম বা সভা-সমাবেশে গিয়ে এখন আর বুঝার কোন উপায়ই থাকে না - কে শিক্ষিত, আর কে অশিক্ষিত! আমরা কি আসলেই আগাচ্ছি, না-কি পিছাচ্ছি? শিক্ষিত হচ্ছি, না-কি শিক্ষিতের ফানুস উড়াচ্ছি? শিক্ষার মর্মার্থও বুঝতে পারেন না যে দেশের বেশিরভাগ তথাকথিত সার্টিফিকেটধারী, সে দেশে ৫০ হাজার ৪৩২ কোটি টাকার শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রেখে বা ব্যয় করে লাভ কি? বরং পাঠশালা বন্ধ করে দক্ষতার কর্মশালা নির্মাণ করাই শ্রেয়।

নাচতে না জানা লোকের কাছে তো উঠোন বাঁকা হবেই; শিক্ষকতার উদ্দেশ্য ও বিধেয় না জানা লোকদের জন্য সৃজনশীলতাও তেমনই শিশু নির্যাতনই মনে হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ও পাঠ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকা প্রতিটি ব্যক্তির অবশ্যই একটি কথা জানা উচিত, শিক্ষা হলো কোন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয়ার একটি প্রক্রিয়া এবং এর মাধ্যমে সমাজে একজনকে উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সকল দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই হলো শিক্ষা; ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হলো সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। আর একজন শিক্ষকই পারেন এই অনুশীলনের মাধ্যমে প্রতিটি শিশুর মস্তিষ্কের দশ হাজার কোটি নিউরনের প্রতিটিকে স্বাতন্ত্র্য করতে এবং পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে।

'সৃজন' শব্দের অর্থ হলো - সৃষ্টি, আর 'শীল' শব্দের অর্থ হলো - নিজ; অর্থাৎ সৃজনশীল শব্দের পূর্ণাঙ্গ স্বরূপ দাঁড়ালো - নিজ থেকে সৃষ্টি বা আপন সৃষ্টি। সম্প্রতি সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে গণমাধ্যমে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে তা আমাদের সবার জন্যই খুব বিব্রতকর ও উদ্বেগজনক। দেশে অর্ধেকের বেশি, প্রায় ৫২.০৫% মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক এখনো পর্যন্ত সৃজনশীল পদ্ধতিই বোঝেন না; গত মে মাসে ১৮ হাজার ৫৯৮টি মাধ্যমিক স্কুল পরিদর্শন শেষে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ কথা জানতে পেরেছে! অন্য আরেকটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় - এখনো পর্যন্ত সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন এদেশের মাত্র ৪৮% স্কুল শিক্ষক, অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রশ্ন করে থাকেন ৩১% শিক্ষক এবং বাহির থেকে প্রশ্নপত্র জোগাড় করেন ২১% শিক্ষক!

নিঃসন্দেহে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এর সফলতা বা বিফলতা কোনভাবেই এককভাবে কোন ব্যক্তি বা বিষয়ের উপর নির্ভরশীল নয়। এ ব্যবস্থায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো এবং সার্বিক পারাপার্শ্বিকতারও গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য ভূমিকা রয়েছে। কাউকে সৃজনশীল করে গড়ে তুলতে হলে এসবের প্রত্যেকটিই একটি আরেকটির পরিপূরক; আর সকল ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভুমিকাই মূখ্য ও অতিব প্রয়োজনীয়। একজন শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে যেমন পাঠদানে যত্নশীল ও সৃজনশীল হতে হবে, তেমনিভাবে পাঠ পরিক্রমা ও অনুশীলনেও তাদের বৈচিত্র্য আনতে হবে; পাশাপাশি প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নে দক্ষতা অর্জনে শিক্ষককক্ষে এবং বাড়িতেও শিক্ষকদের যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হবে। 

কারণ, একজন শিক্ষক প্রশ্নপত্র প্রণয়নে ও উত্তরপত্র মূল্যায়নে দক্ষ না হলে কোনো অবস্থাতেই সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না, আর জাতীয়ভাবে কোন বড় সফলতাও আসবে না। তাছাড়া এটি অতো সহজ কোন কাজ নয়, এবং রাতারাতি এটিকে সফল বা বাস্তবায়নও করা সম্ভব হবে না বা যাবে না। অবশ্যই শিক্ষককে আগে দক্ষতা অর্জনে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং সেভাবে নিজকে তৈরি করতে হবে; অন্যথায় জাতি গঠনে ভূমিকা রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

অতি চালাকরা ইনিয়ে-বিনিয়ে যত কথাই বলুন না কেন আমার মত বোকারা নিশ্চয় স্বীকার করবেন - বর্তমান শিক্ষানীতিতে এদেশে নৈতিক শিক্ষার উপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আর অবশ্যই শিক্ষকদের আগে এসব কিছুর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে এবং নিজেদের জীবনে সেসবের চর্চা করতে হবে, পরে শিক্ষার্থীদের মাঝে অনুশীলন করাতে হবে। শিক্ষকতা সমাজের অন্য আর পাঁচটি পেশার পেশাদারের মতো কোন পেশা নয়, শিক্ষকতা অবশ্যই একটি মহৎ ব্রত; এ কথাটি শিক্ষকতার সাথে জড়িত হওয়ার আগেই প্রতিটি শিক্ষককে বুঝতে হবে। পাশাপাশি একজন অভিভাবককেও নিয়মিত সন্তানের লেখাপড়ার খোঁজ-খবর ও শ্রেণি-শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে; এবং কোনো অবস্থাতেই সন্তানকে কোচিং সেন্টারে পাঠানো যাবে না। যে কোন ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। আর এসব করতে পারলেই সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিসহ সার্বিক শিক্ষার সুফল তাড়াতাড়ি ও ব্যাপকভাবে পাওয়া যাবে।

শিক্ষা পদ্ধতিতে সৃজনশীল ব্যবস্থা যুক্ত হওয়ার অনেক অনেক আগে আমরা যারা সনাতনী পদ্ধতিতে লেখাপড়া করেছি তারা সবাই জানি, পাঠ্যবইয়ের মূল আলোচনা শেষে আমাদের পাঠ্য বইয়ে কিছু প্রশ্ন থাকতো - সংক্ষিপ্ত ও বিবৃতিমূলক; আমরা মূল পাঠ শেষে সেসব প্রশ্নের উত্তর বের করে করে নিজ হাতে নোট করতাম এবং অনেকটা মুখস্থ করেই উত্তর লিখতাম; বৃটিশ আমল থেকে অনেকটা মুখস্থনির্ভর এই শিক্ষা পদ্ধতিই এদেশের প্রচলিত ছিল। স্বাধীনতার পর আস্তে আস্তে কেমন করে যেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নোট-গাইড নির্ভর হয়ে যেতে শুরু করে; এমন একটা সময় গেছে এদেশে - গতবারের আসা প্রশ্ন বাদ দিয়ে বিগত কয়েক বছরের প্রশ্ন-উত্তর মুখস্ত করে পরীক্ষার হলে গেলেই দেখা যেতো ১০০% কমন পড়ে যেতো।

সেই প্রচলিত মুখস্থনির্ভর লেখাপড়া থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনা এবং কোচিং-প্রাইভেট, নোট-গাইড বন্ধ করার অভিপ্রায়ে মূলতঃ সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনটিই এখনো পর্যন্ত সম্ভবপর হয়নি, হচ্ছেও না; বরং সবই বেড়েছে। বর্তমানের সৃজনশীল চতুর্থ প্রশ্নটির উত্তরও শিক্ষর্থীরা সাধারণত মুখস্থ করেই লিখছে বলে উত্তরপত্র থেকে প্রতিয়মান হয়। প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষকরা ঠিকমতো না বুঝার কারণে তারা ক্লাসে ভালোভাবে পড়াতে পারছেন না, এবং ছাত্রছাত্রীরাও এর সঠিক প্রয়োগ বুঝে উঠতে পারছে না; তাই সবাই নোট-গাইড নির্ভরই হয়ে পড়েছে, পড়ছে। খোদ সরকারি একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে এ পদ্ধতিটি চালু হলেও এক যুগ পরেও মাত্র ৫৬% শিক্ষক এটি আয়ত্ত করতে পেরেছেন। 

এ পদ্ধতি বুঝতে শিক্ষকরা যেন পরিশ্রম করেন সে জন্য বাইরে থেকে না কিনে  স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিজেরা যেন তৈরি করতে পারেন সেই নির্দেশনা আগেই দেওয়া হয়েছিল, এ ব্যাপারে সরকারিভাবে একটি পরিপত্রও জারি করা হয়েছিল। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে যেন এই পদ্ধতিটিকে তারা অনবরত প্রশ্নবিদ্ধ করেই যাচ্ছেন! না কি, তারা ইচ্ছে করেই না বুঝার ভান করছেন? অনেক শিক্ষক আবার এখনো এই পদ্ধতি মানতেই পারছেন না! কোনরুপ চেষ্টা না করেই তারা বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশ্ন কিনে এনে পরীক্ষা নিচ্ছেন। স্কুল-কলেজ তো বটেই, বড় সাংঘাতিক ব্যাপার হলো - খোদ বোর্ড পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে হুবহুব প্রশ্ন তুলে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে!

এতে করে শিক্ষার্থীরা আগে যেমন এক কোম্পানির গাইড কিনতো, এখন বেশি উদ্দীপক পাওয়ার আশায় একাধিক কোম্পানির গাইড কিনছে; এতেকরে অভিভাবক হয়রানি বেড়েছে শতগুণ। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া এখন ক্লাসরুমের পরিবর্তে চলে গেছে কোচিং সেন্টারে। বেশিরভাগ স্কুল শিক্ষক এ পদ্ধতি না বুঝায় কমার্শিয়াল কোচিং সেন্টার বিস্তার লাভ করেছে ব্যাপকভাবে; এতে করে শিক্ষকরা ক্লাশে পড়ানোতে মনোযোগ না দিয়ে তারা কোচিং ব্যবসায় মনোযোগ দিচ্ছেন এবং কয়েকজন জানা শিক্ষক ভাড়া করে এনে ব্যবসাকে জমজমাট করছেন। আর, এসব অতি লোভী শিক্ষকরাই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত হচ্ছেন; শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর না হয়ে তারা হয়ে যাচ্ছেন জাতির অভিশাপ!
  
একজন দক্ষ মালির অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধম্য সাধনায় ফুলেফলে সুসজ্জিত হয় একটি বাগান, যে বাগানের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে সবাইকে; ফুলের সুবাসে বিমোহিত হয় সকল সৌন্দর্য পিপাসুরা। ছোট্ট একটি চারা গাছে ফুল ফোটাতে যেমন লাগে মাটি, পানি, সূর্যকিরণ, আকাশ, বাতাস, পরিচর্চা ও কঠিন সাধনা; ঠিক তেমনই একটি শিশুকে গড়ে তুলতেও প্রয়োজন পড়ে বোধ-বিবেচনাসহ সার্বিক পরিচর্চার। চারা গাছে ফুলফল ফলাতে যেমন লাগে একজন ভালো ও দক্ষ মালির, ঠিক তেমন-ই একটি শিশু মস্তিষ্কে নিউরনের বিকাশ ঘটাতেও প্রয়োজন পরে সৎ ও বোধ-বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন একজন জ্ঞানী শিক্ষকের। একজন মা-বাবা হয়তো নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য সন্তানের ভরণপোষণ, দেখা-শোনা ও সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে সামর্থানুযায়ী কিছুদিন যোগান দান করতে পারেন, কিন্তু আমার বিবেচনায় একজন শিক্ষক একটি মানুষের সারা জীবনের জন্য চলার পথের পাথেয়-এর সার্বিক ব্যবস্থা করে সঠিক ও যথার্থ যোগান দিয়ে থাকেন; বাচ্চাদের মস্তিষ্কের নিউরনের বিকাশ, মানসিক পরিপূর্ণতা ও পরিতৃপ্ততার সার্বিক কর্মকান্ডে একটি জীবনকে সময়ের উপযোগী করে গড়ে তোলেন একজন শিক্ষকই।

শুধুমাত্র শিক্ষকের মানের অভাবে এতো ভালো ও সহজ-সরল-সুন্দর একটি পরীক্ষা পদ্ধতি এদেশে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা আজও গেল না বা যায় নি - তা ভাবতেও আমার কষ্ট লাগে। প্রকৃতপক্ষে, সৃজনশীল মানে - পাঠ্যবইয়ের গল্পের আদলে শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন করে কোন একটি প্রশ্ন তৈরি করা নয়, সৃজনশীল হলো - পাঠের মূল স্পিরিটকে সামনে রেখে প্রশ্ন ও তার উত্তর তৈরি করা। কিন্তু সহজ এই পদ্ধতিটিও বাস্তবে এদেশে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না; কারণ, এখনকার শিক্ষকরা মোটেও খাঁটতে চান না, এবং অত্যন্ত বেশি লোভ করেন। আর এজন্যই শিক্ষা পেশাটাকেই তারা বানিজ্যিক অবয়বে আবদ্ধ করে ফেলতে চাইছেন! তারা হয়তো ভাবেন - শিক্ষায় উন্নত হলে, এতে তাদের লাভ কি?! 

অবশ্য, নতুন কোনো শিক্ষা পদ্ধতি চালু করার আগে শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল; দীর্ঘ প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, উপর্যুপরি সেমিনারসহ নানা ধরনের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থাপনাকে প্রস্তুত করার যে প্রয়োজনীয়তা ছিল তা একেবারেই পূরণ করা হয়নি। বরং যেনতেনভাবে নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করে দিয়ে তারপর ধারাবাহিকভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া ব্যবস্থাটি এতোটাই ধীরগতির যে, এক যুগ পার করেও সকল শিক্ষকের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা আজও সম্ভব হয়ে উঠেনি। অথচ পরীক্ষা এবং প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কিন্তু থেমে নেই। ফলে বাজারে প্রচলিত গাইড বইয়ের সহায়তা নেওয়ার প্রবণতা এমনিতেই চলে এসেছে; শুধু সহায়তা নয়, এমনকি বেড়েছে নির্ভরতাও।

সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির উদ্ভাবনের বা এর প্রচলনের প্রধান কারণ প্রকৃতপক্ষে নকল ও মুখস্থনির্ভরতা থেকে ছাত্রছাত্রীদের মুক্তি দেওয়া। সাধারণ পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীরা কোনো বিষয়ে কেবল একটি স্থির ধারনা পায় - এর পরিবর্তনশীলতা, ব্যাখা বিশ্লেষণ ইত্যাদি তাদের কাছে অস্পষ্টই থেকে যায়। সৃজন মানে সৃষ্টি; সৃষ্টি মানে নতুন কিছু তৈরি করা, পথ নির্দেশ করা, লক্ষ্য ঠিক করা। এক কথায় ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে গন্তব্যে পৌঁছা বা একটি নির্দষ্ট চিন্তার উপর ভর করে মাথা খাটিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো কিছু করার নামই সৃজনশীলতা। এ চিন্তা ছাত্রছাত্রীদের মাথায় আসবে কোথা থেকে? অনেক ছাত্রছাত্রীর সাথে কথা বলে আমি জেনেছি, এখনো বেশিরভাগ শিক্ষক ক্লাশে তাদের গাইডবই পড়ান এবং ওটা থেকেই প্রশ্নপএ্রও তৈরি করেন। তাই যদি হয়ে থাকে, শিক্ষার্থীদের অবস্থা তথৈবচ তো হবেই! অগত্যা যে উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন এই প্রশ্ন পদ্ধতিটি চালু করা হয়েছিল, সেটি মুখ থুবড়ে পরেছে এবং পরবেই। শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার প্রবণতা তো কমেইনি, বরং তা আরো নতুন মাত্রা পেয়েছে।

ছোট বেলায় আমরা যে কত গল্প-উপন্যাস পড়েছি তার কোন ইয়ত্তা নেই; আমাদের স্কুলে লাইব্রেরী কার্ড করা ছিল প্রত্যেক ছাত্রের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটি বাজে প্রবনতা - তারা মোটেও পড়তে চায় না। প্রিন্ট মিডিয়ায়, অনলাইন মিডিয়া বা ফেসবুকেও লক্ষ্য করেছি, কিছুটা বড় লেখা দেখলে তারা সে লেখার ধারকাছ দিয়েও হাঁটে না! অনেকের মন্তব্য দেখেই বুঝা যায়, না পড়ে এমনি এমনিই মন্তব্যটি সে করেছে। শিক্ষা জীবনেও তারা শুধু কিছু কিছু পাঠ মুখস্ত করেই ছাত্রত্ব চুকাতে চায়। 

পাঠ মুখস্থ নির্ভর শিক্ষা অনেকটা কূয়া'র ব্যাঙের লাফালাফি বা অনেকটা নির্দিষ্ট গন্ডিতে জীবন-যাপনের মতো। ছোট্ট একটি পরিসরে নেচে গেয়ে থাকা ব্যাঙ মনে মনে ভাবে ওটাই বুঝি কত বড় সমুদ্র! কিন্তু সমুদ্র যে কত বিশাল বিস্তৃত তা তো সে দেখেনি, জানেও না। কূয়া'র সোজা উপরের দিকে তাকিয়ে তারা শুধু আকাশের খণ্ড রূপ দেখে - পুরো আকাশ দেখে না; তাই স্বপ্ন আঁকার সাধও তাদের ওখানেই শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ শহুরে এই ছোট্ট পরিসরে আকাশের বিশালতা সমুদ্রের গভীরতা উপলদ্ধি করার সুযোগ যাদের নেই, মুক্ত অঙ্গণে যারা আসতে পারে না, পৃথিবীর পাঠশালায় ভর্তি করতে যাদের বাবাদের কৃপনতা, প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে ভালো মন্দ বিচার করার সাধ্য ও সুযোগ যাদের নেই - তাদের বইয়ের মাধ্যমে চিন্তা, বুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটানোর পথ প্রশস্ত করতে হবে। কল্পনাশক্তি জাগাতে ও বাড়াতে বইয়ের কোন বিকল্প নেই; তাই বই পড়ার অভ্যাস গড়তে হবে, আর বেশি বেশি বই পড়তে হবে। তবেই হয়তো একদিন পুরো জাতি পাল্টে যাবে।

শিক্ষানীতির নতুন প্রস্তাবে অষ্টম শ্রেণি শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষার বিধান রেখে শিক্ষা আইনের নতুন খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে; পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থাকবে কি না থাকবে তার নির্বাহী আদেশ দিয়ে সরকার তা নির্ধারণ করবে বলে সেখানেও উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীতকরণে কাজ করছে সরকার; অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা উন্নীত করার প্রাথমিক সমাপনী এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা থাকবে কি-না তা নিয়েও বিতর্ক চলছে। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে - সরকার প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এই ধারা লঙ্ঘন করলে যে কেউ অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা ছয় মাসের জেল বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তির বিষয়ে ওখানে বলা আছে - শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালীন মানসিক বা শারীরিক শাস্তি দেয়া যাবে না; এটি লঙ্ঘন করলে শিক্ষক অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা তিন মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নির্ধারিত পাঠ্যবই না পড়িয়ে বাইরের বই পড়ালে দুই লক্ষ টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের জেল বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। এমনতরো আরো অনেক কিছু রাখা হয়েছে এই খসড়ায়; আর জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০  বছর বছর পরিবর্তন বা সংযোজন হচ্ছে।

স্বাধীনতার এতো বছর পরে হলেও বর্তমান সরকার অন্ততঃ চেষ্টা করেছে এবং করছে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে - তিন স্তরবিশিষ্ট করতে এবং এই তিন স্তরবিশিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এরই মধ্যে প্রশ্নপদ্ধতি সৃজনশীল হয়েছে; কিন্তু এই প্রশ্নপদ্ধতি নিয়েও সর্বত্র প্রথম থেকেই কেমন যেন এক শ্রেণির মানুষের মাঝে এক ধরণের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আমি মনে করি এর প্রভাব পড়েছে সার্বিক শিক্ষায়ও; এবং কি যেন এক অদৃশ্য দোটানায় এক ধরণের অসঙ্গতি বিরাজ করছে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে প্রতিটি ক্ষেত্রে। তাই অবশ্যই শিক্ষাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সাজানোর জন্য আমাদের দেশের পুরো শিক্ষা কাঠামোই ঢালাওভাবে পরিবর্তনের প্রয়োজন। অবশ্য এরই মধ্যে বর্তমান সরকার যথেষ্ট প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং বিভিন্ন ভাবে চেষ্টাও করেছে করছে, নতুন নতুন উদ্যোগও নিয়েছে নিচ্ছে। 

স্বাধীনতার চার দশক পরে হলেও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণীত হয়েছে, কিন্তু আজও তা পরিপূর্ণ আলোর মুখ দেখেনি; এখনো পর্যন্ত কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে বেশিরভাগ নির্দেশনা বা নীতিমালা। সার্বিক বিবেচনায় আমরা চাই একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতীয় শিক্ষানীতি, যা এখন শুধুই সময়ের দাবী; এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা ঘোষণা করা হউক॥    

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২২ নভেম্বর, ২০১৭.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন