শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২০

সুখ তুমি কি বড় জানতে ইচ্ছে করে :


সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
            অনলে পুড়িয়া গেল|
অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে
            সকলি গরল ভেল|
  
সখি কি মোর করমে লেখি|
শীতল বলিয়া ও চাঁদ সেবিনু
            ভানুর কিরণ দেখি|

উচল বলিয়া অচলে চড়িতে
            পড়িনু অগাধ জলে|
লছিমি চাহিতে দারিদ্র্য বেড়ল
          মাণিক্য হারানু হেলে|

নগর বসালাম সায়র বাঁধিলাম
            মাণিক পাবার আশে|
সাগর শুকাল মাণিক লুকাল
         অভাগার করম-দোষে|

পিয়াস লাগিয়া জলদ সেবিনু
             বজর পড়িয়া গেল|
জ্ঞানদাস কহে কানুর পিরীতি
             মরণ অধিক শেল|

ড. মঞ্জুরে খোদা দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় আজ একটি সচিত্র প্রতিবেদনমূলক প্রবন্ধ লিখেছেন— 'কানাডার বেগমপাড়া একটি থিম' শিরোনামে। সেখানে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের অসৎ-দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী-আমলা-কামলা-রাজনীতিকদের পরিবার কানাডার যেসব স্থানে বাসা-বাড়ি কিনে বসবাস করছে সেসব স্থানকে ওখানকার বাঙালিরা 'বেগমপাড়া' বলে অভিহিত করেছে; কানাডায় আসলে সুনির্দিষ্টভাবে 'বেগমপাড়া' বলে কোনো জায়গা নেই। 'বেগমপাড়া' নামকরণ করার কারণটি হচ্ছে বাংলাদেশের লুটেরা দুর্নীতিবাজদের দ্বিতীয় আবাসভূমির প্রতীকী হিসেবে; সাহেবরা সব বাংলাদেশে লুট করে, আর বেগমরা কানাডায় আরাম-আয়েশ করে!

যে দেশের সাধারণ জনগণ এখনো দু'মুঠো ভাত যোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছে, রাস্তায় ভুখানাঙা হতাশাগ্রস্ত মানুষ ঘুরেফিরে হাহাকার করছে, দুটো ভাতের জন্য ভিক্ষাবৃত্তির মতো নিকৃষ্ট পেশাটি বেছে নিয়েছে অসংখ্য মানুষ, সেদেশেরই কিছু দূর্নীতিবাজ লুটেরা অপকর্মের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে তাদের পরিবারপরিজনকে দেশের টাকায় বিদেশে সেটেল্ড করছে; এবং দেশ থেকে অবৈধভাবে টাকা কামিয়ে অবৈধ উপায়েই সেসব পাঠিয়ে তাদের পরিজনকে আয়েসি, নিরাপদ ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করাচ্ছে! এদেশের চাষাভুষা খেটে-খাওয়া মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করে তা পাচার করছে তাদের নিজ পরিবারপরিজনকে নিরাপদে বিদেশে সুখে শান্তিতে রাখার মতো হীন কর্মটি করতে।
   
চিরন্তন উচ্চারণ, এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি— ভাব-সমপ্রসারণটি ছোটবেলায় বেশ মজা করে পড়তাম, এবং এ নিয়ে তখন পাতার পাতা লিখতেও পারতাম। আজ এর ভাব সম্প্রসারণ করতে গিয়ে প্রথমেই তুলে ধরছি  একটি কথা— মানুষের চাওয়া পাওয়ার কোন শেষ নেই, কারণ চাহিদা অপরিসীম; যে যত পায় সে তত আরও চায়। লক্ষ টাকা মাসিক বেতন পাওয়া একজন সরকারি আমলা ঘুষ খেয়ে কামায় কোটি টাকা, দশ হাজার টাকা মাসিক বেতন পাওয়া একজন কামলা বকশিস নামের বোঁঝা সাধারণের কাঁধে চাপিয়ে মাসে কামায় লক্ষ টাকা, আর অসৎ ব্যবসায়ীরা সবকিছুতে ভেজাল দিয়ে মানুষকে ঠকিয়ে সম্পদের পাহাড় বানিয়ে সেসব পাচার করে এবং করছে বিদেশে!  কি অদ্ভুত এদেশের এক শ্রেণীর লোকজনের মানসিকতা?     

এমন চাওয়া-পাওয়া কাদের? বর্তমানের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যারাই সম্পদশালী তারা হয়তো নেতা-নেত্রী, আমলা-কামলা বা অসৎ ব্যবসায়ী। সম্পদের প্রতি তাদের তৃষ্ণা প্রকট, দুর্নিবার ও অসীম। নির্বিচারে সম্পদ সংগ্রহের ফলে দেশের সব গরীবের সম্পদ তাদের হাতে চলে যাচ্ছে, গরিবেরা হচ্ছে  নিষ্পেষিত, আর মধ্যবিত্তরা হচ্ছে নিঃশেষিত। দরিদ্র কাঙ্গালেরা এক-দুই বেলা দুমুঠো  ভাত জোগাড় করতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, কোনমতে বেঁচে থাকার আশা পোষণ করতে গিয়ে যেখানে অন্ধকারের অতল গহব্বরে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, সেখানে ঐ শ্রেণীর লোকজন গড়ছে বিত্তবৈভবের  পাহাড়! দুর্ভাগ্য তাদের যারা সামান্য নুন-ভাতও অনেক সময় জোটাতে পারছে না। 

এমনতর অসমান অবস্থার জন্য কারও থাকছে ঐশ্বর্য্যের প্রাচুর্য আলোর আতশবাজী খেলা, আবার কারও ঘরে অন্ধকারে প্রদ্বীপ জ্বলছে না। যে ব্যক্তি একবেলা আহার যোগাড় করতে পারছে না, সে চায় জীবন ধারণের ন্যূনতম অন্ন টুকু, কিন্তু যার সব কিছু আছে তার তো কোন অভাব থাকতে পারে না? অথচ পৃথিবীর মানুষের চিরাচরিত স্বভাব চাই আর চাই! আমি দেখেছি যার ধন সম্পদের আর প্রয়োজন নেই, তার জীবনেই অভাববোধ সবচেয়ে বেশি এবং প্রকট। কথায় আছে না- রাজাই সব সময় প্রজার ধন সম্পদের অধিকারী হয়, ধনী দরিদ্রকে শোষণ করেই বড় হয়; এই বৈষম্যটি একটি নিষ্ঠুর জাগতিক সত্য বিষয়। লুব্ধ মানুষের বড় হবার নীতিই হলো দরিদ্রের সব কিছু জোর করে কেড়ে নিয়ে তাকে সর্বশান্ত করা, সব কিছু হতে বঞ্চিত করা। এর হিসেব কেউ রাখে না বা কেউ খবরের প্রয়োজনও বোধ করে না। লক্ষ্য করে দেখেছি লোভী মানুষের সংখ্যা সমাজে দিনদিন তুলনামূলক বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে; তারা যে কোন ভাবে যে কোন উপায়ে শুধু পরের ধন চুরি করে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার সমৃদ্ধি চায়। তারা অর্থসম্পদের মাঝে সুখ খোঁজে, আর সুখি হতে চায় বিত্তবৈভব দিয়ে।

আঙুল ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হওয়া ধনীরা গরীব ভুখা নাঙা মানুষের রক্ত শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে, এবং সদা সচেষ্ট; গরীবরা শোষিত,  বরং বলা উত্তম চিরশোষিত লাঞ্চিত। অনাহারী, নিরন্ন মানুষের ন্যূনতম সম্পদটুকুর প্রতিও ভয়াল থাবা প্রসারিত করতে এসব ঠকরা এতটুকুও কুণ্ঠিত হয় না! বিত্তবানদের এ অতৃপ্ত সর্বগ্রাসী প্রক্রিয়া সমাজের সর্বস্ব নিঃস্ব লোকদের বেঁচে থাকার স্পৃহাকে নিঃশেষ করে দেয়। ধন-সম্পদ উপরওয়ালার দান, যা ধনী-গরীব উভয় শ্রেণীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ; তবে নির্ধারিত। যারা তকদীর মানেন তাদের উচিৎ সন্তুষ্ট থাকা এবং সৎকর্ম চালিয়ে সবুর করা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণের জন্য কারোই অতিরিক্ত লোভ করা উচিত নয়। অবশ্যই যার যতটুকু সম্পদ প্রযোজন ঠিক তাকে ততটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা বাঞ্ছনীয়। কবরে কিন্তু কেউ সম্পদ নিয়ে যেতে পারেন না।  দুনিয়ার সম্পদ দুনিয়াতেই থেকে যায়। দুনিয়াতে কত ধনী হলো আর গেলো,কে তার খবর রেখেছে? কিন্তু হাজার হাজার বছর আগের না খেতে পাওয়া সক্রেটিসকে আজকের পৃথিবীবাসীরাও চেনে। তাই আফসোস করে কোন লাভ নেই।

চলতি বছর মার্চে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক অর্থপাচারবিরোধী সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) জানিয়েছিল গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা স্থানীয় মুদ্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানতের অর্থ নানা কৌশলে তারা বিদেশে পাচার করে সেখানে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ)-এর তথ্য অনুযায়ী বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই এদেশে  বেশি টাকা পাচার হয়। নানা পন্থায় বিদেশে টাকা পাচার করে এক শ্রেণীর লোকজন প্রবাসে বাড়ি-গাড়ি ও স্থায়ী সম্পদের মালিক হয়; আর এ অভিযোগ এদেশের রাজনৈতিক নেতা আমলা আর ব্যবসায়ীদের  বিরুদ্ধে; সুখের আশায় কত কিই না করছে তারা, বাঁধছে বাসা দ্বীপান্তরে!

ইদানীংকালের নিউজফিডে প্রতিনিয়ত এমনতর সব ছেঁচড়া বড়লোকের আমিত্বের খবর ভেসে উঠছে যা কল্পনাতীত। যখনই সেসব আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বা তালগাছ হওয়া কোটিপতির কোন খবর দেখি, চমকে যাই এবং মনে পড়ে মধ্যযুগীয় বাংলা কবি (যাঁর জন্ম ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দ, যিনি ষোল শতকের পদাবলী সাহিত্যের একজন সেরা কবি ছিলেন) কবি জ্ঞানদাস-এর বৈষ্ণবপদাবলীর অমর সেই কথাগুলো, যা এ লেখার সূচনাতেই তুলে ধরেছি। অমর এ গীতিকবিতাটি কেউ বুঝতে পাড়লে তার জীবনে 'সুখ' নিয়ে আর কোন জ্ঞানের প্রয়োজন পরবে বলে আমি মনে করি না। 

সুখ আসলে কি? কোথায়, কোনখানে আছে সুখ??- সুখের আভিধানিক অর্থ হলো— পরিতোষ, প্রেম, পূর্ণতা, পুলক, উল্লাস, আহ্লাদ ইত্যাদির এক বা একাধিক বা সম্মিলিত অনুভুতি; যা একান্তই একটি মানবিক ব্যাপার, সাময়িক অনুভূতি। সুখ মনের একটি অবস্থা বা অনুভূতি যা ভালোবাসা, তৃপ্তি, আনন্দ বা উচ্ছ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সত্য ও সুন্দর দ্বারা  প্রস্ফুটিত। জৈবিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক, দর্শনভিত্তিক এবং ধার্মিক দিক থেকে সুখের সংজ্ঞা নির্ধারণ ও নিরূপণ এবং এর উৎস নির্ণয়ের প্রচেষ্টা সাধিত হয়েছে এবং হয়। সঠিকতার মাপযন্ত্রে সুখকে পরিমাপ করা এবং নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন। 

অবশ্য এ ব্যাপারে গবেষকেরা একটি কৌশল উদ্ভাবন করেছেন, যা দিয়ে সুখের পরিমাপ কিছুটা হলেও করা যায় বা সম্ভব; মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা তাত্ত্বিক মডেলের ভিত্তিতে সুখকে পরিমাপ করে থাকেন। এই মডেলে সুখকে ইতিবাচক কর্ম ও আবেগ সমূহের সমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া এক্ষেত্রে তিনটি বিশেষ অবস্থাকেও বিবেচনা করা হয়: আনন্দ, অঙ্গীকার এবং অর্থ। গবেষকগণ এমন  কিছু বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করেছেন যেগুলো সুখের সাথে পারস্পরিকভাবে সম্পর্কযুক্ত: বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্ক, বহির্মুখী বা অন্তর্মুখী অবস্থা, বৈবাহিক অবস্থা, স্বাস্থ্য, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা, আশাবাদ, ধর্মীয় সম্পৃক্ততা, আয় এবং অন্যান্য সুখী মানুষের সাথে নৈকট্য। 

প্রত্যেক সমাজেই ধনী, গরিব, সুখী, অসুখী বিভিন্ন ধাঁচের মানুষের বসবাস। তবে বর্তমান পৃথিবীতে প্রকৃত সুখী মানুষ খুঁজে পাওয়া সোনার পাথর বাটির মতো। সকলেই কি সুখী হতে পারে?- কখনো না। তবে, একটি কথা চিরসত্য— সুখী হতে পয়সা লাগে না। নিজের সততা এবং ইচ্ছা থাকলেই হয়; অবশ্যই সুখী হওয়া যায়, এবং তা খুব বেশি কঠিন নয়, সম্ভব। নিজের যতটুকু আছে, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকলে, আনন্দ খুঁজে পেলে সুখী হওয়া তেমন কঠিন কিছু নয়। চাহিদা ও যোগানের সামাঞ্জস্য করতে পারলে অসুখী হওয়ার কোন আর অবকাশ থাকবে না। তবে, সুখ একটি আপেক্ষিক ব্যাপার; এ নিয়ে মতের ভিন্নতা থাকবেই। তবে মনে রাখতে হবে, ধনবান ব্যক্তি হলেই কেবল সুখী হওয়া যায় না যাবে না, এমনটি কখনও হয় না; আত্মতুষ্টি নিয়ে ছোট্ট কুটিরে বা রাস্তায় ঘুমিয়েও সুখ লাভ করা যায়, যা অতৃপ্তে প্রাসাদেও মেলে না।

দর্শনশাস্ত্র এবং ধর্মীয় চিন্তাবিদরা প্রায়ই আবেগের পরিবর্তে একটি ভালো জীবন বা সমৃদ্ধশালী জীবনধারণের ক্ষেত্রকে সুখ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেন। এই অর্থে সুখকে অনুবাদ করার জন্য গ্রিক eudaimonia ব্যবহৃত হতো, এবং এখনও নৈতিকতার নীতিতে তা ব্যবহার করা হয়। সময়ের সাথে সাথে একটি পরিবর্তন হয়েছে যেখানে গুনের সাথে সুখের সম্পর্কের চেয়ে সুখের সাথে গুনের সম্পর্কের উপর বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। সহস্রাব্দ ঘুরে আসার পর থেকে, বিশেষ করে অমর্ত্য সেনের মানবিক বিকাশের পদ্ধতিটি উন্নত হয়েছে তার ফলে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের উপর আগ্রহ বেড়ে গেছে। বিশেষত মার্টিন সেলিগম্যান, এড ডায়নার এবং রুউৎ ভেনহোভেনের কাজ, এবং পল আনন্দ এর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং চিকিৎসা গবেষণায় ব্যাপক অবদানের ফলে এই বিষয়ের গুরুত্ব বেড়ে যায়।

১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থমাস জেফারসন দ্বারা লিখিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি ব্যাপকভাবে আলোচিত রাজনৈতিক মূল্যবোধ ছিল; কারণ তিনি উল্লেখ করেছিলেন, 'সুখের অনুধাবন করা' একটি সার্বজনীন অধিকার। মনে হচ্ছে এটি একটি বিষয়ভিত্তিক ব্যাখ্যা করার কথা বলে তারপরেও তা একাই আবেগ অতিক্রম করে। আসলে, এই আলোচনাটি প্রায়শঃই সহজ ধারণার উপর ভিত্তি করে চলছে; সুখ শব্দটি একই জিনিস বোঝায় যা ১৯৭৬ সালে ছিল এবং আজও তাই আছে। প্রকৃতপক্ষে, অষ্টাদশ শতকে সুখ বলতে বুঝাতো— সমৃদ্ধি, উন্নতি এবং সুস্থতা।

আজকাল সুখ একটি ঝাপসা ধারণা এবং ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাছে এর অর্থ ভিন্ন মনে হতে পারে। সুখের বিজ্ঞান একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো— সুখ নিয়ে বিভিন্ন ধারণা চিহ্নিত করা এবং যেখানে প্রযোজ্য সেই অনুযায়ী তাদের উপাদানগুলোকে বিভক্ত করা। প্রাসঙ্গিক ধারণাগুলো হচ্ছে সুস্থতা, জীবনের মান এবং সমৃদ্ধি। নিদেনপক্ষে একজন হলেও লেখক সুখকে তুষ্টি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কিছু ভাষ্যকার আনন্দবাদী ঐতিহ্যের মাধ্যমে সুখকে অনুসন্ধান এবং অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতাগুলোকে অবজ্ঞা করার মাধ্যমে ইউডামোনিক উপায়ে জীবনকে পুরোপুরি এবং গভীরভাবে ও পরিতৃপ্তির সাথে উপভোগ করার উপর বেশি জোর দেন।

২০১২ সালের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ব্যক্তিগত কল্যাণমূলক পদক্ষেপে, প্রাথমিক বিশুদ্ধতম জীবনের মূল্যায়ন এবং মানসিক প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা। সুখকে উভয় জীবন মূল্যায়নে ব্যবহার করা হয়, যেমন— মোটের উপর আপনি আপনার জীবনে কতটা সুখী? এবং মানসিক প্রতিবেদনে— এখন আপনি কতটা সুখী?- লোকজন এই ধরনের মৌখিক contexts-এ সুখকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করতে পারে বলে মনে হয়। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস প্রতিবেদনগুলো এই পরিমাপ পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে সুখের সর্বোচ্চ স্তরের দেশগুলোকে চিহ্নিত করে থাকেন।

১৯৬০-এর দশক থেকে গ্যারান্টোলজি, সামাজিক মনোবিজ্ঞান, ক্লিনিক্যাল এবং মেডিক্যাল গবেষণা এবং সুখ অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক শাখায় সুখ নিয়ে গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। বিগত দুই দশক ধরে, বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্র ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে এবং বিভিন্ন মতামতের উপর ভিত্তি করে সুখের কারণগুলো এবং যে বিষয়গুলোর সাথে সুখের আন্তঃসম্পর্ক আছে সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সুখের ধারণাকে উন্নত করার জন্যে অনেক স্বল্পমেয়াদী স্ব-উদ্যোগের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ব্যাপক অর্থে সুখ হলো একটি পরিবারের জন্য আনন্দদায়ক একটি অবস্থা, যেমন— আনন্দ, পরিতৃপ্তি, সন্তুষ্টি, উষ্ণতা এবং জয়লাভ। 

উদাহরণস্বরূপ, সুখ মূলতঃ অপ্রত্যাশিত ইতিবাচক ঘটনাগুলোর মাধ্যমে, অন্যদের দেখার মাধ্যমে, এবং অন্যদের প্রশংসা করা এবং গ্রহণ করা থেকে আসে। আরও সংকীর্ণভাবে, এটি পরীক্ষামূলক এবং মূল্যায়নযোগ্য সুখের কথা উল্লেখ করে। 
অভিজ্ঞতাগত সুখ, বা বিষয়গত সুখ, প্রশ্নের মাধ্যমে যাচাই করা হয়; যেমন— এখন আপনার অভিজ্ঞতাটি কতটুকু ভাল বা মন্দ? পক্ষান্তরে, মূল্যায়ন করার মত সুখ নিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা যায়, যেমন— আপনার অবকাশ কতটা ভাল ছিল? এবং অতীত সুখ সম্পর্কে একজন ব্যক্তির বিষয়ভিত্তিক চিন্তা এবং অনুভূতিগুলো পরিমাপ করার চেষ্টা করা। 

পরীক্ষামূলক সুখ কম ত্রুটিপূর্ণ যা মেমোরির মাধ্যমে পুনরুৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু সুখের উপর ভিত্তি করে লেখা বেশিরভাগ সাহিত্য মূল্যায়নের সুফলকে বোঝায়। হিরোস্টিকস দ্বারা সুখ পরিমাপের সাথে দুইটি বিষয় জড়িত থাকতে পারে, যেমন— peak-end rule এর কথা বলা যেতে পারে। সুখ পুরোপুরি বহিরাগত বিষয় নয়, এমনকি মুহূর্তের আনন্দ থেকেও তা প্রাপ্ত হয় না। প্রকৃতপক্ষে, প্রচলিত ধারণায় সুখ দ্রুতগামী বলা সত্ত্বেও গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, সময়ের সাথে সাথে সুখ স্থিতিশীল হয়। সুখ আংশিকভাবে জিনগত। যমজ গবেষণা করে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, মানুষের সুখ স্তরের ৫০ শতাংশ জিনগতভাবে নির্ধারিত হয়, ১০ শতাংশ জীবনের চলমান পরিস্থিতি এবং অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ সুখ আত্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়।

এ্যাক্রোনিম পিইআরএমএ সুখের সাথে সম্পর্কযুক্ত পাঁচটি বিষয়কে সংক্ষেপ করে এভাবে—
১. আনন্দ (সুস্বাদু খাদ্য, উষ্ণ বাথ, ইত্যাদি), 
২. যোগদান (বা প্রবাহ, একটি উপভোগ্য কার্যকলাপ যা এখনো চ্যালেঞ্জিং পর্যায়ে আছে), 
৩. সম্পর্ক (সামাজিক সম্পর্ককে সুখের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য নির্দেশক বলা যায় ), 
৪. অর্থ (একটি অনুভূতির খোঁজ করা বা বড় কিছুর সাথে সম্পর্কিত), এবং 
৫. অর্জন (বাস্তব লক্ষ্য উপলব্ধি করা)।
এবং বিশেষ করে পিতা-মাতার সাথে সম্পর্কযুক্ত ভালোবাসার ক্ষমতা এবং পারষ্পরিক সংযুক্তি যা মানুষের জীবনে সুখের একটি দৃঢ় অবস্থার কথা বলে।
মস্তিষ্কের বামদিকের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের উচ্চ কার্যকলাপের দিকে লক্ষ্য করে বুঝা যায় যে এই অংশটির সাথে মানুষের সুখানুভূতির আন্তঃসম্পর্ক আছে।

এটিও যুক্তিযুক্ত করা হয়েছে যে, টাকার মাধ্যমে কার্যকরভাবে সুখ কিনতে পারা যায় না, যদি না একে সুনির্দিষ্ট উপায়ে ব্যবহার করা হয়। এটি ছাড়াও যে ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ আছে যার মাধ্যমে তারা সহজেই খাবার কিনতে পারে, নতুন কাপড় পরিধান এবং ঘর বাড়ি বানাতে পারে - এমনকি অনেক লোকের বেশি অর্থ আছে যা তাদের সামান্য সুখী করতে পারে। অন্যদের জন্য অর্থ ব্যয় করে সত্যিই আমরা অনেক সুখ অনুভব করি; কিন্তু নিজেদের জন্য ব্যয় করলে ততটা সুখ করি না।

ধর্ম কীভাবে সুখের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা নিয়ে কিছু গবেষণা করা হয়েছে। সাধারণ সম্পর্ক অস্পষ্ট, কিন্তু ধর্মের মধ্যে মানুষকে বেশি সুখী হতে দেখা যায়। PERMA-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, ধর্ম নিজের চেয়ে আরও ব্যাপক অর্থবোধক এবং সংযোগের অনুভূতি প্রদান করতে পারে। ধর্ম মানুষকে সাম্প্রদায়িক সদস্যপদ দিতে পারে, যা সাধারণ সম্পর্ক থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী। অন্য একটি উপাদান এর কথা বলা যায় যা রীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

মাসলো চাহিদার অনুক্রমের একটি পিরামিড অঙ্কন করেছেন— যা মানবিক চাহিদা, মানসিক এবং শারীরিক মাত্রার চিত্র তুলে ধরে। যখন একজন মানুষ পিরামিডের ধাপে উঠবে, সে আত্মতৃপ্তির চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছবে। প্রয়োজন পূরণের রুটিনের বাহিরে, Maslow অসাধারণ অভিজ্ঞতার মুহূর্তের কথা বলেছেন যা চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা হিসাবে পরিচিত। তাছাড়া প্রেমের গভীর মুহূর্ত, বোঝা, সুখ বা পরমানন্দ, যার ফলে একজন ব্যক্তি অনুভব করে আরও পুরো, জীবিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং নিজেকে বিশ্বের একটি অংশ হিসেবে অনুভব করে। এটি মিহালি সিস্কসজেন্টমিহালি প্রবাহ ধারণার অনুরূপ।

স্ব-সংকল্প তত্ত্ব তিনটি চাহিদার সাথে সম্পর্কিত: দক্ষতা, স্বায়ত্তশাসন এবং সংশ্লিষ্টতা।

বিশ্বব্যাপী ক্রস বিভাগীয় গবেষণাগুলো সুখের সাথে ফল এবং শাক-সবজি খাওয়ার একটি সম্পর্ককে সমর্থন করে। প্রতিদিন ফল এবং শাক-সবজি খাওয়াকে 'খুব খুশি' হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। তারা মনে করেন ফল এবং শাক-সবজি খাওয়া ও সুখের মধ্যে একটি শক্তিশালী এবং ইতিবাচক পারস্পরিক সম্পর্ক আছে। দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, চিলি, ইউএসএ বা ইউকে-তে ব্যাপক হারে ফল এবং উদ্ভিজ্জ ব্যবহারে অধিক সুখের সাথে ইতিবাচক সহযোগিতা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ধূমপান, ব্যায়াম, বডি মাস ইনডেক্স এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয়গুলোও সুখের সাথে জড়িত।

Layard এবং অন্যান্যরা দেখান যে, সুখের উপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে মানসিক স্বাস্থ্য। ব্রাহ্মকুমারী রাজা যোগ ব্যায়ামে ধ্যানকারীদের উপর অক্সফোর্ডের সুখের প্রশ্নাবলী ব্যবহার করে একটি গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রিত গ্রুপের চেয়ে অনিয়ন্ত্রিত গ্রুপের লোকেরা বেশি সুখী। Yongey Mingyur Rinpoche বলেছেন যে— স্নায়ু বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় লক্ষ্য করেছেন ধ্যানের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার সুখের বেসলাইন পরিবর্তন করতে পারেন।

ধর্ম এবং সুখ নিয়ে অনেক গবেষক গবেষণা করেছেন এবং গবেষণা হয়েছে। ধর্মীয় বিষয় সুখের উপাদান হিসাবে অনেক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করে, যা ইতিবাচক মনোবিজ্ঞান দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। সুখের সাথে সংগঠিত ধর্মের সামাজিক সংযোগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে; প্রার্থনা এবং বিশ্বাস দ্বারা স্নায়বিক সুবিধা লাভ করা যায় অনেক বেশি।

এমন অনেক বিষয় আছে যা দ্বারা ধর্ম একজন ব্যক্তিকে নেক ও সুখী করতে পারে; এমনকি সামাজিক যোগাযোগ এবং সমর্থন যা ধর্মীয় pursuits থেকে যা পাওয়া যায়। তাছাড়া মানসিক কার্যকলাপ, যা আশাবাদ এবং স্বেচ্ছাসেবী বিষয়ের সঙ্গে জড়িত, কি কৌশলের মাধ্যমে মানসিক চাপ মোকাবেলা করা যাবে এবং এর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাবে। এটাও হতে পারে যে ধার্মিক লোকেরা ভাল স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আচরণ, যেমন— পদার্থের কম অপব্যবহার করে; যেহেতু মনস্তাত্ত্বিক পদার্থের ব্যবহারকে কখনও কখনও অপব্যবহার বলে মনে করা হয়। The Handbook of Religion and Health-এ Feigelman (১৯৯২) দ্বারা পরিচালিত একটি জরিপের বর্ণনা দিয়েছে যে, যারা ধর্মকে ছেড়ে দিয়েছে এমন আমেরিকানদের মধ্যে সুখ নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে, সেখানে এটি পাওয়া গেছে যে, ধর্মীয় অধিভুক্তি বাতিল ও অসুখের মধ্যে সামান্য সম্পর্ক রয়েছে। 

কসমিন ও লচম্যান (১৯৯৩) তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ধর্মের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের তুলনায় যাদের ধর্মের সাথে কোন সম্বন্ধ নেই তাদের বিষণ্ণতা উপসর্গের ঝুঁকি µ অনেক বেশি। ১৪৭ টি স্বাধীন তদন্তকারীর গবেষণায় দেখা গেছে— ধর্মীয়বোধ এবং বিষণ্নতাগত উপসর্গগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল -০.০৯৬; যা ইঙ্গিত দেয় যে, বৃহত্তর ধর্মীয়বোধ হালকাভাবে কম উপসর্গের সাথে জড়িত।

ল্যাজাটুম প্রসপারিটি ইনডেক্স সুখের বিজ্ঞান নিয়ে যে গবেষণা পরিচালনা করেছে সেই গবেষণায় এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, ধর্মীয় সংযুক্তি ও সুখের সাথে একটি ইতিবাচক লিংক আছে; তারা এই রিপোর্ট করে যে, যাদের জীবনে ঈশ্বর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তারা তাদের জীবনে অনেক বেশি সন্তুষ্ট থাকে, তাদের আয়, বয়স এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য হিসাব করার পরও। 

গালাপের জরিপ, জাতীয় মতামত গবেষণা কেন্দ্র এবং প্যা অর্গানাইজেশন এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে, আধ্যাত্মিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ব্যক্তিরা অন্তত ধর্মীয়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ব্যক্তিদের তুলনায় 'খুব খুশি' হওয়ার রিপোর্টের দ্বিগুণ। ২০০ টিরও বেশি সামাজিক গবেষণার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, উচ্চ ধার্মিকতা— বিষণ্ণতা এবং মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং আত্মহত্যার ঝুঁকির পরিমাণ কমিয়ে দেয়, শুধু তাই নয় যৌন জীবন এবং সন্তুষ্টির দিক থেকেও তারা অনেক এগিয়ে। তবে ধর্ম এবং সুখের মধ্যে সম্পর্ক ধর্মগ্রন্থের উপর সর্বদা নির্ভরশীল। 

ধর্ম এবং যন্ত্রণা এর মধ্যে অনেক বড় সংযোগ রয়েছে (লিঙ্কন ১০৩৪); এবং ৪৯৮ টি সমীক্ষা পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণা পর্যালোচনা করে উপসংহারে এসেছেন যে, একটি ইতিবাচক পারস্পরিক সম্পর্ক দেখিয়েছে বড় সংখ্যার ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি সাথে অনুভূত সুখ এবং আত্মসম্মান এবং নিম্ন রক্তচাপ, বিষণ্ণতা, এবং ক্লিনিক্যাল কর্তব্যে অবহেলার বিষয় গুলো জড়িত। 

১৯৯০ থেকে ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত ৩৪ টি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধার্মিকতার মানসিক সমন্বয়ের সাথে একটি ভাল সম্পর্ক রয়েছে, কম মানসিক অসুস্থতা, আরও বেশি জীবন নিয়ে সন্তুষ্টি এবং ভাল আত্ম-তুষ্টি লক্ষ্য করা গেছে। অবশেষে, ৮৫০টি গবেষণাপত্রের একটি সাম্প্রতিক পদ্ধতিগত পর্যালোচনা করে এই উপসংহারে এসেছিল যে— বেশিরভাগ সুশৃঙ্খল গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, উচ্চ মাত্রায় ধর্মীয় সম্পৃক্ততার সাথে ইতিবাচকভাবে মনস্তাত্ত্বিক সুখের সূচক (জীবন সন্তুষ্টি, সুখ, ইতিবাচক প্রভাব, এবং উচ্চতর মনোবল) এবং কম বিষণ্ণতা, আত্মঘাতী চিন্তা ও আচরণ, ড্রাগস বা অ্যালকোহল এর ব্যবহার ও অপব্যবহারসহ বিষয়গুলো সম্পৃক্ত। 

যাইহোক, পণ্ডিতদের মধ্যে দৃঢ় মতবিরোধ রয়েছে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রভাব বিশেষ করে গির্জায় যোগদান বা অন্যথায় ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্তর্গত হওয়া, আধ্যাত্মিক বা সামাজিক দিকগুলোর কারণে মানুষ সুখী হতে পারে কিনা এই সব বিষয় নিয়ে। যারা গির্জা বা অনুরূপ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত তারা শুধুমাত্র সামাজিক সংযোগের প্রভাবে প্রভাবিত হতে পারে। এই সুবিধাগুলোই যথেষ্ট, যা তারা একই বা অন্য ধর্ম নিরপেক্ষ দল, ক্লাব বা অনুরূপ সংস্থাগুলোতে যোগদান করে লাভ করতে পারে।

ইসলামে— ৫০% সুখকে 'রিদাহ বাই আল-কাদাহ' বলা হয় (ভাগ্যে যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা)। এর অর্থ হলো— ইমানদার হওয়া। যদি আমরা সত্যিই আল্লাহকে ভালোবাসি এবং তাঁর উপরে নির্ভর করি, আমাদের জন্য তিনি যা আদেশ করেছেন তা নিয়ে যেন আমরা অবশ্যই সন্তুষ্ট থাকি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ভাগ্য নিয়ে অনেক কথা বলেছেন এবং সন্তুষ্টির গুরুত্বও তুলে ধরেছেন। অতএব, আমাদের মুসলমানদের ওইসব  অনুরোধগুলো অবশ্যই পড়ার প্রচেষ্টা চালানো উচিত— 'আমি আল্লাহকে আমার পালনকর্তা হিসাবে পেয়ে খুশি হয়েছি, আমার ধর্ম হিসাবে ইসলামের সাথে এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আমার নবী হিসাবে পেয়ে  [সহীহ্ আবু দাউদ]।' 'হে আল্লাহ্‌, আমাকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করে দিন, আমার জন্য আশীর্বাদ পাঠান, এবং আমার জন্য প্রত্যেকটি অনুপস্থিত জিনিসের মধ্য দিয়ে ভাল কিছু রাখুন [সহীহ্ বুখারী]।'

বৌদ্ধধর্ম মতে— সুখ হচ্ছে বৌদ্ধ শিক্ষার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় । দুঃখকষ্ট থেকে চূড়ান্ত স্বাধীনতা লাভের জন্য নোবেল আটটি পথ তার অনুশীলনকারীদেরকে নির্বান লাভের স্তরে নিয়ে যায়, যাকে বলা হয় চির সুখের একটি স্থান। পরম সুখ শুধুমাত্র অর্জিত হবে তখন, যখন চাওয়া পাওয়াকে কেউ অতিক্রম করতে পারবে। সম্পদ অর্জন এবং ভালো বন্ধুত্ব বজায় রাখার মধ্যেও জাগতিক সুখের সন্ধান পাওয়া যায়, যা মানুষের জন্য যোগ্য লক্ষ্য হিসেবে স্বীকৃত। বৌদ্ধ ধর্ম সমবেদনা, সমস্ত মানুষের সুখ এবং কল্যাণের জন্য উৎসাহ দেয়।

ইহুদীধর্ম মতে— সুখ বা সিম্ছাকে  ঈশ্বরের সেবায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাইবেলের গসপেল 'সুখের সাথে পালনকর্তার পূজা করা, আনন্দের গান নিয়ে তাঁর সামনে আসা (গীতসংহিতা ১০০: ২)'। ঈশ্বরের সেবা আনন্দের উপর জোর দেয়। ঊনবিংশ শতকের রাব্বি নাচম্যান ব্রেসলভ দ্বারা একটি জনপ্রিয় শিক্ষা চাছিদিক রাব্বি, 'মিৎস্ভা গেদোলাহ লাহিয়ত বাসিমচা তামিড'—এটি একটি মহান মিৎস্ভা (আজ্ঞা) সব সময় ভাল থাকার একটি পর্যায়। যখন একজন ব্যক্তি সুখী থাকে, তখন তারা ঈশ্বরকে সেবা করার এবং বিষণ্ণ বা বিরক্তির চেয়ে তাদের দৈনিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে আরও বেশি সক্ষম হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় সুখের প্রধান অর্থ সৌভাগ্য, সুযোগ বা যা ঘটছে। 
গ্রিক দর্শনে প্রাথমিকভাবে এটি নৈতিকতা অর্থে বোঝায়। 

ক্যাথলিকবাদে— মানুষের অস্তিত্বের চূড়ান্ত বিষয়টি গ্রীক ইউদাইমনিয়ার সমতুল্য বা 'আশীর্বাদপূর্ণ সুখ'; যা ত্রয়োদশ শতাব্দীর দার্শনিক-ধর্মতত্ত্ববিদ টমাস অ্যাকুইনাসের ঈশ্বরীয় উপায়ে একটি বিস্ময়কর দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মানুষের জটিলতাগুলো, যেমন— কারণ এবং চেতনা, যা সুস্থতা বা সুখ উৎপাদন করতে পারে; কিন্তু এই ধরনের ফর্ম সীমিত এবং ক্ষণস্থায়ী। আক্ষরিক জীবনের মধ্যে ঈশ্বরের চিন্তা, অসীম সুন্দর এবং ইচ্ছার সর্বোচ্চ বাস্তবায়নজনিত বিষয়গুলো জড়িত থাকে। Beatitudo বা সম্পূর্ণ সুখ বলতে যা বুঝায় তা এই জীবনে অর্জন করা যাবেনা, কিন্তু পরবর্তী জীবনে তা অবশ্যই সম্ভব।

যদিও ধর্ম প্রায়ই আনুষ্ঠানিক এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক, কিন্তু আধ্যাত্মিকতা পৃথক হয়ে থাকে, যা অনানুষ্ঠানিকভাবে হিসাবে চর্চা করা হয়। ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় পাবলিক এবং প্রাইভেট স্কুল উভয় ক্ষেত্রেই ৮-১২ বছর বয়সী শিশুদের ৩২০ জনকে আধ্যাত্মিক সুস্বাস্থ্য সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা ও সুখের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক মূল্যায়ণ করা হয়েছে। আধ্যাত্মিকতা— যা ধর্মীয় চর্চা নয় (প্রার্থনা, গির্জা সেবা ,যোগদান)। ছেলেমেয়েদের মধ্যে সুখের ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে যে, যারা যত বেশি আধ্যাত্মিক ছিল তারা তত বেশি সুখী ছিল। আধ্যাত্মিকতা থেকে প্রাপ্ত সুখের মধ্যে প্রায় ৩-২৬% ভিন্নতার জন্য দায়ী।

২৩০০ বছর আগে চীনের কনফুসিয়ান চিন্তক মেনসিউস যুদ্ধ জড়িত নির্দয় রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ দিতে চেয়েছিলেন, তিনি মনে করেছিলেন যে—ক্ষুদ্র স্বার্থ (শারীরবৃত্তীয় স্বার্থ) এবং বৃহত্তর স্বার্থ (নৈতিক স্বার্থ )-র মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালন করেছিল যা ঋষি হুড পর্যন্ত পৌঁছতে সাহায্য করবে বলে তিনি দাবী করেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, যদি আমরা ন্যায়পরায়ণ কাজ ও প্রাণবন্ত শক্তি দিয়ে কাউকে পুষ্ট করার জন্য সন্তুষ্টি বা পরিতোষ অনুভব না করি, তবে সেই শক্তি কুচকিয়ে যাবে (মেনেসিয়াস, ৬এ:১৫ ২এ: ২)। আরও বিশেষভাবে, তিনি বিশেষ করে সংগীতের মাধ্যমে মহান গুণাবলীগুলোর অনুশীলনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ)(১০৫৮-১১১১) একজন জগৎবিখ্যাত মুসলিম সূফী চিন্তাবিদ; Alchemy of Happiness লিখে তিনি সুখের ভিত্তি দাঁড় করিয়ে গেছেন, যা বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব জুড়ে ব্যাপকভাবে সমাদৃত এবং প্রচলিত।

যোগসূত্রের লেখক হিন্দু চিন্তাবিদ পতঞ্জলি সুখের মনোবৈজ্ঞানিক ও আণবিক শক্তির উপর লিখে গেছেন।

৩৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে লিখিত Nicomachean Ethics-এ অ্যারিস্টেটল বলেন যে, সুখ (ভাল হওয়া এবং ভাল কাজ করা বুঝায়); সুখ হলো একমাত্র জিনিস যা মানুষ নিজের জন্য কামনা করে এবং যা ধন, সম্মান, স্বাস্থ্য বা বন্ধুত্বের মতো নয়। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, মানুষ শুধুমাত্র নিজের জন্য নয় বরং সুখী হওয়ার জন্য ধন, সম্মান বা স্বাস্থ্যের সন্ধান করে। উল্লেখ্য, আমরা ইউডাইমোনিয়া শব্দটিকে 'সুখ' হিসাবে অনুবাদ করি, যাকে অ্যারিস্টেটল আবেগ বা একটি অবস্থার পরিবর্তে একটি কার্যকলাপ হিসেবে দেখেছিলেন। 

এভাবে বোঝা যায় যে, সুখী জীবন হলো ভালো জীবন; অর্থাৎ এমন একটি জীবন যার মধ্যে একটি মানুষ অপর একটি মানুষের প্রকৃতিকে একটি চমৎকার উপায়ে উদযাপন করে। বিশেষতঃ অ্যারিস্টেটল যুক্তি দেন যে, ভাল জীবন হচ্ছে চমৎকার যুক্তিপূর্ণ কার্যকলাপের মাধ্যমে অতিবাহিত জীবন। তিনি ফাংশন আর্গুমেন্টের মাধ্যমে এই দাবি উত্থাপন করেছিলেন। মূলতঃ যদি এটি সঠিক হয়— প্রতিটি জীবন্ত জিনিসের একটি ফাংশন আছে, যা অনন্য উপায়ে কাজ পরিচালনা করে। চমৎকার যুক্তিপূর্ণ কার্যকলাপের মাধ্যমে পরিচালিত জীবনই হলো সুখী জীবন; অ্যারিস্টেটল এটা বলাও ছেড়ে দেননি। কারণ, তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে— চমৎকার যুক্তিপূর্ণ কার্যকলাপে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ জীবন রয়েছে। এই দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ জীবন হলো নৈতিক গুণাবলীর জীবন।

অনেক নৈতিকতাবাদি যুক্তি দিয়েছেন সুখের আচরণের উপর ভিত্তি করে পৃথকভাবে বা যৌথভাবে কিভাবে মানুষের আচরণ করা উচিত তা নিয়ে। ইউটিলিটেরিয়নরা, যেমন— জন স্টুয়ার্ট মিল এবং জেরেমি বেন্থহ্যাম নৈতিক আচরণের পথ নির্দেশনা হিসাবে সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ নীতির কথা বলেছিলেন। ফ্রেডরিখ নয়েৎশে সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ অর্জন নিয়ে ইংরেজি উটিলিটিরিয়ান ফোকাসের নিন্দা করে বলেন, মানুষ সুখের জন্য সংগ্রাম করে না, শুধু ইংরেজরাই করে। নয়েৎশে মনে করেছিলেন যে, সুখ মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য, মানুষের অস্তিত্বের লক্ষ্য, যা মানুষকে নীচ করে তোলে; নয়েৎশ এর পরিবর্তে একটি সংস্কৃতির জন্য আকাঙ্ক্ষিত, যা নিখুঁত সুখ প্রতিষ্ঠিত করবে। সেন্ট অগাস্টিন এবং টমাস অ্যাকুইনাসের মতে, শেষের সুখটিই হল আসল সুখ— সমস্ত মানুষ শেষ প্রান্তের আশা করতে সম্মত হয়, যা প্রকৃত সুখ।

যাইহোক, সুবিধার জন্য প্রাথমিক সরঞ্জাম হিসাবে পরিণামের ফলাফলের ভিত্তিতে যুক্তিবাদী ব্যক্তিরা অ্যাকুইনাস এবংং অ্যারিস্টেটলের সাথে একমত হন যে, সুখ কেবল কাজের পরিণতি নিয়ে যুক্তিযুক্তভাবেই পৌঁছতে পারে না, তবে কার্যের জন্য ভালো কারণগুলোর অনুসরণ করারও প্রয়োজন হয়, যেমন— নৈতিকতা অনুযায়ী অভ্যাস; অভ্যাস এবং কাজ যা সাধারণত সুখের দিকে পরিচালিত হয়। অ্যাকুইনাসের মতে যা আইন অনুসারে সৃষ্ট, যেমন— প্রাকৃতিক আইন এবং ঐশ্বরিক আইন। অ্যাকুইনাস এর মত অনুযায়ী এই আইনগুলো প্রথম কারণ দ্বারা সৃষ্ট, বা ঈশ্বর দ্বারা।

অ্যাকুইনাসের মতে— সুখ একটি ফটকামূলক বুদ্ধিমত্তার অপারেশন নিয়ে গঠিত হয়; ফলস্বরূপ সুখ সাধারণত এমন একটি অপারেশন নিয়ে গঠিত যা ঐশ্বরিক বিষয়ের সাথে জড়িত এবং শেষ প্রয়াস সক্রিয় জীবন যাপন করতে পারে না, যা বাস্তবিক বুদ্ধি সম্পর্কিত।

সাধারণ বাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেমন জিডিপি এবং জিএনপি হিসাবে সফল নীতির পরিমাপ হিসাবে ব্যবহার করা হয় এবং হয়েছে; গড় ধনী দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোর তুলনায় বেশি সুখী হয়। তাই এই প্রভাবটি ধন-সম্পদের সাথে কিছুটা  সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়। এটি দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, নির্ভরশীলতা লিনিয়ার নয় তবে লগারিদমিক; অর্থাৎ,জিএনপিতে একই শতাংশ বৃদ্ধি দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ধনী দেশে সুখ বৃদ্ধি করে। ক্রমবর্ধমানভাবে, একাডেমিক অর্থনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলি বহু-মাত্রিক ড্যাশবোর্ডের জন্য বাদানুবাদ করছে এবং বিকাশ করছে যা মানবীয় কল্যাণের আরও সরাসরি ও সুস্পষ্ট মূল্যায়ন প্রদানের জন্য ব্যক্তিগত ও উদ্দেশ্য সূচককে একত্রিত করা যায় কিনা। পল আনান্দ এবং তার সহকর্মীদের দ্বারা এই বিষয়টিকে তুলে ধরতে সহায়তা করে যে, সুখের প্রতিফলন ঘটেছে সুখের পরিপ্রেক্ষিতে অংশীদারত্বের দিক থেকে, যেমন— প্রধান সীমাবদ্ধতার উপস্থিতি এবং সেই ন্যায্যতা, স্বায়ত্তশাসন, সম্প্রদায় এবং অংশগ্রহণগুলো সুখ ও সুখের প্রধান দিক, যা সারাজীবন জুড়ে পরিচালিত হয়।

উদারপন্থী চিন্তাবিদ কাটো ইন্সটিটিউট দাবি করেন যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সুস্পষ্টভাবে সুখের সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রাথমিকভাবে একটি পাশ্চাত্যের মিশ্র অর্থনীতি, মুক্ত সংবাদ এবং গণতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত। নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো (কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা শাসিত) পশ্চিমাদের তুলনায় কম সুখী ছিল, এমনকি সমান দরিদ্র দেশগুলোর চেয়েও কম সুখী।

তবে, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক বেঞ্জামিন রেডক্লিফ, যিনি সুখ অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনেক গবেষণা করেছেন, তিনি মনে করেন— গণতান্ত্রিক দেশে জীবন সন্তুষ্টি অনেক দৃঢ় হয়, যদি ইতিবাচকভাবে একটি উদার সামাজিক নিরাপত্তা নেট, প্রো- শ্রম বাজার প্রবিধান এবং শক্তিশালী শ্রম ইউনিয়নের ব্যবস্থা করা যায়। একইভাবে, অনেক প্রমাণ আছে যে পাবলিক পলিসিগুলো দারিদ্র্যতা কমাতে এবং একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সমর্থন করতে পারে, যদি উচ্চতম ন্যূনতম মজুরি সুনিশ্চিত করা যায় তাহলে তা সুখের উপর অনেক প্রভাব ফেলে।

এটি সাধারণভাবে গৃহীত হয় যে, সুখ অন্ততঃপক্ষে ডোপমিনার্জিক, অ্যাড্রেনার্জিক এবং সেরোটোনার্জিক বিপাকের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করা হয়। হরমোনের মাত্রা এবং সুখের মধ্যে একটি সম্পর্ক পাওয়া গেছে। SSRIs, যেমন— Prozac ক্লিনিক্যালভাবে অসুখী কিনা সেরোটোনিকের মাত্রা সমন্বয়ের মাধ্যমে তা যাচাই করা হয়। গবেষকরা, যেমন— আলেকজান্ডার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, অনেক লোক মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য হরমোনের মাত্রা সংশোধন করার প্রচেষ্টা করলে ফলাফল হতে পারে বিপরীত যা তাদের অসন্তুষ্ট করে। একটি ইতিবাচক সম্পর্ক মস্তিষ্কের ডান পাশে precuneus এলাকায় ধূসর কিছু উপাদান পাওয়া গেছে যার মাধ্যমে সুখের মাত্রা পরিমাপ করা যায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। ধ্যান ভিত্তিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে লক্ষ্য করা গেছে যে, precuneus এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হারে ধূসর উপাদান বৃদ্ধির সম্পর্ক পাওয়া গেছে।

২০০৫ সালে লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে এন্ড্রু স্টেপটো এবং মাইকেল মারমোট কর্তৃক পরিচালিত একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, সুখ জৈবিক মার্কারদের সাথে সম্পর্কিত যা স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষকরা লক্ষ্য করেন যে, সুখ এবং তিনটি জৈবিক মার্কার এর মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে কি না, যেমন— হৃৎস্পন্দন, করটিসোল স্তর এবং প্লাজমা ফাইব্রিনোজেন এর মাত্রা। যারা নিজেদেরকে কমপক্ষে সুখী মনে করেন তাদের মধ্যে করটিসোলের মাত্রা ছিল ৪৮% বেশি যারা নিজেদেরকে সবচেয়ে বেশি সুখী বলে মনে করে তাদের থেকে। অন্তত সুখী বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে দুটি স্ট্রেস-ইনডুইটিং টাস্কগুলোর একটি বড় প্লাজমা ফাইব্রিনোজেন প্রতিক্রিয়া— স্ট্রোপ পরীক্ষা এবং একটি মিররে একটি তারকার ট্রেসিং করা। তিন বছর পরে তাদের বিষয়গুলো পুনরাবৃত্তি করে যে, স্টেপটো এবং মারমোটে পাওয়া যায় তাতে ইতিবাচক আবেগগুলোর মধ্যে উচ্চতর অংশগ্রহণকারী কোরিটিসোল এবং ফাইব্রিনোজেনের নিম্ন স্তরের পাশাপাশি নিম্ন হার্টের হারও অব্যাহত ছিল।

হ্যাপি পিপল লাইভ লংগার (২০১১), ব্রুনো ফ্রাই জানায় যে, সুখী মানুষেরা ১৪% বেশি সময় বেঁচে থাকে, দৈর্ঘ্য ৭.৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত। এবং রিচার্ড ডেভিডসনের বেস্টসেলার (২০১২) The Emotional Life of Your Brain যুক্তি দেয় যে, ইতিবাচক আবেগ এবং সুখ ভাল স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

যাইহোক, ২০১৫ সালের আগে পরিচালিত গবেষণাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, মৃত্যুর উপর সুখের কোন প্রভাব নেই। মৌলিক বিশ্বাস হলো— যদি আপনি সুখী হন তাহলে আপনি দীর্ঘকাল বাঁচবেন; এটা সত্য নয়। সুসঙ্গত ফলাফল হলো সুস্বাস্থ্যের পাশাপাশি সুখী মানুষের বয়স বেশি হতে পারে— ধূমপান না করা, শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকা, কঠোর অনুশীলন করা , সঙ্গীর সাথে বাস করা, ধর্মীয় বা গোষ্ঠী ক্রিয়াকলাপ পরিচালনা করা এবং রাতে অন্তত আট ঘণ্টা ঘুমানো।

সুখ দেহের রোগপ্রতিরোধে প্রভাব ফেলে বলে মনে করা হচ্ছে। ধূমপান, মদ্যপান, ব্যায়াম, এবং ঘুমের মতো অন্যান্য কারণগুলোর সাথে ইতিবাচক আবেগ অনুধাবনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে যা ঠাণ্ডা ও ফ্লু প্রতিরোধে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। (তথ্যসূত্র: ইউকি)

পরিশেষে— ভিন্ন দেশের সেকেন্ড হোমে সুখ নেই, নেই  সুখ কানাডার বেগমপড়ায় বা অন্য কোথাও;  সুখের আসল ঠিকানা সৎ মানুষের চিত্ত। আর চিত্তে সুখ থাকলে অরণ্যে বসবাসেও সমস্যা নেই। 'সুখ' অত্যন্ত আপেক্ষিক ও জটিল একটি বিষয়; জীবন থেকে এ কথাটি নিশ্চিত বলতে পারি— চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারলে সে জীবনে সুখের আর কোন কমতি থাকে না থাকবে না।।  

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২৭ নভেম্বর, ২০২০.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন