.بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
﴿اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ﴾
১) পড়ো ( হে নবী ) , তোমার রবের নামে ৷ যিনি সৃষ্টি করেছেন৷
﴿خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ﴾
২) জমাট বাঁধা রক্তের দলা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন৷
﴿اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ﴾
৩) পড়ো , এবং তোমার রব বড় মেহেরবান ,
﴿الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ﴾
৪) যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন৷
﴿عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ﴾
৫) মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন , যা সে জানতো না৷
- [সুরা আলাক : ১-৫]
পবিত্র কোর'আনুল কারীমের ৯৬ নং সুরা আলাক-এর প্রথম পাঁচ আয়াত হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম-এর নিকট প্রথম ওহী, যার শুরু 'পড়ো' দিয়ে এবং ভিত্তি যার 'শিক্ষা ও জ্ঞান'। জীবনের মাত্র ২৩ বছরে তিনি সমগ্র মানব জাতির মধ্যে শিক্ষার এক নতুন জাগরণের সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। যারা একদিন তাঁর শত্রু ছিল - তারাই এই শিক্ষা গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিল; যারা পরস্পর রেষারেষিতে মত্ত ছিল - তারাই এই শিক্ষা গ্রহণ করে আপন ভাইয়ে পরিণত হয়েছিল; যে সমাজের সর্বত্র রক্তক্ষয়ী সংঘাত খুন-খারাবির অগ্নি দাবানল হয়ে জ্বলে উঠত - সেখানেই এই শিক্ষার আলোকে শান্তির ফুল ফুটে উঠেছিল। আমাদের দেশের বর্তমান মুসলিমদের হুঙ্কার শুনে ভাবি, এ আবার কোন অশনি সংকেত?
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম-এর জন্মভূমি আরবদেশ একটি ত্রিভূজাকৃতির উপদ্বীপ; যা ইসলামের লীলাভূমি। তিনদিক জল ও একদিক স্থল পরিবেস্টিত জাজিরাতুল আরব বা আরব উপদ্বীপের বৈচিত্র্যময় ভৌগলিক পরিবেশ ও শুষ্ক আবহাওয়া ওখানকার অধিবাসীদের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে জাজিরাতুল আরব এশিয়ার দক্ষিন পশ্চিম উপদ্বীপ; যা মানচিত্রের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ উপদ্বীপ। আগের এই জাজিরাতুল আরব নামে সুপরিচিত ভূ-খন্ডের উত্তরে সিরিয়ার মরুভূমি, দক্ষিনে ভারত মহাসাগর, পূর্বে পারস্য উপসাগর ও পশ্চিমে লোহিত সাগর; এর আয়তন ১০ লক্ষ ২৭ হাজার বর্গমাইল। আয়তনের দিক থেকে এটি ইউরোপের এক চতুর্থাংশ। ঐতিহাসিক মাকরিযির মতে, প্রাচীন আরবের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ।
নদ-নদী না থাকায় এবং শুষ্ক আবহাওয়ার কারনে আরবের এক-তৃতীয়াংশ মরুময় ও মানুষের বসবাসের অযোগ্য। এসব স্থান খুবই শুষ্ক, নিষ্করুন, রৌদ্রদগ্ধ ও বৃক্ষলতাদি শূন্য, ফলে সেখানে প্রায়ই ‘লু' হাওয়া প্রবাহিত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই লু’ হাওয়া ও উত্তপ্ত বালুকামিশ্রিত আবহাওয়া থেকে আত্মরক্ষার্থে আরবরা অনেক আগ থেকেই ঢিলেঢালা লম্বা আলখেল্লা জাতীয় পোষাক পড়ে এবং বাতাসের উড়ন্ত বালি থেকে নিজেদের রক্ষার্থে মাথায় পাগড়ি পড়ে।
আরবজাতি প্রধানত দু-ভাগে বিভক্ত; যথাঃ আরব আরিবা বা প্রকৃত আরব এবং আরব মুস্তারিবা বা আরবিকৃত আরব। আরব আরিবা বলতে বুঝায় কাহতানের বংশধর; অর্থাৎ, মহানবী (সাঃ) এর জন্মের পূর্বে যাঁরা হেজাজ ও ইয়েমেনের শাসনকাজ পরিচালনা করতেন। আর আরব মুস্তারিবা হলেন বহিরাগতরা; তাঁরা হযরত ইব্রাহিম (আঃ), হযরত ইসমাইল (আঃ) ও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর বংশধর; যাঁদের প্রচারিত ধর্মের নাম ইসলাম।
প্রকৃতপক্ষে ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃতি শুরু হয় হুজুরপাক (সঃ)-এর মৃত্যুর পর, অর্থাৎ ৬৩০-এর প্রথম থেকে। বাইজেন্টাইন (পূর্ব রোমান) সাম্রাজ্য ও সাসানিদ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর এই নতুন ধর্ম ইসলামকে নতুন নতুন সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। এই ধর্মের অনুসারী আরবের মরু যোদ্ধাদের তখন মোকাবেলা করতে হয়েছিল প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত সব সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে; যাদের রাজধানী ছিল কনস্ট্যান্টিনোপোল (বর্তমানে ইস্তানবুল) এবং তিসফুনে।
ইসলামের ১ম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) সৈনিকদের উদ্দেশ্যে কিছু নীতিমালা বেঁধে দিয়েছিলেন। যেগুলোর সাথে পূর্ব ও পরবর্তী যুগের যুদ্ধবিগ্রহের রীতি-নীতির তুলনা করলে বুঝা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রেও ইসলামের নীতি কতটা মহান ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। তিনি মুসলিম সৈন্যদের যে নির্দেশনাটি দিয়েছিলেন তা সরাসরি তুলে ধরলাম -
“যুদ্ধক্ষেত্রে কিভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করবে সে ব্যাপারে আমি দশটি নীতিমালা দিচ্ছি :
কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না কিংবা সঠিক পথ থেকে দূরে সরে যাবে না। মৃতদেহ বিকৃত করবে না। শিশুদের হত্যা করবে না; নারী কিংবা বয়স্কদেরও নয়। বৃক্ষাদির কোন ক্ষতি করো না; কিংবা আগুনে পুড়িয়ে দিবে না, বিশেষ করে ফলবতী বৃক্ষরাজির দিকে বেশী নজর রাখবে। শত্রুবাহিনীর পাল থেকেও কোন প্রাণী হত্যা করবে না; খাদ্য সঞ্চয় করবে, অপচয় করবে না। তোমরা হয়তো এমন সব মানুষের দেখা পাবে যারা সন্ন্যাসী হিসেবে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে (সন্যাসব্রত পালন করেছে); তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দিবে, উত্যক্ত করবে না এবং এড়িয়ে চলবে।”
ইসলামের স্বর্ণালী যুগে ও তৎপরবর্তীতেও দেখা যেতো একজন মুসলিমের জীবনাদর্শে মুগ্ধ ও উদ্ভুদ্ধ হয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীরা ইসলামে দীক্ষা নিত; কাউকে জোর করে চাপিয়ে ধর্মান্তরিত করা হতো না। যে ধর্মের অগ্রযাত্রার পিছনের চালিকা শক্তি ছিল শিক্ষা, ন্যায় পরায়নতা, নমনীয়তা, সহনশিলতা, সহমর্মিতা; আজ সেই ধর্মই ভ্রান্ত মতবালম্বীদের পাল্লায় পরে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। হুজুরপাক (সাঃ)-কে যাঁরা দু'চোখে দেখেছেন, ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং হুজুরপাক (সাঃ)-এর সাথে ছিলেন তাঁরা হলেন সাহাবী (রাঃ); যাঁরা নক্ষত্রসম। তাঁদের পরের প্রজন্ম তাবেঈন; এর পরের প্রজন্ম তাবে-তাবেঈন। কিতাব থেকে নেয়া তাবে-তাবেঈন যুগের একটি সত্য ঘটনা:
এক তাবে-তাবেঈন তাঁর দোকানে ১২/১৩ বছর বয়সের ভাতিজাকে রেখে একদিন আসরের নামাজ আদায় করতে যান। ফেরার পথে তিনি দেখতে পান, এক ব্যক্তি তাঁর দোকানের রেশমী একটি কাপড় হাতে নিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। লোকটিকে থামিয়ে তিনি জানতে চাইলেন কত দিয়ে কাপড়টি কিনে এনেছেন। ঐ ব্যক্তি বললেন, "৪০০ দিহরাম।" তাবে-তাবেঈন চমকে উঠে বললেন, " বলেন কি? এটার দাম তো এতো না, ফিরে চলুন আমার সাথে।" লোকটি বলল, " আমি একজন বেদুইন, প্রত্যন্ত্য গ্রামে থাকি; আমার এলাকায় এই রেশমি কাপড় খুব কম পাওয়া যায়, কদাচিত পাওয়া গেলেও দাম আরো অনেক বেশি। দোকানি আমার কাছে ৫০০ দিহরাম দাম চেয়েছিল; দামাদামী করেই আমি কম দামে এটা নিয়ে এসেছি। তাছাড়া এত কম দামে এমন কাপড় পেয়ে আমি খুশি।" তাবে-তাবেঈন বললেন, " অসম্ভব! যে দোকান থেকে আপনি এটা কিনে এনেছেন আমি সেই দোকানের মালিক, ভাতিজাকে দোকানে রেখে আমি নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলাম; আপনাকে সে ঠকিয়েছে, ফিরে চলুন।"
বেদুইন ফিরে আসতে না চাইলেও তাবে-তাবেঈন তাকে দোকানে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এবং এসেই প্রথমে ভাতিজাকে তিরস্কার করেন; বলেন, " তোমার ভাইকে কি তুমি এভাবে ঠকাতে পারতে? তবে কেন তুমি ২০০ দিহরামের কাপড় ৪০০ দিহরাম দাম নিলে?"
তাবে-তাবুঈন অত্যন্ত লজ্জিত ও দুঃখিত হয়ে বেদুঈনের কাছে ক্ষমা চেয়ে তৎক্ষণাৎ ২০০ দিহরাম ফেরত দেন। একজন সাধারণ মুসলিমের এই আচরণে মুগ্ধ হয়ে সেইদিন সেইসময় সেখানেই বেদুঈন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
আর আজকের মুসলমান একটু সুযোগ পেলেই দূর্বলের উপর, সংখ্যালঘুদের উপর চেঁপে বসে; অনেক তথাকথিত আলেম-ওলামাকেও দেখেছি বিচ্ছিরিভাবে ওদেরকে গালাগালি বা অভিসম্পাত করতে। কেউ কি কখনো নিশ্চিত করে বলতে পারবে, কে কখন আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীনের দ্বারা হেদায়েত প্রাপ্ত হবেন বা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবেন?
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, "জ্ঞানের কথা বিজ্ঞজনের হারানো সম্পদ; যে যেখানেই তা পাবে সে-ই হবে তার সবচেয়ে বেশি অধিকারী।"
হাদিসটি থেকে একথাটি স্পষ্ট প্রতিয়মান - রাসুলুল্লাহ (সা.) জ্ঞানকে সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষার নামে কোনো বিভেদ সৃষ্টি করেন নি; দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণে যে জ্ঞান উপকারী তার সবই ইসলামী শিক্ষার জন্য প্রযোজ্য। শুধুমাত্র বিশুদ্ধ নিয়তে আল্লাহর নামে শুরু হলে যেকোনো ধরনের জ্ঞান অর্জনই ইবাদত বলে গণ্য হয়।
ইসলামের স্বর্ণালী যুগে সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষা নামে শিক্ষার বিপরীতমুখী কোন শিক্ষাধারা ছিল না, বরং যাঁরাই তখন কোরআন ও হাদিস চর্চা করতেন, তাঁরাই আবার সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান, ভূগোল, দর্শন ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতেন; ইবনে রুশদ, ইমাম রাজি, হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী প্রমুখ মনীষীগণ এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। পর্যায়ক্রমে মুসলিম বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হতে ওদের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। ইসলামী চেতনার চতুর্মুখী শিক্ষার ধারাকে গুরুত্বহীন করার অভিপ্রায়ে প্রাচ্যাত্য সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিমদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষা নামে দুটি ধারার সৃষ্টি করে দিয়ে যায়; যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পরেছে অনেক মুসলিম সমাজে। এতে মুসলিমের মধ্যে মতবেদ, বিভেদ ও অনৈক্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরেছে; ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে দাঁড়ানোর শক্তিই আজ তারা হারিয়ে ফেলেছে। অথচ শিক্ষাকে কখনো ইসলাম বিভক্ত করে নি, বরং শিক্ষা ও জ্ঞানকে ইসলামে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া আছে; আর শিক্ষাই মুসলমানের সবচেয়ে বড় হারানো সম্পদ।
অষ্টম শতাব্দীর গোড়া থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত মুসলিমরা ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনন্য অসাধারণ এক জাতি। তাঁরা তখন শুধু নিজেরাই জ্ঞানচর্চা ও অনুশীলনে নিবেদিত থাকতেন না, বরং জ্ঞানান্বেষু অন্যান্য জাতিকেও তাঁদের উদ্ভাসিত জ্ঞানের অংশীদার করতে কুণ্ঠিত হতেন না। মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা জ্ঞান সাধনার পাশাপাশি ধর্মপ্রচারক ও সমরনায়কদের সাথেও বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। মুসলিমদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে এভাবেই বন্য দ্যালামাইতস, স্যালজুক, তাতারস ও বার্বার জাতি শান্তির সন্ধান খুঁজে পেয়েছিল।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মুসলিমরা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে - যেমন চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে ক্রমেই অগ্রসর হতে থাকে; বিশেষ করে কারাওইন, কর্ডোভা, টলেডো, সেভিল ও গ্রানাডার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা দেশে ফেরত আসার পর বর্ণিত বিষয় ও ক্ষেত্রগুলোতে শনৈঃ শনৈঃ অগ্রগতি লাভ করতে থাকে। বিস্ময়করভাবে মুসলিমদের জ্ঞান তখন পরিশ্রমী অনুবাদকদের দ্বারা অনূদিত হয়ে ইউরোপে স্থানান্তরিত হতে থাকে। আরব থেকে মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতিও তরতর করে ইউরোপে বিস্তৃতি লাভ করে; বিশেষকরে সিসিলি ও স্পেন দিয়ে। সিসিলি ও স্পেন ছিল তখন এসব বিস্তৃতির প্রধান উৎসস্থল; সিসিলিতে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত দুজন শাসক ছিল - একজন দ্বিতীয় রজার এবং অন্যজন দ্বিতীয় ফ্রেডরিক; যারা শিক্ষা সহযোগীতায় যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন।
যারা ভাবে ধৃষ্টতাপূর্ণ কথাবার্তা, রূঢ় আচার আচরণ ও তলোয়ারের পিঠে ইসলামের বিজয় সূচিত হয়েছে, তারা ভুল ধারণা পোষণ করছে। সেই শুরু থেকেই একজন মুসলমান ছিল উদার; তাঁদের জীবনযাত্রা ছিল অনুকরণীয় অনুসরণীয়। ইসলামী জীবনে কোনদিনও কোথাও বিন্দু পরিমাণ সন্ত্রাস বা উগ্রতার স্থান ছিল না, নেইও। বিশ্বের কট্টর ইসলামী রাষ্ট্রও যখন অবাধ তথ্যপ্রযুকতির এই ডিজিটাল যুগের সত্যতা ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে নিজেদের পরিবর্তন করতে উঠেপড়ে লেগেছে, তখন আমাদের দেশের এক শ্রেণীর তথাকথিত আলেম-ওলামা প্রবেশ করতে চাইছে আইয়ামে জাহিলিয়াতে। যখন বদলে যেতে চাইছে বা বদলে যাচ্ছে জাজিরাতুল আরব তথা আরব উপদ্বীপ; বদলাতে চাইছে না আমাদের তথাকথিত আলেম-ওলামার দল। মুর্খতা তাদেরকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে; তারা নাকি চাচ্ছে না - মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে বিজ্ঞান গণিত একত্রিভূত করতে!
বিগত ৫ বছরে ১ হাজার ৭৯৩টি স্কুল খোলা হয়েছে ইসলামের তীর্থ সৌদি আরবে। বছরে গড়ে ৩০০ কিন্ডারগার্টেন স্থাপন করা হচ্ছে সে দেশ জুড়ে। আরবের শিশুদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা এবং বর্তমান অলস আরবীয়দের কর্মসংস্থানে উদ্ভুদ্ধ করতেই এই উদ্যোগ নিয়েছে সেদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
'ভিশন ২০৩০' এর আওতায় প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করছে জাজিরাতুল আরবের অন্য আরেক ছোট্র দেশ কাতার। এরই মাঝে যৌথভাবে ৫.৮ পিসা স্কোর নিয়ে পঞ্চম স্থানে স্থান করে নিয়েছে এই রক্ষনশীল ইসলামী সমাজব্যবস্থার দেশটি; তাঁরাও এখন বেড়িয়ে আসতে চাইছে। ২০৩০ সালে শিক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা পাওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষাপদ্ধতিতে তারা এনেছেন ব্যাপক পরিবর্তন।
বিংশ শতাব্দীর পূর্বে কাতারের সমাজে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য তেমন কোন জোর দেওয়া হত না। এটি ছিল প্রথাগত বেদুইন সংস্কৃতির দেশ। একসময় কাতারের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের শিখানো হতো কিভাবে কুরআন মুখস্ত করতে হয়, মনে রাখতে হয় এবং পড়তে হয়। এই ধরনের শিক্ষা সাধাণত ১০ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যায়। যার ফলে তাদের পরিবার ১০ বছর বয়সেই আল-খাতমা বা কুরআন শিক্ষা শেষকে উৎযাপন করতো। ১৮শ শতকের দিকে পেনিনসুলার একটি উল্লেখযোগ্য শহর যুবারাহ ইসলামি শিক্ষার কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
ইসলামী বিদ্যালয় তখন তিন ভাগে বিভক্ত ছিল; মসজিদ, কুত্তাব এবং মাদ্রাসা। ১৮৭৮ এবং ১৯১৩ এর মধ্যে ২০টি কুত্তাব, ৩০টি মাদ্রাসা ও ৪০০ টি মসজিদ কাতার এর মধ্যে আল-হাসা নামক এলাকায় ছিল। মসজিদ সাধারণত প্রার্থনা করার জন্য ব্যাবহৃত হত, সেখানে ইসলামের নানান ধরনের ধর্মীয় নির্দেশনা ও শিক্ষার সুযোগ সুবিধাও দেওয়া হতো।
কুত্তাব যা মক্তব নামে পরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২ ভাগে বিভক্ত ছিল। কুত্তাব-এর ১ম ভাগে কুরআন ও ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ শিক্ষা দেওয়া হতো; যা শহর ও গ্রাম উভয় যায়গাতেই ব্যাপক বিস্তৃত ছিল। ছেলে-মেয়ে উভয় শিশুরাই ওখানে অংশগ্রহণ করতে পারতো; যদিও তারা লিঙ্গে পৃথকীকৃত ছিল। পুরুষ শিশুদের শেখানো হতো খোলা যায়গায় বা মসজিদে, অন্যদিকে নারী শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হতো ঘরে। কুত্তাবের অন্য বিভাগে কুরআন ছাড়াও পড়া, লেখা এবং গণিত শিক্ষা দেওয়া হতো। কুত্তাবে অবশ্য বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল; এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রশিক্ষকদের যোগ্যতার অভাব।
মাদ্রাসা গুলোই শিক্ষার জন্য সবচেয়ে ভাল মাধ্যম ছিল; সেখানে ইসলাম, বিজ্ঞান ও আরবি সাহিত্য শিক্ষা দেওয়া হতো। এগুলো সাধাণত শহর এলাকায় দেখা যেত; মাদ্রাসাগুলো থেকে সবসময় ভাল এবং উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন কবি ও সরকারি কর্মচারী বের হত; ১৯৩৮ সালে যা বন্ধ হয়ে যায়।
কাতারের এক ধনাট্ট ব্যাক্তি দ্বারা ১৯৪৯ সালে দোহায় দেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়; যার নাম ইসলাহ আল-মুহাম্মাদিয়া। এটি ১ জন শিক্ষক ও ৫০ জন শিক্ষার্থী দ্বারা পরিচালিত হতো। নগরীর দ্বিতীয় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালে। দোহাতে দেশের ১ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শীগ্রই তার প্রভাব চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯৫২ সালে আল-খোর নামক একটি অর্ধ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়, এবং আর-রুয়াস এর প্রথম ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়; এভাবেই বিদ্যালয় এর সংখা ২ থেকে ৪, ৪ থেকে ৮ হতে থাকে। ১৯৫৪ সালে সর্বমোট ৫৬০ জন শিক্ষার্থী এবং ২৬ জন শিক্ষক ছিল এই শিক্ষাব্যবস্থায়। ১৯৫৫ সালে প্রথম মেয়েদের আনুষ্ঠানিক বিদ্যালয় দোহাতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন শিক্ষা কর্মকাণ্ডের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাপ নির্ধারণ করে দেয়। ঐ বছরই ১৭ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৩৩৩ জন শিক্ষার্থী ও ৮০ জন শিক্ষক নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৭ সালে মেয়েদের শিক্ষাকেও জাতীয় শিক্ষা কর্মসূচিতে যোগ করা হয়। সে বছর ২টি মেয়েদের বিদ্যালয় ১৪ জন শিক্ষিকা এবং ৪৫১ জন ছাত্রী নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। মেয়েদের শিক্ষার হার এত দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায় যে ১৯৭৫-৭৬ সালে এসে মেয়েদের বিদ্যালয় এবং ছেলেদের বিদ্যালয়ের সংখা সমান হয়ে যায়; উভয় ক্ষেত্রেই তখন ৬৫ টি স্কুল গড়ে উঠে।
১৯৯৬ সালে কাতারের শিক্ষার্থীর সংখা ছিল প্রায় ৫১০০০ জন যার মধ্যে ৩৫০০০ জন ছিল প্রাথমিক, ১৬০০০ জন ছিল মাধ্যমিক এবং ৮০০০ জন বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থী ছিল।
[ তথ্যসুত্র : ইউকিপিডিয়া ]
বর্তমানে কাতারের শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ দুইটি মন্ত্রণালয় এর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে; শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সর্বচ্চ শিক্ষা কাউন্সিল। এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়ন হ্রাস করা হয়েছে এবং অনেক বিদ্যালয় বর্তমানে সর্বোচ্চ শিক্ষা কাউন্সিলের অধিনে চলে গেছে।
কাতারের শিক্ষাব্যবস্থা সর্বোচ্চ শিক্ষা কাউন্সিল (এসইসি) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় (এমওই) এর দ্বারা যৌথভাবে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সকল স্বাধীন বিদ্যালয়গুলি এসইসি এর দ্বায়িত্বে থাকে অন্যদিকে এমওই সকল বেসরকারি বিদ্যালয় সমূহকে সাহায্য প্রদান করে। ১৯৫৬ সাল থেকে প্রথাগত বিদ্যালয় ভিত্তিক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষা সকল শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক এবং সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে প্রাথমিক শিক্ষা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়।
কাতারে শিক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট বৈচিত্র্যময়, এখানে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করে। কাতারে প্রায় ৩৩৮ টি আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় আছে। রাজধানী দোহা গড়ে উঠেছে দেশটির শিক্ষা শহর হিসেবে; যেখানে বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় এর স্যাটেলাইট ক্যাম্পাস রয়েছে।
২০০১ সালে কাতার রেন্ড কর্পোরেশনকে ভাড়া করে তাদের কিন্টারগার্টেন থেকে ১২ তম শ্রেণীর লেখাপড়ার মান ও অনিশ্চয়তা সম্পর্কে জানতে। এ সময় রেন্ড এর গবেষণা পরিচালিত হয়, প্রায় ১০০০০০ শিক্ষার্থী কাতারের শিক্ষাব্যবস্থা কতৃক পরিবেশিত হয়,যাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ সরকারি বিদ্যালয় গুলোতে উপস্থিত ছিল। রেন্ড শিক্ষাখাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃপণতাকে দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রের প্রধান দুর্বলতা বলে জানায়। রেন্ড এছাড়াও কাতার সরকারকে আরও নানা ধরণের সংস্কার এর কথা বলে; যার মধ্যে পাঠ্যক্রম এর উন্নয়নের উপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়। রেন্ড এর গবেষণার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ২০০১ সালে সুপ্রিম শিক্ষা কাউন্সিল নতুন যুগের শিক্ষা (EFNE) নামে একটি নতুন উদ্যোগ গ্রহন করে এবং দেশের শিক্ষা নীতির প্রচুর সংস্কার করে। ইএফএনই এর একটি প্রধান উদ্যেশ্য ছিল পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষা পদ্ধতিকে গ্রহন করা এবং বিদ্যালয় গুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া। এছাড়াও এসইসি-ও এই উদ্যেগ গ্রহনের মাধ্যমে তাদের ভর্তি বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল। ২০০৫ সালে এসইসি আরবি, গণিত ও বিজ্ঞান সকল শ্রেনির জন্য দেশীয় পাঠ্যক্রম এর শিক্ষা পদ্ধতি উত্থাপন করে। এর পরেই সেখানে বৃহৎ পরিমাণে স্বাধীন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম শুরু হয়; ২০০৪ সালে ১২ টি, ২০০৫ সালে ২১ টি এবং ২০০৬ সালে তেরটি বিদ্যালয় খোলা হয়।
২০০৮ সালের একটি মূল্যায়ন পরীক্ষাতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ নতুন পাঠ্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারে। প্রায় ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজি, ৫ শতাংশ আরবি এবং ১ শতাংশেরও কম শিক্ষার্থী গণিত ও বিজ্ঞানের সংগে পরিচিত ছিল। ওইসিডি দ্বারা পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায় তখন কাতার তার শিক্ষা সূচক এর ১০ম অবস্থানে ছিল।
আল ওয়াকরা এর ভিশন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল প্রথম প্রাক কিন্টারগার্টেন থেকে ১২ তম শ্রেনি পর্যন্ত আমেরিকান পাঠ্যক্রম অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়ার কথা বলে ২০১৪ সালে। ২০১৫ সালের জানুয়ারীর হিসাবে, আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় পরামর্শ (আইএসসি) কাতারের আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় সমূহের একটি তালিকা প্রকাশ করে যাতে ১৪৭ টি আন্তর্জাতিক বিদ্যালয়ের কথা বলা হয়। বর্তমানে রক্ষণশীল কাতারের শিক্ষাব্যবস্থায়ও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে; এরই মধ্যে তারা ৫.৮ পিসা শিক্ষা স্কোর নিয়ে বিশ্বে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে।
দুনিয়াই আখেরাতের চারণক্ষেত্র; বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণে এখানটা চষে বেড়ানো প্রতিটি মুসলিমের ইমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য। একজন মানুষ যত ধনধৌলতের মালিকই হউক না কেন, শিক্ষা ছাড়া যেমন কখনো পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না; ঠিক তদ্রুপ একটি দেশ যত ধনীই হউক না কেন, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া জাতি কখনো পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২৮ এপ্রিল, ২০১৭.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন