শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০

প্রোপাগাণ্ডার পরিসমাপ্তি কবে হবে?

মুক্তিযুদ্ধ ও তদপরবর্তী সময়, বিশেষ করে ৭৪/৭৫ নিয়ে এদেশের তরুণ প্রজন্মের একাংশের মাঝে এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হয়েছে, যা করা হয়েছে অত্যন্ত কূটকৌশলে;  যা পড়ে জেনে আজকের তরুণতরুণীর অনেকে এরই মাঝে বিভ্রান্তির অতলে তলিয়ে গেছে। তাদের মনে এমনসব ভ্রান্ত ধারণা জন্ম নেয়ার পিছনের বহুবিদ কারণের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে - গুগোল সার্চে ঐ সময়কার সঠিক তথ্য সম্বলিত সামাজিক চিত্র বা ইতিহাস তুলে ধরে লেখালেখি তারা খুব কমই পেয়েছে, পায়; বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের পক্ষের লেখার চেয়ে বিরুদ্ধে লেখা  তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পাওয়া যায়, পাচ্ছে এবং দেখেছে, পড়ছে। তারা যা বা যতোটুকোই লেখা পাচ্ছে বা দেখেছে তার প্রায় সবটাই ৭৫ পরবর্তীতে তৈরি করা স্বাধীনতাবিরোধীদের লেখা, তাদের হাতে গড়া এক ধরনের মিথ্যার পাণ্ডুলিপি; অথবা তৎকালীন সময়ে তৈরী করা এক ধরনের নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা, যা ছিল বেশিরভাগই প্রোপাগাণ্ডা। 

আজকের তরুণতরুণীরা অনেকটাই অনলাইন নির্ভর। তারা যা বা যতটুকো পড়ে তার সবটাই অনলাইনে পড়তে চায় জানতে চায়; পবিত্র কোর'আন পড়লেও তারা তা অনলাইনে পড়ে! গল্প ইতিহাস উপন্যাস কবিতা সাহিত্য সব সবকিছুই তারা অনলাইন থেকে পড়তে চায় জানতে চায়; এক কথায় দিনদিন তারা অনেকটাই অনলাইনের উপর নির্ভরশীল ও বিশ্বাসী হয়ে পড়ছে। তাই অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মিথ্যা ইতিহাস পড়ে পড়ে তা-ই তারা ধারণ করছে। অনেক চিন্তা করে আমি আবিষ্কার করেছি সেই সব মিথ্যা অপপ্রচার এখন অনেকেই বিশ্বাস করছে এবং তা নিয়ে মেতেও আছে। 

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের যেসব ঘটনা অনলাইন জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার সবটাই প্রায় এক ধরণের মিথ্যা অপপ্রচার। ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ ও পূর্ববর্তী সময়গুলোকে তারা বলতে চায় বঙ্গবন্ধুর কুশাসনের ফসল। বলার কারণ, ওইসব একচেটিয়া একমুখী লেখালেখি। কখনো ওরা এর পিছনের গভীর ষড়যন্ত্রের কথা চিন্তাও করেনি; যা স্বাধীনতার পর থেকেই করা হয়েছে এবং চলে আসছে। অনেক খুঁজে আমি একটি জিনিস আবিষ্কার করেছি— এইসব লেখালেখি হয়তো স্বাধীনতাবিরোধীদের কারো না কারো, নয়তো তাদের পয়সায় বিক্রি হওয়া কোন বুদ্ধিব্যবসায়ীর মনগড়া সব পাণ্ডুলিপি। অনলাইনে এখনো মুক্তিযুদ্ধের অনেক নেতিবাচক বানানো গল্প বসে আছে বা ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। এইসব পড়ে পড়ে তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ প্রতিনিয়ত নতুনভাবে বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হচ্ছে এবং সেই সব বিভ্রান্তিতেই মেতে আছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বেকার প্রজন্ম আমরা যারা কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছি নিশ্চয় এসব দেখে আমাদের কষ্ট হয়, কিন্তু কিছুই করার নেই; এই সব দেখারও যেন কেউ নেই। 

হে আজকের তরুণ প্রজন্ম, তোমরা একটু ভাল করে ভেবে দেখো দেশ শাসন করার মতো কতোটা সময় পেয়েছিলেন জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান? দেশ গঠন করা বা গড়ার মতো কতটুকো সময় তিনি পেয়েছিলেন? যুদ্ধবিধ্যস্ত একটা দেশ ও জাতি ৩/৪ বছরে পুনর্গঠিত করা যায় কি করে বা তা কি করে সম্ভব? সময়ের আগেই তো বপন করা হয়ে গিয়েছিল গভীর এক ষড়যন্ত্রের বীজ, শুরু হয়ে গিয়েছিল তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র। তারা খুব ভাল করেই জানতো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে না পারলে তারা কোনদিনও এদেশে সুবিধা করতে পারবে না; তাই তিনিই তাদের প্রথম টার্গেট হন। যুদ্ধাপরাধীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা শোনার পর দেশবিদেশে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে এবং কিছু অতিলোভী মুক্তিযুদ্ধাকেও তাদের দলভুক্ত করে নেয়। ১৫ আগস্ট ৭৫ তারা ষোলকলা পূর্ণ করে জাতিরজনককে হত্যার মাধ্যমে। 

এই তো, মনে হয় যেন সেই দিন; কত কঠিনই-না ছিল আমাদের সেই পথচলা। বিশেষ করে ৭০ এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর পরবর্তী দিনগুলো। মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়গুলোকে বিতর্কিত করার দূরঅভিসন্ধি নিয়ে আজ যারা এর পিছনে কলকাঠি নাড়ছে তারাই সেইদিন গোপনে অথবা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল। আজ যেমন যুদ্ধাপরাধীর বিচার সময়ের দাবী, সেদিন স্বাধীনতাও ছিল সময়ের দাবী। 

১২ নভেম্বর ১৯৭০, উপকূলীয় এলাকায় ঘটে গিয়েছিল দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং প্রলয়ঙ্করী এক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস; সমগ্র উপকূলবাসীর জন্য সেই দিনটি ছিল এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের দিন। দীর্ঘ ৪৫ বছর কেটে গেলেও স্বজনহারা মানুষ সেদিনের কথা আজও ভুলতে পারেনি। সেদিন পূর্ব পাকিস্থানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সম্পূর্ণ লণ্ডভণ্ড হয়ে শুধু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসটি ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে গিয়েছিল, প্রায় সমগ্র দেশটাকে তচনচ করে ফেলেছিল। 

যতটুকো মনে পরে সেই দিনটি ছিল রোজার দিন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিসহ সারাদিন সারাদেশে টানা বাতাস বইছিল। রাতে উপকূলের উপর দিয়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটারের উপর বেগে বয়ে যায় এক প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস; শুধু রেখে যায় রাশিরাশি ধ্বংসযজ্ঞ। বহু মানুষ সেদিন তাদের প্রিয়জনের লাশও খুঁজে পায়নি। জলোচ্ছ্বাসের পর থেকে দেড় মাস পর্যন্ত স্বজনহারাদের কান্নায় উপকূলের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে গিয়েছিল। গত ৪ দশকে পৃথিবীর এই অঞ্চলে যতক'টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে তার সবক'টির চেয়ে ওই ঝড়টি ছিল সবচেয়ে বেশি হিংস্র ও মারাত্মক। 

৭০-এর 'হারিকেন'রূপী ওই ঝড়টি উপকূলীয় ভোলা, বরিশাল, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনাসহ দেশের প্রায় ১৮টি জেলাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি আজকের মতো এতোটা শক্তিশালী ছিল না, অনেকটা দুর্বল থাকায় উপকূলের অনেক মানুষই ঝড়ের পূর্বাভাস জানতে পারেনি শুনতে পায়নি। তাই হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল কল্পনাতীত। ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাস ছিল ৮ থেকে ১০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। কেউ-বা গাছের ডালে কেউ-বা উঁচু ছাদে আশ্রয় নিয়ে কোনোমতে প্রাণে রক্ষা পেলেও ৩/৪ দিন তাদের অভুক্তই কাটাতে হয়েছিল।  

পরবর্তীতে জানা যায় ১২ নভেম্বর রাতের সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার বা ১৩৮ মাইল। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ, বাতাসে মানুষপঁচা গন্ধ। ৩ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়াতে মৃতদেহগুলো দাফন করাও সম্ভব ছিল না। আর করবেই-বা কে? সে সময় দুর্গত অঞ্চলে পৌঁছানো এতো সহজ ছিল না। তদানীন্তন পাকিস্থান সরকার নুন্যতম খোঁজখবরটুকো পর্যন্ত নেয়নি। সেদিনের ঝড়ে কত মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল তার সঠিক হিসাব অদ্যাবধি জানা না গেলেও উপকূলীয় অঞ্চলের ৮৭% ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং তিন চার মাস পরেও ৫২.৪% মানুষ গৃহহীন অবস্থায় জীবন যাপন করেছিল। ধারণা করা হয় সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে লাখ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। ঘটনার দুই দিন পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কর্তাব্যক্তিরা দুর্গত অঞ্চলের খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে কেন যেন তাও বন্ধ হয়ে যায় বা করে দেয়। বিদেশী সংবাদ কর্মীদেরও তখন দুর্গত অঞ্চল পরিদর্শনে যেতে দেয়া হয়নি, বরং তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। 

জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাসানীসহ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের এ অঞ্চলের অনেকে অনেক কষ্ট করে তৎক্ষণাৎ উপদ্রুত এলাকায় দুর্গত মানুষের পাশে ছুটে গিয়েছিলেন, সার্বিক অবস্থা দেখে সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে শুধু কেঁদেছিলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু ও ভাসানী যে যার মতো করে সবাইকে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছিলেন। সেই সময়ের পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খান একটি বারের জন্যও বাংলার স্বজনহারা মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়নি, এমনকি নুন্যতম খোঁজখবরটুকো পর্যন্ত নেননি। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ সেই ধ্বংসযজ্ঞের পূর্ণাঙ্গ দলিল অদ্যাবধি সুস্পষ্টভাবে কোথাও লিখা হয়নি বা প্রকাশিত হয়নি। 

৭০-এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের রেষের মাঝেই শুরু হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। অনেকে বলে বঙ্গবন্ধু সেদিন স্বাধীনতা চান নি, চেয়েছিলেন স্বায়ত্তশাসন। মিথ্যা কথা, ভুল ধারণা; সেদিন  পূর্বাঞ্চলের প্রতিটা মানুষের হৃদয়ের দাবী ও কামনা ছিল স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের নেতা ছিলেন, তিনি প্রতিটি মানুষের পার্লস খুব ভাল করেই বুঝতেন। পরিবেশ পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতা আমাদের যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। যুদ্ধের ইতিহাস সবারই কমবেশি জানা থাকলেও, এর নিকট অতীত ও নিকট ভবিষ্যৎ অনেকের কাছে আজও অজানা; আর সেই সুযোগটাই গ্রহণ করেছে স্বাধীনতাবিরোধীরা। নিজেদের ইচ্ছেমত লিখে তা তারা অনলাইনে ছেড়ে দিয়েছে এবং প্রজন্ম পরম্পরায় মিস গাইড করেছে করছে। 
দেশজুড়ে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা বিরাজ করছিল তারই মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়। নয় মাসের সেই ভয়াবহ সময়ের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সঠিক অনেক ইতিহাস ও পূর্ণাঙ্গ দলিল থাকলেও পরবর্তী সময় নিয়ে এদেশে একটা ঘোলাটে অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছিল, আর এর পিছনে যাদের হাত ছিল তারা হলো মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি। যারা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে স্বাধীনতার আগে ও পরে এবং এখনও করেই যাচ্ছে! 

নয় মাসের দুঃস্বপ্ন বিভীষিকাময় যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো, পৃথিবীর মানচিত্রে  নতুন একটি দেশ স্থান পেলো, যার নাম— 'বাংলাদেশ'। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্যস্ততা; দুইয়ে মিলে অভাব অভিযোগের অন্ত ছিল না। চতুর্দিকে শুধু হাহাকার আর হাহাকার, অভাব আর অভাব, অভিযোগ আর অভিযোগ। চুরিডাকাতি লেগেই থাকতো। এরই মাঝে শুরু হলো দেশ পুনর্ঘটনের কাজ। অনেককেই আজ অনেক বড় বড় কথা বলতে শুনি; কিন্তু সেদিনের সেই সময়টা ছিল 'এক নেতার এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ'। বঙ্গবন্ধু সেদিন যা'ই বলতেন তা'ই সবায় মেনে নিত। বয়স কম হলেও সেদিন কেন যেন আমার বেশ  খটকা লেগেছিল, মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধু মারাত্মক একটা ভুল কাজ করেছেন— যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে; যদিও সেই সাধারণ ক্ষমা সকল যুদ্ধাপরাধীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। তথাপি আমার কাছে আজও মনে হয় সেদিনের সেই ঘোষণার জন্যই স্বাধীনতাবিরোধীরা এতোটা সাহস পেয়েছিল এবং সংঘবদ্ধ হয়ে পুনরায় ষড়যন্ত্র করতে পেড়েছিল। সেদিন যদি রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু সকল রাজাকার, আল-সামস, আল-বদরকে হত্যার নির্দেশ দিতেন তবে হয়তো এদেশে আর কোন দিনও তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতো না, দেশেও দ্বিবিভক্তির সৃষ্টি করতে পারতো না। 

আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দের বিষয় এটাই যে আমি নিজ চোখে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর হতে দেখে যেতে পাড়লাম। মাননীয়া বঙ্গবন্ধু কন্যার এই দৃঢ়প্রত্যয় এ অসীম সাহসিকতার জন্য তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি ও চিরকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তিনি যুদ্ধাপরাধীর সেইদিনের ঝুলে থাকা বিচারের রায় আজ এতো বছর পর সম্পন্ন করে এক বিরল নজীর সৃষ্টি করে গেলেন। আমি নিশ্চিত— আগামী প্রজন্মের কাছে তিনি ইতিহাস হয়ে বেঁচে থাকবেন। আমি আরোও নিশ্চিত করে বলতে পারি সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পূর্ণ নিষ্পত্তি হলে, তাদের সাজা কার্যকর হলে একটা সময় এদেশের মানুষ কিছুটা হলেও শান্তিতে থাকতে পারবে; নয়তো প্রজন্ম পরম্পরায় এর খেসারত গুনতেই হবে। 

৭৪ বলতে শুধুই অভাব আর হাহাকার যারা বুঝে তারা একবারও ভেবে দেখে না সে সময়ের প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি। সেই বছর ও তার আগের বছরের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভয়াবহ বন্যা ও খরা দেশটাকে সম্পূর্ণভাবে উলটপালট করে দিয়েছিল। বন্যার পর খরায় সেই বছর ক্ষেতে মোটেও ফসল ফলেনি, ঘরে ভাত ছিল না। তাই সেই সময় কবিরা কবিতায় লেখতো - 'ভাত দে হারামজাদা, নয়তো মানচিত্র খাবো'। দূর্ভিক্ষে চতুর্দিকে মানুষ মরছে; খড়ের অভাবে গোয়ালে গরু মরে পরে আছে, ঘাসের অভাবে ছাগল-ভেড়া; মাঠেঘাটে পরে থাকতো মরা গরু ছাগল ভেড়ার পাল, শকুন সে'সব নিয়ে টানাটানি করতো। 

না! এতো অভাব অভিযোগের পরও বঙ্গবন্ধুর সময়োচিত পদক্ষেপে তা মনন্তরে রূপ নিতে পারেনি। সেইদিনের সেই অভাবের জন্য একপক্ষ একচেটিয়া শাসনব্যবস্থাকে দায়ী করে আসছে; আমি কিন্তু তা মোটেও মনে করি না। আমার মতে সেই দূর্ভিক্ষটা হয়েছিল কিছুটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ও বাকীটা তৈরি করা হয়েছিল বা অনেকটা জন্ম দেওয়া হয়েছিলো ষড়যন্ত্র করে। 

কি করে? 

যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন একটা দেশে অভাব অভিযোগ থাকাটা খুবই সাধারণ ও স্বাভাবিক ব্যাপার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি জাপানীরাও খাদ্যের অভাবে লতা-পাতা মরাপঁচা সাপ-ব্যাঙ সব কিছু খেয়ে জীবন বাঁচিয়েছে, জীবন রক্ষা করেছিল। আর আমরা কি করেছি? একদিকে যুদ্ধবিধস্ত দেশ তার উপর প্রতি বছর লেগে থাকা বন্যা ও খরায় একমাত্র উপার্জনক্ষম পণ্য পাটের উৎপাদন কমে যায়। তাই সোনালি আঁশ পাট রপ্তানিও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে জাসদ ও সর্বহারারা একের পর এক পাটের গুদামের পর গুদামে আগুন দিয়ে যায়! একদিকে বন্যা খরা অন্যদিকে পাট রপ্তানি থেমে যাওয়া। তাই সেদিন বঙ্গবন্ধু হাত পাততে বাধ্য হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিরোধীতা করা পরাশক্তি আমেরিকার কাছেও। খয়রাতি পিএল-৪৮০ কার্যক্রমের আওতায় দুইটি আমেরিকান জাহাজ খাদ্যশস্য বোঝাই করে ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনাও দিয়েছিল, তৈরি ছিল আরো দুইটি জাহাজ। এর মাঝেই ঢাকার মার্কিন দুতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে খবর গেলো, বাংলাদেশ কিউবার সঙ্গে পাটবিক্রির চুক্তি করেছে, দুইটি জাহাজে পাট বোঝাই করা হয়েছে। তথ্যটা একজন সচিব নিশ্চিত করেছিল। তিনি স্বশরীরে গিয়ে জাহাজের নাম ও পাটের পরিমাণসহ সমগ্র তথ্য মার্কিন দূতাবাসে জানিয়ে এসেছিলেন। 

যা হওয়ার তাই হলো, মাঝসাগরে ফেলে দেওয়া হলো বাংলাদেশের জন্য আনা দুই জাহাজ খাদ্যশস্য, বাকি দুই জাহাজ রওনা দিলো অন্য দিকে করাচির উদ্দেশ্যে। সেই যাত্রা বাংলাদেশ কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছিলো শুধুমাত্র রাশিয়া ও ভারতের তড়িৎ সাহায্যের জন্য। কিন্তু ততদিনে দেশে প্রচুর মানুষের প্রাণ চলে গেছে, মরে গেছে অনেকে। তাদের নিয়ে শুরু হয়েছিল আবার নতুন এক ষড়যন্ত্র  রাজনীতির। ১৯৭১ সালে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের পোস্টার থেকে ছবি নিয়ে সেটা চালানো হয়েছিল দূর্ভিক্ষের ছবি বলে। ওটা ধরিয়ে দেওয়ার পর এলো জাল পড়া বাসন্তী! বোবা বাসন্তীকে জাল পড়িয়ে ইত্তেফাকের আফতাব আহমেদ নতুন ছবি বানালো, সেই কুখ্যাত ছবিও একই ষড়যন্ত্র 'ষড়যন্ত্র-৭৪' এর অংশ ছিল; ছবি সুপারহিট! 'বাসন্তী' দেশবিদেশে ঝড় তুললো!

আফতাব আহমেদ এর মতো এমন কুলাঙ্গার আরো অনেক ছিল, যারা স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে গড়া নতুন নতুন কাহিনীর পরিচালক, যারা একের পর এক মিথ্যা কল্পকাহিনীর জন্ম দিতো; যা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে বিতর্কিত করা যায়। এ'সবের সবই ছিল মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল। 

অবশ্য পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত আমেরিকার কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশান এর ত্রৈমাসিক পত্রিকা 'ফরেন এ্যাফেরার্স' এর এক গবেষণামূলক নিবন্ধ থেকে সবই স্পষ্ট হয়ে যায়। সেখানে তারা বলেছিল— ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের কারণগুলো আসলে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের আয়ত্তাধীন ছিল না। ওই নিবন্ধে এমা রথসচাইল্ড বিচিত্র সব আমেরিকান সরকারের দলিলপত্র দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন এবং স্পষ্ট বলেছিলেন— ৭৪ এর দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের প্রায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্যে দায়ী ছিল প্রকৃতপক্ষে মার্কিন সরকার। 

জিয়া, এরশাদ, খালেদাজিয়া ও জামাত প্রায় একই সুরে একই কায়দায় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় নিয়ে এবং বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে বারংবার যতসব মিথ্যা কথা আওড়িয়ে গেছেন, অপপ্রচার চালিয়ে গেছেন এবং আজও যাচ্ছেন; যার পুরোটাই সম্পূর্ণভাবে অপপ্রচার এবং শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক অপকৌশল। ওইসব মিথ্যা অপপ্রচার শুনে শুনে আজ এদেশে একটা শ্রেণীই তৈরি হয়ে গেছে যারা প্রকৃত সত্যের ধারেকাছেও ঘেষতে চায় না, যায় না সত্য ইতিহাসের ধারেকাছেও। তারা সবায় মিথ্যাকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছে এবং তাই অন্তরে ধারণ করছে!

দেখতে দেখতে অনেক দিন অনেক বছর চলে গেল, দ্বিবিভক্ত এই জাতি এক কদম আগায় তো দুই কদম পিছায়। আর এ'সবের পিছনের কারণ সেই একই অপশক্তি স্বাধীনতাবিরোধী। আর কত? চোর সবসময়ই ছোটমনা থাকে, প্রকাশ্যে আসতে পারে না; আমরা ঐক্যবদ্ধ হলে তারা পিছু হটবেই। সময় এসেছে সত্য জানার, শুধরাবার এবং নিজ দেশটাকে ভালোবাসবার। 

৪৪তম বিজয় দিবসের ঊষালগ্নে আসুন আমরা সবায় মিলে শপথ করি, রাজাকার মুক্ত সুন্দর বাংলাদেশ গড়ি।। 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
১৬ - ১২ - ২০১৫.

1 টি মন্তব্য:

  1. যুদ্ধ দেখিনি ছোট ছিলাম,আমাদের সত‍্যটা জানা দরকার,সবার মাঝে ছরিয়ে দেওয়া হোক বিজয়ের আগের ও পরের সব ঘটনা।লিখাটা পড়ে তৃপ্তি পেলাম।আপনার জন‍্য👍✌🌺

    উত্তরমুছুন