হযরত নূহ (আঃ) ছিলেন হযরত আদম (আঃ)-এর অষ্টম অধস্তন প্রজন্ম। হাদিস ও তাফসীর থেকে জানা যায় - হযরত নূহ (আঃ) ও হযরত আদম (আঃ)-এর মধ্যবর্তী যুগ ছিল প্রায় এক হাজার বছর, অর্থাৎ তাঁদের দুনিয়ায় আসার সময়ের ব্যবধান ছিল প্রায় এক হাজার বছর। ঐ সময়ের মাঝেখানে পৃথিবীতে এসেছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ নবী ও রাসুল; যাঁর কথা আমরা অনেকেই জানি না বা অনেকে আবার নামও শুনিনি।
হযরত নূহ (আঃ)-এর সময়ে একবছর ব্যাপী মহাপ্লাবন এবং হযরত নুহ ( আঃ)-এর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা সম্বন্ধে কমবেশি আমাদের সমাজের সবার কিছুটা জানা আছে, আলেম সমাজ এই সব বিষয় নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা করেন, বিশেষ করে নুহ (আঃ)-এর সময়কার দীর্ঘ প্লাবন নিয়ে তাঁরা বেশ ব্যাপকভাবে আলোকপাত করেন। কিন্তু পবিত্র কুর'আনুল কারীমে বর্ণিত আরও অনেক পয়গম্বর-কে নিয়ে তাঁরা তেমন কিছুই বলেন না, তাই ওনাদের কথা সবার কাছে অজ্ঞাতই থেকে যায়; তেমন একটা জানাও হয়ে উঠে না। আজ আমি তেমনই অজানা অচেনা একজন পয়গম্বরকে নিয়ে কিছু লিখার প্রত্যাশা রাখছি।
গণিতবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষাকে আজকাল অনেক আলেমই অবজ্ঞা করেন, এমনকি এ'সবকে কুফরি শিক্ষা নাস্তিকদের শিক্ষা হিসেবে আখ্যায়িত করেন! না জেনে না বুঝে ব্যঙ্গ করে গণিতবিদ বা জ্যোতির্বিদদের নামে মিথ্যা ফতোয়া দিয়ে বসেন; এ'সব আসলে তাদের অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। আজ আমি গণিত বিদ্যা কি করে পৃথিবীতে আবির্ভূত হলো তার ইতিহাস তুলে ধরে দু'চার কথা লিখতে চেষ্টা করবো। প্রত্যাশা করছি অন্ততঃ দু'চার জন হলেও এ লেখা পড়বেন এবং হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করবেন, তবেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সার্থক হবে। আপনারা হয়তো অনেকেই হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর নাম পর্যন্ত শোনেননি বা চিনেন না জানেন না। তাই গণিতের জন্মকথা বলার আগে পবিত্র কোর'আন ও হাদিসের আলোকে হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের কিছুটা তুলে ধরছি।
সূরা মারইয়ামে উল্লেখ করা হয়েছে, "এই গ্রন্থে উল্লেখিত ইদ্রিসের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, সে ছিল সত্যবাদী নবী। আমি তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি।" এই আয়াতের তাফসীর থেকে জানা যায়, এখানে ইদ্রিস (আঃ)-এর কথা বর্ণনা করা হয়েছে; তিনি ছিলেন একজন সত্য নবী এবং আল্লাহ তা'আলার একজন বিশিষ্ট বান্দা। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন।
হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণিত আছে মেরাজ গমনকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের সাথে হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর সাক্ষাত ঘটেছিল। এ নিয়ে ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) একটি অতি বিস্ময়কর হাদীস তুলে ধরেছেন - তিনি বলেন, ইবনে আব্বাস (রাঃ) কা'আব ( রাঃ)-কে "ওয়ারাফ'না মাকা-নান আলিয়্যা" - আয়াতের ভাবার্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেন, "আল্লাহ তা'আলা হযরত ইদ্রিস (আঃ)-কে ওহী করেন - 'আদম সন্তানের আমলের সমান তোমার একার আমল আমি প্রতিদিন উঠিয়ে থাকি। কাজেই আমি পছন্দ করি যে, তোমার আমল বৃদ্ধি পাক।' অতঃপর তাঁর নিকট একজন বন্ধু ফেরেশতা আগমন করলে তিনি তাঁর কাছে বলেন - 'আমার নিকট ওহী এসেছে; অতএব আপনি মৃত্যুর ফেরেশতাকে বলে দিন তিনি যেন একটু দেরি করে আমার জান কবজ করেন, যাতে আমার আমল বৃদ্ধি পায়।'"
ঐ বন্ধু ফেরেশতা তখন তাঁকে নিজের পালকের উপর বসিয়ে নিয়ে আকাশে উঠে যান এবং চতুর্থ আসমানে গিয়ে মালাকুল মাউত ফেরেশতার সাক্ষাত পান। ঐ ফেরেশতা মালাকুল মাউত ফেরেশতাকে হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর ব্যাপারে সুপারিশ করলে মৃত্যুর ফেরেশতা বন্ধু ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করেন, "তিনি কোথায় আছেন?"
উত্তরে বন্ধু ফেরেশতা বলেন, "এই তো তিনি আমার পালকের উপর বসে আছেন।"
মৃত্যুর ফেরেশতা তখন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, "সুবহানাল্লাহ! আমাকে এখনই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি যেন ইদ্রিস (আঃ) এর রুহ চতুর্থ আসমান থেকে কবয করি। কিন্তু আমি চিন্তা করছিলাম - ইদ্রিস (আঃ) তো আছেন জমিনে, চতুর্থ আসমান থেকে তাঁর রুহ কবয করবো কিভাবে?"
অতঃপর তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর ফেরেশতা হযরত ইদ্রিস (আঃ) রুহ কবয করে নেন। উক্ত রেওয়াতটিই অন্য এক সনদে এভাবে এসেছে - হযরত ইদ্রিস (আঃ) বন্ধু ফেরেশতার মাধ্যমে মালাকুল মাউত ফেরেশতাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, "আমার হায়াত আর কত দিন বাকী আছে?" অন্য আর এক হাদিসে আছে তাঁর এই প্রশ্নের উত্তরে মালাকুল মাউত বলেছিলেন, "আমি লক্ষ্য করছি, চক্ষুর একটা পলক ফেলার সময় মাত্র বাকী আছে।"
বন্ধু ফেরেশতা তাঁর পলকের নিচে তৎক্ষণাৎ তাকিয়ে দেখেন, হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর জান এরই মধ্যে কবয করা হয়ে গেছে।
হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন - হযরত ইদ্রিস (আঃ)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, তিনি মৃত্যুবরণ করেননি, বরং তাঁকে হযরত ঈসা (আঃ)-এর মতো জীবিত উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আউফী (রঃ)-এর রিওয়াতের মাধ্যমে ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে - হযরত ইদ্রিস (আঃ)-কে ষষ্ঠ আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল, আর সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
হযরত ইদ্রিস (আঃ) হযরত নূহ (আঃ)-এর পূর্ববতী নবী ছিলেন। তিনি ছিলেন হযরত নূহ (আঃ)-এর দাদা এবং হযরত হাবিল (আঃ)-এর বংশধর। মেরাজের হাদিসে বর্ণিত আছে হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর সাথে হযতর মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের সাক্ষাতের সময় তাঁকে তিনি উত্তম নবী ও উত্তম ভাই বলে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। —[মূস্তাদরাক হাকীম]
হযরত আদম (আঃ)-এর পর তিনিই সর্ব প্রথম পূর্ণাঙ্গ নবী ও রাসুল; যাঁর প্রতি আল্লাহ রাব্বুল তা'আলামিন ত্রিশটি সহীফা নাযিল করেন। হযরত ইদ্রিস (আঃ) সর্ব প্রথম মানব যাঁকে মু'জিযা হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও অংকবিজ্ঞান দান করা হয়েছিল। —[বাহরে মুহীত]
তিনিই প্রথম মানব যিনি কলমের দ্বারা লিখা ও কাপড় সেলাই আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর পূর্বে সাধারণতঃ মানুষ পোশাকের পরিবর্তে পশুর চামড়া বা গাছের পাতা বা ছাল ব্যবহার করতো। ওজন ও পরিমাপ পদ্ধতি সর্বপ্রথম তিনিই আবিষ্কার করেন এবং আস্ত্র-শস্ত্রের আবিষ্কারও তাঁর আমল থেকেই শুরু হয়। তিনিই অস্ত্র তৈরি করে তা দিয়ে কাবীল গোত্রের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন।
সর্ব বিবেচনায় এখন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিত হলো আল্লাহর তরফ থেকে আসা ঐশী বাণী। এখন আপনারাই বলেন যারা গণিতবিদ বা জ্যোতির্বিদদেরকে নাস্তিক বলে উপহাস করেন তারা কোথায় কি অবস্থায় আছেন? তাদের জ্ঞানের গভীরতাই-বা কতটুকো?
বিখ্যাত মুসলিম মনীষী এবং একজন তা'বে তা'বেঈ মূসা আল খায়েরী যামী আজকের আধুনিক গণিত শাস্ত্র তথা বীজগণিতের জনক। এ ছাড়াও অনেক মুসলিম মনীষীই গণিতের বিভিন্ন শাখাকে উদ্ভাসিত করে গেছেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় মুসলিম মনীষীদের অবদান অনস্বীকার্য। অথচ আজকের আলেম সমাজ ফতোয়া দিয়ে বেড়াচ্ছেন বা বেড়ায় গণিত নাস্তিকদের বিদ্যা(!), জ্যোতির্বিদ্যা নাস্তিকদের বিদ্যা(!), বিজ্ঞান যারা পড়ে তারা নাস্তিক(!); অজ্ঞতাই আজকের মুসলিম সমাজের প্রথম এবং প্রধান প্রতিবন্ধকতা। অথচ এক সময় এই মুসলমানদের জ্ঞান প্রজ্ঞায়ই সাড়া পৃথিবী উদ্ভাসিত হতো এবং হয়েছে; এক কথায় বললে বলা যায়— মুসলিমদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও গরিমার কাছে অন্যান্য জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠীর জ্ঞান-গরিমা ছিল নস্যি।
কিন্তু আজকের আলেমরা করছেন কি? বেহেস্ত আর দোযখের বর্ণনা ছাড়া তাদের মুখে অন্য কোন কিছুই রোচে না। দুনিয়ায় বিচরণের নিয়ম কানুন এক সময় মুসলিম আলেমগণই শিক্ষা দিতেন, শিক্ষা দিতেন দুনিয়াই আখেরাতের চারণক্ষেত্র; দুনিয়ার বিখ্যাত সব বিদ্যাপীঠ মুসলিমদেরই হাতে গড়া। মুসলিম সমাজকে তথা সমগ্র দুনিয়াকে সুন্দর ও সঠিক পথের সন্ধান দিতেন মুসলিম আলেমগণই।
পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ভুলে আজকের আলেমরা আছেন শুধু ফতোয়া আর ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের ধান্দা নিয়ে; নিজ স্বার্থ ও মতের এতটুকো ব্যত্যয় ঘটলেই অন্যের বিরুদ্ধে তারা ফতোয়া দিয়ে বসেন, এক আলেম অন্য আলেমকে নিয়ে যা-তা মন্তব্য করে বসেন; সাধারণের সাথে কি করেন সে কথা না হয় বাদই দিলাম। এইসব দেখেশুনে ওদের থেকে শিক্ষা নিয়ে মুসলিম আজ শতধা বিভক্ত, পুরো সমাজ তচনচ হয়ে গেছে। পৃথিবীর প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রের দিকে তাকালে এই একই দৃশ্য গোচরীভূত হয়।
মসজিদের নগরী হিসেবে ঢাকা পৃথিবী বিখ্যাত এবং সমগ্র বাংলাদেশেটাই মসজিদে ছেঁয়ে আছে ছেঁয়ে গেছে। যেখানেই যতটুকো অবৈধ জায়গা পাওয়া যায়, সেই জায়গাটুকোই দখল করে গড়ে তোলা হয় মসজিদ বা মাদ্রাসা। এক জঘন্য প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণ কাজের; গড়ে তোলা হয় বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা, আলিশান সব কাঠামো আর সৌখিন সব ইতালিয়ান আমেরিকান বা জাপানী ইহুদী খ্রিষ্টানদের উপঢৌকন দেয়া টাইলস দিয়ে মসজিদ সাজানোর কাজ। জায়গার সত্ত্ব উৎস বা অর্থ যোগান উৎসের চিন্তা করার কারো কোন বালাই নেই, এ'সব কোন কিছুই বিবেচনায় নেয়া হয় না বা বিবেচ্য বিষয় হিসেবে ধরা হয় না!
দেশে আজ মসজিদের অভাব নেই, নেই মুসল্লিরও অভাব; আবার মসজিদে জুতা চোরেও অভাব নেই! মুসলিম সমাজ আজ এক ধরনের অন্ধত্ব ও জান্নাতি অহংবোধে এক মিথ্যা মরীচিকার পিছু ছুটছে; জান্নাত পাওয়ার আশায় কেউ-বা আবার জঘন্য পাপ মানুষ হত্যার কাজেও লিপ্ত হচ্ছে। চোগলখোরি, মোনাফেকি, পরশ্রীকাতরতা, চোরাকারবারি, সুদখোরি, ঘুষখোরি এই সব বদ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি এখন মুসলমাদের মাঝেই বেশি পরিলক্ষিত হয়। এসব করে জান্নাতের প্রত্যাশা অবান্তর নয় কি? হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-এর অমর একটি বাণী এই মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি- "প্রস্রাব দিয়ে কাপড় দৌত করে যেমন কাপড়ের পবিত্রতা আনয়ন করা যায় না, তদ্রূপ হারাম উপার্জিত পয়সা দিয়ে দানখয়রাতও ইহকাল ও পরকালের অকল্যাণ বৈ কল্যাণ বয়ে আনে না আনতে পারে না।"
জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা আজকাল মুসলিম সমাজ থেকে যেন উঠেই গেছে; সন্দেহ প্রবনতা ও পরশ্রীকাতরতা থেকে জন্ম নেয়া হিংসা বিদ্বেষ আর খুনাখুনি আজ সমগ্র মুসলিম জাহানের প্রতিটি সমাজের সামাজিক চিত্র; কোথাও শান্তি নেই। অথচ 'ইসলাম' বলতেই আমরা সবাই বুঝি 'শান্তি'; একজন মুসলিম হিসেবে অনেকে যথেষ্ট অহংবোধও করি(!)। কিন্তু, কোথায় শান্তি?
আত্ম অহংকার করার মতো বা অহংবোধ করার মতো আমরা কিছু করি কি? শান্তি নেই ঘরে, শান্তি নেই বাইরে; শান্তি নেই আমাদের সমাজে, শান্তি নেই দেশজুড়ে; শান্তি নেই আরবে, শান্তি নেই পারস্যে; শান্তি নেই প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে, শান্তি নেই কোথাও! তাহলে কবরে গিয়ে কি শান্তি পাবো? এমন মোনাফেকি করে?
সে শুধুই এক অবান্তর কল্পনা।।
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২২-১-২০১৫.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন