শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০

প্রোপাগাণ্ডার পরিসমাপ্তি কবে হবে?

মুক্তিযুদ্ধ ও তদপরবর্তী সময়, বিশেষ করে ৭৪/৭৫ নিয়ে এদেশের তরুণ প্রজন্মের একাংশের মাঝে এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হয়েছে, যা করা হয়েছে অত্যন্ত কূটকৌশলে;  যা পড়ে জেনে আজকের তরুণতরুণীর অনেকে এরই মাঝে বিভ্রান্তির অতলে তলিয়ে গেছে। তাদের মনে এমনসব ভ্রান্ত ধারণা জন্ম নেয়ার পিছনের বহুবিদ কারণের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে - গুগোল সার্চে ঐ সময়কার সঠিক তথ্য সম্বলিত সামাজিক চিত্র বা ইতিহাস তুলে ধরে লেখালেখি তারা খুব কমই পেয়েছে, পায়; বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের পক্ষের লেখার চেয়ে বিরুদ্ধে লেখা  তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পাওয়া যায়, পাচ্ছে এবং দেখেছে, পড়ছে। তারা যা বা যতোটুকোই লেখা পাচ্ছে বা দেখেছে তার প্রায় সবটাই ৭৫ পরবর্তীতে তৈরি করা স্বাধীনতাবিরোধীদের লেখা, তাদের হাতে গড়া এক ধরনের মিথ্যার পাণ্ডুলিপি; অথবা তৎকালীন সময়ে তৈরী করা এক ধরনের নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা, যা ছিল বেশিরভাগই প্রোপাগাণ্ডা। 

আজকের তরুণতরুণীরা অনেকটাই অনলাইন নির্ভর। তারা যা বা যতটুকো পড়ে তার সবটাই অনলাইনে পড়তে চায় জানতে চায়; পবিত্র কোর'আন পড়লেও তারা তা অনলাইনে পড়ে! গল্প ইতিহাস উপন্যাস কবিতা সাহিত্য সব সবকিছুই তারা অনলাইন থেকে পড়তে চায় জানতে চায়; এক কথায় দিনদিন তারা অনেকটাই অনলাইনের উপর নির্ভরশীল ও বিশ্বাসী হয়ে পড়ছে। তাই অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মিথ্যা ইতিহাস পড়ে পড়ে তা-ই তারা ধারণ করছে। অনেক চিন্তা করে আমি আবিষ্কার করেছি সেই সব মিথ্যা অপপ্রচার এখন অনেকেই বিশ্বাস করছে এবং তা নিয়ে মেতেও আছে। 

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের যেসব ঘটনা অনলাইন জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার সবটাই প্রায় এক ধরণের মিথ্যা অপপ্রচার। ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ ও পূর্ববর্তী সময়গুলোকে তারা বলতে চায় বঙ্গবন্ধুর কুশাসনের ফসল। বলার কারণ, ওইসব একচেটিয়া একমুখী লেখালেখি। কখনো ওরা এর পিছনের গভীর ষড়যন্ত্রের কথা চিন্তাও করেনি; যা স্বাধীনতার পর থেকেই করা হয়েছে এবং চলে আসছে। অনেক খুঁজে আমি একটি জিনিস আবিষ্কার করেছি— এইসব লেখালেখি হয়তো স্বাধীনতাবিরোধীদের কারো না কারো, নয়তো তাদের পয়সায় বিক্রি হওয়া কোন বুদ্ধিব্যবসায়ীর মনগড়া সব পাণ্ডুলিপি। অনলাইনে এখনো মুক্তিযুদ্ধের অনেক নেতিবাচক বানানো গল্প বসে আছে বা ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। এইসব পড়ে পড়ে তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ প্রতিনিয়ত নতুনভাবে বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হচ্ছে এবং সেই সব বিভ্রান্তিতেই মেতে আছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বেকার প্রজন্ম আমরা যারা কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছি নিশ্চয় এসব দেখে আমাদের কষ্ট হয়, কিন্তু কিছুই করার নেই; এই সব দেখারও যেন কেউ নেই। 

হে আজকের তরুণ প্রজন্ম, তোমরা একটু ভাল করে ভেবে দেখো দেশ শাসন করার মতো কতোটা সময় পেয়েছিলেন জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান? দেশ গঠন করা বা গড়ার মতো কতটুকো সময় তিনি পেয়েছিলেন? যুদ্ধবিধ্যস্ত একটা দেশ ও জাতি ৩/৪ বছরে পুনর্গঠিত করা যায় কি করে বা তা কি করে সম্ভব? সময়ের আগেই তো বপন করা হয়ে গিয়েছিল গভীর এক ষড়যন্ত্রের বীজ, শুরু হয়ে গিয়েছিল তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র। তারা খুব ভাল করেই জানতো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে না পারলে তারা কোনদিনও এদেশে সুবিধা করতে পারবে না; তাই তিনিই তাদের প্রথম টার্গেট হন। যুদ্ধাপরাধীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা শোনার পর দেশবিদেশে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে এবং কিছু অতিলোভী মুক্তিযুদ্ধাকেও তাদের দলভুক্ত করে নেয়। ১৫ আগস্ট ৭৫ তারা ষোলকলা পূর্ণ করে জাতিরজনককে হত্যার মাধ্যমে। 

এই তো, মনে হয় যেন সেই দিন; কত কঠিনই-না ছিল আমাদের সেই পথচলা। বিশেষ করে ৭০ এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর পরবর্তী দিনগুলো। মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়গুলোকে বিতর্কিত করার দূরঅভিসন্ধি নিয়ে আজ যারা এর পিছনে কলকাঠি নাড়ছে তারাই সেইদিন গোপনে অথবা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল। আজ যেমন যুদ্ধাপরাধীর বিচার সময়ের দাবী, সেদিন স্বাধীনতাও ছিল সময়ের দাবী। 

১২ নভেম্বর ১৯৭০, উপকূলীয় এলাকায় ঘটে গিয়েছিল দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং প্রলয়ঙ্করী এক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস; সমগ্র উপকূলবাসীর জন্য সেই দিনটি ছিল এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের দিন। দীর্ঘ ৪৫ বছর কেটে গেলেও স্বজনহারা মানুষ সেদিনের কথা আজও ভুলতে পারেনি। সেদিন পূর্ব পাকিস্থানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সম্পূর্ণ লণ্ডভণ্ড হয়ে শুধু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসটি ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে গিয়েছিল, প্রায় সমগ্র দেশটাকে তচনচ করে ফেলেছিল। 

যতটুকো মনে পরে সেই দিনটি ছিল রোজার দিন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিসহ সারাদিন সারাদেশে টানা বাতাস বইছিল। রাতে উপকূলের উপর দিয়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটারের উপর বেগে বয়ে যায় এক প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস; শুধু রেখে যায় রাশিরাশি ধ্বংসযজ্ঞ। বহু মানুষ সেদিন তাদের প্রিয়জনের লাশও খুঁজে পায়নি। জলোচ্ছ্বাসের পর থেকে দেড় মাস পর্যন্ত স্বজনহারাদের কান্নায় উপকূলের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে গিয়েছিল। গত ৪ দশকে পৃথিবীর এই অঞ্চলে যতক'টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে তার সবক'টির চেয়ে ওই ঝড়টি ছিল সবচেয়ে বেশি হিংস্র ও মারাত্মক। 

৭০-এর 'হারিকেন'রূপী ওই ঝড়টি উপকূলীয় ভোলা, বরিশাল, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনাসহ দেশের প্রায় ১৮টি জেলাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি আজকের মতো এতোটা শক্তিশালী ছিল না, অনেকটা দুর্বল থাকায় উপকূলের অনেক মানুষই ঝড়ের পূর্বাভাস জানতে পারেনি শুনতে পায়নি। তাই হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল কল্পনাতীত। ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাস ছিল ৮ থেকে ১০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। কেউ-বা গাছের ডালে কেউ-বা উঁচু ছাদে আশ্রয় নিয়ে কোনোমতে প্রাণে রক্ষা পেলেও ৩/৪ দিন তাদের অভুক্তই কাটাতে হয়েছিল।  

পরবর্তীতে জানা যায় ১২ নভেম্বর রাতের সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার বা ১৩৮ মাইল। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ, বাতাসে মানুষপঁচা গন্ধ। ৩ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়াতে মৃতদেহগুলো দাফন করাও সম্ভব ছিল না। আর করবেই-বা কে? সে সময় দুর্গত অঞ্চলে পৌঁছানো এতো সহজ ছিল না। তদানীন্তন পাকিস্থান সরকার নুন্যতম খোঁজখবরটুকো পর্যন্ত নেয়নি। সেদিনের ঝড়ে কত মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল তার সঠিক হিসাব অদ্যাবধি জানা না গেলেও উপকূলীয় অঞ্চলের ৮৭% ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং তিন চার মাস পরেও ৫২.৪% মানুষ গৃহহীন অবস্থায় জীবন যাপন করেছিল। ধারণা করা হয় সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে লাখ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। ঘটনার দুই দিন পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কর্তাব্যক্তিরা দুর্গত অঞ্চলের খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে কেন যেন তাও বন্ধ হয়ে যায় বা করে দেয়। বিদেশী সংবাদ কর্মীদেরও তখন দুর্গত অঞ্চল পরিদর্শনে যেতে দেয়া হয়নি, বরং তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। 

জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাসানীসহ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের এ অঞ্চলের অনেকে অনেক কষ্ট করে তৎক্ষণাৎ উপদ্রুত এলাকায় দুর্গত মানুষের পাশে ছুটে গিয়েছিলেন, সার্বিক অবস্থা দেখে সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে শুধু কেঁদেছিলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু ও ভাসানী যে যার মতো করে সবাইকে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছিলেন। সেই সময়ের পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খান একটি বারের জন্যও বাংলার স্বজনহারা মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়নি, এমনকি নুন্যতম খোঁজখবরটুকো পর্যন্ত নেননি। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ সেই ধ্বংসযজ্ঞের পূর্ণাঙ্গ দলিল অদ্যাবধি সুস্পষ্টভাবে কোথাও লিখা হয়নি বা প্রকাশিত হয়নি। 

৭০-এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের রেষের মাঝেই শুরু হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। অনেকে বলে বঙ্গবন্ধু সেদিন স্বাধীনতা চান নি, চেয়েছিলেন স্বায়ত্তশাসন। মিথ্যা কথা, ভুল ধারণা; সেদিন  পূর্বাঞ্চলের প্রতিটা মানুষের হৃদয়ের দাবী ও কামনা ছিল স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের নেতা ছিলেন, তিনি প্রতিটি মানুষের পার্লস খুব ভাল করেই বুঝতেন। পরিবেশ পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতা আমাদের যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। যুদ্ধের ইতিহাস সবারই কমবেশি জানা থাকলেও, এর নিকট অতীত ও নিকট ভবিষ্যৎ অনেকের কাছে আজও অজানা; আর সেই সুযোগটাই গ্রহণ করেছে স্বাধীনতাবিরোধীরা। নিজেদের ইচ্ছেমত লিখে তা তারা অনলাইনে ছেড়ে দিয়েছে এবং প্রজন্ম পরম্পরায় মিস গাইড করেছে করছে। 
দেশজুড়ে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা বিরাজ করছিল তারই মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়। নয় মাসের সেই ভয়াবহ সময়ের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সঠিক অনেক ইতিহাস ও পূর্ণাঙ্গ দলিল থাকলেও পরবর্তী সময় নিয়ে এদেশে একটা ঘোলাটে অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছিল, আর এর পিছনে যাদের হাত ছিল তারা হলো মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি। যারা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে স্বাধীনতার আগে ও পরে এবং এখনও করেই যাচ্ছে! 

নয় মাসের দুঃস্বপ্ন বিভীষিকাময় যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো, পৃথিবীর মানচিত্রে  নতুন একটি দেশ স্থান পেলো, যার নাম— 'বাংলাদেশ'। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্যস্ততা; দুইয়ে মিলে অভাব অভিযোগের অন্ত ছিল না। চতুর্দিকে শুধু হাহাকার আর হাহাকার, অভাব আর অভাব, অভিযোগ আর অভিযোগ। চুরিডাকাতি লেগেই থাকতো। এরই মাঝে শুরু হলো দেশ পুনর্ঘটনের কাজ। অনেককেই আজ অনেক বড় বড় কথা বলতে শুনি; কিন্তু সেদিনের সেই সময়টা ছিল 'এক নেতার এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ'। বঙ্গবন্ধু সেদিন যা'ই বলতেন তা'ই সবায় মেনে নিত। বয়স কম হলেও সেদিন কেন যেন আমার বেশ  খটকা লেগেছিল, মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধু মারাত্মক একটা ভুল কাজ করেছেন— যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে; যদিও সেই সাধারণ ক্ষমা সকল যুদ্ধাপরাধীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। তথাপি আমার কাছে আজও মনে হয় সেদিনের সেই ঘোষণার জন্যই স্বাধীনতাবিরোধীরা এতোটা সাহস পেয়েছিল এবং সংঘবদ্ধ হয়ে পুনরায় ষড়যন্ত্র করতে পেড়েছিল। সেদিন যদি রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু সকল রাজাকার, আল-সামস, আল-বদরকে হত্যার নির্দেশ দিতেন তবে হয়তো এদেশে আর কোন দিনও তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতো না, দেশেও দ্বিবিভক্তির সৃষ্টি করতে পারতো না। 

আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দের বিষয় এটাই যে আমি নিজ চোখে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর হতে দেখে যেতে পাড়লাম। মাননীয়া বঙ্গবন্ধু কন্যার এই দৃঢ়প্রত্যয় এ অসীম সাহসিকতার জন্য তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি ও চিরকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তিনি যুদ্ধাপরাধীর সেইদিনের ঝুলে থাকা বিচারের রায় আজ এতো বছর পর সম্পন্ন করে এক বিরল নজীর সৃষ্টি করে গেলেন। আমি নিশ্চিত— আগামী প্রজন্মের কাছে তিনি ইতিহাস হয়ে বেঁচে থাকবেন। আমি আরোও নিশ্চিত করে বলতে পারি সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পূর্ণ নিষ্পত্তি হলে, তাদের সাজা কার্যকর হলে একটা সময় এদেশের মানুষ কিছুটা হলেও শান্তিতে থাকতে পারবে; নয়তো প্রজন্ম পরম্পরায় এর খেসারত গুনতেই হবে। 

৭৪ বলতে শুধুই অভাব আর হাহাকার যারা বুঝে তারা একবারও ভেবে দেখে না সে সময়ের প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি। সেই বছর ও তার আগের বছরের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভয়াবহ বন্যা ও খরা দেশটাকে সম্পূর্ণভাবে উলটপালট করে দিয়েছিল। বন্যার পর খরায় সেই বছর ক্ষেতে মোটেও ফসল ফলেনি, ঘরে ভাত ছিল না। তাই সেই সময় কবিরা কবিতায় লেখতো - 'ভাত দে হারামজাদা, নয়তো মানচিত্র খাবো'। দূর্ভিক্ষে চতুর্দিকে মানুষ মরছে; খড়ের অভাবে গোয়ালে গরু মরে পরে আছে, ঘাসের অভাবে ছাগল-ভেড়া; মাঠেঘাটে পরে থাকতো মরা গরু ছাগল ভেড়ার পাল, শকুন সে'সব নিয়ে টানাটানি করতো। 

না! এতো অভাব অভিযোগের পরও বঙ্গবন্ধুর সময়োচিত পদক্ষেপে তা মনন্তরে রূপ নিতে পারেনি। সেইদিনের সেই অভাবের জন্য একপক্ষ একচেটিয়া শাসনব্যবস্থাকে দায়ী করে আসছে; আমি কিন্তু তা মোটেও মনে করি না। আমার মতে সেই দূর্ভিক্ষটা হয়েছিল কিছুটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ও বাকীটা তৈরি করা হয়েছিল বা অনেকটা জন্ম দেওয়া হয়েছিলো ষড়যন্ত্র করে। 

কি করে? 

যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন একটা দেশে অভাব অভিযোগ থাকাটা খুবই সাধারণ ও স্বাভাবিক ব্যাপার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি জাপানীরাও খাদ্যের অভাবে লতা-পাতা মরাপঁচা সাপ-ব্যাঙ সব কিছু খেয়ে জীবন বাঁচিয়েছে, জীবন রক্ষা করেছিল। আর আমরা কি করেছি? একদিকে যুদ্ধবিধস্ত দেশ তার উপর প্রতি বছর লেগে থাকা বন্যা ও খরায় একমাত্র উপার্জনক্ষম পণ্য পাটের উৎপাদন কমে যায়। তাই সোনালি আঁশ পাট রপ্তানিও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে জাসদ ও সর্বহারারা একের পর এক পাটের গুদামের পর গুদামে আগুন দিয়ে যায়! একদিকে বন্যা খরা অন্যদিকে পাট রপ্তানি থেমে যাওয়া। তাই সেদিন বঙ্গবন্ধু হাত পাততে বাধ্য হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিরোধীতা করা পরাশক্তি আমেরিকার কাছেও। খয়রাতি পিএল-৪৮০ কার্যক্রমের আওতায় দুইটি আমেরিকান জাহাজ খাদ্যশস্য বোঝাই করে ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনাও দিয়েছিল, তৈরি ছিল আরো দুইটি জাহাজ। এর মাঝেই ঢাকার মার্কিন দুতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে খবর গেলো, বাংলাদেশ কিউবার সঙ্গে পাটবিক্রির চুক্তি করেছে, দুইটি জাহাজে পাট বোঝাই করা হয়েছে। তথ্যটা একজন সচিব নিশ্চিত করেছিল। তিনি স্বশরীরে গিয়ে জাহাজের নাম ও পাটের পরিমাণসহ সমগ্র তথ্য মার্কিন দূতাবাসে জানিয়ে এসেছিলেন। 

যা হওয়ার তাই হলো, মাঝসাগরে ফেলে দেওয়া হলো বাংলাদেশের জন্য আনা দুই জাহাজ খাদ্যশস্য, বাকি দুই জাহাজ রওনা দিলো অন্য দিকে করাচির উদ্দেশ্যে। সেই যাত্রা বাংলাদেশ কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছিলো শুধুমাত্র রাশিয়া ও ভারতের তড়িৎ সাহায্যের জন্য। কিন্তু ততদিনে দেশে প্রচুর মানুষের প্রাণ চলে গেছে, মরে গেছে অনেকে। তাদের নিয়ে শুরু হয়েছিল আবার নতুন এক ষড়যন্ত্র  রাজনীতির। ১৯৭১ সালে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের পোস্টার থেকে ছবি নিয়ে সেটা চালানো হয়েছিল দূর্ভিক্ষের ছবি বলে। ওটা ধরিয়ে দেওয়ার পর এলো জাল পড়া বাসন্তী! বোবা বাসন্তীকে জাল পড়িয়ে ইত্তেফাকের আফতাব আহমেদ নতুন ছবি বানালো, সেই কুখ্যাত ছবিও একই ষড়যন্ত্র 'ষড়যন্ত্র-৭৪' এর অংশ ছিল; ছবি সুপারহিট! 'বাসন্তী' দেশবিদেশে ঝড় তুললো!

আফতাব আহমেদ এর মতো এমন কুলাঙ্গার আরো অনেক ছিল, যারা স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে গড়া নতুন নতুন কাহিনীর পরিচালক, যারা একের পর এক মিথ্যা কল্পকাহিনীর জন্ম দিতো; যা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে বিতর্কিত করা যায়। এ'সবের সবই ছিল মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল। 

অবশ্য পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত আমেরিকার কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশান এর ত্রৈমাসিক পত্রিকা 'ফরেন এ্যাফেরার্স' এর এক গবেষণামূলক নিবন্ধ থেকে সবই স্পষ্ট হয়ে যায়। সেখানে তারা বলেছিল— ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের কারণগুলো আসলে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের আয়ত্তাধীন ছিল না। ওই নিবন্ধে এমা রথসচাইল্ড বিচিত্র সব আমেরিকান সরকারের দলিলপত্র দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন এবং স্পষ্ট বলেছিলেন— ৭৪ এর দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের প্রায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্যে দায়ী ছিল প্রকৃতপক্ষে মার্কিন সরকার। 

জিয়া, এরশাদ, খালেদাজিয়া ও জামাত প্রায় একই সুরে একই কায়দায় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় নিয়ে এবং বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে বারংবার যতসব মিথ্যা কথা আওড়িয়ে গেছেন, অপপ্রচার চালিয়ে গেছেন এবং আজও যাচ্ছেন; যার পুরোটাই সম্পূর্ণভাবে অপপ্রচার এবং শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক অপকৌশল। ওইসব মিথ্যা অপপ্রচার শুনে শুনে আজ এদেশে একটা শ্রেণীই তৈরি হয়ে গেছে যারা প্রকৃত সত্যের ধারেকাছেও ঘেষতে চায় না, যায় না সত্য ইতিহাসের ধারেকাছেও। তারা সবায় মিথ্যাকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছে এবং তাই অন্তরে ধারণ করছে!

দেখতে দেখতে অনেক দিন অনেক বছর চলে গেল, দ্বিবিভক্ত এই জাতি এক কদম আগায় তো দুই কদম পিছায়। আর এ'সবের পিছনের কারণ সেই একই অপশক্তি স্বাধীনতাবিরোধী। আর কত? চোর সবসময়ই ছোটমনা থাকে, প্রকাশ্যে আসতে পারে না; আমরা ঐক্যবদ্ধ হলে তারা পিছু হটবেই। সময় এসেছে সত্য জানার, শুধরাবার এবং নিজ দেশটাকে ভালোবাসবার। 

৪৪তম বিজয় দিবসের ঊষালগ্নে আসুন আমরা সবায় মিলে শপথ করি, রাজাকার মুক্ত সুন্দর বাংলাদেশ গড়ি।। 

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
১৬ - ১২ - ২০১৫.

বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০২০

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স:

স্যার, এই করোনায় চাকরিজীবী যেগুলি শয়তান.....তারা তো দেশের উন্নয়নের টাকা আত্মসাৎ করে করে কোটিপতি হয়ে গেলো.....মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটুখানি ঝাঁকি দিলেই লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বের হয়ে আসতো....যা দিয়ে বাংলাদেশ ১০০ বছর এগিয়ে যেতো.....যত করোনা তত আত্মসাৎ.... কিছু অজাতের হাতে অফিস আদালত জিম্মি হয়ে যাচ্ছে......যে কর্মকর্তা/কর্মচারী, তারাই আবার ঠিকাদার.....একই স্কুলের বেঞ্চের বিল কতবার যে উত্তোলন  হচ্ছে...... আমার চোখ কামড়ায়...... কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারিনা.....

কোন রাখঢাক না করে সরকারি অফিসে  চাকুরী করা আমার এক বোনের কিছু অসমাপ্ত কথা দিয়েই আজ লিখার সূচনা করলাম। নিশ্চয় এতটুকুতেই পুরো  বাংলাদেশের অফিস-আদালতের দুর্নীতির সার্বিক চিত্র সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।  শুধুই কি অফিস-আদালতে দুর্নীতি হয়? দুর্নীতি এখন কোথায় নেই, কোথায় হচ্ছে না? আমার তো মনে হয় আমাদের অস্থিমজ্জা সব সবকিছুই এখন দূর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মাছওয়ালা মাছে ভেজাল করে মাছ বেচে শাক কিনে, শাকওয়ালা তার শাকে ভেজাল করে শাক বেচে চাল কেনে, চালওয়ালা চালে ভেজাল করে চাল বিক্রি করে ঔষধ কেনে, ঔষধওয়ালা ঔষধে ভেজাল করে ঔষধ বেচে জামা কিনে, জামাওয়ালা জামায় ভেজাল করে......... আসলে কে কাকে ঠকাচ্ছি আমরা? দিন শেষে সবাই ঠকছি! দুর্নীতি করছি সবাই, সবাই আমরা দুর্নীতিবাজ!  

দার্শনিক ধর্মতাত্ত্বিক নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন আদর্শের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অসাধুতা বা বিচ্যুতি বা ব্যত্যয় মানেই দুর্নীতি। বৃহৎ পরিসরে বলতে গেলে বলতে হয়— ঘুষ প্রদান, সম্পত্তির আত্মসাৎ এবং সরকারি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার নাম দুর্নীতি। দুর্নীতি শব্দটি যখন বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন সাংস্কৃতিক অর্থে  'সমূলে বিনষ্ট হওয়াকে' নির্দেশ করে। এই শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪ –৩২২), তাঁর পরে মার্কাস টুলিয়াস সিসারো (খ্রীস্টপূর্ব ১০৬— ৪৩); সিসারো এর সাথে নীতিহীন আদানপ্রদান অর্থাৎ  ঘুষ এবং সৎ অভ্যাস ত্যাগ প্রত্যয়ের যোগ করেছিলেন। রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক মরিস  লিখেছেন, দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য  অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার। 

অর্থনীতিবিদ আই. সিনিয়র একে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন— দুর্নীতি এমন একটি কাজ যেখানে (১) গোপনে প্রদানের কারণে, (২) তৃতীয় কোনো পক্ষ সুবিধা পায়, (৩) যার ফলে তারা বিশেষ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করে, যা (৪) দুর্নীতির সাথে যুক্ত পক্ষটি এবং তৃতীয় পক্ষ উভয়ই লাভবান হয়, (৫) এবং এই কাজে দুর্নীতিগ্রস্ত পক্ষটি থাকে কর্তৃপক্ষ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কাফম্যান দুর্নীতির ধারণাটিকে আরো বিস্তৃত করেন 'আইনানুগ দুর্নীতি' শব্দদ্বয় যোগ করার মাধ্যমে যেখানে আইনকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করা হয়, যাতে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের ক্ষমতা আইন প্রণেতার নিকট রক্ষিত থাকে।

ট্রান্সপারেন্সির এক জরিপে দেখা যায় যে, দুর্নীতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এ হিসাব করা হয় ১০০ পয়েন্ট এর ভিত্তিতে। যে দেশ যত দুর্নীতি মুক্ত সে দেশের তত পয়েন্ট। হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, এদিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সোমালিয়া; এ দেশের পয়েন্ট ১০০-তে মাত্র ১০। এরপর কয়েকটি দেশের পরে আছে সিরিয়া; এর পয়েন্ট মাত্র ১৩। এরপর ১৪ পয়েন্ট নিয়ে অবস্থান করছে লিবিয়া, সুদান ও ইয়েমেন; এরপর ইরাকের আছে ১৭, লেবাননের আছে ২৮। 

প্রথম আলোর তথ্যমতে, আরব বিশ্বের নয়টি দেশ ও ভূখণ্ডে (ফিলিস্তিন) গত বছর দুর্নীতির পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলে মনে করে সেখানকার সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে গভীর সংকটে পড়া লেবানন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের  অবস্থা আরও বেশি খারাপ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে, প্রায় ১১ হাজার অংশগ্রহণকারীর মতামতের ভিত্তিতে পাওয়া জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে যে, এ অঞ্চলের দুর্নীতি বেড়ে যাওয়া অন্য দেশ ও ভূখণ্ড হলো আলজেরিয়া, মিসর, জর্ডান,  মরক্কো, ফিলিস্তিন, সুদান ও তিউনিসিয়া। অংশগ্রহণকারীদের ৬১ শতাংশ এসব দেশে গত বছর দুর্নীতি বেড়ে গেছে বলে তাদের ধারণা ব্যক্ত করেছেন। 

টিআই বলছে, 'আরব বসন্ত শুরুর পর প্রায় অর্ধদশক পেরিয়ে গেলেও বিশ্বব্যাপী আমাদের দুর্নীতির পরিমাপকে দেখা গেছে, সরকারি খাতের দুর্নীতি কমাতে বিভিন্ন সরকারের প্রচেষ্টা নিয়ে এখনো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছে।' দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, আরব দেশগুলোর অধিকাংশ নাগরিক মনে করেন, সম্প্রতি এসব দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, সরকারি কর্মকর্তা ও পার্লামেন্ট সদস্যরা ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে লেবাননের ৯২ শতাংশ, ইয়েমেনের ৮৪ শতাংশ, জর্ডানের ৭৫ শতাংশ মনে করছেন দেশগুলোতে দুর্নীতি বেড়েছে। 

বিপরীতে মিসরের ২৮ শতাংশ ও আলজেরিয়ার ২৬ শতাংশ মনে করেন তাঁদের দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। জরিপে যাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ ইয়েমেনি ও প্রায় অর্ধেক মিসরীয় বলেন, সরকারি সেবা পেতে তাঁদের ঘুষ দিতে হয়েছে। একই কথা বলেন তিউনিসিয়ার ৯ শতাংশ ও জর্ডানের ৪ শতাংশ সাক্ষাৎকার প্রদানকারী। জরিপ প্রতিবেদনের রচয়িতা কোরালাই প্রিং বলেন, তাঁরা লেবাননের দুর্নীতি পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন। গভীর রাজনৈতিক বিভক্তির মধ্যে দেশটি ২০১৪ সালের মে থেকে কোনো প্রেসিডেন্ট ছাড়াই চলছে। কোরালাই আরও বলেন, বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে জনগণ যে শুধু দুর্নীতি রোধে সরকারি প্রচেষ্টাতেই তাঁদের প্রচণ্ড অসন্তোষ জানিয়েছেন তা-ই নয়, বরং সরকারি খাতজুড়ে দুর্নীতির উচ্চহারেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আমাদের দেশের কি অবস্থা? 

তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর সচিবালয়ে গিয়ে প্রথমদিনই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স'। মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে তিনি বেশকিছু নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সুশাসন খুবই জরুরি। সাথে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন কর্মকর্তাদের; এবং বলেছিলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, ফলে এখন আর দুর্নীতির প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবতায় ঘটেছে কি?

অবশ্য দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতিতে কঠোর অবস্থানে দেখা গেছে এক মাত্র এবং একজন মাত্র ব্যক্তিকে, আর তিনি হলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। দেরিতে  হলেও তাঁর নির্দেশনায় দেশজুড়ে শুরু হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান। আশার বিষয় হলো আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যত প্রভাবশালী আর ক্ষমতাসীনই হউক বা সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের যত ঘনিষ্ঠজনই হউন না কেন, ছাড় পাচ্ছে না কোনো অপরাধীই। হয়তো কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় নিতেও নারাজ সরকার। সরকারের এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সুশীল সমাজসহ সর্বমহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছে হচ্ছে। আমরা আশান্বিত। 

সাম্প্রতিককালের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা-বিবৃতিগুলোতে আবারও সেই অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ গত ৯ জুলাই জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'দুর্নীতিবাজ যে-ই হোক ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে। কে কোন দলের তা বড় কথা নয়, দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের আমরা ধরে যাচ্ছি, ধরে যাব।' এর আগের দিন সংসদে আরেক বক্তৃতায় করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে প্রতারণায় যুক্ত রিজেন্ট হাসপাতাল ও এর চেয়ারম্যান মো. সাহেদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'ওই হাসপাতালের এই তথ্য আগে কেউ দেয়নি, জানাতে পারেনি। সরকারের পক্ষ থেকেই খুঁজে বের করেছি, ব্যবস্থা নিয়েছি।' 

সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, করোনা সংকট শুরুর পর থেকে বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলার পাশাপাশি কঠোরহস্তে তিনি অনিয়ম-দুর্নীতি দমনে জোর দিয়েছেন। তার নির্দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আগে থেকেই চলে আসা অভিযান নতুন মাত্রা পেল বলে মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে মানব পাচারে অভিযুক্ত স্বতন্ত্র এমপি শহীদ ইসলাম পাপুলের কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়াসহ দেশের কয়েকটি স্থানে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে দলের কয়েকজন নেতা ও জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে।

গত রোববার দুর্নীতির ফাইলের খোঁজে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই দিন দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) তিন কর্মকর্তাকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অন্যদিকে অনুমতি ছাড়া করোনা ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষার অভিযোগে গতকালই রাজধানীর সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মকর্তাকে আটক করা হয়। 

করোনাকালে এখন পর্যন্ত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সবচেয়ে আলোচিত দুটি ঘটনা হচ্ছে করোনার সনদ জালিয়াতিসহ নানা প্রতারণায় জড়িত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম এবং জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরী ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা। সাহেদের বিরুদ্ধে করোনা পরীক্ষা ছাড়াই ছয় হাজার এবং আরিফ-সাবরিনা দম্পতির বিরুদ্ধে ১৫ হাজার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ ছিল। এ দুই প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে করোনা পরীক্ষার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেই এমন প্রতারণা চালিয়ে আসছিল। 

অভিযানকালে শুধু সাহেদ ও আরিফ-সাবরিনাই নন, তাদের অনেক সহযোগী গ্রেপ্তার হয়েছেন। বন্ধ হয়েছে অনিয়মে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের বিরুদ্ধে বেশকিছু মামলা করার পাশাপাশি ব্যাংক হিসাব জব্দ ও অন্যান্য আইনি পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রতারক সাহেদ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য পরিচয় দিয়ে সরকার ও দলের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের অপতৎপরতায় লিপ্ত ছিল। মন্ত্রী ও নেতানেত্রীদের সঙ্গে ছবি তুলে অপব্যহারের মাধ্যমে প্রতারণার জাল বিস্তার করে আসছিল। 

অবৈধভাবে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক বনে যায় এই মহাপ্রতারক সাহেদ। আশাজাগানিয়া বিষয়টি হলো দলীয় পরিচিতি কিংবা এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে 'ঘনিষ্ঠতা'- কোনো কিছুতেই তার শেষরক্ষা হয়নি। সাঁড়াশি অভিযানের মুখে ৯ দিন আত্মগোপনে থাকার পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে সাতক্ষীরা সীমান্তে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। ঠিক তার মতোই নানা অসাধু উপায়ে অবৈধভাবে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিল সাবরিনা-আরিফও; পরিশেষে তাদেরও শেষরক্ষা হয়নি।

এদিকে, করোনা পরীক্ষা, পিপিই ও কিট সরবরাহ নিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া স্বাস্থ্য খাতের কয়েকজন হর্তাকর্তার বিরুদ্ধেও নানা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। করোনাকালে ত্রাণ তৎপরতায় যেসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাদেরও তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করে কঠোর বার্তা দিয়েছে সরকার। অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছে। এসব জনপ্রতিনিধির বেশিরভাগ ছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত।সংসদ সদস্য শহীদ ইসলাম পাপুলও মানব পাচারে অভিযুক্ত হয়ে কুয়েতে গ্রেপ্তারের ঘটনায় কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। 

পাপুল ও তার স্ত্রী সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলামের অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান, ব্যাংক হিসাব এবং স্ত্রী-শ্যালিকাসহ অনেকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ওদের ব্যাপারে মাননীয়  প্রধানমন্ত্রী  নিজেই সংসদে বলেছেন, 'ওই সংসদ সদস্য (পাপলু) কুয়েতের নাগরিক কিনা, তা নিয়ে কুয়েতের সঙ্গে কথা বলছি। বিষয়টি দেখব। যদি এটা হয়, তাহলে তার ওই আসনটি (লক্ষ্মীপুর-২) খালি করে দিতে হবে। যেটা আইন আছে, সেটাই হবে। আর তার বিরুদ্ধে এখানেও তদন্ত চলছে।'

পাপুল-সাহেদ-সাবরিনা ছাড়াও অনিয়ম-দুর্নীতিতে যুক্ত আরও অনেকের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে হচ্ছে। তদবির-বাণিজ্যে যুক্ত হয়ে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক বনে যাওয়া পাপিয়া নামের এক যুব মহিলা লীগ নেত্রীকে গ্রেপ্তার ও জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থানে আগে থেকেই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং মনে হচ্ছে একাই তিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন; দেশের  বাকী আমরা সবায় তামাশা দেখছি। সারা বিশ্ব যখন করোনা নিয়ে উদ্বিগ্ন আর আমরা তখন উদ্বিগ্ন দুর্নীতি নামক বিষফোঁড়া নিয়ে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে, তা রোখা কি একা একজনের পক্ষে সম্ভব?  

দুর্নীতির বিষবৃক্ষটি এতটাই  মহিরুহ আকার ধারণ করেছে, যা বলা বাহুল্য।  এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে, সমগ্র জাতির সমস্ত প্রক্রিয়ায়। দুর্নীতির ব্যাপকতা কতটা বেড়েছে তা করোনাকালে আমরা কিছুটা হলেও টের পেয়েছি, প্রকাশ হয়েছে বলে। বিশেষ করে  আমাদের স্বাস্থ্য খাত যে কতটা ভঙ্গুর এবং দুর্নীতিগ্রস্ত, তা স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করেছিল; যন্ত্রপাতি কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলিসহ আরও বিভিন্নভাবে এ মন্ত্রণালয়ে যেসব দুর্নীতি হয়ে থাকে সেসবের; কিন্তু তদন্ত  কার্যক্রম কেন থেমে ছিল? বুঝে আসে না। 

এদেশে অনেকেই জিরো টলারেন্স জিরো টলারেন্স বলে চিল্লায়, এই 'জিরো টলারেন্স' কি শুধুই কথার কথা? এর আগে আমরা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা শুনেছি, এখন যুক্ত হয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সেই ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, মন্ত্রী-সচিবেরা সৎ হলে ৫০ শতাংশ দুর্নীতি কমে যাবে, কিন্তু এখন তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক এবং দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি  মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী; দিনশেষে তিনি কতটা কি করেছেন বা করতে পারলেন?! 

প্রধানমন্ত্রী হয়েই মাননীয় শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া তাঁর প্রথম ভাষণে দুর্নীতিগ্রস্তদের শোধরানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন; মনে করেছিলাম শুভসূচনা। দুর্নীতি উচ্ছেদের সংকল্পের পাশাপাশি তিনি স্বীকারও করেছিলেন— দুর্নীতি নিয়ে সমাজে অস্বস্তি রয়েছে। এবারের কথা তো আগেই বলেছি। তাঁদের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না বা কার্যকর হচ্ছে না কেন? বরং দিনেদিনে  দুর্নীতি কমার বদলে বহুগুণ বেড়েছে!    

এবারের মন্ত্রিসভার নতুন মন্ত্রীদের মুখে  প্রথমেই আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় বড় নানা কথা শুনেছিলাম; স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক '১০০ দিনের কর্মসূচিতে' দুর্নীতিগ্রস্ত কাউকেই সরকার রেহাই দেবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী কোনো দুর্নীতি প্রশ্রয় না দেওয়ার কথা বলেছিলেন। ভূমিতে দুর্নীতির ক্ষেত্রে 'জিরো টলারেন্স' ঘোষণা করেই শুধু ক্ষান্ত হননি ভূমিমন্ত্রী, তিনি ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হিসাব চেয়েছিলেন। ওনাদের কথার কোন বাস্তবতা কি আমরা দেখেছি, না-কি পেয়েছি??      

পরিকল্পনামন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রীও বলেছিলেন— এখন আর দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা কোনো ছাড় পাবে না, 'চরম শাস্তির' মুখোমুখি হতে হবে। রাজউকসহ গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই 'সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত' করার ঘোষণা দিয়েছিলেন গণপূর্তমন্ত্রী। রেলমন্ত্রী এতটুকু অনিয়ম ছাড় না দেওয়ার কথা বলেছিলেন। পরিবেশমন্ত্রী, সমাজকল্যাণমন্ত্রীর মুখেও শোনা  গিয়েছিল একই সংকল্পের কথা। আর দুদকের চেয়ারম্যান সবাইকে টপকে বলেছিলেন— 'দুর্নীতির গন্ধ' পেলেই তিনি ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু  বাস্তবতায় ঘটেছে উল্টো! সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি আজ মহিরুহ; জাতির অভিশাপ হয়ে পুরো দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে।      

শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে টানা পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার এতকাল পর ২০২০ সালে এসে আজ আবারও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা শুনতে হচ্ছে; আফসোস! তাহলে এত দিন আমরা তবে কোন নীতিতে চলেছি এবং কেন? কেন এখনো  পারিনা আমরা বুক ফুলিয়ে বাঁচতে?   আর একটি কথা— সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এবং মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি আমাদের কী দিয়েছে? কিছু সাফল্য অবশ্যই আছে, কিন্তু তা-ই-বা কতটুকু? এবং কি-ই-বা  মূল্যে তা পেয়েছি?? 
না-কি আবারও সব কিছুই আগের মতো ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে যাবে???

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
৫ অগাস্ট, ২০২০.

মঙ্গলবার, ৪ আগস্ট, ২০২০

জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিত ঐশী বাণী:

হযরত নূহ (আঃ) ছিলেন হযরত আদম (আঃ)-এর অষ্টম অধস্তন প্রজন্ম। হাদিস ও তাফসীর থেকে জানা যায় - হযরত নূহ (আঃ) ও হযরত আদম (আঃ)-এর মধ্যবর্তী যুগ ছিল প্রায় এক হাজার বছর, অর্থাৎ তাঁদের দুনিয়ায় আসার সময়ের ব্যবধান ছিল প্রায় এক হাজার বছর। ঐ সময়ের মাঝেখানে পৃথিবীতে এসেছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ নবী ও রাসুল; যাঁর কথা আমরা অনেকেই জানি না বা অনেকে আবার নামও শুনিনি। 

হযরত নূহ (আঃ)-এর সময়ে একবছর ব্যাপী মহাপ্লাবন এবং হযরত নুহ ( আঃ)-এর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা সম্বন্ধে কমবেশি আমাদের সমাজের সবার কিছুটা জানা আছে, আলেম সমাজ এই সব বিষয় নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা করেন, বিশেষ করে নুহ (আঃ)-এর সময়কার দীর্ঘ প্লাবন নিয়ে তাঁরা বেশ ব্যাপকভাবে আলোকপাত করেন। কিন্তু পবিত্র কুর'আনুল কারীমে বর্ণিত আরও  অনেক পয়গম্বর-কে নিয়ে তাঁরা তেমন কিছুই বলেন না, তাই ওনাদের কথা সবার কাছে অজ্ঞাতই থেকে যায়; তেমন একটা জানাও হয়ে উঠে না। আজ আমি তেমনই অজানা অচেনা একজন পয়গম্বরকে নিয়ে কিছু লিখার প্রত্যাশা রাখছি।  

গণিতবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষাকে আজকাল অনেক আলেমই অবজ্ঞা করেন, এমনকি এ'সবকে কুফরি শিক্ষা নাস্তিকদের শিক্ষা হিসেবে আখ্যায়িত করেন! না জেনে না বুঝে ব্যঙ্গ করে গণিতবিদ বা জ্যোতির্বিদদের নামে মিথ্যা ফতোয়া দিয়ে বসেন; এ'সব আসলে তাদের অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। আজ আমি গণিত বিদ্যা কি করে পৃথিবীতে আবির্ভূত হলো তার ইতিহাস তুলে ধরে দু'চার কথা লিখতে চেষ্টা করবো। প্রত্যাশা করছি অন্ততঃ দু'চার জন হলেও এ লেখা পড়বেন এবং হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করবেন, তবেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সার্থক হবে। আপনারা হয়তো অনেকেই হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর নাম পর্যন্ত শোনেননি বা চিনেন না জানেন না। তাই গণিতের জন্মকথা বলার আগে পবিত্র কোর'আন ও হাদিসের আলোকে হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের কিছুটা তুলে ধরছি। 

সূরা মারইয়ামে উল্লেখ করা হয়েছে, "এই গ্রন্থে উল্লেখিত ইদ্রিসের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, সে ছিল সত্যবাদী নবী। আমি তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি।" এই আয়াতের তাফসীর থেকে জানা যায়, এখানে ইদ্রিস (আঃ)-এর কথা বর্ণনা করা হয়েছে; তিনি ছিলেন একজন সত্য নবী এবং আল্লাহ তা'আলার একজন বিশিষ্ট বান্দা। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। 

হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণিত আছে মেরাজ গমনকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের সাথে হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর সাক্ষাত ঘটেছিল। এ নিয়ে ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) একটি অতি বিস্ময়কর হাদীস তুলে ধরেছেন - তিনি বলেন, ইবনে আব্বাস (রাঃ) কা'আব ( রাঃ)-কে "ওয়ারাফ'না মাকা-নান আলিয়্যা" - আয়াতের ভাবার্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেন, "আল্লাহ তা'আলা হযরত ইদ্রিস (আঃ)-কে ওহী করেন - 'আদম সন্তানের আমলের সমান তোমার একার আমল আমি প্রতিদিন উঠিয়ে থাকি। কাজেই আমি পছন্দ করি যে, তোমার আমল বৃদ্ধি পাক।' অতঃপর তাঁর নিকট একজন বন্ধু ফেরেশতা আগমন করলে তিনি তাঁর কাছে বলেন - 'আমার নিকট ওহী এসেছে; অতএব আপনি মৃত্যুর ফেরেশতাকে বলে দিন তিনি যেন একটু দেরি করে আমার জান কবজ করেন, যাতে আমার আমল বৃদ্ধি পায়।'" 

ঐ বন্ধু ফেরেশতা তখন তাঁকে নিজের পালকের উপর বসিয়ে নিয়ে আকাশে উঠে যান এবং চতুর্থ আসমানে গিয়ে মালাকুল মাউত ফেরেশতার সাক্ষাত পান। ঐ ফেরেশতা মালাকুল মাউত ফেরেশতাকে হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর ব্যাপারে সুপারিশ করলে মৃত্যুর ফেরেশতা বন্ধু ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করেন, "তিনি কোথায় আছেন?" 
উত্তরে বন্ধু ফেরেশতা বলেন, "এই তো তিনি আমার পালকের উপর বসে আছেন।" 

মৃত্যুর ফেরেশতা তখন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, "সুবহানাল্লাহ! আমাকে এখনই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি যেন ইদ্রিস (আঃ) এর রুহ চতুর্থ আসমান থেকে কবয করি। কিন্তু আমি চিন্তা করছিলাম - ইদ্রিস (আঃ) তো আছেন জমিনে, চতুর্থ আসমান থেকে তাঁর রুহ কবয করবো কিভাবে?" 

অতঃপর তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর ফেরেশতা হযরত ইদ্রিস (আঃ) রুহ কবয করে নেন। উক্ত রেওয়াতটিই অন্য এক সনদে এভাবে এসেছে - হযরত ইদ্রিস (আঃ) বন্ধু ফেরেশতার মাধ্যমে মালাকুল মাউত ফেরেশতাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, "আমার হায়াত আর কত দিন বাকী আছে?" অন্য আর এক হাদিসে আছে তাঁর এই প্রশ্নের উত্তরে মালাকুল মাউত বলেছিলেন, "আমি লক্ষ্য করছি, চক্ষুর একটা পলক ফেলার সময় মাত্র বাকী আছে।" 
বন্ধু ফেরেশতা তাঁর পলকের নিচে তৎক্ষণাৎ তাকিয়ে দেখেন, হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর জান এরই মধ্যে কবয করা হয়ে গেছে। 

হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন - হযরত ইদ্রিস (আঃ)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, তিনি মৃত্যুবরণ করেননি, বরং তাঁকে হযরত ঈসা (আঃ)-এর মতো জীবিত উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আউফী (রঃ)-এর রিওয়াতের মাধ্যমে ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে - হযরত ইদ্রিস (আঃ)-কে ষষ্ঠ আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল, আর সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। 

হযরত ইদ্রিস (আঃ) হযরত নূহ (আঃ)-এর পূর্ববতী নবী ছিলেন। তিনি ছিলেন হযরত নূহ (আঃ)-এর দাদা এবং হযরত হাবিল (আঃ)-এর বংশধর। মেরাজের হাদিসে বর্ণিত আছে হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর সাথে হযতর মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের সাক্ষাতের সময় তাঁকে তিনি উত্তম নবী ও উত্তম ভাই বলে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।  —[মূস্তাদরাক হাকীম] 

হযরত আদম (আঃ)-এর পর তিনিই সর্ব প্রথম পূর্ণাঙ্গ নবী ও রাসুল; যাঁর প্রতি আল্লাহ রাব্বুল তা'আলামিন ত্রিশটি সহীফা নাযিল করেন। হযরত ইদ্রিস (আঃ) সর্ব প্রথম মানব যাঁকে মু'জিযা হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও অংকবিজ্ঞান দান করা হয়েছিল। —[বাহরে মুহীত] 

তিনিই প্রথম মানব যিনি কলমের দ্বারা লিখা ও কাপড় সেলাই আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর পূর্বে সাধারণতঃ মানুষ পোশাকের পরিবর্তে পশুর চামড়া বা গাছের পাতা বা ছাল ব্যবহার করতো। ওজন ও পরিমাপ পদ্ধতি সর্বপ্রথম তিনিই আবিষ্কার করেন এবং আস্ত্র-শস্ত্রের আবিষ্কারও তাঁর আমল থেকেই শুরু হয়। তিনিই অস্ত্র তৈরি করে তা দিয়ে কাবীল গোত্রের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন। 

সর্ব বিবেচনায় এখন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিত হলো আল্লাহর তরফ থেকে আসা ঐশী বাণী। এখন আপনারাই বলেন যারা গণিতবিদ বা জ্যোতির্বিদদেরকে নাস্তিক বলে উপহাস করেন তারা কোথায় কি অবস্থায় আছেন? তাদের জ্ঞানের গভীরতাই-বা কতটুকো? 

বিখ্যাত মুসলিম মনীষী এবং একজন তা'বে তা'বেঈ মূসা আল খায়েরী যামী আজকের আধুনিক গণিত শাস্ত্র তথা বীজগণিতের জনক। এ ছাড়াও অনেক মুসলিম মনীষীই গণিতের বিভিন্ন শাখাকে উদ্ভাসিত করে গেছেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় মুসলিম মনীষীদের অবদান অনস্বীকার্য। অথচ আজকের আলেম সমাজ ফতোয়া দিয়ে বেড়াচ্ছেন বা বেড়ায় গণিত নাস্তিকদের বিদ্যা(!), জ্যোতির্বিদ্যা নাস্তিকদের বিদ্যা(!), বিজ্ঞান যারা পড়ে তারা নাস্তিক(!); অজ্ঞতাই আজকের মুসলিম সমাজের প্রথম এবং প্রধান প্রতিবন্ধকতা। অথচ এক সময় এই মুসলমানদের জ্ঞান প্রজ্ঞায়ই সাড়া পৃথিবী উদ্ভাসিত হতো এবং হয়েছে;  এক কথায় বললে বলা যায়— মুসলিমদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও গরিমার কাছে অন্যান্য জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠীর জ্ঞান-গরিমা ছিল নস্যি। 

কিন্তু আজকের আলেমরা করছেন কি?  বেহেস্ত আর দোযখের বর্ণনা ছাড়া তাদের মুখে অন্য কোন কিছুই রোচে না। দুনিয়ায় বিচরণের নিয়ম কানুন এক সময় মুসলিম আলেমগণই শিক্ষা দিতেন, শিক্ষা দিতেন দুনিয়াই আখেরাতের চারণক্ষেত্র; দুনিয়ার বিখ্যাত সব বিদ্যাপীঠ মুসলিমদেরই হাতে গড়া। মুসলিম সমাজকে তথা সমগ্র দুনিয়াকে সুন্দর ও সঠিক পথের সন্ধান দিতেন মুসলিম আলেমগণই। 

পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ভুলে আজকের আলেমরা আছেন শুধু ফতোয়া আর ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের ধান্দা নিয়ে; নিজ স্বার্থ ও মতের এতটুকো ব্যত্যয় ঘটলেই অন্যের বিরুদ্ধে তারা ফতোয়া দিয়ে বসেন, এক আলেম অন্য আলেমকে নিয়ে যা-তা মন্তব্য করে বসেন; সাধারণের সাথে কি করেন সে কথা না হয় বাদই দিলাম। এইসব দেখেশুনে ওদের থেকে শিক্ষা নিয়ে মুসলিম আজ শতধা বিভক্ত, পুরো সমাজ তচনচ হয়ে গেছে। পৃথিবীর প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রের দিকে তাকালে এই একই দৃশ্য গোচরীভূত হয়। 

মসজিদের নগরী হিসেবে ঢাকা পৃথিবী বিখ্যাত এবং সমগ্র বাংলাদেশেটাই মসজিদে ছেঁয়ে আছে ছেঁয়ে গেছে। যেখানেই যতটুকো অবৈধ জায়গা পাওয়া যায়, সেই জায়গাটুকোই দখল করে গড়ে তোলা হয় মসজিদ বা মাদ্রাসা। এক জঘন্য প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণ কাজের; গড়ে তোলা হয় বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা, আলিশান সব কাঠামো আর সৌখিন সব ইতালিয়ান আমেরিকান বা জাপানী ইহুদী খ্রিষ্টানদের উপঢৌকন দেয়া টাইলস দিয়ে মসজিদ সাজানোর কাজ। জায়গার সত্ত্ব উৎস বা অর্থ যোগান উৎসের চিন্তা করার কারো কোন বালাই নেই, এ'সব কোন কিছুই বিবেচনায় নেয়া হয় না বা বিবেচ্য বিষয় হিসেবে ধরা হয় না! 

দেশে আজ মসজিদের অভাব নেই, নেই মুসল্লিরও অভাব; আবার মসজিদে জুতা চোরেও অভাব নেই! মুসলিম সমাজ আজ এক ধরনের অন্ধত্ব ও জান্নাতি অহংবোধে এক মিথ্যা মরীচিকার পিছু ছুটছে; জান্নাত পাওয়ার আশায় কেউ-বা আবার জঘন্য পাপ মানুষ হত্যার কাজেও লিপ্ত হচ্ছে। চোগলখোরি, মোনাফেকি, পরশ্রীকাতরতা, চোরাকারবারি, সুদখোরি, ঘুষখোরি এই সব বদ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি এখন মুসলমাদের মাঝেই বেশি পরিলক্ষিত হয়। এসব করে জান্নাতের প্রত্যাশা অবান্তর নয় কি? হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-এর অমর একটি বাণী এই মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি- "প্রস্রাব দিয়ে কাপড় দৌত করে যেমন কাপড়ের পবিত্রতা আনয়ন করা যায় না, তদ্রূপ হারাম উপার্জিত পয়সা দিয়ে দানখয়রাতও ইহকাল ও পরকালের অকল্যাণ বৈ কল্যাণ বয়ে আনে না আনতে পারে না।" 

জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা আজকাল মুসলিম সমাজ থেকে যেন উঠেই গেছে; সন্দেহ প্রবনতা ও পরশ্রীকাতরতা থেকে জন্ম নেয়া হিংসা বিদ্বেষ আর খুনাখুনি আজ সমগ্র মুসলিম জাহানের  প্রতিটি সমাজের সামাজিক চিত্র; কোথাও শান্তি নেই। অথচ 'ইসলাম' বলতেই আমরা সবাই বুঝি 'শান্তি'; একজন মুসলিম হিসেবে অনেকে যথেষ্ট অহংবোধও করি(!)। কিন্তু, কোথায় শান্তি? 

আত্ম অহংকার করার মতো বা অহংবোধ করার মতো আমরা কিছু করি কি? শান্তি নেই ঘরে, শান্তি নেই বাইরে; শান্তি নেই আমাদের সমাজে, শান্তি নেই দেশজুড়ে; শান্তি নেই আরবে, শান্তি নেই পারস্যে; শান্তি নেই প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে, শান্তি নেই কোথাও! তাহলে কবরে গিয়ে কি শান্তি পাবো? এমন মোনাফেকি করে?
সে শুধুই এক অবান্তর কল্পনা।।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২২-১-২০১৫.

শনিবার, ১ আগস্ট, ২০২০

ঈদ মোবারক!

মানুষ তার স্বপ্ন নিয়েই বাঁচে, বেঁচে থাকে;  ভালো দিন আসবেই ইনশাআল্লাহ! সৃষ্টির শুরু থেকে সেই কত কি প্রতিকূলতা! প্রকৃতির সাথে যুুদ্ধ করেই মানুষ বেঁচে থেকেছে। মানব ইতিহাসের সেই শুরুতে মা হাওয়া (আঃ) ও আদম (আঃ) দীর্ঘ একটা সময় আলাদা থেকেছেন। নবী-রাসুল (আঃ)-গণ কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন; হুজুর পাক (সাঃ)-এর ত্যাগের মহিমা আর নাইবা বললাম। সাহাবী (রাঃ)-গণ ত্যাগের এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র।  

এই উপমহাদেশের সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকে বছরের পর বছর কারাগারে কাটিয়েছেন; দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বছরের পর বছর তাঁরা কত কি দুঃখকষ্ট স্বীকার করেছেন। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে আমাাদের কষ্ট তাঁদের কষ্টের তুলনায় কতটুকু? আমরা হয়তো একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে ঘরে বন্দী জীবনযাপন করছি, এই তো? 

হয়তো অচিরেই ভেকসিন আবিষ্কার হবে; মানুষের বিচ্ছিন্নতা ঘুচবে। আমরা আজ একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন, নির্বাসিত; এই বিচ্ছিন্নতা মানুষের জন্য খুবই বিপজ্জনক। প্রকৃতিতে মানুষই সবচেয়ে অরক্ষিত প্রাণী। বিভিন্ন প্রাণীর আত্মরক্ষার জন্য তাদের নানা রকমের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকে; কারও দাঁত, কারও নখ, কারও বিষ ইত্যাদি। কিন্তু মানুষের আত্মরক্ষার জন্য তেমন কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষ সবচেয়ে অসহায়, সবচেয়ে অরক্ষিত প্রাণী। 

অরক্ষিত প্রাকৃতিক পরিবেশে এমনতর কঠিন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে মানুষ কী করে টিকে থাকলো? টিকে থাকতে পেরেছে— মানুষ মানুষকে সহযোগিতা করেছে বলে, মানুষ মানুষের জন্য দাঁড়ায় বলে। পরস্পর যুক্ত হলেই মানুষ বাঁচতে পারে; আর এভাবেই মানব জাতি নিজেদেরকে রক্ষা করে থাকে। মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো পরস্পর নির্ভরশীলতা। মানুষ টিকে থাকে, টিকে থাকতে পারে মানুষেরই জন্য। আজকে সেই মানুষ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে; যা অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি। হয়তো আবারও মানুষ তার স্বভাবগত চরিত্রে ফিরে যাবে, সব কিছু ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে।     

এতোকিছুর পরও আবারও শান্তি, সৌহার্দ্য আর আনন্দের বারতা নিয়ে বছর ঘুরে এলো খুশির ঈদ, পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। ঈদের এই খুশিতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'য়ালা  আমাদের প্র‍ত্যেককে পূর্ণতা দান করুন, এই কামনা করছি৷ পবিত্র ঈদ-উল-আযহা সবার জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি৷ বছরের প্রতিটি দিন ঈদের দিনের ন্যায় আনন্দময় হোক। শুভ প্রত্যয় কামনান্তে— 'তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ (আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন)!
ঈদ মোবারক!!