শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০

সত্য শাশ্বত চীর অম্লান:


বর্তমানের এই মহাফেতনার যুগে কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক, কোনটা আসল আর কোনটা নকল, কোন পথ পঙ্কিল আঁকাবাঁকা আর কোন পথ সিরাতুল মুস্তাকিম-এর তা বুঝাই হয়ে উঠেছে এক মহা মুশকিলের বিষয়। বহু পথ হেটেছি, বহু মাঠ ঘাট প্রান্তর ঘুরে বেড়িয়েছি, কত কি দেখছি, যেখানে গিয়েছি সেখানেই অবলোকন করেছি ইসলামের নামে চলা যতসব ভন্ডামী। সুদ খাওয়া হারাম, অথচ সুদের টাকায় অবৈধ জায়গা দখল করে এদেশে গড়ে উঠছে মসজিদ, মাদ্রাসা; এ'ক্ষেত্রে ফতোওয়া দেয়ার কেউ নেই। মিথ্যে বলা সবচেয়ে বড় পাপ, অথচ এ'নিয়ে বয়ান কম; মুসলিমরাই আজ এ'দোষে সবচেয়ে বড় দোষী। হাক্কুল্লাহ্ নিয়ে কত কি মাতামাতি, অথচ হাক্কুল ইবাদ নষ্ট করে লোকজন করছে হজ্জ, দিচ্ছে যাকাত; এ'সব নিয়ে ওয়াজ নেই। মসজিদে লোক দেখানো নামাজীর অভাব নেই, নামাজ পড়তে পড়তে একেক জন কপালে টিক্কা ফেলে দিচ্ছে; কিন্তু ইমানের খবর নেই। এ'সব দেখে দেখে শেষ পর্যন্ত স্থির করলাম দুনিয়ায় যত দিন হায়াত রেখেছেন আল্লাহ্ সত্য অন্বেষণ করে সে'সব বলেই যাবো।   

কে না জানে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এ'টি একটি মীমাংসিত বিষয়; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম ও প্রতিষ্ঠাকালীন রাষ্ট্রপতি, এ নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ কারো নেই। এমনকি জিয়াউর রহমানও বঙ্গবন্ধুকে এই স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন; কিন্তু তাঁর সন্তানই কয়দিন আগে ঘোষণা দিয়ে বসলো - বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান! হটাৎ করে স্বাধীনতার এতো বছর পর নতুন করে জিয়াউর রহমান-কে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বানানোর কি প্রয়োজন ছিল, উদ্দেশ্যই-বা কি? এ'নিয়ে আহম্মকের মত তর্কও শুরু করেছিল অনেকে; নতুন প্রজন্মের দু'চার জন হয়তো বিশ্বাসও করছে। এমনও-তো হতে পারে আজ থেকে একশ বছর পর তখনকার কেউ হয়তো তারেক জিয়া'র এই রাষ্ট্রপতি তত্ত্ব নিয়েই প্রচন্ড রকমের বাড়াবাড়ি করবে; রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। এটি তো আমাদের এই ছোট্ট ভূখণ্ডের মাত্র ৪৬ বছরের একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র ইতিহাসের ঐতিহাসিক একটি ফেতনার সূচনা। ইসলামের ইতিহাস তো সাড়ে চৌদ্দশ বছরের; এখানে কত কি হয়েছে, কত কি ঘটেছে, যার হিসাব মেলানোও ভার। অতএব, বিকৃত ভার্সন তো থাকবেই। 

যদিও ইসলামের ইতিহাসের সাথে একটা দেশের ইতিহাস মেলানো যায় না, তদুপরি আজ মেলালাম সহজভাবে বুঝানোর অভিপ্রায়ে; তাছাড়া মানুষ, দেশ ও জাতি নিয়েই ইতিহাস। প্রত্যেক ইতিহাসেরই একটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষা আছে। আমাদের দেশের অনেক আলেম ওলামা ইতিহাসকে অবজ্ঞা করে শুধুমাত্র ইমান ও আমল, কবর ও হাশর নিয়ে ব্যস্ত থাকেন; এমন কি এ-ও বলেন ইতিহাস জেনে লাভ কি? আমল করেন, আমল! সঠিক পথের জন্য সঠিক ইতিহাস জানার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম ও অনস্বীকার্য। এইসব জানা প্রত্যেকের, বিশেষ করে আলেম ওলামার জন্য অত্যন্ত জরুরি বলে আমি মনে করি; নয়তো পথভ্রষ্টতার সম্ভাবনা থাকবেই। আর একজন আলেম পথভ্রষ্ট হলে সাধারণ মুসলিমের যে কত বড় ক্ষতি তা কল্পনারও অতীত। 

ইসলামের অনেক বিকৃত ইতিহাস আছে, যেগুলোর বেশিরভাগই ইহুদী নাসারা'রা তাদের মনগড়াভাবে তৈরী করেছে। তবে, সাম্রাজ্যবাদীদের ইতিহাস জানা থাকলে ভালভাবে বুঝা যায় কতটা বিকৃত করেছে তারা আমাদের ঐতিহ্যকে। মুসলিম বিখ্যাত মনীষীদের নামও তারা বিকৃত করে   উপস্থাপন করেছে, কোর'আনের আয়াত ৬৬৬৬ টি বলেও তারা প্রচার করেছে, আরো কত কি! মুসলিমের প্রকৃত ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কিছুটা উঠে এসেছে বিভিন্ন কোর'আন তাফসীরকারকদের বর্ণনায়।  ইবনে কাসির, ইবনে খালদুন, ইবনে হিশাম, মুহাম্মদ ইবনে জারির আল-তাবারি, ইবনে ইসহাক, আলি ইবনে আসির, ইবনে খালিকান, মোহাম্মদ মোহর আলী, শেখ মোহাম্মদ ইকবাল এ'রকম আরো অনেক মুসলিম ইতিহাসবীদের লেখা থেকে ইসলামের ইতিহাসের সঠিক ধারাবাহিকতা পাওয়া যায়। তাই মুসলিম লেখকদের লেখা ইতিহাস থেকেই আমরা জানতে পারবো ও শিখতে পারবো অনেক কিছু এবং জেনে বুঝে সঠিক পথও অনুসরণ করতে পারবো। 

ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিল ইসলামের সোনালী যুগ। সেই যুগের পর থেকেই মুসলমানের ইমান ও আকিদাগত নতুন এক ধরা বা ফেতনার সূচনা হয়েছে। যদিও সেই প্রাথমিক যুগ থেকেই ফেতনাবাজ মুনাফিকরা ছিল, যারা মুখেমুখে ইসলাম গ্রহণ করেছিল মূলত লোভ-লালসা ও ফেতনা ফ্যসাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে; কিন্তু ইমান আকিদাগত আভ্যন্তরিন এতোসব ফেতনা তখন ছিল না। যুগে যুগে ইসলামে নতুন নতুন ফেতনার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আছে এবং থাকবে। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের ফেতনা ইসলামের মূল বিষয় ইমান ও আকিদা-য় হাত বসিয়েছিল। তাই আমাদেরই অনুসন্ধান করে তাদের প্রতিহত করতে হবে। 

হুজুরপাক (সাঃ)-র উপর নাজিলকৃত পবিত্র মহাগ্রন্থ কোর'আন। ইসলামী ইতিহাস অনুসারে দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে খণ্ড খণ্ড অংশে এটি নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট অবতীর্ণ হয়। আমরা মুসলিমরা এই পবিত্র মহাগ্রন্থকে একটি পুর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বলে বিশ্বাস করি। কুরআনে সর্বমোট ১১৪টি সূরা আছে, যার আয়াত সংখ্যা ৬,২৩৬ টি; কাল কেয়ামত পর্যন্ত যা অপরিবর্তিত থাকবে। কিন্তু ইহুদী নাসারাদের মদদে মনগড়া কোর'আন তাফসীর হয়েছে অনেক। যেসব তারা কোটি কোটি কপি ছাপিয়ে বিনা মূল্যে মুসলিমের ঘরে ঘরে পৌছে দিয়েছে।  

রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নবুয়াতী জীবনের সকল কথা, কাজ এবং অনুমোদনকে হাদীস বলে। মূল বক্তব্য হিসাবে হাদীস তিন প্রকার ১) কাওলী হাদীস : রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পবিত্র মুখের বানীই কাওলী হাদীস। ২) ফিলী হাদীস: যে কাজ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) স্বয়ং করেছেন এবং সাহাবীগণ তা বর্ণনা করেছেন তাই ফিলী হাদীস। ৩) তাকরীরী হাদীস : সাহাবী (রাঃ)-গণের যে সব কথা ও কাজের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সমর্থন প্রদান করেছেন তা-ই তাকরীরী হাদীস।
হাদীস নিয়ে সে যে কত কি ঘটেছে তা বলা বাহুল্য। একজন একটা হাদিস বললে অন্যজন তা থেকে কমিয়ে বা ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে কত কি করেছে। তাই তো এক সময় হাদীস সংকোলনে ব্রতী হন ইসলামী স্কলারগণ। শেষ পর্যন্ত সহিহ্ সিত্তা বা ছয়টি নির্ভূল ও বিশুদ্ব হাদীস গ্রন্থ এক কথায় সিহাহ্ সিত্তা হিসেবে সংকোলিত হয় এবং গ্রন্থ আকারে সার্বজনীন স্বীকৃতি পায়।

কোর'আন নাজিল হওয়ার পর তা সংরক্ষিত ছিল সাহাবী (রাঃ)-গণের হৃদয়ের তাম্রশাসনে খোঁদাই করা স্মৃতিভান্ডারে। ধাপে ধাপে আয়াতগুলো লিপিবদ্ধ হতে হতে এক সময় পূর্ণাঙ্গ কোর'আন শরীফ প্রকাশ পায়। সাহাবী (রাঃ)-গণ একে অন্যকে কোর'আন শিক্ষা দিতেন, হাদিস নিয়েও একে অন্যের সাথে বলাবলি করতেন; যাচাই বাছাই করতেন। সময়ের প্রয়োজনে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভাবনায় তা বাধাঁই করা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় পরবর্তীতে তাবেঈগণ সাহাবী (রাঃ)-গণের শিখানো পথই অনুসরণ করেন এবং তাবে-তাবেঈগন তাবেঈদের। ইসলামের ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতার কোন বিকল্প নেই।  

আলো থেকে যত দূরে যাওয়া যায় আলোর জ্যোতি যেমন কমতে থাকে, তদ্রুপ হুজুর পাক (সাঃ) থেকে যত দিন যাবে ইসলামের দ্যোতিও ততো কমতে থাকবে - এমনটাই পড়েছিলাম ইমাম গাজ্জীলী (রঃ)-র এক কিতাবে (এই মুহূর্তে কিতাবের নাম মনে করতে পারছি না)। ইমামে আজম আবু হানিফা (রঃ) নিঃসন্দেহে একজন তাবেঈ; এতে কারো কোন সন্দেহ বা দ্বিমত নেই। কারণ ইমামে আজম ইরাকের কুফায় ৫ সেপ্টেম্বর ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৪ জুন ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৫০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। সাহাবী আনাস ইবনে মালিক (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত হওয়ার কারণে তিনি একজন তাবেঈ। অন্য মতে ইমাম আবু হানীফা (রঃ) অন্যুন আটজন সাহাবী (রাঃ)-র সাক্ষাত লাভ করেছেন। অতএব, এ'ব্যপারে নিশ্চিত বলা যায় যে, তিনি একজন তাবেঈ। 

ইসলামী জীবনবিধানে ফিকাহ-র কোন বিকল্প নেই। পবিত্র কোর'আনে কিন্তু কোথাও উল্লেখ নেই নামাজ কয় রাকাত, কি ভাবে তা আদায় করতে হবে - এমন অনেক বিষয়। হুজুর পাক (সাঃ)-এর নামাজ দেখে সাহাবী (রাঃ)-গণ তা শিখেছেন, সাহাবী (রাঃ)-গণদের দেখে তাবেঈগণ শিখেছেন; আর এ'টিই সহিহ্ বা সঠিক দিক নির্দেশনা। 
ইসলামী শরিয়াহ্-য় ফিকাহ এই ভাবেই ধারাবাহিকতা বঝায় রেখে আমাদের কাছে এসেছে; হটাৎ করে কেউ যদি নতুন কিছু বলে বসে ফেতনার তো উদ্ভব ঘটবেই। পর্যায়ক্রমে তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈদের সৃষ্ট চার মাযহাব হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী এসেছে। এগুলো নেহায়েত ইসলামী শরিয়াহ ও ফিকাহ-কে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতেই সৃষ্টি হয়েছে; ফেতনার জন্যে নয়। চার মাযহাবের চার স্থপতি নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে কোর'আন ও সুন্নাহ্-র আলোকেই সকল ফিকাহ তৈরী করেছেন; ওনাদের ব্যক্তিগত মত থেকে নয়। চারজনই সর্বজনস্বীকৃত বিখ্যাত ইসলামিক চিন্তাবীদ ও ফকিহ। বর্তমানে একদল তথাকথিত আলেম বলছে - এইসব মাযহাব নাকি ফেতনা (নাঊযুবিল্লাহ)! 
অনেকে হয়তো বলতে পারেন, বিদায়ী হজ্জের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দু'টো জিনিস অনুসরণের ঘোষণা দিয়ে গেছেন। কেমনে কি? অন্ধত্ব পরিহার করে একটু ভালভাবে বিবেক খাটিয়ে চিন্তা করুন, আপনিও নিশ্চয় কাউকে না কাউকে অনুসরণ করছেন। ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস জানুন এবং তিনি কতটা সহিশুদ্ধ ছিলেন তার খোঁজ করুন।

জঙ্গিবাদের স্থান ইসলামে নেই; ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সন্ত্রাসী ও জঙ্গী দল খারেজী সম্প্রদায়। এর উৎপত্তির কয়েক শতাব্দী পরই সিরিয়ার অধিবাসী ইবনে তাইমিয়া আরেকটি চরমপন্থী সন্ত্রসী দল সৃষ্টি করেন। প্রথমদিকে তারা হাম্বলী মাযহাবের বলে নিজেদের পরিচয় দিলেও পরে তাদের ধর্মবিশ্বাস ও সন্ত্রাসের কারণে ইবনে তাইমিয়া ও তার অনুসারীদের মুসলিম শাসকরা ইসলাম বহির্ভুত সম্প্রদায় বা মুরতাদ বলে ঘোষণা করে। অবশ্য যুক্তি দিতে পারেন - শাসকরা কখনো ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কয়েম করতে চান না। কে বলেছে আপনাকে? সত্য প্রচারে মুসলিম শাসকদের ইতিহাস না জেনে অযথা মিথ্যা প্রচার বিশ্বাস করবেন না। বিশ্বখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমন কহিনীতে লিখেছেন, "একদা দামেস্কের জামে মসজিদে ইবনে তাইমিয়া ঘোষণা করেছিল- আল্লাহ আসমান হতে জমিনে নামেন, ঠিক যেভাবে আমি নেমে যাচ্ছি বলে ইবনে তাইমিয়া মিম্বর থেকে নেমে পড়ে। (নাঊযুবিল্লাহ) আল্লাহ পাক মানবসুলভ আকৃতি বিশিষ্ট মতবাদের সে একজন দৃঢ় বিশ্বাসী হিসেবে কুখ্যাত।“

৬৬১ হিজরি তথা ১২৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সিরিয়ার দামেস্কে জন্ম নিয়েছিলেন এই ইবনে তাইমিয়া, যিনি ইসলামের ইতিহাসে ফেতনা সৃষ্টিকারী হিসেবে কুখ্যাত; বিশেষ করে ইমান, আমল ও আকিদাগত ফেতনা (অবশ্য তাকে নিয়ে আমি তিনটি সিরিজ লেখা প্রকাশ করেছি)। যা ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুতে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়নি। নতুনভাবে নজদ তথা বর্তমান রিয়াদ-এর মোহাম্মদ আবদুল ওহাব নাজদী (১৭০৩ - ১২৮৮)-র মাধ্যমে তা ডালপালা মেলে। যা এখন সাড়া বিশ্বের মুসলিমের জন্য এক মহাফেতনা। 
তার বিগত ও বর্তমান অনুসারীরাই আজ মাযহাবের বিখ্যাত তাবেঈ তাবে-তাবেঈ ইমামদের নিয়ে প্রচন্ড বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলছে এবং সেসব বিভিন্ন ভাষায় লিখেও ইন্টারনেট-এ ছড়াচ্ছে। গুগোল সার্চ দিলে এখন ওদের ফেতনা সর্বস্ব বয়ান ও লেখাই বেশি মেলে। তাদেরকে আমি অনুরোধ করবো, কুর'আন ও সহীহ হাদীসের আলোকে ইমামে আজম আবূ হানিফা (রঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ তুলে ধরা পরবর্তী অংশ অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে পড়তে এবং কোন মতামত থাকলে জানাতে।

আল্লাহপাক পবিত্র কুর'আন বলেন -

ﻭﺁﺧﺮﻳﻦ ﻣﻨﻬﻢ ﻟﻤﺎ ﻳﻠﺤﻘﻮﺍ ﺑﻬﻢ

অর্থাৎ- "এই রসূল প্রেরিত হয়েছেন অন্য আরও লোকদের জন্যে, যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি।" - (সূরা আল জুমুআহ্ - ৩)

 সুরা জুমআহ্-র এই আয়াতের তাফসীরে ইমাম বুখারী, হিন্দুস্তানিয় নুসখার বুখারী শরীফের দ্বিতীয় খন্ডের ৭২৭ পৃষ্ঠায় কিতাবুত তাফসীরে একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন—

ﺣﺪﺛﻨﻲ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻌﺰﻳﺰ ﺑﻦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ
 ﻗﺎﻝ : ﺣﺪﺛﻨﻲ ﺳﻠﻴﻤﺎﻥ ﺑﻦ ﺑﻼﻝ
 ﻋﻦ ﺛﻮﺭ ﻋﻦ ﺃﺑﻲ ﺍﻟﻐﻴﺚ ﻋﻦ
 ﺃﺑﻲ ﻫﺮﻳﺮﺓ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻗﺎﻝ
 ﻛﻨﺎ ﺟﻠﻮﺳﺎ ﻋﻨﺪ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ
 ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻓﺄﻧﺰﻟﺖ ﻋﻠﻴﻪ ﺳﻮﺭﺓ
 ﺍﻟﺠﻤﻌﺔ : { ﻭﺁﺧﺮﻳﻦ ﻣﻨﻬﻢ ﻟﻤﺎ
 ﻳﻠﺤﻘﻮﺍ ﺑﻬﻢ } ﻗﺎﻝ ﻗﻠﺖ ﻣﻦ ﻫﻢ
 ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﻓﻠﻢ ﻳﺮﺍﺟﻌﻪ ﺣﺘﻰ
 ﺳﺄﻝ ﺛﻼﺛﺎ، ﻭﻓﻴﻨﺎ ﺳﻠﻤﺎﻥ
 ﺍﻟﻔﺎﺭﺳﻲ، ﻭﺿﻊ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ
 ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻳﺪﻩ ﻋﻠﻰ
 ﺳﻠﻤﺎﻥ ﺛﻢ ﻗﺎﻝ : (( ﻟﻮ ﻛﺎﻥ
 ﺍﻹﻳﻤﺎﻥ ﻋﻨﺪ ﺍﻟﺜﺮﻳﺎ ﻟﻨﺎﻟﻪ ﺭﺟﺎﻝ –
ﺃﻭ ﺭﺟﻞ – ﻣﻦ ﻫﺆﻻﺀ )). ] ﻃﺮﻓﻪ
4898 ، ﺗﺤﻔﺔ 189/ 6
 12917-] 

৪৮৯৭. আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর কাছে বসেছিলাম। এমন সময় তাঁর উপর অবতীর্ণ হলো সুরাহ্ জুমু‘আহ্, যার একটি আয়াত হলো - "এবং তাদের অন্যান্যের জন্যও যারা এখনও তাদের সঙ্গে মিলিত হয়নি।" তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারা কারা….? তিনবার এ কথা জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও তিনি কোন উত্তর দিলেন না।
আমাদের মাঝে সালমান ফারসীও উপস্থিত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালমান ফারসী-র উপর হাত রেখে বললেন, ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রের নিকট থাকলেও আমাদের কতক লোক অথবা তাদের এক ব্যক্তি তা অবশ্যই অর্জন করতে সক্ষম। - [৪৮৯৮; আধুনিক প্রকাশনীঃ  ৪৫২৯, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৪৫৩৩]
 
ইমাম মুসলিমও মুসলিম শরীফের কিতাবুল ফদ্বায়েলিসুস সাহাবাতে, পারস্য অঞ্চলের ফজিলত সম্পর্কে একটি অনুচ্ছেদ কায়েম করে সুরা জুমআ-র এ আয়াতের তাফসীরে বুখারীর উক্ত হাদিসটি ৬৬৬২ নং হাদিসে উল্লেখ করেছেন। তার আগে পারস্যের এক ব্যক্তির (আবূ হানিফা) ব্যাপারে একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন-
ﺣﺪﺛﻨﻲ ﻣﺤﻤﺪ ﺑﻦ ﺭﺍﻓﻊ ﻭﻋﺒﺪ ﺑﻦ
 ﺣﻤﻴﺪ ﻗﺎﻝ ﻋﺒﺪ ﺃﺧﺒﺮﻧﺎ ﻭﻗﺎﻝ ﺍﺑﻦ
 ﺭﺍﻓﻊ ﺣﺪﺛﻨﺎ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﺮﺯﺍﻕ ﺃﺧﺒﺮﻧﺎ
 ﻣﻌﻤﺮ ﻋﻦ ﺟﻌﻔﺮ ﺍﻟﺠﺰﺭﻱ ﻋﻦ
 ﻳﺰﻳﺪ ﺑﻦ ﺍﻷﺻﻢ ﻋﻦ ﺃﺑﻲ ﻫﺮﻳﺮﺓ
 ﻗﺎﻝ : ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ
 ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ : (( ﻟﻮ ﻛﺎﻥ ﺍﻟﺪﻳﻦ
 ﻋﻨﺪ ﺍﻟﺜﺮﻳﺎ ﻟﺬﻫﺐ ﺑﻪ ﺭﺟﻞ ﻣﻦ
 ﻓﺎﺭﺱ – ﺃﻭ ﻗﺎﻝ ﻣﻦ ﺃﺑﻨﺎﺀ
 ﻓﺎﺭﺱ – ﺣﺘﻰ ﻳﺘﻨﺎﻭﻟﻪ .((
 অর্থাৎ- রসূল (সাঃ) বলেছেন দ্বীন আকাশের সুরাইয়া নক্ষত্রের নিকট চলে গেলেও পারস্যবাসীদের মধ্যে অথবা তিনি বলেছেন পারসী সন্তানদের মধ্যে এক ব্যক্তি সেখান থেকে তা গ্রহণ করবেন। - (মুসলিম শরীফ,হাদীস নং ৬৬৬১)
 
সুরা জুমআহ্-র উক্ত আয়াতের তাফসীরে উল্লেখিত হাদীসটি নুয়াইম শরীফে ১৬ জন সাহাবী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে (সুবহানআল্লাহ)।সালমান ফারসি (রাঃ) ৩৬ হিজরী সনে ২৫০ মতান্তরে ৩৫০ বছর বয়সে মাদায়েন শহরে ইন্তেকাল করেন। পক্ষান্তরে সাহাবী (রাঃ)-গণের মধ্যে সবর্শেষ ইন্তেকাল করেন হযরত আবু তোফায়েল (রাঃ) ১১০ বা ১২০  হিজরী সনে। এ পর্যন্ত সময়কালকে সাহাবায়ে কেরামের যুগ বলা হয়।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বোঝাতে চাইলেন,
ﻭﺁﺧﺮﻳﻦ ﻣﻨﻬﻢ আয়াতের - (সূরা জুমআহ্ -৫) উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইমাম আজম আবু হানিফা (রঃ)। কেননা ইমাম মালেক (রঃ) আরবের আসবাহী বংশের, ইমাম শাফেয়ী (রঃ) কুরাইশ বংশের, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রঃ) শাইবানি বংশের; ওনাদের কেউই পারাস্যের নন। কেবল ইমাম আবূ হানিফা (রঃ)-ই পারস্যের অধিবাসী। আকাশের সুরাইয়া তারকার নিকটও যদি ইমান/ইলম থাকে পারস্যের এক ব্যক্তি/সালমান ফারসী (রাঃ)-র বংশের এক ব্যক্তি তা অবশ্যই অর্জন করতে সক্ষম বা পারসী সন্তানদের মধ্যে এক ব্যক্তি সেখান থেকে তা গ্রহণ করবেন। সুতরাং ইমাম আজম আবূ হানিফা (রঃ) হচ্ছেন হাদিসে ঘোষিত সেই ব্যক্তি।

এই মর্মে ত্বহাবী শরীফের বৈরুত (লেবানন) নুসখার প্রথম খন্ডের ৫-৬  পৃষ্ঠায়, হিন্দুস্তানীয় নুসখার ৭ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে-

ﺍﻹﻣﺎﻡ ﺍﻷﻗﺪﻡ ﺍﻟﻬﻤﺎﻡ ﺍﻷﻋﻈﻢ
 ﺍﻷﻓﺨﻢ ﻧﺎﺋﻞ ﺍﻟﺪﺭﺟﺎﺕ ﺍﻟﻌﻠﻰ
 ﺑﺸﻬﺎﺩﺓ ﻟﻮ ﻛﺎﻥ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﻋﻨﺪ ﺍﻟﺜﺮﻳﺎ
 ﻓﺨﺮﺍﻷﻣﺔ ﺍﻟﻤﺤﻤﺪﻳﺔ ﻧﺎﺷﺮﺍﻟﺴﻨﺔ
 ﺍﻟﻤﺼﻄﻔﻮﻳﺔ ﻗﺮﻡ ﺍﻟﻔﻘﻬﺎﺀ ﻭ
 ﺍﻟﻤﺤﺪﺛﻴﻦ ﻭﻣﻌﻈﻢ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﺼﻼﺡ
 ﻭﺍﻟﺪﻳﻦ ﺇﻣﺎﻣﻨﺎ ﻭ ﺇﻣﺎﻡ ﺍﻟﻤﺴﻠﻤﻴﻦ
 ﻣﻦ ﻟﺪﻥ ﻋﻬﺪ ﺍﻟﺘﺎﺑﻌﻴﻦ ﺇﻟﻰ ﻳﻮﻡ
 ﺍﻟﺪﻳﻦ ﺃﺑﻮﺣﻨﻴﻔﺔ ﺍﻟﺼﻮﻓﻰ
 ﺍﻟﺘﺎﺑﻌﻰ ﺍﻟﻜﻮﻓﻰ ﺭﺡ ) ﻃﺤﺎﻭﻯ
 ﺷﺮﻳﻒ ﺝ 5-6 )
 
অর্থাৎ - ইমামে আজম হযরত আবু হানিফা (রঃ) মুজতাহেদ ইমামগণের সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বড় ইমাম। তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী ও ইমামদের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভবিষ্যতবাণী - “যদি ইলম আকাশের সূরাইয়া তারকার কাছেও থাকে তবুও কেউ তা হাসিল করবেন" সেই সৌভাগ্য তিনিই অর্জন করেছিলেন। তিনি উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য গর্বস্বরূপ এবং সুন্নতের প্রচার-প্রসারকারী। তিনি সকল ফকিহ ও মুহাদ্দেসগণের সর্দার ও তাদের মাথার মুকুট। তিনি দ্বীনদার বুযুর্গগণ ও মাশায়েখগণের মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি তাবেঈগণের যুগ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আমাদের ও মুসলমানদের ইমাম। তিনি একজন সূফি এবং কুফী-তাবেঈ ছিলেন। - (তাহাবী শরিফ বৈরুত নসখা-১খ; ৫-৬পৃঃ; হিন্দুস্তানীয় নুসখা ৭পৃঃ)
 
ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী আস শাফেয়ী (রঃ), ওফাত ৯১১হি; তাঁর তাবয়িদুস সহীফা গ্রন্থের ’তাবশীরুন নবী’ অধ্যায়ে বলেন- উক্ত হাদীস দ্বারা ইমামে আজম আবু হানিফা (রঃ)-কে বুঝানো হয়েছে|
ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ুতী (রঃ) কোন হানাফী আলেম নয়, তিনি ছিলেন শায়েফী; সেই ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী (রঃ) বলেন - উক্ত হাদিস দ্বারা ইমামে আজম আবূ হানিফা (রঃ)-ই উদ্দেশ্য।

ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী (রঃ), ওফাত ৯৭৩হি.; তাঁর আল ’খায়রাতুল হিসান’ কিতাবের একটি অধ্যায়ে বর্ণনা করেন-
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের ’সুসংবাদ বিষয়ক হাদীস’ অধ্যায়ের প্রারম্ভে তিনি বলেন-
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ দ্বারা ইমাম আবু হানিফা (রঃ) উদ্দেশ্য| কেননা, তাঁর সমসাময়িক পারস্যবাসীদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি তাঁর জ্ঞানের সীমায় এমনকি তাঁর ছাত্রদের জ্ঞানের সীমা পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়নি| -  (ইবনে হাজর হায়তামী, ১৯৮৩, পৃ. ২৪)
 কেননা চার ইমামের মধ্যে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ছাড়া অন্য কেউ পারস্যের ছিলেন না| উল্লেখ্য, ইমাম মালিক (রঃ) মদীনায় ৯৩ হিজরীতে জন্ম লাভ করেন| - (যাহাবী, সিয়ারু, আ’লামিন নুবালা, ১৪১৩ হি, ৮/৪৮)
ইমাম শাফে’ঈ ১৫০ হিজরীতে বায়তুল মুক্বাদ্দিসের গাজায় জন্মলাভ করেন| - (নভভী, তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত,১/৬৮)
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল মাতা-পিতা উভয় দিক থেকে আরবী| তিনি বাগদাদে ১৬৪ হিজরীতে জন্ম লাভ করেন|- (মযী, তাহযীবুল কামাল, ১৯৮০, ১/৪৩৭)

বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার ইবনে হাজার আসক্বালানী (রঃ)-ও বলেছেন উপরের হাদিস ধারা ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে বুঝানো হয়েছে। ইমাম আজম আবূ হানিফা (রঃ) ’দিরায়তো হাদীসে’ যেমন সকলের জন্য অনুকরণীয়, তেমন 'রেওয়াতে হাদীসে’ও তিনি সর্বজন স্বীকৃত ইমাম  ছিলেন। কিন্তু যার ব্যক্তিত্ব যত বেশি তার বিরোধিতাও তত বেশি| ইমাম আজম-কেও বিরোধিতা ও শত্রুতার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে বারংবার| বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে তাঁর বিরোধিতার যে প্রপাগাণ্ডা চলছে তা হলো তিনি ইলমে হাদীস সম্পর্কে অনবিহিত ও  অনভিজ্ঞ ছিলেন (নাঊযুবিল্লাহ)।
এটি তাঁর বিরুদ্ধে এক জঘন্য অপবাদ|
যেখানে কুরআন,হাদীস প্রমাণ করে, ইমাম আবু হানিফার শ্রেষ্ঠত্বের কথা। সেখানে কিছু কিছু ওলামাদের বিচ্ছিন্ন “যেরা” কে পুজি করে কুরআন,হাদীসের “তাদীলের” বিপরিত দলিল কায়েম করে ইমাম আবূ হানিফার 'দিরায়তে হাদীস' ও ’রেওয়াতে হাদীস'- কে প্রত্যাখ্যান করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। আফসুস তাদের জন্য, যাদের মধ্যে ইনসাফের লেশমাত্রাও নেই। আরো আফসুস হয় তাদের জন্য , যারা ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-এর সম্পর্কিয় আয়াত ও হাদীসসমূহের উপরও ইনসাফ করতে পারেনি। জানিনা উক্ত আয়াত ও সহীহ হাদিসের বিরুধীতাপূর্বক তাদের ইমান ও আখেরাতের পরিণতি কি হবে?

ইমামে আজম আবু হানিফা (রঃ) এর
 মর্যাদা ইমামদের ধারা সত্যায়ন :-

১. ইমাম মালিক (রঃ) [৯৩-১৭৯ হিজরী] :
ইমাম মালিক (রঃ)-কে একবার জিজ্ঞাস করা হলো, আপনি কি আবু হানিফা (রঃ)-কে দেখেছেন?
তিনি জবাব দিলেন হ্যাঁ, আমি এমন এক ব্যক্তিত্বকে দেখেছি, যিনি ঘরের এই স্তম্ভকে (ইলমের যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে) যুক্তি দ্বারা স্বর্ণের স্তম্ভে পরিণত করে দিতে পারেন। - (তারীখে বাগদাদ, খন্ড-১৩, পৃষ্ঠা-৩৩৮)
২. ইমাম শাফিঈ (রঃ)  [১৫০-২০৪ হিজরী] : ইমাম শাফিঈ (রঃ) বলেন, ”যে ব্যক্তি ফিকহ এর ইলিম হাসিল করতে চায়, সে যেন ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এবং তাঁর ছাত্রদের সান্নিধ্য লাভ করে। কারণ, ফিকহের এর ব্যপারে সকলেই ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-এর মুখাপেক্ষী।" - (তারীখে বাগদাদ, খন্ড-১২, পৃষ্ঠা-৩৪৬) 
”যে ব্যক্তি আবু হানিফা (রঃ)-এর কিতাব পড়বে না, ইলমে তার গভীরতা হবে না এবং জ্ঞানও তার অর্জিত হতে পারে না। 
আবু হানিফা (রঃ)-এর কথা এবং কাজ তাঁর ফিকহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।” - (উকুদুল জিমান, পৃষ্ঠা-১৮৭ ) 
“অন্যান্য সকল ফকীহ আলিমগণ ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-এর শাগরেদ।" - (তাযকিরাতুল মুহাদ্দিসীন, পৃষ্ঠা-৬৬)
৩. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ) [১৬৪-২৪১ হিজরী] : ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ) বলেন, “তিনজন এমন ব্যক্তি আছেন, যারা কোন মাসআলায় একমত হয়ে গেল, সেখানে আর ইখতিলাফ করার কোন সুযোগ থাকে না। তখন তাঁকে জিজ্ঞাস করা হলো, কে সেই তিনজন ব্যক্তি? তখন তিনি জাবাব দিলেন, 'আবু হানিফা (রঃ) এবং তাঁর দুই বিশেষ ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) ও ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান (রঃ)'।" - (আল-আনসাব লিস সামআনী, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-২০৪)
8.  ইব্রাহীম হারবী বলেন, ” আমি একবার ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ)-কে জিজ্ঞাস করলাম, ‘এত সূক্ষ্ম মাসআলাসমূহের উত্তর আপনার কাছে কোথা থেকে আসলো? 
তিনি জবাব দিলেন, "মুহাম্মদ ইবনে হাসান (রঃ) (ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-র ছাত্র) - এর কিতাব থেকে।” - (তারীখে বাগদাদ, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭৭)
৫. ইমাম খুরাইবী (রঃ) বলেন, "অজ্ঞ বা হিংসুক ছাড়া আর কেউ ইমাম আবু হানিফা (রঃ) সম্পর্কে কটুক্তি করবে না।" 
তিনি আরো বলেন, "মুসলমানদের উপর ওয়াজিব তাদের নামাজে ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-র জন্য দু'আ করা।"
৬. ইমাম বুখারী (রঃ)-র খাস উস্তাদ, মুহাদ্দেস মক্কী ইবনে ইবরাহীম (রঃ) বলেন, "ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তাঁর যুগের সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন।" - (মানাকিবুল ইমাম আবু হানীফা: ২৭ পৃ.)

হে আল্লাহ! ইমামে আজম আবু হানিফা রহমতুল্লাহ আলাহি-কে না জেনে না চিনে যারা বিরুপ মন্তব্য করে, আমাদের সে ভাইদের জানার ও বুঝার তৌফিক দিন, হিংসুকদের বন্ধুতে পরিণত করে দিন; তাদের অন্তরকে প্রশস্ত করে দিন। তাদের অপপ্রচারে আমাদের সবরে জামীল ইখতিয়ার করার তাওফীক দান করুন।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১৬ মে ২০১৭.

শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০

আরব বিশ্বে শিক্ষার পুনঃজাগরণ; কওমী শিক্ষার বোধহীনতা!


.بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

﴿اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ﴾
১) পড়ো ( হে নবী ) , তোমার রবের নামে ৷  যিনি সৃষ্টি করেছেন৷

﴿خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ﴾
২) জমাট বাঁধা রক্তের দলা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন৷

﴿اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ﴾
৩) পড়ো , এবং তোমার রব বড় মেহেরবান ,  

﴿الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ﴾
৪) যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন৷

﴿عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ﴾
৫) মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন , যা সে জানতো না৷
- [সুরা আলাক : ১-৫]

পবিত্র কোর'আনুল কারীমের ৯৬ নং সুরা আলাক-এর প্রথম পাঁচ আয়াত হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম-এর নিকট প্রথম ওহী, যার শুরু 'পড়ো' দিয়ে এবং ভিত্তি যার 'শিক্ষা ও জ্ঞান'। জীবনের মাত্র ২৩ বছরে তিনি সমগ্র মানব জাতির মধ্যে শিক্ষার এক নতুন জাগরণের সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। যারা একদিন তাঁর শত্রু ছিল - তারাই এই শিক্ষা গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিল; যারা পরস্পর রেষারেষিতে মত্ত ছিল - তারাই এই শিক্ষা গ্রহণ করে আপন ভাইয়ে পরিণত হয়েছিল; যে সমাজের সর্বত্র রক্তক্ষয়ী সংঘাত খুন-খারাবির অগ্নি দাবানল হয়ে জ্বলে উঠত - সেখানেই এই শিক্ষার আলোকে শান্তির ফুল ফুটে উঠেছিল। আমাদের দেশের বর্তমান মুসলিমদের হুঙ্কার শুনে ভাবি, এ আবার কোন অশনি সংকেত? 
 
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম-এর জন্মভূমি আরবদেশ একটি ত্রিভূজাকৃতির উপদ্বীপ; যা ইসলামের  লীলাভূমি। তিনদিক জল ও একদিক স্থল পরিবেস্টিত জাজিরাতুল আরব বা আরব উপদ্বীপের বৈচিত্র্যময় ভৌগলিক পরিবেশ ও শুষ্ক আবহাওয়া ওখানকার অধিবাসীদের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে জাজিরাতুল আরব এশিয়ার দক্ষিন পশ্চিম উপদ্বীপ; যা মানচিত্রের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ উপদ্বীপ। আগের এই জাজিরাতুল আরব নামে সুপরিচিত ভূ-খন্ডের উত্তরে সিরিয়ার মরুভূমি, দক্ষিনে ভারত মহাসাগর, পূর্বে পারস্য উপসাগর ও পশ্চিমে লোহিত সাগর; এর আয়তন ১০ লক্ষ ২৭ হাজার বর্গমাইল। আয়তনের দিক থেকে এটি ইউরোপের এক চতুর্থাংশ। ঐতিহাসিক মাকরিযির মতে, প্রাচীন আরবের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ।

নদ-নদী না থাকায় এবং শুষ্ক আবহাওয়ার কারনে আরবের এক-তৃতীয়াংশ মরুময় ও মানুষের বসবাসের অযোগ্য। এসব স্থান খুবই শুষ্ক, নিষ্করুন, রৌদ্রদগ্ধ ও বৃক্ষলতাদি শূন্য, ফলে সেখানে প্রায়ই ‘লু' হাওয়া প্রবাহিত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই লু’ হাওয়া ও উত্তপ্ত বালুকামিশ্রিত আবহাওয়া থেকে আত্মরক্ষার্থে আরবরা অনেক আগ থেকেই ঢিলেঢালা লম্বা আলখেল্লা জাতীয় পোষাক পড়ে এবং বাতাসের উড়ন্ত বালি থেকে নিজেদের রক্ষার্থে মাথায় পাগড়ি পড়ে। 
আরবজাতি প্রধানত দু-ভাগে বিভক্ত; যথাঃ আরব আরিবা বা প্রকৃত আরব এবং আরব মুস্তারিবা বা আরবিকৃত আরব। আরব আরিবা বলতে বুঝায় কাহতানের বংশধর; অর্থাৎ, মহানবী (সাঃ) এর জন্মের পূর্বে যাঁরা হেজাজ ও ইয়েমেনের শাসনকাজ পরিচালনা করতেন। আর আরব মুস্তারিবা হলেন বহিরাগতরা; তাঁরা হযরত ইব্রাহিম (আঃ), হযরত ইসমাইল (আঃ) ও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর বংশধর; যাঁদের প্রচারিত ধর্মের নাম ইসলাম।

প্রকৃতপক্ষে ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃতি শুরু হয় হুজুরপাক (সঃ)-এর মৃত্যুর পর, অর্থাৎ ৬৩০-এর প্রথম থেকে। বাইজেন্টাইন (পূর্ব রোমান) সাম্রাজ্য ও সাসানিদ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর এই নতুন ধর্ম ইসলামকে নতুন নতুন সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়।  এই ধর্মের অনুসারী আরবের মরু যোদ্ধাদের তখন মোকাবেলা করতে হয়েছিল প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত সব সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে; যাদের রাজধানী ছিল কনস্ট্যান্টিনোপোল (বর্তমানে ইস্তানবুল) এবং তিসফুনে।

ইসলামের ১ম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) সৈনিকদের উদ্দেশ্যে কিছু নীতিমালা বেঁধে দিয়েছিলেন। যেগুলোর সাথে পূর্ব ও পরবর্তী যুগের যুদ্ধবিগ্রহের রীতি-নীতির তুলনা করলে বুঝা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রেও ইসলামের নীতি কতটা মহান ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। তিনি মুসলিম সৈন্যদের যে নির্দেশনাটি দিয়েছিলেন তা সরাসরি তুলে ধরলাম - 
“যুদ্ধক্ষেত্রে কিভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করবে সে ব্যাপারে আমি দশটি নীতিমালা দিচ্ছি : 
কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না কিংবা সঠিক পথ থেকে দূরে সরে যাবে না। মৃতদেহ বিকৃত করবে না। শিশুদের হত্যা করবে না; নারী কিংবা বয়স্কদেরও নয়। বৃক্ষাদির কোন ক্ষতি করো না; কিংবা আগুনে পুড়িয়ে দিবে না, বিশেষ করে ফলবতী বৃক্ষরাজির দিকে বেশী নজর রাখবে। শত্রুবাহিনীর পাল থেকেও কোন প্রাণী হত্যা করবে না; খাদ্য সঞ্চয় করবে, অপচয় করবে না। তোমরা হয়তো এমন সব মানুষের দেখা পাবে যারা সন্ন্যাসী হিসেবে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে (সন্যাসব্রত পালন করেছে); তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দিবে, উত্যক্ত করবে না এবং এড়িয়ে চলবে।” 

ইসলামের স্বর্ণালী যুগে ও তৎপরবর্তীতেও দেখা যেতো একজন মুসলিমের জীবনাদর্শে মুগ্ধ ও উদ্ভুদ্ধ হয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীরা ইসলামে দীক্ষা নিত; কাউকে জোর করে চাপিয়ে ধর্মান্তরিত করা হতো না। যে ধর্মের অগ্রযাত্রার পিছনের চালিকা শক্তি ছিল শিক্ষা, ন্যায় পরায়নতা, নমনীয়তা, সহনশিলতা, সহমর্মিতা; আজ সেই ধর্মই ভ্রান্ত মতবালম্বীদের পাল্লায় পরে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। হুজুরপাক (সাঃ)-কে যাঁরা দু'চোখে দেখেছেন, ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং হুজুরপাক (সাঃ)-এর সাথে ছিলেন তাঁরা হলেন সাহাবী (রাঃ); যাঁরা নক্ষত্রসম। তাঁদের পরের প্রজন্ম তাবেঈন; এর পরের প্রজন্ম তাবে-তাবেঈন। কিতাব থেকে নেয়া তাবে-তাবেঈন যুগের একটি সত্য ঘটনা:

এক তাবে-তাবেঈন তাঁর দোকানে ১২/১৩ বছর বয়সের ভাতিজাকে রেখে একদিন আসরের নামাজ আদায় করতে যান। ফেরার পথে তিনি দেখতে পান, এক ব্যক্তি তাঁর দোকানের রেশমী একটি কাপড় হাতে  নিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। লোকটিকে থামিয়ে তিনি জানতে চাইলেন কত দিয়ে কাপড়টি কিনে এনেছেন। ঐ ব্যক্তি বললেন, "৪০০ দিহরাম।" তাবে-তাবেঈন চমকে উঠে বললেন, " বলেন কি? এটার দাম তো এতো না, ফিরে চলুন আমার সাথে।"  লোকটি বলল, " আমি একজন বেদুইন, প্রত্যন্ত্য গ্রামে থাকি; আমার এলাকায় এই রেশমি কাপড় খুব কম পাওয়া যায়, কদাচিত পাওয়া গেলেও দাম আরো অনেক বেশি। দোকানি আমার কাছে ৫০০ দিহরাম দাম চেয়েছিল; দামাদামী করেই আমি কম দামে এটা নিয়ে এসেছি। তাছাড়া এত কম দামে এমন কাপড় পেয়ে আমি খুশি।" তাবে-তাবেঈন বললেন, " অসম্ভব! যে দোকান থেকে আপনি এটা কিনে এনেছেন আমি সেই দোকানের মালিক, ভাতিজাকে দোকানে রেখে আমি নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলাম; আপনাকে সে ঠকিয়েছে, ফিরে চলুন।"

বেদুইন ফিরে আসতে না চাইলেও তাবে-তাবেঈন তাকে দোকানে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এবং এসেই প্রথমে ভাতিজাকে তিরস্কার করেন; বলেন, " তোমার ভাইকে কি তুমি এভাবে ঠকাতে পারতে? তবে কেন তুমি ২০০ দিহরামের কাপড় ৪০০ দিহরাম দাম নিলে?"
তাবে-তাবুঈন অত্যন্ত লজ্জিত ও দুঃখিত হয়ে বেদুঈনের কাছে ক্ষমা চেয়ে তৎক্ষণাৎ ২০০ দিহরাম ফেরত দেন। একজন সাধারণ মুসলিমের এই আচরণে মুগ্ধ হয়ে সেইদিন সেইসময় সেখানেই বেদুঈন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। 
আর আজকের মুসলমান একটু সুযোগ পেলেই দূর্বলের উপর, সংখ্যালঘুদের উপর চেঁপে বসে; অনেক তথাকথিত আলেম-ওলামাকেও দেখেছি বিচ্ছিরিভাবে ওদেরকে গালাগালি বা অভিসম্পাত করতে। কেউ কি কখনো নিশ্চিত করে বলতে পারবে, কে কখন আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীনের দ্বারা হেদায়েত প্রাপ্ত হবেন বা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবেন?

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, "জ্ঞানের কথা বিজ্ঞজনের হারানো সম্পদ; যে যেখানেই তা পাবে সে-ই হবে তার সবচেয়ে বেশি অধিকারী।" 
হাদিসটি থেকে একথাটি স্পষ্ট প্রতিয়মান - রাসুলুল্লাহ (সা.) জ্ঞানকে সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষার নামে কোনো বিভেদ সৃষ্টি করেন নি; দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণে যে জ্ঞান উপকারী তার সবই ইসলামী শিক্ষার জন্য প্রযোজ্য। শুধুমাত্র বিশুদ্ধ নিয়তে আল্লাহর নামে শুরু হলে যেকোনো ধরনের জ্ঞান অর্জনই ইবাদত বলে গণ্য হয়।

ইসলামের স্বর্ণালী যুগে সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষা নামে শিক্ষার বিপরীতমুখী কোন শিক্ষাধারা ছিল না, বরং যাঁরাই তখন কোরআন ও হাদিস চর্চা করতেন, তাঁরাই আবার সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান, ভূগোল, দর্শন ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতেন; ইবনে রুশদ, ইমাম রাজি, হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী প্রমুখ মনীষীগণ এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। পর্যায়ক্রমে মুসলিম বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হতে ওদের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। ইসলামী চেতনার চতুর্মুখী শিক্ষার ধারাকে গুরুত্বহীন করার অভিপ্রায়ে প্রাচ্যাত্য সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিমদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষা নামে দুটি ধারার সৃষ্টি করে দিয়ে যায়; যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পরেছে অনেক মুসলিম সমাজে। এতে মুসলিমের মধ্যে মতবেদ, বিভেদ ও অনৈক্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরেছে; ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে দাঁড়ানোর শক্তিই আজ তারা হারিয়ে ফেলেছে। অথচ শিক্ষাকে কখনো ইসলাম বিভক্ত করে নি, বরং শিক্ষা ও জ্ঞানকে ইসলামে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া আছে; আর শিক্ষাই মুসলমানের সবচেয়ে বড় হারানো সম্পদ। 

অষ্টম শতাব্দীর গোড়া থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত মুসলিমরা ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনন্য অসাধারণ এক জাতি। তাঁরা তখন শুধু নিজেরাই জ্ঞানচর্চা ও অনুশীলনে নিবেদিত থাকতেন না, বরং জ্ঞানান্বেষু অন্যান্য জাতিকেও তাঁদের উদ্ভাসিত জ্ঞানের অংশীদার করতে কুণ্ঠিত হতেন না। মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা জ্ঞান সাধনার পাশাপাশি ধর্মপ্রচারক ও সমরনায়কদের সাথেও বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। মুসলিমদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে এভাবেই বন্য দ্যালামাইতস, স্যালজুক, তাতারস ও বার্বার জাতি শান্তির সন্ধান খুঁজে পেয়েছিল। 

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মুসলিমরা   বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে - যেমন চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে ক্রমেই অগ্রসর হতে থাকে; বিশেষ করে কারাওইন, কর্ডোভা, টলেডো, সেভিল ও গ্রানাডার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা দেশে ফেরত আসার পর বর্ণিত বিষয় ও ক্ষেত্রগুলোতে শনৈঃ শনৈঃ অগ্রগতি লাভ করতে থাকে। বিস্ময়করভাবে মুসলিমদের জ্ঞান তখন পরিশ্রমী অনুবাদকদের দ্বারা অনূদিত হয়ে ইউরোপে স্থানান্তরিত হতে থাকে। আরব থেকে মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতিও তরতর করে ইউরোপে বিস্তৃতি লাভ করে; বিশেষকরে সিসিলি ও স্পেন দিয়ে। সিসিলি ও স্পেন ছিল তখন এসব বিস্তৃতির প্রধান উৎসস্থল; সিসিলিতে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত দুজন শাসক ছিল - একজন দ্বিতীয় রজার এবং অন্যজন দ্বিতীয় ফ্রেডরিক; যারা শিক্ষা সহযোগীতায় যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন।

যারা ভাবে ধৃষ্টতাপূর্ণ কথাবার্তা, রূঢ় আচার আচরণ ও তলোয়ারের পিঠে ইসলামের বিজয় সূচিত হয়েছে, তারা ভুল ধারণা পোষণ করছে। সেই শুরু থেকেই একজন মুসলমান ছিল উদার; তাঁদের জীবনযাত্রা ছিল অনুকরণীয় অনুসরণীয়। ইসলামী জীবনে কোনদিনও কোথাও বিন্দু পরিমাণ সন্ত্রাস বা উগ্রতার স্থান ছিল না, নেইও। বিশ্বের কট্টর ইসলামী রাষ্ট্রও যখন অবাধ তথ্যপ্রযুকতির এই ডিজিটাল যুগের সত্যতা ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে নিজেদের পরিবর্তন করতে উঠেপড়ে লেগেছে, তখন আমাদের দেশের এক শ্রেণীর তথাকথিত আলেম-ওলামা প্রবেশ করতে চাইছে আইয়ামে জাহিলিয়াতে। যখন বদলে যেতে চাইছে বা বদলে যাচ্ছে জাজিরাতুল আরব তথা আরব উপদ্বীপ; বদলাতে চাইছে না আমাদের তথাকথিত আলেম-ওলামার দল। মুর্খতা তাদেরকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে; তারা নাকি চাচ্ছে না - মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে বিজ্ঞান গণিত একত্রিভূত করতে!

বিগত ৫ বছরে ১ হাজার ৭৯৩টি স্কুল খোলা হয়েছে ইসলামের তীর্থ সৌদি আরবে। বছরে গড়ে ৩০০ কিন্ডারগার্টেন স্থাপন করা হচ্ছে সে দেশ জুড়ে। আরবের শিশুদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা এবং বর্তমান অলস আরবীয়দের কর্মসংস্থানে উদ্ভুদ্ধ করতেই এই উদ্যোগ নিয়েছে সেদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

'ভিশন ২০৩০' এর আওতায় প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করছে জাজিরাতুল আরবের অন্য আরেক ছোট্র দেশ কাতার। এরই মাঝে যৌথভাবে ৫.৮ পিসা স্কোর নিয়ে পঞ্চম স্থানে স্থান করে নিয়েছে এই রক্ষনশীল ইসলামী সমাজব্যবস্থার দেশটি; তাঁরাও এখন বেড়িয়ে আসতে চাইছে। ২০৩০ সালে শিক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা পাওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষাপদ্ধতিতে তারা এনেছেন ব্যাপক পরিবর্তন।

বিংশ শতাব্দীর পূর্বে কাতারের সমাজে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য তেমন কোন জোর দেওয়া হত না। এটি ছিল প্রথাগত বেদুইন সংস্কৃতির দেশ। একসময় কাতারের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের শিখানো হতো কিভাবে কুরআন মুখস্ত করতে হয়, মনে রাখতে হয় এবং পড়তে হয়। এই ধরনের শিক্ষা সাধাণত ১০ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যায়। যার ফলে তাদের পরিবার ১০ বছর বয়সেই আল-খাতমা বা কুরআন শিক্ষা শেষকে উৎযাপন করতো।  ১৮শ শতকের দিকে পেনিনসুলার একটি উল্লেখযোগ্য শহর যুবারাহ ইসলামি শিক্ষার কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
ইসলামী বিদ্যালয় তখন তিন ভাগে বিভক্ত ছিল; মসজিদ, কুত্তাব এবং মাদ্রাসা। ১৮৭৮ এবং ১৯১৩ এর মধ্যে ২০টি কুত্তাব, ৩০টি মাদ্রাসা ও ৪০০ টি মসজিদ কাতার এর মধ্যে আল-হাসা নামক এলাকায় ছিল। মসজিদ সাধারণত প্রার্থনা করার জন্য ব্যাবহৃত হত, সেখানে ইসলামের নানান ধরনের ধর্মীয় নির্দেশনা ও শিক্ষার সুযোগ সুবিধাও দেওয়া হতো।
কুত্তাব যা মক্তব নামে পরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২ ভাগে বিভক্ত ছিল। কুত্তাব-এর ১ম ভাগে কুরআন ও ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ শিক্ষা দেওয়া হতো; যা শহর ও গ্রাম উভয় যায়গাতেই ব্যাপক বিস্তৃত ছিল। ছেলে-মেয়ে উভয়  শিশুরাই ওখানে অংশগ্রহণ করতে পারতো; যদিও তারা লিঙ্গে পৃথকীকৃত ছিল। পুরুষ শিশুদের শেখানো হতো খোলা যায়গায় বা মসজিদে, অন্যদিকে নারী শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হতো ঘরে। কুত্তাবের অন্য বিভাগে কুরআন ছাড়াও পড়া, লেখা এবং গণিত শিক্ষা দেওয়া হতো। কুত্তাবে অবশ্য বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল; এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রশিক্ষকদের যোগ্যতার অভাব।
মাদ্রাসা গুলোই শিক্ষার জন্য সবচেয়ে ভাল মাধ্যম ছিল; সেখানে ইসলাম, বিজ্ঞান ও আরবি সাহিত্য শিক্ষা দেওয়া হতো। এগুলো সাধাণত শহর এলাকায় দেখা যেত; মাদ্রাসাগুলো থেকে সবসময় ভাল এবং উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন কবি ও সরকারি কর্মচারী বের হত; ১৯৩৮ সালে যা বন্ধ হয়ে যায়। 

কাতারের এক ধনাট্ট ব্যাক্তি দ্বারা ১৯৪৯ সালে দোহায় দেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়; যার নাম  ইসলাহ আল-মুহাম্মাদিয়া। এটি ১ জন শিক্ষক ও ৫০ জন শিক্ষার্থী দ্বারা পরিচালিত হতো। নগরীর দ্বিতীয় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালে। দোহাতে দেশের ১ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শীগ্রই তার প্রভাব চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯৫২ সালে আল-খোর নামক একটি অর্ধ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়, এবং আর-রুয়াস এর প্রথম ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়; এভাবেই বিদ্যালয় এর সংখা ২ থেকে ৪, ৪ থেকে ৮ হতে থাকে। ১৯৫৪ সালে সর্বমোট ৫৬০ জন শিক্ষার্থী এবং ২৬ জন শিক্ষক ছিল এই শিক্ষাব্যবস্থায়।  ১৯৫৫ সালে প্রথম মেয়েদের আনুষ্ঠানিক বিদ্যালয় দোহাতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন শিক্ষা কর্মকাণ্ডের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাপ নির্ধারণ করে দেয়। ঐ বছরই ১৭ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৩৩৩ জন শিক্ষার্থী ও ৮০ জন শিক্ষক নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৭ সালে মেয়েদের শিক্ষাকেও জাতীয় শিক্ষা কর্মসূচিতে যোগ করা হয়। সে বছর ২টি মেয়েদের বিদ্যালয় ১৪ জন শিক্ষিকা এবং ৪৫১ জন ছাত্রী নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। মেয়েদের শিক্ষার হার এত দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায় যে ১৯৭৫-৭৬ সালে এসে মেয়েদের বিদ্যালয় এবং ছেলেদের বিদ্যালয়ের সংখা সমান হয়ে যায়; উভয় ক্ষেত্রেই তখন ৬৫ টি স্কুল গড়ে উঠে।
১৯৯৬ সালে কাতারের শিক্ষার্থীর সংখা ছিল প্রায় ৫১০০০ জন যার মধ্যে ৩৫০০০ জন ছিল প্রাথমিক, ১৬০০০ জন ছিল মাধ্যমিক এবং ৮০০০ জন বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থী ছিল। 
[ তথ্যসুত্র : ইউকিপিডিয়া ]

বর্তমানে কাতারের শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ দুইটি মন্ত্রণালয় এর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে; শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সর্বচ্চ শিক্ষা কাউন্সিল। এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়ন হ্রাস করা হয়েছে এবং অনেক বিদ্যালয় বর্তমানে সর্বোচ্চ শিক্ষা কাউন্সিলের অধিনে চলে গেছে। 
কাতারের শিক্ষাব্যবস্থা সর্বোচ্চ শিক্ষা কাউন্সিল (এসইসি) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় (এমওই) এর দ্বারা যৌথভাবে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সকল স্বাধীন বিদ্যালয়গুলি এসইসি এর দ্বায়িত্বে থাকে অন্যদিকে এমওই সকল বেসরকারি বিদ্যালয় সমূহকে সাহায্য প্রদান করে। ১৯৫৬ সাল থেকে প্রথাগত বিদ্যালয় ভিত্তিক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।  প্রাথমিক শিক্ষা সকল শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক এবং সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে প্রাথমিক শিক্ষা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়।
কাতারে শিক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট বৈচিত্র্যময়, এখানে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করে। কাতারে প্রায় ৩৩৮ টি আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় আছে। রাজধানী দোহা গড়ে উঠেছে দেশটির শিক্ষা শহর হিসেবে; যেখানে বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় এর স্যাটেলাইট ক্যাম্পাস রয়েছে।

২০০১ সালে কাতার রেন্ড কর্পোরেশনকে  ভাড়া করে তাদের কিন্টারগার্টেন থেকে ১২ তম শ্রেণীর লেখাপড়ার মান ও অনিশ্চয়তা সম্পর্কে জানতে। এ সময় রেন্ড এর গবেষণা পরিচালিত হয়, প্রায় ১০০০০০ শিক্ষার্থী কাতারের শিক্ষাব্যবস্থা কতৃক পরিবেশিত হয়,যাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ সরকারি বিদ্যালয় গুলোতে উপস্থিত ছিল। রেন্ড শিক্ষাখাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃপণতাকে দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রের প্রধান দুর্বলতা বলে জানায়। রেন্ড এছাড়াও কাতার সরকারকে আরও নানা ধরণের সংস্কার এর কথা বলে; যার মধ্যে পাঠ্যক্রম এর উন্নয়নের উপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়। রেন্ড এর গবেষণার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ২০০১ সালে সুপ্রিম শিক্ষা কাউন্সিল নতুন যুগের শিক্ষা (EFNE) নামে একটি নতুন উদ্যোগ গ্রহন করে এবং দেশের শিক্ষা নীতির প্রচুর সংস্কার করে। ইএফএনই এর একটি প্রধান উদ্যেশ্য ছিল পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষা পদ্ধতিকে গ্রহন করা এবং বিদ্যালয় গুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া। এছাড়াও এসইসি-ও এই উদ্যেগ গ্রহনের মাধ্যমে তাদের ভর্তি বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল। ২০০৫ সালে এসইসি আরবি, গণিত ও বিজ্ঞান সকল শ্রেনির জন্য দেশীয় পাঠ্যক্রম এর শিক্ষা পদ্ধতি উত্থাপন করে। এর পরেই সেখানে বৃহৎ পরিমাণে স্বাধীন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম শুরু হয়; ২০০৪ সালে ১২ টি, ২০০৫ সালে ২১ টি এবং ২০০৬ সালে তেরটি বিদ্যালয় খোলা হয়।

২০০৮ সালের একটি মূল্যায়ন পরীক্ষাতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ নতুন পাঠ্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারে। প্রায় ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজি, ৫ শতাংশ আরবি এবং ১ শতাংশেরও কম শিক্ষার্থী গণিত ও বিজ্ঞানের সংগে পরিচিত ছিল।  ওইসিডি দ্বারা পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায় তখন কাতার তার শিক্ষা সূচক এর ১০ম অবস্থানে ছিল।
আল ওয়াকরা এর ভিশন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল প্রথম প্রাক কিন্টারগার্টেন থেকে ১২ তম শ্রেনি পর্যন্ত আমেরিকান পাঠ্যক্রম অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়ার কথা বলে ২০১৪ সালে। ২০১৫ সালের জানুয়ারীর হিসাবে, আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় পরামর্শ (আইএসসি) কাতারের আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় সমূহের একটি তালিকা প্রকাশ করে যাতে ১৪৭ টি আন্তর্জাতিক বিদ্যালয়ের কথা বলা হয়। বর্তমানে রক্ষণশীল কাতারের শিক্ষাব্যবস্থায়ও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে; এরই মধ্যে তারা ৫.৮ পিসা শিক্ষা স্কোর নিয়ে বিশ্বে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে।

দুনিয়াই আখেরাতের চারণক্ষেত্র; বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণে এখানটা চষে বেড়ানো প্রতিটি মুসলিমের ইমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য। একজন মানুষ যত ধনধৌলতের মালিকই হউক না কেন, শিক্ষা ছাড়া যেমন কখনো পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না; ঠিক তদ্রুপ একটি দেশ যত ধনীই হউক না কেন, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া জাতি কখনো পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২৮ এপ্রিল, ২০১৭.

'দাওরায়ে হাদীস' সমমান বিশ্ববিদ্যালয়ের 'মাস্টার্স' কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ?


"Education Is the backbone of a nation' কে বলেছিলেন তা আমার জানা নেই, তবে তিনি যে সঠিক কথাটিই বলেছিলেন এটা কিন্তু আজকের আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষের দিকে তাকালে মোটেও অনুধাবন করতে পারা যায় না; সহমর্মিতা সহনশীলতা সহঅবস্থান সমব্যথীতার মনোভাব এখন আর অনেকের মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায় না। আগেকার দিনে দেশে এতো এতো শিক্ষিত মানুষজন ছিল না সত্য, কিন্তু কারো মাঝে শ্রদ্ধাভক্তির মোটেও কমতি ছিল বলে কখনও শুনিনি।  দিন দিন দেশে শিক্ষিতের হার যতটা বাড়ছে তার সাথে ততোধিক পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তথাকথিত শিক্ষিতের সংখ্যা, চলছে স্বার্থ নিয়ে অযথা হিংসে বিদ্বেষ ও শ্রেষ্ঠত্বের কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি। তাই আমি বলবো, প্রকৃতপক্ষে সুশিক্ষাই একটি জাতির মেরুদন্ড।

এদেশের বহু ধারার শিক্ষাব্যবস্থার জন্য দেখা যায় এক পক্ষ আরেক পক্ষকে সবসময়ই কোন না কোনভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে এবং একে অন্যকে দোষারোপ করতে; এক ধরণের তথাকথিত শিক্ষিতরা তো তাদের নিজ ধারার শিক্ষাব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ইঁদুর দৌঁড়ে নেমে আছে বহু দিন ধরে। দেশ জাতি তো সবার; কাকে ছাড়া কার চলবে? বা কে চলতে পারবে? সবাই মিলেমিশেই দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। এখানে শ্রেষ্ঠত্বের কি আছে? আমাদের বর্তমান সমাজের অবস্থা এতোটা নাজুক কেন? শেষমেশ এদেশের আলেম সমাজকেও দেখছি এই ইঁদুর দৌঁড়ে শরিক হতে। তবে কি সবায়-ই আমরা ভ্রান্ত পথে হাটছি?

একসময় এদেশের বিখ্যাত সব আলেম ওলামার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অত্যন্ত সুদৃঢ় ছিল। সেই সুবাদে কাওমী মাদ্রাসার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। প্রতি বছর দাওরায়ে হাদীস সমাপ্তে 'খতমে বোখারী' অর্থাৎ বোখারী শরীফের খতম উপলক্ষে ছাত্রদের মাথায় পাগড়ি পড়িয়ে দেয়ার অনুষ্ঠানে শরিক হতাম। দেখতাম, সদ্য তরুণ থেকে যুবক হওয়ারা দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করে মাথায় পাগড়ি নিয়ে বের হচ্ছে; কতই না মধুর লাগত সেই দৃশ্য। তাদের সম্পর্কে আমার বেশ উঁচু একটা ধারণা ছিল। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করছি তারাই এখন এদেশের বিভিন্ন ধারার শিক্ষার্থীদের, এমন কি আলিয়ায় পড়া আলেমদেরও অবমূল্যায়ন করছে এবং জামাতে ইসলামীর স্টাইলে তারাও সর্বেসর্বা হতে চাচ্ছে; একমাত্র তারাই ইসলামের ধারক ও বাহক, অসীম ইসলামী জ্ঞানের অধিকারী বলে নিজেদেরকে জাহির করতে চাইছে; এসব মোটেও ভাল কোন ভাব নয়। আমার কাছে ভালো  ঠেকছে না।

আমরা প্রায় সবাই এখন সব কিছুতে একে অন্যকে দোষারোপ করে যাই; বড় থেকে ছোট্ট শিশুটি পর্যন্ত। নিজের দোষটা একবারও কেউ ধরতে চাই না বা ধরার চেষ্টাও করি না, কেউ ধরিয়ে দিলেও তা খারাপভাবে নেই। মানুষ হিসেবে ন্যূনতম যেটুকো মমত্ব মনুষ্যত্ব মানবতাবোধ সৌহার্দ, একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার তার বিন্দুবিসর্গও এখন আর আমাদের মাধ্যে অবশিষ্ট নেই, সবটাই আজ আমরা কেন যেন বিসর্জন দিয়েছি বা হারাতে বসেছি। এসব আসবেই-বা কোথ্থেকে (?), পরিবার নাকি স্কুল মাদ্রাসা থেকে? তা নিয়েও আমরা দোষারোপ করে যাচ্ছি একে অন্যের। এটা এখন আমাদের জাতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও এর নানান ধারা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি অনেকেই করেছেন করছেন, আমিও করেছি করছি। কিন্তু কেউই আমরা হয়তো আসল ব্যাপারটা তুলে ধরতে পারছি না, নতুবা কেউই অনুধাবন করতে পারছি না আসল সমস্যাটা কোথায়? সমস্যার গোড়ার গলদ রেখে হয়তো সবাই আমরা আগায়ই পানি ঢেলে যাচ্ছি। যতই এভাবে পানি দেই না কেন আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এসবে কোন কাজই হবে না। 

পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় ও উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই? উন্নত দেশে ২/৩ বছর বয়সের শিশুদের বেশির ভাগই ডে কেয়ার হোমে বেড়ে উঠে। তারা যখন ওখানে যেতে শুরু করে তখন থেকেই তাদের শেখানো শুরু হয় নিয়মানুবর্তিতা এবং নিজের কাজ নিজে করা। ঐ বয়সের বাচ্চাদেরই  নিজের জামা নিজে পড়া, জুতা পায় দেয়া, জায়গা নোঙড়া হলে তা পরিষ্কার করা শিখানো হয়। সেই ছোট্টটি থেকে জাপানের বাচ্চাদের নিজের নেপকিন নিজে ডাস্টবিনে ফেলানোর অভ্যাস করানো হয়। খেলার ছলে শেখানো হয় সময়-রুটিন- জীবন সম্পর্কিত ব্যাপারগুলো। আস্তে আস্তে শেখানো হয় তাদের কোন কাজের পর কোন কাজ করতে হবে, কোন কাজে কতটুকু সময় ব্যয় করা যাবে এইসব।  শিশুকাল থেকেই সেইসব তাদের ট্রেনিং দেয়া হয়। 
নিজের খাওয়া নিজেকেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খেতে হবে, সময় জ্ঞান, সময়ের মূল্য, সময় ভাগ করে নেয়া, স্বনির্ভরতা এইসব শিখানো হয় এবং তাদের বুঝানো হয় জীবনে সাফল্য অর্জনে এগুলোর কোনো বিকল্প নেই। 
সেই সঙ্গে আরও তাদের শেখানো হয় সমাজে একজন মানুষ হিসেবে বাস করতে হলে কি কি গুণাবলি থাকা দরকার, সবকিছু অন্যের সঙ্গে সমভাবে ভাগ করে নিতে হবে, মিথ্যা কথা বলা যাবে না, ধাক্কাধাক্কি করা যাবে না, মারামারি করা যাবে না, বাজে কথা বলা চলবে না, নিজের রাগ ও মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আরো শেখানো হয় টিমওয়ার্ক, দল বেঁধে সবার কাধে কাধ মিলিয়ে কি করে কাজ করতে হবে তা; যেসবের প্রতিটি জিনিস আজীবন মানুষের কাজে লাগে। 
অথচ, আমাদের বাচ্চারা পরিবারের সাথে থেকেই বেড়ে উঠছে, আমরা তাদের কি শেখাচ্ছি?

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ প্রতিবছর 'গ্লোবাল স্টুডেন্টস কম্পিটিটিভনেস রিপোর্ট’ নামের একটি জরিপ প্রকাশ করে থাকে; ওখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষার মান যাচাইয়ে পিআইএসএ (প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট) নামক খুব জনপ্রিয় একটি মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে সুশিক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা সম্পন্ন জাতীয় মান নির্ধারণ করা হয়। গণিত, বিজ্ঞান ও পাঠ অভ্যাস এসবের উপর ভিত্তি করে সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে এই মূল্যায়নটি করা হয়ে থাকে। সেই র‍্যাঙ্কিং-এ বরাবরই সামনের দিকে অবস্থান করে নেয় ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা না করে শিক্ষার্থীদের মননশীলতা তৈরির মাধ্যমে প্রতিভা বিকাশের বিষয়টি অগ্রাধিকার পায়।

ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা যতটা চমকপ্রদ ততটাই সহজসরল। ফিনিশ শিশুরা ৭ বছরের আগে স্কুলে যায় না; এমনকি ৬ বছর পর্যন্ত তাদের স্কুলে ভর্তির অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। সেখানকার শিশুদের যে শুধু মোটা মোটা বইয়ের বোঝাই বইতে হয় না তা নয়, ১৬ বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার আগে এই দীর্ঘ ৯ বছর তাদের কোন ধরণের বার্ষিক পরীক্ষাও দিতে হয় না। আরও চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, সব স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ৯:০০ টা থেকে ৯:৪৫ টার মধ্যে এবং সমাপ্ত হয় দুপুর ২:০০ টা থেকে ২:৪৫ টার মধ্যে; এমনকি একই স্কুলে একেকদিন একেক সময়ে ক্লাস শুরু হয় অর্থাৎ পাঠ কার্যক্রম শুরু করার বাঁধাধরা কোন নিয়মনীতি নেই ।

 ফিনিশরা মনে করে সকাল ৯টার আগে কোন ভাবেই স্কুলে ক্লাস শুরু করা উচিত নয়, এতে বাচ্চাদের ঘুমের ব্যাঘাত হবে।  স্কুলে সচরাচর দিনে তিন থেকে চারটি ক্লাস হয়; একেকটি ক্লাসের দৈর্ঘ্য হয় ৭৫ মিনিট। প্রতি ক্লাসের পর ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বিরতি দেওয়া হয়, যাতে ঐ সময়ের মধ্যে বাচ্চারা তাদের পড়াটা আত্মস্থ করতে পারে এবং কিছুক্ষণ হাঁটাচলা ও কথাবার্তার মাধ্যমে নতুন উদ্যমে পরের ক্লাসটা শুরু করতে পারে। প্রতি ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা থাকে গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন। হোমওয়ার্কের পেছনেও ফিনল্যান্ডের শিশুদের ব্যয় করতে হয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম সময়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি   দ্বীপদেশ সিঙ্গাপুর; এই ক্ষুদ্র দেশটিই আজকের আধুনিক বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যকেন্দ্র। বর্তমানে দেশটি পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন, খাটি গণতান্ত্রিক ও  শীর্ষ মাথাপিছু আয়ের দেশে। জনগণের জীবনযাত্রার মান এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ৪র্থ ও বিশ্বে ২৫তম এবং পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর মধ্যে ২২তম। অথচ আজ থেকে ৫০ বছর পেছনে তাকালেও দেখা যায় সিঙ্গাপুরের চেহারায় ভেসে উঠত অনেকটা আজকের আমাদের বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি।

সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং অনেক উন্নত দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থা অন্যতম; পিআইএসএ মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও শীর্ষ স্থানীয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে নিতান্ত গ্রাম্য জীবন থেকে সিঙ্গাপুর যে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশগুলোর মধ্যে একটি অনন্য হিসেবে স্থান করে নিতে পেরেছে এর মূলে কিন্তু রয়েছে তাদের সুচিন্তিত শিক্ষাব্যবস্থা। তিন জাতির বসবাসস্থল হলেও সততা সৌহার্দ ও সুসংহতিতে গড়া সিঙ্গাপুরের সামাজিক জীবন।

দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকেও এদেশের শিক্ষাব্যবস্থাটি আজও আমি ভাল করে বুঝে উঠতে পারি নি; অবশ্য সেটা আমার অক্ষমতাও হতে পারে। যতটুকোই বুঝতে পেরেছি তা থেকেই বলতে পারছি, এদেশে শিক্ষা নিয়েই সবচেয়ে বেশি রাজনীতি হয় এবং শিক্ষাক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি দূর্নীতি হয়। শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ জাতীয় বরাদ্ধ দেয়া থাকলেও অনৈতিকতা গ্রাস করে নিয়েছে এর সকল ক্ষেত্র, সকল সাফল্য। 
এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার ধারা আজও আমার বোধগম্য হয় নি; সবখানে কেমন যেন এক ধরনের গোজামিল।  শিক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে বিভিন্ন স্তর ও ধারা; বয়সভেদে এদেশে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্তরে লেখাপড়া করে থাকে। আবার প্রতিটি স্তরে রয়েছে একাধিক ধারা; প্রাক প্রাথমিক স্তরে সাধারণ ধারায় যেমন নার্সারী ও কিন্ডারগার্টেন এর অস্তিত্ব রযেছে, তেমনি ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে মক্তব এর ভুমিকাও উল্লেখযোগ্য। 

সরকারি শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ছয় বৎসর থেকে এগারো বৎসরের শিশুদের নির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে ও তিনটি ধারা রয়েছে যা সাধারণত দেশীয় কারিকুলামে বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজী ভার্সনে পড়ানো হয়ে থাকে। মাদ্রাসা শিক্ষায় এবতেদায়ী স্তরে ইসলাম ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে দেশীয় কারিকুলামে শিক্ষা প্রদান করা হয়। কিন্ডারগার্টেনে বিদেশী কারিকুলামে ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়। পাঁচ বছর মেয়াদী মাধ্যমিক স্তরে ও সাধারণ ধারায় এস.এস.সি, মাদ্রাসা ধারায় দাখিল ও ইংরেজী মাধ্যমে "ও" লেভেল সার্টিফিকেটের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা হয়। 
পাশাপাশি বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে কারিগরী শিক্ষাবোর্ডের আওতায় বৃত্তিমূলক ও কারিগরী শিক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুই বছর মেয়াদী উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ও সাধারণ ধারায় এইচএসসি, মাদ্রাসা ধারায় আলীম ও ইংরেজী মাধ্যমে "এ" লেভেল সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা রয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে কারিগরি ধারায় পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট সমূহে ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদান করা হয়। পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞান, কৃষিসহ বিভিন্ন ধারায় কারিগরি শিক্ষার প্রসারতা বেড়েছে।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও সাধারণ, কারিগরী ও মাদ্রাসা ধারার আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। সাধারণ ধারায় তিন বছর মেয়াদী স্নাতক ও চার বছর মেয়াদী স্নাতক (সম্মান) ও এক বছর মেয়াদী স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে দুই বছর মেয়াদী ফাজিল ও দুই বছর মেয়াদী কামিল সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা রয়েছে; কারিগরী শিক্ষার ক্ষেত্রে চার বছর মেয়াদী স্নাতক প্রকৌশল, পাঁচবছর মেয়াদী চিকিৎসা বিজ্ঞানে এম.বি.বি.এস ডিগ্রি, কৃষি বিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) সহ নানাবিধ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভের সুযোগ রযেছে। পাশাপাশি বিশেষায়িত পেশাগত বিষয় যেমন: আইন, শিক্ষা, ক্রীড়া, নার্সিং, সামরিক বিজ্ঞানসহ নানান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের সুযোগ রয়েছে।
 
কয়দিন আগে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীসকে মাস্টার্সের সম পর্যায়ের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যদিও এই শিক্ষা ব্যবস্থা আজও অনেকটা আত্নকেন্দ্রিকতার মোরকে আবদ্ধ। শিক্ষার এই ধারা নিয়ে দেশের সংখ্যাগড়িষ্ট মানুষের স্পষ্ট কোন ধারণাই নেই; তাই অনেকেই অনেকটা উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমি এখানে মোটেও উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু দেখছি না; বরং আমাদের সমাজের অলস একটি শিক্ষিত শ্রেণীকে কর্মমুখী করার উগ্যোগ নেয়ায় সরকারের এই উদ্যোগের তারিফই করবো। 
তবে সরকারকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে, স্বাভাবিকভাবে স্কুল-কলেজ থেকে একটা ছেলে বা মেয়েকে মাস্টার্স পাশ করতে যেখানে সময় লাগে ন্যূনতম ১৭/১৮ বছর, আলিয়া মাদ্রাসা থেকে মাস্টার্স করে বের হতে লাগে প্রায় ১৫ বছর; সেখানে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করতে একজন ছাত্রছাত্রীকে বড়জোর জীবনের ১১ বছর সময় ব্যয় করতে হয়। কেমন করে কোন হিসেবে তড়িগড়ি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার তা  আমি মোটেও মেলাতে পারছি না।
আমার মতে, কওমি মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতির দেয়ার আগে অন্তত একমুখী মাদ্রাসা শিক্ষা নীতি বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। আলিয়া বা কওমী সবাই যেন একই সিলেবাসে পড়তে পারে এবং একই প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারে নিদেন পক্ষে এই ব্যবস্থাটুকো করা উচিৎ ছিল।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ৩ শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায়; প্রাচীন কাঠামোভিত্তিক দরসে নিজামি, পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত পাঠক্রম-ভিত্তিক দরসে নিজামি এবং আলিয়া নেসাব। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর মাদ্রাসাগুলোকে কওমী বা বেসরকারি মাদ্রাসা বলে, তৃতীয় ধারা আগে থেকেই সরকার স্বীকৃত। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি শিক্ষা বোর্ড এসবের কার্যক্রম সমম্বয় করে। ১৯৯৮ সালে সারাদেশে ২,০৪৩টি মাদ্রাসা কওমী মাদ্রাসা হিসেবে বোর্ডে নিবন্ধিত হয়েছিল। শিক্ষার স্তর তখন ৭টি ছিল;  তাকমিল (স্নাতকোত্তর), ফজিলত (স্নাতক), সানুবিয়্যা উলায়া (উচ্চ মাধ্যমিক), মুতাওয়াস ফিতাহ (মাধ্যমিক), ইবতেদায়্যা (প্রাথমিক) এবং ইলমুল কিরাত ওয়াত তাজদিদ (উচ্চতর কুরআন পাঠ) ও হিফজুল কুরআন।

'কওম' মানে জাতি, আর 'কওমী' মানে জাতীয়; আরবী 'মাদ্রাসা' শব্দের মানে হলো বিদ্যালয়। সুতরাং কওমী মাদ্রাসার মানে দাঁড়ায় - জাতীয় বিদ্যালয়। যা সম্পূর্ণরুপে সাধারণ মানুষের সাহায্য সহযোগিতায় ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ-এর শিক্ষা কারিকুলাম অনুসরণ ও অনুকরণ করে এদেশে চলছে। মানুষের দানখয়রাতে এগুলো প্রতিষ্ঠিত। কারো দান করা জায়গায় অথবা ক্ষমতার দাপটে ইচ্ছেমত অবৈধ যে কোন একটা জায়গা দখল করেই সাধারণতঃ এসব মাদ্রাসা এদেশে গড়ে উঠেছে। 
ইসলামের প্রচার প্রসার ও মুসলমানের জীবনমরণে মাদ্রাসা শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তদুপরি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে যতটা না ধর্মের প্রয়োজনে তার চেয়ে বেশি এক শ্রেণীর স্বার্থন্বেষী মহলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্যের আর্থিক সহযোগিতায় ব্যঙের ছাতার মতো এদেশে গজিয়ে উঠেছে এইসব মাদ্রাসা এবং সমাজের পিছিয়ে পরা মানুষের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে ও এতিম মিসকীনদের নামে চলছে এই শিক্ষাব্যবসা। অতি দুঃখের বিষয় হলো, যে হারে এদেশে এইসব মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে সে হারে স্কুল কলেজ গড়ে উঠে নি; এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সবার।
২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ি এদেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। 

কওমী শিক্ষাব্যবস্থায় নির্দিষ্ট কোন স্তর বা বাধাঁধরা কোন নিয়মনীতি নেই। সাধারণতঃ দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায় বিভিন্ন নামে সুবিধামত শ্রেণী স্তরবিন্যাস করা হয়। ঢাকার বিখ্যাত এক কওমী মাদ্রাসার বর্তমান শ্রেণীবিন্যাসের একটি চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করছি :

১) ইবতিদায়ী আউয়াল (১ম শ্রেণী); 
২) ইবতিদায়ী ছানী (২য় শ্রেণী); 
৩। ইবতিদায়ী ছালেছ (৩য় শ্রেণী) 
৪। ইবতিদায়ী রাবে (৪র্থ শ্রেণী); 
৫। ইবতিদায়ী খামেস ( ৫ম শ্রেণী); 
৬। মুতাওয়াস্সিতাহ্ উলা (মীযান); 
৭। মুতাওয়াস্সিতাহ্ ছানিয়াহ্ (নাহবেমীর); 
৮। ছানাভিয়্যাহ্ উলা (কুদূরী); 
৯। ছানাভিয়্যাহ্ ছানিয়াহ্ (হেদায়া-শরহে বেকায়া); 
১০। ফাযীলাত (মিশকাত); 
১১। তাকমীল (দাওরায়ে হাদীস)। 

বছর শেষে নতুন শ্রেণী হিসেবে ইবতিদায়ী আউয়াল (১ম শ্রেণী) থেকে তাকমীল অর্থাৎ দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত পাশ করতে একটা ছেলেমেয়ের বড় জোর ১১ বছর সময় লাগে। কিন্তু এদেশের মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বা ফার্সি বিভাগে বাংলা, ইংরেজি এবং অন্যান্য বিষয়গুলো সাপ্লিমেন্টারী কোর্স হিসেবে থাকে এবং ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করে তাদের ডিগ্রি নিতে হয়, সময় লাগে প্রায় ১৭/১৮ বছর (ওয়ান-মাস্টার্স); অন্যান্য বিষয় বাদই দিলাম। 

একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক গণমুখী সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষাকেও অবশ্যই আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করা দরকার। তাঁদেরকে সময়ের মূল স্রোতাধারায় সংযুক্ত ও সমন্বিত করা বর্তমান সরকারের একটি যুগোপযুগী সিদ্ধান্ত; এতে সাধুবাদ তাঁরা পেতেই পারেন। তবে কোন হীন রাজনৈতিক স্বার্থ ও অশুভ চক্রান্ত যেন এই শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার প্রক্রিয়া থেমে বিরত না রাখতে পারে সেদিকে আমাদের সবারই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা উচিত। তাছাড়া কওমী শিক্ষাকে বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নততর করা অত্যন্ত জরুরী।

অবশ্যই কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন আনতে হবে এবং ওদের পাঠ্যক্রমে গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, বাংলা এবং ইংরেজির মতো বিষয়গুলো যতটা সম্ভব অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 
সর্বোপরি শুধুমাত্র জন্ম মৃত্যু বিয়েতে আবদ্ধ না রেখে মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের বাস্তবমুখী শিক্ষার মাধ্যমে অবশ্যই জনকল্যাণমূলক দুনিয়াবী কর্মকান্ডেও সম্পৃক্ত করতে হবে; তবেই হয়তো একদিন দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনবে এই বিশাল জনশক্তি।

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
১৯ এপ্রিল, ২০১৭.

বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২০

জাতীয় শিক্ষানীতি সময়ের দাবী :


চলতে চলতে মাঝেমধ্যে অদ্ভুত কিছু মানুষের সাথে হটাৎ দেখা হয়ে যায় এবং চমৎকৃত সব অভিজ্ঞতারও সন্মুক্ষিন হতে হয়; কয়দিন আগে তেমনই একজন শিক্ষকের সাথে আমার সাক্ষাত, যিনি মনে করেন - সৃজনশীলতা মানে হলো শিশু নির্যাতন! এদেশের টিভি বা মিডিয়ার কোন অনুষ্ঠানে, কোন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম বা সভা-সমাবেশে গিয়ে এখন আর বুঝার কোন উপায়ই থাকে না - কে শিক্ষিত, আর কে অশিক্ষিত! আমরা কি আসলেই আগাচ্ছি, না-কি পিছাচ্ছি? শিক্ষিত হচ্ছি, না-কি শিক্ষিতের ফানুস উড়াচ্ছি? শিক্ষার মর্মার্থও বুঝতে পারেন না যে দেশের বেশিরভাগ তথাকথিত সার্টিফিকেটধারী, সে দেশে ৫০ হাজার ৪৩২ কোটি টাকার শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রেখে বা ব্যয় করে লাভ কি? বরং পাঠশালা বন্ধ করে দক্ষতার কর্মশালা নির্মাণ করাই শ্রেয়।

নাচতে না জানা লোকের কাছে তো উঠোন বাঁকা হবেই; শিক্ষকতার উদ্দেশ্য ও বিধেয় না জানা লোকদের জন্য সৃজনশীলতাও তেমনই শিশু নির্যাতনই মনে হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ও পাঠ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকা প্রতিটি ব্যক্তির অবশ্যই একটি কথা জানা উচিত, শিক্ষা হলো কোন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয়ার একটি প্রক্রিয়া এবং এর মাধ্যমে সমাজে একজনকে উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সকল দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই হলো শিক্ষা; ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হলো সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। আর একজন শিক্ষকই পারেন এই অনুশীলনের মাধ্যমে প্রতিটি শিশুর মস্তিষ্কের দশ হাজার কোটি নিউরনের প্রতিটিকে স্বাতন্ত্র্য করতে এবং পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে।

'সৃজন' শব্দের অর্থ হলো - সৃষ্টি, আর 'শীল' শব্দের অর্থ হলো - নিজ; অর্থাৎ সৃজনশীল শব্দের পূর্ণাঙ্গ স্বরূপ দাঁড়ালো - নিজ থেকে সৃষ্টি বা আপন সৃষ্টি। সম্প্রতি সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে গণমাধ্যমে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে তা আমাদের সবার জন্যই খুব বিব্রতকর ও উদ্বেগজনক। দেশে অর্ধেকের বেশি, প্রায় ৫২.০৫% মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক এখনো পর্যন্ত সৃজনশীল পদ্ধতিই বোঝেন না; গত মে মাসে ১৮ হাজার ৫৯৮টি মাধ্যমিক স্কুল পরিদর্শন শেষে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ কথা জানতে পেরেছে! অন্য আরেকটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় - এখনো পর্যন্ত সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন এদেশের মাত্র ৪৮% স্কুল শিক্ষক, অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রশ্ন করে থাকেন ৩১% শিক্ষক এবং বাহির থেকে প্রশ্নপত্র জোগাড় করেন ২১% শিক্ষক!

নিঃসন্দেহে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এর সফলতা বা বিফলতা কোনভাবেই এককভাবে কোন ব্যক্তি বা বিষয়ের উপর নির্ভরশীল নয়। এ ব্যবস্থায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো এবং সার্বিক পারাপার্শ্বিকতারও গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য ভূমিকা রয়েছে। কাউকে সৃজনশীল করে গড়ে তুলতে হলে এসবের প্রত্যেকটিই একটি আরেকটির পরিপূরক; আর সকল ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভুমিকাই মূখ্য ও অতিব প্রয়োজনীয়। একজন শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে যেমন পাঠদানে যত্নশীল ও সৃজনশীল হতে হবে, তেমনিভাবে পাঠ পরিক্রমা ও অনুশীলনেও তাদের বৈচিত্র্য আনতে হবে; পাশাপাশি প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নে দক্ষতা অর্জনে শিক্ষককক্ষে এবং বাড়িতেও শিক্ষকদের যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হবে। 

কারণ, একজন শিক্ষক প্রশ্নপত্র প্রণয়নে ও উত্তরপত্র মূল্যায়নে দক্ষ না হলে কোনো অবস্থাতেই সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে না, আর জাতীয়ভাবে কোন বড় সফলতাও আসবে না। তাছাড়া এটি অতো সহজ কোন কাজ নয়, এবং রাতারাতি এটিকে সফল বা বাস্তবায়নও করা সম্ভব হবে না বা যাবে না। অবশ্যই শিক্ষককে আগে দক্ষতা অর্জনে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং সেভাবে নিজকে তৈরি করতে হবে; অন্যথায় জাতি গঠনে ভূমিকা রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

অতি চালাকরা ইনিয়ে-বিনিয়ে যত কথাই বলুন না কেন আমার মত বোকারা নিশ্চয় স্বীকার করবেন - বর্তমান শিক্ষানীতিতে এদেশে নৈতিক শিক্ষার উপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আর অবশ্যই শিক্ষকদের আগে এসব কিছুর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে এবং নিজেদের জীবনে সেসবের চর্চা করতে হবে, পরে শিক্ষার্থীদের মাঝে অনুশীলন করাতে হবে। শিক্ষকতা সমাজের অন্য আর পাঁচটি পেশার পেশাদারের মতো কোন পেশা নয়, শিক্ষকতা অবশ্যই একটি মহৎ ব্রত; এ কথাটি শিক্ষকতার সাথে জড়িত হওয়ার আগেই প্রতিটি শিক্ষককে বুঝতে হবে। পাশাপাশি একজন অভিভাবককেও নিয়মিত সন্তানের লেখাপড়ার খোঁজ-খবর ও শ্রেণি-শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে; এবং কোনো অবস্থাতেই সন্তানকে কোচিং সেন্টারে পাঠানো যাবে না। যে কোন ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। আর এসব করতে পারলেই সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিসহ সার্বিক শিক্ষার সুফল তাড়াতাড়ি ও ব্যাপকভাবে পাওয়া যাবে।

শিক্ষা পদ্ধতিতে সৃজনশীল ব্যবস্থা যুক্ত হওয়ার অনেক অনেক আগে আমরা যারা সনাতনী পদ্ধতিতে লেখাপড়া করেছি তারা সবাই জানি, পাঠ্যবইয়ের মূল আলোচনা শেষে আমাদের পাঠ্য বইয়ে কিছু প্রশ্ন থাকতো - সংক্ষিপ্ত ও বিবৃতিমূলক; আমরা মূল পাঠ শেষে সেসব প্রশ্নের উত্তর বের করে করে নিজ হাতে নোট করতাম এবং অনেকটা মুখস্থ করেই উত্তর লিখতাম; বৃটিশ আমল থেকে অনেকটা মুখস্থনির্ভর এই শিক্ষা পদ্ধতিই এদেশের প্রচলিত ছিল। স্বাধীনতার পর আস্তে আস্তে কেমন করে যেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নোট-গাইড নির্ভর হয়ে যেতে শুরু করে; এমন একটা সময় গেছে এদেশে - গতবারের আসা প্রশ্ন বাদ দিয়ে বিগত কয়েক বছরের প্রশ্ন-উত্তর মুখস্ত করে পরীক্ষার হলে গেলেই দেখা যেতো ১০০% কমন পড়ে যেতো।

সেই প্রচলিত মুখস্থনির্ভর লেখাপড়া থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনা এবং কোচিং-প্রাইভেট, নোট-গাইড বন্ধ করার অভিপ্রায়ে মূলতঃ সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনটিই এখনো পর্যন্ত সম্ভবপর হয়নি, হচ্ছেও না; বরং সবই বেড়েছে। বর্তমানের সৃজনশীল চতুর্থ প্রশ্নটির উত্তরও শিক্ষর্থীরা সাধারণত মুখস্থ করেই লিখছে বলে উত্তরপত্র থেকে প্রতিয়মান হয়। প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষকরা ঠিকমতো না বুঝার কারণে তারা ক্লাসে ভালোভাবে পড়াতে পারছেন না, এবং ছাত্রছাত্রীরাও এর সঠিক প্রয়োগ বুঝে উঠতে পারছে না; তাই সবাই নোট-গাইড নির্ভরই হয়ে পড়েছে, পড়ছে। খোদ সরকারি একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে এ পদ্ধতিটি চালু হলেও এক যুগ পরেও মাত্র ৫৬% শিক্ষক এটি আয়ত্ত করতে পেরেছেন। 

এ পদ্ধতি বুঝতে শিক্ষকরা যেন পরিশ্রম করেন সে জন্য বাইরে থেকে না কিনে  স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিজেরা যেন তৈরি করতে পারেন সেই নির্দেশনা আগেই দেওয়া হয়েছিল, এ ব্যাপারে সরকারিভাবে একটি পরিপত্রও জারি করা হয়েছিল। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে যেন এই পদ্ধতিটিকে তারা অনবরত প্রশ্নবিদ্ধ করেই যাচ্ছেন! না কি, তারা ইচ্ছে করেই না বুঝার ভান করছেন? অনেক শিক্ষক আবার এখনো এই পদ্ধতি মানতেই পারছেন না! কোনরুপ চেষ্টা না করেই তারা বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশ্ন কিনে এনে পরীক্ষা নিচ্ছেন। স্কুল-কলেজ তো বটেই, বড় সাংঘাতিক ব্যাপার হলো - খোদ বোর্ড পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে হুবহুব প্রশ্ন তুলে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে!

এতে করে শিক্ষার্থীরা আগে যেমন এক কোম্পানির গাইড কিনতো, এখন বেশি উদ্দীপক পাওয়ার আশায় একাধিক কোম্পানির গাইড কিনছে; এতেকরে অভিভাবক হয়রানি বেড়েছে শতগুণ। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া এখন ক্লাসরুমের পরিবর্তে চলে গেছে কোচিং সেন্টারে। বেশিরভাগ স্কুল শিক্ষক এ পদ্ধতি না বুঝায় কমার্শিয়াল কোচিং সেন্টার বিস্তার লাভ করেছে ব্যাপকভাবে; এতে করে শিক্ষকরা ক্লাশে পড়ানোতে মনোযোগ না দিয়ে তারা কোচিং ব্যবসায় মনোযোগ দিচ্ছেন এবং কয়েকজন জানা শিক্ষক ভাড়া করে এনে ব্যবসাকে জমজমাট করছেন। আর, এসব অতি লোভী শিক্ষকরাই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত হচ্ছেন; শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর না হয়ে তারা হয়ে যাচ্ছেন জাতির অভিশাপ!
  
একজন দক্ষ মালির অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধম্য সাধনায় ফুলেফলে সুসজ্জিত হয় একটি বাগান, যে বাগানের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে সবাইকে; ফুলের সুবাসে বিমোহিত হয় সকল সৌন্দর্য পিপাসুরা। ছোট্ট একটি চারা গাছে ফুল ফোটাতে যেমন লাগে মাটি, পানি, সূর্যকিরণ, আকাশ, বাতাস, পরিচর্চা ও কঠিন সাধনা; ঠিক তেমনই একটি শিশুকে গড়ে তুলতেও প্রয়োজন পড়ে বোধ-বিবেচনাসহ সার্বিক পরিচর্চার। চারা গাছে ফুলফল ফলাতে যেমন লাগে একজন ভালো ও দক্ষ মালির, ঠিক তেমন-ই একটি শিশু মস্তিষ্কে নিউরনের বিকাশ ঘটাতেও প্রয়োজন পরে সৎ ও বোধ-বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন একজন জ্ঞানী শিক্ষকের। একজন মা-বাবা হয়তো নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য সন্তানের ভরণপোষণ, দেখা-শোনা ও সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে সামর্থানুযায়ী কিছুদিন যোগান দান করতে পারেন, কিন্তু আমার বিবেচনায় একজন শিক্ষক একটি মানুষের সারা জীবনের জন্য চলার পথের পাথেয়-এর সার্বিক ব্যবস্থা করে সঠিক ও যথার্থ যোগান দিয়ে থাকেন; বাচ্চাদের মস্তিষ্কের নিউরনের বিকাশ, মানসিক পরিপূর্ণতা ও পরিতৃপ্ততার সার্বিক কর্মকান্ডে একটি জীবনকে সময়ের উপযোগী করে গড়ে তোলেন একজন শিক্ষকই।

শুধুমাত্র শিক্ষকের মানের অভাবে এতো ভালো ও সহজ-সরল-সুন্দর একটি পরীক্ষা পদ্ধতি এদেশে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা আজও গেল না বা যায় নি - তা ভাবতেও আমার কষ্ট লাগে। প্রকৃতপক্ষে, সৃজনশীল মানে - পাঠ্যবইয়ের গল্পের আদলে শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন করে কোন একটি প্রশ্ন তৈরি করা নয়, সৃজনশীল হলো - পাঠের মূল স্পিরিটকে সামনে রেখে প্রশ্ন ও তার উত্তর তৈরি করা। কিন্তু সহজ এই পদ্ধতিটিও বাস্তবে এদেশে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না; কারণ, এখনকার শিক্ষকরা মোটেও খাঁটতে চান না, এবং অত্যন্ত বেশি লোভ করেন। আর এজন্যই শিক্ষা পেশাটাকেই তারা বানিজ্যিক অবয়বে আবদ্ধ করে ফেলতে চাইছেন! তারা হয়তো ভাবেন - শিক্ষায় উন্নত হলে, এতে তাদের লাভ কি?! 

অবশ্য, নতুন কোনো শিক্ষা পদ্ধতি চালু করার আগে শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল; দীর্ঘ প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, উপর্যুপরি সেমিনারসহ নানা ধরনের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থাপনাকে প্রস্তুত করার যে প্রয়োজনীয়তা ছিল তা একেবারেই পূরণ করা হয়নি। বরং যেনতেনভাবে নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করে দিয়ে তারপর ধারাবাহিকভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া ব্যবস্থাটি এতোটাই ধীরগতির যে, এক যুগ পার করেও সকল শিক্ষকের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা আজও সম্ভব হয়ে উঠেনি। অথচ পরীক্ষা এবং প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কিন্তু থেমে নেই। ফলে বাজারে প্রচলিত গাইড বইয়ের সহায়তা নেওয়ার প্রবণতা এমনিতেই চলে এসেছে; শুধু সহায়তা নয়, এমনকি বেড়েছে নির্ভরতাও।

সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির উদ্ভাবনের বা এর প্রচলনের প্রধান কারণ প্রকৃতপক্ষে নকল ও মুখস্থনির্ভরতা থেকে ছাত্রছাত্রীদের মুক্তি দেওয়া। সাধারণ পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীরা কোনো বিষয়ে কেবল একটি স্থির ধারনা পায় - এর পরিবর্তনশীলতা, ব্যাখা বিশ্লেষণ ইত্যাদি তাদের কাছে অস্পষ্টই থেকে যায়। সৃজন মানে সৃষ্টি; সৃষ্টি মানে নতুন কিছু তৈরি করা, পথ নির্দেশ করা, লক্ষ্য ঠিক করা। এক কথায় ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে গন্তব্যে পৌঁছা বা একটি নির্দষ্ট চিন্তার উপর ভর করে মাথা খাটিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো কিছু করার নামই সৃজনশীলতা। এ চিন্তা ছাত্রছাত্রীদের মাথায় আসবে কোথা থেকে? অনেক ছাত্রছাত্রীর সাথে কথা বলে আমি জেনেছি, এখনো বেশিরভাগ শিক্ষক ক্লাশে তাদের গাইডবই পড়ান এবং ওটা থেকেই প্রশ্নপএ্রও তৈরি করেন। তাই যদি হয়ে থাকে, শিক্ষার্থীদের অবস্থা তথৈবচ তো হবেই! অগত্যা যে উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন এই প্রশ্ন পদ্ধতিটি চালু করা হয়েছিল, সেটি মুখ থুবড়ে পরেছে এবং পরবেই। শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার প্রবণতা তো কমেইনি, বরং তা আরো নতুন মাত্রা পেয়েছে।

ছোট বেলায় আমরা যে কত গল্প-উপন্যাস পড়েছি তার কোন ইয়ত্তা নেই; আমাদের স্কুলে লাইব্রেরী কার্ড করা ছিল প্রত্যেক ছাত্রের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটি বাজে প্রবনতা - তারা মোটেও পড়তে চায় না। প্রিন্ট মিডিয়ায়, অনলাইন মিডিয়া বা ফেসবুকেও লক্ষ্য করেছি, কিছুটা বড় লেখা দেখলে তারা সে লেখার ধারকাছ দিয়েও হাঁটে না! অনেকের মন্তব্য দেখেই বুঝা যায়, না পড়ে এমনি এমনিই মন্তব্যটি সে করেছে। শিক্ষা জীবনেও তারা শুধু কিছু কিছু পাঠ মুখস্ত করেই ছাত্রত্ব চুকাতে চায়। 

পাঠ মুখস্থ নির্ভর শিক্ষা অনেকটা কূয়া'র ব্যাঙের লাফালাফি বা অনেকটা নির্দিষ্ট গন্ডিতে জীবন-যাপনের মতো। ছোট্ট একটি পরিসরে নেচে গেয়ে থাকা ব্যাঙ মনে মনে ভাবে ওটাই বুঝি কত বড় সমুদ্র! কিন্তু সমুদ্র যে কত বিশাল বিস্তৃত তা তো সে দেখেনি, জানেও না। কূয়া'র সোজা উপরের দিকে তাকিয়ে তারা শুধু আকাশের খণ্ড রূপ দেখে - পুরো আকাশ দেখে না; তাই স্বপ্ন আঁকার সাধও তাদের ওখানেই শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ শহুরে এই ছোট্ট পরিসরে আকাশের বিশালতা সমুদ্রের গভীরতা উপলদ্ধি করার সুযোগ যাদের নেই, মুক্ত অঙ্গণে যারা আসতে পারে না, পৃথিবীর পাঠশালায় ভর্তি করতে যাদের বাবাদের কৃপনতা, প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে ভালো মন্দ বিচার করার সাধ্য ও সুযোগ যাদের নেই - তাদের বইয়ের মাধ্যমে চিন্তা, বুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটানোর পথ প্রশস্ত করতে হবে। কল্পনাশক্তি জাগাতে ও বাড়াতে বইয়ের কোন বিকল্প নেই; তাই বই পড়ার অভ্যাস গড়তে হবে, আর বেশি বেশি বই পড়তে হবে। তবেই হয়তো একদিন পুরো জাতি পাল্টে যাবে।

শিক্ষানীতির নতুন প্রস্তাবে অষ্টম শ্রেণি শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষার বিধান রেখে শিক্ষা আইনের নতুন খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে; পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থাকবে কি না থাকবে তার নির্বাহী আদেশ দিয়ে সরকার তা নির্ধারণ করবে বলে সেখানেও উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীতকরণে কাজ করছে সরকার; অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা উন্নীত করার প্রাথমিক সমাপনী এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা থাকবে কি-না তা নিয়েও বিতর্ক চলছে। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে - সরকার প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এই ধারা লঙ্ঘন করলে যে কেউ অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা ছয় মাসের জেল বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তির বিষয়ে ওখানে বলা আছে - শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালীন মানসিক বা শারীরিক শাস্তি দেয়া যাবে না; এটি লঙ্ঘন করলে শিক্ষক অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা তিন মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নির্ধারিত পাঠ্যবই না পড়িয়ে বাইরের বই পড়ালে দুই লক্ষ টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের জেল বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। এমনতরো আরো অনেক কিছু রাখা হয়েছে এই খসড়ায়; আর জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০  বছর বছর পরিবর্তন বা সংযোজন হচ্ছে।

স্বাধীনতার এতো বছর পরে হলেও বর্তমান সরকার অন্ততঃ চেষ্টা করেছে এবং করছে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে - তিন স্তরবিশিষ্ট করতে এবং এই তিন স্তরবিশিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এরই মধ্যে প্রশ্নপদ্ধতি সৃজনশীল হয়েছে; কিন্তু এই প্রশ্নপদ্ধতি নিয়েও সর্বত্র প্রথম থেকেই কেমন যেন এক শ্রেণির মানুষের মাঝে এক ধরণের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আমি মনে করি এর প্রভাব পড়েছে সার্বিক শিক্ষায়ও; এবং কি যেন এক অদৃশ্য দোটানায় এক ধরণের অসঙ্গতি বিরাজ করছে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে প্রতিটি ক্ষেত্রে। তাই অবশ্যই শিক্ষাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সাজানোর জন্য আমাদের দেশের পুরো শিক্ষা কাঠামোই ঢালাওভাবে পরিবর্তনের প্রয়োজন। অবশ্য এরই মধ্যে বর্তমান সরকার যথেষ্ট প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং বিভিন্ন ভাবে চেষ্টাও করেছে করছে, নতুন নতুন উদ্যোগও নিয়েছে নিচ্ছে। 

স্বাধীনতার চার দশক পরে হলেও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণীত হয়েছে, কিন্তু আজও তা পরিপূর্ণ আলোর মুখ দেখেনি; এখনো পর্যন্ত কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে বেশিরভাগ নির্দেশনা বা নীতিমালা। সার্বিক বিবেচনায় আমরা চাই একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতীয় শিক্ষানীতি, যা এখন শুধুই সময়ের দাবী; এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা ঘোষণা করা হউক॥    

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২২ নভেম্বর, ২০১৭.

শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২০

সুখ তুমি কি বড় জানতে ইচ্ছে করে :


সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
            অনলে পুড়িয়া গেল|
অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে
            সকলি গরল ভেল|
  
সখি কি মোর করমে লেখি|
শীতল বলিয়া ও চাঁদ সেবিনু
            ভানুর কিরণ দেখি|

উচল বলিয়া অচলে চড়িতে
            পড়িনু অগাধ জলে|
লছিমি চাহিতে দারিদ্র্য বেড়ল
          মাণিক্য হারানু হেলে|

নগর বসালাম সায়র বাঁধিলাম
            মাণিক পাবার আশে|
সাগর শুকাল মাণিক লুকাল
         অভাগার করম-দোষে|

পিয়াস লাগিয়া জলদ সেবিনু
             বজর পড়িয়া গেল|
জ্ঞানদাস কহে কানুর পিরীতি
             মরণ অধিক শেল|

ড. মঞ্জুরে খোদা দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় আজ একটি সচিত্র প্রতিবেদনমূলক প্রবন্ধ লিখেছেন— 'কানাডার বেগমপাড়া একটি থিম' শিরোনামে। সেখানে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের অসৎ-দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী-আমলা-কামলা-রাজনীতিকদের পরিবার কানাডার যেসব স্থানে বাসা-বাড়ি কিনে বসবাস করছে সেসব স্থানকে ওখানকার বাঙালিরা 'বেগমপাড়া' বলে অভিহিত করেছে; কানাডায় আসলে সুনির্দিষ্টভাবে 'বেগমপাড়া' বলে কোনো জায়গা নেই। 'বেগমপাড়া' নামকরণ করার কারণটি হচ্ছে বাংলাদেশের লুটেরা দুর্নীতিবাজদের দ্বিতীয় আবাসভূমির প্রতীকী হিসেবে; সাহেবরা সব বাংলাদেশে লুট করে, আর বেগমরা কানাডায় আরাম-আয়েশ করে!

যে দেশের সাধারণ জনগণ এখনো দু'মুঠো ভাত যোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছে, রাস্তায় ভুখানাঙা হতাশাগ্রস্ত মানুষ ঘুরেফিরে হাহাকার করছে, দুটো ভাতের জন্য ভিক্ষাবৃত্তির মতো নিকৃষ্ট পেশাটি বেছে নিয়েছে অসংখ্য মানুষ, সেদেশেরই কিছু দূর্নীতিবাজ লুটেরা অপকর্মের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে তাদের পরিবারপরিজনকে দেশের টাকায় বিদেশে সেটেল্ড করছে; এবং দেশ থেকে অবৈধভাবে টাকা কামিয়ে অবৈধ উপায়েই সেসব পাঠিয়ে তাদের পরিজনকে আয়েসি, নিরাপদ ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করাচ্ছে! এদেশের চাষাভুষা খেটে-খাওয়া মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করে তা পাচার করছে তাদের নিজ পরিবারপরিজনকে নিরাপদে বিদেশে সুখে শান্তিতে রাখার মতো হীন কর্মটি করতে।
   
চিরন্তন উচ্চারণ, এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি— ভাব-সমপ্রসারণটি ছোটবেলায় বেশ মজা করে পড়তাম, এবং এ নিয়ে তখন পাতার পাতা লিখতেও পারতাম। আজ এর ভাব সম্প্রসারণ করতে গিয়ে প্রথমেই তুলে ধরছি  একটি কথা— মানুষের চাওয়া পাওয়ার কোন শেষ নেই, কারণ চাহিদা অপরিসীম; যে যত পায় সে তত আরও চায়। লক্ষ টাকা মাসিক বেতন পাওয়া একজন সরকারি আমলা ঘুষ খেয়ে কামায় কোটি টাকা, দশ হাজার টাকা মাসিক বেতন পাওয়া একজন কামলা বকশিস নামের বোঁঝা সাধারণের কাঁধে চাপিয়ে মাসে কামায় লক্ষ টাকা, আর অসৎ ব্যবসায়ীরা সবকিছুতে ভেজাল দিয়ে মানুষকে ঠকিয়ে সম্পদের পাহাড় বানিয়ে সেসব পাচার করে এবং করছে বিদেশে!  কি অদ্ভুত এদেশের এক শ্রেণীর লোকজনের মানসিকতা?     

এমন চাওয়া-পাওয়া কাদের? বর্তমানের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যারাই সম্পদশালী তারা হয়তো নেতা-নেত্রী, আমলা-কামলা বা অসৎ ব্যবসায়ী। সম্পদের প্রতি তাদের তৃষ্ণা প্রকট, দুর্নিবার ও অসীম। নির্বিচারে সম্পদ সংগ্রহের ফলে দেশের সব গরীবের সম্পদ তাদের হাতে চলে যাচ্ছে, গরিবেরা হচ্ছে  নিষ্পেষিত, আর মধ্যবিত্তরা হচ্ছে নিঃশেষিত। দরিদ্র কাঙ্গালেরা এক-দুই বেলা দুমুঠো  ভাত জোগাড় করতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, কোনমতে বেঁচে থাকার আশা পোষণ করতে গিয়ে যেখানে অন্ধকারের অতল গহব্বরে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, সেখানে ঐ শ্রেণীর লোকজন গড়ছে বিত্তবৈভবের  পাহাড়! দুর্ভাগ্য তাদের যারা সামান্য নুন-ভাতও অনেক সময় জোটাতে পারছে না। 

এমনতর অসমান অবস্থার জন্য কারও থাকছে ঐশ্বর্য্যের প্রাচুর্য আলোর আতশবাজী খেলা, আবার কারও ঘরে অন্ধকারে প্রদ্বীপ জ্বলছে না। যে ব্যক্তি একবেলা আহার যোগাড় করতে পারছে না, সে চায় জীবন ধারণের ন্যূনতম অন্ন টুকু, কিন্তু যার সব কিছু আছে তার তো কোন অভাব থাকতে পারে না? অথচ পৃথিবীর মানুষের চিরাচরিত স্বভাব চাই আর চাই! আমি দেখেছি যার ধন সম্পদের আর প্রয়োজন নেই, তার জীবনেই অভাববোধ সবচেয়ে বেশি এবং প্রকট। কথায় আছে না- রাজাই সব সময় প্রজার ধন সম্পদের অধিকারী হয়, ধনী দরিদ্রকে শোষণ করেই বড় হয়; এই বৈষম্যটি একটি নিষ্ঠুর জাগতিক সত্য বিষয়। লুব্ধ মানুষের বড় হবার নীতিই হলো দরিদ্রের সব কিছু জোর করে কেড়ে নিয়ে তাকে সর্বশান্ত করা, সব কিছু হতে বঞ্চিত করা। এর হিসেব কেউ রাখে না বা কেউ খবরের প্রয়োজনও বোধ করে না। লক্ষ্য করে দেখেছি লোভী মানুষের সংখ্যা সমাজে দিনদিন তুলনামূলক বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে; তারা যে কোন ভাবে যে কোন উপায়ে শুধু পরের ধন চুরি করে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার সমৃদ্ধি চায়। তারা অর্থসম্পদের মাঝে সুখ খোঁজে, আর সুখি হতে চায় বিত্তবৈভব দিয়ে।

আঙুল ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হওয়া ধনীরা গরীব ভুখা নাঙা মানুষের রক্ত শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে, এবং সদা সচেষ্ট; গরীবরা শোষিত,  বরং বলা উত্তম চিরশোষিত লাঞ্চিত। অনাহারী, নিরন্ন মানুষের ন্যূনতম সম্পদটুকুর প্রতিও ভয়াল থাবা প্রসারিত করতে এসব ঠকরা এতটুকুও কুণ্ঠিত হয় না! বিত্তবানদের এ অতৃপ্ত সর্বগ্রাসী প্রক্রিয়া সমাজের সর্বস্ব নিঃস্ব লোকদের বেঁচে থাকার স্পৃহাকে নিঃশেষ করে দেয়। ধন-সম্পদ উপরওয়ালার দান, যা ধনী-গরীব উভয় শ্রেণীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ; তবে নির্ধারিত। যারা তকদীর মানেন তাদের উচিৎ সন্তুষ্ট থাকা এবং সৎকর্ম চালিয়ে সবুর করা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণের জন্য কারোই অতিরিক্ত লোভ করা উচিত নয়। অবশ্যই যার যতটুকু সম্পদ প্রযোজন ঠিক তাকে ততটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা বাঞ্ছনীয়। কবরে কিন্তু কেউ সম্পদ নিয়ে যেতে পারেন না।  দুনিয়ার সম্পদ দুনিয়াতেই থেকে যায়। দুনিয়াতে কত ধনী হলো আর গেলো,কে তার খবর রেখেছে? কিন্তু হাজার হাজার বছর আগের না খেতে পাওয়া সক্রেটিসকে আজকের পৃথিবীবাসীরাও চেনে। তাই আফসোস করে কোন লাভ নেই।

চলতি বছর মার্চে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক অর্থপাচারবিরোধী সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) জানিয়েছিল গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা স্থানীয় মুদ্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানতের অর্থ নানা কৌশলে তারা বিদেশে পাচার করে সেখানে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ)-এর তথ্য অনুযায়ী বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই এদেশে  বেশি টাকা পাচার হয়। নানা পন্থায় বিদেশে টাকা পাচার করে এক শ্রেণীর লোকজন প্রবাসে বাড়ি-গাড়ি ও স্থায়ী সম্পদের মালিক হয়; আর এ অভিযোগ এদেশের রাজনৈতিক নেতা আমলা আর ব্যবসায়ীদের  বিরুদ্ধে; সুখের আশায় কত কিই না করছে তারা, বাঁধছে বাসা দ্বীপান্তরে!

ইদানীংকালের নিউজফিডে প্রতিনিয়ত এমনতর সব ছেঁচড়া বড়লোকের আমিত্বের খবর ভেসে উঠছে যা কল্পনাতীত। যখনই সেসব আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বা তালগাছ হওয়া কোটিপতির কোন খবর দেখি, চমকে যাই এবং মনে পড়ে মধ্যযুগীয় বাংলা কবি (যাঁর জন্ম ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দ, যিনি ষোল শতকের পদাবলী সাহিত্যের একজন সেরা কবি ছিলেন) কবি জ্ঞানদাস-এর বৈষ্ণবপদাবলীর অমর সেই কথাগুলো, যা এ লেখার সূচনাতেই তুলে ধরেছি। অমর এ গীতিকবিতাটি কেউ বুঝতে পাড়লে তার জীবনে 'সুখ' নিয়ে আর কোন জ্ঞানের প্রয়োজন পরবে বলে আমি মনে করি না। 

সুখ আসলে কি? কোথায়, কোনখানে আছে সুখ??- সুখের আভিধানিক অর্থ হলো— পরিতোষ, প্রেম, পূর্ণতা, পুলক, উল্লাস, আহ্লাদ ইত্যাদির এক বা একাধিক বা সম্মিলিত অনুভুতি; যা একান্তই একটি মানবিক ব্যাপার, সাময়িক অনুভূতি। সুখ মনের একটি অবস্থা বা অনুভূতি যা ভালোবাসা, তৃপ্তি, আনন্দ বা উচ্ছ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সত্য ও সুন্দর দ্বারা  প্রস্ফুটিত। জৈবিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক, দর্শনভিত্তিক এবং ধার্মিক দিক থেকে সুখের সংজ্ঞা নির্ধারণ ও নিরূপণ এবং এর উৎস নির্ণয়ের প্রচেষ্টা সাধিত হয়েছে এবং হয়। সঠিকতার মাপযন্ত্রে সুখকে পরিমাপ করা এবং নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন। 

অবশ্য এ ব্যাপারে গবেষকেরা একটি কৌশল উদ্ভাবন করেছেন, যা দিয়ে সুখের পরিমাপ কিছুটা হলেও করা যায় বা সম্ভব; মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা তাত্ত্বিক মডেলের ভিত্তিতে সুখকে পরিমাপ করে থাকেন। এই মডেলে সুখকে ইতিবাচক কর্ম ও আবেগ সমূহের সমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া এক্ষেত্রে তিনটি বিশেষ অবস্থাকেও বিবেচনা করা হয়: আনন্দ, অঙ্গীকার এবং অর্থ। গবেষকগণ এমন  কিছু বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করেছেন যেগুলো সুখের সাথে পারস্পরিকভাবে সম্পর্কযুক্ত: বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্ক, বহির্মুখী বা অন্তর্মুখী অবস্থা, বৈবাহিক অবস্থা, স্বাস্থ্য, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা, আশাবাদ, ধর্মীয় সম্পৃক্ততা, আয় এবং অন্যান্য সুখী মানুষের সাথে নৈকট্য। 

প্রত্যেক সমাজেই ধনী, গরিব, সুখী, অসুখী বিভিন্ন ধাঁচের মানুষের বসবাস। তবে বর্তমান পৃথিবীতে প্রকৃত সুখী মানুষ খুঁজে পাওয়া সোনার পাথর বাটির মতো। সকলেই কি সুখী হতে পারে?- কখনো না। তবে, একটি কথা চিরসত্য— সুখী হতে পয়সা লাগে না। নিজের সততা এবং ইচ্ছা থাকলেই হয়; অবশ্যই সুখী হওয়া যায়, এবং তা খুব বেশি কঠিন নয়, সম্ভব। নিজের যতটুকু আছে, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকলে, আনন্দ খুঁজে পেলে সুখী হওয়া তেমন কঠিন কিছু নয়। চাহিদা ও যোগানের সামাঞ্জস্য করতে পারলে অসুখী হওয়ার কোন আর অবকাশ থাকবে না। তবে, সুখ একটি আপেক্ষিক ব্যাপার; এ নিয়ে মতের ভিন্নতা থাকবেই। তবে মনে রাখতে হবে, ধনবান ব্যক্তি হলেই কেবল সুখী হওয়া যায় না যাবে না, এমনটি কখনও হয় না; আত্মতুষ্টি নিয়ে ছোট্ট কুটিরে বা রাস্তায় ঘুমিয়েও সুখ লাভ করা যায়, যা অতৃপ্তে প্রাসাদেও মেলে না।

দর্শনশাস্ত্র এবং ধর্মীয় চিন্তাবিদরা প্রায়ই আবেগের পরিবর্তে একটি ভালো জীবন বা সমৃদ্ধশালী জীবনধারণের ক্ষেত্রকে সুখ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেন। এই অর্থে সুখকে অনুবাদ করার জন্য গ্রিক eudaimonia ব্যবহৃত হতো, এবং এখনও নৈতিকতার নীতিতে তা ব্যবহার করা হয়। সময়ের সাথে সাথে একটি পরিবর্তন হয়েছে যেখানে গুনের সাথে সুখের সম্পর্কের চেয়ে সুখের সাথে গুনের সম্পর্কের উপর বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। সহস্রাব্দ ঘুরে আসার পর থেকে, বিশেষ করে অমর্ত্য সেনের মানবিক বিকাশের পদ্ধতিটি উন্নত হয়েছে তার ফলে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের উপর আগ্রহ বেড়ে গেছে। বিশেষত মার্টিন সেলিগম্যান, এড ডায়নার এবং রুউৎ ভেনহোভেনের কাজ, এবং পল আনন্দ এর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং চিকিৎসা গবেষণায় ব্যাপক অবদানের ফলে এই বিষয়ের গুরুত্ব বেড়ে যায়।

১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থমাস জেফারসন দ্বারা লিখিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি ব্যাপকভাবে আলোচিত রাজনৈতিক মূল্যবোধ ছিল; কারণ তিনি উল্লেখ করেছিলেন, 'সুখের অনুধাবন করা' একটি সার্বজনীন অধিকার। মনে হচ্ছে এটি একটি বিষয়ভিত্তিক ব্যাখ্যা করার কথা বলে তারপরেও তা একাই আবেগ অতিক্রম করে। আসলে, এই আলোচনাটি প্রায়শঃই সহজ ধারণার উপর ভিত্তি করে চলছে; সুখ শব্দটি একই জিনিস বোঝায় যা ১৯৭৬ সালে ছিল এবং আজও তাই আছে। প্রকৃতপক্ষে, অষ্টাদশ শতকে সুখ বলতে বুঝাতো— সমৃদ্ধি, উন্নতি এবং সুস্থতা।

আজকাল সুখ একটি ঝাপসা ধারণা এবং ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাছে এর অর্থ ভিন্ন মনে হতে পারে। সুখের বিজ্ঞান একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো— সুখ নিয়ে বিভিন্ন ধারণা চিহ্নিত করা এবং যেখানে প্রযোজ্য সেই অনুযায়ী তাদের উপাদানগুলোকে বিভক্ত করা। প্রাসঙ্গিক ধারণাগুলো হচ্ছে সুস্থতা, জীবনের মান এবং সমৃদ্ধি। নিদেনপক্ষে একজন হলেও লেখক সুখকে তুষ্টি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কিছু ভাষ্যকার আনন্দবাদী ঐতিহ্যের মাধ্যমে সুখকে অনুসন্ধান এবং অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতাগুলোকে অবজ্ঞা করার মাধ্যমে ইউডামোনিক উপায়ে জীবনকে পুরোপুরি এবং গভীরভাবে ও পরিতৃপ্তির সাথে উপভোগ করার উপর বেশি জোর দেন।

২০১২ সালের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ব্যক্তিগত কল্যাণমূলক পদক্ষেপে, প্রাথমিক বিশুদ্ধতম জীবনের মূল্যায়ন এবং মানসিক প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা। সুখকে উভয় জীবন মূল্যায়নে ব্যবহার করা হয়, যেমন— মোটের উপর আপনি আপনার জীবনে কতটা সুখী? এবং মানসিক প্রতিবেদনে— এখন আপনি কতটা সুখী?- লোকজন এই ধরনের মৌখিক contexts-এ সুখকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করতে পারে বলে মনে হয়। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস প্রতিবেদনগুলো এই পরিমাপ পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে সুখের সর্বোচ্চ স্তরের দেশগুলোকে চিহ্নিত করে থাকেন।

১৯৬০-এর দশক থেকে গ্যারান্টোলজি, সামাজিক মনোবিজ্ঞান, ক্লিনিক্যাল এবং মেডিক্যাল গবেষণা এবং সুখ অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক শাখায় সুখ নিয়ে গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। বিগত দুই দশক ধরে, বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্র ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে এবং বিভিন্ন মতামতের উপর ভিত্তি করে সুখের কারণগুলো এবং যে বিষয়গুলোর সাথে সুখের আন্তঃসম্পর্ক আছে সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সুখের ধারণাকে উন্নত করার জন্যে অনেক স্বল্পমেয়াদী স্ব-উদ্যোগের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ব্যাপক অর্থে সুখ হলো একটি পরিবারের জন্য আনন্দদায়ক একটি অবস্থা, যেমন— আনন্দ, পরিতৃপ্তি, সন্তুষ্টি, উষ্ণতা এবং জয়লাভ। 

উদাহরণস্বরূপ, সুখ মূলতঃ অপ্রত্যাশিত ইতিবাচক ঘটনাগুলোর মাধ্যমে, অন্যদের দেখার মাধ্যমে, এবং অন্যদের প্রশংসা করা এবং গ্রহণ করা থেকে আসে। আরও সংকীর্ণভাবে, এটি পরীক্ষামূলক এবং মূল্যায়নযোগ্য সুখের কথা উল্লেখ করে। 
অভিজ্ঞতাগত সুখ, বা বিষয়গত সুখ, প্রশ্নের মাধ্যমে যাচাই করা হয়; যেমন— এখন আপনার অভিজ্ঞতাটি কতটুকু ভাল বা মন্দ? পক্ষান্তরে, মূল্যায়ন করার মত সুখ নিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা যায়, যেমন— আপনার অবকাশ কতটা ভাল ছিল? এবং অতীত সুখ সম্পর্কে একজন ব্যক্তির বিষয়ভিত্তিক চিন্তা এবং অনুভূতিগুলো পরিমাপ করার চেষ্টা করা। 

পরীক্ষামূলক সুখ কম ত্রুটিপূর্ণ যা মেমোরির মাধ্যমে পুনরুৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু সুখের উপর ভিত্তি করে লেখা বেশিরভাগ সাহিত্য মূল্যায়নের সুফলকে বোঝায়। হিরোস্টিকস দ্বারা সুখ পরিমাপের সাথে দুইটি বিষয় জড়িত থাকতে পারে, যেমন— peak-end rule এর কথা বলা যেতে পারে। সুখ পুরোপুরি বহিরাগত বিষয় নয়, এমনকি মুহূর্তের আনন্দ থেকেও তা প্রাপ্ত হয় না। প্রকৃতপক্ষে, প্রচলিত ধারণায় সুখ দ্রুতগামী বলা সত্ত্বেও গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, সময়ের সাথে সাথে সুখ স্থিতিশীল হয়। সুখ আংশিকভাবে জিনগত। যমজ গবেষণা করে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, মানুষের সুখ স্তরের ৫০ শতাংশ জিনগতভাবে নির্ধারিত হয়, ১০ শতাংশ জীবনের চলমান পরিস্থিতি এবং অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ সুখ আত্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়।

এ্যাক্রোনিম পিইআরএমএ সুখের সাথে সম্পর্কযুক্ত পাঁচটি বিষয়কে সংক্ষেপ করে এভাবে—
১. আনন্দ (সুস্বাদু খাদ্য, উষ্ণ বাথ, ইত্যাদি), 
২. যোগদান (বা প্রবাহ, একটি উপভোগ্য কার্যকলাপ যা এখনো চ্যালেঞ্জিং পর্যায়ে আছে), 
৩. সম্পর্ক (সামাজিক সম্পর্ককে সুখের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য নির্দেশক বলা যায় ), 
৪. অর্থ (একটি অনুভূতির খোঁজ করা বা বড় কিছুর সাথে সম্পর্কিত), এবং 
৫. অর্জন (বাস্তব লক্ষ্য উপলব্ধি করা)।
এবং বিশেষ করে পিতা-মাতার সাথে সম্পর্কযুক্ত ভালোবাসার ক্ষমতা এবং পারষ্পরিক সংযুক্তি যা মানুষের জীবনে সুখের একটি দৃঢ় অবস্থার কথা বলে।
মস্তিষ্কের বামদিকের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের উচ্চ কার্যকলাপের দিকে লক্ষ্য করে বুঝা যায় যে এই অংশটির সাথে মানুষের সুখানুভূতির আন্তঃসম্পর্ক আছে।

এটিও যুক্তিযুক্ত করা হয়েছে যে, টাকার মাধ্যমে কার্যকরভাবে সুখ কিনতে পারা যায় না, যদি না একে সুনির্দিষ্ট উপায়ে ব্যবহার করা হয়। এটি ছাড়াও যে ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ আছে যার মাধ্যমে তারা সহজেই খাবার কিনতে পারে, নতুন কাপড় পরিধান এবং ঘর বাড়ি বানাতে পারে - এমনকি অনেক লোকের বেশি অর্থ আছে যা তাদের সামান্য সুখী করতে পারে। অন্যদের জন্য অর্থ ব্যয় করে সত্যিই আমরা অনেক সুখ অনুভব করি; কিন্তু নিজেদের জন্য ব্যয় করলে ততটা সুখ করি না।

ধর্ম কীভাবে সুখের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা নিয়ে কিছু গবেষণা করা হয়েছে। সাধারণ সম্পর্ক অস্পষ্ট, কিন্তু ধর্মের মধ্যে মানুষকে বেশি সুখী হতে দেখা যায়। PERMA-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, ধর্ম নিজের চেয়ে আরও ব্যাপক অর্থবোধক এবং সংযোগের অনুভূতি প্রদান করতে পারে। ধর্ম মানুষকে সাম্প্রদায়িক সদস্যপদ দিতে পারে, যা সাধারণ সম্পর্ক থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী। অন্য একটি উপাদান এর কথা বলা যায় যা রীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

মাসলো চাহিদার অনুক্রমের একটি পিরামিড অঙ্কন করেছেন— যা মানবিক চাহিদা, মানসিক এবং শারীরিক মাত্রার চিত্র তুলে ধরে। যখন একজন মানুষ পিরামিডের ধাপে উঠবে, সে আত্মতৃপ্তির চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছবে। প্রয়োজন পূরণের রুটিনের বাহিরে, Maslow অসাধারণ অভিজ্ঞতার মুহূর্তের কথা বলেছেন যা চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা হিসাবে পরিচিত। তাছাড়া প্রেমের গভীর মুহূর্ত, বোঝা, সুখ বা পরমানন্দ, যার ফলে একজন ব্যক্তি অনুভব করে আরও পুরো, জীবিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং নিজেকে বিশ্বের একটি অংশ হিসেবে অনুভব করে। এটি মিহালি সিস্কসজেন্টমিহালি প্রবাহ ধারণার অনুরূপ।

স্ব-সংকল্প তত্ত্ব তিনটি চাহিদার সাথে সম্পর্কিত: দক্ষতা, স্বায়ত্তশাসন এবং সংশ্লিষ্টতা।

বিশ্বব্যাপী ক্রস বিভাগীয় গবেষণাগুলো সুখের সাথে ফল এবং শাক-সবজি খাওয়ার একটি সম্পর্ককে সমর্থন করে। প্রতিদিন ফল এবং শাক-সবজি খাওয়াকে 'খুব খুশি' হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। তারা মনে করেন ফল এবং শাক-সবজি খাওয়া ও সুখের মধ্যে একটি শক্তিশালী এবং ইতিবাচক পারস্পরিক সম্পর্ক আছে। দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, চিলি, ইউএসএ বা ইউকে-তে ব্যাপক হারে ফল এবং উদ্ভিজ্জ ব্যবহারে অধিক সুখের সাথে ইতিবাচক সহযোগিতা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ধূমপান, ব্যায়াম, বডি মাস ইনডেক্স এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয়গুলোও সুখের সাথে জড়িত।

Layard এবং অন্যান্যরা দেখান যে, সুখের উপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে মানসিক স্বাস্থ্য। ব্রাহ্মকুমারী রাজা যোগ ব্যায়ামে ধ্যানকারীদের উপর অক্সফোর্ডের সুখের প্রশ্নাবলী ব্যবহার করে একটি গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রিত গ্রুপের চেয়ে অনিয়ন্ত্রিত গ্রুপের লোকেরা বেশি সুখী। Yongey Mingyur Rinpoche বলেছেন যে— স্নায়ু বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় লক্ষ্য করেছেন ধ্যানের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার সুখের বেসলাইন পরিবর্তন করতে পারেন।

ধর্ম এবং সুখ নিয়ে অনেক গবেষক গবেষণা করেছেন এবং গবেষণা হয়েছে। ধর্মীয় বিষয় সুখের উপাদান হিসাবে অনেক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করে, যা ইতিবাচক মনোবিজ্ঞান দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। সুখের সাথে সংগঠিত ধর্মের সামাজিক সংযোগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে; প্রার্থনা এবং বিশ্বাস দ্বারা স্নায়বিক সুবিধা লাভ করা যায় অনেক বেশি।

এমন অনেক বিষয় আছে যা দ্বারা ধর্ম একজন ব্যক্তিকে নেক ও সুখী করতে পারে; এমনকি সামাজিক যোগাযোগ এবং সমর্থন যা ধর্মীয় pursuits থেকে যা পাওয়া যায়। তাছাড়া মানসিক কার্যকলাপ, যা আশাবাদ এবং স্বেচ্ছাসেবী বিষয়ের সঙ্গে জড়িত, কি কৌশলের মাধ্যমে মানসিক চাপ মোকাবেলা করা যাবে এবং এর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাবে। এটাও হতে পারে যে ধার্মিক লোকেরা ভাল স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আচরণ, যেমন— পদার্থের কম অপব্যবহার করে; যেহেতু মনস্তাত্ত্বিক পদার্থের ব্যবহারকে কখনও কখনও অপব্যবহার বলে মনে করা হয়। The Handbook of Religion and Health-এ Feigelman (১৯৯২) দ্বারা পরিচালিত একটি জরিপের বর্ণনা দিয়েছে যে, যারা ধর্মকে ছেড়ে দিয়েছে এমন আমেরিকানদের মধ্যে সুখ নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে, সেখানে এটি পাওয়া গেছে যে, ধর্মীয় অধিভুক্তি বাতিল ও অসুখের মধ্যে সামান্য সম্পর্ক রয়েছে। 

কসমিন ও লচম্যান (১৯৯৩) তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ধর্মের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের তুলনায় যাদের ধর্মের সাথে কোন সম্বন্ধ নেই তাদের বিষণ্ণতা উপসর্গের ঝুঁকি µ অনেক বেশি। ১৪৭ টি স্বাধীন তদন্তকারীর গবেষণায় দেখা গেছে— ধর্মীয়বোধ এবং বিষণ্নতাগত উপসর্গগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল -০.০৯৬; যা ইঙ্গিত দেয় যে, বৃহত্তর ধর্মীয়বোধ হালকাভাবে কম উপসর্গের সাথে জড়িত।

ল্যাজাটুম প্রসপারিটি ইনডেক্স সুখের বিজ্ঞান নিয়ে যে গবেষণা পরিচালনা করেছে সেই গবেষণায় এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, ধর্মীয় সংযুক্তি ও সুখের সাথে একটি ইতিবাচক লিংক আছে; তারা এই রিপোর্ট করে যে, যাদের জীবনে ঈশ্বর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তারা তাদের জীবনে অনেক বেশি সন্তুষ্ট থাকে, তাদের আয়, বয়স এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য হিসাব করার পরও। 

গালাপের জরিপ, জাতীয় মতামত গবেষণা কেন্দ্র এবং প্যা অর্গানাইজেশন এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে, আধ্যাত্মিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ব্যক্তিরা অন্তত ধর্মীয়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ব্যক্তিদের তুলনায় 'খুব খুশি' হওয়ার রিপোর্টের দ্বিগুণ। ২০০ টিরও বেশি সামাজিক গবেষণার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, উচ্চ ধার্মিকতা— বিষণ্ণতা এবং মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং আত্মহত্যার ঝুঁকির পরিমাণ কমিয়ে দেয়, শুধু তাই নয় যৌন জীবন এবং সন্তুষ্টির দিক থেকেও তারা অনেক এগিয়ে। তবে ধর্ম এবং সুখের মধ্যে সম্পর্ক ধর্মগ্রন্থের উপর সর্বদা নির্ভরশীল। 

ধর্ম এবং যন্ত্রণা এর মধ্যে অনেক বড় সংযোগ রয়েছে (লিঙ্কন ১০৩৪); এবং ৪৯৮ টি সমীক্ষা পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণা পর্যালোচনা করে উপসংহারে এসেছেন যে, একটি ইতিবাচক পারস্পরিক সম্পর্ক দেখিয়েছে বড় সংখ্যার ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি সাথে অনুভূত সুখ এবং আত্মসম্মান এবং নিম্ন রক্তচাপ, বিষণ্ণতা, এবং ক্লিনিক্যাল কর্তব্যে অবহেলার বিষয় গুলো জড়িত। 

১৯৯০ থেকে ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত ৩৪ টি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধার্মিকতার মানসিক সমন্বয়ের সাথে একটি ভাল সম্পর্ক রয়েছে, কম মানসিক অসুস্থতা, আরও বেশি জীবন নিয়ে সন্তুষ্টি এবং ভাল আত্ম-তুষ্টি লক্ষ্য করা গেছে। অবশেষে, ৮৫০টি গবেষণাপত্রের একটি সাম্প্রতিক পদ্ধতিগত পর্যালোচনা করে এই উপসংহারে এসেছিল যে— বেশিরভাগ সুশৃঙ্খল গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, উচ্চ মাত্রায় ধর্মীয় সম্পৃক্ততার সাথে ইতিবাচকভাবে মনস্তাত্ত্বিক সুখের সূচক (জীবন সন্তুষ্টি, সুখ, ইতিবাচক প্রভাব, এবং উচ্চতর মনোবল) এবং কম বিষণ্ণতা, আত্মঘাতী চিন্তা ও আচরণ, ড্রাগস বা অ্যালকোহল এর ব্যবহার ও অপব্যবহারসহ বিষয়গুলো সম্পৃক্ত। 

যাইহোক, পণ্ডিতদের মধ্যে দৃঢ় মতবিরোধ রয়েছে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রভাব বিশেষ করে গির্জায় যোগদান বা অন্যথায় ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্তর্গত হওয়া, আধ্যাত্মিক বা সামাজিক দিকগুলোর কারণে মানুষ সুখী হতে পারে কিনা এই সব বিষয় নিয়ে। যারা গির্জা বা অনুরূপ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত তারা শুধুমাত্র সামাজিক সংযোগের প্রভাবে প্রভাবিত হতে পারে। এই সুবিধাগুলোই যথেষ্ট, যা তারা একই বা অন্য ধর্ম নিরপেক্ষ দল, ক্লাব বা অনুরূপ সংস্থাগুলোতে যোগদান করে লাভ করতে পারে।

ইসলামে— ৫০% সুখকে 'রিদাহ বাই আল-কাদাহ' বলা হয় (ভাগ্যে যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা)। এর অর্থ হলো— ইমানদার হওয়া। যদি আমরা সত্যিই আল্লাহকে ভালোবাসি এবং তাঁর উপরে নির্ভর করি, আমাদের জন্য তিনি যা আদেশ করেছেন তা নিয়ে যেন আমরা অবশ্যই সন্তুষ্ট থাকি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ভাগ্য নিয়ে অনেক কথা বলেছেন এবং সন্তুষ্টির গুরুত্বও তুলে ধরেছেন। অতএব, আমাদের মুসলমানদের ওইসব  অনুরোধগুলো অবশ্যই পড়ার প্রচেষ্টা চালানো উচিত— 'আমি আল্লাহকে আমার পালনকর্তা হিসাবে পেয়ে খুশি হয়েছি, আমার ধর্ম হিসাবে ইসলামের সাথে এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আমার নবী হিসাবে পেয়ে  [সহীহ্ আবু দাউদ]।' 'হে আল্লাহ্‌, আমাকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করে দিন, আমার জন্য আশীর্বাদ পাঠান, এবং আমার জন্য প্রত্যেকটি অনুপস্থিত জিনিসের মধ্য দিয়ে ভাল কিছু রাখুন [সহীহ্ বুখারী]।'

বৌদ্ধধর্ম মতে— সুখ হচ্ছে বৌদ্ধ শিক্ষার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় । দুঃখকষ্ট থেকে চূড়ান্ত স্বাধীনতা লাভের জন্য নোবেল আটটি পথ তার অনুশীলনকারীদেরকে নির্বান লাভের স্তরে নিয়ে যায়, যাকে বলা হয় চির সুখের একটি স্থান। পরম সুখ শুধুমাত্র অর্জিত হবে তখন, যখন চাওয়া পাওয়াকে কেউ অতিক্রম করতে পারবে। সম্পদ অর্জন এবং ভালো বন্ধুত্ব বজায় রাখার মধ্যেও জাগতিক সুখের সন্ধান পাওয়া যায়, যা মানুষের জন্য যোগ্য লক্ষ্য হিসেবে স্বীকৃত। বৌদ্ধ ধর্ম সমবেদনা, সমস্ত মানুষের সুখ এবং কল্যাণের জন্য উৎসাহ দেয়।

ইহুদীধর্ম মতে— সুখ বা সিম্ছাকে  ঈশ্বরের সেবায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাইবেলের গসপেল 'সুখের সাথে পালনকর্তার পূজা করা, আনন্দের গান নিয়ে তাঁর সামনে আসা (গীতসংহিতা ১০০: ২)'। ঈশ্বরের সেবা আনন্দের উপর জোর দেয়। ঊনবিংশ শতকের রাব্বি নাচম্যান ব্রেসলভ দ্বারা একটি জনপ্রিয় শিক্ষা চাছিদিক রাব্বি, 'মিৎস্ভা গেদোলাহ লাহিয়ত বাসিমচা তামিড'—এটি একটি মহান মিৎস্ভা (আজ্ঞা) সব সময় ভাল থাকার একটি পর্যায়। যখন একজন ব্যক্তি সুখী থাকে, তখন তারা ঈশ্বরকে সেবা করার এবং বিষণ্ণ বা বিরক্তির চেয়ে তাদের দৈনিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে আরও বেশি সক্ষম হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় সুখের প্রধান অর্থ সৌভাগ্য, সুযোগ বা যা ঘটছে। 
গ্রিক দর্শনে প্রাথমিকভাবে এটি নৈতিকতা অর্থে বোঝায়। 

ক্যাথলিকবাদে— মানুষের অস্তিত্বের চূড়ান্ত বিষয়টি গ্রীক ইউদাইমনিয়ার সমতুল্য বা 'আশীর্বাদপূর্ণ সুখ'; যা ত্রয়োদশ শতাব্দীর দার্শনিক-ধর্মতত্ত্ববিদ টমাস অ্যাকুইনাসের ঈশ্বরীয় উপায়ে একটি বিস্ময়কর দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মানুষের জটিলতাগুলো, যেমন— কারণ এবং চেতনা, যা সুস্থতা বা সুখ উৎপাদন করতে পারে; কিন্তু এই ধরনের ফর্ম সীমিত এবং ক্ষণস্থায়ী। আক্ষরিক জীবনের মধ্যে ঈশ্বরের চিন্তা, অসীম সুন্দর এবং ইচ্ছার সর্বোচ্চ বাস্তবায়নজনিত বিষয়গুলো জড়িত থাকে। Beatitudo বা সম্পূর্ণ সুখ বলতে যা বুঝায় তা এই জীবনে অর্জন করা যাবেনা, কিন্তু পরবর্তী জীবনে তা অবশ্যই সম্ভব।

যদিও ধর্ম প্রায়ই আনুষ্ঠানিক এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক, কিন্তু আধ্যাত্মিকতা পৃথক হয়ে থাকে, যা অনানুষ্ঠানিকভাবে হিসাবে চর্চা করা হয়। ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় পাবলিক এবং প্রাইভেট স্কুল উভয় ক্ষেত্রেই ৮-১২ বছর বয়সী শিশুদের ৩২০ জনকে আধ্যাত্মিক সুস্বাস্থ্য সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা ও সুখের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক মূল্যায়ণ করা হয়েছে। আধ্যাত্মিকতা— যা ধর্মীয় চর্চা নয় (প্রার্থনা, গির্জা সেবা ,যোগদান)। ছেলেমেয়েদের মধ্যে সুখের ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে যে, যারা যত বেশি আধ্যাত্মিক ছিল তারা তত বেশি সুখী ছিল। আধ্যাত্মিকতা থেকে প্রাপ্ত সুখের মধ্যে প্রায় ৩-২৬% ভিন্নতার জন্য দায়ী।

২৩০০ বছর আগে চীনের কনফুসিয়ান চিন্তক মেনসিউস যুদ্ধ জড়িত নির্দয় রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ দিতে চেয়েছিলেন, তিনি মনে করেছিলেন যে—ক্ষুদ্র স্বার্থ (শারীরবৃত্তীয় স্বার্থ) এবং বৃহত্তর স্বার্থ (নৈতিক স্বার্থ )-র মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালন করেছিল যা ঋষি হুড পর্যন্ত পৌঁছতে সাহায্য করবে বলে তিনি দাবী করেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, যদি আমরা ন্যায়পরায়ণ কাজ ও প্রাণবন্ত শক্তি দিয়ে কাউকে পুষ্ট করার জন্য সন্তুষ্টি বা পরিতোষ অনুভব না করি, তবে সেই শক্তি কুচকিয়ে যাবে (মেনেসিয়াস, ৬এ:১৫ ২এ: ২)। আরও বিশেষভাবে, তিনি বিশেষ করে সংগীতের মাধ্যমে মহান গুণাবলীগুলোর অনুশীলনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ)(১০৫৮-১১১১) একজন জগৎবিখ্যাত মুসলিম সূফী চিন্তাবিদ; Alchemy of Happiness লিখে তিনি সুখের ভিত্তি দাঁড় করিয়ে গেছেন, যা বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব জুড়ে ব্যাপকভাবে সমাদৃত এবং প্রচলিত।

যোগসূত্রের লেখক হিন্দু চিন্তাবিদ পতঞ্জলি সুখের মনোবৈজ্ঞানিক ও আণবিক শক্তির উপর লিখে গেছেন।

৩৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে লিখিত Nicomachean Ethics-এ অ্যারিস্টেটল বলেন যে, সুখ (ভাল হওয়া এবং ভাল কাজ করা বুঝায়); সুখ হলো একমাত্র জিনিস যা মানুষ নিজের জন্য কামনা করে এবং যা ধন, সম্মান, স্বাস্থ্য বা বন্ধুত্বের মতো নয়। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, মানুষ শুধুমাত্র নিজের জন্য নয় বরং সুখী হওয়ার জন্য ধন, সম্মান বা স্বাস্থ্যের সন্ধান করে। উল্লেখ্য, আমরা ইউডাইমোনিয়া শব্দটিকে 'সুখ' হিসাবে অনুবাদ করি, যাকে অ্যারিস্টেটল আবেগ বা একটি অবস্থার পরিবর্তে একটি কার্যকলাপ হিসেবে দেখেছিলেন। 

এভাবে বোঝা যায় যে, সুখী জীবন হলো ভালো জীবন; অর্থাৎ এমন একটি জীবন যার মধ্যে একটি মানুষ অপর একটি মানুষের প্রকৃতিকে একটি চমৎকার উপায়ে উদযাপন করে। বিশেষতঃ অ্যারিস্টেটল যুক্তি দেন যে, ভাল জীবন হচ্ছে চমৎকার যুক্তিপূর্ণ কার্যকলাপের মাধ্যমে অতিবাহিত জীবন। তিনি ফাংশন আর্গুমেন্টের মাধ্যমে এই দাবি উত্থাপন করেছিলেন। মূলতঃ যদি এটি সঠিক হয়— প্রতিটি জীবন্ত জিনিসের একটি ফাংশন আছে, যা অনন্য উপায়ে কাজ পরিচালনা করে। চমৎকার যুক্তিপূর্ণ কার্যকলাপের মাধ্যমে পরিচালিত জীবনই হলো সুখী জীবন; অ্যারিস্টেটল এটা বলাও ছেড়ে দেননি। কারণ, তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে— চমৎকার যুক্তিপূর্ণ কার্যকলাপে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ জীবন রয়েছে। এই দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ জীবন হলো নৈতিক গুণাবলীর জীবন।

অনেক নৈতিকতাবাদি যুক্তি দিয়েছেন সুখের আচরণের উপর ভিত্তি করে পৃথকভাবে বা যৌথভাবে কিভাবে মানুষের আচরণ করা উচিত তা নিয়ে। ইউটিলিটেরিয়নরা, যেমন— জন স্টুয়ার্ট মিল এবং জেরেমি বেন্থহ্যাম নৈতিক আচরণের পথ নির্দেশনা হিসাবে সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ নীতির কথা বলেছিলেন। ফ্রেডরিখ নয়েৎশে সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ অর্জন নিয়ে ইংরেজি উটিলিটিরিয়ান ফোকাসের নিন্দা করে বলেন, মানুষ সুখের জন্য সংগ্রাম করে না, শুধু ইংরেজরাই করে। নয়েৎশে মনে করেছিলেন যে, সুখ মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য, মানুষের অস্তিত্বের লক্ষ্য, যা মানুষকে নীচ করে তোলে; নয়েৎশ এর পরিবর্তে একটি সংস্কৃতির জন্য আকাঙ্ক্ষিত, যা নিখুঁত সুখ প্রতিষ্ঠিত করবে। সেন্ট অগাস্টিন এবং টমাস অ্যাকুইনাসের মতে, শেষের সুখটিই হল আসল সুখ— সমস্ত মানুষ শেষ প্রান্তের আশা করতে সম্মত হয়, যা প্রকৃত সুখ।

যাইহোক, সুবিধার জন্য প্রাথমিক সরঞ্জাম হিসাবে পরিণামের ফলাফলের ভিত্তিতে যুক্তিবাদী ব্যক্তিরা অ্যাকুইনাস এবংং অ্যারিস্টেটলের সাথে একমত হন যে, সুখ কেবল কাজের পরিণতি নিয়ে যুক্তিযুক্তভাবেই পৌঁছতে পারে না, তবে কার্যের জন্য ভালো কারণগুলোর অনুসরণ করারও প্রয়োজন হয়, যেমন— নৈতিকতা অনুযায়ী অভ্যাস; অভ্যাস এবং কাজ যা সাধারণত সুখের দিকে পরিচালিত হয়। অ্যাকুইনাসের মতে যা আইন অনুসারে সৃষ্ট, যেমন— প্রাকৃতিক আইন এবং ঐশ্বরিক আইন। অ্যাকুইনাস এর মত অনুযায়ী এই আইনগুলো প্রথম কারণ দ্বারা সৃষ্ট, বা ঈশ্বর দ্বারা।

অ্যাকুইনাসের মতে— সুখ একটি ফটকামূলক বুদ্ধিমত্তার অপারেশন নিয়ে গঠিত হয়; ফলস্বরূপ সুখ সাধারণত এমন একটি অপারেশন নিয়ে গঠিত যা ঐশ্বরিক বিষয়ের সাথে জড়িত এবং শেষ প্রয়াস সক্রিয় জীবন যাপন করতে পারে না, যা বাস্তবিক বুদ্ধি সম্পর্কিত।

সাধারণ বাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেমন জিডিপি এবং জিএনপি হিসাবে সফল নীতির পরিমাপ হিসাবে ব্যবহার করা হয় এবং হয়েছে; গড় ধনী দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোর তুলনায় বেশি সুখী হয়। তাই এই প্রভাবটি ধন-সম্পদের সাথে কিছুটা  সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়। এটি দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, নির্ভরশীলতা লিনিয়ার নয় তবে লগারিদমিক; অর্থাৎ,জিএনপিতে একই শতাংশ বৃদ্ধি দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ধনী দেশে সুখ বৃদ্ধি করে। ক্রমবর্ধমানভাবে, একাডেমিক অর্থনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলি বহু-মাত্রিক ড্যাশবোর্ডের জন্য বাদানুবাদ করছে এবং বিকাশ করছে যা মানবীয় কল্যাণের আরও সরাসরি ও সুস্পষ্ট মূল্যায়ন প্রদানের জন্য ব্যক্তিগত ও উদ্দেশ্য সূচককে একত্রিত করা যায় কিনা। পল আনান্দ এবং তার সহকর্মীদের দ্বারা এই বিষয়টিকে তুলে ধরতে সহায়তা করে যে, সুখের প্রতিফলন ঘটেছে সুখের পরিপ্রেক্ষিতে অংশীদারত্বের দিক থেকে, যেমন— প্রধান সীমাবদ্ধতার উপস্থিতি এবং সেই ন্যায্যতা, স্বায়ত্তশাসন, সম্প্রদায় এবং অংশগ্রহণগুলো সুখ ও সুখের প্রধান দিক, যা সারাজীবন জুড়ে পরিচালিত হয়।

উদারপন্থী চিন্তাবিদ কাটো ইন্সটিটিউট দাবি করেন যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সুস্পষ্টভাবে সুখের সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রাথমিকভাবে একটি পাশ্চাত্যের মিশ্র অর্থনীতি, মুক্ত সংবাদ এবং গণতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত। নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো (কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা শাসিত) পশ্চিমাদের তুলনায় কম সুখী ছিল, এমনকি সমান দরিদ্র দেশগুলোর চেয়েও কম সুখী।

তবে, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক বেঞ্জামিন রেডক্লিফ, যিনি সুখ অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনেক গবেষণা করেছেন, তিনি মনে করেন— গণতান্ত্রিক দেশে জীবন সন্তুষ্টি অনেক দৃঢ় হয়, যদি ইতিবাচকভাবে একটি উদার সামাজিক নিরাপত্তা নেট, প্রো- শ্রম বাজার প্রবিধান এবং শক্তিশালী শ্রম ইউনিয়নের ব্যবস্থা করা যায়। একইভাবে, অনেক প্রমাণ আছে যে পাবলিক পলিসিগুলো দারিদ্র্যতা কমাতে এবং একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সমর্থন করতে পারে, যদি উচ্চতম ন্যূনতম মজুরি সুনিশ্চিত করা যায় তাহলে তা সুখের উপর অনেক প্রভাব ফেলে।

এটি সাধারণভাবে গৃহীত হয় যে, সুখ অন্ততঃপক্ষে ডোপমিনার্জিক, অ্যাড্রেনার্জিক এবং সেরোটোনার্জিক বিপাকের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করা হয়। হরমোনের মাত্রা এবং সুখের মধ্যে একটি সম্পর্ক পাওয়া গেছে। SSRIs, যেমন— Prozac ক্লিনিক্যালভাবে অসুখী কিনা সেরোটোনিকের মাত্রা সমন্বয়ের মাধ্যমে তা যাচাই করা হয়। গবেষকরা, যেমন— আলেকজান্ডার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, অনেক লোক মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য হরমোনের মাত্রা সংশোধন করার প্রচেষ্টা করলে ফলাফল হতে পারে বিপরীত যা তাদের অসন্তুষ্ট করে। একটি ইতিবাচক সম্পর্ক মস্তিষ্কের ডান পাশে precuneus এলাকায় ধূসর কিছু উপাদান পাওয়া গেছে যার মাধ্যমে সুখের মাত্রা পরিমাপ করা যায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। ধ্যান ভিত্তিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে লক্ষ্য করা গেছে যে, precuneus এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হারে ধূসর উপাদান বৃদ্ধির সম্পর্ক পাওয়া গেছে।

২০০৫ সালে লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে এন্ড্রু স্টেপটো এবং মাইকেল মারমোট কর্তৃক পরিচালিত একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, সুখ জৈবিক মার্কারদের সাথে সম্পর্কিত যা স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষকরা লক্ষ্য করেন যে, সুখ এবং তিনটি জৈবিক মার্কার এর মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে কি না, যেমন— হৃৎস্পন্দন, করটিসোল স্তর এবং প্লাজমা ফাইব্রিনোজেন এর মাত্রা। যারা নিজেদেরকে কমপক্ষে সুখী মনে করেন তাদের মধ্যে করটিসোলের মাত্রা ছিল ৪৮% বেশি যারা নিজেদেরকে সবচেয়ে বেশি সুখী বলে মনে করে তাদের থেকে। অন্তত সুখী বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে দুটি স্ট্রেস-ইনডুইটিং টাস্কগুলোর একটি বড় প্লাজমা ফাইব্রিনোজেন প্রতিক্রিয়া— স্ট্রোপ পরীক্ষা এবং একটি মিররে একটি তারকার ট্রেসিং করা। তিন বছর পরে তাদের বিষয়গুলো পুনরাবৃত্তি করে যে, স্টেপটো এবং মারমোটে পাওয়া যায় তাতে ইতিবাচক আবেগগুলোর মধ্যে উচ্চতর অংশগ্রহণকারী কোরিটিসোল এবং ফাইব্রিনোজেনের নিম্ন স্তরের পাশাপাশি নিম্ন হার্টের হারও অব্যাহত ছিল।

হ্যাপি পিপল লাইভ লংগার (২০১১), ব্রুনো ফ্রাই জানায় যে, সুখী মানুষেরা ১৪% বেশি সময় বেঁচে থাকে, দৈর্ঘ্য ৭.৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত। এবং রিচার্ড ডেভিডসনের বেস্টসেলার (২০১২) The Emotional Life of Your Brain যুক্তি দেয় যে, ইতিবাচক আবেগ এবং সুখ ভাল স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

যাইহোক, ২০১৫ সালের আগে পরিচালিত গবেষণাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, মৃত্যুর উপর সুখের কোন প্রভাব নেই। মৌলিক বিশ্বাস হলো— যদি আপনি সুখী হন তাহলে আপনি দীর্ঘকাল বাঁচবেন; এটা সত্য নয়। সুসঙ্গত ফলাফল হলো সুস্বাস্থ্যের পাশাপাশি সুখী মানুষের বয়স বেশি হতে পারে— ধূমপান না করা, শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকা, কঠোর অনুশীলন করা , সঙ্গীর সাথে বাস করা, ধর্মীয় বা গোষ্ঠী ক্রিয়াকলাপ পরিচালনা করা এবং রাতে অন্তত আট ঘণ্টা ঘুমানো।

সুখ দেহের রোগপ্রতিরোধে প্রভাব ফেলে বলে মনে করা হচ্ছে। ধূমপান, মদ্যপান, ব্যায়াম, এবং ঘুমের মতো অন্যান্য কারণগুলোর সাথে ইতিবাচক আবেগ অনুধাবনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে যা ঠাণ্ডা ও ফ্লু প্রতিরোধে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। (তথ্যসূত্র: ইউকি)

পরিশেষে— ভিন্ন দেশের সেকেন্ড হোমে সুখ নেই, নেই  সুখ কানাডার বেগমপড়ায় বা অন্য কোথাও;  সুখের আসল ঠিকানা সৎ মানুষের চিত্ত। আর চিত্তে সুখ থাকলে অরণ্যে বসবাসেও সমস্যা নেই। 'সুখ' অত্যন্ত আপেক্ষিক ও জটিল একটি বিষয়; জীবন থেকে এ কথাটি নিশ্চিত বলতে পারি— চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারলে সে জীবনে সুখের আর কোন কমতি থাকে না থাকবে না।।  

মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 
২৭ নভেম্বর, ২০২০.