শনিবার, ২৯ জুলাই, ২০২৩

শ্রেষ্ঠত্ব আসে কোন পথে?



'কুনতুম খাইরা উম্মাতিন উখরিজাত লিন্নাসি.....'- 'তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে।' পবিত্র কুর'আনুল কারীমায় আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা সুরা আল ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু সাথে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন— সৎকাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ, এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ  ঈমান; তাহলেই উম্মত সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত, অন্যথায় উপাধি থেকে নিশ্চিত বঞ্চিত। উক্ত আয়াতের শেষাংশে আহলে কিতাবের নিন্দাবাদের উদ্দেশ্য হলো—  বিষয়টিকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়া, যদি উম্মত ভাল কাজের আদেশ মন্দ কাজে বাধা প্রদান না করে, তাহলে তারাও তাদের মত বিবেচিত হবে; কেননা আহলে কিতাবের দোষ হলো 'তারা যে মন্দ কাজ করতো, তা থেকে তারা একে অপরকে নিষেধ করতো না' (সুরা মায়েদাহ : ৭৯) 

আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ, আর সেই শ্রেষ্ঠ জীবের মাঝে আল্লাহর ঘোষিত সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষের দল বলা হয়েছে উম্মতে মোহাম্মদীকে।  শ্রেষ্ঠত্ব দুনিয়ার কোন রাজা বাদশা বা কোন মানব-দানব-জ্বীন জাতি-গোষ্ঠী থেকে আসেনি, স্বয়ং রাব্বুল ইজ্জতের ঘোষণা এটি, কিন্তু বর্তমান বিশ্বে মুসলিম জাতি যেন এক করুণার জাতি, সাহায্য নেয়ার জাতি, অন্য জাতির তাবেদার হয়ে তাদের দুনিয়া চলছে; কিন্তু কেন? বস্তুতঃ দুনিয়ার সকল কিছু পরিচালনা করার কথা মুসলমানের, কিন্তু বর্তমান বিশ্বের বাস্তব অবস্থা বড়ই বেদনাদায়ক। কেন আজ মুসলিম জাতির এই করুন দশা? মাত্র তেইশ বছরে যে জাতির সূচনা, সেই থেকে সারে বারোশ বছর যে জাতি বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে, কর্তৃত্ব করেছে, সেই জাতির ভাগ্যে আজ এমন করুণ দশা কারণ কি? সৃষ্টি গজতের সবকিছুর রহস্য যাদের সংবিধানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তু, সে জাতি আবার এমন ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে কি করে??  


জগতের যা কিছু আছে, সব কিছু তথা সকল সম্পদ, সকল প্রাকৃতিক অবদানকে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা মানুষের অধীন করে দিয়েছেন, তারাই পৃথিবীকে জীবের বাস যোগ্য করে গড়ে তুলবে, সকল সম্পদের সুষ্ঠু এবং সুন্দর ব্যবস্থাপনা করবে; সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, বিস্বস্ততার সাথে সফল নিশ্চয়তায় দক্ষতার সাথে আল্লাহর দান সকল সম্পদের সদ্ব্যবহার করবে, এটাই তো মূল প্রতিপাদ্য। সব কিছুর সফল পরিচলন, সুষম বন্টন করে সত্য সুন্দরের পথে পৃথিবী পরিচালনা করবে এবং সব কিছুর সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করবে, এর উপরই নিশ্চিত হবে জীব জগতের উন্নত জীবন, গঠিত হবে উন্নত পরিবার, উন্নত সমাজ সম্বৃদ্ধ শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামো, নিশ্চিত হবে মানবসম্পদের সঠিক সুষম ব্যবস্থাপনা; এই তো আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার ঘোষণার মূল প্রতিপাদ্য। আর তা করতে হবে আল্লাহর প্রতি পূর্ণাঙ্গ নির্ভরতার সাথে, অর্থাৎ ঈমানের সাথে; তবেই তো আসবে দুনিয়া আখিরাতের সফলতা। কিন্তু আজ মুসলিম জাতি হয়ে গেছে অন্যান্য জাতির তাবেদার। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু কেন? দ্বিচারিতা যেদিন থেকে আমাদের চারিত্রে মিশেছে, সে'দিন থেকেই আমরা হারিয়েছি আমাদের ঐতিহ্য  এবং শ্রেষ্ঠত্ব। প্রাচুর্য আর ভোগের মোহ আমাদের অন্ধ করে রেখেছে; সরল জীবন আমরা যেদিন থেকে পরিত্যাগ করেছি, সে'দিন থেকেই আমাদের পতনের শুরু, যা আজও অব্যাহত। হুজুরপাক (সা:)--এর মূল মিশন ছিল সরলতা; সৎ সহজ সাবলীল জীবন। 


পবিত্র কুর'আনুল কারীমায় পূর্ববর্তী জাতি-গুষ্ঠি ধ্বংসের যেসব উদাহরণ সন্নিবেশিত আছে, আজকের মুসলিমের জাতীয় চরিত্রে তার প্রতিটি মন্দ কাজের স্বভাব বিদ্যমান; হেন কোন বদকাজ নেই যা আজ মুসলমান করে না, করছে না। যে সব কাজ মুসলিম সমাজের জন্য হারাম বা নিষিদ্ধ, তা- আজ আমরা অকাতরে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি; কূটচালে কেমন করে যেন মন্দের সব কিছুই মুসলমান সমাজ জীবনে গেঁথে দেয়া হয়েছে। দুনিয়াবি সাময়িক ভোগের লোভে মুসলমান তা লুফে নিয়েছে। অথচ মাত্র দশ বছরে গড়া ইসলামি রাষ্ট্রের এবং খেলাফত প্রধানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ভোগ নয়, ত্যাগ; ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে একজন মুসলিম তার দুনিয়া আখেরাত প্রতিষ্ঠা করবে। যিনি এই নীতিমালার প্রবর্তক, নিজ জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রনয়ণ করেছিলেন, তিনি হলেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহম্মদ মুস্তবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নিজেকে আমরা উম্মতে মুহাম্মদী দাবী করি সত্য, কিন্তু কিছুতেই তাঁর (সা:) মতো জীবন গড়তে ইচ্ছা পোষণ করি না, মোটেও চেষ্টা করি না। নবীর (সাঃ) চলমান জীবনের কোন কিছু কি আমরা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করেছি, না কি করতে চেষ্টা করি? পড়ে জেনে বুঝে তাবলীগ করে যদি তেমন জীবন গঠন করতে না পারি, তবে কেমন করে আমরা শ্রেষ্ঠত্বের প্রত্যাশা করতে পারি বা অধিকারী হবো? শ্রেষ্ঠ জাতি শ্রেষ্ঠ জাতি বলে চিল্লালে লাভ কি? কর্মে যদি তার লেশমাত্র প্রতিফলন প্রতিপাদন না প্রতিফলিত ও প্রমাণিত হয়??  


"হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সাঃ)-এর নিকট প্রবেশ করলাম। তিনি তখন খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর শোয়া ছিলেন, আমি বসে পড়লাম। তাঁর পরিধানে ছিলো একটি লুঙ্গি; ছাড়া আর কোন বস্ত্র তাঁর পরিধানে ছিলো না। তাঁর পাঁজরে চাটাইয়ের দাগ বসে গিয়েছিলো। আমি দেখলাম যে, তাঁর ঘরের এক কোণে ছিলো প্রায় এক ছা গম, বাবলা গাছের কিছু পাতা এবং ঝুলন্ত একটি পানির মশক। অবস্থা দেখে আমার দুচোখে অশ্রু প্রবাহিত ল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কাঁদছো কেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! আমি কেন কাঁদবো না? এই চাটাই আপনার পাঁজরে দাগ কেটে দিয়েছে, আর এই হচ্ছে আপনার ধনভান্ডার, এতে যা আছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এই কিসরা (পারস্যরাজ) কায়সার (রোম সম্রাট) বিরাট বিরাট উদ্যান ঝর্ণা সমৃদ্ধ অট্টালিকায় বিলাস-ব্যসনে জীবন-যাপন করছে। আর আপনি হলেন ­আল্লাহর নবী এবং তাঁর মনোনীত প্রিয় বান্দা। আর আপনার ধনভান্ডারের অবস্থা এই! তিনি বলেন, হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, আমাদের জন্য রয়েছে আখেরাতের স্থায়ী সুখ-শান্তি এবং ওদের জন্য রয়েছে পার্থিব ভোগ বিলাস? আমি বললাম, হ্যাঁ।" সহীহ মুসলিম ইবনু মাজাহ- উক্ত হাদীসটি সহীহ সনদে বিবৃত হয়েছে। ঠিক একই ধাচের আরেকটি হাদীস আমি পেয়েছি মুসনাদে আহমাদ, হাকেম সহীহাহতে- "ইবনে আববাস (রাঃ) তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা ওমর (রাঃ) রাসুল (সাঃ)-এর নিকট প্রবেশ করলেন। তিনি তখন খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর শোয়া ছিলেন। তাঁর পাঁজরে চাটাইয়ের দাগ বসে গিয়েছিলো। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, হে ­আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! যদি আপনি থেকে রক্ষার জন্য একটি বিছানা বানিয়ে নিতেন। তখন রাসুল (সাঃ) বললেন, ‘আমার ধন-সম্পদ দুনিয়া বা আমার দুনিয়ার উদাহরণ হলো, কোন মুসাফির গরমের দিনে চলতে চলতে কোন বৃক্ষের ছায়াতলে দিনের কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো, তারপর তা ছেড়ে চলে গেল।"


"আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক আনছারী মহিলা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সে দেখতে পায় রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিছানা ভাঁজ করা চোগা (হাতকাটা এক ধরনের জামা) দিয়ে তৈরী। সে তখন বাড়ি গিয়ে তাঁর জন্য পশমভরা একটি তোশক পাঠিয়ে দিল। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন আমার ঘরে এলেন তখন তিনি বিছানা দেখে বললেন, এটা কী? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! অমুক আনছারী মহিলা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সে আপনার বিছানা দেখে বাড়ি গিয়ে এই বিছানা পাঠিয়ে দিয়েছে। তিনি বললেন, এটা ফেরৎ দাও, কিন্তু আমি ফেরৎ দিলাম না; বিছানাটা আমার ঘরে থাকা আমার ভাল লাগছিল। এমনি করে তিনি বেশ কয়েকবার কথাটি আমাকে বললেন। তারপর তিনি বললেন, 'আল্লাহর কসম! হে আয়েশা! আমি চাইলে আল্লাহ তাআলা আমার সঙ্গে সোনা-রূপার পাহাড়কে চলমান করে দিতেন।' তখন আমি সেটি মহিলাটির কাছে ফিরিয়ে দিলাম।" -[শু'আবুল ঈমান : ১৩৯৫; সহীহাহ : ২৪৮৪]


"কা বিন ওযরা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসুল (সাঃ)-এর বাড়িতে এসে দেখলাম তাঁর চেহারার মধ্যে বিবর্ণতা রয়েছে। আমি বললাম, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হউক! আপনার চেহারায় বিষণ্ণতা কেন? তিনি বললেন, তিনদিন যাবত আমার পেটে কিছুই প্রবেশ করেনি যা প্রত্যেক কলিজাওয়ালা পেটের মধ্যে প্রবেশ করে থাকে। আমি সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম। পথে জনৈক ইহুদীকে দেখলাম সে তার উটকে পানি পান করাচ্ছে। আমি প্রতি বালতির বিনিময়ে একটি খেজুর প্রাপ্তির প্রত্যাশায় তার উটগুলোকে পানি পান করালাম। কিছু খেজুর জমা লে সেগুলো নিয়ে রাসুল (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হলাম। রাসুল (সাঃ) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে কা তুমি এগুলো কোথা থেকে পেলে। আমি তাঁকে অবহিত করলাম। তখন নবী করীম (সাঃ) আমাকে বললেন, হে কা তুমি কি আমাকে ভালোবাস? হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! আমার পিতা আপনার জন্য কুরবান হউক! তিনি বললেন, আমাকে যে ভালোবাসে দরিদ্রতা জোয়ারের দিকে ধাবমান বন্যার চেয়ে তার দিকে দ্রুত ছুটে যায়। খুব শিঘ্রই বিপদ-আপদে নিপতিত হবে। অতএব তুমি তার মুকাবিলা করার জন্য শক্তভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ কর। এরপর নবী করীম (সাঃ) কাবকে হারিয়ে ফেললেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কাবের কী হয়েছে? ছাহাবীগণ বললেন, তিনি অসুস্থ। সুতরাং তিনি বের হয়ে পায়ে হেঁটে তাঁর কাছে এসে বললেন, কা! তুমি সুসংবাদ নাও। তাঁর মা তাঁর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, হে কা! তোমার জন্য জান্নাত মোবারক হউক। তা শুনে তিনি বললেন, কে আল্লাহর ব্যাপারে কসম খেয়ে নিশ্চয়তা দিচ্ছে? কা বললেন, উনি আমার মা, হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! তিনি তাঁর মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন, হে কাবের মা! কীভাবে জানলে তুমি সে জান্নাতী? হয়তোবা কা এমন কথাবার্তা বলেছে, যা তার উপকার করে না এবং এমন কিছু দানে বিরত থেকেছে, যা তাকে অভাবমুক্ত করে না।" [তাবরানি আওসাত : ৭১৫৭]


ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর একাধারে কয়েক রাত অভুক্ত অবস্থায় কেটে যেত এবং তাঁর পরিবারের লোকেদেরও রাতের আহার জুটতো না। অধিকাংশ সময় তাদের রুটি হতো যবের তৈরী। -[তিরমিজি:২৩৬০; ইবনু মাজাহ:৩৩৪৭] অন্যত্র এসেছে "আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রাসুল (সাঃ) দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন, তখন আমার পাত্রে সামান্য কিছু যব ব্যতীত কোন কলিজাধারী (প্রাণী) খেতে পারে এমন কিছুই আমার তাকে ছিল না; আমি তা থেকেই খেতাম। এভাবে অনেক দিন চলে গেলে আমি একবার তা মেপে নিলাম; ফলে তা শেষ হয়ে গেল।" -[বুখারী:৬৪৫১; মুসলিম:২৯৭৩; মিসকাত:৫২৫৩]


মূল্যহীন এই দুনিয়ার এই মুসাফিরখানায় রাসুলপাক (সাঃ) যে খুব সাধারণ জীবন-যাপন করে গেছেন তাতে কারোরই কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু নিজ জীবনটাকে আমরা কেউ সে ভাবে সাজাতে চাই না বা অভ্যস্ত নই; নিজকে অতি সাধারণ করায় আজকের মুসলমানের সে কি অতুষ্টি, সে কি কষ্টআমাদের নবী (সাঃতো কখনো দুনিয়ার কোন কিছু প্রাপ্তির জন্য কষ্ট প্রকাশ করেন নি, বরং তিনি স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় যা পেয়েছেন তা নিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছেন এবং আল্লাহর প্রশংসায় সদা ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। ক্ষুধায় কাতর হয়েছেন, এমনকি পেটে পাথর বেঁধেছেন; ক্ষুধায় রাসুলপাক (সাঃ)-এর চেহারা বিমর্ষ হয়ে গেছে, কখনোবা খাবারের সন্ধানে মানুষের বাড়িতে গমন করেছেন, কিন্তু রাব্বুল আলামিনের কাছে কখনো নিজের ভোগ বিলাসিতার জন্য কখনো কোন ফরিয়াদ করেননি, করেছেন উম্মতের জন্য। রাসুলপাক (সাঃ)-এর বিছানা ছিল খেজুর পাতার; পবিত্র দেহে খেজুর পাতার দাগ পড়ে থাকত; বিছানায় কোন গদি ছিল না, ছিল না কোন ভালো বালিশ। এভাবেই বছরের পর বছর অতিবাহিত করে গেছেন। বাড়িতে মাসের পর মাস চুলা জ্বলতো না; কেবল নিম্ন মানের একটি খেজুর পানি পান করেই কাটিয়ে দিতেন দিনের পর দিন। কেন? কেবল পরকালের শান্তির জন্য উম্মতের মুক্তির জন্য। আজ যারা আমরা তাঁর (সাঃ) উম্মতের দাবীদার তাদের অবস্থা কি? রাসুলপাক (সা:)-এর আদর্শের পরিপন্থী নয় কি?? 


রাসুল (সা:) নামে কেউ কটূক্তি করলে ইমোশনালী তাকে মারতে ধরতে এমন কি নিজ জীবন দিতে আমরা চলে যাই, কিন্তু রাসুলপাক (সা:)-এর মতো জীবন গড়তে চাই না কেউ; রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর জীবনের আদর্শ অনুসরণ আমাদের কার মাঝে কতটা কি আছে? মোটেও নেই। লম্মা জুব্বা, লম্বা দাড়ি, লম্বা টুপি পাগড়ি লাগিয়ে যখন আমরা নামাজ-রোজা-হজ্জ-যাকাত-এর মতো ইসলামের মৌলিক এবাদত--বন্দেগীগুলোকেও ব্যবসায়ীক হাতিয়ার এবং উন্নত জীবনযাপনের অবলম্বন বিবেচনা করি, বদ পুঁজি বানাই, অর্থমোহে আবদ্ধ হয়ে ইসলামের বারোটা বাজাই, তখন মুসলমানের তেরোটা বাজবে না তো কি হবে? ওয়াজের ময়দানে ঝড় তুলছি পেটের তিন ভাগের এক ভাগ খাবার দ্বারা পূর্ণ করার হাদীস বলে, মঞ্চ থেকে নেমে সেই আমিই ভোজন করছি পেট ভরে, গলা পর্যন্ত! কি কপটচারীতা নয়? নিজের স্বার্থে অন্যের অন্ন কেড়ে নিতে, রক্ত ঝরাতে আমরা এতোটুকুও দ্বিধাবোধ করিনা, করছি না। তাহলে আমরা কেমন আশেকে রাসুল (সা:) হলাম? কার আদর্শ অনুসরণ করছি আমরা?? নাকি আমাদের ধর্মীয় কাজগুলো শুধুই দুনিয়াবী স্বার্থে পালিত??? যে রাসুলপাক (সাঃ) অর্থাভাবে অনাহারে দিন কাটালেন, সে রাসুলপাক (সাঃ)-এর উম্মত হয়ে জীবিকা অন্বেষণের অযুহাত দিয়ে মিথ্যা বলতে, প্রতারণা করতে, লোক ঠকাতে, ঘুষ আদন-প্রদান করতে, পরের হক নষ্ট করতে আমাদের অন্তরে একটুও বাঁধে না; অথচ নিজেদের আমরা তাকওয়াধারী তাকওয়াশীল বলে পরিচয় দিতে খুবই স্বাছন্দ্যবোধ করি; নিজের এবাদত-আমলের তুলনায় সিদ্দীকে আকবর (রাঃ)-এর এবাদত-আমলকেও কম মনে করি (নাউযুবিল্লাহ)! মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে কপটচারীতায় মেতে উঠি। 


লাগামহীন অনিয়ন্ত্রিত জিহ্বার ব্যবহার যে আমাদের জীবনে ব্যাপক বিপর্যয় ডেকে আনবে ব্যাপারে আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী হুজুরপাক (সাঃ) সারে চৌদ্দশ বছর আগেই বলে গিয়েছেন, এবং মুখের ব্যবহারে আমাদের চরমভাবে সতর্ক থাকতে বলেছেন। "সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ আস-সাকাফি (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! আমাকে এমন একটি কথা বলুন, যা আমি ধারণ করতে পারি। তিনি বললেন, তুমি বলো, আল্লাহই আমার রব! তারপর এতে অটল থাকো। তিনি (বর্ণনাকারী) বলেন, আমি আবার বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! আপনার দৃষ্টিতে আমার জন্য সর্বাধিক আশঙ্কাজনক বস্তু কোনটি? তিনি স্বীয় জিহ্বা ধরে বলেন, এই যে এটি! -[তিরমিজি : ২৪১০] অন্য এক হাদীসে এসেছে, "মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের ব্যাপারে আমি যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই, তা হলো শিরকে আসগর (ছোট শিরক) সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! শিরকে আসগর কী? তিনি বললেন, রিয়া বা লোক দেখানো আমল। কেয়ামতের দিন যখন মানুষকে তাদের কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে, তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, তোমরা যাদের দেখাতে তাদের কাছে যাও, দেখো তাদের কাছে তোমাদের পুরস্কার পাও কি না!’’ -[মুসনদে আহমদ : /৪২৮-৪২৯; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ : /১০২] হাদীসদ্বয়ের সবচেয়ে বেশি যারা বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছে তারা এদেশের এক শ্রেণির তথাকথিত আলেম। নিজেকে ভাইরাল করে বিখ্যাত করার দুরভিসন্ধি নিয়ে ওয়াজের মঞ্চে তারা এমন সব বক্তব্য দিচ্ছেন, যা ইসলাম ঈমানের পুরোপুরি পরিপন্থী।


"রাসুলপাক (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের নিয়ে দারিদ্র্যের ভয় করি না। কিন্তু আশঙ্কা করি যে তোমাদের উপর দুনিয়া এমন প্রসারিত হয়ে পড়বে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর প্রসারিত হয়েছিল। আর তোমরাও দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে, যেমন তারা আকৃষ্ট হয়েছিল। আর তা তোমাদের বিনাশ করবে, যেমন তাদের বিনাশ করেছে। -[সহিহ বুখারি : ৩১৫৮] গোপন শিরক বা শিরকে খপি- ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) আগেই বলে গেছেন; যা হচ্ছে আজ মসজিদে মসজিদে, এমন কি রোজা, হজ্জ, যাকাতের মতো প্রতিটি এবাদত থেকেও দুনিয়াবি ফায়দা হাসিল করছে এক শ্রেণির তথাকথিত; অন্যে নামাজি, রোজাদার, হাজি, যাকাতি বলবে/ভাববে, দান করবে - যাতে তার দানশীলতা নিয়ে আলোচনা হয়; অর্থাৎ   লোক দেখানো সব কিছুই করছে। 


"আবু সাইদ খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আমাদের নিকট রাসুল (সাঃ) বের হলেন, আমরা তখন দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তিনি (সাঃ) বলেন, আমি কি তোমাদের এমন বিষয় অবহিত করব না, যা আমার মতে তোমাদের জন্য দাজ্জালের চেয়েও ভয়ংকর? বর্ণনাকারী বলেন, আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই। তিনি বলেন, গোপন শিরক। মানুষ নামাজ পড়তে দাঁড়ায় আর অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সুন্দরভাবে নামাজ পড়ে। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪২০৪) সমকামিতা এমন পাপ যা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত এবং কারণে আল্লাহ তা'আলা পূর্ববর্তী উম্মতের ওপর আজাব-গজব নাজিল করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী উম্মতের ব্যাপারেও এই ভয়াবহ অপরাধের আশঙ্কা প্রকাশ করে গেছেন। রাসুলপাক (সাঃ) বলেছেন, আমি যে কুকর্মটি আমার উম্মতের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সর্বাধিক ভয় করি তা হলো লুত সম্প্রদায়ের কুকর্ম। (জামে তিরমিজি : ১৪৫৭) রাসুলপসক (সাঃ) বলেছেন, এই উম্মাতের জন্য যাকে আমি সবচেয়ে ভয়ংকর বিপজ্জনক মনে করি এবং সবচেয়ে ভয় করি, সে হচ্ছে অতিশয় বাকপটু মুনাফিক। -[মুসনাদে আহমদ : ৩১০] - হাদীসগুলোর কোন কাজ থেকে আজকের মুসলমান বিরত?


জ্বীন শয়তান মানুষের প্রধান শত্রু, কিন্তু আজকের দিনে ইনসান শয়তান জ্বীন-ভূত শয়তানের স্থান দখল করে নিয়েছে। লোভ মানুষের এক স্বভাবজাত প্রবৃদ্ধি  স্বভাব-চরিত্রের অন্যান্য মন্দ বিষয়ের মতো লোভকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হয়; নিয়ন্ত্রণহীন লোভ পরিণতিতে ধ্বংস ডেকে আনে। লোভ যে কতটা ভয়াবহ পরিণতির মুখে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিতে পারে এর নজির তো আমরা প্রতিদিনই আশেপাশে দেখতে পাই; লোভ-লালসা মানুষের অন্তরে এক মারাত্মক ব্যাধি। সীমাহীন লোভ-লালসা মানুষকে তার সামর্থ্যকে বাহিরে ঠেলে দেয়; বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনার লোপ ঘটায়, দুর্নীতি পাপের পথে পরিচালিত করে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জবরদখল, ঘুষ-দুর্নীতি, মারামারি, হানাহানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, অপহরণ, গুম, খুন-খারাবিসহ সকল সামাজিক অনাচার এবং সকল বিপর্যয়ের পেছনে লোভ-লালসার বিরাট প্রভাব রয়েছে। তাই তো রাসুলুল্লাহ (সাঃ) লোভ-লালসাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেছেন, 'তোমরা লোভ-লালসা থেকে বেঁচে থাকো, কেননা জিনিসই তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করেছে এবং পরস্পরকে রক্তপাত ঘটানোর ব্যাপারে উসকিয়ে দিয়েছে। লোভ-লালসার কারণেই তারা হারামকে হালাল সাব্যস্ত করেছে।' -[মুসলিম]


হুজুরপাক (সাঃ) বলেছেন, ‘যদি কোনো মানুষের এক উপত্যকা ভরা স্বর্ণ থাকে, তবে সে তার জন্য দুটি উপত্যকা (ভর্তি স্বর্ণ) হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করে। তার মুখ মাটি ছাড়া (মৃত্যু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত) আর কিছুতেই ভরে না। আর যে ব্যক্তি তওবা করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন।' -[সহিহ বোখারি] এই দুনিয়ায় লোভ-লালসা, মোহ-মায়া, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা সবই বৃথা, সবই মরীচিকা। ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন সম্পদ ভোগ করবে; কিন্তু পাপের বোঝা বহন করতে হবে শুধু নিজেকেই। তাই সময় থাকতেই সৃষ্টিকর্তার রঙে নিজেকে রাঙিয়ে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করতে পারলেই লোভ-লালসা এবং যাবতীয় মন্দকাজ বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের অবশ্যই সব সময় স্মরণ রাখা উচিত- 'লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।।


মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 

২৯ জুলাই, '২৩.

২টি মন্তব্য: