বুধবার, ২৬ জুলাই, ২০২৩

ইয়া মাওলা! কেমনে কি?




সাধারণভাবে ধর্ম-জ্ঞানীদের আমরা আলেম বলি; আলেম শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো- জ্ঞানী। শরিয়তের পরিভাষায় আলেম বলা হয়- যিনি দ্বীন শরিয়তের গভীর জ্ঞান রাখেন বা ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী হন, এবং যিনি তাঁর জ্ঞান অনুযায়ী যথাযথ আমল করেন, পাশাপাশি সুন্নতের অনুসরণে নিজের জীবন পরিচালিত করেন, এবং আল্লাহর ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত থাকেন। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় বর্তমান যুগে বেশিরভাগ আলেমের মাঝে তাকওয়া বা পরহেজগারি একেবারেই দেখা যায় না বা নেই বললেই চলে; দুনিয়াবি সম্পদ হাসিল করাই যেন ধর্মজ্ঞানের অনন্য উদ্দেশ্য। আল্লাহ ভীতির ন্যূনতম লক্ষণও কারো কারো মাঝে মোটেও পরিলক্ষিত হয় না; নামাজে ইমামতী করতেও কত ছলাকলা! ইসলামের প্রতিটি রোকনকে তারা বানিজ্যিক উপকরণ বানিয়েছে। নামের আগে বাহারী টাইটেল লাগিয়ে ভাইরাল হওয়ার ইঁদুর দৌঁড়ে যেন সবাই মেতে উঠেছে; 'সব দুনিয়াবি আলেমের সংখ্যা বর্তমানে এতোটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, যা বলা বাহুল্য। তাই তো আজ মুসলিম সমাজ থেকে ন্যায়-অন্যায়ের ন্যূনতম অনুশীলনও উবে গেছে; মৌলিক শিক্ষার গুরুরা যখন অনাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছে, তখন আর সে সমাজে কে শোনে কার কথা


তথাকথিত 'সব মোল্লা-মওলুবিদের নামের আগে সে কি যে বিশেষণের বাহার! এমন কি 'মাওলানা' 'আল্লামা', আরও কত কি যে তারা তাদের নামের আগে লাগিয়ে দিয়েছেন, বলা মুশকিল! 'সব শব্দের ব্যবহার কতটা যৌক্তিক? 'সব কি সৃষ্টিকর্তার সাথে শরিকী বা শিরক করার নামান্তর নয়? 'হুজুরপাক' (সা:)-এর 'হুজুর' বিশেষণটিও তো অনেক আগেই চুরি হয়ে গেছে! কি কুফরীর নামান্তর নয়? যতটা স্মরণ করতে পারছি- কিছুদিন আগেও 'সবের ব্যবহার এতোটা ব্যাপক বা রমরমা ছিল না, আগের দিনে তো মোটেও 'সব কেউ ব্যবহার করতেন না। সম্ভবত দেইল্যা রাজাকারের ক্ষেত্রেই 'দেশে প্রথম 'মাওলানা' ট্যাগ লেগেছিল; সে নিজে তা লাগিয়েছিলেন বা তার দলের লোকেরা। নামের আগে মাওলানা লাগিয়ে আশির দশকে তিনি 'মাওলানা সাইদী' সেজেছিলেন বা হয়েছিলেন, ধাপেধাপে আরও উপরে উঠে এক সময় তিনি হয়ে যান 'আল্লামা সাইদী'! সেই থেকে একে একে দেশের আরও বহুত নামীদামী তথাকথিত মোল্লা-মৌলোভী 'মাওলানা' থেকে 'আল্লামা' হয়েছেন, সেজেছেন আরও কত কি! 'হুজুরপাক' সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে 'জনাবে রাসুলুল্লাহ' বানিয়ে নিজের নামের আগে লাগিয়েছেন 'হুজুর' খেতাব! আর 'সব মোল্লা-মওলুবির কূটচাল না বুঝে অশিক্ষিতরা বা সাধারণ অন্যধারার শিক্ষায় শিক্ষিতরা আস্তে আস্তে এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন; যা আজ সামাজিক স্বীকৃত বহুল প্রচলিত বিশেষণে রূপ নিয়েছে! কিন্তু কেমনে কি??


'মাওলা' একটি খাস আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ- 'প্রতিপালক', এবং যা দিয়ে খোদ সৃষ্টিকর্তাকে বোঝানো হয়; আর এই সূত্রে 'মাওলানা' শব্দটির অর্থ দাঁড়ায়- 'আমাদের প্রতিপালক' "------রাব্বানা-ওয়ালা তুহাম্মিলনা-মা-লা-তা-কাতা লানা-বিহী ওয়াফুআন্না-ওয়াগফিরলানা-ওয়ারহামনা-আনতা মাওলা-না-ফানসুরনা-‘আলাল কাওমিল কা-ফিরীন।" -আল-কুরআনের দ্বিতীয় সূরা আল-বাক্বারা শেষের আয়াতেমাওলানাশব্দটি স্পষ্টত ব্যবহৃত হয়েছে, যে আয়াতটি প্রায়শই দু-মুনাজাতে আমরা পাঠ করে থাকি। আল্লাহ সুবহানাহু আয়াতে আমাদের শিখিয়েছে,  'আন্তা মাওলানা ফানসুরনাআলাল কাওমিল কাফিরিন।' অর্থাৎ 'আপনিই আমাদের প্রভু! সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।' কেউ কেউ এই আয়াতটি ব্যবহার করে বোঝাতে চান, যে শব্দটি আল্লাহ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, তা মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা মানে হলো- তাকে আল্লাহ পর্যায়ে উত্তীর্ণ করে ফেলা (নাউযুবিল্লাহ!) 


'মাওলানা' টাইটেলটি বিশেষত মধ্য-এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে; কারণ, মাদ্রাসা কিংবা দারুল উলুম থেকে স্নাতক পাশ করা কিংবা কোনো ধর্মীয় পন্ডিতের ছত্রছায়ায় পান্ডিত্য অর্জনকারী সম্মানিত ধর্মীয় মুসলিম নেতাকে ব্রিটিশ আমল থেকেমাওলানাবলে উপাধি দেয়ার প্রচলন শুরু হয়। যদিও 'মাওলানা' শব্দটির একাধিক- নিদেনপক্ষে ১৬টি আলাদা অর্থ রয়েছে; প্রয়োগের উপর নির্ভর করে একটি শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে। তাই সেই সুযোগের ব্যবহার করেই ব্রিটিশ শাসনামলে আমাদের উপমহাদেশের আলেমদের নামের আগে ট্যাগ লাগানো হয়, অপরদিকে সাধারণ ধর্মীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে টাইটেল হিসেবেমৌলভীশব্দটিও ব্যবহৃত  হয়, যা বাংলাদেশের সরকারীআলিয়া মাদ্রাসা নিয়মে তাদেরকেমৌলভীবলা হয়যারামৌলভী’ (basic), ‘মৌলভী আলিম’ (intermediate) অথবামৌলভী ফাজিল’ (advanced)


পবিত্র কুর'আনুল কারীমের অসংখ্য আয়াতে এবং সহীহ হাদিসে 'মাওলানা' শব্দটির ব্যবহার অসংখ্যবার আমার চোখে পড়েছে; নিয়ে নানান জনের নানান মত থাকলেও তাফসীরের কিতাব ঘেঁটে আামার কাছে যা স্পষ্ট সঠিক মনে হয়েছে তা হলোমহান প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত-এর শা'নে যে শব্দের ব্যবহার, সাধারণের বিশেষণ হিসেবে তা ব্যবহার না করাই শ্রেয়, বরং মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় বর্তমান মুসলিম বিশ্বে, বিশেষ করে এই উপমহাদেশে 'সবের বাড়াবাড়ি এতো বেশি, যা বলা বাহুল্য। কেমন করে যেন সদুরুদ্দিন/বদুরুদ্দিনের নামের আগেও মাওলানা বা আল্লামা বিশেষণ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, হচ্ছে! 'সব কি অজ্ঞতা নয়?


অন্যদিকে সুরা বাকারাহ- ১০৪ নাম্বার আয়াতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে- রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর বিশেষণ যেন বিশেষ বা খাস হয়। 'ইয়া আইয়ুহাল্লাযীনা -মানূ লা-তাকূলূরা-‘ইনা- ওয়া কূলুনজু রনা- ওয়াছমা ওয়া লিলকা-ফিরীনাআযা-বুন আলীম।' অর্থাৎ- 'হে মু'মিনগণ, তোমরারায়িনাবলো না-‘উনযুরনাবল এবং শুনতে থাক; আর কাফেরদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।' আগেকার দিনের তাফসীর থেকে জানতে পেড়েছি- মদীনায় বসবাসকারী ইয়াহুদীদের একটি দল ছিল অতিশয় দুষ্ট, তারা যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসতো, তখন তাঁকে (সা:) লক্ষ্য করে দীর্ঘ স্বরে বলতো ' ইয়া রাইনা'; স্বাভাবিকভাবে বললে বা পড়লে  'রাইনা' শব্দের অর্থ- 'হে সম্মানিত! আমাদের প্রতি লক্ষ্য রাখুন' হিসেবে শব্দটিতে এমনিতে দোষের কিছু নেই, এর মধ্যে বেআদবীরও কিছু নেই। কিন্তু ইয়াহুদীদের ধর্মীয় ভাষা হিব্রুতে এরই কাছাকাছি একটি শব্দ অভিশাপ গালি অর্থে ব্যবহৃত হতো, তাছাড়া শব্দটিকেই যদি ع এর দীর্ঘ উচ্চারণে পড়া হয়, তবে راعينا হয়ে যায়, যার অর্থ দাঁড়ায় 'আমাদের রাখাল' মোটের উপর কথা হলো- ইয়াহুদীদের আসল উদ্দেশ্য ছিল শব্দটিকে মন্দ অর্থে ব্যবহার করা। কিন্তু আরবীতে যেহেতু বাহ্যিকভাবে শব্দটিতে কোনও দোষ ছিল না, তাই কতিপয় সরলপ্রাণ মুসলিমও শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করে দেয়। এতে ইয়াহুদীরা বড় খুশী হতো এবং ভেতরে ভেতরে মুসলিমদের নিয়ে মজা করতো। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার তা পছন্দ হয়নি। তাই আয়াতে মুসলিমদেরকে তাদের দুষ্কর্ম সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে তাদেরকে 'রাইনা' শব্দ ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর শা'নে 'উনযূরনা' বলার জন্য মু'মিনদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমন কি মু'মিনদের শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে যে, সাধারণকে প্রয়োগ করা বিশেষণ বা যে শব্দের ভেতর কোনও মন্দ অর্থের অবকাশ থাকে বা যা দ্বারা ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা থাকে, সে রকম কোন শব্দ রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর শা'নে ব্যবহার করা সমীচীন নয়।


কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজ কারো কারো কাছে হয়ে গেছেন 'জনাবে রাসুলুল্লাহ', আর তারা নিজেরা সেজেছেন 'হুজুর'! তাছাড়া আজকাল হরহামেশা এমন কিছু শব্দ আলেম-ওলামারা ব্যবহার করছেন, যা নিতান্তই মূর্খতা। এমনকি নামের আগে তারা এমন কিছু বিশেষ বিশেষণ ব্যবহার করছেন, যা প্রকৃতপক্ষে শিরক কুফরের পর্যায়ে পড়ে; যা ঈমান ধ্বংসকারী হটকারিতায় নামান্তর। লেখাপড়া গবেষণা না করে বা 'ইকরা' বা 'পড়া' বাদ দিয়ে মুসলমান আজকাল লেখক হচ্ছে, বক্তা সাজছে, তথাকথিত আলেমের খাতায় নাম লেখাচ্ছে; 'সব তো কেয়ামতের আলামত ছাড়া অন্য কিছুই নয়। অজ্ঞতা আমাদের একেবারে গ্রাস করে ফেলেছে; দিনে দিনে আজ আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি, একবারও কি ভেবে দেখেছি? আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার ভাষায় আমরা নাকি 'কুন্তুম খাইরা উম্মত'; কেমনে কি??


'ইকরা' ছাড়া কোন জাতিই পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি, আর পারবেও না। মুসলমানকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই তাদেরকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে; ধর্মশিক্ষা আর বিজ্ঞান শিক্ষাকে কোনভাবেই আলাদা করা যাবে না।।   


মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 

২৬ জুলাই '২৩.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন