মঙ্গলবার, ৮ আগস্ট, ২০২৩

অনুগ্রহ ও নিয়ামত প্রাপ্তদের পথ:

অনুগ্রহ ও নিয়ামত প্রাপ্তদের পথ:

অনৈতিকতায় নিমজ্জিত হওয়া একটি জাতিগোষ্ঠীকেও সভ্যভব্য করে গড়ে তুলতে খুব বেশি একটা সময় লাগে না, যদি সাথে থাকে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার খাস রহমত; আর ব্যক্তির মাঝে যদি থাকে ত্যাগের মহিমা সততা একাগ্রতা একনিষ্ঠতা। তবে, ব্যক্তির মাঝে অবশ্যই থাকতে হবে আল্লাহর উপর একান্ত বিশ্বাস এবং পূর্ণ ঈমান। তৎকালীন আরবের বর্বর জাহেলদের জাহিলিয়াতের যূগের নাগপাশ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে সেই মানুষগুলোকেই মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র তেইশ বছর সময়কালে এমন এক সভ্যভদ্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল; সর্বকালের অনন্য অবিস্মরণীয় বিষ্ময়ের এক উদাহরণ। নবুওয়াত প্রাপ্তির পর খুব বেশি একটা সময় লাগেনি মাত্র তেইশ বছরেই ইসলামের আলো সারাবিশ্বের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। সবেমাত্র কয়েকজন মানুষ, যাঁরা উঠে এসেছেন বর্বর জাহেলদের সেই সমাজ থেকেই; অনন্য সেই মানুষগুলোই স্বীকৃতি পেয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মহৎ সৎ ভদ্র সভ্য সেরা মানুষ হিসেবে; জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র সর্বশ্রেণীর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ বিখ্যাত মানুষ হিসেবে তাঁরাই স্বীকৃতি পেয়েছেন, এবং সেই তাঁরাই উন্মেষ ঘটিয়েছেন একটি অসাধারণ অদ্বিতীয় জাতির। হুজুরপাক (সা:) এবং খোলাফায়ে রাশেদা (রা:)-গণে শাসনামলেই মূলতঃ ইসলামের আলো দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, আলোকিত পৃথিবী গড়ে উঠেছিল; যে সমাজের প্রতিটি মানুষ ছিল নিশ্চিন্ত নিরাপদ, এমনকি প্রতিটি প্রাণীও।  

বিশাল শক্তির অধিকারী প্রতাপশালী পারস্য রোমান সাম্রাজ্যের কিসরা কায়সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে খুব অল্পসংখ্যক মানুষই দেশের পর দেশ জয় করেছিলেন; আর তাঁদের প্রাণখোলা অকৃত্রিম ভালোবাসা মায়া-মমতা সততা সহানুভূতি সৌহার্দ্যতা ভ্রাতৃত্ব দিয়ে জয় করেছিলেন বিশ্বের সকল সাধারণ মানুষের হৃদয়। সময়টায় মুসলমানদের জয়যাত্রা শুধু দেশ জয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সমান তালে তাঁরা সামনে এগিয়ে গেছেন, ব্যাতিব্যস্ত ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায়; দিনে যুদ্ধের সাথে সাথে দুনিয়াবি কাজে যেমন ব্যস্ত সময় কাটাতেন, তেমনই রাত জাগতেন আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার একান্ত দীদারে এবং অধ্যয়নে। জ্ঞান চর্চা বাদ দিয়ে সেই তাঁদের উত্তরসূরী দাবীদার আমরা, আজকের মুসলমান ইসলামের মূল লক্ষ্য থেকে যোজন-যোজন দূরে সরে গিয়ে মেতে উঠেছি দলবাজিতায়, গা ভাসিয়েছি গড্ডালিকা প্রবাহে। দুনিয়া লাভের মোহগ্রস্ততা আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে; ভোগ-বিলাস আর প্রাচুর্য আমাদের কাছে মূখ্য বিষয় হয়ে গেছে; পাপপুণ্য বিচার করার কারো যেন কোন ফুসরত নেই। অনৈতিকতার অতল গহব্বরে ডুবে গেছি; ব্যক্তিস্বার্থে নিজেদের মধ্যে দলাদলি আর একে অন্যের বিরুদ্ধে কাঁদা ছোঁড়াছুড়িই যেন বর্তমান মুসলিমের একমাত্র ঈমানী কর্ম, সামাজিক দায়িত্ব


খারিজী, রাফেজী, শিয়া, সুন্নী, নাজদী ওহাবী, আহলে হাদীস, আহলে কুর'আন আরও কত কি, মুসলিমের মাঝে শতদা বিভক্তি; অবশ্য প্রত্যেক দলই তার নিজ নিজ মতবাদ অবস্থান নিয়ে তুষ্ট। অথচ পবিত্র কুর'আনুল কারীম কি বলেছে, তা একটি বারের জন্যও কেউ চোখ মেলে দেখি না। প্রতিনিয়ত নামাজে তিলাওয়াত করছি যা- 'ইহদিনাস সিরা-ত্বাল মুছতাকীম; সিরা-ত্বালল্লাযীনা আনআমতাআলাইহিম; গাইরিল মাগদূ বিআলাইহিম ওয়ালাদ্দাল্লীন।'- এর আভ্যন্তরীণ বিষয় একটিবারের জন্যও ভেবে দেখি না, পথের সন্ধান তো বহু দূর।  আমি ভেবে দেখেছি অনেকের মাঝেই সঠিক পথের সন্ধান পাওয়ার অদম্য ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা আছে, কিন্তু  নানা পথ নানা মতের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে তারাও দ্বিধাবিভক্ত তিক্ত অতিষ্ঠ হয়ে নিরাশ হয়ে পড়ে; তারপরও কিছু মানুষ হাল ছাড়ে না। সেই মানুষগুলো এক সময় সত্য সুন্দর এবং সঠিক পথের দিশা ঠিকই খুঁজে পায়। 


ইসলাম, ঈমান এবং মুসলিমের সংজ্ঞা আসলে বেশ পরিব্যাপ্ত; সংক্ষিপ্তসারে- 'ইসলাম' হলো শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার কাছে আত্মসমর্পণ করা। 'ঈমান' হলো- বিশ্বাস করা, স্বীকার করা আস্থা স্থাপন করা; শরিয়তের পরিভাষায়- মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহম্মদ মুস্তবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার পক্ষ থেকে দ্বীন হিসেবে অপরিহার্য যেসব বিষয় নিয়ে এসেছেন সেগুলোকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করা এবং মেনে নেয়ার সাথে সাথে দৃঢ়বিশ্বাস প্রত্যয় ব্যক্ত করা, যা আনার ফলে ঈমানদার ব্যক্তি চিরকালের জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তি পায় এবং পাবে; দুনিয়া আখেরাতে। 'মুসলমান' হলো স্ব ইচ্ছায় আত্মসমর্পণকারী; যিনি আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার কাছে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ আত্মসমর্পণ করেন, তিনিই প্রকৃত মুসলিম। পবিত্র কুর'আনুল কারীম হলো মুসলিমের কোড অব লাইফ; কেমন করে আত্মসমর্পণ করতে হবে, কি করতে হবে না করতে হবে, কাঁদের অনুসরণ করতে হবে, সকল কিছুর নির্দেশিকা। কোড অব লাইফে এমন কিছু কমান্ড বা আদেশ  আছে যা অনুসরণ না করলে কোনভাবেই একজন মুসলিম কখনোই মু'মিন হতে পারবে না; পথের দিশা বা সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ খুঁজে পাওয়া তো বহু দূর 


পবিত্র কুর'আনুল কারীমায় মু'মিনের জন্য বেশ কিছু বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন মহান রব, তার অন্যতম একটি আদেশ আছে সুরা আত তওবা'য়; আত তওবাহ একটি বিশেষ অতি গুরুত্বপূর্ণ সুরা, বিশেষ করে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ খুঁজে পেতে এই সুরা পর্যবেক্ষণ অতি জরুরি। সুরার অনন্য একটি আয়াত হলো ১০০; যাতে আছে, "وَالسّٰبِقُوۡنَ الۡاَوَّلُوۡنَ مِنَ الۡمُہٰجِرِیۡنَ وَالۡاَنۡصَارِ وَالَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡہُمۡ بِاِحۡسَانٍ ۙ رَّضِیَ اللّٰہُ عَنۡہُمۡ وَرَضُوۡا عَنۡہُ وَاَعَدَّ لَہُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ تَحۡتَہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَاۤ اَبَدًا ؕ ذٰلِکَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ" অর্থাৎ- 'মুহাজির আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের অনুসরণ করে, আল্লাহ্ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট, আর তিনি তাদের জন্যে প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে; এটাই মহাসাফল্য।


উক্ত আয়াতে কারীমায় তিন শ্রেণীর লোকের বর্ণনা বিদ্যমান। প্রথমঃ মুহাজির; যাঁরা দ্বীনের খাতিরে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা এবং রাসুলপাক (সা:)-এর আদেশ পালনার্থে মক্কা অন্যান্য এলাকা থেকে হিজরত করতঃ সকল কিছু ত্যাগ করে মদীনায় চলে যান। দ্বিতীয়ঃ আনসার; যাঁরা মদীনার অধিবাসী ছিলেন, সর্বাবস্থায় তাঁরা রাসুলপাক (সাঃ)-এর সাহায্য সুরক্ষা বিধান করেছিলেন; মদীনায় আগত মুহাজিরদের যথাযথ সম্মান করেছিলেন এবং নিজেদের সবকিছু তাঁদের খিদমতে কুরবান করে দিয়েছিলেন। এখানে রাব্বুল ইজ্জত সেই উভয় শ্রেণীর 'আস্-সাবিক্বূনাল আওয়ালূন' (অগ্রবর্তী প্রথম) ব্যক্তিবর্গের কথা বর্ণনা করেছেন; অর্থাৎ এই উভয় শ্রেণীর মধ্যে সকল ব্যক্তি যাঁরা সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। ওঁনারা কারা ছিলেন তা নির্ধারণ করণে যদিও মতবিরোধ রয়েছে, তবে বেশিরভাগ ইসলামী স্কলারদের অভিমত, 'আস্-সাবিক্বূনাল আওয়ালূন' তাঁরা, যাঁরা উভয় ক্বিবলার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেছেন; অর্থাৎ ক্বিবলা পরিবর্তন হওয়ার পূর্বে যে সমস্ত মুহাজির আনসার মুসলমান হয়েছিলেন। আবার কারো কারো মতে 'আস্-সাবিক্বূনাল আওয়ালূন' সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম, যাঁরা হুদাইবিয়ায় অনুষ্ঠিত বাইআতে-রিযওয়ানে অংশগ্রহণ করেছিলেন বা তার আগে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আবার অনেকের মতে ওঁরা হলেন তাঁরা, যাঁরা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইমাম শওকানী (:) বলেন, সকল অভিমতই সঠিক হতে পারে। তৃতীয়ঃ- সকল ব্যক্তি, যাঁরা একনিষ্ঠভাবে সেই মুহাজির আনসারদের অনুগামী ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তাঁরা হলেন পারিভাষিক অর্থে তাবেয়ীগণ, যাঁরা নবী (সা:)-এর দর্শন লাভ করতে পারেননি, কিন্তু সাহাবায়ে কিরামগণের সাথী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। আবার কেউ কেউ তা সাধারণ রেখেছেন; অর্থাৎ কাল-কিয়ামত পর্যন্ত যে সকল মুসলিম মুহাজির আনসারদের অনুসরণ করবে, তাঁদের  সাথে মহব্বত রাখবে, এবং তাঁদের আদর্শের উপর অটল থাকবে, তাঁরা সবায় এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। 


'আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট' বাক্যটির অর্থ হলো- আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা তাঁদের সকল সৎকর্ম গ্রহণ করেছেন, মানুষ হিসাবে তাঁদের কৃত ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন, এবং তিনি তাঁদের উপর অসন্তুষ্ট নন; যদি তা না হতো তাহলে উক্ত আয়াতে তাঁদের জন্য জান্নাত জান্নাতের নিয়ামতের সুসংবাদ দেওয়া হতো না। এই আয়াত দ্বারা এটা সুস্পষ্ট জানা যায় যে, আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার এই সন্তুষ্টি সাময়িক ক্ষণস্থায়ী নয়, বরং চিরস্থায়ী। যদি রাসুলপাক (সা:)-এর ওফাতের পর সাহাবায়ে কিরামগণের মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকতো (যেমন এক বাতিল ফির্কার বিশ্বাস) তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা তাঁদেরকে কোনভাবেই জান্নাতের সুসংবাদ দিতেন না। থেকে কথাটি স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, যখন আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা তাঁদের সমস্ত ত্রুটি মার্জনা করে দিয়েছেন, তখন তাঁদের সমালোচনা করে তাঁদের ভুল-ত্রুটি বর্ণনা করা কোন মুসলিমেরই উচিত না। বস্তুতঃ এটাও জানা গেল যে, তাঁদের প্রতি মহব্বত রাখা এবং তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কারণ। তাঁদের দেখানো পথই সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ; আর তাঁদের প্রতি শত্রুতা বিদ্বেষ ঘৃণা পোষণ করা আল্লাহর সন্তুষ্টি থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ হবে।

 

আবার সুরা নূরের ৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন- "وَعَدَ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَیَسۡتَخۡلِفَنَّہُمۡ فِی الۡاَرۡضِ کَمَا اسۡتَخۡلَفَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ ۪ وَلَیُمَکِّنَنَّ لَہُمۡ دِیۡنَہُمُ الَّذِی ارۡتَضٰی لَہُمۡ وَلَیُبَدِّلَنَّہُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ خَوۡفِہِمۡ اَمۡنًا ؕ یَعۡبُدُوۡنَنِیۡ لَا یُشۡرِکُوۡنَ بِیۡ شَیۡئًا ؕ وَمَنۡ کَفَرَ بَعۡدَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ" অর্থাৎ- 'তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে সৎকর্ম করে আল্লাহ্ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্যে প্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দ্বীনকে, যা তিনি তাদের জন্যে পছন্দ করেছেন, এবং তাদের ভয়ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমারইবাদত করবে, আমার কোন শরীক করবে না, এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী।'


হিজরীতে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার দেয়া উক্ত প্রতিশ্রুতি ঘোষণার সময় যেসব মুহাজির আনসার বর্তমান ছিলেন তাঁদের মধ্য থেকে সিদ্দীকে আকবর হযরত আবু বকর (রা:),  ফারুকে আজম হযরত ওমর (রা:), জিন্নুরাইন হযরত ওসমান গনী (রা:), এবং মুশকিলে কুশা বাব মাদিনাতুল ইলম হযরত আলী মুরতাজা (রা:) যথাক্রমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর খিলাফত এবং দ্বীনকে মজবুত করার তৌফিক লাভ করেন; এই চারজন খলিফা ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং আপাদমস্তক ঈমান আমলের মূর্ত প্রতীক। তাঁরা হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের শিক্ষাগার থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং ইহকালীন পরকালীন সৌভাগ্যের সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হয়ে জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করেছেন; তাঁদের শাসনামল ছিল ন্যায় ইনসাফে পরিপূর্ণ।  তাঁরা রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর কাজগুলোকেই সুসম্পন্ন করেছেন এবং টিকিয়ে রেখেছেন। বাহিরের সকল রকম প্রভাব থেকে তা রক্ষা করেছেন, নিজেদের কর্মশক্তি দ্বারা দ্বীনের প্রকাশকে পূর্ণতা দান করেছেন এবং শরীয়তের জ্ঞান বিস্তারে পূর্ণরূপে সচেষ্ট থেকেছেন। তাঁদের মধ্যে এমন সার্বিক যোগ্যতা ছিল যে, তাঁরা একই সাথে ছিলেন মুজতাহিদ, মুর্শিদে কামেল, ন্যায়বিচারক, যোগ্যতম প্রশাসক এবং যুদ্ধক্ষেত্রের সুদক্ষ সেনাপতি। মোটকথা হলো, ধর্ম রাজনীতির সকল দিক বিভাগে তাঁরা ছিলেন হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যিকার উত্তরসূরী। এটাই হচ্ছে খিলাফতে রাশেদা বা নবুওয়াতের পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত। 


হুজুরপাক (সা:) তৎকালীন পরবর্তী সকল মুসলিমকে এই খেলাফতের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে - 'তোমাদের উপর আমার সুন্নাতের অনুসরণ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণ অত্যাবশ্যক।' আরেক হাদিসে তিনি বলেন, 'আমার পর ত্রিশ বছর খিলাফত ব্যবস্থা সমুন্নত থাকবে, তারপর তা রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হবে।' হাদীসটির বর্ণনাকারী হযরত সাফীনা (রা:) নবী কারীম (সা:)-এর আযাতকৃত দাস; তিনি হাদিসের নিন্মরূপ ব্যাখ্যা করেছেন- হযরত আবু বকর (রা:)-এর খিলাফত দুই বছর, হযরত ওমর (রা:)- খিলাফতকাল দশ বছর, হযরত ওসমান (রা:)-এর বারো বছর এবং হযরত আলী (রা:)-এর ছয় বছর, এভাবে মোট ত্রিশ বছর হিসেব করো।' অনেকের মতে  হযরত হাসান (রা:)-এর ছয় মাস শাসনামল যোগ করলেই খিলাফতকাল মোট ৩০ বছর পূর্ণ হয়। ৪১ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে হযরত হাসান (রা:) মুসলিমের রক্তপাত বন্ধ করার অভিপ্রায়ে মু'আবিয়া (রা:)- সাপেক্ষে নিজে খিলাফত থেকে সরে দাঁড়ান, আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয় ১১ হিজরী সনের রবিউল আউয়াল মাসে; এই হিসেবে হযরত হাসান (রা:)-এর খিলাফতকাল শেষ হওয়ার সাথে সাথে খিলাফতে রাশেদার পবিত্র যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে।             


সহীহ সনদে আরেকটি উত্তম হাদিসে বর্ণিত আছে- "দেশ শাসনের এই বিষয়টি শুরু হয়েছে রহমত নবুওয়াতের ভিত্তিতে, এরপর এটি পরিণত হবে রহমত খিলাফত রীতিতে, এরপর এটি পরিনত হবে জুলুমবাজ রাজতন্ত্রে। এরপর এটি পরিনত হবে স্বৈরাচারী, সীমালঙ্ঘন, বলপ্রয়োগ পৃথিবীতে বিপর্যয় বিশৃংখলা সৃষ্টির মাধ্যমরূপে। তখন তারা রেশমি কাপড় পরিধান, ব্যভিচার মদপান বৈধ করে নিবে। তবুও তারা রিযিকপ্রাপ্ত হবে এবং সাহায্য পাবে। মৃত্যুর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত ঘটার পূর্ব পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকবে।


খিলাফতে রাশেদার ত্রিশ বছর শাসনকাল ছিল হুকুমতে ইলাহিয়ার সত্যিকার রূপ; যখন কিতাব সুন্নাহ অনুসারে সরকার ছিল প্রকৃত গণতান্ত্রিক। এই কল্যাণকর যুগের পরিসমাপ্তির পর ৪১ হিজরীতে সরকারি ক্ষমতা বনী উমাইয়্যাদের হাতে চলে যায়; আমীরে মু'আবিয়া (রা:) ছিলেন যার প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম ক্ষমতাসীন ব্যক্তি। সেই সময় থেকেই খিলাফত ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায় এবং নবুওয়াতের আদর্শের খিলাফত ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়; গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে ব্যক্তি শাসনে রূপ নেয়। এই সময় থেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লক্ষ্যের সামনে ধর্মীয় নীতিমালা বিধি-বিধানকে গৌণ পরোক্ষ মর্যাদা দেয়া হয় এবং নিয়ম-শৃঙ্খলা আদর্শ যাই হউক না কেন সমকালীন সরকারের আনুগত্য ফরজ, জনগণের মধ্যে এই মতবাদ চালু করার চেষ্টা করা হয়।


মূলত: সিরিয়া এলাকা ইতিপূর্বে সাসানীয় বাইজান্টাইন শাসনাধীন ছিল; সেখানকার অধিবাসীরা তাই কাইজার কিসরার শাসন রীতিনীতিতে অভ্যস্ত ছিল। কারণে সিরিয়া কাইজার কিসরার ব্যক্তি শাসন পদ্ধতির কেন্দ্রে পরিনত হয়। দীর্ঘদিন এলাকায় অবস্থান করার প্রেক্ষিতে আমীরে মু'আবিয়া (রা:) কাইজার কিসরার রাজদরবারের মতোই জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন করতে শুরু করেন; তাদের নীতি অনুসরণ করেই তিনি দারোয়ান দেহরক্ষী নিয়োগ করেন। যিয়াদের মতো অত্যাচারী খুনী গভর্ণরকে সব রকমের জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত করে ইসলামী রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় যেন, যে ক্ষেত্রে রাজকীয় দান-দক্ষিণায় কাজ হবে না সেক্ষেত্রে তীক্ষ্ণধার তরবারি মানুষকে অনুগত বানাতে পারে। পরে বাইজান্টাইন কিসরার রীতির অনুসরণে আমীরে মু'আবিয়া (রা:) তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ইয়াযীদের মতো অযোগ্য অবিবেচক ব্যক্তির অভিষেক অনুষ্ঠান করেন; বিদ'আতের  জন্য তিনি তার শাসনের সময়কালে সব রকম অপকৌশল রাজনৈতিক বিচক্ষণতা প্রয়োগ করেন; যেখানে উপহার-উপঢৌকন দান-দক্ষিণায় কাজ হয়নি সেখানে জুলুম-নির্যাতনের পথ বেছে নেয়া হয়েছে। মোটকথা যেখানে যেভাবে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই ইয়াযীদের উত্তরাধিকারিত্বের বাই'আত গ্রহণ করা হয়- যার অর্থ হলো যোগ্যতা থাক বা না থাক এখন শাসন-ক্ষমতা লাভের অধিকারী সেই হবে যে তা শক্তির মাধ্যমে অর্জন করতে পারবে। তাছাড়া এই শাসন ক্ষমতা এমন এক শাহীতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে যেখানে ব্যক্তি স্বার্থের জন্য সব রকমের জুলুম-নির্যাতন বৈধ এবং নিজের কল্যাণের জন্য জাতীয় কোষাগার ব্যক্তিগত অর্থ ভান্ডারে রূপান্তরিত হয়েছে। -(তারীখে ইসলাম থেকে হুবহু তুলে ধরলাম।)


মোটকথা মু'আবিয়া (রা:) যখন ইয়াযীদের উত্তরাধিকারত্বের বাই'আত গ্রহণ আংশিক সমাপ্ত করেন এর সাথে সাথেই আশার শেষ ক্ষীণ রশ্মিটুকুও তিরোহিত হয়ে যায়, এবং ব্যক্তি শাসনের ভিত্তি দৃঢ় সুগম হয়ে যায়। অথচ সেই সময়েও সাহাবায়ে কেরাম (রা:) তাবেয়ী (:)-দের মধ্যে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার মতো অনেক যোগ্য লোক বর্তমান ছিলেন। অবশ্য বনী উমাইয়্যাদের ক্ষমতার লোভের দ্বন্দ্ব অনেক পুরানো। হুজুরপাক (সা:)-এর পূর্বপুরুষদের মধ্যে উর্ধতম পঞ্চম পূর্বপুরুষ ছিলেন আবদে মান্নাফ; তাঁর ছয় পুত্র সন্তানের মধ্যে হাশেম, মুত্তালিব আবদুশ শামস ছিলেন আপন সহোদর ভাই; হাশেমের সন্তানদের হাশেমী এবং মুত্তালিবের সন্তানদের মুত্তালিবী বলে আখ্যায়িত করা হয়; হুজুরপাক (সা:) হাশেমী। জাহেলি ইসলামী উভয় যুগে মুত্তালেবী হাশেমীরা পরস্পর বেশ শক্তভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকতেন। আর আবদুশ শামসের সন্তানেরা আবশামী বলে আখ্যায়িত; তার এক পুত্রের নাম ছিল উমাইয়্যা, আর তার সন্তানরাই উমাইয়্যা বা বনী উমাইয়্যা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। 

 

খাজা হাশেম তাঁর বদান্যতা, জ্ঞান-বুদ্ধি বিচক্ষণতার জন্য কুরাইশদের নেতা হিসেবে বৃত হন, কিন্তু তাঁর ভাতিজা উমাইয়্যা তাঁর নেতৃত্বকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারতো না। ফলে সেই কালেই তাদের মধ্যে এক ধরনের বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে জাহেলী যুগেও হাশেমী উমাইয়্যাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। ইসলামের সূচনা পর্বে দু'এক জন পবিত্রাত্মা ছাড়া বাদবাকি সকল বনী উমাইয়্যারা ইসলাম ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা হুজুরপাক (সা:)-এর বিরোধিতায় তাদের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছিল। বদর যুদ্ধের পর থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত মক্কাবাসীদের সঙ্গে যতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বনী উমাইয়্যা মু'আবিয়া (রা:)-এর পিতা আবু সুফিয়ান ছিলেন তার নেতৃত্বে; মক্কা বিজয়ের সময় ঠেলায় পরে তারা ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হন। যার জন্য তারা হলেন 'তোলাকা'; মক্কা বিজয়ের পর যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলো তাদেরকে বলা হয় 'তোলাকা' বা সাধারণ ক্ষমাপ্রাপ্ত। এই 'তোলাকা'দের জীবন চরিত্র ভালোভাবে লক্ষ্য করলে যতটুকো অনুধাবণ করা যায় তা হলো, তাদের বেশিরভাগই সুবিধাবাদী মুসলিম; দুনিয়ার ক্ষমতার লোভ ভোগের জন্য তারা উন্মত্ত ছিল; তারাই  ইসলামে ভোগবিলাসের প্রথম সূচনাকারী ক্ষমতার লোভ তাদেরকে অন্ধ করে দিয়েছিল; নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য এমন কোন হেন কাজ নেই যা তারা করতেন না। জিন্নূরাইন হযরত উসমান (রা:)- শাহাদাতের পর হাশেমী বংশোদ্ভূত খোলাফায়ে রাশেদ হযরত আলী (রা:)-এর খিলাফতের প্রতি উমাইয়্যাদের ক্ষমতার সেই পূর্বতম লোভ ঘৃণা-বিদ্বেষ পুনরায় জাগ্রত হয়ে উঠে; যা হযরত আলী (রা:)-কে চরমভাবে ব্যতিব্যস্ত রাখে। বহু যড়যন্ত্র আর বহু মুসলিমের রক্তের মাঝ দিয়ে মু'আবিয়া (রা:)  ৪১ হিজরীতে উমাইয়্যা শাসনের ভিত্তি রচনা করেন, যা ১৩৩ হিজরী পর্যন্ত বহাল থাকে, হাশেমী বংশোদ্ভূত আব্বাসী শাসনামল প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত। 


আমীরে মু'আবিয়া (রা:) কিসরা-কায়সারের রাজা-রাজা-বাদশাহ হালতে দীর্ঘ বিশ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন; তার আগে একচ্ছত্রভাবে উনিশ বছর তিনি ছিলেন শ্যামের গভর্নর, তারপর নানা ছলাকলার মাধ্যমে তিনি তার সন্তান ইয়াজিদকে সিংহাসনে আরোহন করিয়ে যান। তার শাসনামলের জুলুম নির্যাতনের ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহ আমরা প্রত্যেকেই কম-বেশি অবগত; বিশ্বের সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষই কমবেশি ইয়াজিদ ইবনে মু'আবিয়াকে চেনে নিকৃষ্ট জীব হিসেবে। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কলিজার টুকরা বেহেশতের যুবকদের সর্দার নিজের জীবন কুরবানী করে শাসকদের শোষণ নির্যাতনের গতি রোধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা আর তিনি করতে পারেননি; কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে শহীদ হয়েছেন। কারবালার সেই হৃদয়বিদারক জুলুম নির্যাতনের পর পবিত্র মদীনা শরিফের চরম অবমাননা- লুটপাটের অবাধ অনুমতি, মসজিদে নববীকে ঘোড়ার আস্তাকুঁড় বানানোর মতো নিকৃষ্ট কাজ, পবিত্র বায়তুল্লাহর অমর্যাদা (উপর পাথর বর্ষণ), এসব জঘন্যতম কাজের ফলে অল্প দিনেই ইয়াজিদের নাপাক অস্তিত্ব থেকে দুনিয়া নিষ্কৃতি পায়। 


সিংহাসনে আরোহনের উত্তরাধিকার নীতি অনুসারে নাপাক ইয়াজিদের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় মু'আবিয়া সিংহাসন লাভ করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন পিতার চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত; অত্যন্ত ভদ্র দ্বীনদার। মাত্র চল্লিশ দিন তিনি সিংহাসনে আসীন থেকে কি এক অযাচিত অন্তর্যাতনায় শাহী দাবী পরিত্যাগ করে নিজে সরে দাঁড়ান। রাজদরবারে সে সময় তিনি এক দীর্ঘ বক্তৃতা করেন; বক্তৃতার শেষাংশ এখানে তুলে ধরলাম-

"আমাদের জন্য সর্বাপেক্ষা কষ্টদায়ক অনুভূতি এই যে, পিতা অশুভ পরিণতির সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খান্দানের লোকদেরকে শহীদ করেছেন। মদীনার পবিত্র হারামে হত্যাকাণ্ড রক্তপাত ঘটিয়েছেন এবং পবিত্র কাবার অমর্যাদা ক্ষতিসাধন করেছেন। আমি খিলাফতের এই গুরুভার বহন করতে অক্ষম। পরামর্শ করে অন্য কাউকে খলিফা নির্বাচিত করে নিন।

মাত্র ২৩ বছরের মধ্যেই মু'আবিয়া (রা:) খান্দান দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, কিন্তু যা ঘটিয়ে গেছেন (যে সব বিদ'আতের সূচনা তিনি করে গেছেন) তা থেকে মুসলিম জাতি কোনদিনও নিষ্কৃতি পাবে না।   


নানান ছলাকলায় পরবর্তীতে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন উমাইয়্যা শাসক মারওয়ান ইবনে হাকাম তার বংশধরেরা। মক্কা বিজয়ের পর হুজুরপাক (সা:) মারওয়ানসহ তার পিতা হাকাম ইবনে আসকে তায়েফে নির্বাসিত করেন; সিদ্দিকে আকবর (রা:) এবং ফারুকে আজম (রা:)- খেলাফতকালেও তারা নির্বাসিত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে অনুমতি নিয়েছেন বলে হযরত ওসমান (রা:) তাদের মদিনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এবং মারওয়ানকে প্রধান সচিব মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন; খলিফার সীলমোহর তার কাছেই থাকতো। হযরত ওসমান (রা:) তাকে জামাতা হিসেবেও গ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় যে, লোকটি ছিল চরম ফিতনাবাজ; তার ফিতনাবাজির জন্যই হযরত ওসমান (রা:)-এর শাহাদাতের ঘটনা সংঘটিত হয়। তার অসংখ্য অপরাধ জানার জন্য রাসায়েলুল আরকান, শারহু বাহরিল উলুম, ফাতাওয়ায়ে আযীযিয়া, লিসানুল মীযান তাহযীব প্রভৃতি গ্রন্থগুলো পড়তে পারেন।


উমাইয়্যা শাসনামলেই ইসলামে সংগীতের শাস্ত্রীয় ধারা ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করে; উমাইয়্যা শাসকরা মুসলিম জাহানের রাজধানী মদিনা থেকে শ্যাম তথা সিরিয়ার দামেস্কে স্থানান্তরিত করে। দামেস্কের রাজদরবার সর্বদা নারী পুরুষ সংগীতজ্ঞ দ্বারা ভরপুর থাকতো। তাদের মধ্যে অধিকাংশ জন্মসূত্রে কিংবা সাংস্কৃতিক অভিযোজনের সূত্রে আরবীয় হলেও তাদের মূল ছিল অনারবীয়। তখন পারস্য, আফ্রিকা, তুরস্ক প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক অনারব ইসলাম গ্রহণ করে। এই সব নওমুসলিমদের কারণে গোত্রীয় আরব সমাজে কিছু সামাজিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। এর সমাধান হিসেবে এসব অনারব নওমুসলিমকে কোনো একটি আরব গোত্র কিংবা কোনো একজন আরব ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় থাকতে হতো। এই নওমুসলিমদের ও অমুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য জিজিয়া নামক কর দিতে হতো এবং তারা সরকার সামরিক বাহিনীতে স্থান পেত না। তৎকালীন  আরব সমাজে শ্রেণীর লোকদের মাওলা, বহুবচনে মাওয়ালি বলা হতো। উমাইয়্যা শাসনামলে সংগীতের চর্চা বিকাশ সাধনে মাওলারাই মূল ভূমিকা পালন করতো। মাওলাদের মধ্যে একশ্রেণীর নারীদের শিল্প, সাহিত্য সংগীতের নানা কলায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ বিনোদনকর্মী হিসেবে প্রস্তুত করা হতো; আরবীয় পরিভাষায় তাদেরকে বলা হতোক্বায়েনা


ইসলামে যতসব বাজে বিদ'আত সংযোজিত হয়েছে তার বেশিরভাগই শুরু হয়েছে উমাইয়্যা শাসনামলে; যেসব আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে প্রভাবিত করছে খুব বেশি। কিন্তু কি অদ্ভুত আশ্চর্যের ব্যাপার, উমাইয়্যা শাসকদের করা 'সব বাজে বিদ'আতকে আমরা সাদরে গ্রহণ করেছি, আর খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক স্বীকৃত, সেসবের দিকে আঙ্গুল তুলছি! মু'আবিয়া (রা:) মারওয়ানের মতো বাজে লোক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাজে বিদ'আত গ্রহণ করেছি; আর খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছি! মু'আবিয়া (রা:) কর্তৃক প্রবর্তিত এক রাক'আত বিতের নামাজ গ্রহন করেছি, ফারুকে আজম হযরত ওমর (রা:)- প্রবর্তিত ২০ রাক'আত তারাবীর নামাজকে  চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছি! আমরা অনুসরণ করছি কাদের, হাঁটছি কোন পথে??


আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা পবিত্র কুর'আনুল কারীমে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে অগ্রবর্তী পূর্ববর্তী, মুহাজির আনসার (রা:)-দের অনুসরণ করতে আদেশ করেছেন, আর আমরা অনুসরণ অনুশীলন করছি তোলাকাদের? কেমনে কি? 'তোলাকাবলতে তাদেরকে বুঝায়, বন্দী হওয়ার পর যাদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, মক্কা বিজয়ের পর হুজুরপাক (সা:) শব্দটি মক্কার কিছু কিছু লোকের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন; যারা ছিল ইসলামের ঘোরবিরোধী, এবং মক্কা বিজয়ের পর অনিচ্ছায় ইসলাম গ্রহণকারী। সেদিন তিনি (সা:) তাদেরকে কৃতদাস হিসেবে বন্দী না করে 'তোলাকা' তথা 'মুক্তিপ্রাপ্ত' বলে আখ্যায়িত করেন। এতে কাথাটি এখানে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তোলাকা হলো সাধারণ ক্ষমায় মুক্তিপ্রাপ্তরা, শব্দ দ্বারা হুজুরপাক (:) ইসলাম বিরোধী দলটির প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি যাদেরকে শাস্তি প্রদান করেননি; দলের শীর্ষে রয়েছেন আবু সুফিয়ান তার দলবল; আমিরে মু'আবিয়া (রা:)- দলভুক্ত। হযরত আলী (রা:)- সিফফীনের যুদ্ধে সকল লোকদের 'তোলাকা' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন; যারা সর্বদা ইসলামের সাথে শত্রুতা করতেন, এবং শেষপর্যন্ত ঠেলায় পড়ে অনিচ্ছায় ঈমান এনেছেন; যাদের বেশিরভাগই ছিলেন উমাইয়্যা। আর কারণেই তাদেরকে খেলাফতের যোগ্য বলে বিবেচনা করা হতো না। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এই, বনী উমাইয়্যারাই অনেকটা সময় ধরে মুসলিম সাম্রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। তাদের এই দীর্ঘ শাসনামলে মুসলমানের, এমন কি মু'মিনেরও ঈমানের বারোটা বাজিয়েছে, অসংখ্য বিদ'আতের সংযোগ ঘটিয়েছে এই উমাইয়্যারাই।   


"ইমাম আহমদ, ইমাম মুসলিম তাঁদের নিজ নিজ গ্রন্থে এবং ইমাম হাকিম তাঁর মুসতাদরাকে আবু আওয়ানা আল ওয়াযযাহ ইবনে আবদুল্লাহ য়াশকুরীর সূত্রে, তিনি আবু হামযা ইমরান ইবনে আবু আতা থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, একবার আমি বালকদের সাথে খেলছিলাম। তখন হটাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে উপস্থিত হলেন। তখন আমি ভাবলাম নিশ্চয় তিনি আমার কাছে এসেছেন। তখন আমি এক দরজার আড়ালে আত্মগোপন করলাম। তিনি আমার কাছে এসে আমাকে একটি বা দু'টি মৃদু ধাক্কা দিলেন। তারপর বললেন, যাও, আমার কথা বলে মু'আবিয়াকে ডেকে আন। উল্লেখ্য যে তিনি ওহী লেখক ছিলেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, তখন আমি  গিয়ে তাকে ডাকলাম। তখন আমাকে বলা হল, সে খাচ্ছে। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বললাম,সে খাচ্ছে। কথা শুনে তিনি বললেন, আবার যাও, তাকে ডেকে আন। আমি দ্বিতীয় বার তাকে ডাকতে আসলাম। এবারও আমাকে বলা হল, সে খাচ্ছে। তখন গিয়ে তাঁকে অবহিত করলাম। তৃতীয়বার তিনি বললেন, আল্লাহ তাকে তৃপ্ত না করুন।

 

রাবী বলেন, এরপর আর কখনও তিনি তৃপ্ত হন নি। মু'আবিয়া (রা:) এই দু'য়া দ্বারা দুনিয়া আখিরাতে উপকৃত হয়েছেন; দুনিয়ার উপকার হলো, তিনি যখন শ্যামের গভর্নর হন, তখন দিনে সাতবার আহার গ্রহণ করতেন, প্রচুর পরিমাণ গোশতপূর্ণ পাত্র পেঁয়াজসহ তার কাছে আনা হত এবং তিনি তা (যথেষ্ট পরিমাণ) খেতেন। দিনের মধ্যে সাতবারই তিনি গোশত সহযোগে খেতেন। এছাড়া প্রচুর পরিমাণ মিষ্টান্ন দ্রব্য এবং ফলমূল খেতে পারতেন এবং বলতেন, আল্লাহর কসম!  (এতে) আমি তৃপ্ত হই না, ক্লান্ত হয়ে পড়ি।"  -[আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইফা) : অষ্টম খণ্ড, ২৩২ পৃষ্ঠা]  


কিতাবুল মানাকিবে ইমাম বুখারী হযরত মু'আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের আলোচনা প্রসঙ্গে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন; তিনি বলেন, আমাদেরকে আল হাসান ইবনে বিশর বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমাদেরকে আল মু'আফী, উসমান ইবনে আসওয়াদ থেকে, তিনি ইবনে মুলাইকা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ইশার পর মু'আবিয়া (রা:) এক রাক'আত বিতর পড়তেন। সময় তাঁর কাছে ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর এক গোলাম কুরাইব ছিল। সে ফিরে এসে ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে বলল, ইশার পর মু'আবিয়া এক রাক'আত বিতর পড়েছেন। তিনি বললেন, তাঁর ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ো না। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর সাহচর্য পেয়েছেন।


শা'বী থেকে মুগীরা বলেন, সর্বপ্রথম যিনি বসে খুৎবা দেন তিনি হলেন হযরত মু'আবিয়া (রা:) যখন তাঁর শরীরে প্রচুর মেদ জমেছিল এবং তাঁর বিশাল ভুঁড়ি নেমেছিল। তদ্রূপ ইবরাহীমের সূত্রে মুগীরা থেকে বর্ণিত আছে যে তিনি বলেন, সর্বপ্রথম বসে খুৎবা দেন হযরত মু'আবিয়া (রা:) আবুল মালীহ্ মায়মুন থেকে বলেন, সর্বপ্রথম মিম্বরে বসার প্রচলন ঘটিয়েছেন হযরত মু'আবিয়া (রা:), আর বসার জন্য তিনি সকলের অনুমতি গ্রহণ করেছেন। সায়ীদ বিন মুসায়্যাব থেকে কাতাদা বলেন, ঈদুল ফিতর ঈদুল আযহার দিন সর্বপ্রথম আযান ইকামাতের প্রচলন ঘটান মু'আবিয়া (রা:)। আবু জা'ফর আল-বাকির বলেন, পবিত্র মক্কার প্রবেশ দ্বারসমূহের কোন অর্গল (তালা) ছিল না। সর্বপ্রথম যিনি মক্কায় অর্গলযুক্ত ফটকের ব্যবস্থা করেন তিনি হলেন হযরত মু'আবিয়া (রা:) আবুল রায়ান শু'আইব থেকে, তিনি যুহরী থেকে বর্ণনা করেন, এভাবেই সুন্নাহ প্রচলিত হয়ে এসেছে যে, কাফির মুসলমানের আর মুসলমান কাফিরের উত্তরাধিকারী হবে না। প্রথম যে ব্যক্তি মুসলমানকে কাফিরের উত্তরাধিকারী বানান তিনি হলেন মু'আবিয়া (রা:) তারপর বনূ উমাইয়্যা সে অনুযায়ী ফয়সালা করেছে। অবশেষে হযরত ওমর বিন আবদুল আজীজ (:) যখন খলীফা হলেন তিনি সুন্নাহ-এর অনুসরণ করলেন। কিন্তু পরবর্তীতে হিশাম ক্ষমতায় এসে মু'আবিয়া (রা:)  তাঁর পরবর্তী বনূ উমাইয়্যার ফয়সালাকৃত সবকিছু ফিরিয়ে দিলেন। 


"মুহাম্মাদ ইবনে কুদামা আল জাওহারী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমাকে আবদুল আযীয ইবনে ইয়াহ্ইয়া তাঁর জনৈক শায়খের বরাত দিয়ে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, উমর ইবনুল খাত্তাব (রা:) যখন শ্যামে আগমন করলেন, তখন এক বিশাল লোকসমাবেশ নিয়ে মু'আবিয়া তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। যখন তিনি উমর (রা:)-এর নিকটে আসলেন তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি কি এই বিশাল জনসমাবেশের ব্যবস্থা করেছো? তিনি বললেন, জ্বি হ্যাঁ, আমীরুল মু'মিনীন। উমর (রা:) বলেন, এই হলো তোমার অবস্থা। তদুপরি আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, প্রয়োজন প্রার্থীদের তোমার সাক্ষাতের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়।


মু'আবিয়া  বলেন, বিষয়ে আপনার কাছে যা পৌঁছেছে তা অসত্য নয়। তিনি বলেন, কেন তুমি এটা কর? আমি তো তোমাকে হিজায পর্যন্ত খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার নির্দেশ দিতে চেয়েছিলাম।......."

"আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (:) কিতাবুয যুহদে বলেন, আমাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনে যি' বর্ণনা করেন, মুসলিম ইবনে জুনদুব থেকে, তিনি উমর (রা:)-এর গোলাম আসলাম থেকে, তিনি বলেন, একবার আমাদের কাছে মু'আবিয়া আসলেন, আর তখন তিনি ছিলেন উজ্জ্বল ফর্সাদেহী তরতাজা শরীরের অধিকারী সুপুরুষ। এরপর তিনি উমর (রা:)-এর সাথে হজ্জে বের হলেন। এসময় হযরত উমর (রা:) তার দিকে তাকিয়ে অবাক হতেন। তারপর মু'আবিয়া (রা:)-এর পিঠে তাঁর হাত রাখতেন, এরপর তাকে বিশেষভাবে জুতার ফিতা থেকে উঠাবোর ন্যায় উঠিয়ে বিস্ময় প্রকাশক ধ্বনি করতেন এবং বলতেন, তাহলে আমরা ভাগ্যবান মানুষ; দুনিয়া-আখিরাত উভয়টির কল্যাণ আমাদের ভাগে জুটেছে। মু'আবিয়া (রা:) বলেন, আমীরুল মু'মিনীন! আমি আপনাকে বিষয়টি খুলে বলছি। আসলে আমরা (আমি) এমন ভূখণ্ডে বাস করি যেখানে ( উর্বর শস্যক্ষেত্র) প্রাচুর্য, (হাম্মামখানা) বিলাসিতা কামনা বাসনার আধিক্য বিদ্যমান। তখন হযরত উমর (রা:) বলেন, আমিই তোমাকে বলছি শোনতুমি তো সর্বোৎকৃষ্ট  খাবার খেয়ে তোমার শরীরকে কোমল কর। আর পূর্বাহ্ন পর্যন্ত আরামে ঘুমাও। এদিকে প্রয়োজনগ্রস্তরা তোমার সাক্ষাতে অপেক্ষমান। তিনি বলেন, আমিরুল মু'মিনীন! আমাকে শিখিয়ে দিন আমি আপনার নির্দেশ পালন করব। 

আসলাম বলেন, আমরা যখন 'যু-তুআ' নামক স্থানে পৌঁছলাম তখন মু'আবিয়া একজোড়া কাপড় বের করে পরিধান করলেন। উমর (রা:) তা থেকে সুগন্ধির ন্যায় সুঘ্রাণ পেয়ে বলেন, তোমাদের কাউকে দেখা যায় সামান্য পাথেয় নিয়ে হজ্জে রওনা হয়েছে। এরপর যখন আল্লাহর সবচেয়ে সম্মানিত শহরে পৌঁছার উপক্রম হয়েছে তখন এমন কাপড়ের জোড়া বের করে পরিধান করেছে যেন তা সুগন্ধিতে ডুবানো ছিল। কথা শুনে মু'আবিয়া বলেন, আমিরুল মু'মিনীনআমার জাতি-গোষ্ঠীর লোকদের সাথে সাক্ষাতের জন্যই আমি তা পরিধান করেছি। আল্লাহর কসম! এখানে এবং শ্যামে আপনার কথার কষ্ট আমার নাগাদ পেয়েছে। আর আল্লাহ জানেন যে, আমি তাতে লজ্জিত। এরপর মু'আবিয়া তার কাপড় জোড়া খুলে ইহরামের কাপড়দ্বয় পরলেন।"

আবু বকর ইবনে আবদু দুন্' বলেন, আমাকে আমার পিতা বর্ণনা করেন, হিশাব ইবনে মুহাম্মাদ থেকে, তিনি আবু আবদুর রহমান আল মাদানী থেকে, তিনি বলেন, উমর (রা:) যখন মু'আবিয়া (রা:)-কে দেখতেন, তখন বলতেন, হল আরবের কিসরা। এভাবেই মাদাইনী উমর (রা:) থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি তা বলেছেন।


মু'য়াবিয়া (রা:)- ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা দেয়ার প্রত্যাশায় হাদীসের কিতাব থেকে উপরোক্ত ঘটনাগুলো সরাসরি তুলে ধরেছি; বিবেক-বিবেচনা, চিন্তা-চেতনা ফয়সালা আপনার। তবে এটা ধ্রুব সত্য যে হযরত মু'আবিয়া (রা:) কাতিবে 'হি ছিলেন; কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন খুবই অল্প সময়ের জন্য। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে তখনযখন কিতাব খুলতেই দেখতে পাই উমাইয়্যাদের রেফারেন্সের হাদিসে ভর্তি কিতাবের পৃষ্ঠা। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর সার্বক্ষণিক সাহচর্যে থাকা খোলাফায়ে রাশেদা চলার সাথী আহলে বায়'আতের বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা নেহায়েত হাতে গোণা! কিছুই কি বোধগম্য হয় না আপনার?  


ধর্মীয় কিতাবগুলোর বঙ্গানুবাদের সে যে কি করুণ হাল, নিজ মতবাদে অটল থেকে মনগড়া অনুবাদ করেছেন তথাকথিত প্রখ্যাত বিখ্যাত নামধারী সব আলেম-ওলামা। ইসলামের ইতিহাস পড়েও এখন আর সঠিক তথ্য উদ্ধার করার কোন জো নেই; যে যার ধারা অনুযায়ী ইতিহাস রচনা করেছেন। পবিত্র কুর'আনুল কারীমের বঙ্গানুবাদের তো যাচ্ছেতাই অবস্থা, তাফসিরে কুর'আন পড়েও বিভ্রান্তির অতলে তলিয়ে যেতে হয়। মুসলমান এখন যাবে কোথায়? ওয়াজ-নসীহতের মঞ্চে যারা ঝড় তোলেন, রাতারাতি ভাইরাল বক্তা বনে যান, তাদের ওয়াজ তো সমাজ ধ্বংসের টনিক; নাচ-গান-নাটকের আসর জমায় তারা। তাছাড়া বর্তমানে যারা (দু'চার জন বাদে) ওয়াজ-মাহফিল করেন, তারা কতটা কি জানেন? লেখাপড়ার পিছনে কতটা সময় ব্যয় করেন তা বুঝে উঠা যায় না। অবশ্য বেশিরভাগের ক্ষেত্রে মনে হয় আদৌ কিছু পড়ে তারা মঞ্চে উঠেন না; যদিও-বা পড়েন তা- নিজের সেই দলীয় কিতাবই। বিবেক-বিবেচনার ধার না ধেরে মুখস্ত কিছু বক্তব্য উগলে দিয়ে মোটা অংকের হাদিয়া হাসিলই যেন বয়ানের মূল উদ্দেশ্য; হেদায়েতের নূর জ্বালানোর কারো মাঝে কোন প্রচেষ্টা নেই। এতো এতো পথভ্রষ্টদের মাঝ দিয়ে এখন আমরা যাবো কার কাছে, কোন দিকে


উপায় কি? নিশ্চিত এলমে লাদুনীর জন্য তপস্যা করুন; ইবাদত আমলে খুশু খুজু আনতে চেষ্টা করুন। ইসলামের সঠিক পথে চলতে, পড়া-জানা-বুঝা  সঠিক আমলের মাধ্যমে এই জ্ঞানের অন্বেষণ ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই; ইহকাল-পরকালে মুক্তির অন্য কোন পথ নেই, প্রত্যাশা নেই। বেশ কড়াকড়ি কিছু কথা লিখে ফেললাম সঠিক পথের দিশা হিসেবে। সত্যিকার সঠিক পথের সন্ধান হয়তো লিখা থেকে ইচ্ছা করলেই আপনি পেয়ে যেতে পারেন; সন্ধান করুন, দেখবেন আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা নিশ্চয়ই আপনাকে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে তুলে নেবেন।। 


মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ 

জুলাই, ২০২৩.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন