ক্লাশে শিক্ষক এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, ”তোমার সামনে এক বাক্সে ‘টাকা’ অন্য বাক্সে ‘জ্ঞান’ রাখা হলো, তুমি কোনটা নেবে?"
ছাত্রের ঝটপট উত্তর: ”টাকা!”
শিক্ষক : ”দুর বোকা! আমি হলে ‘জ্ঞান’ নিতাম।”
ছাত্র : ”যার যেটার অভাব!”
ছাত্র-শিক্ষকের উপরোক্ত আলাপচারিতা থেকে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান – শিক্ষকদের আসলেই জ্ঞানের বড় অভাব; একজন শিক্ষক হিসেবে অবলীলায় আমি তা স্বীকারও করে নিচ্ছি।
ইদানিং গল্পছলে আমার স্ত্রী উপরোক্ত ছাত্র-শিক্ষক কথোপকথন মাঝেমধ্যেই আমাকে শোনান। কেন শোনান তা বেশিরভাগ সময়ই তেমন একটা ভাল বুঝে উঠতে পারি না। তবে এতোটুকো বুঝি – বাস্তব জীবনের জটিল হিসাব-নিকাশ হয়তো আমি ঠিকমত তেমন মিলাতে পারিনি (অনেকে মনে করেন সমাজের সাথে আমি তাল মিলাতে পারি না, আসলে আমি মোটেও তা চাই না)। এসব ব্যাপার নিয়ে কোনদিনই কোন ধরনের আফসোস বা অভিযোগ কোনটাই আমার ছিল না, আজও নেই; বরং মনে হয় অনেকের চেয়ে আমি অধম বেশ ভাল আছি, সুখে শান্তিতে আছি।
ছোটবেলা থেকে এমন সব ব্যাপারগুলো আমার কাছে তেমন একটা বোধগম্য হতো না বা পাত্তা পেতো না, তাই অনেকেই আমাকে বোকা ভাবতো, আজও মনে হয় তাই ভাবে। আমার মতে – কিছুটা বোকা থাকাটা তেমন বড় দোষের কিছু নয়, বরং কখনো কখনো বেশ ভাল মনে হয়। এতে অসুবিধার চেয়ে সুবিধা অনেক বেশি। বোকা ভেবে সবায় চালাকি করে, আর তা দেখে বুঝে ভালই শেখা যায়; সর্বক্ষেত্রে সমস্যাও অনেকটা কমে যায়। অযাচিত ভুল করে বসলেও খুব বেশি একটা খেসারত গুনতে হয় না, বোকা বলে সহজেই ক্ষমা পাওয়া যায়; চালাকরা যা মোটেও পায় না। বরঞ্চ বোকারাই সমাজ সংসারে বেশ সুখে থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।
আজকাল অর্থের মাপকাঠিতে সবকিছুর পরিমাপ করা হয়; বুদ্ধিমান বা বোকার পার্থক্যও নির্ধারিত হয় অর্থ দিয়ে। সেই হিসেবে নিঃসন্দেহে শিক্ষকরা এদেশে সবচেয়ে বড় বোকা! কতইবা তাঁরা বেতন পায়? – অর্থের তুলাদণ্ডে মেপে জ্ঞানের পরিমাপ যাচাই? – এ শুধু বোকামিই নয়, বরং এর চেয়েও অনেক বড় কিছু। প্রকৃতপক্ষে একজন শিক্ষক সব সময়ই নিজ জ্ঞানের স্বল্পতা অনুভব করে থাকেন, এই স্বল্পতা থেকে জন্ম নেয়া প্রচন্ড অভাব আকাঙ্ক্ষা তাঁদেরকে জ্ঞানপিপাসু করে তোলে। একজন প্রকৃত শিক্ষকের জ্ঞানতৃষ্ণা কখনো মিটে না, এ অভাব সবসময় লেগেই থামে।
ইমামে আজম আবু হানিফা (রঃ) অত্যন্ত উঁচু স্তরের উঁচু মানের একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন, এতে তৎকালীন বা বর্তমান সময়েও কারো কোন দ্বিমত বা সন্দেহের অবকাশ নেই। সর্বকালের সর্বযুগের পৃথিবীশ্রেষ্ট একশ মনিষীর মাঝে তিনি একজন। সর্ব গুণে-জ্ঞানে গুণান্বিত এই মহান শিক্ষক একবার ক্লাশে এক ছাত্রের প্রশ্নের উত্তর তৎক্ষণাৎ দিতে পারেননি। ছাত্রের প্রশ্ন ছিল – কি করে বুঝা যাবে কুকুর কখন বালেগ হয়? ইমাম সাহেব এর সঠিক উত্তর জানতেন না। তাই বিমর্ষ বদনে গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকেন, বাড়ি ফিরেও ভাবনার জগতে সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুজতে থাকেন; নিজ কন্যার চোখ তা এড়ায়নি। বাবাকে বিমর্ষ বদনে ভাবতে দেখে জিজ্ঞেস করতেই ছাত্রের প্রশ্নটি জানতে পারেন। প্রশ্নটি শুনেই মেয়ে খুব সহজভাবে বাবাকে বলেন, ”পাশে যে মুচি আছেন তিনি অনেকগুলো কুকুর পালেন, তাকে জিজ্ঞাস করলেই এর সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে, এটা নিয়ে অতো চিন্তার কিছু নেই।"
বিকেলবেলা ইমাম সাহেব হাটতে হাটতে সেই মুচির বাড়ি গেলেন। তাঁকে দেখে মুচি তো অবাক! দেশের স্বনামধন্য শিক্ষক তার মতো একজন ক্ষুদে মুচির বাড়িতে ছুটে এসেছেন, ব্যাপার কি? বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করতেই মুচি প্রশ্নটি জানতে পারে এবং মুচকি হেসে অত্যন্ত সহজ ও সাবলীলভাবে জবাব দেয় – ”একটি কুকুর যখন পা তুলে পস্রাব করে তখনই বুঝা যায় ওটা বালেগ হয়েছে।"
কথিত আছে ইমামে আজম সেই মুচিকেও শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর হৃদয়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন। তাঁর মহান জীবনী থেকে জানা যায় চার হাজারেরও অধিক শিক্ষক থেকে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। শিক্ষকদের তিনি এতোটাই শ্রদ্ধা সম্মান করতেন যে – বেয়াদবির ভয়ে এক সময় কোথাও তিনি পা ছড়িয়ে বসতেন না, সবসময় পা জড়সড় করে গুটিয়ে রাখতেন। কারন – তাঁর বাড়ির পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ সবদিকেই শিক্ষকদের বসবাস ছিল; যদি কখনো পা কোন শিক্ষকমুখী হয়ে যায়!
ইমামে আজম একদিন রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। এমন সময় আটদশ বছরের ছোট্ট একটি বাচ্চা হাতে দুধের বাটি নিয়ে বিপরীত দিক থেকে দৌঁড়ে আসছিল। ইমামে আজম বাচ্চাটিকে দেখে বলেন, "বাবা! আস্তে দৌঁড়াও, হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে ক্ষতি হবে।”
বাচ্চাটি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো, ”হুজুর! আপনি আস্তে চলেন।”
ইমাম সাহেব বাচ্চাটির কথায় স্তম্ভিত হয়ে যান। ভাবেন ছোট্ট বাচ্চার আঁতে হয়তো আঘাত লেগেছে, সে হয়তো ইমাম সাহেবের কথা বুঝতে ভুল করেছে। তাই তিনি পুনরায় বললেন, ”বাবা! আমি বয়োবৃদ্ধ মুরুব্বি মানুষ, তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য কিছু বলিনি। তুমি হোঁচট খেয়ে পরে গেলে হয়তো দুধের বাটি পরে যাবে, ক্ষতি হবে; তাই আস্তে চলতে বলেছি।"
ইমাম সাহেবের কথাগুলো শুনে বাচ্চাটি বলে উঠে, ”হুজুর! আমি আপনাকে আস্তে চলতে বলছি কারণ, আমি হোঁচট খেলে হয়তো অল্প কিছু দুধ পরে যাবে, অল্প ক্ষতি হবে, এতে কারো কিছু আসবে যাবে না; কিন্তু আপনি হোঁচট খেলে অর্থাৎ আপনার কলম হোঁচট খেলে, সারা মুসলিম জাহান হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পরবে; বিশাল ক্ষতি হবে। তাই আমি আপনাকে আস্তে চলতে বলেছি।”
সেই ছোট্ট বাচ্চাটির সেইদিনের সেই কথাগুলো ইমামে আজম আবু হানিফা (রঃ) এর পরবর্তী জীবনের পাথেয় ছিল।
মহানবী (সাঃ) বলেছেন – ”দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত তোমরা জ্ঞানান্বেষণ কর।" দশজন অশিক্ষিত অজ্ঞানীর চাইতেও একজন শিক্ষিত জ্ঞানী উত্তম বলে তিনি স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। শিক্ষা ও জ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়বস্তু নিয়ে পবিত্র কালাম পাক ও সহি হাদিস গ্রন্থগুলোতে ব্যাপক আলোকপাত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানান্বেষণ একটি অত্যন্ত ব্যাপক ও বিশাল জিনিস। এর কোন স্থান কাল পাত্র নেই, নেই কোন সীমাবদ্ধতা। জীবনের প্রতিটি ক্ষণে প্রতিটি স্তরে সবার কাছ থেকেই শিক্ষা নেয়া যায়। এই মৌলিক বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার বা দেখার মত কোন সুযোগ কারোই নেই। জ্ঞান অন্বেষণকে প্রতিটি ধর্মগ্রন্থই অগ্রাধিকার দিয়েছে। ধর্ম অবিশ্বাসীরাও কখনো জ্ঞানের ব্যাপারে কোনরুপ দ্বিমত পোষণ করেনি বা বিরোধীতা করে না। যুগে যুগে জ্ঞানান্বেষণ ও জ্ঞানার্জনকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে পৃথিবীর সভ্য অসভ্য সর্বশ্রেণীর মানুষজন।
জ্ঞানের প্রদীপ্ত শিখা চীর প্রজ্বলিত, এ শিখা চির অম্লান অমলিন। এই স্বচ্ছ স্পষ্ট বিষয়টি এদেশে আজকাল সবার কাছে কেমন যেন গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কেউই এখন আর তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না, জ্ঞানের চর্চাও কেউ করতে চায় না। জ্ঞানার্জন জ্ঞানচর্চা যেন খুবই ফালতু একটা বিষয়, সময়ের অপচয়। অর্থই যেন বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে কাঙ্খিত একমাত্র বস্তু। বিশেষ করে আমাদের পরিবর্তিত সামাজিক ব্যবস্থা এতোটাই উঁচ্চবিলাসী হয়েছে যেখানে সব কিছুই অর্থের পরিমাপে বিবেচনা করা হয়। এই অশুভ নেক্কারজনক প্রবণতা দিনদিন বেড়েই চলছে। বিশ্বায়নের সুফলের চাইতে কুফল বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে বেশি প্রভাবিত করছে; দিনদিন পাল্টে যাচ্ছে আমাদের স্বভাবচরিত্রও। আমূল পরিবর্তন ঘটছে সামাজিক অবকাঠামো ও পারিবারিক বন্ধনগুলোর। সমাজবিজ্ঞানীরা এসব নিয়ে কিছু ভাবেন বলে মনে হয় না। নিশ্চয় এ দায় তাঁরা কিছুতেই এড়াতে পারবেন না?
কৈশোরে খুব গাছ বাইতে পারতাম। আমাদের বাড়ির সবচেয়ে বড় নারকেল গাছটিতে কেউই উঠতে সাহস করতো না; একেতো বিশাল তার উপর বাড়ির ছোটবড় প্রায় সবার ধারনা ছিল ঐ গাছে ভূত বসবাস করে! তাই ঐ গাছের নারকেল কখনো পারা হতো না, এমনিতে যদি নিচে পরতো তা নিয়ে সবার মাঝে কাড়াকাড়ি লেগে যেত; কারন ঐ গাছের নারকেল খুব মিষ্টি ছিল। সেই বয়সেও কেন জানি ভুতের ব্যাপারটা আমার কাছে মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো না। তাই অনায়াসে আমি সেই বিশাল ভূতের গাছে উঠে বসে তৃপ্তি সহকারে নারকেল খেতাম আর দুনিয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করতাম। সত্য হলো – তখন কখনো আমি আসল ভুতের সাক্ষাত পাইনি।
আমাদের কবরস্থানের টেকে বেশকিছু তালগাছ ছিল। সবাই বলতো – ঐগুলো ভুতের বাড়িঘর, ভুতেরা তালগাছের আগডালে বসবাস করে। তাই ঐ সব গাছের আশপাশ দিয়েও কেউ হাটতো না। গাছে তাল পেকে নিচে ঝরে পরলেও তা কুড়িয়ে আনার লোকের অভাব ছিল। ভরদুপুর বা ভরসন্ধায় অনেকেই ঐ গাছগুলো থেকে বাঁশির সুর বাতাসে ভেসে আসতে শুনতো। আওয়াজ শুনে সবারই ধারনা হতো – প্রেমিক ভুত মনের আনন্দে সুর তুলেছে, কেউ পাশদিয়ে গেলেই তাকে খপ করে ধরবে, ঘাড় মটকাবে!
আগাগোড়াই আমি খুব কৌতুহলী একজন মানুষ, সেই বয়সে কৌতুহল আরো একটু বেশিই ছিল। একবার আষাঢ়ি (কঁচি তাল) খাওয়ার খুব ইচ্চা হওয়াতে বাড়ির মুরুব্বিদের নিষেধ উপেক্ষা করে চুপিচুপি আমরা ক’জন মিলে লম্বা বরাকবাঁশ জোগাড় করে তা এক তালগাছে লাগালাম, গাছে উঠার দায়িত্ব আমার কাঁধেই বর্তালো। ইতিপূর্বে বাঁশ বেয়ে অন্য তালগাছে অনেকবার উঠেছি, সব ধরনের গাছে উঠারই বেশ ভাল অভিজ্ঞতা আমার ছিল। কিন্তু ঐ দিন ঐ গাছে উঠতে বুকটা কেমন যেন টিপটিপ করছিল, তা সত্ত্বেও উঠে পড়লাম। তালগাছের ডাগগা বেশ পাস, ওখানে বসে থাকতে বেশ মজা লাগে; শুধু করাতের মত ধারগুলো কেঁটে একটু ভোঁতা করে নিলেই হয়। গাছে উঠতেই হটাৎ বুকটা মোচর দিয়ে উঠলো! হালকা মধুর এক ধরনের বাঁশির মিষ্টি সুর কানে ভেসে আসতে লাগলো, নিচে থাকতে যা মোটেও শুনিনি। তবে কি ভুত আমার ঘাড় মটকাতে আসছে?
দপাদপ কয়েকটা আষাঢ়ির বাঁদা নিচে ফেলে দিয়ে তালগাছের মগডালে বসে শব্দের দিকে মনোযোগ দিলাম। মনে হলো শব্দটা যে করছে সে বেশি দুরে নয়। কেন যেন হটাৎ আমার মনে হলো এই শব্দ কোন ভূতটুতের না। আস্তে আস্তে ডাগগা টপকাতে টপকাতে গভীরভাবে লক্ষ্য করতে থাকলাম – শব্দটা কোথা থেকে আসছে? কিছুক্ষণের মাধ্যেই উৎস আবিষ্কার করতে সক্ষম হলাম; কঁচি তালপাতা ও বাতাস মিলে প্রেমের এই মধুর সুর তুলেছে। বাতাস এসে তালের কঁচি পাতায় আঘাত করছে, কঁচিপাতার কম্পন সুর শলাকায় রুপ নিচ্ছে। এই হলো তালগাছের ভূত!
ছোটকালে শুনতাম হিজল গাছে ‘পেত্নী’ থাকে। ‘পেত্নী’ দেখার জন্য প্রায়ই ভরদুপুর বা তিনসন্ধ্যায় খাল পাড়ের হিজল গাছগুলো চষে বেড়াতাম; কিন্তু কোনদিনও পেত্নীর সাক্ষাত পাইনি। বাস্তবে ভুতপেত বলতে কিছু আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে, গল্পের ভুত যে মানুষের ঘাড় মটকিয়েছে এমন অনেক ভুতপেতের সাক্ষাত গল্প উপন্যাসে পড়েছি। ইদানিং বুঝতেছি – তালগাছের সেই ভূত হিজল গাছের সেই পেত্নী সত্যি বাস্তবে আবির্ভূত হয়েছে। যে ভুতপেত আমাদের দেশ ও জাতির প্রতিটি মানুষের কাঁধে চেপে বসেছে, কখন যে কার ঘাড় মটকিয়ে দেয় তা বলা মুশকিল। বনের বাঘের কবলে পরলে হয়তো ভাগ্যজোড়ে প্রাণ বাঁচলে বাঁচতেও পারে, কিন্তু মনের বাঘে ধরলে প্রাণ বাঁচানো বড়ই কঠিন।
সরকার বাহাদুর এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভুতপেতের মত যে সব তামাসা করছেন তা নিয়ে শংকিত না হয়ে পারছি না। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের বাস্তব ভূতপেত্নীরা যে ভাবে প্রতিনিয়ত সুর তুলছে তা শুনে পুরো দেশবাসী এক ভ্রান্তবিলাসে মেতে উঠেছে। এর মূলে অবশ্য কাজ করছে আমাদের অশিক্ষা কুশিক্ষা ও অজ্ঞতা। পরিপূর্ণ পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ‘উঠ ছেরি তোর বিয়া!' স্টাইলে বর্তমান সরকার তড়িগড়ি ১০০% শিক্ষিত জাতি গঠনের এক উঁচ্চবিলাসী মহা পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছে, মেতে উঠেছে এক মহাযজ্ঞে; যা দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ অশনিসংকেত ভিন্ন অন্য কিছু নয়। যেনতেন ভাবে পাশ করিয়ে শুধুমাত্র সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেয়ার মাঝ দিয়ে জাতীয় বা ব্যক্তিগতভাবে এদেশের কেউ লাভবান হবে কিনা তা আমার মোটেও বোধগম্য হচ্ছে না।
বরং এতে বর্তমান প্রজন্মও অনেকটা জটিলতার মধ্যে পরে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। রেজাল্ট দেখে পড়া নাপড়া বা মেধাবী মেধাহীনের পার্থক্য মোটেও করা যায় না। না পড়েও কি করে এতো ভাল ফলাফল করেছে সেই ঘোর অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। পর্যায়ক্রমিক এই ধরনের পরীক্ষা বিপর্যয়ের শিকার হয়ে এদেশের বর্তমান ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক উভয়েই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জ্ঞান বিবর্জিত সার্টিফিকেটধারী এ সমাজে যতই বাড়ুক না কেন, এতে কারো কোন লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না; জাতির লাভের তো প্রশ্নই উঠে না। বিবেকের দহনে দগ্ধ হয়ে আজকের ভাল ফলাফল করা ছেলেমেয়েদেরও দেখা যাচ্ছে হতাশার অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ হলে আমরা সবায় ত্রাণ নিয়ে দূর্গত এলাকায় যাই, এ দেশের ছাত্রছাত্রীদের এই মহা বিপর্যয়ে আমাদের কি করা উচিৎ? শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অজ্ঞাত ভূতপেত গুলোকেই বা কি করে তাড়ানো যায়? – নয়তো এ জাতির ঘাড় মেরুদণ্ড একদিন তারা ঠিকই ভেঙে দেবে।
মৌলিক শিক্ষা বিষয়ক বিষয়বস্তু নিয়ে প্রতিনিয়ত অনেক লেখালেখিই হয় হচ্ছে, প্রকাশিতও হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে এই সবের প্রতি সাধারণ মানুষজনের আগ্রহ একেবারে নেই বললেই চলে। বাহ্যিক চাকচিক্যে ভরপুর চটুল বিষয় সাধারণের কাছে যতটা আকর্ষিত হয় ব্যাপকতা পায়, মৌলিক বিষয়বস্তু সম্পর্কিত লেখাগুলো ততোটাই অবহেলিত হয়। মৌলিক লেখা অবহেলিত হওয়ার পিছনে যুক্তিযুক্ত অনেক কারণও আছে। প্রথমত এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার যা তা অবস্থা। সরকারের কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত সবখানেই এক জটিল পরিস্থিতি। তোষামোদি তেলামী দিয়ে আর যাই হউক শিক্ষায় উন্নতি হয় না।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ঠ মানুষজন প্রত্যেকে যেন এক একটা উদ্ভট প্রাণী হয়ে গেছে! বোধ-বুদ্ধি-বিবেচনা কিছুই যেন তাদের নেই। হবেইনা বা কেন? যে দেশে স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী অবলিলায় মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে, সত্যবাদী স্পষ্টবাদীকে হুমকি ধমকি দিয়ে মুখ বদ্ধ করাতে চায়; সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তো মুখ থুবড়ে পরবেই! যে দেশের শিক্ষা মন্ত্রনালয় ১০০% পাশ ছাত্রছাত্রী দেখার চিন্তায় বিভোর হয়ে তৃপ্তির ডেকুর তুলতে চায়; সে দেশে এমন তো হবেই! বেতনের জন্য যে দেশের শিক্ষকদের আন্দোলনে যেতে হয়; সেদেশে এমন শিক্ষিত তো প্রতিনিয়ত জন্ম নিতেই থাকবে! জ্ঞানীর চাইতে অজ্ঞানীর দাম্ভিকতা প্রকোপ রুপ ধারণ করবেই! নয়তো অমর বাণী যে মিথ্যা হয়ে যাবে! – ”তোমরা যখন সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ থেকে বিরত থাকবে, তখন মুর্খরা তোমাদের ঘাড়ে চেপে বসবে।” – এরাই প্রকৃত সত্যভূত!
লেখাটি যখন লেখছি তখন এদেশের সুন্নি আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী আততায়ীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। সংবাদটি শোনা মাত্রই চমকে উঠলাম। এদেশের তথাকথিত আলেম সমাজ এ কোন নিঃসংশ নিষ্টুর খেলায় মেতেছে? মত ও পথের অমিল হলেই একজনকে এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে? এই নিঃসংশ হত্যাকান্ডের গৃণা জানানোর ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি। এদেশের ইসলামের বর্তমান এই নাজুক পরিস্থিতিতে শত ভ্রান্ত মতবাদের ভিড়ে প্রকৃত সত্য সন্ধানী উপস্থাপক হিসেবে ইতোমধ্যে মাওলানা ফারুকী বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। ভ্রান্তমতবালম্বীরা কখনো সত্যের মুখামুখি হতে চায় না, সত্যকে তারা ভয় পায়। তাই রাতের অন্ধকারে সত্যিকার ফারুকীদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়।
ন্যায়ের ধর্ম সত্যের ধর্ম ইসলাম কখনো কোন মানুষ হত্যাকে সমর্থন করে না; হউক সে ভিন জাতি বা ধর্মের। যারা নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য এই সব নিষ্টুর নিকৃষ্ট কাজগুলো করছে, তারা কখনো মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লামের উম্মত হতে পারে না। "হে মহান রাব্বুল আ’লামিন! তুমি বেবুঝদের বুঝ দান করো। মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে উত্তম প্রতিদান দান করো।”
মুহাম্মদ ওয়ালিউল্যাহ
২৬ আগস্ট, ২০১৪.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন